Monday, February 15, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২৫)

সুখের ঘরে আগুন (২৫)

    অচলা সেই সোফার উপরেই বসে থাকল।নিলয় পাউরুটি আর সেদ্ধ ডিম খেয়ে অফিসে বেরিয়ে গেল।যাওয়ার সময় অচলা কে পুনরায় বলে গেল,
---  অফিস ছুটির পর আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। রান্নাবান্না করে তো খেতে হবে।তাই একটু দেরী হবে আমার আসতে।আবারও বলছি আপনি কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কেউ ডাকলে দরজা খুলবেন না বা জানালা দিয়ে উকি মারবেন না।ওরা কিন্তু সন্দেহ করছে আপনি এই চত্বরেই কোথাও আছেন।
  নিলয় বেরিয়ে গেল।কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে বাস রাস্তা পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল কাল এখানে এসে মাকে একটা ফোন করে জানিয়েছিলাম।তারপরে আর নানান উটকো  ঝামেলায় মাকে ফোন করার কথা মনেই নেই। ভেবেছিলাম রাতে অম্বিকাকে একটা ফোন করবো।তাও মাথা থেকে উবে গেছে। বিছানায় শুয়েই গতকাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।অম্বিকা তো ফোন করতে পারবেনা।তার কাছে তো নিলয়ের ফোন নম্বরটাই নেই।সুতরাং সে ফোন না করা পর্যন্ত অম্বিকার ইচ্ছে হলেও সে নিলয়ের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারবে না।আজ ফিরে অম্বিকাকে একটা ফোন করতেই হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সে বাস রাস্তা চলে এলো।আসবার সময় চায়ের দোকানটায় তাকিয়ে দেখল সকালের সেই লোকটা না থাকলেও কয়েকটা লোক সেখানে বসে তখনও আড্ডা দিয়ে চলেছে।এদের মধ্যেই হয়তো ওদের গ্যাংয়ের কোন লোক বসে আছে। কি সমস্যায় যে পড়া গেল! মেয়েটাকে নিয়ে এখন যে সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।মায়ের সাথে আলোচনা করবে?নাকি বাবাকে সব বলবে?আচ্ছা অম্বিকাকে বললে কেমন হয়? নাহ এর কোনটাই ঠিক হবে না।যা করার নিজেকেই করতে হবে।এ নিয়ে কারও সাথে আলোচনা করতে গেলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।মাকে বললে মা আকাশ-পাতাল চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবে সাথে বাবা কেউ ছাড়বেন না। অম্বিকাকে বললে সে  কিভাবে ব্যাপারটাকে নেবে তাও বলা যাচ্ছে না।সুতরাং কারো সাথে কোন বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। নিজেকেই সমাধান বের করতে হবে।
  নূতন অফিস।সকলেই নূতন।প্রথমদিন সকলে এমনভাবে তার দিকে তাঁকিয়ে দেখছে যেন সে চিড়িয়াখানার কোন জীবজন্তু হবে। যেচে পড়ে অনেকের সাথেই আলাপ করেছে সে। তাদের মধ্যে নিখিলেশ বলে একটি ছেলে যে তার সমবয়সী হবে তার সাথে প্রথম দিনেই খুব ভাব হয়ে যায়। নিলয়, নিখিলেশের কাছ থেকে বাজারঘাট সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে নেয়। নিখিলেশ তার সাথে বাজারে যেতে চাইলেও নিলয় আপত্তি জানায়।তাকে বলে,
---  অনেক দরকারি কাজে হয়তো তোমাকে আমার প্রয়োজন হবে। তাই এই বাজারঘাটটা আমি নিজেই করে নিতে  পারবো।
আসলে নিলয়ের মনে ছিল যে সে অচলার জন্য কিছু জামা কাপড় কিনবে।কিন্তু নিখিলেশ সাথে থাকলে এটা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। তাই কোনোরকমে নিখিলেশকে তার সাথে যাওয়া থেকে বিরত করে।দুই হাত ভর্তি করে নিলয় একবারে রাতের খাবার কিনে নিয়ে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকে দেখে ঘর অন্ধকার । ঘরে ঢুকে সে লাইট জ্বালায়।দেখে অচলা সোফার উপরে অন্ধকারেই শুয়ে আছে।নিলয়কে দেখে সে উঠে বসে।পরনে তার নিলয়ের সকালে কিনে দেওয়া সাধারন একটা নাইটি। অচলা উঠে গিয়ে নিলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
---  আপনাকে ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছি।আমি এখান থেকে চলে যাই।আমার যা কপালে আছে তাই হবে। কিন্তু আমি এখানে থাকলে আমাকে নিয়ে আপনার যেমন একটা চিন্তা থাকবে আবার আপনার বদনাম হবে।
---- আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।আমি এতটা অমানুষ নই যে আপনাকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেবো। আপনার যাওয়ার যদি কোন জায়গা থাকতো আমি সেখানে আপনাকে পৌঁছে দিতাম।কিন্তু সে উপায়ও নেই।আপাতত আপনি কিছুদিন আমার এখানে থাকুন।তারপর দেখছি কি করা যায়।আপনি এক কাজ করুন,এই জিনিসগুলো নিয়ে রান্নাঘরে রাখুন।এর ভিতর থালা, গ্লাস, বাটি, চাল,ডাল সব আছে।রাতের খাবারটাও নিয়ে এসেছি।আচ্ছা আপনি চা করতে পারেন?একটু চা করবেন?সব আছে ব্যাগের মধ্যে।খুব টায়ার্ড লাগছে।
অচলা ব্যাগগুলি নিয়ে একটা একটা করে সব রান্না ঘরে নিয়ে গেল।দুপুরের দিকে সে রান্নাঘরটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রেখেছিল।এখন অভিজ্ঞ হাতে জিনিসগুলোকে রান্নাঘরে গুছিয়ে স্টোভ এ দু'কাপ চা করে দুটো বিস্কুট নিয়ে আসে।তার আগেই নিলয় হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। চা টা মুখে দিয়ে অচলার দিকে তাঁকিয়ে বলে,
--- বাহ চমৎকার!আপনিতো খুব সুন্দর চা করেন। তার মানে আপনি রান্নাও করতে জানেন।ও হ্যাঁ আপনি বলেছিলেন বটে মামাবাড়িতে আপনি রান্না করতেন।এখানে কাল থেকে আপনি চুপচাপ বসে না থেকে এই রান্নাটাই করবেন। আপনার ও সময় কেটে যাবে আর আপনিও নিশ্চিন্ত মনে এখানে থাকতে পারবেন।এই মুহূর্তে আমি তো কোন কাজের লোক রাখতেও পারবোনা।বাইরের লোক আসলেই আপনাকে দেখে ফেলবে।আপনি কিন্তু ভাববেন না যে আপনাকে কাজ করার জন্য এখানে আমি থাকতে বলছি। আপনার বিপদের আঁচ পেয়েই আপনাকে এখানে থাকতে বলছি।আমি আপনাকে জোর করবো না।যদি আপনি মনে করেন এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও থাকতে পারবেন তাহলে আপনি আমায় বলুন কোথায় যাবেন আমি নিজে গিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।কিন্তু আপনাকে একা একা আমি বাইরে কিছুতেই ছাড়বো না। জেনেশুনে আপনাকে আমি বিপদের মধ্যে ফেলে দিতে পারবো না। এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি করবেন?
--- আপনি যে আমার জন্য এতটা ভেবেছেন তাতেই আমি খুশি।আমি বাঁচতে চাই তাই আপনার কথা শুনে এখানেই আমি থাকবো।কিন্তু একটা সম্পর্ক তো গড়তে হবে আপনার আর আমার মধ্যে।তা না হলে কি পরিচয়ে আপনার কাছে থাকবো?আর কি নামেই বা আপনাকে ডাকবো?
নিলয়ের বুকটা তখন দুকদুক করছে।এইরে!কি পরিচয় চাইছে এখন অচলা?
--- সম্পর্কটা আমিই গড়ি তবে-- কি বলো দাদা?
আগের কথাটা শুনে নিলয়ের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।কিভাবে নিঃশ্বাস নিতে হয় আর ছাড়তে হয় সে যেন সেটাই ভুলে গেছিল।কিন্তু অচলার পরের কথাটা শুনে সে  হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।আর মনেমনে ভাবল, না মেয়েটা মোটেই খারাপ নয়।তার সম্পর্কে সে যেটুকু বলেছে এখন মনে হচ্ছে পুরোটাই সত্যি।থাক না এখানেই সে।একটা অসহায় মেয়ে! কেউ নেই কোথাও,কি আর এমন বিপদ হবে? যদি সেরকম কিছু হয় আইন তো আছে আর আইনের কাছে গেলে অন্তত ওই গ্যাংয়ের সন্ধানটা পাওয়া যাবে।
এভাবে দুই সপ্তাহ কেটে গেল।অচলা ঘরের ভিতরেই থাকে। ও নিজেই রান্নাবান্না করে।নিলয় অফিস যাওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে যায় এসে তালা খোলে।ছোট থেকেই অচলা মামাবাড়িতে সংসারের যাবতীয় কাজ করার ফলে নিলয়ের এখানে এসে সে খুব সুন্দর ভাবে নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে।কিন্তু সমস্যা দেখা দিল দু সপ্তাহ পর যখন নিলয়ের নাইট ডিউটি শুরু হলো। নিলয় কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না রাতের বেলা কিভাবে ওকে একা রেখে সে অফিস যাবে।কিন্তু অচলা।বহুবার বলেছে তার কোন অসুবিধা হবে না।সে একাই থাকতে পারবে।সারাদিন যেভাবে থাকে রাতেও সেই একইভাবে থাকবে তার ভয় করবে না।কিন্তু নিলয় রাতের বেলা অচলাকে রেখে কিছুতেই ডিউটিতে যেতে সাহস পাচ্ছে না।অথচ অন্য কোন পথও খুঁজে পাচ্ছে না।সুতরাং তাকে এভাবেই অচলাকে তালাবন্ধ করে ডিউটিতে যেতে হবে।
  নিলয় সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।সে বাইরে থেকে তালা দিয়েই বেরিয়ে যায়।অচলা সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সমস্ত লাইক অফ করে দেয়।রাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রান্নাঘরে বসে চুপিসারে ডিনারটা করে ফেলে।ঘরে আলো জ্বালালে বাইরে থেকে লোকে বুঝতে পারবে ভিতরে লোক রয়েছে তাই সে অন্ধকারের ভিতর এঘর-ওঘর করে আর তার টুকটাক কাজগুলো করে করতে থাকে ওই মোমবাতির আলো়তেই।কিন্তু তা সত্ত্বেও রাত দশটা নাগাদ সে প্রথমে শুনতে পায় দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ,তারপর বেলের আওয়াজ।এর পরেও যখন ভিতর থেকে কোন সাড়া তারা পায়না তখন "ভিতরে কেউ আছেন?"বলে কয়েকবার চিৎকার।অন্ধকার ঘরের ভিতর অচলা জড়োসড়ো হয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে অঝোর ধারায় সারারাত কেঁদে চলেছে। সকাল আটটা নাগাদ নিলয় ফিরে এসে তালা খুলে যখন ঘরে ঢোকে অচলা দৌড়ে এসে নিলয়কে  জড়িয়ে ধরে ভীষণভাবে কাঁদতে থাকে।প্রথম অবস্থায় নিলয় থতমত খেয়ে যায়।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
---  চিন্তা কিসের?দাদা তো রয়েছে।কিচ্ছু হবে না তোর।তুই এখানেই থাকবি।তোর সব দায়িত্ব আমার।কাল রাতে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কি হয়েছে সেটা আমাকে বল।
অচলা কাঁদতে কাঁদতে গতরাতের।সমস্ত ঘটনা জানায় নিলয়কে।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment