Thursday, August 16, 2018

এই হয়
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

      প্রথম যেদিন সংসার চালানোর জন্য এই লাইনে ঢোকে বকুল তখন একটা ভয় একটা আতঙ্ক তার ভিতর ছিলো।বাবা এ্যাকসিডেন্ট করে পা হারালেন।জমানো কিছু ছিলোনা বললেই চলে।মায়ের একটা একটা গয়না বিক্রি হতে হতে অবশিষ্ট আর কিছুই থাকলোনা।পেট ভরে খাওয়ার সংস্থান শেষ হোল।ছোট দুটি ভাই বোন, মা,বাবার এই কষ্ট আর দেখতে পারছিলোনা আজকের বকুল মায়ের আদরের বনলতা।
        নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বনলতা।তিন ভাইবোন।সেই বড় সন্তান।বাবা ছোটখাটো একটা কারখানায় চাকরী করেন।অভাব থাকলেও তিনবেলা পেট পুরে খাওয়ার সংস্থান তাদের ছিলো। দারিদ্রতা তাদের সুখের সংসারে কোন ছাপ ফেলতে পারেনি।কষ্ট করে হলেও  তিনজনেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কারখানা থেকে ফেরার পথে বাসের পিছনের চাকায় বামপায়ের হাড় ভেঙ্গে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যায় হরিসাধনবাবুর।রাস্তার লোকেরায় তাকে কাছাকাছি একটা সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যায়।এমতাবস্থাতেও তিনি জ্ঞান হারাননি।পকেট থেকে ছোট্ট একটি ডায়রী বের করে তিনি একজনের হাতে দিয়ে বলেন যে রমেশ মজুমদারকে ফোন করতে  হরিসাধনবাবু এ্যাকসিডেন্ট করেছেন।হাসপাতালের নামটা জানিয়ে দিতে।
       বাড়িতে ফোন না থাকায় বাড়ীওয়ালার নম্বরটা তার কাছে থাকতো।সুবিধা-অসুবিধায় ফোন করলে তিনি ঠিক বনলতাদের ঘরে খবরটা পৌঁছে দিতেন।রমেশবাবু মানুষটাও খুব ভালো।ফোন পেয়েই তিনি কিছু টাকা নিয়ে বনলতার সাথে হাসপাতালে উপস্থিত হন।সরকারি নিয়ম-কানুনের ধাক্কায় তখনও হরিবাবু ভর্তি হতেই পারেননি।রমেশবাবুর সোর্সে যখন তিনি ভর্তি হলেন ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরনের ফলে তিনি জ্ঞান হারান।
      সারাটা রাত রমেশবাবু বনলতার সাথে দৌড়াদৌড়ি,ছুটোছুটি করে রক্তের জোগাড় করে ভোরের দিকে বাড়িতে আসেন।কিন্তু বনলতা হাসপাতালেই থেকে যায়।আর তখনই তার পরিচয় হয় আরশিমাসির সাথে।বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ থেকে আটত্রিশ বছর, খুব সুন্দর দেখতে।জাতিতে মুসলমান হলেও তিনি শাঁখা-সিঁদুর পড়েন।দীর্ঘসময় একজায়গায় বসে থাকার ফলে বনলতা ও আরশিমাসির মধ্যে অনেক কথায় হয়।
      আরশিমাসি ভালোবেসে সেলিমকে বিয়ে করেছিলো।সেলিমের একটা স্টেশনারি দোকান ছিলো।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল আলো করে আসে তাদের ছেলে আশিক।এর কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়ে সেলিমের দু'টো কিডনিই নষ্ট হয়ে।ঠিকভাবে দোকানে সময় দিতে না পারায় দোকানও আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়ে।এদিকে সেলিমের চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার দরকার।দোকানটা নিজেই আবার দাঁড় করাবে ভেবে সে মাল আনতে সেলিমের পরিচিত সকলের কাছেই যায়।কিন্তু সেলিমের এই অবস্থার কথা জেনে কেউই বাকিতে মাল দিতে রাজি হয়না।কিন্তু একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা সে পায় যার বিনিময়ে সে তার বহুমূল্যবান জিনিসটি খুইয়ে ফেলে।তাই টাকার দরকার পড়লেই সে তার শরীর বিক্রি করতে ছুটে যেত ওই পিশাচের কাছে।আর সেই শুরু।এখন শুরু হয়েছে ডায়ালাইসিস।সরকারি হাসপাতালে সব ওষুধ পাওয়া যায়না।প্রচুর দাম ওষুধের।এখন আর এক পুরুষ নয় নিত্য নূতন পুরুষসঙ্গ।সেই আদিকাল থেকে চলে আসছে অভাবী,অশিক্ষিত পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে,রোগের চিকিৎসা করতে নারীর দেহব্যবসা।
---কিন্তু বিশ্বাস করো বনলতা আমি এটা চাইনি।আমি তো সেলিমকে ভালোবেসে ওর সন্তানের মা হয়ে সুখি জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম।কিন্তু খোদা বাধ সাধলেন।তিনি এমন একটা রোগ আমার সেলিমকে দিলেন যা থেকে সে কোনদিন মুক্ত হতে পারবেনা।এই ডায়ালাইসিস করে যে কটাদিন বাঁচবে।ডাক্তার বলেছেন কিডনি পাল্টালে ও আরও কিছুদিন বাঁচবে।আমার সে সামর্থ্য কোথায়?নিজের কিডনি দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ডাক্তারবাবু বললেন কি সব মেলেনি আমার শরীরের সাথে।
      কথাগুলো বলে খুব কাঁদতে থাকে আরশি।বনলতা তার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে,
---কিন্তু দিদি,তুমি এই শাঁখা,সিঁদুর কেন পর?
---যখন ওই নোংরা কাজগুলো করি স্বামী,সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে তখন আমি আরশি।আর যখন আমি সেলিমের বৌ আর আমার সন্তানের মা তখন আমি রাধা।এইগুলো পরি তার কারন কি জানো?তোমাদের ধর্মে আছে শাঁখা,সিঁদুর স্বামীর আয়ু বাড়ায়।যদি আমার সেলিম আরও কিছুদিন বেশি বাঁচে তার মঙ্গল কামনায় আমি এসব পরি।মসজিদে সিন্নি মানত করি,মন্দিরে যেয়ে পূজা দিই।যে যা বলে তাই করি।কিন্তু আমার সেলিম দিনকে দিন দূর্বল হয়ে পড়ছে।আমি জানিনা সত্যিই আমি জানিনা আমার কপালে খোদা এতো কষ্ট কেন লিখেছেন?আজ পর্যন্ত কাউকেই এসব বলতে পারিনি।আজ তোমায় মন খুলে সব বললাম।নিজেকে একটু হালকা মনে হচ্ছে।তুমি ভেবোনা তোমার আব্বু ভালো হয়ে যাবেন।
       সকাল দশটা নাগাদ বনলতার মা ও ছোট ভাই আসে।তখন আরশি চলে গেছে।হরিসাধনবাবুর অপারেশানও হয়ে গেছে।বাম পা টা মালায় চাকীর উপর থেকে কাটা গেছে।অনেকদিন এখন হাসপাতালে থাকতে হবে।অফিস থেকে সামান্যকিছু টাকা পাওয়া গেছিলো তাই দিয়ে কটাদিন চললো।বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে যাচ্ছে।মা, মেয়ে মিলে ঠিক করে একটা বস্তির মধ্যে কম টাকায় ঘর ভাড়া করে চলে এলো।সরকারী হাসপাতাল তাই চিকিৎসার জন্য কোন টাকা খরচ হচ্ছেনা।রমেশবাবু অবশ্য দু'মাসের ভাড়ায় মকুব করে দিয়েছেন।
      কিছুতেই আর সংসার চলেনা।লতা পড়া বন্ধ করে দেয়।টেষ্ট পরীক্ষা দিয়েও অভাবের তাড়নায় পড়ায় মন বসাতে পারেনা।লোকের বাড়ি কাজ করতে শুরু করে।সারাটাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে।মাস গেলে তবে তো মাইনে।কিন্তু টাকা তো নিত্য দরকার।নূতন কাজ ধরেছে কেউই আগাম দিতে রাজি নয়।বাবাও বাড়ি ফিরে এসেছেন।একটা ক্রাস কেনা একান্ত দরকার।বাথরুমে যেতে গেলে মায়ের কাঁধের উপর ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে হয় বাবাকে।মায়েরও খুব কষ্ট হয়।কিন্তু কোন উপায়ই লতা দেখতে পারছেনা।হঠাৎ মনেপড়ে আরশির কথা।কাজের বাড়িগুলোতে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বিকালে আর আসবেনা জানিয়ে সে মাকে এসে বলে,
---আমি একটা কারখানায় কাজের খোঁজ পেয়েছি।আজ কথা বলতে যেতে হবে।অনেক রাতে ফিরবো।
     নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়।জীবনে  দেখা স্বপ্নগুলিকে বাবা,মা আর ছোট দু'টি ভাইবোনের জন্য নিজের মনেই ঢেউএর সাথে ভাসিয়ে দেয়।সেদিন ভাগ্যিস আরশির বাড়িটা কোথায় জেনে নিয়েছিলো।মা যাওয়ার সময় বারবার করে বলে দিলেন, "দিনকাল ভালোনা সাবধানে যাস।"যে স্বেচ্ছায় বলিকাঠে মাথা দিতে চলেছে তার কাছে ভালো আর মন্দের কোন তফাৎ সত্যিই থাকেনা।
       সেই শুরু। বিকালের দিকের কাজের বাড়ির কাজগুলো ছেড়ে দিলো বনলতা।সকালের দিকে কাজ করেই বাড়িতে এসে নিজেকে একটু পরিপাটি করে বাড়িতে কারখানায় কাজে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়ে।কিছুটা হলেও সংসারের হাল ফেরে।মাঝে মাঝে বাবা,মা খুব দুঃখ করেন তার এই অসীম পরিশ্রম নিয়ে।বনলতার তাতে কোন অনুতাপ নেই।বরং বাড়ির মানুষগুলো পেট পুরে তিনবেলা খেতে পারছে এই শান্তিটা সে নিজের জীবনের সুখ শান্তির বিনিময়ে এনে দিতে পেরেছে তাতেই সে খুশি।
      এইভাবেই বনলতার জীবন এগিয়ে যেতে থাকে।সে আস্তে আস্তে ঝিয়ের কাজগুলো ছেড়ে দেয়।কয়েক বছরের মধ্যে বাবাও মারা যান।বোনটার আঠারো বছর বয়স হওয়ার সাথে সাথেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে।কারন বনলতা জানতো এ সত্য বেশিদিন চেপে রাখা যাবেনা।একটা ভালো ছেলের সন্ধানও পায়।ভাইটাও মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হয়।মোটামুটি যেটুকু না করলে নয় ঠিক সেইভাবেই বোনটার বিয়ে দিয়ে দেয়।মায়ের শরীরও বেশি ভালো নয়।ডাক্তার ওষুধ লেগেই আছে।ইতিমধ্যে বোনের বিয়ের আগেই বস্তির বাড়িটা ছেড়ে একটা ঘর ভাড়া করে উঠে আসে।রোজ দুপুর একটা দেড়টা নাগাদ বেরোয় আর রাত দশটা এগারোটা বেজে যায় তার বাড়ি ফিরতে।মায়ের বা বাড়ির কারও কোনদিন কোনই সন্দেহ হয়নি কারন সময়টা তার সব সময় নির্দিষ্ট ছিলো।ভাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই চাকরির চেষ্টা শুরু করে।ঈশ্বরের অপার কৃপায় একটা চাকরী জুটিয়ে ফেলে।সরকারি না হলেও মা ও দিদি খুশি।বনলতা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।এবার সে তবে এই পথ থেকে সরে আসতে পারবে।কিন্তু ভগবান তার কপালে লিখেছেন অন্যকিছু।সে পৃথিবীতে এসেছে শুধু অন্যকে দিতে,নিজে কিছু পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে সে জম্মায়নি। সপ্তাহ খানেক সে বেরোনো বন্ধ করে দিয়ে ঘরের কাজ আর মায়ের সেবা নিয়েই সময় কাটিয়ে দিতে লাগলো।
        একদিন সে লক্ষ্য করলো ভাই অফিস থেকে এসেই মায়ের ঘরে ঢুকে আস্তে আস্তে কথা বলছে।সে ভায়ের জলখাবার নিয়ে ঢুকলে দু'জনেই চুপ করে যায়।ভাই বেশ রাগত স্বরেই বলে,
---তোর হাতে খেতে আমার ঘৃনা হয়।আমি ভাবতেই পারিনা এতো পাপের কাজ তুই কি করে করতিস?তোর মুখ দেখাও পাপ।
---কি বলছিস তুই ভাই?মা তুমি কিছু বলবেনা?  সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই ছাড়া আমার আর কোন পথ ছিলোনা।
---তাই বলে এই পাপের পথে তোকে নামতে হোল?নাহয় না খেতে পেয়ে সব মারা যেতাম।কি এমন হত তাতে?আমার তো ভাবতেও গা ঘিনঘিন করছে এতদিন তোর ওই পাপের টাকায় আমরা খেয়েছি। ওই জন্যই মনেহয় তোদের বাবা এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
      বনলতা পাথর।তার জীবনের সুখের বিনিময়ে যাদের বাঁচিয়ে রেখেছে,যাদের এই ওবধি এনে দাঁড় করিয়েছে তাদের এ কোন রূপ?মানুষ স্বার্থপর হয় সে জানতো কিন্তু তাইবলে মা,ভাই?কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যেয়ে সে মায়ের পাদু'টি জড়িয়ে ধরতে যায়।কিন্তু তার মা পা সরিয়ে নিয়ে বললেন,
---ওই পাপের হাতে তুই আমায় ছুবিনা।বেরিয়ে যা আমার সামনের থেকে।তোর মুখ দেখাও পাপ!
       সেলিম অনেকদিন আগেই মারা গেছে।সেই রাতেই বনলতা আবার বকুল হয়েই ফিরে আসে আরশির দোরগোড়ায়। বকুল,আরশি আর আশিক এখন এক বাড়িতেই থাকে।

                       শেষ 

No comments:

Post a Comment