বাঁধন হোক শক্ত
রাহুল আর শ্রীতমা একই কলেজে পড়তো।যদিও তারা ক্লাসমেট নয়;রাহুল দু'বছরের সিনিয়র ছিল।দুজনের মনের মধ্যেই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল।কিন্তু কেউ কোনদিন কাউকে মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারেনি।কখনো অফ পিরিওড অথবা টিফিন পিরিয়ডে দুজনে একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছে।গল্পগুজব,ক্যান্টিনে খাওয়া, কলেজের বিশাল মাঠে বসে গল্প করা সবই চলতো।কিন্তু ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা কোনটাই কেউ কোনদিন মুখে প্রকাশ করতে পারেনি।
ধনী পরিবারের সন্তান রাহুল পাস করার পর তার বাবা উচ্চশিক্ষার্থে তাকে বাইরে পাঠিয়ে দেন।তখনো শ্রীতমার কলেজ শেষ হয়নি।একদিন কলেজ ছুটি শেষে শ্রীতমা কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখে রাহুল দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে।তাকে দেখে শ্রীতমা ভীষণ খুশি হয়।হাসতে হাসতে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
--- কিরে এতদিন পরে মনে পরলো বুঝি আমার কথা?একটা ফোনও তো করতে পারতিস--।
---সে তো তুইও আমাকে করতে পারতিস।করিস নি তো! তাহলে আমিই বা কেন উপযাচক হয়ে তোকে ফোন করতে যাবো? দায় টা কি আমার একার?
--- না আমার সব দায়--।এখন বল কি বলতে এসেছিস ?
--- অনেক কিছু বলবো বলেই তো এসেছিলাম।কিন্তু তুই তো আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলি।এখন কোথা থেকে শুরু করবো সেটাই ভাবছি।
--- আমারও তো তোকে কিছু বলার ছিল।তবে তুই যখন আগে বলতে চেয়েছিস তখন বলে নে।আমি না হয় ফোন করে তোকে বলবো।
রাহুল বার করে আশে পাশে তাকালো,কয়েকবার দুপুরের কাঠফাটা রোদে আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল, সর্বশেষে শ্রীতমা দিকে তাকিয়ে বলল,
--- আগামী পরশু আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি।তিন বছর পরে ফিরে আসবো।তুই কি এই তিনটে বছর আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবি?
রাহুলের স্পষ্ট কথা বলার ধরনে শ্রীতমা ফিক করে হেসে দিলো।কিন্তু রাহুলের কথা শুনে তার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছিল।সে সরাসরি রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
--- তোকে পাওয়ার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
সেদিন রাতেই রাহুল শ্রীতমাকে ফোন করল।তার কাছে জানতে চাইলো,
---তুই যেন কি আমাকে ফোন করে বলবি বলেছিলি?
-- আমি যা বলবো ভেবেছিলাম তা তুই বলে দিয়েছিস।তাই নতুন করে আর কিছু আমার বলার নেই।শুধু অপেক্ষার পালা।
রাহুল চলে গেল উচ্চশিক্ষার্থে অস্ট্রেলিয়া।মাঝেমধ্যে রাহুলের সাথে ফোনে কথা হয় শ্রীতমার। দেখতে দেখতে দিনগুলি কেটে যেতে থাকে।দুজনেই মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে।কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার পর শ্রীতমারা সবাই মিলে ঠিক করে তারা কোথাও একটা জায়গায় ঘুরতে যাবে।সেইমতো সবাই বেরিয়ে পড়ে।একটা বাস ভাড়া করে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেও যায়।সেখানে পৌঁছে শ্রীতমা দেখতে পায় সকলেই তাকে লুকিয়ে কিছু একটা আলোচনা করে চলেছে।কিন্তু কী সেই আলোচনা তা সে জানে না।যখন কারো কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করছে সকলেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।কেউ কথা বলতে লাগলে সেখানে শ্রীতমা উপস্থিত হলে তারা কথাবলা বন্ধ করে দিচ্ছে।শেষমেষ শ্রীতমার প্রিয় বন্ধু স্মৃতির কাছ থেকে জানতে পারি রাহুল নাকি দিন তিনেক আগে কোন এক বিদেশিনীকে ভালবেসে বিয়ে করেছে।রাহুলের প্রিয় বন্ধু মৈনাককে সে একথা জানিয়েছে।সরল বিশ্বাসে শ্রীতমা ওদের কথা বিশ্বাস করে নেয়।কিন্তু ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে সে।রাহুলের সাথে অভিমান করে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।ভার্চুয়াল জগতে তাকে ব্লক করে দেয়।
এই ঘটনার বছর খানেক বাদে রাহুল দেশে ফিরে আসে তখন শ্রীতমা নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে।শ্রীতমা রাহুল দুজন দুজনকে ভালবাসলেও এবং তারা বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া সত্বেও দুজনের কেউই কিন্তু দুজনের বাড়ির ঠিকানা জানতো না।হঠাৎ করে একদিন মৈনাক শ্রীতমাকে ফোন করে একটা কফিশপে তার সাথে দেখা করতে বলে।কথাটা শুনে শ্রীতমা তাকে মুখের উপরই না বলে দেয়। কিন্তু মৈনাকের শত অনুরোধ এবং কাকুতি মিনতি দেখে শ্রীতমা রাজি হয় তার সাথে দেখা করতে কফিশপে। মৈনাক শ্রীতমার অনেক আগেই কফিশপে পৌঁছে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শ্রীতমা সেখানে পৌঁছালে মৈনাক তাকে বলে,
---আজকে তোমার সাথে একজনের দেখা করিয়ে দেবো। তখন তুমি বুঝতে পারবে আমার মুখে বসিয়ে যে কথাগুলি তোমার বন্ধুরা বলেছিলো কথাগুলো সত্যি নয়।তুমি কোনদিন তা যাচাই করার জন্য আমার কাছে জানতেও চাওনি সত্যিটা আসলে কি এবং আমি কথাগুলো কাউকে বলেছি কিনা।মানুষ সবথেকে যে ভুলটা করে সেটা হচ্ছে অন্যের মুখে কথা শুনে হঠাৎ করে কিছু মানুষ সম্পর্কে ভুল ধারনা করে ফেলে,তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়।কিন্তু এটা যে কতটা বোকামি তা তারা একবারও ভেবে দেখেনা। সবসময় উচিত কোন কথা কারোর কাছ থেকে জানলে তার সত্যতা বিচার করার জন্য অন্তত একবার মানুষটার মুখোমুখি হওয়া। যাহোক আমার কাজ শেষ আমি চললাম আমি যার সাথে তোমাকে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে এখানে আসতে বলেছিলাম সে তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
মৈনাক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।আর শ্রীতমা পিছন ফিরে দেখে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে রাহুল দাঁড়িয়ে আছে।
--- তুই এখানে ?তোর বউ কোথায়?বিদেশিনী বউ আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি না?
--- তুই মনেহয় মৈনাকের কথাগুলো বুঝতে পারিস নি। কে বা কারা কেন রটিয়ে ছিল যে আমি একজন বিদেশীনিকে বিয়ে করেছি এবং সেটা একমাত্র মৈনাককেই জানিয়েছি আমি জানিনা।তবে এটা আমি ভালোভাবে জানি একজন বউ থাকতে আর একটা মেয়েকে বিয়ে করা যায় না।
-- মানে?
--- পাগলি একটা, যাওয়ার আগে তোকে বলে গেলাম না আমার জন্য অপেক্ষা করিস তিনটে বছর।ফিরে এসে তোকে বউ করে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব এটাই ভেবে বলেছিলাম। কিন্তু তুই অন্যের মুখের কথা শুনে আমাকে অবিশ্বাস করলি! পাগলী তোকে আমি কত ভালবাসি--।আর তুই যে আমাকে ভার্চুয়াল জগতে ব্লক করে দিয়েছিস, আমার সাথে যোগাযোগ রাখিস নি।একবারও ভেবে দেখিসনি যে তোর জন্য চিন্তা করে করে আমার রেজাল্ট খারাপ হতে পারে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি, আমার কিছু হয়ে যেতে পারে। একবারের জন্যও এসব ভাবিস নি।কিন্তু কেন রে? ভালোবাসার মধ্যে বিশ্বাস থাকা দরকার সকলের আগে। বিশ্বাস যদি না থাকে ভালোবাসায় ফাটল আসে।আর কোনদিন আমাকে অবিশ্বাস করিস না।আমি তোকে ছাড়া আমার জীবনটাকে কল্পনাই করতে পারি না।
শ্রীতমা হঠাৎ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাহুলকে জড়িয়ে ধরে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
--- খুব ভুল করে ফেলেছি।আমিও তোকে ভীষণ ভালোবাসি। ওরকম একটা কথা শুনে আমি সত্যিই খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম।সত্য মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা তখন আমার ছিলনা। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।আর সারা জীবনের মতো শক্ত করে বুকের সাথে বেঁধে রাখিস।
No comments:
Post a Comment