Friday, August 31, 2018

একটি মালা
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

কতদিন পরে দেখলাম তোমায়,
ঠিক সেই আগের মতই আছো,
হাসিটা আছে আজও অমলিন।
কাছে থাকতে কোনদিনই বুঝিনি-
কতটা ভালবেসেছি তোমায়,
দূরে সরে গিয়ে বুঝতে শেখালে।
কতবার বলতে চেয়েছো মনের কথা,
আমি হেসেই উড়িয়ে দিয়েছি প্রতিবার।
তোমার অনুপস্থিতিই আমায় বুঝিয়েছিলো,
তুমি আমার কে? 
লতা দিয়ে শিউলির মালা গেঁথে-
শরতের সকালে আমায় পরিয়ে
 দিয়েছিলে,
খুব রেগে মালাটা ছিড়ে ফেলেছিলাম,
একটুও রাগ না করে বলেছিলে,
"একদিন আমার হাতে মালা পরার জন্য
তুই ব্যাকুল হবি!"
তারপরই হঠাৎ নিরুদ্দেশ-

আজ চাইছি তোমার হাতে পরতে ফুলমালা,
দেবে কি? ওই হাতে আমায় পরিয়ে-
একটি রজনীগন্ধার মালা।

# নন্দা

Tuesday, August 28, 2018

ভুগতে হবে
        নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

কত কতদিন চলে গেলো,
ফিরে তো এলেনা আর,
তোমার ব্যথায় কাঁদে হৃদয়,
জীবনে আসে না ভোর।

তোমাকে ছাড়ায় এগিয়ে চলেছি,
সাথে আছে সন্তানেরা,
মনের মাঝে শুধুই হাহাকার,
অভাগা সব আমরা।

এ প্রতীক্ষা হবেনা শেষ-
সময়ের সাথে জীবনও এগোবে,
স্মৃতিরা সব জমাট বাঁধা,
সারাজীবন আমাদের ভোগাবে। 

Sunday, August 26, 2018


      সঙ্গী
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

         বাস থেকে নামার সাথে সাথেই লোডশেডিং হয়ে গেলো।গলির ভিতর থেকে অনেকটাই হেঁটে তবে সুচরিতাকে বাড়ি পৌঁছাতে হয়।বাড়ি বলতে যা বোঝায় ঠিক তা নয়।একটা বাড়িতে সে পেয়িংগেষ্ট থাকে।তবু আস্তানা যখন ওটাই ওটাকেই বাড়ি তো বলতেই হবে।
        দ্রুত একমনে হাঁটতে থাকে।শীতকালের রাত।রাত ন'টাতেই রাস্তা শুনশান।পিছনে কেউ একজন আসছে বুঝতে পারে।কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে যায় সুচরিতা।আরও দ্রুত পা চালায়।বাড়ির সামনে এসে পিছন ফিরে দেখে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।সরাসরি প্রশ্ন ছোড়ে,
---কি চায় আপনার?
---আমার?আপনার কাছে কিছুই চাইনা। 
---মানে?
---মানে আর কিছুনা;এটা আমার বাড়ি। তা আপনি এই বাড়িতে কি জন্য?
     সুচরিতা আমতা আমতা করে বলে,
---না মানে আমি এই বাড়িতে .....
       কথা শেষ হয়না।বারান্দার লাইট জ্বলে ওঠে।অঙ্কুরের মা হাসি মুখে ছেলেকে বলেন,
---তোর এতো দেরি হোল বাবা?ট্রেন কি লেট ছিলো? 
     সুচরিতা এবার পিছনে চলে যায় অঙ্কুর গিয়ে মাকে প্রনাম করে।সুচরিতা পাশ কেটে তার ঘরের তালা খুলতে ব্যস্ত।একই বারান্দা দিয়ে তার রুমে ঢুকতে হয়।তিনি বলেন,
---তুই রাগ করবি বলে তুতুন তোকে জানাইনি।এ সুচরিতা,তুই বাইরে বাইরে থাকিস।ওকে আমি পেয়িংগেষ্ট রেখেছি।একটু কথা তো বলতে পারি।ও ভালো চাকরী করে রে! খুব ভালো মেয়ে।যতক্ষণ ঘরে থাকে আমার কাছেই থাকে।হাতে হাতে কত কাজ করে দেয় আমায়,একদম মেয়ের মত।
---তা উনি কি পুলিশে চাকরী করেন?
    মা একগাল হেসে দেন আর সুচরিতা লজ্জায় মুখ নিচু করে থাকে।
---না না ও পুলিশে চাকরী করেনা।ও একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী করে।ভালো রান্নাও করে।কোথায় আমি ওকে রেঁধে খেতে দেবো উল্টে ও আমার সব কাজ সেরে রান্না করে আমার খাবার গুছিয়ে রেখে তবে অফিসে বেরোয়।মনেহয় ও আমার মা।
     মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই অঙ্কুর বলে,
---মা, আমি কয়েকদিন থাকবো।আজই বাইরে দাঁড় করিয়েই সব বলে ফেলবে?
        সকালে মা এসে বিছানার ভিতরেই কফি দিয়ে যান।সেটা খেয়েই অঙ্কুর আবার শুয়ে পড়ে।ন'টা নাগাদ উঠে মুখ হাত ধুয়ে পেপারটা হাতে করে রান্নাঘরে উঁকি মেরে মাকে বলে,
---মা,সকালবেলার মত সুন্দর করে এককাপ কফি দাও তো।
      অন্নদাদেবী কফি এনে ছেলের সামনে রেখে বললেন,
---তুতুন সকালের কফিটা সুচরিতা করেছিলো।এখন তো ও বেরিয়ে গেছে তাই আমার হাতের করা কফিটুকুই খা।
---তুমি পেয়িংগেষ্ট রেখেছো নাকি কাজের লোক রেখেছো মা।
---ছি!এ কি কথা?এভাবে বলতে হয়?আমি কি ওকে এসব করতে বলেছি।আমারই তো দু'বেলা ওকে রান্না করে খাবার দেওয়ার কথা।কিন্তু ও কিছুতেই শোনেনা।নিজে যতটুকু সময় পায় আমারই কাজ করে।আমার দরকার ছিলো একজন সঙ্গীর;যার সাথে আমি একটু কথা বলে সময় কাটাতে পারি।তোর বাবার বন্ধু রবিনকাকুকে বলেছিলাম সেই কথা।উনি এসে অনুরোধ করলেন মেয়েটিকে ঘর ভাড়া দেওয়ার জন্য।আমি না বলে দেবো ভেবেছিলাম।কিন্তু খুব করে বললেন উনি।গ্রামে বাড়ি।সকাল পাঁচটায় উঠে ট্রেন ধরে আর বাড়িতে পৌঁছাতে রাত দশটা হয়ে যায় কোন কোন দিন।দিনকাল ভালোনা।তাই একটা ভালো ঘর খুঁজছিলো শুধু থাকার জন্য।প্রথম প্রথম ও হোটেল থেকেই খাবার নিয়ে ঢুকতো।আর দুপুরে অফিস ক্যান্টিনে খেতো।কিন্তু এতো মিষ্টি স্বভাব মেয়েটার ভালো না বেসে পারা যায়না।তখনও ও আমার কাছে এসে টুকটাক কাজ করতো।আমি না বললেও শুনতোনা।তখন আমিই বললাম আমার কাছেই খাওয়ার জন্য।তুই কি ভাবছিস আমি এই খাবারের জন্য ওর কাছ থেকে কোন টাকা নেবো।কেন আমার ছেলে কি কম রোজগার করে নাকি?আমার তো শুধু একজন সঙ্গীর দরকার ছিলো।তুই বিয়ে করলে আমি কি ঘর ভাড়া দিয়ে সঙ্গী খুঁজতাম?
---আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।পুরো রামায়ন শুনিয়ে গেলে।তা রবিনকাকু কি বললো?মেয়েটি ভালো তো?আজকাল কাউকেই বিশ্বাস করা যায়না।যা দিনকাল পড়েছে!
---হ্যাঁ সে সব আমি শুনে নিয়েছি।উনাদের গায়েরই মেয়ে।শুধু মা আছেন।মেয়েটি পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলো।তাই চাকরী পেতে খুব অসুবিধা হয়নি।একটু গুছিয়ে নিয়ে মাকেও নিয়ে আসবে বলেছে।আর আমি নিজেও তো দেখছি সত্যিই মেয়েটি খুব ভালো।
---হ্যাঁ -ওই মেয়ে মেয়ে করে নিজের ছেলেটাকে ফেলে দিওনা।
     অন্নদা দেবী ছেলের কানটা ধরে বললেন,"তাই বল তোর হিংসা হচ্ছে!"

    সেদিন সন্ধ্যা-
      অফিস থেকে ফিরে আসলে অঙ্কুরই গেট খুলে দিয়ে একটু পাশে সরে দাঁড়ায়।এর আগে বার কয়েক মা বলে গেছেন,"কিরে তুই তো বাড়িতে এসে সন্ধ্যা হলেই বেরিয়ে পড়িস।আজ বেরোবি না?"
       কিন্তু মায়ের তুতুন কোন উত্তর করেনি।হয়তো সে নিজেও জানেনা কেন আজ সে বেরোল না।বাস্তব এটাই কিছুতেই আজ তার মন সায় দিলোনা,ভিতর থেকে কোন তাগিদ সে অনুভব করলোনা বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার।সুচরিতা চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেলো। অঙ্কুরও এসে নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লো।সুচরিতা ফ্রেস হয়ে মাসিমার কাছে এসে বসে জানতে চায়,
---চা খেয়েছেন?
---কোথায় আর খেলাম!তোর দেরি হচ্ছে এই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ---তুই বরং তিনকাপ কফি কর।
---কিন্তু তুমি তো এখন চা খাও।আমি তুমি চা ই খাবো।
---এতো পরিশ্রম তোকে করতে হবেনা।
---এমন কি পরিশ্রম?দু'কাপ চা আর এককাপ কফি করতে।তুমি এখানেই বসো আমি করে দিচ্ছি।আর হ্যাঁ আজ রাতে রুটির তরকারি কি হবে?নলিনী রুটি করে দিয়ে গেছে?
---রাতে ভাবছি ঢোকার ডালনা করবো।তুতুন রুটি দিয়ে ভালো খায়।আমিই করবো,তোকে আজ করতে হবেনা।সারাদিন পরিশ্রম করে সবে তো আসলি।আর হ্যাঁ নলিনী রুটি করে দিয়ে গেছে।
      দু'কাপ চা আর এককাপ কফি করে সুচরিতা।কফি নিয়ে মা ছেলেকে দিয়ে আসেন।সুচরিতা ঢোকার ডালনার আলু কুটতে কুটতে বলে, "তুমি আমায় দেখিয়ে দাও আমি করছি।সে কোন নিষেধই শোনেনা।"অন্নদাদেবী কৃতিম রাগ দেখিয়ে বলেন,
---তুই একটা কথা আমার শুনিসনা।তোর মায়ের সাথে আমার দেখা হোক;দু'জনে মিলে তোকে শাষন করবো।
---মাসিমা একটা কথা বলার ছিলো।
---হ্যাঁ বলনা কি বলবি !
     কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুচরিতা বলে,
---কাল তো শনিবার, আমি অফিসের পথেই বাড়ি চলে যাবো।সোমবার ছুটি নিয়েছি।ভালো একটা ঘর ভাড়া পেয়েছি।এবার মাকে নিয়েই ফিরবো।
    অন্নদাদেবী আকাশ থেকে পড়েন।এই তো একমাসও হয়নি।এর মধ্যেই চলে যাবি?অবশ্য কিছু বলারও নেই।তোর মা ও তো একা রয়েছেন।
---আসলে সবাইকেই বলছিলাম তাই খোঁজটা একটু তাড়াতাড়ি পেলাম।তোমার এখানে আলাদা একটা রান্নাঘর থাকলে তো যেতামই না।
---তুতুনকে বলি ওদিকে একটা রান্নাঘর করে দিতে।
---সেটা তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।এতদিন মা একাএকা থাকবেন?তুমি রান্নাঘর শুরু করো আমি আবার চলে আসবো।
---কি বলবো বলতো?মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।
    রাতের খাবারটা আজ সুচরিতা ঘরে নিয়ে যায়।এক'টাদিন সে মাসিমার সাথে গল্প করতে করতে খেয়েছে।অন্নদাদেবী বুঝতে পারলেন সুচরিতা তুতুননের সামনে বসে খেতে চায়না।মার মুখটা গম্ভীর দেখে অঙ্কুর জানতে চায়,
---তোমার কি হয়েছে মা?
---মেয়েটা খাবারটা নিয়ে ঘরে চলে গেলো।আগামীকাল বাড়ি যাবে।একটা ভালো বাড়ি পেয়েছে,মাকে নিয়ে সোমবার ফিরবে।
     বিদুৎ এর সক খেলে যেমন হয় অঙ্কুরের বুকের ভিতরটা ঠিক তেমন করে উঠলো।কিন্তু কতটুকু জানে বা চেনে সে সুচরিতাকে যার চলে যাওয়ার খবরে সে এতটা আঘাত পেলো।'তবে কি আমি সুচরিতাকে ......।কিন্তু প্রেম কি জীবনে এভাবে হঠাৎ করেই আসে? '

   পরদিন সকাল-
     খুব ভোরে অঙ্কুর নিজেই  এককাপ কফি করে খেয়ে বেরিয়ে যায়।খুব তাড়াতাড়ি করে বাইরের কাজগুলো সেরে সুচরিতার অফিস বেরোনোর আগেই ফিরে আসার ইচ্ছা থাকলেও দশটার আগে কিছুতেই সে ফিরতে পারেনা।সুচরিতা অফিস বেরোয় সাড়ে ন'টায়।মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।এই আঠাশ বছর জীবনে কোনদিন যা হয়নি আজ কেন সেটা হচ্ছে অঙ্কুরের বুঝতে আর বাকি নেই।সে যে সুচরিতার প্রেমে পড়েছে এটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।কিন্তু সে তো সুচরিতা সম্পর্কে কিছুই জানেনা।যে টুকু সে তার মায়ের কাছে শুনেছে।এ দুদিন কোন কথাও হয়নি।সুচরিতার কথা মনে পড়লেই বুকের ভিতর কেমন যেন করছে।এ অনুভূতি ব্যক্ত করার ক্ষমতা তার নেই।সবসময় তার কথা ভাবতে ভালো লাগছে।বন্ধুরা কেউ কেউ রাস্তায় দেখে কত টিটকারি করলো এবার এসে রাস্তায় বেরোয়নি কেন মাসিমার পেয়িংগেস্টের কারনে কিনা জানতে চেয়ে হাসাহাসি করলো।কিন্তু তার যেন কোন কিছুই ভালো লাগছিলোনা।কতক্ষণে সে বাড়িতে ফিরবে!কিন্তু তাড়াহুড়ো করে এসেও সে সুচরিতার দেখা পেলোনা।অনেকক্ষণ আগেই সে বেরিয়ে গেছে।সে যে অফিস থেকে আজ বাড়ি ফিরবেনা এটা সে মায়ের কাছেই জেনেছে।আপাতত যে কাজটা তার করতে হবে তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো।মাকে ডেকে বললো,
---মা, চলো একটু ফাঁকা জমিটা গিয়ে দেখি।তুমি মোটামুটি আমায় একটা আইডিয়া দাও কোথায় কি করতে হবে।
---কি ব্যপারে?ঘরের কথা বলছিস?এবারই শুরু করবি?
---হ্যাঁ,তুমি যখন করতে বললে আর আমি বেশ কিছুদিন ছুটি নিয়ে এসেছি এবারই শুরু করি।একটু পরেই মিস্ত্রী আসবে সন্ধ্যার আগেই ইঁট,বালি, সিমেন্ট চলে আসবে।
---ওরে বাবা! তোর তো দেখছি প্রচন্ড তাড়া।
---তাড়া আর কিসের?তুমি বললে কথাটা;বাড়িতে আছি তাই শুরু করে দিলাম।
   কিন্তু অঙ্কুর মনেমনে বললো, 'তাড়া তো আছেই মা।পারলে আমি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ন্যায় আজই ঘরটা তুলে দিতাম।'আনুসঙ্গিক সব কাজ মিটিয়ে পরেরদিন থেকেই শুরু হোল সুচরিতার থাকা ঘর লাগোয়া একটি রান্নাঘর।
     দু'দিন মায়ের সাথে গ্রামে কাটিয়ে সোমবার মাকে নিয়ে দুপুরের দিকে সুচরিতা অঙ্কুরদের বাড়িতে আসে।গেট বারান্দার গ্রিল খোলায় ছিলো।সারা বাড়ি বালি আর বালি।বারান্দায় সিমেন্টের বস্তা জড়ো করা।বাড়িতে ঢুকেই সে মাকে নিয়ে সোজা মাসিমার ঘরে ঢোকে।বেলা তখন তিনটে হবে।টেবিলে মা ও ছেলে খাচ্ছে।সুচরিতা ঢুকেই বললো,
---এতো বেলায় খেতে বসেছেন মাসিমা?
 ---ওমা চলে এসেছিস?
---হ্যাঁ মাসিমা।সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে যাবো যা সামান্য জিনিসপত্র আছে টা নিয়ে।
---কিন্তু তোর তো যাওয়া হবেনা মা।তুতুনকে বলেছিলাম একটা রান্নাঘর থাকলে তুই আর দিদি এখানেই থাকতে পারতিস।ও ভালো কথা দিদি কোথায়?
---মা ড্রয়িংরুমে বসে আছেন।
    অন্নদাদেবী তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বসবার ঘরে এলেন।অঙ্কুরের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোর করে নমস্কার করে বললেন,
---আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।
---আমারও আপনাকে খুব চেনা লাগছে, কেন বলুন তো?
---আপনার নাম টা যদি জানতে পারতাম।
---আমার নাম অন্নদা বসু।
        সোফা ছেলে লাফিয়ে উঠলেন সুচরিতার মা।
---অনু? আমি ঠিকই ধরেছিলাম সই!
---তুই আমার সেই রাধা?দেখ কি কান্ড!
কত যুগ পরে দু'জনের দেখা।বয়সের ভারে ছেলেবেলার সব স্মৃতি ভুলে গেলেও তোর কথা এখনও মাঝে মাঝেই মনে পড়ে।এখনও মাঝে মধ্যে তোকে স্বপ্ন দেখি।
---এইভাবে যে আবার কোনদিন দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।
   দুই সখি পুরনো দিনের গল্পে মেতে উঠলেন।সুচরিতা 'থ'।সে দুই বন্ধুর মিলনের দৃশ্য দেখছে আর ভাবছে বাইরেই বুঝি মানুষের বয়স বারে ভিতরে তারা সেই কিশোর কিশোরীই থাকে।অন্নদাদেবী সুচরিতাকে বললেন,
---ওরে ও সুচরিতা যা না মা ফ্রিজ থেকে মাকে একটু মিষ্টি আর জল এনে দে।অনুরাধাদেবীর দিকে মুখ করে বললেন,"মেয়েটা বড্ড লক্ষ্মী রে তোর।এই তোর মনে আছে আমাদের পুতুলের ছেলেমেয়ের বিয়ের কথা?এবার আমরা এ কথা রাখবো কি বলিস?"
     অঙ্কুর খেয়ে ঘরে চলে গেছিলো।সুচরিতাকে রান্নাঘরে যেতে দেখে সেও তড়িঘড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো।সুচরিতা তখন ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করছে।অঙ্কুর তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো যেন ফ্রিজের ভিতরেই তার কাজ।
---কিছু বলবেন?
---না মানে একটু জল খেতাম।
---কিন্তু এখন ঠান্ডা জল খেলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে।
---তাহলে এমনি জলই খাই।
   কথাটা বলে জল ভরা বোতলের দিকে এগিয়ে গেলো।পূণরায় ফিরে এসে বললো,
---একটা কথা ছিলো।
---হ্যাঁ বলুন।
---ঘরটা পুরো শেষ হতে দিন পনের লাগবে।
---তো ?
---না -তাই বলছিলাম আর কি!
    সুচরিতা হেসে দিয়ে মিষ্টির প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু সে হাসি যে একজনের বুকে সেল হয়ে ঢুকলো তা কি অপরজন বিন্দুমাত্র বুঝতে পারলো?

     সেদিন সন্ধ্যায় -
      মা মেয়েকে বললেন,
---দেখা সূচী আজ তো ওই বাড়িতে যাওয়া আর হলনা।তুই ওখানে ফোন করে বলে দে আমরা ওই বাড়ি নেবোনা।আমরা এখানেই থাকবো।
---তা কি করে হয় মা?আমি কথা দিয়েছি।
  "হয় হয় খুব হয়"।বলতে বলতে অন্নদাদেবী ওদের ঘরে ঢুকলেন।
---তুই ফোন করে বলে দে তোরা যাচ্ছিস না।সই চল আমরা একটু ঘুরে আসি পাশের বাড়ি থেকে।
  কথাকটি বলে তিনি তার সইকে যে চোখ টিপলেন তা সুচরিতার নজর এড়ালোনা। বেরিয়ে গেলেন দুই সখি যেন সদ্য দুই কিশোরী।
    এ ঘরে সুচরিতা একা আর ওদিকে অঙ্কুর ঘরে একা।কিছুক্ষণ পরে অঙ্কুর দরজার এপাশ থেকে বললো,
---ভিতরে আসতে পারি?
---হ্যাঁ আসুন।
---একটা কথা ছিলো।বলছিলাম কি কয়েকদিনের মধ্যেই তো ঘরটা হয়ে যাবে যদি এখানেই আপনারা থেকে .......
   চুপ করে গেলো অঙ্কুর।সুচরিতা বললো,
---যাওয়া তো হচ্ছেনা বুঝতে পারছি।তা আর কিছু বলবেন?
    অঙ্কুর আমতা আমতা করছে দেখে সুচরিতা একটা খাম বের করে অঙ্কুরের হাতে দিয়ে বলে,
---ঘরটা করতে আপনার তো অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তাই এটা রাখুন।
---আমি কি আপনার কাছে এটা চাইতে এসেছি?
---তা আপনি তো বললেন না কি জন্য এসেছেন।তাই আমি ভাবলাম...
---আপনার ভাবনার তারিফ না করে পারছিনা।
  রাগে গজগজ করতে করতে অঙ্কুর বেরিয়ে গেলো।মাথায় তখন তার আগুন জ্বলছে।খামটা এনে খাটের উপর রাগ করে ছুড়ে ফেলে দিলো।সেটি খুলে দেখার প্রয়োজনও বোধ করলোনা।অন্নদাদেবী সুচরিতাকে ডেকে বললেন,
---আমি তোর মায়ের সাথে একটু গল্প করি।দুজনে একসাথেই খাবো।তুই একটু কষ্ট করে তুতুনকে খাবারটা দিয়ে দিবি মা?
---ঠিক আছে,খাবারটা দিয়ে দিচ্ছি কিন্তু আমিও তোমাদের সাথেই খাবো।
   অঙ্কুর গিয়ে খাবার টেবিলে বসলো।সুচরিতা অঙ্কুরের গম্ভীর মুখ দেখে অবলীলায় জানতে চাইলো-
---কি হয়েছে আপনার?খামটা দিয়েছি বলে রাগ করেছেন আমার উপর?খুলে দেখেছেন?
---না খুলিনি।মায়ের বাড়ি ওটা আমি মাকেই দিয়ে দেবো রাতে।
   সুচরিতা আঁতকে উঠে বললো,
---না-ওটা আপনার।মাসিমাকে দেবেননা। আপনিই খুলে দেখবেন খেয়ে গিয়ে।
     অঙ্কুর কোন কথা না বলে গম্ভীর মুখে খেয়ে উঠে গেলো।তবে বারকয়েক সুচরিতার সাথে চোখাচোখি হওয়াতে প্রতিবারই সে দেখেছে সুচরিতা মুচকি মুচকি হাসছে।ঘরে ঢুকেই সে খামটা নিয়ে খুলে দেখলো তার মধ্যে একটা চিঠি।পড়তে শুরু করলো ----
অঙ্কুর,
        তুমি যে মুখে কথাটা বলতে পারবেনা আমি জানতাম।মা আর মাসিমা যে আমাদের সুযোগ করে দিলেন এবং সেই সুযোগে তুমি আমার কাছে আসবে এটাও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। সেটা বুঝতে পেরেই আমি চিঠিটা লেখা শুরু করলাম।তোমার ভাবনাটা মা আর মাসিমার পরে ছেড়ে দাও।তোমার আর আমার মনের ইচ্ছাটা তাদেরও মনের ইচ্ছা।এতো লাজুক তুমি?এতো সুযোগ পেয়েও 'ভালোবাসো' কথাটা মুখে বলতেই পারলেনা?তোমার সমস্যাটা আমি সলভ করে দিলাম।হ্যাঁ-আমিও তোমায় ভালোবাসি।এতো তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে গেলো নিজেও বুঝতে পারলামনা।তাই তো পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আজ এসে যখন দেখলাম ঘর শুরু হয়েছে তখন বুঝতে পারলাম-ভালোবাসাটা আমার একতরফা নয়।কাল অফিস ছুটির পর কথা হবে।
                                    ইতি
                                       সুচরিতা
    নীচুতে একটা ঠিকানা দেওয়া।অঙ্কুর চিঠিটা পড়েই দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখে সুচরিতারা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে।অগত্যা সেও ঘরে এসে প্রসন্নমনে সকালের কফির অপেক্ষায় শুয়ে পড়ে। 
                     (ইতি)

 
 


       

Saturday, August 18, 2018

আমার খোকা
 নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

খোকারে তোকে,বহু যতন করে,
মানুষ করেছি যে ওরে,
এত কটুকথা কেন শোনাস বাবা?
চোখ ভরে শুধু জলে।

আদরে যতনে কোলে কোলে তোরে,
ঘুরে বেরিয়েছি সদা,
সারারাত বুকে জড়িয়ে রেখেছি,
বুজিনি চোখের পাতা।

দুষ্টুমি ভরা দিনগুলি তোর,
ছিলো বড়ই ভালো,
গায়ে কখনও হাত তুলিনি,
মুখ করিনি কালো।

শরীর খারাপে রাত জেগেছি,
তোর বাবা আমি একসাথে,
একমুহূর্ত করিনি আড়াল,
জড়িয়ে রেখেছি দুইহাতে।

কত ঝড়-ঝাপটা এসেছে জীবনে,
এতটুকু লাগাতে দিইনি আঁচড়,
খোকা তুই আজ কত বড় হলি?
কথায় কথায় বসাস কামড়!

তোকে বুকে করে অনাহারে কেটেছে,
কত বিনিদ্র রাত,
কোনদিন তোকে দিইনি সামান্য কষ্ট,
মনেকরে দেখ বাপ।

আমরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হয়েছি,
বড় হয়েছিস তুই ওরে,
বড়ই করতে পেরেছি শুধু,
মানুষ করতে পারিনি তোরে।

# নন্দা  17-8-18  
উর্দেশ্য এক
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

পথের ধারে ফুঁটে থাকে,
নাম হারা কত ফুল,
দেবতার চরন পায়না তারা,
তারাও কি করেছে ভুল?

জীবনের প্রতি পাতায় পাতায়,
হিসাবের ফল শূ্ন্য,
দুস্থের সেবা করলে পরে-
হয় কি কিছু পুণ্য?

নদী ছুটে চলে সমুদ্র পথে,
পথ যে তাদের ভিন্ন,
মানবের স্বপ্ন ভালোভাবে বাঁচা,
কিছু পাপ কিছু পুণ্য।

#নন্দা


Friday, August 17, 2018

অনিচ্ছায়
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

মায়াবী রাতের স্বপ্নগুলো,
হারালো অন্ধকারে-
ফাগুন দিনের ভালোবাসা,
ডুবলো বুঝি ঝড়ে।

হেথায় হোথায় খুঁজি তারে,
যে ছিলো আমার পাশে;
হাতটি ছেড়ে পালালো কোথায়?
কাছে ছিলো যে ভালোবেসে।

পরশ তার আজও পাই আমি,
ভুলবো তারে কেমন করে?
আসেনা আর সেই রাত ফিরে-
তার কথায় পড়ে মনে বারেবারে।

আমি পাগলিনী তার বিরহে,
সেতো ফিরবেনা আর;
বিধাতার লিখনে ছেড়েছে আমায়,
দোষ কিছু নেই তার।

# নন্দা    17-8-18 1-40 AM

Thursday, August 16, 2018

   কেন করলে এমন
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

     রক্তিমের পুরনো কাগজ পত্র ঘাটতে ঘাটতে অনেকদিন আগের একটা খাম পায় পূবালী।কিছুটা কৌতুহলবশত খামটা খুলেই হাতের লেখাটা খুব চেনা মনেহয় পূবালীর।আগেই ইতি টা দেখে নেয়। শরীরটা ঠকঠক করে তখন কাঁপছে তার ।তারমানে রক্তিমকে কিংশুক চিনতো।  চিঠিটা পড়তে শুরু করে।
      রক্তিম,
            বন্ধুর থেকেও তুই আমার কাছে আর বেশিকিছু।যে কথা তোকে আজ বলবো সে কথা আর কাউকে বলার আমার সাহস নেই।একমাত্র তুইই জানিস আমি পূবালীকে কতটা ভালোবাসি।বিয়ের দিনক্ষণ ও ঠিক হয়ে গেছে এটাও তোর অজানা নয়।কিন্তু যা তুই জানিসনা সেটাই তোকে আজ লিখে জানছি কারন মুখে বলার সাহস আজ আর আমার নেই।বাড়ির কেউই জানেনা আমার আয়ু আর মাস তিনেক।আমার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।লাষ্ট স্টেজ।পূবালী আমার সন্তানের মা হতে চলেছে।আমি পূবালীকে আমার অসুখের কথা নিজ মুখে বলতে পারবোনা।আমি ওর সাথে খামোখা খুব খারাপ ব্যবহার করেছি যাতে ও আমায় ভুলে যেতে পারে।বন্ধু, আজ হাত জোর করে তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো-আমায় ফিরিয়ে দিবিনা কিন্তু ভাই।আমি তো চললাম।কিন্তু যারা একটু ছায়া পেলে বেঁচে যেতে পারে তুই সেই চেষ্টাটা করিস। অন্যায় আবদার হলেও তোর কাছে ছাড়া পূবালী ও ওর সন্তানকে বাঁচানোর দাবি আর কার কাছে করবো বল?তুই পূবালীকে ওই তারিখেই বিয়ে করিস আর  আমার সন্তানের পিতৃপরিচয়টা দিস।এটা করতে না পারলে ওই জীবন দু' টিই শেষ হয়ে যাবে রে! অনেক আশা নিয়ে তোর কাছে এই কথাটা বললাম।আমি জানিনা আত্মা মানুষের মৃত্যুর পর থাকে কিনা।যদি সত্যিই থেকে থাকে আমার আত্মা শান্তি পাবে তোদের তিনজনকে দেখে।আর একটা কথা কোনদিন তুই এ কথা পূবালীকে জানাবিনা।
                            ইতি হতভাগ্য
                                 কিংশুক
      চিঠিটা পড়া শেষ করে পূবালী সেখানেই বসে থাকে।মনে পড়তে থাকে কিংশুকের বলা শেষ কথাগুলো।এতো ভালোবাসতো কিংশুক আর সে কিনা ওই একদিনের কথাতেই তাকে এতো ঘৃণা করতে শুরু করেছিলো।কিংশুক ঠিকই বলেছিলো সত্যিই আমি ওর ভালোবাসার যোগ্য নই।ভাবতে থাকে পূবালী সাতপাঁচ।ভাবনায় ছেদ পড়ে পিতাপুত্রের হৈ হৈ করে আগমনে।রক্তিম এসে পূবালীকে জিজ্ঞাসা করে,"কি হয়েছে?"সে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা তার হাতে দেয়।চিঠিটা হাতে নিয়ে রক্তিম পূবালীর মাথায় হাত রাখে।আর পূবালী রক্তিমকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। 
এই হয়
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

      প্রথম যেদিন সংসার চালানোর জন্য এই লাইনে ঢোকে বকুল তখন একটা ভয় একটা আতঙ্ক তার ভিতর ছিলো।বাবা এ্যাকসিডেন্ট করে পা হারালেন।জমানো কিছু ছিলোনা বললেই চলে।মায়ের একটা একটা গয়না বিক্রি হতে হতে অবশিষ্ট আর কিছুই থাকলোনা।পেট ভরে খাওয়ার সংস্থান শেষ হোল।ছোট দুটি ভাই বোন, মা,বাবার এই কষ্ট আর দেখতে পারছিলোনা আজকের বকুল মায়ের আদরের বনলতা।
        নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বনলতা।তিন ভাইবোন।সেই বড় সন্তান।বাবা ছোটখাটো একটা কারখানায় চাকরী করেন।অভাব থাকলেও তিনবেলা পেট পুরে খাওয়ার সংস্থান তাদের ছিলো। দারিদ্রতা তাদের সুখের সংসারে কোন ছাপ ফেলতে পারেনি।কষ্ট করে হলেও  তিনজনেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কারখানা থেকে ফেরার পথে বাসের পিছনের চাকায় বামপায়ের হাড় ভেঙ্গে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যায় হরিসাধনবাবুর।রাস্তার লোকেরায় তাকে কাছাকাছি একটা সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যায়।এমতাবস্থাতেও তিনি জ্ঞান হারাননি।পকেট থেকে ছোট্ট একটি ডায়রী বের করে তিনি একজনের হাতে দিয়ে বলেন যে রমেশ মজুমদারকে ফোন করতে  হরিসাধনবাবু এ্যাকসিডেন্ট করেছেন।হাসপাতালের নামটা জানিয়ে দিতে।
       বাড়িতে ফোন না থাকায় বাড়ীওয়ালার নম্বরটা তার কাছে থাকতো।সুবিধা-অসুবিধায় ফোন করলে তিনি ঠিক বনলতাদের ঘরে খবরটা পৌঁছে দিতেন।রমেশবাবু মানুষটাও খুব ভালো।ফোন পেয়েই তিনি কিছু টাকা নিয়ে বনলতার সাথে হাসপাতালে উপস্থিত হন।সরকারি নিয়ম-কানুনের ধাক্কায় তখনও হরিবাবু ভর্তি হতেই পারেননি।রমেশবাবুর সোর্সে যখন তিনি ভর্তি হলেন ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরনের ফলে তিনি জ্ঞান হারান।
      সারাটা রাত রমেশবাবু বনলতার সাথে দৌড়াদৌড়ি,ছুটোছুটি করে রক্তের জোগাড় করে ভোরের দিকে বাড়িতে আসেন।কিন্তু বনলতা হাসপাতালেই থেকে যায়।আর তখনই তার পরিচয় হয় আরশিমাসির সাথে।বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ থেকে আটত্রিশ বছর, খুব সুন্দর দেখতে।জাতিতে মুসলমান হলেও তিনি শাঁখা-সিঁদুর পড়েন।দীর্ঘসময় একজায়গায় বসে থাকার ফলে বনলতা ও আরশিমাসির মধ্যে অনেক কথায় হয়।
      আরশিমাসি ভালোবেসে সেলিমকে বিয়ে করেছিলো।সেলিমের একটা স্টেশনারি দোকান ছিলো।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল আলো করে আসে তাদের ছেলে আশিক।এর কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়ে সেলিমের দু'টো কিডনিই নষ্ট হয়ে।ঠিকভাবে দোকানে সময় দিতে না পারায় দোকানও আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়ে।এদিকে সেলিমের চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার দরকার।দোকানটা নিজেই আবার দাঁড় করাবে ভেবে সে মাল আনতে সেলিমের পরিচিত সকলের কাছেই যায়।কিন্তু সেলিমের এই অবস্থার কথা জেনে কেউই বাকিতে মাল দিতে রাজি হয়না।কিন্তু একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা সে পায় যার বিনিময়ে সে তার বহুমূল্যবান জিনিসটি খুইয়ে ফেলে।তাই টাকার দরকার পড়লেই সে তার শরীর বিক্রি করতে ছুটে যেত ওই পিশাচের কাছে।আর সেই শুরু।এখন শুরু হয়েছে ডায়ালাইসিস।সরকারি হাসপাতালে সব ওষুধ পাওয়া যায়না।প্রচুর দাম ওষুধের।এখন আর এক পুরুষ নয় নিত্য নূতন পুরুষসঙ্গ।সেই আদিকাল থেকে চলে আসছে অভাবী,অশিক্ষিত পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে,রোগের চিকিৎসা করতে নারীর দেহব্যবসা।
---কিন্তু বিশ্বাস করো বনলতা আমি এটা চাইনি।আমি তো সেলিমকে ভালোবেসে ওর সন্তানের মা হয়ে সুখি জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম।কিন্তু খোদা বাধ সাধলেন।তিনি এমন একটা রোগ আমার সেলিমকে দিলেন যা থেকে সে কোনদিন মুক্ত হতে পারবেনা।এই ডায়ালাইসিস করে যে কটাদিন বাঁচবে।ডাক্তার বলেছেন কিডনি পাল্টালে ও আরও কিছুদিন বাঁচবে।আমার সে সামর্থ্য কোথায়?নিজের কিডনি দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ডাক্তারবাবু বললেন কি সব মেলেনি আমার শরীরের সাথে।
      কথাগুলো বলে খুব কাঁদতে থাকে আরশি।বনলতা তার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে,
---কিন্তু দিদি,তুমি এই শাঁখা,সিঁদুর কেন পর?
---যখন ওই নোংরা কাজগুলো করি স্বামী,সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে তখন আমি আরশি।আর যখন আমি সেলিমের বৌ আর আমার সন্তানের মা তখন আমি রাধা।এইগুলো পরি তার কারন কি জানো?তোমাদের ধর্মে আছে শাঁখা,সিঁদুর স্বামীর আয়ু বাড়ায়।যদি আমার সেলিম আরও কিছুদিন বেশি বাঁচে তার মঙ্গল কামনায় আমি এসব পরি।মসজিদে সিন্নি মানত করি,মন্দিরে যেয়ে পূজা দিই।যে যা বলে তাই করি।কিন্তু আমার সেলিম দিনকে দিন দূর্বল হয়ে পড়ছে।আমি জানিনা সত্যিই আমি জানিনা আমার কপালে খোদা এতো কষ্ট কেন লিখেছেন?আজ পর্যন্ত কাউকেই এসব বলতে পারিনি।আজ তোমায় মন খুলে সব বললাম।নিজেকে একটু হালকা মনে হচ্ছে।তুমি ভেবোনা তোমার আব্বু ভালো হয়ে যাবেন।
       সকাল দশটা নাগাদ বনলতার মা ও ছোট ভাই আসে।তখন আরশি চলে গেছে।হরিসাধনবাবুর অপারেশানও হয়ে গেছে।বাম পা টা মালায় চাকীর উপর থেকে কাটা গেছে।অনেকদিন এখন হাসপাতালে থাকতে হবে।অফিস থেকে সামান্যকিছু টাকা পাওয়া গেছিলো তাই দিয়ে কটাদিন চললো।বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে যাচ্ছে।মা, মেয়ে মিলে ঠিক করে একটা বস্তির মধ্যে কম টাকায় ঘর ভাড়া করে চলে এলো।সরকারী হাসপাতাল তাই চিকিৎসার জন্য কোন টাকা খরচ হচ্ছেনা।রমেশবাবু অবশ্য দু'মাসের ভাড়ায় মকুব করে দিয়েছেন।
      কিছুতেই আর সংসার চলেনা।লতা পড়া বন্ধ করে দেয়।টেষ্ট পরীক্ষা দিয়েও অভাবের তাড়নায় পড়ায় মন বসাতে পারেনা।লোকের বাড়ি কাজ করতে শুরু করে।সারাটাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে।মাস গেলে তবে তো মাইনে।কিন্তু টাকা তো নিত্য দরকার।নূতন কাজ ধরেছে কেউই আগাম দিতে রাজি নয়।বাবাও বাড়ি ফিরে এসেছেন।একটা ক্রাস কেনা একান্ত দরকার।বাথরুমে যেতে গেলে মায়ের কাঁধের উপর ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে হয় বাবাকে।মায়েরও খুব কষ্ট হয়।কিন্তু কোন উপায়ই লতা দেখতে পারছেনা।হঠাৎ মনেপড়ে আরশির কথা।কাজের বাড়িগুলোতে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বিকালে আর আসবেনা জানিয়ে সে মাকে এসে বলে,
---আমি একটা কারখানায় কাজের খোঁজ পেয়েছি।আজ কথা বলতে যেতে হবে।অনেক রাতে ফিরবো।
     নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়।জীবনে  দেখা স্বপ্নগুলিকে বাবা,মা আর ছোট দু'টি ভাইবোনের জন্য নিজের মনেই ঢেউএর সাথে ভাসিয়ে দেয়।সেদিন ভাগ্যিস আরশির বাড়িটা কোথায় জেনে নিয়েছিলো।মা যাওয়ার সময় বারবার করে বলে দিলেন, "দিনকাল ভালোনা সাবধানে যাস।"যে স্বেচ্ছায় বলিকাঠে মাথা দিতে চলেছে তার কাছে ভালো আর মন্দের কোন তফাৎ সত্যিই থাকেনা।
       সেই শুরু। বিকালের দিকের কাজের বাড়ির কাজগুলো ছেড়ে দিলো বনলতা।সকালের দিকে কাজ করেই বাড়িতে এসে নিজেকে একটু পরিপাটি করে বাড়িতে কারখানায় কাজে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়ে।কিছুটা হলেও সংসারের হাল ফেরে।মাঝে মাঝে বাবা,মা খুব দুঃখ করেন তার এই অসীম পরিশ্রম নিয়ে।বনলতার তাতে কোন অনুতাপ নেই।বরং বাড়ির মানুষগুলো পেট পুরে তিনবেলা খেতে পারছে এই শান্তিটা সে নিজের জীবনের সুখ শান্তির বিনিময়ে এনে দিতে পেরেছে তাতেই সে খুশি।
      এইভাবেই বনলতার জীবন এগিয়ে যেতে থাকে।সে আস্তে আস্তে ঝিয়ের কাজগুলো ছেড়ে দেয়।কয়েক বছরের মধ্যে বাবাও মারা যান।বোনটার আঠারো বছর বয়স হওয়ার সাথে সাথেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে।কারন বনলতা জানতো এ সত্য বেশিদিন চেপে রাখা যাবেনা।একটা ভালো ছেলের সন্ধানও পায়।ভাইটাও মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হয়।মোটামুটি যেটুকু না করলে নয় ঠিক সেইভাবেই বোনটার বিয়ে দিয়ে দেয়।মায়ের শরীরও বেশি ভালো নয়।ডাক্তার ওষুধ লেগেই আছে।ইতিমধ্যে বোনের বিয়ের আগেই বস্তির বাড়িটা ছেড়ে একটা ঘর ভাড়া করে উঠে আসে।রোজ দুপুর একটা দেড়টা নাগাদ বেরোয় আর রাত দশটা এগারোটা বেজে যায় তার বাড়ি ফিরতে।মায়ের বা বাড়ির কারও কোনদিন কোনই সন্দেহ হয়নি কারন সময়টা তার সব সময় নির্দিষ্ট ছিলো।ভাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই চাকরির চেষ্টা শুরু করে।ঈশ্বরের অপার কৃপায় একটা চাকরী জুটিয়ে ফেলে।সরকারি না হলেও মা ও দিদি খুশি।বনলতা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।এবার সে তবে এই পথ থেকে সরে আসতে পারবে।কিন্তু ভগবান তার কপালে লিখেছেন অন্যকিছু।সে পৃথিবীতে এসেছে শুধু অন্যকে দিতে,নিজে কিছু পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে সে জম্মায়নি। সপ্তাহ খানেক সে বেরোনো বন্ধ করে দিয়ে ঘরের কাজ আর মায়ের সেবা নিয়েই সময় কাটিয়ে দিতে লাগলো।
        একদিন সে লক্ষ্য করলো ভাই অফিস থেকে এসেই মায়ের ঘরে ঢুকে আস্তে আস্তে কথা বলছে।সে ভায়ের জলখাবার নিয়ে ঢুকলে দু'জনেই চুপ করে যায়।ভাই বেশ রাগত স্বরেই বলে,
---তোর হাতে খেতে আমার ঘৃনা হয়।আমি ভাবতেই পারিনা এতো পাপের কাজ তুই কি করে করতিস?তোর মুখ দেখাও পাপ।
---কি বলছিস তুই ভাই?মা তুমি কিছু বলবেনা?  সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই ছাড়া আমার আর কোন পথ ছিলোনা।
---তাই বলে এই পাপের পথে তোকে নামতে হোল?নাহয় না খেতে পেয়ে সব মারা যেতাম।কি এমন হত তাতে?আমার তো ভাবতেও গা ঘিনঘিন করছে এতদিন তোর ওই পাপের টাকায় আমরা খেয়েছি। ওই জন্যই মনেহয় তোদের বাবা এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
      বনলতা পাথর।তার জীবনের সুখের বিনিময়ে যাদের বাঁচিয়ে রেখেছে,যাদের এই ওবধি এনে দাঁড় করিয়েছে তাদের এ কোন রূপ?মানুষ স্বার্থপর হয় সে জানতো কিন্তু তাইবলে মা,ভাই?কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যেয়ে সে মায়ের পাদু'টি জড়িয়ে ধরতে যায়।কিন্তু তার মা পা সরিয়ে নিয়ে বললেন,
---ওই পাপের হাতে তুই আমায় ছুবিনা।বেরিয়ে যা আমার সামনের থেকে।তোর মুখ দেখাও পাপ!
       সেলিম অনেকদিন আগেই মারা গেছে।সেই রাতেই বনলতা আবার বকুল হয়েই ফিরে আসে আরশির দোরগোড়ায়। বকুল,আরশি আর আশিক এখন এক বাড়িতেই থাকে।

                       শেষ 

Tuesday, August 14, 2018

একই রূপ
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

     বাথরুমে যাওয়ার পথে মায়ের ঘর থেকে এতো রাতে কথা শুনে অতসী একটু চমকেই গেলো।মা কাকে যেন বলছেন,"এ বিয়ে যেভাবেই হোক তোমায় আটকাতে হবে।তুমি তোমার ছেলেকে যা বলার বলবে।এই ব্যপারে আমি মেয়ের সাথে কোন কথা বলতে পারবোনা।এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।সম্পর্কে ওরা ভাই-বোন।এ বিয়ে হতে পারেনা।"এই কথা শুনে অতসী আর সেখানে দাঁড়ায়না। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে।অরিন্দম সম্পর্কে তার দাদা?ভাবতেই পারছেনা।মা সধবার বেশে থাকেন ঠিকই কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছে তার বাবা অফিসের কাজে বাইরে যেয়ে আর ফিরে আসেননি।খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু খবর পাওয়া যায়নি।আর এটাকেই সে সত্যি মনে করে বিশ্বাস করেছে।তারমানে মা তাকে মিথ্যা বলেছেন।বাবা এই শহরেই থাকেন তার ছেলের সাথে।
       অরিন্দমের সাথে মাত্র দু'বছরের আলাপ।ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে।মাকে সবকিছু জানানোয় মা অরিন্দমকে দেখতে চেয়েছিলেন।অরিন্দমের সাথে আলাপচারিতায় মা তার বাবার নাম ও বাড়ি কোথায় জেনেই কেমন গুম মেরে যান। আর কোন কথা না বলে শরীর খারাপ লাগছে এই অজুহাতে ঘরে চলে যান।অরিন্দম চলে যাওয়ার পর সে মায়ের ঘরের কাছে এসে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।কয়েকবার ডাকার পর তিনি সাড়া দিয়ে বলেন,"একটু ঘুমালেই শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে।তুমি ডিনার সেরে নাও।আমি আজ আর কিছু খাবোনা।আর আমাকে বিরক্ত কোরোনা এসে।"
       নীতাদেবী ফিরে যান একুশ বছর আগের জীবনে।তখন ছেলে অরিন্দমের বয়স চার আর অতসীর ছ'মাস।সুখি সংসার।নীতাদেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা আর তার স্বামী ছিলেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে।দূর সম্পর্কের এক বোন থাকতো দু'জন বাইরে বেরিয়ে গেলে বাচ্চাদু'টিকে সামলানোর জন্য।একদিন সকালে দু'জনে একসাথেই যে যার অফিসে বেরিয়ে যান।স্কুল থেকে ফিরে এসে বারবার বেল বাজিয়েও কোন লাভ না হওয়ায় ফ্লাটের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তিনি ঘরে ঢুকে সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে যান।অরিন্দম ও অতসী তখন নিচের বেডরুমে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু তিনি তার বেডরুমে ঢুকে যা দেখেন তা তিনি কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেননি।রূপা  তার খাটের উপর আর পাগলের মত আভাষ তাকে ইচ্ছেমত ছিড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে।আপ্রাণ চেষ্টা করছে রূপা নিজেকে রক্ষা করার ওই পশুটার হাত থেকে।কিন্তু পারছে কোথায়?নীতাকে দেখতে পেয়ে রূপা চিৎকার করে ওঠে, "দিদি তুমি আমাকে বাঁচাও।"হাতের কাছে একটা পিতলের ফুলদানী ছিলো।রাগে ঘেন্নায় সেটা দিয়ে সজোরে আভাষের পিঠে নীতা আঘাত করে।আভাষ আ-আ-আ-বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে।রূপা দৌড়ে এসে নীতাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"দিদি, জামাইবাবু আজ এতো ড্রিংক করেছেন তার কোন জ্ঞানই নেয়।আমি অনেক কাকুতিমিনতি করেছি।উনি শোনেননি।জ্ঞান থাকলে তো শুনবেন!"
       সেই মুহূর্তে বাচ্চাদু'টিকে আর রুপাকে সাথে নিয়ে ঘর ছেড়েছে নীতা।পরে বহুবার আভাষ এসেছে ক্ষমা চেয়ে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।কিন্তু নীতা  যায়নি।অরিন্দমকে একটা ভালো বোডিং স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল নীতা।কিন্তু আভাষ কেস করে সন্তানদের তার কাছে রাখার জন্য।রায় বেরোয় যেহেতু দুটি সন্তান তাই ছোটটি থাকবে মায়ের কাছে আর বড়টি তার বাবার কাছে।রায় বেরোনোর পর একবারই মাত্র নীতা ছেলেকে দেখতে বোডিং স্কুলে গেছিলো।তারপর আর কখনো যোগাযোগ রাখেনি।
         আজ এতোগুলো বছর বাদে নীতা  বাধ্য হলেন আভাষকে ফোন করতে। আর এদিকে সারাটা রাত ছটফট করতে করতে ভোর হওয়া মাত্র মায়ের ঘরের ল্যান্ডফোনে রিডায়াল করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে আভাষ চৌধুরীর সাথে কথা বলে সকালেই পৌঁছে যায় অতসী তার বাবার বাড়ি।ঘরে ঢুকেই সে আভাষ চৌধুরীর সামনাসামনি হয়ে প্রথমেই যে কথাটা বললো তা হোল,
---আমি নীতা চৌধুরীর মেয়ে।কাল পর্যন্ত আমি জানতামনা আমার বাবা কে?শুধু নামটাই শুনেছিলাম।আপনাদের মধ্যে কি হয়েছিলো আমি বা আমার দাদা জানিনা।কিন্তু আমরা দু'জনেই কেউ পিতৃস্নেহ কেউবা মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি।পৃথিবীতে যা কখনোই সম্ভব নয় ঠিক তেমনই একটি ঘটনা আমার ও আমার দাদার জীবনে ঘটেছে।এসবকিছুর জন্য আপনি না মা দায়ী আমি জানিনা।মাকে যতটুকু জেনেছি তিনি তার সংসার জীবনে কখনোই কোন অন্যায় করেননি।আর বাকি থাকলেন আপনি!এখন আমরা বড় হয়েছি নিশ্চয় জানার আমার  অধিকার আছে কি এমন ঘটেছিলো যে মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো?
       এতক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো তিনি শুনছিলেন।মেয়েটিকে দেখতে তার নিজের মত হলেও সাহস ও কথা বলার ভঙ্গিমাটা পুরো তার মায়ের মত।তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়ের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন,
---একুশ বছর আগে যে ঘটনার জন্য তোমার মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো তারজন্য সম্পূর্ণভাবেই আমি দায়ী।অনেকবার তোমার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।কিন্তু অত্যন্ত জেদী তোমার মা।যা আমি জ্ঞানে করিনি তা জানা সত্বেও তিনি আমায় ক্ষমা করেননি।আমি অনুতপ্ত।কিন্তু সবকিছু আমার হাতের বাইরে ছিলো।পারলে আমায় ক্ষমা কোর।
---আমি এখানে এসেছিলাম মা যেন না জানেন।দাদাকে যা বলার আজই তাকে বলে দেবেন।সে ইচ্ছা করলে মাকে দেখতে যেতেই পারে।তবে আমার সাথে আর কখনোই আপনাদের দেখা হবেনা।কথাগুলো বলে অতসী গটগট করে হেঁটে চলে গেলো।আভাষ চৌধুরী একুশ বছর আগের জেদী,একরোখা নিতা কে যেন পূণরায় দেখতে পেলেন।

                  শেষ 

Sunday, August 12, 2018

আপনমনে
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

আজ রাতে তারাদের মাঝে,
খুঁজবো তোমায় আমি,
দেখতে তোমায় পাবো কি ?
জানেন শুধুই অন্তর্যামী।

বদ্ধঘরে অন্ধকারে-
একলা আমি বসে,
জানলা দিয়ে ঢুকলো ঘরে,
জোনাকি কিছু এসে।

জোনাকির আলোয় আলোকিত ঘর,
সে আলো পৌঁছায়না মনে,
তারাদের মাঝে ডুবে আমি,
খুঁজি তোমায় সঙ্গোপনে।

# নন্দা   12-8-19

Tuesday, August 7, 2018

শেষ চিঠি
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

 কেমন আছো?
অনেকদিন হল,আমাদের ছেড়ে-
দূরে চলে গেছো!
বহুদিন তোমায় দেখিনা,
আমি তো এভাবে অভ্যস্ত নই,
ফিরে এসো কোন শিশুর বেশে।
তবেই পাবো আমি শান্তি!
আপনমনে অবোধ শিশুটির সনে-
বলবো না বলা সব কথা।

মন যে আমার কেবলই বলে,
আসবে তুমি আবার এই ঘরে,
এই পরিবারের কোন শিশু হয়ে।
সেই অপেক্ষাতেই তো বেঁচে থাকা।
তোমার ছেলেমেয়ের কোলে কোলে ঘুরবে,
পূনরায় তারা তোমায় বাবা বলে ডাকবে।

কত সাধ অপূর্ণ রেখে গেলে,
একবার শুধু ফিরে এসে দেখে যাও-
সবকিছু কেমন গুছিয়ে নিয়েছি,
খুব ভরসা ছিলো যে তোমার,
দেখে যাও অমর্যাদা করিনি তার।
মেয়ে তোমার সুখি আছে।
কত চিন্তা ছিলো ছেলেকে নিয়ে তোমার,
সে এখন ইন্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে।
আমি জানি তোমার আশীর্বাদের হাত-
তার মাথার উপর আছে।
আর ভেবোনা,ওর জীবন ও ঠিক গড়ে নেবে।
শুধু তুমি ফিরে এসো কোন এক শিশুবেশে। 
ফিরে পাওয়া
         নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

      গরীবের ঘরে রূপবতী হয়ে জম্ম নিয়ে আসমানীর জীবনটা আরও বিষাক্ত হয়ে পরে।বস্তির ছোট্ট একটি ঘরে মা ও বাবার সাথে চৌদ্দ বছর ধরে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে ভ্যানচালক আসিকের সাথে প্রেম করে পনের বছরেই ঘর ছাড়ে।বাবা, মা-ও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।অন্তত মেয়ের বিয়েটা দিতে হলনা।
       ঘোর কাটে আসমানীর বিয়ের তিন মাসের মাথায়।তিনমাস বেশ ভালোই কাটে তার।তিনমাসের মাথায় এসে সে বুঝতে পারে আসিক একজন চোর।দিনে ভ্যান চালানো আর রাত হলেই অন্যের বাড়িতে চুরি-এটাই তার নিত্য রুটিন।খোদাতালাকে কখনোই সে দোষ দেয়না।দোষ তার কপালের।বাপের বাড়ির অভাবী সংসার ছেড়ে পেট ভরে দুবেলা দুমুঠো খাবারের আশায় সে আসিককে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো।কিন্তু সুখ তো তার কপালে নেই।
      কয়েকদিন ধরে শরীরটাও ভালো না।কিছুই খেতে ইচ্ছা করছেনা ,বমি বমি পাচ্ছে।তার রীতিমত ভয়ই করছে। এর মধ্যে যদি একটা বাচ্চা-কাচ্চা পেটে এসে যায় তো আরও বিপদ।না সে মা হতে চায়না।সকলে বলবে চোরের বাচ্চা।মাত্র ষোল বছর বয়সেই আসমানী বাস্তব জীবনটাকে অনেক ভালোভাবে চিনেছে ।
     কিন্তু তার সন্দেহই ঠিক।সে মা হতে চলেছে।আসিককে খবরটা দিলে সে খুব খুশি হয়।আসমানী তাকে বলে,
---দেখো চুরি করাটা ছেড়ে দাও।বাচ্চা হলে সবাই বলবে চোরের বাচ্চা।তার থেকে বরং আমি লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ নিই।আমাদের ভালোভাবে চলে যাবে।ধরা পড়ে গেলে তো জেল হাজত হবে।তখন আমার আর বাচ্চাটার কি হবে ভেবে দেখেছো?
---আরে কিচ্ছু হবেনা।এতো বছর ধরে চুরি করছি আজ পর্যন্ত কোনদিন ধরা পড়িনি।তুই চিন্তা করিসনা বৌ,এখন আমাদের অনেক টাকার দরকার।বাচ্চাটাকে মানুষ করতে হবে তো।ওকে আমরা লেখাপড়া শিখিয়ে বড় মানুষ তৈরি করবো।
       আসমানীর মন কিছুতেই সায় দেয়না।এখন আসিক আরও দেরি করে বাড়ি ফেরে।কোনদিন কিছু আনতে পারে আর কোনদিন বা সারাটা রাত চেষ্টা করেও কিছুই নিয়ে ফিরতে পারেনা।এবার এক দলের সাথে মিশে শুরু করে ছিনতাই করা।যথারীতি একদিন পুলিশ ধরেও ফেলে।সারাটা রাত উৎকন্ঠা নিয়ে কাটিয়ে কোথাও আসিককের সন্ধান আসমানী পায়না।সপ্তাহ খানেক এভাবে কাটিয়ে আসমানী এক বাড়িতে খাওয়ার ও সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে কাজ নেয়।এইভাবে সে আস্তে আস্তে অনেকগুলো বাড়িতে ঝিয়ের কাজ পেয়ে যায়।মাস গেলে এখন তার হাতে আসে ছ' হাজার টাকা।তার কোনই খরচ নেই কারন সে তিন বেলার খাবার কাজের বাড়ির থেকেই পেয়ে যায়।দেখতে দেখতে সাত আটমাস এভাবেই কেটে যায়।একদিন এক বাড়িতে কাজের সময় তার প্রসব যন্ত্রনা ওঠে।ওই বাড়ির লোকেরাই তাকে হাসপাতাল নিয়ে যায়।হাসপাতালে তার একটি সুন্দর ফুটফুটে ছেলে হয়।আসমানী মুনীবের বাড়ির লোকের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আসিকের জন্য।তখনই সে তার জীবনের করুন পরিণতি ওই বাড়ির লোকের কাছে জানায়।
        ঘটনাচক্রে ওই বাড়ির দিদি ছিলেন উকিল।তিনি আসমানীকে কথা দেন আসিককে তিনি খুঁজে বের করবেন।আর আসমানীকে বলেন,"হয়তো সে কোন জেলে বিচার হীন অবস্থায় পড়ে আছে।
         হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর সে ওই ছোট্ট বাচ্চাটিকে নিয়েই কাজে বের হয়।সুন্দর চেহারা আর শান্তশিষ্ট ভদ্র আসমানীকে এই অবস্থায় সব বাড়ির থেকেই কাজের ব্যপারে ছাড় দেয়।একদিন ওই উকিল দিদির সাহায্যে আসিকের খবর পেয়ে দিদির সাথেই বাচ্চাটিকে সাথে নিয়ে স্বামীর সাথে দেখা করতে যায়।আসিক এবং আসমানী দুজনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
---তুই ঠিকই বলেছিলি বৌ,তোর কথা যদি শুনতাম আজ এতোগুলো দিন এই জেলে পড়ে থাকতে হতনা।বাচ্চাটা পুরো তোর মতই সুন্দর হয়েছে।একবার যদি জেল থেকে ছাড়া পাই তাহলে আর কোনদিনও ওই সব খারাপ কাজ করবো না।তুই তোর দিদিকে বলে দেখনা আমায় ছাড়াতে পারে কিনা?
---দিদি তোমায় ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে।কিন্তু দিদি বলেছে তোমায় চুরি,ছিনতাই এগুলো করা বন্ধ করতে হবে।
---বলছি তো আমি আর কোনদিনও ওমুখো হবোনা।আমাদের এই ফুটফুটে ছেলেটাকে নিয়ে কূলিগিরি করে জীবন কাটিয়ে দেবো।ছেলেটাকে ভালোভাবে মানুষ করবো।
       এর কয়েক মাসের মাথায় আসিক জেল থেকে ছাড়া পায় সাথে আরও দুজন।কারন সকলেই ছিলো একই অপরাধে অপরাধী।উকিল দিদির পা ছুঁয়ে শপথ করে আর কোনদিন সে খারাপ কোন কাজ করবেনা।ফিরে আসে তারা তাদের কুঁড়েঘরে।উকিল দিদির সহায়তায় সে একটি প্লাবিং দোকানে কাজ নেয়।মাস গেলে সামান্য যা কিছু সে পায় এনে তুলে দেয় তার আসমানীর হাতে।আস্তে আস্তে সে দোকান মালিকের খুব বিশ্বত্ব হয়ে ওঠে।আসমানী লোকের বাড়ির কাজ আরও বাড়িয়ে দেয়।আগের থেকে অনেক ভালোভাবেই তাদের সংসার চলতে থাকে।আর্থিক অভাব থাকলে সুখ আর স্বস্তির কোন অভাব ছিলোনা।দুঃখের দিনে খোদাতালাকে দোষ না দিলেও সুখের দিনে আসমানী তাকে সুখর জানাতে ভোলেনা।
      আস্তে আস্তে এভাবেই দরিদ্র আসমানীর জীবন এগিয়ে চলে।আসমানী এতেই খুব খুশি।ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে,স্বামীকে সৎ মানুষ হিসাবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।দুবেলা পেট ভরে খেতে পারছে।আর কি চাই তার জীবনে?জীবনে যা কিছু সে চেয়েছিলো সব কিছুই সে ফিরে পেয়েছে।খোদাতালার কাছে তার আর কোন চাহিদা নেই।
                     শেষ  

Sunday, August 5, 2018

Follow my writings on https://www.yourquote.in/nanda_mukherjee #yourquote

অটুট বন্ধন 
            নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

         মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়ে পাড়ার দোকানে না পেয়ে কৌশিকি হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে আসে।শ্রাবণ মাস।যখন তখন বৃষ্টি নামে।ছাতাটা সাথে ছিলো তাই রক্ষে।ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী সন্ধ্যাও তখন হয়নি।কিন্তু কালো মেঘের আবির্ভাবে বিকেল বেলাতেই রাত্রি নেমে এসেছে।ভিজে একসার।হঠাৎ তার নজরে পড়ে বাসরাস্তা থেকে একটু দূরে একটা বেড়া দেওয়া চায়ের দোকানের কাছে একটা ছাতা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে।দেখে মনে হচ্ছে ছাতার তলে একটা বড় ঝুড়িতে কিছু আচ্ছাদন দেওয়া।কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে যেয়ে ছাতাটা সরাতেই সে চমকে ওঠে।সদ্যোজাত একটি শিশু।কৌশিকি এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই।ইচ্ছাকৃত যে কেউ বাচ্চাটিকে ফেলে গেছে এটা তার বুঝতে একটুও সময় নিলোনা।কিন্তু সে এখন কি করবে?তার যে মন সায় দিচ্ছেনা বাচ্চাটিকে ফেলে যেতে।পরম যত্নে কৌশিকি ওকে বুকে চেপে ধরে। 
         অসুস্থ্য মায়ের কাছে এসে সব জানায়।মা তাকে রাগ করলেও মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,"তোর তো কিছু ওই সময় করারও ছিলোনা।কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।পার্থ তো কিছুতেই বাচ্চাটিকে মেনে নেবেনা।আর পার্থ একা তো নয়।ওদের একান্নবর্তী পরিবার।কেউ না কেউ আপত্তি তুলবেই।"
---এখন কি করবো তাহলে মা?বাচ্চাটিকে তো মেরে ফেলতে পারিনা। 
---না তা কেন?পার্থর সাথে কথা বলে ওকে কোন অনাথ আশ্রমে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। 
---দেখি তাহলে রাতে ওর সাথে কথা বলি। এখন ওকে একটু চামচে করে দুধ খাওয়ায়।ও তো অকাতরে ঘুমিয়ে চলেছে ওর মনেহয় ক্ষিদে পেয়েছে। 
     পার্থ আর কৌশিকির প্রেম পাঁচ বছরের।দু'পক্ষের মত থাকায় ওদের রেজিস্ট্রিও হয়ে গেছে।এখন বাকি অগ্নি স্বাক্ষী করে বিয়ে।সময় হাতে পনেরদিন।রাতেই কৌশিকি পার্থকে ফোন করে সব জানায়।পার্থ কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা।পরিশেষে সে বলে,"আগামীকাল আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়ে সামনাসামনি কথা বলবো।তবে আমারও মনেহয় মাসিমা যেটা বলেছেন সেটাই ভালো হবে বাচ্চাটির পক্ষে"।
         রাতে বাচ্চাটির গা গরম হওয়ায় কৌশিকি যেয়ে মাকে ডেকে আনে।কামিনীদেবী বলেন,"অনেকক্ষণ বৃষ্টির মধ্যে থাকায় ওর ঠান্ডা লেগে জ্বর হয়েছে।রাতে যদি জ্বর বারে মাথায় জলপট্টি দিস।এতো টুকুন বাচ্চা কিছু করতেও তো ভয় লাগে।কি থেকে আবার কি হয়ে যায়।"
     বাইরে বৃষ্টি হলেও ঘরের ভিতর গুমোট গরম।কিন্তু বাচ্চাটির ক্ষতি হবে চিন্তা করে গলদ ঘামে ঘামতে থাকলেও কৌশিকি পাখা চালায় না। সকালের দিকেই পার্থ এসে হাজির হয়।তখন বাচ্চাটির জ্বর অনেকটাই কম।কৌশিকি ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলে পার্থ বাঁধা দিয়ে বলে, 
---নানান রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।তার থেকে বরং আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে তাকে ফোন করে জেনে নিই ওকে কি ওষুধ দেওয়া যাবে। 
---তাই কর।খুব খারাপ লাগছে বাচ্চাটির জন্য।কেমন বাবা,মা সন্তান জম্মের পরেই ফেলে দিয়ে যায়।ওর মুখটা দেখেও কি ওদের মায়া হয়নি?আমার তো বাবা ওর প্রতি মায়া পড়ে গেছে।ওর একটা নামও ঠিক করে ফেলেছি। 
---এই মরেছে এর মধ্যে নামও ঠিক হয়ে গেছে?কিন্তু ওর তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। 
---এই শোনোনা-ওকে যদি আমরাই দত্তক নিই। 
---পাগলী!আমাদের তো এখনও বিয়েই হয়নি।দত্তকটা নেবো কি করে।তাছাড়া দত্তক নিতে গেলেও ওকে একটা ঠিকানা আমাদের জোগাড় করে দিতে হবে।আগে দেখি কি করা যায়।আমি এখান থেকেই অফিস বেরোবো। 
      পার্থ একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী করে।কৌশিকির কথা মত গ্রামের দিকে একটা অনাথ আশ্রমে শিশুটিকে ওরা দিয়ে আসে।তাদের সাথে কথা হয় ছ'মাস পর ওরা বাচ্চাটিকে দত্তক নেবে।কারন কিছুতেই কৌশিকি বাচ্চাটিকে ছাড়তেই রাজি হচ্ছিলোনা।তাকে এই শর্তে পার্থ রাজি করিয়েছে বিয়ের পর তারা ছ'মাসের মাথায় বাচ্চাটিকে দত্তক নেবে আর এখান থেকে দূরে বদলি হয়ে যাবে।এই শিশুটিকে সে মানুষ করবেই।বাড়ির লোককে দত্তক নেওয়ার পর জানাবে যে ওরা ওকে কুড়িয়ে পেয়েছে। 
         ওরা দুজনে মিলে গ্রামের দিকে একটি এতিমখানায় শিশুটিকে রেখে আসে।ছ'মাসের মাথায় বাড়ির সকলকে রাজি করিয়ে শিশুটিকে দত্তকও নেয়।দু'বছরের মধ্যে ওদের একটি ছেলে হয়।ওরা এবং ওদের বাড়ির লোক কখনোই দুই ছেলেকে আলাদা করে দেখেনি।দুজনকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে।দুজনেই বাইরে চাকরী পায়।কিন্তু বড়ছেলে কৌশিক মা,বাবাকে ছেড়ে বাইরে যেতে রাজি হয়না।কৌশিক মা ছাড়া কিছুই জানেনা।মাকে ছেড়ে দূরে যাওয়ার কথা সে ভাবতেই পারেনা।সে জানেনা এরা কেউই তার আসল মা,বাবা, দাদু,ঠাকুমা নয়।বাড়ির প্রতিটা মানুষের প্রতি তার অসম্ভব একটা টান যা ছোট ছেলে কিংশুকের মধ্যে দেখা যায়না।সে রাগী,বদমেজাজী কিন্তু তাইবলে সে কিন্তু উশৃঙ্খল নয়।অপরদিকে কৌশিক ধীর,শান্ত একটু গম্ভীর প্রকৃতির।দুটি ছেলেই দুই মেরুর বাসিন্দা।কিন্তু ভায়ে ভায়ে খুব মিল।রেগে গেলে কিংশুক একমাত্র তার দাদাভায়ের কথা ছাড়া অন্য কারও কথা সেই মুহূর্তে সে শোনেনা।সবাই বলে আদরটা একটু বেশি পাওয়াতে কিংশুকটা এরূপ হয়েছে।কিন্তু কৌশিকি একথা মানতে নারাজ।সে দুই ছেলের মধ্যে কোনদিন কোন পার্থক্য করেনি।মা হিসাবে সে গর্বিত।দুই ছেলেই তার মনের মত হয়েছে।কৌশিক এখনও মাঝে মাঝে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,"আমি জম্ম-জম্মান্তর ধরে তোমায় মা হিসাবে পেতে চাই।তোমার মত মা পাওয়া ভাগ্যের কথা"।আনন্দে কৌশিকির চোখ থেকে জল পড়তে থাকে।আর মনেমনে ভাবে ভাগ্যিস সেদিন ওকে বুকে তুলে নিয়েছিলো।তাই তো আজ সে এতো সুখি।নিজের পেটের সন্তান চলে গেলো বিদেশে বেশি অর্থ উপার্জনের আশায়।অথচ তার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে তাকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে চায়না অফিসের সময়টুকু ছাড়া।কিংশুক বছরে একবার করে আসে।বিয়ে-থা করলে হয়তো তাও আসবেনা।কিন্তু তার কৌশিক এখনও মায়ের পায়ের উপর শুয়ে আদর খায়।বাবা পার্থ দেখে আর হাসতে হাসতে বলে,"তোমার বড় ছেলে তো এখনও বড় হতেই পারলোনা।ওকে বড় হওয়ার একটু সুযোগ দাও।এর পরে বৌ ঘরে আসলে বলবে,মায়ের আঁচল ধরা ছেলে।"
---বাবা আমি তো বিয়ে করবোনা।আমি সারাজীবন মায়ের ছেলে হয়েই থাকবো। 
    কৌশিকি ওদের কথার মাঝখানে বলে ওঠে, 
---দূর বোকা বিয়ে করবিনা এ কি কথা।আমি ঠাকুমা হবো কি করে?দেখবি তোর বৌ খুব ভালো হবে।তুই আমার এতো ভালো ছেলে আর তোর বৌ ও খুব ভালো হবে।
     শুরু হয় কৌশিকের জন্য মেয়ে দেখা। কিন্তু হঠাৎই কৌশিকির সংসারে ছন্দপতন!ধরা যখন পড়লো কৌশিকির দুটো কিডনিই পুরো নষ্ট।একমাসের মধ্যে কিডনি ট্রান্সফার করতে হবে তার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিস।বারবার পেপারে দিয়েও কিডনি পাওয়া যায়না।কিংশুক বিদেশ থেকে মায়ের অপারেশান হবে শুনে চলে এসছে।
        আজ অপারেশান।কিংশুকই ছুটোছুটি করছে।ধারেকাছে কৌশিককে দেখা যাচ্ছেনা।কিংশুককে দেখে মনেহচ্ছে সে খুবই চাপের মধ্যে আছে।চুল উস্কোখূস্কো চোখের পাতা ভেজা।সকলেই ভাবছে মায়ের জন্য।তারকাছে তার দাদার কথা জানতে চাইলে সবসময়ই সে বলছে দাদা ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। 
       অপারেশান ভালোভাবেই হয়ে যায়।আবার খোঁজ পরে কৌশিকের।এবার আর কিংশুক নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"বাবা টাকার বিনিময়ে মায়ের জন্য কিডনি জোগাড় করতে দাদা পারেনি।ওই অল্প সময়ের মধ্যে কাউকেই পাওয়া যায়নি।দাদাভাই তার একটা কিডনি দিয়ে মাকে বাঁচিয়েছে।আমাকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিয়েছিলো অপারেশনের আগে আমি যদি মুখ খুলি তাহলে তার মরা মুখ দেখবো।তাই আমি তোমাদের কিছু বলতে পারিনি।বাবা চলো, দাদাভাইকে দেখতে যাই।"
        পার্থ মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন।কিংশুক ধরে ফেলে।তখনও কৌশিকির জ্ঞান ফেরেনি।কৌশিক ভালো আছে।বাবা,ভাই যেয়ে তার বেডের কাছে দাঁড়ালে সে বলে,"মায়ের দুধের ঋণ কোনদিন শোধ করা যায়না বাবা।তবুও একটু তো কিছু মায়ের জন্য করতে পারলাম।তোমরা মাকে কিছু বোলোনা।আমি কাল সকালেই মায়ের সাথে গিয়ে দেখা করে আসবো।"
     পার্থর চোখ থেকে অবিরাম ধারায় জল পড়তে থাকে।আর মনেমনে বলতে থাকেন,"তোর যে তোর মায়ের কাছে কোন দুধের ঋণ নেই রে।ভগবান সব আগে থাকতেই ঠিক করে রাখেন।তোর মাকে তুই বাঁচাবি বলেই হয়তো এতো প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও তোকে সেদিন বুকে করে তোর মা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো।তুই পরের জম্মে তোর মায়ের গর্ভেই আসিস বাবা।"পার্থ কাঁদতে কাঁদতে তার আদরের বড় ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। 
                             শেষ 

      
   

Thursday, August 2, 2018

শুধু তোমাকেই চাই
      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

মাঝে মাঝে তোমার গায়ের গন্ধ,
জানলার ফাঁক গলে নাকে আসে।
অন্ধের মত চারিদিকে হাতড়াই,
কোথাও তোমায় দেখতে পাইনা।
চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছা করে,
একবুক তাজা রক্ত নিয়েও-
শরীর আস্তে আস্তে শীতল হয়ে পড়ে।
কি দুর্বার আকর্ষন তোমাকে কাছে পাওয়ার!
তুমি কিছুই জানতে পারোনা,
এ কষ্ট,এ বেদনা একাকী ভোগ করি।
মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর জুড়ালে-
হৃদয়ের আকাঙ্খা আরও তীব্র হয়।
দুহাত বাড়িয়ে ছুতে চাই তোমাকে,
তোমাকে একান্তভাবে নিরালায় পেতে চাই।