বদলাতে হয়
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
--আরে কখন থেকে বলছি বাজার যাও এরপর আর বাজারে মাছ পাবেনা ।
চিৎকার করে স্বামী রতনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে ওঠে সুপর্ণা।
শ্বাশুড়ীমা শুনতে পেয়ে বললেন,
--বৌমা আজ আর মাছ আনতে হবেনা। একদিন মাছ না খেলে কিছু হবেনা।বাইরে যা রোদ উঠেছে এক্ষুণি এসেই তো আবার অফিস ছুটবে।
--মা,তুমি আর ওকে আস্কারা দিওনা।তোমার ছেলে এমনিতেই খুব কুরে।এই বাজারটাই তো সংসারে শুধু করে।বাকি তো সব আমাকেই সামলাতে হয়।
শোভাদেবী হেসে ফেলেন তার আদরের বৌমার কথা শুনে। রতন বলে,
--কে যেন আমার বিয়ের সম্মন্ধটা দিয়েছিলো মা ?ও পুলিশে চাকরী করতো মা।ওই ঘটক আমাদের কাছে লুকিয়েছে।
শোভাদেবী হাসতে হাসতে বলেন,
--যা পারিস কর তোরা আমি চললাম।
রতনও ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
আজ পাঁচ বছর হয়েছে শোভাদেবীর স্বামী গত হয়েছেন।ছোটবেলা থেকেই মাছ ছাড়া তিনি একবেলাও ভাত খেতে পারেননা।ছেলের বিয়ে দিয়েছেন প্রায় বছর দশেক।একমাত্র নাতী হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করে।কাছেপিঠে কোন ভালো স্কুল না থাকায় এই ব্যবস্থা।
স্বামীর পারলৌকিক কাজের একদিন পর নিয়ম ভঙ্গের দিনে আত্মীয়-স্বজনরা চলে যাওয়ার পর শোভাদেবী একটু দই ও খই নিয়ে যখন খাওয়ার উদ্দোগ করছেন ঠিক তখনই সুপর্ণা তার শ্বাশুড়ীর সামনে হাজির হয়।
--মা, এসব খাচ্ছ কেন?
--খুব খিদে পেয়েছে মা।
--চলো ভাত খাবে।আমিও তো এখনও খাইনি।আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে।তোমার ছেলে ও নাতী তো ওই জ্ঞাতিদের সাথেই বসেছিলো।নাকি নিয়ম আছে।আমাকেও বলেছিলো।আমি তোমায় রেখে কি করে খাই বলো?
--সে কি বৌমা তুমি এখনো খাওনি?
--বাড়িতে আমরা চারটে প্রাণী।একজন না খেয়ে থাকবে আর আমরা সবাই খেয়ে নেবো মা, তাই কি হয় ?
--কিন্তু বৌমা আমি তো ওইসব খাবার খাবোনা।
--আপনি যদি না খান মা আমিও কিন্তু খাবোনা।
--এ তোমার অন্যায় জেদ বৌমা।তুমি কি জানোনা আজ থেকে আমি মাছ,মাংস এসব খাওয়া তো দূরের কথা ছোঁব পর্যন্ত না।
--মা আজকের দিনে এসব আর কেউ মানেনা।আজকের যুগে ঘরে বাইরে মেয়েরা সমান পারদর্শী।সে ঘর,অফিস দুইই সামলাচ্ছে।স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে যদি তাকে মাছ মাংস ছাড়া একবেলা খেয়ে,একাদশী করে দিনাতিপাত করতে হয় তাহলে তার রোজগারের টাকা দিয়ে তো অন্যেরাও মাছ,মাংস কিনতে পারেনা।কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা কি হয়?
একজন স্ত্রী মারা গেলে কই সেই স্বামীর তো কিচ্ছুটি ত্যাগ করতে হয়না।তাহলে একজন স্ত্রীকেই বা এসব করতে হবে কেন?
--অতসত বুঝিনা বৌমা।ছোটবেলা থেকে যা দেখে আসছি সেই বিধিনিষেধ থেকে আমি বেরোতে পারবোনা।আমার মা, ঠাকুমাকেউ দেখেছি তারাও স্বামীর মৃত্যুর পর কোনদিন মাছ,মাংস খাননি।
--যুগ পাল্টেছে মা।আগেকারদিনে মেয়েরা অল্প বয়সে বিধবা হত।তারা বাড়ির ভিতরেই থাকতো ঘর সংসার নিয়ে।প্রোটিন জাতীয় খাবার বন্ধ করা হত তাদের রীপুগুলোকে দমিয়ে রাখার জন্য।তারা ছিলো অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত।এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর তাদের কোন মনোবল ছিলোনা।তাই পণ্ডিতের দেওয়া বিধান তারা মানতে বাধ্য হত।
--আমি তোমার সাথে তর্কে পারবোনা।তবে আমি কিছুতেই আর মাছ , মাংস ছোঁবনা।
--তাহলে আজ থেকে আমিও মাছ খাওয়া ছেড়ে দেবো মা।এই বাড়িতে আর মাছ,মাংস আসবেনা।
--ছি, ছি বৌমা। আজকের দিনে এসব কথা বলতে নেই।
--বাবা চলে যাওয়াতে যদি আপনি মাছ ছেড়ে দিতে পারেন তাহলে আমরা কেন পারবোনা?আপনি কি একাই বাবাকে ভালোবাসতেন?আমরা ভালোবাসতাম না?
--উফফ বৌমা চুপ করো তুমি।লোকে শুনলে সবাই নিন্দা করবে।
--লোকের কথায় আমার কিছু যায় আসেনা মা।এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর থেকে দেখে আসছি আপনি মাছ ছাড়া একটা দিনও দুপুরে পেট ভরে ভাত খেতে পারেননা।আপনি যখন আধপেটা খেয়ে খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়বেন তখন কি আপনার ওইসব লোকেরা এসে আপনার পাশে দাঁড়াবে? আপনি কষ্ট পেলে বাবার আত্মা কি শান্তি পাবে?আত্মা বলে যদি সত্যিই কিছু থাকে মা তাহলে বাবা কোনদিনও শান্তি পাবেননা।বাবা আপনাকে কম ভালোবাসতেন না।
রতন এসে দাঁড়িয়ে সুপর্ণার শেষের কথাগুলো শুনে বললো,
--তোমার বৌমা তো ঠিক কথায় বলছে মা।তুমি যদি মাছ না খাও আমরা তিনজনেও মাছ আর খাবোনা।এই বাড়িতে আর মাছ আনা হবেনা।
--এ কি অন্যায় জেদ তোদের বলতো?
--কোনটা অন্যায় মা?স্বামীর মৃত্যুর পর মাছ, মাংস খাওয়া নাকি যে মাছ ছাড়া খেতে পারেনা তার সামনে বসে তাকে মাছ না দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে মাছ খাওয়া।ঠিক আছে মা।আপনি দই চিড়ে খাবেন তো ওই থেকে আমাকেও একটু দেবেন আজ থেকে আপনি যা যা করবেন আমিও তাই করবো।
--তোমার মুখে কিছুই আটকায় না বৌমা। দাও আমায় কি খেতে দেবো দাও ।যা দেবে আমায় তাই খাবো।দয়া করে তুমি আর ওইসব কথা বোলোনা।আমার রতনের অকল্যাণ হবে।
সেই থেকে সুপর্ণার বাড়িতে আগের মতই খাওয়াদাওয়া চলতে থাকে।