সুখের ঠিকানা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
বিয়ের পর থেকেই অতসী দেখে আসছে এ বাড়িতে শ্বাশুড়ী মায়ের কথায় শেষ কথা।আর শেষ কথা হবেই না বা কেন?তিনি কখনো অন্যায় যেমন করেননা আবার কেউ অন্যায় করলেও তিনি তা প্রশ্রয় দেননা।সবসময় ন্যায়ের পক্ষে তিনি।কেউ কোন ভুল করলেই তিনি তাকে দু'কথা শুনাতে কখনোই ছাড়েন না।যুক্তি দিয়ে বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অপরের ত্রুটিগুলি তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দেন।তা সে তার স্বামী,ছেলে,বিয়েদারী মেয়ে বা জামাই যেই হোকনা কেন?
অতসীর বিয়ে হয়েছে মাত্র একবছর।সবাই তাকে আপন করে নিলেও যে মানুষটার হাত ধরে তার এই বাড়িতে প্রবেশ সেই মানুষটাকেই এই এক বছরেও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি।অতসীর প্রতি তার কোন ভালোবাসা আছে বলে সে মনে করেনা।সুবীর কেমন যন্ত্রচালিতের মত।যেটুকু কথা অতসী বলে সেটুকুরই শুধু জবাব পায়।বাড়তি একটা কথাও সুবীর তার সাথে বলেনা।রাতে একই খাটে পাশাপশি দুটি পুরুষ নারী প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মাঝে মধ্যে মিলিত হয় ঠিকই কিন্তু সে মিলনে ভালোবাসার থেকে শরীরের খিদেটাই যেন বেশি গুরুত্ব পায়। অতসী এই নিয়ে কোনদিনও কোন অভিযোগ স্বামী বা শ্বাশুড়ীর কাছে করেনি।এটাকে তার ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছে।ছোটবেলা থেকেই সে খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। ধনীর দুলালী না হলেও বাপের বাড়িতে খাওয়াপরার অভাব তার কোনদিনও হয়নি।গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে।প্রতিবেশীর এক বিয়ে বাড়িতে তাকে দেখে শ্বাশুড়ীমা সুপ্রভাদেবী পছন্দ করে এক কাপড়ে ছেলে সুবীরের বৌ করে আনেন এক মাসের মধ্যেই।
আজ কিছুদিন হোল অতসী তার ভিতর দ্বিতীয় এক প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়।সুবীর অফিস থেকে ফিরলে সে খুশি মনে সুখবরটা তাকে জানায়।কিন্তু সুবীরের চোখে মুখে সে কোন ভাবান্তর দেখতে পায়না।একটা জড়পদার্থের মত কথাগুলো শুনে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমে টিভি চালিয়ে বসে।অতসী অবাক হয়।এতো বড় সুখবরটা শোনার পরও কি করে সুবীর এতো নির্লিপ্ত থাকতে পারে?
পরদিন সুবীর অফিস থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে ঘরেই বসে থাকে।অতসী চা নিয়ে আসলে কোন ভণিতা না করেই সে অতসীকে জানায়, এ বাচ্চা সে চায়না আর এ নিয়ে কোন কথাও সে বাড়াতে চায়না।নার্সিংহোমে সে কথা বলে এসেছে আগমীকাল অফিস যাওয়ার সময় অতসীকে সাথে নিয়ে গিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে আসবে।অতসী হতভম্ব হয়ে যায়।কিছু বলতে চেষ্টা করে।সেটা বুঝতে পেরেই সুবীর তাকে জানায়,"আমি তো আগেই বলেছি এ নিয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাইনা।"কথাকটি বলেই সুবীর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ঘর অন্ধকার করে অতসী অনেকক্ষণ চোখের জলে নিজের কষ্টকে লাঘব করার চেষ্টা করে।শ্বাশুড়ীমায়ের ডাকে সে তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে এসে রাতের খাবারের তোড়জোড়ে হাত লাগায়।কিছুক্ষণ পর বিচক্ষণ সুপ্রভাদেবীর নজরে আসে তার আদরের বৌমার কাজের অন্যমনস্কতা আর ফোলা চোখ।দু'হাতে টেনে বুকের কাছে নিয়ে জানতে চান,"কি হয়েছে বৌমা?সুবীর কিছু বলেছে তোমায়?"মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে অতসী এই এক বছরের সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলে।সে যে মা হতে চলেছে এবং সুবীর যে এই বাচ্চা চায়না সে কথাও সে তার শ্বাশুড়ী মাকে জানায়।সুপ্রভাদেবী চমকে ওঠেন সুবীরের এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে।অতসীকে যেমন মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেন তিনি আছেন কোন ভয় নেই ঠিক তেমনই মৃদু বকাও দেন কেন এতদিন সে সুবীরের কোন কথা তাকে জানায়নি।
রাতে খাবার টেবিলে সুপ্রভাদেবী সকলকে জানান আগমীকাল সকালে তিনি তার বৌমাকে নিয়ে কালীঘাট পুজো দিতে যাবেন।ছেলে ও স্বামীর খাবার সকাল সকাল রান্না করে টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে যাবেন।সুবীর শুনে বলে,
---কিন্তু মা,কাল যে আমি সকালে তোমার বৌমাকে নিয়ে একটু বেরোবো ভাবছিলাম।
সুপ্রভাদেবী দৃঢ় কণ্ঠে ছেলেকে জানান,
---কাল শনিবার।আমি মায়ের মন্দিরে যাবো ওকে নিয়ে।তুমি আর একদিন ওকে নিয়ে বেরিও।
সুবীর আর কোন কথা না বলে খেয়ে তার ঘরে চলে যায়।
পরদিন শ্বাশুড়ী,বৌ পুজো দিয়ে বাড়িতে আসে।সুপ্রভাদেবী সকলকে জানান বাড়ির সকলের সাথে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।আগামীকাল রবিবার তিনি মেয়ে ও জামাইকে দুপুরে এখানে খেতে বলেছেন তারা আসলেই তাদের সামনে তিনি তার প্রয়োজনীয় কথাগুলি বলবেন।একমাত্র শ্বশুর অনিকেতবাবু ছাড়া সুবীর ও অতসী বুঝতেই পারেনা কি এমন কথা যার জন্য মা দিদি ও জামাইবাবুকেও এখানে আসতে বললেন।অতসী তার শ্বাশুড়ীকে এই এক বছরে খুব একটা ভালোভাবে চিনতে না পারলেও এটা সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে গতকাল রাতে তার মুখে নিজের ছেলের কথা শুনে তিনি কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন।তবে সেটা কি এবং সে সিদ্ধান্ত তার পক্ষে না বিপক্ষে এটা সে আন্দাজ করতে পারছেনা।আর সুবীর এ ব্যপারে নিশ্চিত এই এক বছরে সে যতটুকু অতসীকে চিনেছে তাতে করে অতসী তার মায়ের কাছে কখনোই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলবেনা।সুতরাং যা হচ্ছে বৃথা না ভেবে তাই হতে দাও।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ হলে তিনি সকলকে হাতমুখ ধুয়ে এসে ওখানেই থাকতে বলেন।কাজের মাসি এসে টেবিল পরিষ্কার করে যায়।সুপ্রভাদেবী এবার তার কথা শুরু করেন।"এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন আমার শ্বশুরমশাই।তিনি নিজে পছন্দ করে আমায় ঘরের বৌ করে এনেছিলেন।তখন আমার বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর।তার কথা ছাড়া এই সংসারে একটা কাজও হতনা।তোমার বাবা সংসার নিয়ে কোনদিনও মাথা ঘামাতেন না।বাবা আমাকে বলেছিলেন সংসারে শান্তি বজায় রাখতে গেলে সংসারে একজনকে একটু কড়া হতেই হয়।তানাহলে হাতের থেকে কাঁচের প্লেট পড়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার মত সংসারও ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়।তিনি নিজে হাতে সর্বদা আমার সাথে সাথে থেকে পরম স্নেহে অতি যত্নে নিজের মনের মত করে সংসারের উপযোগী করে তৈরি করেছিলেন আমায়।আমার শ্বাশুড়ীমা মানে তোমাদের দিদা তিনি আমাকে একমাত্র রান্নাবান্নার দিকটাই দেখিয়েছেন।আর বাকি ঘরে বাইরে যাবতীয় কাজ আমায় সাথে নিয়ে গিয়ে হাতে ধরে শিখিয়েছেন আমার শ্বশুরমশাই।জীবনে কোনদিন তাকে কোন অন্যায় করতে দেখিনি।মৃত্যুকলে তিনি তার সমস্ত বিষয়সম্পত্তি তার ছেলের মানে তোমাদের বাবার অনুমতি নিয়েই আমার নামে দানপত্র করে যান।আমি আজ পর্যন্ত তার শিক্ষার কোন অবমাননা করিনি।তোমাদের বাবার সাথে গতকাল আমার কথা হয়ে গেছে।আমি আজকে যে সিদ্ধান্তের কথা তোমাদের জানাবো তাতে তার কোন অমত নেই।
অতসীকে আমি নিজে পছন্দ করে সুবীরের বৌ করে নিয়ে এসেছি।আমি জানি সুবীরের সাথে তার এক অফিস কলিগের একটা সম্পর্ক রয়েছে।যে কিনা বিবাহিত।
সুবীর বলে ওঠে,"কি হচ্ছে মা সকলের সামনে?
সুপ্রভাদেবী হেসে বলেন,
---তুমি একটা অবৈধ সম্পর্ককে সকলের অলক্ষ্যে টেনে নিয়ে যেতে পারছো আর আমি সেটা সকলের সামনে বললেই দোষ?তোমার বিয়ের পর থেকেই আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম।কিন্তু বৌমার দিক থেকে কোন সারা না পেয়ে কোন সিন্ধান্তে উপনীত হতে পারছিলাম না।তাইবলে আমি চুপ করে বসেও ছিলামনা।কয়েকদিন আগে সুবীরের মোবাইলে একটা ফোন আসে রেখা নামের কোন মহিলার।একবার নয় বারবার ফোনটা বেজে যায়।সুবীর তখন বাথরুমে ছিলো।আমার কিছুটা সন্দেহ হয়।আমি আমার পরিচিত একজনকে দিয়ে সুবীরের অফিসে খোঁজ নিয়ে সবকিছু জানতে পারি এবং তোমার বাবাকে সব জানাই।কিন্তু অতসীর দিক থেকে কোন সঙ্কেত না পেয়ে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলামনা।আমার পরিবারে যে নূতন অথিতি আসতে চলেছে সে আসবেই সুবীর না চাইলেও আসবে।সে আসার আগেই আমি আমার সমস্ত স্থাবরঅস্থাবর সম্পত্তি,মায় টাকা পয়সা পর্যন্ত সবকিছু অতসীর নামে লিখে যেতে চাই।আমার মেয়ের যদি প্রয়োজন হত তাহলে তাকেও কিছু অংশ দিতাম কিন্তু তেমন ঘরে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিইনি।আর যতটুকু আমি আমার জামাতাকে চিনি সে শ্বশুরবাড়ি থেকে এক কপর্দকও নেবেনা।
সুবীর কিছু বলার চেষ্টা করে।সুপ্রভাদেবী আঙ্গুল তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,"দু'নৌকায় পা দিয়ে চলা যায়না সুবীর।তোমাকে যে কোন একটা দিক বেছে নিতে হবে।তোমাকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি।কিন্তু মানুষ করতে পারিনি বুঝতেই পারছি।যদি তুমি মনে করো সবকিছু বাদ দিয়ে বৌমার সাথে সুখে সংসার করবে তাহলে খুবই ভালো।আর যদি তোমার মনে হয় তুমি ওই মেয়েটির সাথে এ ভাবেই সারাজীবন চলবে তাহলে তোমায় এই বাড়ি এবং আমাদের সকলকে তোমায় ছাড়তে হবে।আমি পনেরদিন তোমায় সময় দিলাম।তুমি তোমার সিদ্ধান্ত আমায় জানাবে।আমি আমার সিদ্ধান্ত সকলের সামনে জানিয়ে দিলাম।তোমাদের কারও কোন বক্তব্য থাকলে বলতে পারো।সুবীর মাথা নীচু করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।সকলেই সেখানে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে যে যার মত উঠে চলে যায়।অতসী তার ঘরের দিকে পা বাড়ালে তিনি বলেন,"বৌমা আজ থেকে তুমি আমার ঘরে শোবে।তোমার বাবাকে একটা ক্যাপখাট পাতিয়ে দেবো।দুপুরে তুমি তোমার ঘরে থেকো কিন্তু সুবীরের ছুটির দিনগুলি নয়।অতসী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
সুবীর মনেমনে ভেবেছিলো অতসী ঘরে ঢুকলে তার কাছে সে জানতে চাইবে কেন সে মাকে সব জানিয়েছে?কিন্তু সে সুযোগ সে আর পায়না।পনেরদিনের মাথায় সুবীর তার সামান্য কিছু জামাকাপড় নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো।এই পনেরদিন সুবীরের সাথে অতসীর মাঝে মাঝে দেখা হলেও কথা হয়নি।দুবেলা খাবার টেবিলে শ্বাশুড়ী বৌ হাজির থাকলেও সুবীরের সাথে মা বা বৌয়ের কোন কথা হয়না।সুবীরকে ব্যাগ নিয়ে আসতে দেখে সুপ্রভাদেবী তার বৌমার উদ্দেশ্যে বলেন,"দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিও বৌমা।"সুবীর বেরিয়ে যায়।হতভম্ব হয়ে অতসী সেখানে দাঁড়িয়েই চোখের জলে ভাসে।শ্বাশুড়ী এসে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেন,"কাঁদিস না মা।কটাদিন একটু কষ্ট কর।আমি তোকে বলছি ও ঠিক ফিরে আসবে।আর যখন ও ফিরবে ঠিক খাঁটি সোনা হয়ে ফিরবে।এসব সম্পর্ক হচ্ছে চোখের খিদে।আসল হিরে ছেড়ে বেশিদিন ও নকল হিরে নিয়ে থাকতে পারবেনা মা।এইছাড়া ওকে ভালো পথে আনার আমার আর কোন পথ জানা ছিলোনা।তুই যদি ভেঙ্গে পড়িস আমার লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে যাবে রে!যে আসছে এবার তুই তার কথা ভাব।দেখবি নূতন অথিতি আসার আগেই সুবীর তার ভুল বুঝতে পারবে এবং ফিরে আসবে।"
এই ঘটনার ছ'মাসের মধ্যেই সুবীর ফিরে আসে।মা,বাবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চায়।সুপ্রভাদেবী রাতে বৌকে নিজে সুবীরের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসেন। গুমোট গরমের পরে এক পশলা বৃষ্টি যেমন শরীর ও মনকে সতেজ করে এতদিন পর অতসী ও সুবীরের মনেও সেই সতেজতা সেই খুশি ফিরে এলো আর খুঁজে পেলো তারা আসল সুখের ঠিকানা।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
বিয়ের পর থেকেই অতসী দেখে আসছে এ বাড়িতে শ্বাশুড়ী মায়ের কথায় শেষ কথা।আর শেষ কথা হবেই না বা কেন?তিনি কখনো অন্যায় যেমন করেননা আবার কেউ অন্যায় করলেও তিনি তা প্রশ্রয় দেননা।সবসময় ন্যায়ের পক্ষে তিনি।কেউ কোন ভুল করলেই তিনি তাকে দু'কথা শুনাতে কখনোই ছাড়েন না।যুক্তি দিয়ে বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অপরের ত্রুটিগুলি তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দেন।তা সে তার স্বামী,ছেলে,বিয়েদারী মেয়ে বা জামাই যেই হোকনা কেন?
অতসীর বিয়ে হয়েছে মাত্র একবছর।সবাই তাকে আপন করে নিলেও যে মানুষটার হাত ধরে তার এই বাড়িতে প্রবেশ সেই মানুষটাকেই এই এক বছরেও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি।অতসীর প্রতি তার কোন ভালোবাসা আছে বলে সে মনে করেনা।সুবীর কেমন যন্ত্রচালিতের মত।যেটুকু কথা অতসী বলে সেটুকুরই শুধু জবাব পায়।বাড়তি একটা কথাও সুবীর তার সাথে বলেনা।রাতে একই খাটে পাশাপশি দুটি পুরুষ নারী প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মাঝে মধ্যে মিলিত হয় ঠিকই কিন্তু সে মিলনে ভালোবাসার থেকে শরীরের খিদেটাই যেন বেশি গুরুত্ব পায়। অতসী এই নিয়ে কোনদিনও কোন অভিযোগ স্বামী বা শ্বাশুড়ীর কাছে করেনি।এটাকে তার ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছে।ছোটবেলা থেকেই সে খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। ধনীর দুলালী না হলেও বাপের বাড়িতে খাওয়াপরার অভাব তার কোনদিনও হয়নি।গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে।প্রতিবেশীর এক বিয়ে বাড়িতে তাকে দেখে শ্বাশুড়ীমা সুপ্রভাদেবী পছন্দ করে এক কাপড়ে ছেলে সুবীরের বৌ করে আনেন এক মাসের মধ্যেই।
আজ কিছুদিন হোল অতসী তার ভিতর দ্বিতীয় এক প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়।সুবীর অফিস থেকে ফিরলে সে খুশি মনে সুখবরটা তাকে জানায়।কিন্তু সুবীরের চোখে মুখে সে কোন ভাবান্তর দেখতে পায়না।একটা জড়পদার্থের মত কথাগুলো শুনে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমে টিভি চালিয়ে বসে।অতসী অবাক হয়।এতো বড় সুখবরটা শোনার পরও কি করে সুবীর এতো নির্লিপ্ত থাকতে পারে?
পরদিন সুবীর অফিস থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে ঘরেই বসে থাকে।অতসী চা নিয়ে আসলে কোন ভণিতা না করেই সে অতসীকে জানায়, এ বাচ্চা সে চায়না আর এ নিয়ে কোন কথাও সে বাড়াতে চায়না।নার্সিংহোমে সে কথা বলে এসেছে আগমীকাল অফিস যাওয়ার সময় অতসীকে সাথে নিয়ে গিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে আসবে।অতসী হতভম্ব হয়ে যায়।কিছু বলতে চেষ্টা করে।সেটা বুঝতে পেরেই সুবীর তাকে জানায়,"আমি তো আগেই বলেছি এ নিয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাইনা।"কথাকটি বলেই সুবীর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ঘর অন্ধকার করে অতসী অনেকক্ষণ চোখের জলে নিজের কষ্টকে লাঘব করার চেষ্টা করে।শ্বাশুড়ীমায়ের ডাকে সে তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে এসে রাতের খাবারের তোড়জোড়ে হাত লাগায়।কিছুক্ষণ পর বিচক্ষণ সুপ্রভাদেবীর নজরে আসে তার আদরের বৌমার কাজের অন্যমনস্কতা আর ফোলা চোখ।দু'হাতে টেনে বুকের কাছে নিয়ে জানতে চান,"কি হয়েছে বৌমা?সুবীর কিছু বলেছে তোমায়?"মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে অতসী এই এক বছরের সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলে।সে যে মা হতে চলেছে এবং সুবীর যে এই বাচ্চা চায়না সে কথাও সে তার শ্বাশুড়ী মাকে জানায়।সুপ্রভাদেবী চমকে ওঠেন সুবীরের এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে।অতসীকে যেমন মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেন তিনি আছেন কোন ভয় নেই ঠিক তেমনই মৃদু বকাও দেন কেন এতদিন সে সুবীরের কোন কথা তাকে জানায়নি।
রাতে খাবার টেবিলে সুপ্রভাদেবী সকলকে জানান আগমীকাল সকালে তিনি তার বৌমাকে নিয়ে কালীঘাট পুজো দিতে যাবেন।ছেলে ও স্বামীর খাবার সকাল সকাল রান্না করে টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে যাবেন।সুবীর শুনে বলে,
---কিন্তু মা,কাল যে আমি সকালে তোমার বৌমাকে নিয়ে একটু বেরোবো ভাবছিলাম।
সুপ্রভাদেবী দৃঢ় কণ্ঠে ছেলেকে জানান,
---কাল শনিবার।আমি মায়ের মন্দিরে যাবো ওকে নিয়ে।তুমি আর একদিন ওকে নিয়ে বেরিও।
সুবীর আর কোন কথা না বলে খেয়ে তার ঘরে চলে যায়।
পরদিন শ্বাশুড়ী,বৌ পুজো দিয়ে বাড়িতে আসে।সুপ্রভাদেবী সকলকে জানান বাড়ির সকলের সাথে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।আগামীকাল রবিবার তিনি মেয়ে ও জামাইকে দুপুরে এখানে খেতে বলেছেন তারা আসলেই তাদের সামনে তিনি তার প্রয়োজনীয় কথাগুলি বলবেন।একমাত্র শ্বশুর অনিকেতবাবু ছাড়া সুবীর ও অতসী বুঝতেই পারেনা কি এমন কথা যার জন্য মা দিদি ও জামাইবাবুকেও এখানে আসতে বললেন।অতসী তার শ্বাশুড়ীকে এই এক বছরে খুব একটা ভালোভাবে চিনতে না পারলেও এটা সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে গতকাল রাতে তার মুখে নিজের ছেলের কথা শুনে তিনি কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন।তবে সেটা কি এবং সে সিদ্ধান্ত তার পক্ষে না বিপক্ষে এটা সে আন্দাজ করতে পারছেনা।আর সুবীর এ ব্যপারে নিশ্চিত এই এক বছরে সে যতটুকু অতসীকে চিনেছে তাতে করে অতসী তার মায়ের কাছে কখনোই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলবেনা।সুতরাং যা হচ্ছে বৃথা না ভেবে তাই হতে দাও।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ হলে তিনি সকলকে হাতমুখ ধুয়ে এসে ওখানেই থাকতে বলেন।কাজের মাসি এসে টেবিল পরিষ্কার করে যায়।সুপ্রভাদেবী এবার তার কথা শুরু করেন।"এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন আমার শ্বশুরমশাই।তিনি নিজে পছন্দ করে আমায় ঘরের বৌ করে এনেছিলেন।তখন আমার বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর।তার কথা ছাড়া এই সংসারে একটা কাজও হতনা।তোমার বাবা সংসার নিয়ে কোনদিনও মাথা ঘামাতেন না।বাবা আমাকে বলেছিলেন সংসারে শান্তি বজায় রাখতে গেলে সংসারে একজনকে একটু কড়া হতেই হয়।তানাহলে হাতের থেকে কাঁচের প্লেট পড়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার মত সংসারও ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়।তিনি নিজে হাতে সর্বদা আমার সাথে সাথে থেকে পরম স্নেহে অতি যত্নে নিজের মনের মত করে সংসারের উপযোগী করে তৈরি করেছিলেন আমায়।আমার শ্বাশুড়ীমা মানে তোমাদের দিদা তিনি আমাকে একমাত্র রান্নাবান্নার দিকটাই দেখিয়েছেন।আর বাকি ঘরে বাইরে যাবতীয় কাজ আমায় সাথে নিয়ে গিয়ে হাতে ধরে শিখিয়েছেন আমার শ্বশুরমশাই।জীবনে কোনদিন তাকে কোন অন্যায় করতে দেখিনি।মৃত্যুকলে তিনি তার সমস্ত বিষয়সম্পত্তি তার ছেলের মানে তোমাদের বাবার অনুমতি নিয়েই আমার নামে দানপত্র করে যান।আমি আজ পর্যন্ত তার শিক্ষার কোন অবমাননা করিনি।তোমাদের বাবার সাথে গতকাল আমার কথা হয়ে গেছে।আমি আজকে যে সিদ্ধান্তের কথা তোমাদের জানাবো তাতে তার কোন অমত নেই।
অতসীকে আমি নিজে পছন্দ করে সুবীরের বৌ করে নিয়ে এসেছি।আমি জানি সুবীরের সাথে তার এক অফিস কলিগের একটা সম্পর্ক রয়েছে।যে কিনা বিবাহিত।
সুবীর বলে ওঠে,"কি হচ্ছে মা সকলের সামনে?
সুপ্রভাদেবী হেসে বলেন,
---তুমি একটা অবৈধ সম্পর্ককে সকলের অলক্ষ্যে টেনে নিয়ে যেতে পারছো আর আমি সেটা সকলের সামনে বললেই দোষ?তোমার বিয়ের পর থেকেই আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম।কিন্তু বৌমার দিক থেকে কোন সারা না পেয়ে কোন সিন্ধান্তে উপনীত হতে পারছিলাম না।তাইবলে আমি চুপ করে বসেও ছিলামনা।কয়েকদিন আগে সুবীরের মোবাইলে একটা ফোন আসে রেখা নামের কোন মহিলার।একবার নয় বারবার ফোনটা বেজে যায়।সুবীর তখন বাথরুমে ছিলো।আমার কিছুটা সন্দেহ হয়।আমি আমার পরিচিত একজনকে দিয়ে সুবীরের অফিসে খোঁজ নিয়ে সবকিছু জানতে পারি এবং তোমার বাবাকে সব জানাই।কিন্তু অতসীর দিক থেকে কোন সঙ্কেত না পেয়ে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলামনা।আমার পরিবারে যে নূতন অথিতি আসতে চলেছে সে আসবেই সুবীর না চাইলেও আসবে।সে আসার আগেই আমি আমার সমস্ত স্থাবরঅস্থাবর সম্পত্তি,মায় টাকা পয়সা পর্যন্ত সবকিছু অতসীর নামে লিখে যেতে চাই।আমার মেয়ের যদি প্রয়োজন হত তাহলে তাকেও কিছু অংশ দিতাম কিন্তু তেমন ঘরে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিইনি।আর যতটুকু আমি আমার জামাতাকে চিনি সে শ্বশুরবাড়ি থেকে এক কপর্দকও নেবেনা।
সুবীর কিছু বলার চেষ্টা করে।সুপ্রভাদেবী আঙ্গুল তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,"দু'নৌকায় পা দিয়ে চলা যায়না সুবীর।তোমাকে যে কোন একটা দিক বেছে নিতে হবে।তোমাকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি।কিন্তু মানুষ করতে পারিনি বুঝতেই পারছি।যদি তুমি মনে করো সবকিছু বাদ দিয়ে বৌমার সাথে সুখে সংসার করবে তাহলে খুবই ভালো।আর যদি তোমার মনে হয় তুমি ওই মেয়েটির সাথে এ ভাবেই সারাজীবন চলবে তাহলে তোমায় এই বাড়ি এবং আমাদের সকলকে তোমায় ছাড়তে হবে।আমি পনেরদিন তোমায় সময় দিলাম।তুমি তোমার সিদ্ধান্ত আমায় জানাবে।আমি আমার সিদ্ধান্ত সকলের সামনে জানিয়ে দিলাম।তোমাদের কারও কোন বক্তব্য থাকলে বলতে পারো।সুবীর মাথা নীচু করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।সকলেই সেখানে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে যে যার মত উঠে চলে যায়।অতসী তার ঘরের দিকে পা বাড়ালে তিনি বলেন,"বৌমা আজ থেকে তুমি আমার ঘরে শোবে।তোমার বাবাকে একটা ক্যাপখাট পাতিয়ে দেবো।দুপুরে তুমি তোমার ঘরে থেকো কিন্তু সুবীরের ছুটির দিনগুলি নয়।অতসী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
সুবীর মনেমনে ভেবেছিলো অতসী ঘরে ঢুকলে তার কাছে সে জানতে চাইবে কেন সে মাকে সব জানিয়েছে?কিন্তু সে সুযোগ সে আর পায়না।পনেরদিনের মাথায় সুবীর তার সামান্য কিছু জামাকাপড় নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো।এই পনেরদিন সুবীরের সাথে অতসীর মাঝে মাঝে দেখা হলেও কথা হয়নি।দুবেলা খাবার টেবিলে শ্বাশুড়ী বৌ হাজির থাকলেও সুবীরের সাথে মা বা বৌয়ের কোন কথা হয়না।সুবীরকে ব্যাগ নিয়ে আসতে দেখে সুপ্রভাদেবী তার বৌমার উদ্দেশ্যে বলেন,"দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিও বৌমা।"সুবীর বেরিয়ে যায়।হতভম্ব হয়ে অতসী সেখানে দাঁড়িয়েই চোখের জলে ভাসে।শ্বাশুড়ী এসে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেন,"কাঁদিস না মা।কটাদিন একটু কষ্ট কর।আমি তোকে বলছি ও ঠিক ফিরে আসবে।আর যখন ও ফিরবে ঠিক খাঁটি সোনা হয়ে ফিরবে।এসব সম্পর্ক হচ্ছে চোখের খিদে।আসল হিরে ছেড়ে বেশিদিন ও নকল হিরে নিয়ে থাকতে পারবেনা মা।এইছাড়া ওকে ভালো পথে আনার আমার আর কোন পথ জানা ছিলোনা।তুই যদি ভেঙ্গে পড়িস আমার লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে যাবে রে!যে আসছে এবার তুই তার কথা ভাব।দেখবি নূতন অথিতি আসার আগেই সুবীর তার ভুল বুঝতে পারবে এবং ফিরে আসবে।"
এই ঘটনার ছ'মাসের মধ্যেই সুবীর ফিরে আসে।মা,বাবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চায়।সুপ্রভাদেবী রাতে বৌকে নিজে সুবীরের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসেন। গুমোট গরমের পরে এক পশলা বৃষ্টি যেমন শরীর ও মনকে সতেজ করে এতদিন পর অতসী ও সুবীরের মনেও সেই সতেজতা সেই খুশি ফিরে এলো আর খুঁজে পেলো তারা আসল সুখের ঠিকানা।
No comments:
Post a Comment