সুখের ঘরে আগুন (২৮)
নিখিলেশের সাথে কথা বলে অচলাকে নিয়ে কলকাতায় যাওয়াই মনস্থ করে নিলয়। নিখিলেশের কথা অনুযায়ী নিলয় ওর জন্য কিছু ভিন্ন ধরনের পোশাক কিনে আনে। এইসব তালমাতাল অবস্থায় দিনান্তে বাবা মায়ের সাথে একবার করে কথা হলেও অম্বিকার সাথে সেই একদিন ছাড়া নিলয়ের আর কোন কথা হয়নি। একদিন রাতে শেষ ট্রেন ধরে তারা কলকাতা যাওয়া ঠিক করে।সেদিন সন্ধ্যাবেলা নিখিলেশ নিলয়ের কোয়ার্টারে চলে আসে।রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে অচলাকে জিন্স আর টি-শার্ট পরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে একদম কোয়ার্টারে ভেতর থেকে প্রথমে নিখিলেশ ও অচলা স্টেশনে পৌঁছে যায়।তারপর নিলয় আরেকটি ট্যাক্সি ধরে জিনিসপত্র নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যায়।কোয়ার্টার থেকে বেরোনোর সময় অচলা নিলয়কে বারবার বলে এইসব পোশাক পরতে সে অভ্যস্ত নয়।তার খুবই অস্বস্তি হচ্ছে আর এত তাড়াতাড়ি তার যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।অচলা আরও বলে যে সে চলে গেলে তার দাদার খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট হবে,তাই আর কটা দিন দেরি করে গেলে কি এমন ক্ষতি হত?সে তো ঘরের ভিতরেই থাকতো।কিন্তু নিলয় তাকে জানায় তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য একটা দিনও সে ওকে এখানে রাখবে না।অচলাকে আর কোন কথা বলার সুযোগে নিলয় দেয় না।
টাক্সির ভিতর নিখিলেশের পাশে অচলা জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল।নিখিলেশ তা দেখতে পেয়ে তাকে বলে,
---. আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি তোমার দাদার বন্ধু।সেই হিসেবে আমি তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। নিলয় আমাকে বিশ্বাস করে এই দায়িত্বটা দিয়েছে আর আমি মনে করি বিপদে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোটা বন্ধুরে কর্তব্য।তুমি সম্পূর্ণ সেফ আমার কাছে।
অচলা চুপ করে নিখিলেশের কথাগুলো মাথা নিচু করে শুধু শুনে যায়। নিখিলেশ পুনরায় তাকে বলে,
--- নিলয় তোমাকে পড়াশোনা করাবে বলেছে তুমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা কোরো।মানুষ সবসময় সুযোগ পায় না আবার অনেকে সুযোগ পেয়েও হারিয়ে ফেলে।তুমি তোমার জীবনে তোমার দাদার কাছ থেকে যে সুযোগ পেয়েছ সেই সুযোগটা তুমি হেলায় হারিয়ে ফেলো না।
এই কথাগুলো তোমাকে বলার আমার কোন অধিকার হয়তো নেই,কিন্তু একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে কথাগুলো বললাম।
কোয়ার্টার থেকে স্টেশনের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয় কথা বলতে বলতে তারা স্টেশনে পৌঁছে যায় নিখিলেশ অচলার হাত ধরে আগে অচলাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তারপর নিজে উঠে। তখনো নিলয় সেখানে পৌঁছায়নি।নিখিলেশ অচলার পাশে বসে অচলাকে বলে,
--- আমাদের আবার দেখা হবে।আমি কলকাতায় মাঝেমধ্যে যাই।ওখানে আমার আত্মীয়-স্বজনেরা আছে।তখন তোমার সাথে দেখা করে আসবো।আসলে আমি মানুষ বড্ড ভালোবাসি।ছেলেবেলা থেকে আমি মামা বাড়িতে মানুষ হয়েছি।আমার জন্মের সাথে সাথে আমার মা মারা যান। যখন বয়স আমার আট বছর তখন আমার ঠাকুমা মারা যান।আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার ঠাকুমাই আমার দেখাশোনা করতেন।কিন্তু ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর আমি বাড়িতে সম্পুর্ন একা হয়ে যাই।আত্মীয়-স্বজনের চাপে আমাকে দেখাশোনা করার জন্য বাবা আবার বিয়ে করেন। কিন্তু সেই মা আমায় মেনে নিতে পারেন না।আমি তখন পুনরায় মামা বাড়িতে চলে যাই।মামার কোনো সন্তান ছিল না।তাই তাদের হেফাজতে আমি বিএ পাস করি এবং নিজের চেষ্টায় রেলে এই চাকরিটা পাই। এখনো আমি নিলয়কে আমার জীবনের কোন কথা জানায়নি কিন্তু কেন জানিনা তোমার কাছে সব কথা আমি বলে ফেললাম।আমি কলকাতা থেকে চাকরি পেয়ে এই ভুবনেশ্বরে জয়েন করি। আজ আমার মামা,মামি কেউ বেঁচে নেই।আমি সম্পূর্ণ একাই পৃথিবীতে।একাই থাকি কোয়ার্টারে। অফিসে কারো সাথে সেরকম মিশতে পারি না কিন্তু তোমার দাদা এখানে আসার পর প্রথম দিন থেকে তার সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।তারপর তোমার দাদার কোয়ার্টারে এসে তোমাকে দেখে আমার ভাল লেগে যায়।
নিখিলেশের কথা শুনে অচলা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো মুখটা নিচু করে নেয়।নিখিলেশ তা দেখে বলে ওঠে,
---- এতে তুমি কিছু মনে করো না।আমি রাখঢাক রেখে কোন কথা বলতে পারিনা।যা মুখে আসে সেটাই সরাসরি বলে ফেলি। আমার কথায় তুমি কিন্তু অন্য কিছু মনে করোনা।
নিখিলেশের কথা শেষ হতে না হতেই সেখানে নিলয় হাজির হয়।নিলয় ট্রেনে উঠে নিখিলেশকে জড়িয়ে ধরে বলে,
--- তোমার এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না। আমি পরশুদিন ফিরে আসবো।তুমি যেভাবে অচলাকে কোয়ার্টার থেকে বের করে নিয়ে আসলে আমি একা ঠিক পারতাম না।তোমার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম।
নিখিলেশ তখন নিলয়কে বলল,
--- একটা অপরিচিত মেয়েকে নিজের বোনের জায়গা দিয়ে তার জন্য তুমি যা করছো তার তুলনা হয়না এর জন্য তোমাকে আমার স্যালুট ভাই আর তোমার বন্ধু হিসেবে তোমার বোনের জন্য কিছু করতে পেরেছি মনে করে আমি মনেমনে আনন্দিত।
ভুবনেশ্বরে পৌঁছানোর একদিন পরে নিলয় অম্বিকাকে ফোন করার পর অম্বিকা ভেবেছিল হয়তো নিলয় তাকে রোজই ফোন করবে। কিন্তু নিলয় তাকে ফোন না করাতে অম্বিকার সত্যিই খুব অভিমান হয়।তাই সে রাগ করে কোন ফোন নিলয়কে করে না। এরপর সে একদিন বিকেলে নিলয়দের বাড়িতে যায়।অম্বিকাকে বাড়িতে দেখে নিলয়ের বাবা-মা খুবই অবাক হয়ে যান। তারা কখনোই ভাবতে পারেননি যে অম্বিকা তাদের বাড়িতে আসবে।অম্বিকাকে দেখে মলিনাদেবী মনেমনে ভেবে বসলেন হয়তো তার ছেলের বউয়ের সব ঘটনা জানার পর সেগুলো সরোজমিনে অম্বিকা জানতে এসেছে।তাই প্রথম অবস্থায় তাকে দেখে তিনি খুশি হতে পারেনি।কিন্তু নিলয়ের বাবা নরেশ বাবু অম্বিকাকে দেখে খুবই খুশি হন।আজ বেশ কয়েকটা দিন ছেলেটা বাড়ি নেই।তারও মন মেজাজটা ভালো নয়। আর বিয়ের 30 বছর পর স্ত্রীর সাথে নিত্যদিন গল্প করতে কার আর ভালো লাগে?আর তিনি বাইরে বেরোলেই তো সেই প্যানপ্যানানি!" আমি সারাক্ষন একা একা থাকি।তাও তুমি ঘরে থাকলে মনেহয় একটা মানুষ অন্তত বাড়িতে আছে।সেই তুমিও যদি বেরিয়ে যাও তাহলে তো আমাকে সেই ভূতের মত বাড়ি পাহারা দিতে হয়।" আর ঘরে থাকলে সেই একই কথা- ছেলের ভবিষ্যৎ, ছেলেটার কপালটা কেন এমন হলো? ছেলে বাইরে গিয়ে ঠিকভাবে খেলো ঘুমালো কিনা ;সেই ভাঙ্গা রেকর্ড!এসব কথা নরেশবাবুর মাথার মধ্যে ঘুরপাক করলেও সব সময় অন্যের মুখ থেকে শুনতে কার আর ভালো লাগে?তাই মেয়েটি যখন তার বাড়িতে এসেছে তাকে দেখে ভাবলেন অন্তত কিছুটা সময় গল্প করে কাটানো যাবে।
অম্বিকা ঘরে ঢুকেই ঢিপ হয়ে মলিনাদেবী ও নরেশবাবুকে প্রণাম করে।তারা দুজনে দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে অম্বিকার উদ্দেশ্যে মলিনাদেবী বললেন,
--- তা মা হঠাৎ কি মনে করে?আগে তো কোনদিন আমাদের বাড়িতে আসোনি?
--- এমনিই এলাম মাসিমা।আপনারা কেমন আছেন জানতে। আসলে নিলয়দা তো এখানে নেই তাই ভাবলাম যাই একটু আপনাদের সাথে দেখা করে আসি।
স্বামী,স্ত্রী দুজনে আকাশ থেকে পড়লেন।তারা ভাবলেন নিলয় যে এখানে নেই অম্বিকা সে কথা জানলো কি করে?
মলিনা দেবী অনেক চেষ্টা করে মুখে হাসি এনে বললেন, --- --- নীলু যে এখানে নেই তুমি কি করে জানলে? তোমার সাথে কি নিলুর কথা হয়?
--- না না মাসিমা, মাঝে একটা বিয়েবাড়িতে নিলয়দার সাথে আমার দেখা হয়েছিল।তখনই জানতে পারি নিলয়দা ভুবনেশ্বরে ট্রান্সফার হয়ে গেছেন।আর তখন বলেছিলেন আমি যেন মাঝেমধ্যে এসে আপনাদের সাথে দেখা করে যাই। তাহলে আপনাদেরও ভালো লাগবে।আজ ছুটি ছিল তাই একটু সময় পেয়ে চলে এলাম দেখা করতে।আসলে আমার তো আসতে আসতে সেই সন্ধ্যা হয়ে যায়।
এতক্ষণ পরে নরেশবাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- আরে এতো কথার কি আছে?পাড়ার মেয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তা কিসের জন্য, কেন এলো, কি প্রয়োজন? এত প্রশ্ন করার তো কোন দরকার নেই।যাও একটু চা, জলখাবার করে নিয়ে এসো।তিনজনে বসে একটু গল্পগুজব করি। নিলুটা বাড়ি নেই সত্যিই বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।তাও মেয়েটার সাথে বসে একটু সময় কাটানো যাবে।তা না হলে তো তোমার ওই টিভি খুলে বসে সিরিয়াল দেখা,আর তা না হলে ছেলের জন্য বসে বসে টেনশন করা। তোমাদের মেয়েদের একটা মস্ত বড় দোষ ছেলেমেয়েরা যতই বড় হোক না কেন তাদের সারা জীবনই তোমরা ছোট করে রাখবে।আর তারা কিছু জানেনা, বোঝেনা, পারেনা বলেই চালিয়ে দেবে।
তারপর তিনি নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হাসতে লাগলেন। মলিনাদেবী স্বামীর এই রসিকতায় মোটেই খুশি হতে পারলেন না।তিনি বলে উঠেন,
-- তোমরা কি করে বুঝবে মায়ের কি জ্বালা!
--- হ্যাঁ তাই তো মায়েরাই সবকিছু বোঝে!বাপেরা কিচ্ছু বোঝে না।তারা তো কোনো দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেনা। আর সেই জন্য বাপেদের জ্বালাও থাকে না। যত্তসব!
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment