স্বপ্নের পথে বাঁধা
মাইকের ঘোষণা শুনে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সহেলি।হলের মধ্যে তখন লোক গিজগিজ করছে।মঞ্চে ওঠার আগে পুরো হলের ভিতর একবার চোখ বুলিয়ে নিল সহেলি।হয়তো তাঁর চোখ দু'টি খুঁজছিল অন্য আর দুটি চোখ। সাহেলি জানে এটা তার আশা করা বৃথা।তবুও কি এক অমোঘ আকর্ষণে বারবার সেই চোখ দুটি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে,কিন্তু কখনোই তা বাস্তব হয়ে আজ প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো তার সামনে দেখা দেয় না। এক পা দু পা করে সহেলী এগিয়ে যেতে থাকে মঞ্চের দিকে।প্রায় ছ'বছর পর আবার সেই মঞ্চে ওঠা। হঠাৎ তার মনে হল তার পা দুটো কি একটু কাঁপছে?বুকটার ভিতরে ধুকপুক করছে?সেকি ভয় পেয়েছে?সে কি ভয় পাচ্ছে শয়ে শয়ে লোকের সামনে আবার নতুন করে গান করতে এসে?
মাইকের সামনে সহেলী তার প্রিয় হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসে প্রথমেই গান ধরল,
অনেক আশার স্বপ্ন আমার
আজকে বুঝি ভেঙ্গে গেল।
তোমার মুখে একটি কথাই
জীবন আমার হারিয়ে গেল।
অনেক আশার স্বপ্ন আমার -----
আজকে বুঝি তোমার কাছে
নতুন কোন সাথী এলো
নতুন সাথী তোমার মাঝে
নতুন কিছুর ছোঁয়া দিলো।
আমি দূরে হারিয়ে গেলাম,
নতুন সাথি সেথায় নীড় রচিল,
জীবনে তোর এটাই পাবি,
মনে কি তোর জানা ছিল?
পাওয়ার যা পেয়ে গেলি
যাবার যে জন চলে গেল
আর কি তোর চাওয়ার আছে?
তোর প্রিয় তো সুখী হলো।
মিছামিছি কাঁদিস কেন?
যা হারাবার হারিয়ে গেল--
অনেক আশার স্বপ্ন আমার ---।
গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকাসন হতে পরপর গানের জন্য অনুরোধ আসতে থাকে।কয়েকটা গান গেয়ে সহেলী নেমে আসে স্টেজ থেকে। গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় নিজের চোখে দেখেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারে না,
সামনে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে আর কেউ নয় যাকে সে হলের ভিতরে বারবার খুঁজেছে, যে চোখ দুটি সে বারবার দেখতে চেয়েছে আজ প্রায় ছ'বছর ধরে। তার সামনে দাঁড়িয়ে অরুনাংশ রায়চৌধুরী তার স্বামী।
কলেজ ফেস্টে সহেলীর গান শুনে প্রেমে পড়েছিল অরুনাংশ। সহেলির তখন ফার্স্ট ইয়ার।আর অরুনাংশ ওই কলেজেরই ইতিহাসের প্রফেসার।দু'বাড়ির মতামতের ভিত্তিতে এক বছরের মধ্যেই বিয়ে।গ্রাজুয়েশনটা সহেলীর আর করা হয়ে ওঠে না।
।সহেলীর গানের গুরু ওস্তাদ অমিয় কান্তি ভাদুড়ী। ওস্তাদের সকল ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে সহেলি ছিল তার প্রিয় ছাত্রী। অমিয় কান্তি কলকাতার ভিতর যেখানে অনুষ্ঠান করতে যেতেন সহেলীকে সাথে নিয়ে যেতেন। এছাড়া সপ্তাহে দুদিন সহেলী ওস্তাদের কাছে নিয়ম করে গান শিখতে যেত। বিয়ের পর মাস ছয়েক অরুনাংশ এ ব্যাপারটি মেনে নিলেও পরবর্তীতে সে যেন সহেলীর এই নিত্য বেরোনো ভালো চোখে নিতে পারেনা। শুরু হয় অশান্তি।গান পাগল সহেলি সকল অশান্তি কে উপেক্ষা করে তার গানকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।কিন্তু অরুনাংশ দিনের পর দিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে থাকে।শুরু হয় ওস্তাদ এবং তাকে নিয়ে নানান ধরনের কুরুচিকর মন্তব্য। অরুনাংশকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে বিফল হয় সহেলী।কিন্তু গানকে ছেড়ে সংসার তার জীবনে হবে না এটা সে ভালভাবেই বুঝে যায়।আর অরুনাংশ তাকে শর্ত দেয় হয় গান না হয় সে -- যেকোনো একটা সহেলীকে বেছে নিতে হবে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে যখন প্রায় পরাজিত তখন সে স্থির সিদ্ধান্তে আসে গানকেই সে জীবনে প্রাধান্য দেবে বেশি।
বেরিয়ে আসে সে অরুনাংশর জীবন থেকে।অরুনাংশ তাকে কোনো বাধা দেয় না। উভয় পক্ষ কোন ডিভোর্স এর নোটিশও কারো কাছে পাঠায় না।ফিরে আসে সে তার বাবা-মায়ের কাছে।গান এবং পড়াশোনা পুনরায় চালিয়ে যেতে থাকে। কোনরকমে গ্রাজুয়েশন শেষ করে সে। কিন্তু গানকেই সে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান করে নেয়।আজ সহেলীর নামে যেকোনো একটা স্টেজ শো অনায়াসেই হতে পারে। দর্শক আসনগুলি সহেলীর নাম শুনে ভর্তি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অরুনাংশ কাছ থেকে চলে আসার পর সহেলীর বুকের একটা দিক আজও শূন্য হয়েই পড়ে আছে। এগিয়ে আসে অরুনাংশ তার দিকে জানতে চায়,
--- কেমন আছো?আজ অনেকদিন পর তোমার গান শুনলাম।আগের থেকে আরো অনেক বেশি ভালো গাও এখন।
--- তুমি ভালো আছো?শরীরটা তো দেখছি একদম ভেঙ্গে গেছে।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো না নাকি?
--- ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করি,না খেলে বাঁচবো কি করে? কিন্তু জীবনে ভালোভাবে বাঁচতে গেলে আগে দরকার মানসিক শান্তি;যেটা আমার ভুলে বহুদিন আগেই হারিয়ে ফেলেছি।আর আমার ইগো আমাকে বিপথে চালনা করেছে।
--- ছাড় ওসব পুরনো কথা।শরীরের দিকে যত্ন নিও। একা একা থাকো দেখার কেউ নেই নিজের শরীরের যত্ন নিজেকেই নিতে হবে।
--- সবকিছু ভুলে আর একবার চেষ্টা করা যায় না?আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।যদি পারো আমায় ক্ষমা করে দিও।চলো আবার নতুন করে আমরা সবকিছু শুরু করি।
--- ভাঙ্গা কাঁচ জোড়া দিলে তার ভিতরে একটা দাগ থেকেই যায়।ভাঙ্গা সম্পর্ক গুলোও ঠিক যেন ভাঙ্গা কাঁচের মতন। যতই তাকে জোড়াতালি দিয়ে কম্প্রোমাইজ করো না কেন পূর্বের জায়গাটা আর ফিরে আসে না।প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা স্বপ্ন থাকে।সেই স্বপ্ন পূরণে যদি কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে অপরপক্ষ তাকে পূর্বের জায়গাটা কখনোই আর দিতে পারে না।ক্ষমা করতে পারে কিন্তু আগের মত ভালবাসতে আর পারে না।আমি দ্বিচারিতা করতে পারবো না।আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা গান।সেই গানকে যে অপমান করবে আমি তাকে আর যাই হোক কিছুতেই ভালোবাসতে পারবো না।তাই আমি নতুন করে আর কোন ভুলের মধ্যে পা দিতে চাইনা।সংসার সকলের দ্বারা সম্ভব হয়না।আমি মনেকরি আমার কপালে ওই কটা দিনই সংসার করা লেখা ছিল।নূতন করে সংসার নিয়ে আর ভাবতে চাই না।
গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসলো সহেলী।ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। অরুনাংশ ভাঙ্গা মন নিয়ে গাড়িটার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মনেমনে বলল,
--- আমি আমার ভুল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হলেও আজ আমার স্বীকার করতে একটুও দ্বিধা নেই আমার কাছে থাকলে তোমার স্বপ্ন কোনদিনও পূরণ হতো না।তাই যা হয়েছে হয়তো ভালোর জন্যই হয়েছে।এই জন্যই হয়তো মানুষ বলে থাকে "ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন"।
No comments:
Post a Comment