একদিন ভালোবাসবে (৬৩ পর্ব )
সুজয় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এদিকে দীপিকাও চুপচাপ বসে ফেলে আসা অতীতকে নিয়ে ভেবে চলেছে। কিছু পরে দীপিকা বলে,
-- এখানে তোমার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনেহয় না। তুমি আর এখানে এসো না। তুমি বিয়ে করেছ, তোমার বউ আছে। সে যদি জানতে পারে তুমি তোমার পুরনো প্রেমিকার সাথে দেখা করতে আসো তাহলে তোমার সুখের সংসার ভেঙে যাবে। তোমার প্রতি আমার আজ আর কোন অনুভূতি নেই। ন'বছর আগে কোন এক দুপুরে তোমার আবেগকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হয়ত নিজেকেই শেষ করে দিতাম। কিন্তু ঈশ্বর অত সহজে আমার কপালে মৃত্যু লেখেননি। তিনিই তার দূত পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। একথাগুলো তোমাকে না বললেও চলতো। বলছি এই কারণে - তোমার এখানে বারবার আসার কারণ হিসাবে আমার মনে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে ভদ্রলোককে তুমি দেখেছো উনি মানুষরূপী ভগবান। উনার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষই তাই।
-- উনি বিয়ে করেননি?
-- অবান্তর প্রশ্ন করো না। ওসব জেনে তোমার কী লাভ?
-- না, মানে তুমিও তো বিয়ে করোনি তাই ভাবছিলাম --
--- সকলের সাথে নিজেকে গুলিয়ে ফেলো না। উনি এবং উনার পরিবার আজ আমার পরিবার। তারাই আমাদের সব দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার মেয়ের উচ্চ শিক্ষার কোন গাফিলতি উনি হতে দেবেন না। জানি না এখানে তুমি কেন এসেছো? আর জানার ইচ্ছাও আমার নেই। তবে তুমি যদি মনে করো আমার মেয়ের জন্য তুমি কিছু করলে আমি সেটা হাত পেতে নেবো তাহলে ভুল ভাবছো। আমার মেয়ে আমার কাছে থেকেই তার সৌম্য আঙ্কেলের সহয়তায় নিজেকে তৈরি করে নেবে। স্বেচ্ছায় যে দায়িত্ব তুমি নিতে চাওনি এত বছর বাদে আমি কোন কিছুর বিনিময়েই তোমার কাছ থেকে কোন দান চাই না। তুমি আর কখনো এখানে আসবে না। আর এটাই আমার শেষ কথা।
-- কিন্তু আমি তো --
-- তুমি এবার আসতে পারো। বলতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি তুমি আমার মেয়ের জীবনে অভিশাপ!
-- দীপিকা!
-- তোমার সাথে আমার কিংবা আমার মেয়ের সেদিনই সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে যেদিন তুমি আমাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলে। এবার আসতে পারো আমার কাজ আছে।
কথাক'টি বলে দীপিকা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে গেলো। সুজয় আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সেও আস্তে আস্তে ঘর থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলো। সামনে কিছুটা ঝাপসা দেখতে লাগলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের কোণায় জমে থাকা জলটা মুছে নিলো। হয়ত নিজের পাপের কিছুটা, চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসলো।
দীপিকা তার বেড়ার ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে যতক্ষণ সুজয়কে দেখা যায় তাকিয়ে থাকলো। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে তার। কানে বাজছে সুজয়ের সেই কথা বউকে নিয়ে সে এখানে ঘুরতে এসেছে।
সুজয়ের অফিসের কারণে তাকে তার বউকে রেখেই কলকাতা ফিরতে হয়েছিলো। কারণ অফিস তাকে আর ছুটি মঞ্জুর করেনি। কলকাতা থেকে বউয়ের প্লাস্টার কাটার আগেরদিন এসে তার প্লাস্টার কাটিয়ে তাকে নিয়ে কলকাতা ফেরে। মেয়ে কিংবা দীপিকার সাথে দেখা করার অদম্য ইচ্ছাটাকে কোনক্রমে সে আটকে রাখে। দীপিকাকে দেখার পর থেকেই নিজের প্রতি নিজের প্রচণ্ড একটা রাগ হতে থাকে। মা,বাবার কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে কিভাবে সে ভুলে গেলো কোথায় ছিলো তখন তার বিবেক,মনুষ্যত্ব এইসব চিন্তা করতে করতে সে মনেমনে ঠিক করে দীপিকা আর তার মেয়েকে কলকাতা যদি আনতে পারে তাহলে দিনান্তে একবার হলেও সে তাদের চোখের দেখা দেখতে পারবে। আর সেইজন্য দীপিকা যে বেঁচে আছে সেই খবরটা সে যেভাবেই হোক তার বাবা,মাকে সে জানাবে।
দীপিকার বাবা,মায়ের বয়স এখন অনেক। তারা দু'জনেই বাইরে এখন কম বেরোন। বার্ধক্যজনিত অসুখে দু'জনেই জর্জরিত। একমাত্র মেয়ের শোকে তারা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথেও খুব একটা মেলামেশা করেন না। কিন্তু তারা আজও বিশ্বাস করেন তাদের মেয়ে বেঁচে আছে। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে দু'জনেই কোন রকমে বেঁচে আছেন। সুজয় যদি তাদের গিয়ে তাদের মেয়ের বেঁচে থাকার খবরটা দিতে পারে তাহলে একটু হলেও হয়ত তার পাপের বোঝা হালকা হতে পারে।
সে মনেমনে নিজেকে তৈরি করে নেয়। দীপিকার বাড়িতে ঢুকলে অবধারিত তার বাবা,মা তাকে অপমান করবেন। কিন্তু সে সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েই দীপিকার বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল টেপে। ভিতর থেকে এক অচেনা মহিলা এসে দরজা খোলেন।
ক্রমশ