পেয়ে হারানোর ব্যথা
--- সিস্টার,কাল যে পেশেন্টের অপারেশন হবে সে ফাইল টা একটু আমায় দিন আর তার বাড়ির লোককে আমার সাথে দেখা করতে বলুন।
--- বাড়ির লোক বলতে উনার স্ত্রী।বয়স্কা মানুষ, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার চেম্বারে।
সিস্টারকে কথাগুলো বলে ডক্টর অস্মিতা মুখার্জি তার নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন।যাওয়ার সময় তিনি ফাইলটা হাতে করে নিয়ে গেলেন।নিজের চেম্বারে বসে পেশেন্টের নামটা দেখে তার চোখ আটকে গেল সেখানে। একজনের সাথে নামটার ভীষণ মিল ---। যদিও মানুষটাকে সে কোনদিনও চোখেই দেখেনি। নামটা দেখেই তার মনটা কেমন উসখুশ করতে লাগলো।এবার সে ঠিকানায় চোখ বোলালো।কিন্তু যে মানুষটাকে সে কোনদিন চোখেই দেখেনি শুধু নিজের নামের পাশে সেই নামটা বহন করে চলেছে সে মানুষটার ঠিকানা তার অজানা। অন্যমনস্ক হয়ে পরলো। ফাইলটা রেখে দিয়ে চেয়ারটায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে অনেক কিছু ভাবতে লাগলো।তার এই ভাবনায় ছেদ পড়ল হঠাৎ "ভিতরে আসতে পারি?" কথাটা শুনে।
বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রমহিলা ভিতরে এসে দাঁড়ালেন।
ডক্টর অস্মিতা তাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন।
--- তুমি মানে আপনি আমায় ডেকেছেন?
--- আপনি অনায়াসে আমাকে তুমি করে কথা বলতে পারেন। আমি আপনার মেয়ের বয়সীই হব।
--- আচ্ছা এই বয়সে আপনি যে হাসপাতাল বাড়ি ছোটাছুটি করছেন আপনার ছেলে-মেয়ে বা বাড়ির অন্য কেউ আসছেন না কেন?
--- আমার কেউ নেই মা। আর ছেলে মেয়ের কথা বলছ?না তাও নেই।একটা ছেলে আমার হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে দু'বছর বয়সে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।তারপর আর কোন সন্তান আমাদের হয়নি।
ডক্টর মুখার্জী ভদ্রমহিলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
--- আচ্ছা আমরা এবার কাজের কথায় আসি।কাল সকাল সাতটায় অপারেশন হবে।আপনার স্বামীর বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে অপারেশন করলে তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ফিফটি পার্সেন্ট। যথেষ্ট বয়স হয়েছে উনার। অপারেশনের ধকল কতটা নিতে পারবেন তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।আমার দিক থেকে আমি সম্পূর্ণ চেষ্টা করব।চিন্তা করবেন না।আপনি আজ বাড়ি চলে যান কাল সকালে আসবেন।
--- চিন্তা করে আর কি করবো মা!তবে একটা কথা উনি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।ঈশ্বর কপালে যা লিখেছেন তাতো হবেই।আমরা তো উপলক্ষ মাত্র।তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে।শুধু তুমি কেন আমরা সাধারন মানুষেরা ডাক্তারের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই প্রিয় মানুষগুলিকে সুস্থ করার জন্য তাদের হাতে তুলে দিই।আর ডাক্তারেরা তাদের সম্পূর্ণ টুকুন দিয়ে চেষ্টা করেন মানুষটাকে সুস্থ করে আমাদের মুখে হাসি ফোঁটাতে।
ভদ্রমহিলা বেরিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর মুখার্জি আবার তার ফাইলটা নিয়ে বসেন।নামটা পুনরায় দেখেন।সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনেহয় 'মাকে একটা ফোন করলে হয়না?একটু ঠিকানাটা মায়ের কাছে জানতে চাইলে কেমন হতো?তাহলে অন্তত বুঝতে পারতাম এই মানুষটাকে আমি যা ভাবছি তিনি ঠিক সেই কিনা?'
অনেক ভেবেচিন্তে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে মাকে রিংটা করেই বসে।কিন্তু রিং হয়ে যায় ফোনটা ডক্টর মুখার্জির মা ধরেন না।অস্মিতা মনেমনে ভাবেন হয়তোবা মা এখন অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।যাকগে বাড়িতে গিয়েই সব জানতে চাইবো।
পঁচিশ বছর আগে স্কুল শিক্ষিকা কমলাদেবীর বিয়ে হয় ইঞ্জিনিয়ার সুকান্ত মুখার্জির সাথে। সুকান্তদের শিক্ষিত পরিবার হলেও পরিবারটি ছিল কুসংস্কারচ্ছন্ন।তারা সংসারে চেয়েছিলেন একটি পুত্র সন্তান।কিন্তু কমলাদেবী তাদের সে আশা পূরণ করতে পেরেছিলেন না।তিনি জন্ম দিয়েছিলেন একটি কন্যা সন্তানের।আর এই অপরাধের কারণে তাকে সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করতে হয়েছিল। সেদিনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার এই কন্যাটিকে মানুষের মত মানুষ করে তিনি শুধু তার স্বামী শ্বাশুড়ী নয় পুরো পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবেন ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে আজকের দিনে কোন পার্থক্য থাকে না যদি তাকে ঠিকভাবে মানুষ করা যায়।
সেদিনের সেই ছোট্ট শিশু কন্যাটি আজ ডক্টর অস্মিতা মুখার্জি বাবা,সুকান্ত মুখার্জি।
অস্মিতা বাড়িতে ফিরেই মায়ের সাথে প্রতিদিনই তার নানান রোগীর নানান সমস্যার কথা নিয়ে আলোচনা করে। সে সেদিনও ফিরে চা খেতে খেতে মায়ের সাথে নানান কথা বলতে বলতে সুকান্ত মুখার্জির প্রসঙ্গ আসে। মায়ের কাছে জানতে চায় তাদের পুরনো বাড়ি ঠিকানা। মেয়ের মুখে এই প্রথম বাবার সম্পর্কে কোন কথা জানার কৌতুহল দেখে তিনি নিজেও একটু অবাক হয়ে যান। তিনি মেয়েকে বলেন যে কি কারনে তার এই ঠিকানা জানতে চাওয়া। তখন অস্মিতা বলে,
--আগামীকাল সুকান্ত মুখার্জির হার্ট অপারেশন হবে।এবং নিজেই সুকান্ত মুখার্জির ঠিকানাটা গড় গড় করে বলে যায়।
কমলাদেবী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন তারপর বলেন, ---হ্যাঁ এই সুকান্ত মুখার্জিই তোর বাবা।কারণ এটা তোর বাবার বাড়িরই ঠিকানা। কাল অপারেশনের আগে আমার সাথে তার একটু দেখা করিয়ে দিতে পারবি?আমি যে তোকে একটা ছেলের থেকেও অনেক ভালোভাবে মানুষ করতে পেরেছি তাকে সে কথাটা জানাতে চাই।আর সত্যি বলতে কি কাল অপারেশনের আগে যেতে চাইছি একটাই কারণে যদি সেই সুযোগ আমি আর না পাই।
খুব ভোরে মেয়ের সাথে কমলাদেবী হাসপাতালে আসেন। এবং দেখা করেন তার স্বামী সুকান্ত মুখার্জির সাথে। সুকান্ত মুখার্জির প্রথম অবস্থায় কমলাদেবীকে চিনতে অসুবিধা হলেও কমলাদেবীর কিন্তু বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি ওই মানুষটাকে চিনতে।আর তিনি তো জেনেই এসেছিলেন যে উনি সুকান্ত মুখার্জি, তার স্বামী। অস্মিতা তার বাবার বেডের কাছে দাঁড়িয়ে তাকে ডেকে বলল,
--- মিস্টার মুখার্জি,দেখুন আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে?
--- হ্যাঁ খুব চেনা লাগছে, কে আপনি?
--- একটু ভালো করে দেখো তো চিনতে পারো কিনা?
সুকান্ত বাবু হাতের ইশারায় চশমাটা দিতে বললেন।অস্মিতা চশমাটা তার বাবার হাতে ধরিয়ে দিল এবং বলল,
--- আপনারা কথা বলুন আমি একটু আসছি।
কমলাদেবী মেয়ের হাতটা চেপে ধরে বললেন,
-- না তোকে কোথাও যেতে হবে না, তুই এখানে দাঁড়া; তোর সামনেই আমি কথা বলব।
এতক্ষণে সুকান্ত বাবু তার প্রাক্তন স্ত্রী কমলাদেবীকে চিনতে পেরেছেন। অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
--- তুমি এখানে?তুমি কি করে খবর পেলে?
কমলাদেবী মুখটা একটু কঠিন করে বললেন,
--- না এখানে আসার আমার কোন ইচ্ছা ছিল না।কিন্তু একটা কথা তোমার অপারেশনের আগেই জানাতে এলাম। আমি জানি একজন অসুস্থ মানুষকে এ সময়ে বিরক্ত করা ঠিক নয়।কিন্তু তবুও এই মুহূর্তেই তোমার কথাটা জানা দরকার। একদিন মেয়ে হওয়ার অপরাধে তাকে সমেত আমাকে বাড়ি থেকে তুমি আর তোমার মা তাড়িয়ে দিয়েছিলে।আর কোন খবরই নাওনি। পরে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিলে। আমি ইচ্ছে করলে খোরপোষ দাবী করতে পারতাম।কিন্তু তোমাদের টাকা নিয়ে সেই টাকায় আমার মেয়েকে মানুষ করতে আমি চাইনি।যদিও রক্তের সম্পর্কটা অস্বীকার করতে পারি না।আর তুমি যে ওর বাবা সেটাও তো অস্বীকার করতে পারি না।তাই আজও ওর নামের পাশে বাবা হিসাবে সুকান্ত মুখার্জি নামটাই ব্যবহার করা হয়।এটা আমার কাছে লজ্জার হলেও ওর কাছে সেটা লজ্জার নয়। কাল তোমার যে অপারেশন করবে সে তোমার কে হয় জানো? ও!তা তো তুমি জানো না। আর জানবেই বা কি করে? তুমিতো তার কোন খবরই কোনদিন রাখনি।
অস্মিতার হাতটা টেনে নিয়ে সুকান্তবাবু সামনে দাঁড়িয়ে কমলাদেবী বললেন,
-- এই যে তোমার মেয়ে অস্মিতা।একজন বড় হার্ট স্পেশালিস্ট।যার জন্মের পরেই ওকে সমেত আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল।কারণ আমি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলাম।সেদিন আমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মেয়েকে আমি মানুষ করে তোমাকে দেখাবো।ঈশ্বর আমাকে সে সুযোগটা আজ করে দিলেন।
সুকান্ত বাবু অস্মিতার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরার চেষ্টা করলেন।কমলাদেবী মেয়ের হাতটা টেনে নিলেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে অস্মিতা বলল,
-- মা উনি আমার পেশেন্ট, আজ ওনার অপারেশন। আমি উনার মানসিক বল হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বাবার হাতটা ধরি।
সুকান্ত বাবু ঠোঁটের কোণে হাসি এনে মেয়ের হাতটা ধরে বললেন,
-- মায়ের কথাতে সায় দিতে গিয়ে আমি তোকে অস্বীকার করেছিলাম এ কথা সত্যি।কিন্তু আজ আমি ভীষণ খুশি যে তোর মা তোকে এরকম একজন ডাক্তার তৈরি করেছেন। ঈশ্বরের কি লীলা দেখ সেই তোর হাতেই আজ আমার অপারেশন।অর্থাৎ আমার বাঁচা মরা নির্ভর করছে তোর উপরেই।
অপারেশনের পর এক বছর সুকান্ত বাবু বেঁচে ছিলেন ততদিনে তার বর্তমান স্ত্রী জেনে গেছেন অস্মিতা তার স্বামীর ঔরসজাত সন্তান।তাই তার মৃত্যুর পর তিনি অস্মিতাকে খবর দিয়ে তার বাবার সমস্ত কাজ তার হাত দিয়েই করান। বর্তমানে তার প্রাক্তন এবং বর্তমান স্ত্রী একই বাড়িতে অস্মিতাকে সাথে নিয়েই থাকেন।
No comments:
Post a Comment