শাশ্বত রায় একটা দামি কোম্পানর এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।নিজে ড্রাইভ করে সে তার স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে শপিংমলে আসে কিছু কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে নিয়ে। শপিংমলের পার্কিং জোন এসে সে যখন গাড়িটা পার্কিং করতে যাবে কোথা থেকে সেখানে হাজির হয় ময়লা ছেড়া কাপর পরা এক ভিখারিনী। মেয়ে দীপশিখা এবং স্ত্রী মধুরিমা দুজনে গাড়ি থেকে নেমে ততক্ষণে শপিং মলের ভিতর ঢুকে গেছে।কিন্তু শাশ্বত রায় পঞ্চাশোর্ধ এই মহিলাটিকে দেখে দাঁড়িয়ে যান।তার মনেহয় কোথায় যেন এই মহিলাটিকে তিনি দেখেছেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে অনেক চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারেন না।
বছর সতেরো আগের কথা। তখন শাশ্বত রায় বছর পাঁচেক হল বিয়ে করেছেন। কিন্তু কোন সন্তানাদি তাদের হয়নি।তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিবছরই একবার করে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের পুজো দিতে চান কুলো পুরোহিতের কথামতো। কলকাতা, মাদ্রাস সহ বহু জায়গায় বহু বড় বড় ডাক্তার দেখানোর পরেও কোন সন্তানের মুখ বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেও তারা দেখতে পাননি।বিজ্ঞান যখন মানুষের জীবনে অকৃতকার্য হয় তখন মানুষ দৈবশক্তি লাভের আশায় ঈশ্বরের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান।কুলো পুরোহিতের বিধান অনুসারে প্রতিবছর যদি জগন্নাথ মন্দিরে ভগবান জগন্নাথের পুজো দেয়া হয় তাহলেই তিনি বাবা ডাক শুনতে পারবেন সেই কথা শিরোধার্য করে তারা প্রতিবছরই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিতে যান। প্রথম বছর তারা নির্বিঘ্নে পুজো দিয়ে কলকাতা ফিরে আসেন।কিন্তু দ্বিতীয় বছর পুজো দিয়ে তারা যখন মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হাঁটার পর দেখতে পান রাস্তার উপরে বছরখানেকের একটা শিশু একটা চটের বস্তার উপরে ঘুমিয়ে আছে।তার কাছে তার মা বা অন্য কেউ নেই।আশেপাশেও সেরূপ কোন মানুষজন নেই।প্রথমে ব্যাপারটি তার স্ত্রী মধুরিমার চোখে পড়ে।তিনি তার স্বামীকে দেখান।হঠাৎ সেখানে কয়েকটা সারমেয় চিৎকার চেঁচামেচি করে মারপিট শুরু করে।পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে যেকোন সময় ওই বাচ্চাটির উপর সারমেয়গুলি এসে হামলা করতে পারে।তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েন। তারা সারমেয়গুলিকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বাচ্চাটি মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর এক ভদ্রমহিলা সেখানে এসে হাজির হন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভাবেন এই মহিলাই বাচ্চাটির মা।কিন্তু মহিলা বাচ্চাটির কাছে এসে কিছু মানুষকে ডেকে জানান বাচ্চাকে এখানে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তার মা যখন দোকানে বাচ্চাটির জন্য একটু দুধ আনতে গেছিল তখন একটা গাড়ী এসে তাকে পিষে দিয়ে যায়।ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান।মারা যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে তিনি তার বাচ্চার কথা তাকেই বলে যান।কিন্তু তিনি এ বাচ্চা নিয়ে কি করবেন? তিনি নিজেই তো ভিক্ষে করে খান।এই বাচ্চাকে মানুষ করার তার কোন ক্ষমতা নেই।যদি কেউ থাকে সুপরামর্শ দেয় এই বাচ্চাটিকে নিয়ে কি করা যায় তাহলে তিনি বাচ্চাটির সেই ব্যবস্থা করতে পারেন। সেখানে জড়ো হওয়া প্রত্যেকটা মানুষ দাঁড়িয়ে তার কথা শুনে সকলেই যে যার মত পথ ধরলো। শুধু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো মধুরিমা আর শাশ্বত রায়।
ওই বাচ্চাটি এবং ভদ্রমহিলাকে সাথে নিয়ে শাশ্বত ও মধুরিমা প্রথমে থানায় যায়।সেখানে তারা বাচ্চাটা জমা দিয়ে নিজেরা দুজনে আলোচনা করে ঠিক করে ওই বাচ্চাটিকে তারা দত্তক নেবেন।কিন্তু প্রথম অবস্থায় বাচ্চাটিকে থানায় জমা দিলেও এত ছোট বাচ্চাকে থানায় রাখতে কেউ রাজি হয় না।তখন তার দেখভাল করার জন্য তারা শাশ্বত, মধুরিমাকে অনুরোধ করে, এবং পরবর্তীতে আইনি কাগজপত্র রেডি হলে তারা বাচ্চাটিকে নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারবেন। যতদিন পর্যন্ত ওই শিশুকন্যাটিকে আইনি মারফত শাশ্বত মধুরিমা কাছে পাইনি ততদিন পর্যন্ত তিনি তার ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে পুরীতে থেকে যান।
মেয়েটির বয়স এখন প্রায় 15,16 বছর হবে।সে জানেনা যে শাশ্বত এবং মধুরিমা তার আপন বাবা, মা নয়।
শাশ্বত শপিংমলে ঢুকে তার স্ত্রী এবং কন্যার সাথে শপিং করতে করতে হঠাৎ ওই ভদ্রমহিলাকে কোথায় দেখেছে তার মনে পরল।তিনি তখন স্ত্রী-কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- তোমরা কেনাকাটা করতে লাগো আমি একটু পরেই আসছি।ছুঁটে বাইরে চলে এলেন।খোঁজ করতে লাগলেন মহিলাটিকে এবং একসময় তাকে পেয়েও গেলেন। পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে মহিলার হাতে দিতে গেলে তিনি শাশ্বত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পারেন এবং তার কাছে জানতে চাই,
--- বাবু আমার মেয়েটা কেমন আছে?তাকে আমাকে একটু দেখাবে?
--- কিন্তু সেদিন যে তুমি বলেছিলে ও আর একজনের মেয়ে, ওর মা অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে।
--না বাবু সেটা ঠিক না।মেয়েটি আমারই।সেদিন আমাদেরই মত একজন ভিখারিনী ওই রাস্তায় মারা গেছিলেন ঠিকই আর সেটাকেই কাজে লাগিয়ে আমি মেয়েটাকে অন্য কারো কাছে রেখে মানুষ করতে চেয়েছিলাম।আমার আরো তিন তিনটে মেয়ে রয়েছে। রাস্তাতেই তারা থাকে তাই আমি চাইনি আমার চতুর্থ মেয়েটাও এইভাবে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে পেট চালাক।আমি সেদিন শুধুমাত্র মেয়েটিকে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য ওই অভিনয়টা করেছিলাম।আমি কলকাতারই মেয়ে।পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাছে ভিক্ষে করতাম কারণ আমার সাথে যার বিয়ে হয়েছিল সে ওখানেই থাকতো। বিয়ে করে এনে খেতে পরতে দিত না।তাই ভিক্ষা করতে শুরু করেছিলাম।কিন্তু আমার সাথে যারা পথে পথে ভিক্ষা করতো তারা আমার অভিনয়টা ধরে ফেলেছিল।তারা আমাকে বলেছিল পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবে।তাই ভয় পেয়ে আমি মেয়ে তিনটেকে নিয়ে কলকাতাতেই চলে আসি।চতুর্থ মেয়েটি হওয়ার পরে আমার স্বামী আমায় ছেড়ে চলে গেছিল। বাবু ,আজ যখন তোমার সাথে দেখা হল আমার মেয়েটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে দেবে?বিশ্বাস কর বাবু ,আমি আমার পরিচয় দেবোনা।আসলে নাড়িছেঁড়া ধন তো!মনটাকে বেঁধে রেখে মেয়েটার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সেদিন তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।আজ তোমাকে দেখে তার সেই ছোটবেলার মুখটা ভীষণ মনে পড়ছে।একটু দেখা করিয়ে দাও না বাবু?দূর থেকে দেখবো একদম কাছে যাবো না।
তারপর শাশ্বতর হাতে ধরা টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
---এই টাকাগুলো আমি নেবো না বাবু। তুমি সারা জীবনের জন্য আমার মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছো।তার বিনিময়ে আমি কি তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারি?আমায় ক্ষমা করো।আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, তুমি শুধু আমাকে মেয়েটার মুখটা দূর থেকে একটু দেখার সুযোগ করে দাও;আর আমাকে ক্ষমা করে দিও সেদিন তোমাদের কাছে মিথ্যে কথা বলার জন্য।
No comments:
Post a Comment