একই রূপ
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
বাথরুমে যাওয়ার পথে মায়ের ঘর থেকে এতো রাতে কথা শুনে অতসী একটু চমকেই গেলো।মা কাকে যেন বলছেন,"এ বিয়ে যেভাবেই হোক তোমায় আটকাতে হবে।তুমি তোমার ছেলেকে যা বলার বলবে।এই ব্যপারে আমি মেয়ের সাথে কোন কথা বলতে পারবোনা।এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।সম্পর্কে ওরা ভাই-বোন।এ বিয়ে হতে পারেনা।"এই কথা শুনে অতসী আর সেখানে দাঁড়ায়না। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে।অরিন্দম সম্পর্কে তার দাদা?ভাবতেই পারছেনা।মা সধবার বেশে থাকেন ঠিকই কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছে তার বাবা অফিসের কাজে বাইরে যেয়ে আর ফিরে আসেননি।খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু খবর পাওয়া যায়নি।আর এটাকেই সে সত্যি মনে করে বিশ্বাস করেছে।তারমানে মা তাকে মিথ্যা বলেছেন।বাবা এই শহরেই থাকেন তার ছেলের সাথে।
অরিন্দমের সাথে মাত্র দু'বছরের আলাপ।ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে।মাকে সবকিছু জানানোয় মা অরিন্দমকে দেখতে চেয়েছিলেন।অরিন্দমের সাথে আলাপচারিতায় মা তার বাবার নাম ও বাড়ি কোথায় জেনেই কেমন গুম মেরে যান। আর কোন কথা না বলে শরীর খারাপ লাগছে এই অজুহাতে ঘরে চলে যান।অরিন্দম চলে যাওয়ার পর সে মায়ের ঘরের কাছে এসে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।কয়েকবার ডাকার পর তিনি সাড়া দিয়ে বলেন,"একটু ঘুমালেই শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে।তুমি ডিনার সেরে নাও।আমি আজ আর কিছু খাবোনা।আর আমাকে বিরক্ত কোরোনা এসে।"
নীতাদেবী ফিরে যান একুশ বছর আগের জীবনে।তখন ছেলে অরিন্দমের বয়স চার আর অতসীর ছ'মাস।সুখি সংসার।নীতাদেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা আর তার স্বামী ছিলেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে।দূর সম্পর্কের এক বোন থাকতো দু'জন বাইরে বেরিয়ে গেলে বাচ্চাদু'টিকে সামলানোর জন্য।একদিন সকালে দু'জনে একসাথেই যে যার অফিসে বেরিয়ে যান।স্কুল থেকে ফিরে এসে বারবার বেল বাজিয়েও কোন লাভ না হওয়ায় ফ্লাটের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তিনি ঘরে ঢুকে সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে যান।অরিন্দম ও অতসী তখন নিচের বেডরুমে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু তিনি তার বেডরুমে ঢুকে যা দেখেন তা তিনি কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেননি।রূপা তার খাটের উপর আর পাগলের মত আভাষ তাকে ইচ্ছেমত ছিড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে।আপ্রাণ চেষ্টা করছে রূপা নিজেকে রক্ষা করার ওই পশুটার হাত থেকে।কিন্তু পারছে কোথায়?নীতাকে দেখতে পেয়ে রূপা চিৎকার করে ওঠে, "দিদি তুমি আমাকে বাঁচাও।"হাতের কাছে একটা পিতলের ফুলদানী ছিলো।রাগে ঘেন্নায় সেটা দিয়ে সজোরে আভাষের পিঠে নীতা আঘাত করে।আভাষ আ-আ-আ-বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে।রূপা দৌড়ে এসে নীতাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"দিদি, জামাইবাবু আজ এতো ড্রিংক করেছেন তার কোন জ্ঞানই নেয়।আমি অনেক কাকুতিমিনতি করেছি।উনি শোনেননি।জ্ঞান থাকলে তো শুনবেন!"
সেই মুহূর্তে বাচ্চাদু'টিকে আর রুপাকে সাথে নিয়ে ঘর ছেড়েছে নীতা।পরে বহুবার আভাষ এসেছে ক্ষমা চেয়ে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।কিন্তু নীতা যায়নি।অরিন্দমকে একটা ভালো বোডিং স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল নীতা।কিন্তু আভাষ কেস করে সন্তানদের তার কাছে রাখার জন্য।রায় বেরোয় যেহেতু দুটি সন্তান তাই ছোটটি থাকবে মায়ের কাছে আর বড়টি তার বাবার কাছে।রায় বেরোনোর পর একবারই মাত্র নীতা ছেলেকে দেখতে বোডিং স্কুলে গেছিলো।তারপর আর কখনো যোগাযোগ রাখেনি।
আজ এতোগুলো বছর বাদে নীতা বাধ্য হলেন আভাষকে ফোন করতে। আর এদিকে সারাটা রাত ছটফট করতে করতে ভোর হওয়া মাত্র মায়ের ঘরের ল্যান্ডফোনে রিডায়াল করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে আভাষ চৌধুরীর সাথে কথা বলে সকালেই পৌঁছে যায় অতসী তার বাবার বাড়ি।ঘরে ঢুকেই সে আভাষ চৌধুরীর সামনাসামনি হয়ে প্রথমেই যে কথাটা বললো তা হোল,
---আমি নীতা চৌধুরীর মেয়ে।কাল পর্যন্ত আমি জানতামনা আমার বাবা কে?শুধু নামটাই শুনেছিলাম।আপনাদের মধ্যে কি হয়েছিলো আমি বা আমার দাদা জানিনা।কিন্তু আমরা দু'জনেই কেউ পিতৃস্নেহ কেউবা মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি।পৃথিবীতে যা কখনোই সম্ভব নয় ঠিক তেমনই একটি ঘটনা আমার ও আমার দাদার জীবনে ঘটেছে।এসবকিছুর জন্য আপনি না মা দায়ী আমি জানিনা।মাকে যতটুকু জেনেছি তিনি তার সংসার জীবনে কখনোই কোন অন্যায় করেননি।আর বাকি থাকলেন আপনি!এখন আমরা বড় হয়েছি নিশ্চয় জানার আমার অধিকার আছে কি এমন ঘটেছিলো যে মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো?
এতক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো তিনি শুনছিলেন।মেয়েটিকে দেখতে তার নিজের মত হলেও সাহস ও কথা বলার ভঙ্গিমাটা পুরো তার মায়ের মত।তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়ের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন,
---একুশ বছর আগে যে ঘটনার জন্য তোমার মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো তারজন্য সম্পূর্ণভাবেই আমি দায়ী।অনেকবার তোমার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।কিন্তু অত্যন্ত জেদী তোমার মা।যা আমি জ্ঞানে করিনি তা জানা সত্বেও তিনি আমায় ক্ষমা করেননি।আমি অনুতপ্ত।কিন্তু সবকিছু আমার হাতের বাইরে ছিলো।পারলে আমায় ক্ষমা কোর।
---আমি এখানে এসেছিলাম মা যেন না জানেন।দাদাকে যা বলার আজই তাকে বলে দেবেন।সে ইচ্ছা করলে মাকে দেখতে যেতেই পারে।তবে আমার সাথে আর কখনোই আপনাদের দেখা হবেনা।কথাগুলো বলে অতসী গটগট করে হেঁটে চলে গেলো।আভাষ চৌধুরী একুশ বছর আগের জেদী,একরোখা নিতা কে যেন পূণরায় দেখতে পেলেন।
শেষ
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
বাথরুমে যাওয়ার পথে মায়ের ঘর থেকে এতো রাতে কথা শুনে অতসী একটু চমকেই গেলো।মা কাকে যেন বলছেন,"এ বিয়ে যেভাবেই হোক তোমায় আটকাতে হবে।তুমি তোমার ছেলেকে যা বলার বলবে।এই ব্যপারে আমি মেয়ের সাথে কোন কথা বলতে পারবোনা।এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।সম্পর্কে ওরা ভাই-বোন।এ বিয়ে হতে পারেনা।"এই কথা শুনে অতসী আর সেখানে দাঁড়ায়না। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে।অরিন্দম সম্পর্কে তার দাদা?ভাবতেই পারছেনা।মা সধবার বেশে থাকেন ঠিকই কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছে তার বাবা অফিসের কাজে বাইরে যেয়ে আর ফিরে আসেননি।খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু খবর পাওয়া যায়নি।আর এটাকেই সে সত্যি মনে করে বিশ্বাস করেছে।তারমানে মা তাকে মিথ্যা বলেছেন।বাবা এই শহরেই থাকেন তার ছেলের সাথে।
অরিন্দমের সাথে মাত্র দু'বছরের আলাপ।ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে।মাকে সবকিছু জানানোয় মা অরিন্দমকে দেখতে চেয়েছিলেন।অরিন্দমের সাথে আলাপচারিতায় মা তার বাবার নাম ও বাড়ি কোথায় জেনেই কেমন গুম মেরে যান। আর কোন কথা না বলে শরীর খারাপ লাগছে এই অজুহাতে ঘরে চলে যান।অরিন্দম চলে যাওয়ার পর সে মায়ের ঘরের কাছে এসে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।কয়েকবার ডাকার পর তিনি সাড়া দিয়ে বলেন,"একটু ঘুমালেই শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে।তুমি ডিনার সেরে নাও।আমি আজ আর কিছু খাবোনা।আর আমাকে বিরক্ত কোরোনা এসে।"
নীতাদেবী ফিরে যান একুশ বছর আগের জীবনে।তখন ছেলে অরিন্দমের বয়স চার আর অতসীর ছ'মাস।সুখি সংসার।নীতাদেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা আর তার স্বামী ছিলেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে।দূর সম্পর্কের এক বোন থাকতো দু'জন বাইরে বেরিয়ে গেলে বাচ্চাদু'টিকে সামলানোর জন্য।একদিন সকালে দু'জনে একসাথেই যে যার অফিসে বেরিয়ে যান।স্কুল থেকে ফিরে এসে বারবার বেল বাজিয়েও কোন লাভ না হওয়ায় ফ্লাটের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তিনি ঘরে ঢুকে সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে যান।অরিন্দম ও অতসী তখন নিচের বেডরুমে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু তিনি তার বেডরুমে ঢুকে যা দেখেন তা তিনি কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেননি।রূপা তার খাটের উপর আর পাগলের মত আভাষ তাকে ইচ্ছেমত ছিড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে।আপ্রাণ চেষ্টা করছে রূপা নিজেকে রক্ষা করার ওই পশুটার হাত থেকে।কিন্তু পারছে কোথায়?নীতাকে দেখতে পেয়ে রূপা চিৎকার করে ওঠে, "দিদি তুমি আমাকে বাঁচাও।"হাতের কাছে একটা পিতলের ফুলদানী ছিলো।রাগে ঘেন্নায় সেটা দিয়ে সজোরে আভাষের পিঠে নীতা আঘাত করে।আভাষ আ-আ-আ-বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে।রূপা দৌড়ে এসে নীতাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"দিদি, জামাইবাবু আজ এতো ড্রিংক করেছেন তার কোন জ্ঞানই নেয়।আমি অনেক কাকুতিমিনতি করেছি।উনি শোনেননি।জ্ঞান থাকলে তো শুনবেন!"
সেই মুহূর্তে বাচ্চাদু'টিকে আর রুপাকে সাথে নিয়ে ঘর ছেড়েছে নীতা।পরে বহুবার আভাষ এসেছে ক্ষমা চেয়ে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।কিন্তু নীতা যায়নি।অরিন্দমকে একটা ভালো বোডিং স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল নীতা।কিন্তু আভাষ কেস করে সন্তানদের তার কাছে রাখার জন্য।রায় বেরোয় যেহেতু দুটি সন্তান তাই ছোটটি থাকবে মায়ের কাছে আর বড়টি তার বাবার কাছে।রায় বেরোনোর পর একবারই মাত্র নীতা ছেলেকে দেখতে বোডিং স্কুলে গেছিলো।তারপর আর কখনো যোগাযোগ রাখেনি।
আজ এতোগুলো বছর বাদে নীতা বাধ্য হলেন আভাষকে ফোন করতে। আর এদিকে সারাটা রাত ছটফট করতে করতে ভোর হওয়া মাত্র মায়ের ঘরের ল্যান্ডফোনে রিডায়াল করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে আভাষ চৌধুরীর সাথে কথা বলে সকালেই পৌঁছে যায় অতসী তার বাবার বাড়ি।ঘরে ঢুকেই সে আভাষ চৌধুরীর সামনাসামনি হয়ে প্রথমেই যে কথাটা বললো তা হোল,
---আমি নীতা চৌধুরীর মেয়ে।কাল পর্যন্ত আমি জানতামনা আমার বাবা কে?শুধু নামটাই শুনেছিলাম।আপনাদের মধ্যে কি হয়েছিলো আমি বা আমার দাদা জানিনা।কিন্তু আমরা দু'জনেই কেউ পিতৃস্নেহ কেউবা মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি।পৃথিবীতে যা কখনোই সম্ভব নয় ঠিক তেমনই একটি ঘটনা আমার ও আমার দাদার জীবনে ঘটেছে।এসবকিছুর জন্য আপনি না মা দায়ী আমি জানিনা।মাকে যতটুকু জেনেছি তিনি তার সংসার জীবনে কখনোই কোন অন্যায় করেননি।আর বাকি থাকলেন আপনি!এখন আমরা বড় হয়েছি নিশ্চয় জানার আমার অধিকার আছে কি এমন ঘটেছিলো যে মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো?
এতক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো তিনি শুনছিলেন।মেয়েটিকে দেখতে তার নিজের মত হলেও সাহস ও কথা বলার ভঙ্গিমাটা পুরো তার মায়ের মত।তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়ের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন,
---একুশ বছর আগে যে ঘটনার জন্য তোমার মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো তারজন্য সম্পূর্ণভাবেই আমি দায়ী।অনেকবার তোমার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।কিন্তু অত্যন্ত জেদী তোমার মা।যা আমি জ্ঞানে করিনি তা জানা সত্বেও তিনি আমায় ক্ষমা করেননি।আমি অনুতপ্ত।কিন্তু সবকিছু আমার হাতের বাইরে ছিলো।পারলে আমায় ক্ষমা কোর।
---আমি এখানে এসেছিলাম মা যেন না জানেন।দাদাকে যা বলার আজই তাকে বলে দেবেন।সে ইচ্ছা করলে মাকে দেখতে যেতেই পারে।তবে আমার সাথে আর কখনোই আপনাদের দেখা হবেনা।কথাগুলো বলে অতসী গটগট করে হেঁটে চলে গেলো।আভাষ চৌধুরী একুশ বছর আগের জেদী,একরোখা নিতা কে যেন পূণরায় দেখতে পেলেন।
শেষ
No comments:
Post a Comment