Saturday, February 13, 2021

বডিগার্ড

বডিগার্ড

   কলেজ ফেস্টে প্রথম দেখা।অয়নের খুব পছন্দ হয়ে যায় রিমাকে।পুরো অনুষ্ঠানে রিমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করে বেড়ায় অয়ন।অয়ন সুন্দর,সুপুরুষ। ছফুটের উপর লম্বা।যে কোন মেয়েই তাকে পছন্দ করবে। রিমারও তাকে ভালো লাগে।কিন্তু রিমার মনেহয় অয়ন যেন একটু বেশি গায়ে পরা ছেলে। রিমার কলেজে ফার্স্ট ইয়ার হলেও অয়নের থার্ড ইয়ার। মাত্র কটা দিনেই অয়ন যেন রিমার বডিগার্ড হয়ে ওঠে।অয়নের সবকিছু রিমার ভালো লাগলেও অয়নের সব সময়ের জন্য রিমাকে আগলে রাখা এটাই সে কিছুতেই মানতে পারেনা।রিমা সুন্দরী। অধিকাংশ ছেলেরাই তার কাছে এসে একটু দাঁড়াতে,একটু কথা বলতে ভালোবাসে।কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই অয়ন সেখানে হলুদের গুঁড়ার মত এসে হাজির হয়ে যায়। রিমার বান্ধবীরা অনেকেই অয়নের এই কার্যকলাপ দেখে রিমার সাথে খুব হাসাহাসি করে যা একেবারেই মেনে নিতে পারেনা রিমা।
  অয়ন কে রিমার ভালো লাগলেও রিমা কিন্তু অয়নকে ঠিক ভালোবাসে না। সে আস্তে আস্তে অয়নকে এড়িয়ে যেতে শুরু করে।রিমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজই অয়নকে বুঝিয়ে দেয় রিমা অয়নের এই গায়ে পড়া মনোভাবটা মোটেই পছন্দ করছে না। আর এটা বুঝতে পেরে অয়নও রিমার কাছ থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। প্রথম প্রথম রিমা জয়ের আনন্দে আনন্দিত হলেও পরে তার মনটা কেন জানিনা খুঁত খুঁত করতে থাকে। অয়নের লাস্ট সেমিস্টার শেষ হয়ে যায়। অয়ন প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে শুধুমাত্র রিমাকে একটা কথা বলার জন্য।রিমাকে দেখতে পেয়ে অয়ন কাছে এগিয়ে যায় এবং বলে,
---  না বুঝে তোকে হয়তো আমি আঘাত করে ফেলেছি।কিন্তু আমার এরকম কোন উদ্দেশ্য ছিল না। তোকে বলা হয়নি বা বলতে পারিস বলার সুযোগও আসেনি।এক কলেজে পড়ার সুবাদে আমরা ক্লাসমেট না হলেও আমরা কিন্তু বন্ধু হতে পারি।কিন্তু তোর দিক থেকে কোন সাড়া আমি পাইনি। যে কথাটা তোকে বলা হয়ে ওঠেনি সেটা হল আমি একটা বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি।এখানকার অফিস আমার  সল্টলেকে। জীবনে আর হয়তো তোর সাথে আমার দেখা হবে না।কিন্তু তোর কথা আমার মনে থাকবে সারা জীবন।
 কথাগুলো বলে রিমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অয়ন দৌড়ে গিয়ে বাস ধরে বেরিয়ে যায়।রিমা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।হঠাৎ করেই তার মনেহয় বুকের ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে।কিন্তু কেন?সে তো অয়ন কে ভালোবাসে না। ওর চলে যাওয়াটা কেন সে মেনে নিতে পারছে না?তবে কি সে অয়নকে - না -- না -- তা কি করে সম্ভব?সে তো সত্যিই কোনদিনও অয়নকে ভালবাসনি।হ্যাঁ এটা ঠিক অয়নের চেহারা দেখে সে আকৃষ্ট হয়েছিল কিন্তু ভালো লাগা আর ভালোবাসা তো এক নয় তবে কেন আজ এই মুহূর্তে তার ভীষণ খারাপ লাগছে।
  বেশ কয়েকটা দিন রিমার মনটা খুবই খারাপ ছিল।কিন্তু সময় মানুষকে আস্তে আস্তে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিতে না পারলেও সবকিছুর উপর একটা মোটা আস্তরন ফেলে দেয়।অয়নের ঘটনাটাও রিমার জীবনে ঠিক তাই হলো একটা মোটা আস্তরণের তলায় চাপা পড়ে গেল।
  বিটেক পাস করে রীমা আমেরিকান কোম্পানিতে  ভালো একটা চাকরি পেয়ে যায়। অফিস,বাড়ি,মা বাবার আদর  বেশ কাটছিল রিমার দিনগুলি।কিন্তু তারই অফিসের সহকর্মী তরুণ পাল নানান অছিলায় তাকে একটু ছোঁয়ার চেষ্টা, রিমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বাসে তুলে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করা - এগুলো রিমা ঠিক ভালোভাবে নিতে পারছিলনা। একচুয়ালি গায়ে পড়া কোন মানুষকেই রিমা পছন্দ করে না।আর এই কারনেই অয়নের মত একটা ভালো ছেলের সাথেও তার কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি।অনেকবার কলিগ তরুণ পালকে নানান ভাবে নিষেধ করেছে  যে তার ব্যাপারে বেশি আগ্রহ প্রকাশ যেন তিনি না করেন।কিন্তু তরুণ পাল নাছোড়বান্দা।একদিন অফিসের করিডোরের ভেতর হঠাৎ পিছন থেকে এসে রিমার হাতটা টেনে নিয়ে তরুণ পাল বলেন,
--- কিছু কথা ছিল।
কিন্তু হঠাৎই পিছন থেকে একটা শক্ত হাতের থাপ্পড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে তরুণবাবু দেওয়ালে গিয়ে পড়েন। আর ঘটনার আকস্মিকতায় রিমা  চোখ বন্ধ করে ফেলে। রিমা যখন চোখ খোলে তখন দেখে করিডোরের শেষ প্রান্ত দিয়ে কোর্ট পরা এক ভদ্রলোক নিমেষের মাঝে মিলিয়ে  গেলেন। ততক্ষণে তরুণবাবু নিজেকে সামলে নিয়েছেন। রিমা তাদের অফিস রুমে ঢুকে তার নির্দিষ্ট চেয়ারটাতে বসে ভাবতে থাকে এটা কি একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল?কে ভদ্রলোক যে তাকে অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করল?এবং নিজের পরিচয় না দিয়ে নিমেষের মাঝে কোথায় চলে গেল? তার মানে বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোকও এই অফিসে চাকরি করেন। নানান ভাবনায় সে ডুবেছিল।হঠাৎ বসের আর্দালি এসে রুমে বলে গেল, টিফিন আওয়ারে মিনিট দশেক সময় যেন সকলে রুমেই থাকে।বস আসবেন কিছু কথা বলার আছে তার। বস তাদের রুমে আসবেন শুনে সকলের বুকটা দুর দুর করতে লাগলো। কারণ সকলেই শুনেছে তাদের উপরের এই বস মানুষটি ভীষণ রাজি এবং কাঠখোট্টা।অফিসের কাজকর্মের বাইরে একটি কথাও তিনি কারো সাথেই বলেননা।একটা নিরস লোক বলেই সকলে তাকে জানে।টিফিন আওয়ার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে বস এসে ঢুকলেন। সকলে দাঁড়িয়ে পড়লে হাতের ইশারায় তিনি সকলকে বসতে বলেন। কিন্তু রিমা তার বসের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েই থাকে। বস অয়ন মুখার্জি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ---- মিস বোস, আপনি কেন দাঁড়িয়ে?বসে পড়ুন।
 রিমা ক্যাবলার মত এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের সিটে বসে পড়লো। অয়ন তখন সমস্ত কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই শুধু বলল,
--- অফিসের ভিতরে কোন মহিলা কর্মচারীর সাথে কোন পুরুষ যদি অশালীন আচরণ করে তবে উপরমহলের নলেজে সেটা দেওয়া হবে।হয়তো ভবিষ্যতে তার চাকরিও যাবে। উপরমহলের এইরকমই নির্দেশ দেওয়া আছে।সুতরাং কারো কোন অসুবিধা হলে আপনারা যে কোন সময় আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।আমার মাধ্যমে সেটা উপর মহলে যাবে। এটাই আপনাদের বলার ছিল।টিফিন আওয়ারে আপনাদের কিছুটা সময় নেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
 কথাগুলো বলে অয়ন তার রুমে ফিরে গেল।একটু পরে আর্দালি একটা কাগজের চিরকুট তার সামনে গিয়ে ধরে। অয়ন চিরকুটটার  দিকে তাকিয়ে বলে, "ভিতরে পাঠিয়ে দাও"।
--- ভেতরে আসবো?
--- ইয়েস ।
 রিমা এসে অয়নের সামনে দাঁড়ায়। অয়ন হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে।তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলে,
--  অফিশিয়াল কোন কাজ থাকলে বলতে পারেন।আর যদি ব্যক্তিগত কোন কথা থাকে তাহলে অফিস শেষে শুনবো। কারণ আমি অফিসে কোন ব্যক্তিগত আলোচনা করিনা।
   রিমা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো।তার অপমানের জবাবে অয়নের দেওয়া অপমানটা হজম করে নিল। কিন্তু তবুও তার চোখ দুটি জলে ভর্তি হয়ে গেল।সে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলো।অফিস ছুটির পর বাসের জন্য যখন সে অপেক্ষা করছে ঠিক তখন তার সামনে এসে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়ায়।গাড়ির কাঁচ নামিয়ে অয়ন রিমাকে ডেকে নেয়।রিমা কিছুটা ইতস্তত করলেও পরে এসে ওর পাশেই বসে।অয়ন নিজেই ড্রাইভ করছিল। অয়নই প্রথমে কথা বলে,
--- আমি অত্যন্ত দুঃখিত রিমা,আবার তোর সামনে আমাকে দাঁড়াতে হলো।আসলে পুরো অফিসে সিসিটিভি বসানো আছে।আমি কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম মিস্টার পাল তোর সাথে অভদ্র আচরণ করছেন।তাই আমিও একটু সজাগ ছিলাম। আজকের ব্যাপারটা পুরো কাকতালীয়।ওই সময়ে আমিও আমার নিজের রুম থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম ওই জায়গাটায় তুই না হয়ে যদি অন্য কোন মেয়ে হতো আমি একে আচরণ করতাম।
--- তুমি এত কৈফিয়ৎ দিচ্ছ কেন?তারমানে তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি।
--- তুই অন্যায় কি করলি যে তোকে ক্ষমা করবো?
--- পাঁচ, ছ বছর আগে হলেও ম্যাচিওরিটিটা কম ছিল।বুঝতে পারিনি।তুমি দূরে চলে না গেলে হয়তো কোনদিনও বুঝতেই পারতামনা।
--- কি বুঝতে পারতিস না?
--- আমাকে আগে বলতে হবে ?
 অয়ন হেসে পড়ে বললো,
--- তাতো হবেই,তবে তুই আমায় বলতে বললে আমি বলতে পারি।কিন্তু তার আগে আমায় একটা কথা বল তো ? কবে থেকে তোর এই বোধোদয় হল?
--- সেই যে কলেজ গেটে যেদিন আমার সাথে --- ।
--- তারপর খুঁজেছিস আমায় ?
--- হু,তবে সেটা মনেমনে কারণ তোমার ঠিকানাটা তো আমার জানা ছিলনা।
--- এবার তাহলে দুজনের একটা ঠিকানা হতে পারে বল ?
--- তা পারে।তবে একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।তুমি তো আগেই জানতে আমি ওই অফিসেই আছি,কোনদিন দেখা করোনি কেন?
--- অভিমানে?
--- মুখ ফুটে তো কোনদিন তোমার ভালোবাসার কথা বলনি,তাহলে এত অভিমান কিসের জন্য?
--- আমার ভালোবাসাটা তোর বুঝতে না পারার কারণটাই আমার অভিমানের কারণ।তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম একদিন না একদিন তুই ঠিক বুঝতে পারবি।ভাগ্যিস বুঝলি তানাহলে তো আমাকে বিবাগী হতে হত।(অয়ন হাসতে থাকে)
 আমি আরও অনেককিছু পারি। ক্রমশ সব জানতে পারবি।
 রিমা অয়নের পিঠে আলতো করে একটা কিল দিয়ে বলে,
--- অসভ্য!তবে যে অফিসের সবাই বলে বস ভীষণ রাগী, বেশি কথা বলে না, মুখে কোনো হাসি নেই, প্যাঁচার মত মুখ করে থাকে।
--- আরে ওটা তো অফিস ।
 অয়ন গাড়ির গতিটা কমিয়ে রিমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
--- বহুদিনের ইচ্ছা আজ না বলিস না।
 আস্তে করে অয়ন রিমার গোলাপী ঠোঁটদুটো স্পর্শ করে।রিমা তার প্রথম প্রেমের ছোঁয়া চোখ বুজে কম্পমান শরীরে গ্রহণ করে।

  শেষ

 
    নন্দা মুখার্জি রায় চৌধুরী
 প্রজনা

No comments:

Post a Comment