Friday, April 28, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৩ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৬৩ পর্ব )

   সুজয় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এদিকে দীপিকাও চুপচাপ বসে ফেলে আসা অতীতকে নিয়ে ভেবে চলেছে। কিছু পরে দীপিকা বলে,
-- এখানে তোমার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনেহয় না। তুমি আর এখানে এসো না। তুমি বিয়ে করেছ, তোমার বউ আছে। সে যদি জানতে পারে তুমি তোমার পুরনো প্রেমিকার সাথে দেখা করতে আসো তাহলে তোমার সুখের সংসার ভেঙে যাবে। তোমার প্রতি আমার আজ আর কোন অনুভূতি নেই। ন'বছর আগে কোন এক দুপুরে তোমার আবেগকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হয়ত নিজেকেই শেষ করে দিতাম। কিন্তু ঈশ্বর অত সহজে আমার কপালে মৃত্যু লেখেননি। তিনিই তার দূত পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। একথাগুলো তোমাকে না বললেও চলতো। বলছি এই কারণে - তোমার এখানে বারবার আসার কারণ হিসাবে আমার মনে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে ভদ্রলোককে তুমি দেখেছো উনি মানুষরূপী ভগবান। উনার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষই তাই। 
-- উনি বিয়ে করেননি?
-- অবান্তর প্রশ্ন করো না। ওসব জেনে তোমার কী লাভ?
-- না, মানে তুমিও তো বিয়ে করোনি তাই ভাবছিলাম --
--- সকলের সাথে নিজেকে গুলিয়ে ফেলো না। উনি এবং উনার পরিবার আজ আমার পরিবার। তারাই আমাদের সব দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার মেয়ের উচ্চ শিক্ষার কোন গাফিলতি উনি হতে দেবেন না। জানি না এখানে তুমি কেন এসেছো? আর জানার ইচ্ছাও আমার নেই। তবে তুমি যদি মনে করো আমার মেয়ের জন্য তুমি কিছু করলে আমি সেটা হাত পেতে নেবো তাহলে ভুল ভাবছো। আমার মেয়ে আমার কাছে থেকেই তার সৌম্য  আঙ্কেলের সহয়তায় নিজেকে তৈরি করে নেবে। স্বেচ্ছায় যে দায়িত্ব তুমি নিতে চাওনি এত বছর বাদে আমি কোন কিছুর বিনিময়েই তোমার কাছ থেকে কোন দান চাই না। তুমি আর কখনো এখানে আসবে না। আর এটাই আমার শেষ কথা।
-- কিন্তু আমি তো --
-- তুমি এবার আসতে পারো। বলতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি তুমি আমার মেয়ের জীবনে অভিশাপ!
-- দীপিকা!
-- তোমার সাথে আমার কিংবা আমার মেয়ের সেদিনই সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে যেদিন তুমি আমাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলে। এবার আসতে পারো আমার কাজ আছে।
  কথাক'টি বলে দীপিকা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে গেলো। সুজয় আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সেও আস্তে আস্তে ঘর থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলো। সামনে কিছুটা ঝাপসা দেখতে লাগলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের কোণায় জমে থাকা জলটা মুছে নিলো। হয়ত নিজের পাপের কিছুটা, চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসলো।
  দীপিকা তার বেড়ার ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে যতক্ষণ সুজয়কে দেখা যায় তাকিয়ে থাকলো। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে তার। কানে বাজছে সুজয়ের সেই কথা বউকে নিয়ে সে এখানে ঘুরতে এসেছে।
    সুজয়ের অফিসের কারণে তাকে তার বউকে রেখেই কলকাতা ফিরতে হয়েছিলো। কারণ অফিস তাকে আর ছুটি মঞ্জুর করেনি। কলকাতা থেকে বউয়ের প্লাস্টার কাটার আগেরদিন এসে তার প্লাস্টার কাটিয়ে তাকে নিয়ে কলকাতা ফেরে। মেয়ে কিংবা দীপিকার সাথে দেখা করার অদম্য ইচ্ছাটাকে কোনক্রমে সে আটকে রাখে। দীপিকাকে দেখার পর থেকেই নিজের প্রতি নিজের প্রচণ্ড একটা রাগ হতে থাকে। মা,বাবার কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে কিভাবে সে ভুলে গেলো কোথায় ছিলো তখন তার বিবেক,মনুষ্যত্ব এইসব চিন্তা করতে করতে সে মনেমনে ঠিক করে দীপিকা আর তার মেয়েকে কলকাতা যদি আনতে পারে তাহলে দিনান্তে একবার হলেও সে তাদের চোখের দেখা দেখতে পারবে। আর সেইজন্য দীপিকা যে বেঁচে আছে সেই খবরটা সে যেভাবেই হোক তার বাবা,মাকে সে জানাবে।
  দীপিকার বাবা,মায়ের বয়স এখন অনেক। তারা দু'জনেই বাইরে এখন কম বেরোন। বার্ধক্যজনিত অসুখে দু'জনেই জর্জরিত। একমাত্র মেয়ের শোকে তারা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথেও খুব একটা মেলামেশা করেন না। কিন্তু তারা আজও বিশ্বাস করেন তাদের মেয়ে বেঁচে আছে। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে দু'জনেই কোন রকমে বেঁচে আছেন। সুজয় যদি তাদের গিয়ে তাদের মেয়ের বেঁচে থাকার খবরটা দিতে পারে তাহলে একটু হলেও হয়ত তার পাপের বোঝা হালকা হতে পারে। 
  সে মনেমনে নিজেকে তৈরি করে নেয়। দীপিকার বাড়িতে ঢুকলে অবধারিত তার বাবা,মা তাকে অপমান করবেন। কিন্তু সে সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েই দীপিকার বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল টেপে। ভিতর থেকে এক অচেনা মহিলা এসে দরজা খোলেন।

ক্রমশ 
    

Wednesday, April 26, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬২ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৬২ পর্ব )

   সুজয় সেদিন চলে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেটা ছিল ওর কাছে সাময়িক। স্বার্থপরের মত হলেও সে মনেপ্রাণে চাইছে মেয়েকে ওর কাছে এনে মানুষ করতে। আর এটা করতে যদি প্রয়োজন হয় সে দীপিকার পা ধরতেও রাজি আছে। সুজয় বিশ্বাস করে যে অন্যায় সে দীপিকার প্রতি করেছে তার কোন ক্ষমা হয় না। এখানে আসার পর দীপিকার সাথে যে ওর দু'বার দেখা হয়েছে দু'বারই দীপিকা ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু সুজয় জানে যে ব্যবহার দীপিকার সাথে সে করেছে তার তুলনায় দীপিকার এই খারাপ ব্যবহার নস্যি। তাই দীপিকার সাথে কথা বলার সময় সুজয় সবসময় অপরাধীর যেমন থাকা উচিত ঠিক সেইরকমই থেকেছে।
   সুজয় বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দীপিকা তার ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখ থেকে সমানে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। আজ যে অন্ধকারটা মধ্যে সে বসে আছে একসময় ঠিক এইরকই তার জীবনে অন্ধকার ধেয়ে এসেছিলো। কিন্তু ভগবান তার কপালে সবকিছু খারাপ হয়ত লিখেছিলেন না। আর সেই কারণেই হয়ত ঈশ্বর সৌম্যকে তার কাছে দূত হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন যদি অত রাতে সৌম্যর সাথে দেখা না হত তাহলে হয়ত নরখাদকেরা তার দেহটাকে ছিঁড়ে খেত। তার জীবনে শুধু সৌম্য কেন তাদের পরিবারের আর দু'জনের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত সৌম্যর মা। যে কটাদিন সে সৌম্যদের বাড়িতে ছিল সৌম্যর মায়ের ব্যবহারে কখনোই মনে হয়নি যে সে তার নিজের মেয়ে নয়। এখানে আসার পরও যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় নিয়মিত ফোন করে খবর নিয়েছেন। একবার সৌম্যর বাবাকে নিয়ে এখানে এসে থেকেও গেছেন। আলাদা করে মেয়ের জন্য কত জিনিস নিয়ে এসেছিলেন। যাওয়ার আগে সৌম্যর বাবাকে না জানিয়ে হাতে মোটা অঙ্কের টাকাও গুজে দিয়ে গেছিলেন। অন্ধকারের মধ্যে বসে অতীতের অনেক কথা তার মনে পড়তে লাগে। বাবা,মায়ের জন্য মন কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝেই। কিন্তু অসহায়ের মত শুধু কেঁদেই চলে তখন। বাড়ি ছেড়ে আসার পরে ভয়ে তাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখতে পারেনি। অনেকবার ভেবেছে ফোন করবে কিন্তু কী জানি এক অজানা আশঙ্কায় আর ফোন করে ওঠা সম্ভব হয়নি। সে নিজেকে কঠোরভাবে তৈরি করে নেয় কোন অবস্থাতেই সুজয়কে দেখে সে দুর্বল হবে না। কেন জানি তার মনেহয় সুজয় এতদিন পরে তাকে দেখে তার মেয়ের জন্যই এই বাসস্থান পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। কথাটা মনে হতেই তার বুকের ভিতর ছ্যাৎ করে ওঠে। আর ঠিক তখনই শ্রেষ্ঠা তার মায়ের ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালিয়ে দেয়। মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-- তুমি এই অন্ধকারে বসে আছো কেন?
দীপিকা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- তুই আমাকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাবি না। আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না। তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই রে!
 হঠাৎ মায়ের মুখে এই কথা শুনে আর তার কান্না দেখে কিছুটা ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
-- কী সব বলছো মা? আমি তোমায় ছেড়ে কেন কোথাও যাবো? তুমি আজ এত কাঁদছো কেন? আমার খিদে পেয়েছে তো।
 দীপিকা চোখ মুছে মেয়ের কপালে একটা চুম্বন করে বলে,
-- চল তোকে খেতে দিই। 

  ঠিক তার পরের দিন দুপুর বারোটা নাগাদ সুজয় আবার আসে। সুজয়কে দেখতে পেয়ে দীপিকা তার মেয়েকে বলে,
-- মামনি তুমি ও ঘরে যাও।
 শ্রেষ্ঠা চলে যেতে উদ্যত হলে সুজয় তাকে ডাক দেয়
-- মামনি একটু শোনো। তোমার জন্য কিছু ফল এনেছি। এগুলো নিয়ে যাও।
 শ্রেষ্ঠা তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লে দীপিকা বলে,
-- তুমি ও ঘরে চলে যাও আঙ্কেলের কাছ থেকে আমি এগুলো নিয়ে নেবো।
 দীপিকা কথাটা বলেই হাত এগিয়ে দেয় সুজয়ের দিকে। আর শ্রেষ্ঠা সেখান থেকে দৌড়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারে মা যখন তাকে এই অঙ্কেলটার কাছ থেকে চলে যেতে বলছে নিশ্চয় আঙ্কেলটা ভীষণ দুষ্টু। কারণ মা তাকে অনেক আগেই এসব শিখিয়ে রেখেছে। কোন অপরিচিত মানুষ আসলে সে যেন সেই সময় সেই মানুষটির সামনে না থাকে। কারণ দীপিকা এখানে এই পাহাড়িয়া অঞ্চলে এসে একটা কথা পরিস্কার বুঝেছে এখনকার মানুষজনগুলি এমনিতে খুবই ভালো কিন্তু তাদের আতে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগলে তারা হিংস্র হয়ে উঠতে এক মুহুর্ত ভাবে না। তাই অনেক সময় অনেককিছুই মুখ না খুলে চোখের ইশারায় বুঝে নিতে হয়। মেয়েকেও ঠিক সেই একই ভাবে শিক্ষা দিয়েছে। তাই সে মায়ের কথা শুনেই সুজয়ের সামনে থেকে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে যায়।
     সুজয়কে এবার সরাসরি দীপিকা প্রশ্ন করে
-- রোজ রোজ এখানে কী জন্য আসছো বলো তো ? এখানে তুমি কি একাই এসেছো? 
 সুজয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-- না আমার স্ত্রীও এসেছে।
 কথাটা শুনেই দীপিকার বুকটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু এমন তাতো হওয়া উচিত হয়নি। সুজয় বিয়ে করেছে,সে তার বউ নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছে এটা জেনে দীপিকার বুকের ভিতর কেন তোলপাল করছে। সুজয়ের প্রতি তো এখন কোন ভালোবাসা তো দূরহস্ত সামান্যতম সহানুভূতিও তো দীপিকার মনে নেই। তবে কেন সুজয় তার বউ নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছে শুনে ওর মনটা ছটফট করছে। 

ক্রমশ 

Friday, April 21, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬১ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৬১ পর্ব )

   খুব সন্তর্পনে সুজয় ওদের অনুসরণ করতে থাকে। আজ সে জ্যাকেটের উপর একটা শাল গায়ে জড়িয়েছে। মাথার উপর থেকে এমনভাবে শালটিকে মাথার পেঁচিয়ে নিয়েছে দূর থেকে কেউ দেখলে চিনতে পারবে না। সৌম্য এবং দীপিকা দু'জনেই একসাথে শ্রেষ্ঠার বেডের কাছে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলছে দেখে। মেয়েটির বয়স তার কাছে ঠিক আট ন'বছরের মধ্যেই হবে বলে মনে হল। সে আর বেশিক্ষণ ওখানে না দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কাছে চলে গেলো। কিছুক্ষণ তার কাছে থেকে "শরীরটা ভালো লাগছে না" - বলে এক চুম্বকীয় শক্তির টানে আবার সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে থাকে। আরও বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ দেখে দীপিকা বেরিয়ে আসছে। ভদ্রলোকটি জোর করে মানিব্যাগ খুলে ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে দেন। দীপিকা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই সুজয় শ্রেষ্ঠার বেডের কাছে দাঁড়িয়ে অতি স্বাভাবিক ভাবে জানতে চায়,
-- তোমার নাম কী? কী হয়েছে তোমার?
 মেয়েটি সুজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- শ্রেষ্ঠা দাস
 সুজয়ের পদবীর সাথে মিলে গেলো। সুজয় আরো আগ্রহী হয়ে উঠলো শ্রেষ্ঠার খুঁটিনাটি জানার জন্য। পরিচয় হল সৌম্যর সাথে। কথা চলছিল কিন্তু হঠাৎ তাকিয়ে দেখে দীপিকা আসছে। মাঝপথে কথা থামিয়ে "কাজের কথা মনে পড়ে গেছে -" বলেই সুজয় দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। 
   সুজয় ঠিক তার পরের দিন ভিজিটিং আওয়ারের অনেক আগেই এসে যায়। যাতে দীপিকারা ঢোকার আগেই সে শ্রেষ্ঠার কাছে পৌঁছাতে পারে। সুজয় শ্রেষ্ঠার জন্য কিছু ফল নিয়ে গিয়ে ওর সাথে এ কথা সে কথার পর জানতে চায় আসল কথা 
-- তোমার বাবার নাম কী মামনি?
মেয়ের মুখে নিজের নাম শুনে আনন্দে, কষ্টে সুজয়ের চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করে। শ্রেষ্ঠা তখন আঙ্কেলকে বলে,
-- জানো আঙ্কেল আমার মা'ও আমায় মামনি বলে ডাকে।
 সুজয়ের তখন মনে পড়ে দীপিকার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর নতুন নতুন প্ল্যান প্রোগ্রামের মধ্যে তারা ঠিক করেছিল তাদের প্রথম ছেলে হলে তারা ডাকবে রাজা বলে আর মেয়ে হলে ডাকবে মামনি বলে। 
বাবা মায়ের চাপে পড়ে এত বড় একটা ভুল সে কী করে করলো? ভাবতেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। হঠাৎ সুজয় কাচের জানলা দিয়ে দেখতে পায় দীপিকা আসছে। সুজয় তার মেয়ের কাছে আজও জানতে পারলো না কে ওই ভদ্রলোকটি?
  এরপর প্রতিদিন সুজয়কে নেশায় পেয়ে বসলো তার মেয়েকে দেখার। একদিন কথা প্রসঙ্গে মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারে সৌম্য আঙ্কেল ভীষণ ভালো মানুষ। ও আর ওর মা থাকে সৌম্য আঙ্কেল কলকাতা থাকে। ছোট্ট মেয়েটার কাছে এই ছাড়া আর কোন খবর ছিল না আর সুজয়ও বুঝতে পারে শ্রেষ্ঠার কাছে আর কোন কথা জানতে চাওয়া ঠিক হবে না।
  হাসপাতাল রেকর্ড বুক থেকে বাকথাং এর ঠিকানা জোগাড় করে। হাসপাতাল থেকে শ্রেষ্ঠাকে ছেড়ে দেওয়ার পর সৌম্য কলকাতা ফেরে। সুজয়ের স্ত্রীর প্লাস্টার না কাটা অবধি তাকে ওখানে থাকতেই হবে। সে ঠিকানা নিয়ে পাহাড়িয়া রাস্তা পেরিয়ে দীপিকার বাসস্থানে এসে হাজির হয়। দীপিকা তাকে দেখে আঁতকে ওঠে। তার একটাই ভয় যদি সে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চায়। দীপিকা তাকে দেখে জানতে চায় 
-- তুমি এই পর্যন্ত ধাওয়া করেছো। তুমি যা ভাবছো তা কখনোই সম্ভব হবে না। পাহারিয়াদের তো চেনো না। আমার একটা ডাকে তারা ছুটে এসে তোমার লাশ ফেলে দেবে।
-- এতটা কেন ভাবছো? আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি, মারত্মক ভুল করেছি অন্তত কনফেস করার সুযোগটুকু দাও 
-- আমায় তুমি কোন সুযোগ দিয়েছিলে? একবারও ভেবেছিলে ওই অবস্থায় একটা মেয়েকে মুখের উপর বিয়ে করতে অস্বীকার করলে তার মনের অবস্থা কী হতে পারে?
--- সেই মুহূর্তে না ভাবলেও তুমি চলে যাওয়ার সাথে সাথে ভেবেছি। ছুটে গেছি তোমাদের বাড়িতে। সারাটা রাত খুঁজেছি। থানা,পুলিশ কিচ্ছু বাদ দিইনি। কিন্তু তোমায় খুঁজে পাইনি। তোমার বাবা,মা প্রথম অবস্থায় আমার সাথে সহযোগিতা করলেও পরে তারা আমাকেই দায়ী করে নানানভাবে হেনস্থা করেন। তবে একথা সত্যি আমি তোমার প্রেগনেন্সির ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলিনি। 
-- তোমার কোন কথা শুনবার প্রবৃত্তি আমার নেই। তুমি কী জন্য এখানে এসেছো সেটা বলো।
-- আমি জানি শ্রেষ্ঠা আমার মেয়ে। তুমি বিয়ে করোনি তাও বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই ভদ্রলোক তোমার কে হন?
-- এসব জানতে চাওয়ার অধিকার যেমন তোমার নেই ঠিক তেমনই আমিও বলতে তোমায় বাধ্য নই। শুধু উনি নন উনার গোটা পরিবার আমার আর আমার মেয়ের কাছে ঈশ্বরের দূত সমান। এর বাইরে একটা কথাও আমি তোমায় বলবো না।
-- বেশ বোলো না। মেয়েকে একটু ডাকো ওকে আদর করেই আমি চলে যাবো।
-- না, আমি চাই না তোমার মত একজন মানুষের সংস্পর্শে ও এক মুহুর্তকাল সময় কাটাক। তুমি এখন যেতে পারো। আর কখনো তুমি এখানে আসবে না। 

ক্রমশ 

  
    

Tuesday, April 18, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬০ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬০ পর্ব)

  এই ক'টা বছরে সৌম্য তার বাবা,মা দু'জনকেই হারিয়েছে। তারা অনেক চেষ্টা করেছেন সৌম্যর বিয়ে দিতে। কিন্তু সৌম্যকে তারা কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। যেহেতু সৌম্য ব্যবসার কাজে সকাল থেকে মাঝ রাত অবধি কখনো কখনো বাইরে থাকতো তাই তিয়াসাদের ঘটনা তারা কিছুই জানেন না আর এই ব্যাপারে সৌম্য কিছু কোনদিনও তার বাড়িতে জানায়নি। মায়ের আদেশ অনুসারে সৌম্য প্রতিমাসে দীপিকাকে টাকা পাঠিয়ে দিতো যা তার বাবা জানতেন না। মেয়ে শ্রেষ্ঠা আস্তে আস্তে উপরে ক্লাসে উঠেছে আর সৌম্যর পাঠানো টাকার একটা করে অংশ বেড়েছে। 
  দীপিকা যতদিন সৌম্যদের বাড়িতে থেকেছে ততদিন সৌম্যর মায়ের কথামত সে শাঁখা, সিঁদুর পরেছে। কিন্তু ব্যকথাং এ গিয়ে সে আর ওইসব ছুঁয়েও দেখেনি। মেয়েকে স্কুলে ভর্তির সময় সে বাবার নামের জায়গায় সুজয়ের নামটা দিলেও চিরদিনের মত তার মন থেকে সে সুজয়ের নামটা মুছে ফেলেছে। 
   মেয়ের বয়স যখন প্রায় আট বছর হঠাৎ সে এতটাই অসুস্থ্য হয়ে পড়ে দীপিকার নিজের কেউ না থাকায় সে সৌম্যকে ফোন করে জানায়। সৌম্যর মায়ের অনুরোধে সৌম্য দু'দিনের জন্য গ্যাংটক ছুটে যায়। শ্রেষ্ঠাকে হাসপাতাল ভর্তি করতে হয়। দু'দিনের জায়গায় সৌম্যকে সেখানে বেশ কটাদিন থাকতে হয়। সৌম্য হোটেলেই থাকে। শ্রেষ্ঠা সুস্থ হয়ে বাড়ি আসলে সৌম্য যথারীতি বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে দীপিকার জীবনে। সুজয় তার বউ নিয়ে গ্যাংটক বেড়াতে যায়। ঢালু পাহাড়ের রাস্তা চলতে গিয়ে সুজয়ের বউ পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে নেয়। সেও তখন ওই হাসপাতালেই তার বউকে নিয়ে আসে। 
  হাসপাতাল গেটের কাছে দীপিকাকে দেখে সুজয় এগিয়ে আসে তার দিকে,
-- তুমি এখানে?
 দীপিকা সুজয়কে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার একদম সামনে দাঁড়িয়েই প্রশ্নটা করায় সে উত্তর দিতে বাধ্য হয়
-- কেন আমি এখানে আসতে পারি না? এ কথা জানার অধিকারও তোমার নেই - আমি এখানে কী করছি ,কেনোই বা এসেছি।
-- আমার প্রতি তোমার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি অন্যায় করেছি আমি স্বীকার করছি। তখন আমি শুধু নিজের কথা আর পরিবারের কথাই ভেবেছিলাম। তোমার দিকটা ভেবে দেখেছিলাম না। পরে ভেবে দেখেছি আমি যা করেছি ভুল করেছি। কিন্তু তুমি আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই ওই মুহূর্তের কথাটা ধরে নিয়ে আজ ন'বছর নিজেকে লুকিয়েই রাখলে।
-- আমার এসব কথা শোনার কোন ধৈর্য কিংবা সময় কোনটাই নেই। 
-- সময় নেই বললে তো হবে না? সারাজীবন তুমি আমায় আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখবে সত্যতা জানবে না তাতো হবে না 
-- আসল কথা আমার তোমার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। ওই অভিশপ্ত দিনগুলির কথা আমি ভুলে গেছি।
 দীপিকা আর এক সেকেন্ডও সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যায়। তখন সৌম্য হাসপাতালের ভিতরেই ছিলো। সে বাইরে বেরিয়ে গেটের কাছে দীপিকাকে না দেখতে পেয়ে ফোন করে। তারপর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দু'জনে একসাথে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে সুজয় সব লক্ষ্য করে। সুজয় নিশ্চিত হয় ওই সৌম্যকান্তি যুবকটিই দীপিকার স্বামী। তাহলে তার যে সন্তান দীপিকার গর্ভে এসেছিলো সে কি পৃথিবীর আলো দেখেনি?
  সাত বছর হল সুজয়ের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোন সন্তান হয়নি। ডাক্তার জানিয়েও দিয়েছেন সুজয়ের স্ত্রী কোনদিন মা হতে পারবেন না। সুজয়ের বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। মা এখনো বেঁচে। তিনি ছেলের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেও সুজয় রাজি হয়নি। তারা একটি শিশু দত্তক নেবে বলে প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে রেখেছে। তবে দত্তক নেবো বললেই তো আর নেওয়া যায় না। হ্যাপা অনেক। সিরিয়ালে এখনো তাদের নাম আসতে অনেক দেরি। প্রতিবছর তারা ঘুরতে বেরোয়। এবার তারা এখানে। কিন্তু এখন যে সমস্যায় সে পড়েছে কবে নাগাদ এখান থেকে বেরোতে পারবে তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে দীপিকাকে দেখে তার মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সে মনেমনে ভাবে এখানে হয় সে কিংবা তার স্বামী চাকরি করে নুতবা কোন আত্মীয় ভর্তি। কিন্তু কলকাতা থেকে এতদূরে দীপিকা কী করে এলো? তবে কি ওর স্বামী এখানেই সার্ভিস করেন? পুরো ঘটনা জানতেই হবে। জানতেই হবে বাচ্চাটার কী হল? যদি সে সত্যিই পৃথিবীর আলো দেখে থাকে তাহলে হিসাব মত তার বয়স এখন আট বছর। কিন্তু সে ছেলে না মেয়ে? যে ভাবেই হোক জানতেই হবে। দীপিকার হাতে পায়ে ধরে যদি নিজের সন্তানটিকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করতে পারে সেই চেষ্টায় সে করবে। 
  পরদিন ভিজিটিং আওয়ারে হোটেল থেকে সুজয় আবার হাসপাতাল আসে। স্ত্রীর কাছে একটু দেরীতে যাবে ঠিক করে। কিন্তু আজ তাকে দেখতেই হবে দীপিকা আজ আবার এখানে আসে কিনা। সে হাসপাতালের বাইরে একটি দোকানের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না তাকে। একটা গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়ায় আর গাড়ি থেকে দীপিকা আর সুদর্শন পুরুষটি নেমে হাসপাতালের ভিতর চলে যায়। সুজয় ওদের ফলো করতে থাকে।

ক্রমশ - 

Sunday, April 16, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৯ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৫৯ পর্ব)

   কোথা দিয়ে যে পাঁচটা বছর কেটে গেলো কেউই টের পেলো না। সবাই কেমন যেন যন্ত্রের মত চলছে। যার যা কাজ, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম। হাসতে, গল্প করতে সবাই যেন ভুলে গেছে। নিলয় চলে যাওয়ার পর সকলের সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। পিয়াকে বলে যাওয়া নিলয়ের কথাগুলো পিয়া অনেক চেষ্টা করেছে দিদিকে রাজি করাতে যাতে সে সৌম্যকে বিয়ে করে। কিন্তু তিয়াসার সেই এক কথা, "দেবতাকে ভালোবাসা যায়,শ্রদ্ধা করা যায় কিন্তু তাকে বিয়ে করে সংসার করা যায় না। তাকে দূর থেকেই প্রণাম জানাতে হয়।"
-- কিন্তু দিদি নিলয়দার যে এটাই শেষ ইচ্ছা ছিলো
-- না, তুই ভুল করছিস তোর নিলয়দার শেষ ইচ্ছা ছিলো তার জুইকে যেন মানুষের মত মানুষ করি। আর যে হৃদয়ে নিলয়কে জায়গা দিয়েছিলাম সে না থাকলেও সেখানে আমি অন্য কাউকেই বসাতে পারবো না।
-- তুই কি বুঝতে পারিস না সৌম্যদা তোকে ভালোবাসে। যে যা করেছে সেই ভালোবাসার জায়গা থেকেই করেছে।
-- কেন বুঝবো না। ভালো না বাসলে কেউ কি কারও জন্য এতটা করতে পারে?
-- তাহলে ওর কথা তুই ভাববি না ?
-- কে বললো ভাবি না? দেবতার স্থান ভক্তিতে হৃদয় গহীনে। সেখানে আছে ভক্তি,শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রেম নয়। প্রেমে অনেক কাঁটা থাকে। কিন্তু ভক্তির ভালোবাসায় কোন কাঁটা থাকে না। সেখানে থাকে শুধু শ্রদ্ধা।
   পিয়া আলাদাভাবে সৌম্যকেও বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়। সৌম্য তাকে বলে,
-- পিয়া, তোমার দিদিও জানে না যে আমি তাকে কলেজ লাইফ থেকেই ভালোবাসি। তাকে ভালোবেসেই অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে সুখী হতে পারবো না বুঝতে পেরে আমি বিয়ে করিনি। হারিয়েই তো গেছিলো তোমার দিদি আমার কাছ থেকে। আমি জানতাম না তোমার দিদিও আমাকে ভালোবাসতো। কিছুদিন আগে জেনেছি। তিয়াসাই আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু কী জানো? সব ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে গেলে ভালোবাসা তার নিজস্বতা হারায়। ভালোবাসার জন্য ভালোবাসতে হয়, ভালোবেসে কিছু পাওয়ার আশা করলেই ভালোবাসা অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে যায়। তিয়াসা, নিলয়ের মধ্যে যে পাগল করা ভালোবাসা ছিলো সেই ভালোবাসায় ওকে আজীবন আগলে রাখবে। নতুন করে তিয়াসা এ জীবনে আর কাউকেই পাগলের মত ভালোবাসতে পারবে না। ওদের দু'জনের ভালোবাসার মধ্যে নতুন করে আমি ঢুকতে গেলে ঝঞ্ঝাট বাড়বে বৈ কমবে না। তার চেয়ে এই ভালো তিয়াসা আর জুইয়ের দেখভাল আজীবন করে যাবো আর দূর থেকেই ওকে ভালোবেসে যাবো।
-- দিদি ঠিকই বুঝেছে তুমি মানুষ নও ,দেবতা। তোমাকে দূর থেকেই পুজো করতে হয়।
-- না,আমি দেবতা নই কিন্তু ভালোবাসা কাকে বলে সেটা বুঝি। ভালোবাসলেই যে কাছাকাছি আসতে হবে তা মোটেই নয়। ভালোবাসা সব থেকে একটা পবিত্র সম্পর্ক। সেই পবিত্র সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে দুটি মানুষকেই একটু দূরে দূরে থাকতে হয়। আর এই পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে থাকে না কোন পাপবোধ। এ ভালোবাসা মনকে উদাস করে, হৃদয়ে প্রফুল্লতা আনে। এ এক আলাদা অনুভুতি।
-- আমার আর কিছু বলার নেই তোমাদের দু'জনকে। আমাকে ডেকে নিলয়দা সেদিন বলেছিল, 'পিয়া যখন আমি থাকবো না তুমি কিন্তু নিজে উদ্যোগী হয়ে সৌম্য আর তিয়াসার বিয়েটা দিয়ে দেবে। আমার মায়ের কোন আপত্তি থাকবে না। কারণ এ বিষয়ে আমি মাকে আমার শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে এসেছি। যে তিনটি মানুষকে আমি রেখে যাচ্ছি মা,জুই আর তিয়াসা এই তিনজনই আমার প্রাণের থেকেও প্রিয়। তাই আমি যখন থাকবো না এরা যাতে ভালো থাকে সেটা ভেবেই আমার এই সিদ্ধান্ত। তিয়াসা মায়ের খেয়াল রাখবে, মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করবে এসব আমি জানি। কিন্তু তিয়ার কথাটাও তো আমায় ভাবতে হবে। সৌম্যর মত একজন মানুষ যদি ওর পাশে থাকে ও সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারবে। তাই এই দায়িত্বটা আমি তোমায় দিয়ে গেলাম।' 
  সৌম্য আর কিছুই বলে না পিয়ার এই কথার জবাবে। শুধু মনেমনে ভাবে 'নিলয়, তোমার মত আমিও তিয়াসাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। তোমার জায়গা আমি নিতে পারবো না ঠিকই কিন্তু তিয়াসা আর জুইয়ের কোন কষ্ট আমি হতে দেবো না। তুমি যেখানেই থাকো না কেন শান্তিতেই থেকো ভাই। যে দায়িত্ব তুমি আমায় দিয়ে গেছো তিয়াসার সাথে একই ছাদের তলায় না থাকলেও যতদিন আমার প্রাণ আছে আমি সে দায়িত্ব পালন করে যাবো।'
  সময়ের সাথে সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন হতে থাকে। তিয়াসার শ্বাশুড়ি এখন শয্যাশায়ী। একজন আয়া রাখা আছে তার জন্য। তিয়াসা যখন অফিসে থাকে সেই সময়টুকু সে নীলিমাকে দেখাশুনা করে। জুই শুধু পড়াশুনায় নয় সংসারিক কাজকর্মও বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। সৌম্য আঙ্কেলকে সে দেবতার মত ভক্তি,শ্রদ্ধা করে। দিনগুলি এভাবেই কেটে যেতে থাকে।

ক্রমশ 

Friday, April 14, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৮ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৫৮ পর্ব)

   নিলয় ওদের দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বললো,
-- তোর বিয়েতে খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু শরীরে দিলো না রে 
 -- আমার বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই 
 অসিত ওদের পরস্পরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
 শ্রাবণী প্রথম অবস্থায় নিলয়কে চিনতেই পারেনি ওর শারীরিক কন্ডিশন দেখে। কিন্তু পরমুহুর্তে নিলয়কে চিনতে পেরেই চোখ ভর্তি জল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই অসিতের ফোনটা বেজে ওঠায় অসিত 'একটু আসছি' - বলে বেরিয়ে যায়। শ্রাবণী নিলয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- এমনভাবে তোমায় দেখবো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। এ কী হয়ে গেলো সবকিছু? কেন হল? এর থেকে জীবনে আর তোমার সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো।
-- আমি কিন্তু অনেকদিন আগেই তোমার খোঁজ পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তুমি অসিতের স্ত্রী। অসিত ভীষণ ভালো ছেলে।
 শ্রাবণী কেঁদেই চলে। নিলয় তাকে বলে,
--- ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। সেই রাতের ঘটনার পর আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি। কিন্তু -- ।ওই যে বললাম ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। তোমার বাবা,মা এখন কেমন আছেন?
 শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
-- সে অনেক ঘটনা। তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। এই পৃথিবীতে আমার নিজের লোক বলতে আছে অসিত আর অসিতের পরিবার।
 নিলয়ের ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি দেখা যায়। 
-- নিজেকে সামলে নাও শ্রাবণী। এক্ষুণি অসিত এসে যাবে। আর শোনো তুমি এখানে আর এসো না। তাতে তোমার কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। বর্তমানকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, অতীতকেও ভুলে যাওয়া যায় না। তবুও বলবো আমার জীবনের এই শেষ বেলার আমাদের দেখা হওয়ার কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কোরো।
 নিলয়ের কথা শেষ হতে হতেই অসিত এসে ঢোকে,
-- আমার বউয়ের সাথে কথা হল?
-- ওই আর কী? হানিমুনে কোথায় গেলি?
-- আর কোথায়? ম্যাডাম তো সরকারি চাকরি করেন। উনার ছুটি ম্যানেজ না হওয়াতে বাঙ্গালীর কম টাকায় যেখানে হানিমুন হয় - পুরী।
 দুই বন্ধু হেসে ওঠে। শ্রাবণী 'আসছি' - বলে বেরিয়ে যায়। একটু পরে তিয়াসা ভিতরে আসে। অসিতও বেরিয়ে আসে।
   শ্রাবণী খুবই মনমরা হয়ে থাকে। অসিত বুঝতে পারে এমন একটা তরতাজা যুবকের এই পরিণতি স্বাভাবিক ভাবেই শ্রাবণী মেনে নিতে পারছে না। তাই ওর মন খারাপ। এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই অসিত নানান কথা বলে শ্রাবণীকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
  এদিকে ডাক্তাদের বোর্ড বসেও নিলয়ের সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কখনো তাঁরা বলেন, হেপাটাইটিস বি, কখনো সারা শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছে আবার কখনো বলতে থাকেন সেপ্রসিমিয়া। তাঁরাও ঠিক ভাবে রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। তিয়াসার চারিপাশ অন্ধকার হতে থাকে। সৌম্য পাজেল্ড হয়ে পড়ে। দিনকে দিন নিলয়ের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এদিকে নার্সিংহোমের বিল হুহু করে বেড়ে চলেছে। নিলয় নিজেই এবার সৌম্যকে বলে,
-- ভাই, বন্ধু হয়ে বন্ধুর জন্য অনেক করেছো। আর টাকা খরচ করে কোন লাভ নেই। রোগ যেখানে ডাক্তারের অধরা সেখানে বাঁচার আশা আর নেই। পরজনম বলে যদি কিছু থাকে আমরা যেন একই মায়ের গর্ভে আসি।
-- উল্টোপাল্টা কথা বোলো না নিলয়। তিয়াসা শুনলে খুব কষ্ট পাবে।
-- ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে ও। তিয়া বুঝেই গেছে আমি আর বাঁচবো না। ও ঠিক নিজেকে সামলে নেবে। আর তুমি তো রইলে ওদের মাথার উপরে। আমার জুই যাতে মানুষ হয় দেখো। খুব অল্প সময় নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর আমাকে এই সময়টুকুতেই দু'হাত ভরে দিয়েছেন।
-- চুপ করো নিলয়। আমার এসব শুনতে একদম ভালো লাগছে না। এত কেন ভাবছো? আমি আছি তো। আমি তোমায় নিয়ে চেন্নাই যাবো। আমি কালই ডাক্তারের সাথে কথা বলবো।
-- পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমায় নিয়ে যাও না কেন আমার রোগ কেউ সারাতে আর পারবে না। আমার সময় শেষ।
-- আজ তুমি বড্ড বেশি কথা বলছো। দাঁড়াও আমি গিয়ে তিয়াসাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-- না,না বসো। ঠিক আছে আর এসব বলবো না। তবে আর একটা কথা না বলে পারছি না। আমি চলে গেলে ওদের তুমি দেখো।
--- উফফ সেই একই কথা! আমি বেরোচ্ছি।
  সৌম্য বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিয়াসা এসে ঢোকে। সে এতক্ষণ বাইরে বসে নীরবে কেঁদে চলেছিল। তাকে দেখেই নিলয় বলে,
-- মেয়েটাকে কালকে একবার নিয়ে এসো।অনেকদিন দেখি না। বড্ড দেখতে ইচ্ছা করছে।
-- কিন্তু কাল তো ওকে ঢুকতে দেবে না। কাল তো শনিবার। পরশু নিয়ে আসবো। রবিবার ছাড়া তো বাচ্চাদের অ্যালাও করে না।
 নিলয় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। 
-- আমায় একটু জল দেবে? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
 নিলয়ের কথা শুনে তিয়াসা উঠে গিয়ে বোতল থেকে গ্লাসে জল ভরে ওকে খাইয়ে দেয়। হঠাৎ তিয়াসার হাতটা ধরে বলে,
-- আজ তোমাকে আমার একদম ছাড়তে ইচ্ছা করছে না।
 তিয়াসা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিলয় তাকে দু'হাতে হালকা জড়িয়ে ধরে বলে,
-- আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি এভাবে কাঁদবে না। মাকে,মেয়েকে তো তোমাকেই সামলাতে হবে।
 তিয়াসা হাত দিয়ে নিলয়ের মুখটা চেপে ধরে বলে,
--- এসব অলুক্ষুনে কথা একদম বলবে না। তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে। সৌম্য বলেছে ও তোমায় নিয়ে চেন্নাই যাবে।
-- ভাগ্য করে একটা বন্ধু পেয়েছিলে।
 কথাটা বলে মৃদু হাসে নিলয়। ইতিমধ্যে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে বেরিয়ে আসতে হয়।নিলয় একদৃষ্টে তিয়াসার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ থেকে অবিরল ধারায় জল পড়তে থাকে 

ক্রমশ -
    

Thursday, April 13, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৭ পর্ব)

অঞ্জলী বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করেন ছেলে বাড়িতে থাকলে কিংবা অধিক রাতে ফিসফিস করে ফোনে কার সাথে যেন গল্প করে। তিনি একদিন অরুণাভকে ডেকে বলেন,
-- তোমার ছেলে প্রেম করছে। এবার ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে ওই মেয়ের সাথেই।
 অরুণাভ তার অঞ্জলীর মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে আছেন দেখে অঞ্জলী নিজেই আবার শুরু করেন -
-- অনেকদিন তোমাদের কাছ থেকে একটা কথা লুকিয়ে রেখেছি। আজ সেটা বলবো।
-- বেশ কয়েক যুগ তোমার সাথে সংসার করছি। তুমি যে কোন কথা লুকিয়ে রাখতে পারো আমি তো ভাবতেই পারছি না 
-- আসলে কী জানো তুমি যখন মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে আসো আমি সত্যিই ওকে আমাদের কুহু ভেবেছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে আমি কয়েক মাসের মধ্যেই সবকিছু মনে করতে পারি। আমাদের কুহু যে নেই সে যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না এই সত্যিটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ততদিনে আমি কুহু ভেবে মেয়েটিকে আমার কুহুর জায়গাটা দিয়ে ফেলেছি। খুব ভালো মেয়ে ও। এমনভাবে ও আমাকে মা বলে ডাকতো  তখন একবারের জন্যও আমার মনে হয়নি ও আমার নিজের মেয়ে নয়। কিন্তু আমি তোমাদের ইচ্ছে করেই ধরা দিইনি। ওকে কুহু বলে ডাকতেই আমার ভালো লাগতো।
  অরুণাভ চুপচাপ অঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনে যাচ্ছেন। অঞ্জলী যখন তাকে কথাগুলো বলছেন তার দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অরুণাভ তবুও যেন দেখতে পারছেন অঞ্জুর মুখে এক প্রসন্নতা। 
 -- মেয়েটির পরিচয় জানার জন্য মনটা উসখুস করতো । একদিন তুমি ব্যবসার কাজে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। সমস্ত ফাইলপত্র খাট আর টেবিলে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। সেগুলো গুছাতে গিয়ে একটা ফাইলের উপর আমি শ্রাবণী নামটা দেখে সেটা খুলে দেখি ওর সমস্ত কাগজপত্র। কিন্তু সবকিছু আমি তোমাদের কাছে গোপন করে যাই। ওকে ছাড়তে আমার মন মোটেই সায় দেয় না। তখন থেকেই আমি ভেবে রেখেছিলাম অতুর সাথে ওর বিয়ে দেবো। কিন্তু প্রথম দিকে অতুর সাথে ওর সম্পর্ক ছিল সাপ আর নেউলের।আমি জানতাম একদিন না একদিন ওরা নিজেদের মধ্যে সব মিটমাট করে নেবে। আর ওদের মিটমাট হয়ে গেলেই আমি ওদের বিয়ের কথা ভাববো।
-- তাই বলে এতদিন ধরে আমাকেও অন্ধকারের মধ্যে রেখে দিলে? অবশ্য আমরা বাপ,বেটা দু'জনেই বুঝেছিলাম ওই ছাব্বিশে জুন পুজোর নাম করে জন্মদিন পালন করার ঘটা দেখে। 
-- কই তোমরা তো কিছু বলনি তখন?
  অরুণাভ তখন হাসতে হাসতে বললেন,
-- তোমার মত আমরাও লুকিয়ে গেছিলাম।
    দু'জনের কাউকে কিছু না জানিয়েই বিয়ের বাজার করতে শুরু করে দিলেন। না জানে অসিত ,না জানে শ্রাবণী। অসিত অফিসে বেরোনোর পর পরই দু'জনে শপিং করতে বেরিয়ে পড়েন। শ্রাবণীর কাছে এক দু'দিন অন্তরই জানতে চান সে কবে নাগাদ ছুটি পাবে? 
  পাক্কা ছ'মাস পরে পুজোর ছুটিতে শ্রাবণী বাড়ি আসবে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে পাঁজি নিয়ে আশ্বিন মাসেই বিয়ের দিনক্ষণ তারা ঠিক করে রাখেন। যেদিন শ্রাবণী বাড়িতে আসে সেদিন রাতেই খাবার টেবিলে সুখবরটা অঞ্জলী নিজেই ওদের দেন। বিয়ে বেশ ধুমধাম সহকারেই হয়। যেহেতু শ্রাবণীর কেউ নেই সেইহেতু বিয়ে বৌভাত সবকিছুরই আয়োজন এই বাড়ি থেকেই হয়। শ্রাবণীর ছুটির সমস্যার কারণে হানিমুন মাত্র তিনদিনের জন্য পুরী। জয়েন করেই কলকাতা ট্রান্সফার নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। প্রায় বছর খানেক যাতায়াতের পর সে কলকাতা আসতে সমর্থ হয়।
  এদিকে নিলয়ের অসুস্থ্যতার খবরে অসিত বেশ কয়েকবার তাকে নার্সিংহোম দেখতে গেছে। বিয়ের আগে এবং পরে বেশ কিছুদিন মনে পড়লেও নিলয়কে দেখতে যাওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি তার। নিলয় পুণরায় যে অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এ খবর সে জানতে পেরেও শ্রাবণীর শিপটিং ডিউটির জন্য যাওয়া হয়ে উঠছে না। কারণ তার এবার ইচ্ছে সে তার বউকে সাথে নিয়েই যাবে। 
  শ্রাবণী একদিন মর্নিং ডিউটি করে বাড়ি আসার পর অসিত ঠিক করে সে অফিসে যাবে না। নিলয়কে দেখতে যাবে দু'জনে। অসিতের মুখে নামটা শুনে প্রথমে শ্রাবণী একটু চমকে উঠলেও পরে ভাবে একই নামে তো কত মানুষই থাকতে পারে। তবুও তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খচখচ করতে থাকে। কিন্তু অসিতকে তো কিছুই বলা ঠিক হবে না ভেবে সেও চুপচাপ থাকে।
  বেরিয়ে পড়ে দু'জনে একদিন বিকেল বিকেল নিলয়কে দেখতে। সেদিন তিয়াসা একাই ছিলো। অন্যেরা আসলেও সকলেই একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছিলো। শুধু পিয়াসা থেকে গেছিলো দিদি একা আছে বলে। অসিতের সাথে তিয়াসার আগেই পরিচয় ছিলো। শ্রাবণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো অসিত। পিয়া নিলয়ের কাছে ভিতরেই ছিলো। তিয়াসা ওকে ডেকে বাইরে আসতে বললো। অসিত ও শ্রাবণী এগিয়ে গেলো নিলয়ের দিকে। 

ক্রমশ -

Tuesday, April 11, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৬ পর্ব)

সৌম্যই তিয়াসার পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু তিয়াসার কাছ থেকে কোন কিছুর আশা সে কখনোই করে না। কী অদ্ভুত ভালোবাসা সৌম্যর! তিয়াসার সুখ,শান্তি, ভালোথাকাই সৌম্যর একমাত্র চাহিদা। নিলয় অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে সৌম্য তার তিয়াকে ভালোবাসে। এখন যে তিয়াসাও বোঝে না তা নয়। কিন্তু এই যে তিনটে মানুষ কেউ কাউকেই তাদের মনের কথা অন্যের সাথে শেয়ার করে না। তিনজনে যখন এক জায়গায় হয় তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া সাধারণত অন্য কোন ইয়ার্কি,ঠাট্টা কখনোই হয় না। সমন্তরাল তিনটি রেখা। 
  জুই খুব ভালোবাসে তার আঙ্কেলকে। আঙ্কেলকে দেখতে পেলেই দৌড়ে এসে সে আঙ্কেলের কোলে উঠে আধো আধো কথায় তাকে পাগল করে তোলে। সৌম্য যখনই এখানে আসে খালি হাতে কখনোই আসে না। জুই,নিলয় এদের জন্য কিছু না নিয়েই আসে। যেটুকু সময় সে থাকে নিলয়ের ঘরে বসেই গল্প করে। বেরোনোর আগে নিলয়ের বাবা,মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ। 
   দেখতে দেখতে বছর দু'য়েক হয়ে যায়। নিলয় এখন বেশ সুস্থই বলা চলে। সে ঘরে বসেই কম্পিউটারে কিছু না কিছু করে দুটো টাকা রোজগার করছে। বাইরে বেরোতে তাকে কখনোই তিয়াসা দেয় না। ভীষণ যত্নের মধ্যেই তাকে রাখে। যেহেতু তিয়াসা সকাল দশটার মধ্যেই বেরিয়ে যায় তাই নীলিমার উপর স্বাভাবিকভাবেই চাপটা বেশি পরে। তার উপর প্রায় চার বছরের দুষ্টু জুই। তার দুষ্টুমি, আর ছুটাছুটিতে বাড়ির সকলেই নাজেহাল। ভোরবেলা তাকে তিয়াসা স্কুলে দিয়ে আসে। তার আসবার সময় আর তিয়াসার অফিস বেরোনোর সময় যেহেতু এক তাই নিলয়ের বাবা অজয় গিয়ে তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসেন। এইভাবেই দিনগুলি দুঃখ,কষ্ট কখনো বা আনন্দের মধ্যেই চলে যাচ্ছিল । কিন্তু হঠাৎ করেই নিলয়ের বাবা অজয়  চিরতরে চলে যাওয়াতে আবার পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে এলো। সবকিছু আবার যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। সব চেয়ে সমস্যা দেখা দিলো জুইয়ের স্কুল নিয়ে। এর সমাধানও সেই সৌম্যই করলো। সে তিয়াসার অফিস টাইমের কিছুটা রদবদল করে দিলো। তিয়াসা প্রতিটা দিন প্রতি মুহূর্ত সৌম্যর কাছ থেকে শুধু নিয়েই যাচ্ছে আর কৃতজ্ঞতার বোঝা নিজের কাঁধের উপর নিতে নিতে সে প্রায় ন্যুজ হয়ে পড়েছে সৌম্যর কাছে। কিন্তু সৌম্যকে সে কথা জানানোর কোন সুযোগ সে পায় না। বলা ভালো সৌম্য সে সুযোগটুকুও তিয়াসাকে দেয় না। 
  সৌম্যই মনেহয় পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ যে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না চেয়ে ভালোবাসার মানুষটির সুখ,দুঃখের প্রতি নজর রেখে, তাকে ভালো রাখতে চায়। আর তাতেই তার সুখ তাতেই তার শান্তি।
   ঝড় যতই প্রবল হোক না কেন; সবকিছু তছনছ করে দেওয়ার পরেও মানুষ ঠিক সময়ের সাথে সাথে নিজেদের একটু একটু করে সামলে নিতে পারে। তিয়াসাও একটার পর একটা ঝড়ের পরেও সৌম্যর মত একজন প্রকৃত বন্ধুর সহয়তায় সব কিছুর থেকে মুক্তি পেলেও মানসিক শান্তি সে পায় না।এত কিছুর পরেও মাঝে মাঝেই নিলয়ের শরীরে নানান উপসর্গ দেখা দেয় দু'বছর পর থেকেই। 
   একদিন অনেক রাতে নিলয়ের কোমরে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর তিয়াসার ঘুমন্ত মুখটা দেখে সে তার ব্যথা নিয়েই সারা রাত কাটিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ে কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশে। ভোরবেলা নিলয়কে নিয়ে নার্সিংহোম ছোটে সে। প্রতিটা মুহূর্তে সৌম্যকে বিরক্ত করতে তার মন আর সায় দেয় না। কিন্তু নার্সিংহোম সেই মুহূর্তেই নিলয়কে ভর্তি করে নেয়। অপারগ হয়ে সে সৌম্যকে ফোন করে। সৌম্য ছুটে আসে। সৌম্যকে দেখেই তিয়াসা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। তিয়াসা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরায় সৌম্যর শরীরের উপর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। তিয়াসার সে আকুল কান্নায় আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে যায়। অনেক বুঝিয়ে সৌম্য তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছোটে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাকে জানিয়ে দেন যে কোন কারণেই হোক নিলয়ের শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছে। কতটা করতে পারবেন তারা সেটা নিজেরাও জানেন না। শুরু হল আবার দৌড়ঝাঁপ।
  তিয়াসার বোন পিয়াসার মাস ছ'য়েক হল বিয়ে হয়েছে একজন স্কুল শিক্ষকের সাথে। বিয়েতে তিয়াসা যাতায়াত করলেও একরাতও থাকতে পারেনি। আর নিলয় তো যেতেই পারেনি তার খাওয়া দাওয়ার রেস্টিকশনের জন্য।তাদের বাবার শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ নিলয়ের এই অসুস্থতার সময়ে তিনি নার্সিংহোম তাকে দেখতে আসতেও পারেননি। পিয়াসা এবং তার স্বামী তিয়াসার পাশে থেকে তার মনোবল বাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এরই মাঝে একদিন নিলয় পিয়ার সাথে একাকী কথা বলতে চায়।
    অধিকাংশ সময় এই চারটে প্রাণী নার্সিংহোম পরে থাকে। তিয়াসা কখনো নিলয়ের কাছে কখনো বা বাইরে বসে থাকে। ওষুধপত্র, ডাক্তারের সাথে কথা বলা সবই সৌম্য আর পিয়াসার স্বামী মিতান ই করে। 

ক্রমশ 

Sunday, April 9, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৫ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৫৫ পর্ব)

 সৌম্য একটু নিজেকে গুছিয়ে নিলো। তারপর বললো,
-- চলো আমরা একটু এগিয়ে ওই চায়ের দোকান থেকে চা খেতে খেতে বাকি কথা বলি।
 তিয়াসারও সেই মুহূর্তে চা খেতে খুব ইচ্ছা করছিলো। সে সৌম্যকে অনুসরণ করে এগিয়ে যায়। ওরা চায়ের দোকানে গিয়ে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে। তিয়াসা কয়েকবার চায়ে চুমুক দিয়ে সৌম্যর দিকে তাকিয়ে তার মনেহল সে যেন একটু অন্যমনস্ক। চুপচাপ চা খেয়ে চলেছে। তিয়াসা পাশে বসা সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- তুমি কী বলবে বলছিলে?
সৌম্য ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- আসলে যে কথাটা বলতে চাইছি সেটা বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি।
-- এত ভেবো না। আমি জানি তুমি এমন কিছু বলবে না যাতে আমি কিছু মনে করতে পারি। বলো কী বলতে চাও?
-- আসলে আমি ভাবছি - হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার পর নিলয়কে অনেক নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে চলতে হবে ।ওর খাওয়া-দাওয়া,ওষুধপত্র ছাড়াও নিয়মিত চেকআপ আছে। কিছু ভেবেছো এসব নিয়ে?
-- ভাবছি,সব সময় ভাবছি। নিলয়ের চাকরিটা চলে গেলো, ওর ওষুধ-পথ্য,মেয়েটার পিছনে খরচ আছে,সংসার চালনা - এসব ভাবতে ভাবতেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।
-- চাকরির চেষ্টা করছো না কেন?
-- কে বললো করছি না। আজ ছ'মাস ধরে চেষ্টা চালিয়েও ছোটখাটো কোন চাকরিও জোগাড় করতে পারছি না।
-- বাড়িতে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারো আমার কোম্পানিতে তাহলে চেষ্টা করতে পারি। তবে ম্যানেজমেন্টের কথায় শেষ কথা। আমি শুধু অনুরোধ করতে পারি।
 সহসা তিয়াসা সৌম্যর হাত দুটি ধরে বলে,
-- চেষ্টা করে দেখো তাহলে। বেঁচে যাবো সকলে সারাজীবন তোমায় দয়ায়।
 সৌম্য তিয়াসার কাছ থেকে আস্তে আস্তে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,
-- এভাবে বোলো না। আমার শুনতে ভালো লাগে না। আমি চেষ্টা করবো তোমার চাকরির জন্য। শুধু তুমি নিলয়ের কাছ থেকে অনুমতিটা নিয়ে নাও। তাহলে আগামীকাল এখানে আসবার সময় কাগজপত্রগুলো নিয়ে এসো।
-- নিলয় তো অনেক আগেই চাকরির জন্য আমায় বলেছে।
-- চাকরির জন্য বলেছে। কিন্তু আমার অফিসে চাকরি করতে দেবে কিনা সেটা তো জানতে হবে?
-- অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া আজ যে নিলয় সুস্থ হওয়ার পথে হাঁটছে সেতো তোমার জন্যই
-- এসব কথা আর বলবে না। ও আয়ু আছে ও বাঁচবে। এসব বিধাতা আগে থাকতেই ঠিক করে রাখেন। যাহোক আমি যেটা বললাম সেটাই কোরো।
-- দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সৌম্য। আর কোন উপায় নেই। নিলয় কোন অবস্থাতেই তোমার অফিসে চাকরি করা নিয়ে কোন কথা বলবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। তবুও আমি তার কাছে জানতে চাইবো। তুমি কেন বলছো সেটাও আমি বুঝতে পারছি।
 সৌম্য কোন উত্তর দেয় না। আবার ওরা নার্সিংহোম ফিরে আসে। কারণ ডাক্তার রাউন্ডে আসেন ঠিক রাত আটটায়। রোজই তার সাথে দেখা করে নিলয়ের শারীরিক অবস্থার কথা জেনে তবে ওরা ফেরে। তিয়াসাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর সৌম্য বাড়ি ফেরে। 
  প্রায় একমাস নিলয়কে হাসপাতাল থাকতে হয়। এরমধ্যে বড় জোর এক দু'দিন ছাড়া সৌম্য প্রায় রোজই গেছে। বাড়িতেও সৌম্য তিয়াসার সাথে নিজের গাড়ি করেই নিলয়কে বাড়িতে নিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই ক'দিনেই নিলয়ের সাথে সৌম্যর বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সৌম্য প্রয়োজনের একটি কথাও তিয়াসার সাথে বলে না। সেই প্রথম থেকেই। কিন্তু কেমন যেন একটা নেশার মত তাকে পেয়ে বসে রোজ তিয়াসাকে একবার দেখার। নিলয় বাড়িতে আসার পর বেশ কয়েকবার সৌম্য এখানে আসে। কিন্তু নিজের মনকে কন্ট্রোল করতে সে আস্তে আস্তে তাও বন্ধ করে দেয়। নিলয়ের ফোনে ফোন করে খোঁজ-খবর নেয় প্রায় প্রতিদিন। তিয়াসা ব্যাপারগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে পারে।।সেও কোন কথা কারো সাথে শেয়ার করে না।
    মাসখানেক হল তিয়াসা সৌম্যর অফিসে জয়েন করেছে। প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়ে সে পুরো তাজ্জব বনে যায়। এত টাকা এই সামান্য কাজে? পরে জানতে পারে সৌম্য তার সংসারের চাহিদা পূরণ করতেই পার্সোনাল একাউন্ট থেকে একমাত্র তার মাইনের টাকাটাই সে পেমেন্ট করে। অফিসে এমন একটি জায়গায় তিয়াসা বসে যেখান থেকে সৌম্য যাতায়াত করে। কিন্তু সে কখনোই তার চলতি পথে তিয়াসার সাথে কথা বলে না। তিয়াসা নিজের মত অফিসে আসে আবার নিজের মতই ছুটির পর বেরিয়ে যায়। অফিসের কেউই জানে না সৌম্য তিয়াসাকে চেনে। কিন্তু নিলয়ের চেকআপের সময় সৌম্য তার গাড়িতেই তাদের নিয়ে যায়। ওই দিনটি তিয়াসার ছুটি। এরজন্য ম্যানেজমেন্টের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না। এটাও সৌম্যরই ব্যবস্থা।
  নিলয় আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। এখন সৌম্য সপ্তাহে মাত্র একদিন তাকে দেখতে আসে। অনেক কিছুই নিলয় বুঝতে পারে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। কিন্তু উপকারীর উপকার সে মনে রাখতেও জানে। এমন কিছু কখনোই তার চোখে পড়েনি যাতে মনে হয় ওদের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে। কিন্তু এটুকুন সে বোঝে এখন মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সেখানে কারো প্রতি শুধু ভালোবাসা কাজ করে না; মানুষটির মনও থাকা দরকার। আর তা সৌম্যর আছে। সেতো প্রতিটা মুহূর্তে বুঝতে পারছে তিয়াসা তাকে পাগলের মত ভালোবাসে। যা কিছু তিয়াসা করেছে শুধুমাত্র তাকে বাঁচানোর জন্যই করেছে। সেখানে সৌম্যর প্রতি তার যদি পূর্ব দুর্বলতা থেকেও থাকে বিয়ের পরে সে সবকিছুই তো ভুলে গেছিলো। এখন যেটা সৌম্যর প্রতি আছে সেটা শুধুই কৃতজ্ঞতা! সেও তো শ্রাবণীকে ভালোবাসতো। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে থাকার। কই বিয়ের পরে তো তার কথা সে ভুলেই গেছিলো। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে কিছু অতীত থাকে। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে সময় মানুষের সেই অতীতের উপর একটা প্রলেপ ফেলে দেয়। কিন্তু ভুলতে কেউ পারে না।আর এটাই জীবন!

ক্রমশ 


 
   

Thursday, April 6, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৪ পর্ব)

দু'মাস চলে গেলো এরপর। কিন্তু ডোনার পাওয়া গেলো না। বলতে গেলে নিত্য খোঁজ নেয় সৌম্য ফোন করে। প্রয়োজনের একটি কথাও সে তিয়াসার সাথে বলে না। কিন্তু সৌম্য সেদিন নার্সিংহোম থেকে আসার পরেই তিয়াসার সাথে আলোচনা না করেই নিজেই একটা মোটা অঙ্কের টাকার অফার দিয়ে সাতদিন অন্তর অ্যাড দিতে থাকে। প্রত্যন্ত গ্রামের থেকে কেউ কেউ আসলেও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যম অতিক্রম করতে পারে না। নিলয়ের শারীরিক কন্ডিশনের কিছু কাগজপত্রের জেরক্স সৌম্য নিজের কাছে এনে রাখে এইগুলির কারণেই। শেষমেশ ডোনার সৌম্য জোগাড় করে। 
  সম্পূর্ণ নিজের খরচে সৌম্য নিলয়ের কিডনী প্রতিস্থাপন করে। হাসপাতালে সেদিন তিয়াসার সাথে রাত জাগে সে। পিয়া অনেক রাতে নিলয়দের বাড়িতে ফিরে যায়। জুই পিয়ার কাছে খুব ভালো থাকে তাই। বেশ কয়েক ঘন্টা পরে নিলয়ের জ্ঞান আসার পর তার সাথে দেখা করে তিয়াসাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সৌম্য ঘরে ফেরে। সৌম্য বাড়িতে টাকা-পয়সার ব্যাপারটা গোপন করে যায়। একজন বন্ধু অসুস্থ্য শুধু এটাই জানায়। সৌম্যর বাবা এখন আর তার ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে শারীরিক কারণে সময় দিতে পারেন না। তাই টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপারেও তিনি আর মাথা ঘামান না। ব্যবসার সমস্ত কিছুই সৌম্য দেখাশুনা করে।
   রোজই সৌম্য নিলয়কে দেখতে যায় বিকেল হলেই। তবে কিছুক্ষণ থেকেই সে চলে আসে। সেদিন সুযোগ পেয়ে তিয়াসা সৌম্যকে বলে,
-- একটু কথা ছিলো।
-- হ্যাঁ বলো কী বলতে চাও?
 আগে সৌম্য তিয়াসাকে তুই বললেও এখন সে তুমি বলে। কেন তা সে নিজেও জানে না। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দু'জনে এসে দাঁড়ায়।
-- তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ জমা হয়ে গেলো। শুধুমাত্র একজন ক্লাসমেট হিসাবে তুমি যা করলে আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকবো।
-- কী উল্টোপাল্টা কথা বলছো তুমি?
-- আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলবো সৌম্য। কোনদিন বলতে পারিনি যে কথা সেটাই তোমায় আজ জানাবো। 
 সৌম্য একটু অবাক হল। 
--- কী এমন কথা যা বলতে পারোনি?
-- নিলয় অসুস্থ্য হওয়ার পর আমি যখন দিশেহারা তখন তোমার মুখটাই আমার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠেছিলো। আমার স্থির বিশ্বাস ছিলো তুমি আমায় ফেরাবে না। তারও একটা কারণ ছিলো -
 তিয়াসা চুপ করে যায়। নিলয় কৌতূহলী হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ তিয়াসা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে।
-- কী হল বললে না কী কারণ ছিলো?
 কথাটা শুনে নিচের দিকে তাকিয়েই এক নিশ্বাসে তিয়াসা বলে উঠলো,
-- কলেজ লাইফে আমি তোমায় ভালোবাসতাম! কোথায় যেন এই ভালোবাসার প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো আমায় তুমি ফেরাবে না।
 সৌম্যর বুকের ভিতর কে যেন তখন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে। তিয়াসা কিন্তু মুখ নিচের দিকেই করে রেখেছে। সেই ভাবেই সে পুণরায় শুরু করে,
-- তুমি খুব বড়লোকের ছেলে। নিজের মনের কথাটা কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি আমরা তোমাদের সমকক্ষ নই বলে। যদি আমার ভালোবাসার কথা শুনে তুমি ব্যঙ্গ করো -
-- আর আজ বললে কেন?
-- জানি না। তবে তোমার মনে এ প্রশ্ন আসতে পারে কেন আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইলাম ? কোথাও যেন তোমার প্রতি একটা জোর অনুভব করছিলাম। জানি না কেন - আমার মন বলছিল আমার বিপদে তুমি আমার পাশে থাকবে।
-- বেশ! তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি।
 সৌম্য জানে আজ তার মনের কথাটা বলে কোন লাভ নেই। তাই সে চুপ করেই থাকে। সে একজন বন্ধু হয়েই আজীবন তিয়াসার পাশে থাকতে চায়। নিজের আবেগ,অনুভূতি সবকিছুই এত দিনের মত আজও কন্ট্রোল করেই নেয়।
-- সত্যি বলতে কী জানো? যখন আমার বিয়ে ঠিক হল তখন তোমার জন্য খুব কষ্ট হত। নিলয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার পরও তোমার কথা ভেবেছি। কিন্তু পরবর্তীতে নিলয়ের পাগল করা ভালোবাসা পেয়ে তোমার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। আমি খুব স্বার্থপর সৌম্য! গ্যাংটকে গিয়ে তোমায় ফোন করতে বলেছিলে। কিন্তু আমি তা করিনি। আসলে নিলয়ের ভালোবাসা আমায় সবকিছু ভুলিয়ে রেখেছিল। আমি ভুলে গেছিলাম তোমায়। ঠিক যখন বিপদে পড়লাম তোমার কাছেই হাত পাতলাম।
-- ছাড়ো না এসব কথা। মানুষ বিপদে পড়লে তো পরিচিতদের কাছেই হাত পাতে। আর আমরা তো বন্ধু ছিলাম। এসব কথা বলে নিজেকে ছোট কোরো না। আমি কিছুই মনে করিনি। তুমি জানো না আমার বাবা সম্পূর্ণ তার নিজ অর্থে কিছু এনজিও চালান। আমিই তাদের একমাত্র সন্তান। বিয়ে থা করিনি। কী হবে এত টাকা দিয়ে যদি মানুষের উপকারেই আসতে না পারলাম।
  তিয়াসা তখন প্রচন্ড কাঁদতে কাঁদতে বললো
--- সে তুমি যাই বলো না কেন আমার বিবেক আমায় প্রতিমুহূর্ত বলছে 'তুই স্বার্থপর।'
-- নিজেকে এভাবে ভেবো না। তাতে কষ্ট পাবে বেশি। বরং এটা ভাবো তোমার স্বামীর অসুস্থতায় তুমি তোমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে তাকে সুস্থ করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছো। ক'জন পারে এভাবে তার স্বামীকে সুস্থ্ করতে? কে টাকা খরচ করলো সেটা এখানে ম্যাটার করে না। নিলয়ের সুস্থ হয়ে উঠাটাই এখানে বড় কথা।এর পরেও যখনই তোমার যে কোন প্রয়োজনে আমি আছি তোমাদের সাথে। 
 তারপর কিছুটা সময় নিয়ে তিয়াসা একটু শান্ত হলে সৌম্য বললো,
-- যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলবো?
 তিয়াসা সৌম্যর দিকে তাকিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজ চোখের জল মুছে বলে,
-- বলো। তুমি যে উপকার আমার করেছো তাতে তুমি যাই বলো না কেন আমি কিছুই মনে করবো না। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।

ক্রমশ 

Monday, April 3, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৩ পর্ব )

মেয়ে জুইয়ের বয়স যখন একবছর, টলমল পায়ে হাঁটছে, আধো আধো স্বরে কথা বলছে ঠিক সেই সময়ে নিলয় একদিন অফিস থেকে জ্বর নিয়ে বাড়ি এলো। পরেরদিন তাকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পত্র সহ কিছু টেষ্টও লিখে দিলেন। জ্বর আর না আসায় গাফিলতি করে টেষ্টগুলো আর করলো না সে। বাড়ির সকলে বলেও কিছুই লাভ হল না। আবার অফিস,বাড়ি সেই একইভাবে আনন্দে ফুর্তিতে কাটতে লাগলো সময়। মাস দু'য়েকের মধ্যে দেখা গেলো তার পায়ের পাতা ফুলছে। মাঝেমধ্যে নিজেকে দুর্বল মনেহয়। আবার ডাক্তার আবার টেষ্ট। ধরা পড়লো সুগার। খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধের মুখেই। নিলয়ের মধ্যে নেই সেই আগের উদ্যমতা,নেই সেই উচ্ছাস। আস্তে আস্তে শারীরিক দিক থেকে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে দেখে তিয়াসা অনেক বুঝিয়ে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো। তখন নিলয়ের ক্রিটি নাইনের মাত্রা অনেক বেশি। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো পরিবারের সকলের মাথায়। এলোপ্যাথি,হোমিওপ্যাথি এমন কী কবিরাজি কোনোটাই বাদ নেই। নিলয় একদিন রাতে মেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তিয়াসাকে কাছে ডেকে বললো,
-- এখনো অফিস করছি। কতদিন করতে পারবো জানি না। তুমি এখন থেকেই চেষ্টা করো যদি কোন চাকরি পাও।
  তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-- তোমার কিছুই হবে না। তুমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। ভগবান এত নিষ্ঠুর কখনোই আমার প্রতি হবেন না।
 নিলয় ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বলে,
-- দূর পাগলী! সেতো বিধাতার হাতে। আমরা কেউ কী কিছু বলতে পারি তিনি কখন সুতো ধরে টান দেবেন?
 তিয়াসা নিলয়কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। 
 ওষুধ চলছে ওষুধের মত। ডাক্তার, বাড়ি আর ওষুধ এই হল এখন নিলয়ের রুটিন। ক্রিটি নাইন বাড়লো লাফিয়ে লাফিয়ে। বন্ধ হল অফিস। শুরু হল ডায়ালিসিস। দিন চলে যাচ্ছে তার মত করে কিন্তু পরিবারটির যেন সময় থমকে গেছে। প্রথমে মাসে ছিলো দু'টো  ডায়ালিসিস এখন সেটা মাসে চারটে হয়েছে। ডায়ালিসিস করে আসার পর তিনদিন একটু কথাবার্তা, হাঁটাচলা করতে পারে। তারপরেই সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তিয়াসা বাড়ির সকলের সাথে কথা বলে কিডনি প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু টাকার দরকার অনেক। গয়নাগাটি, যা জমানো টাকা আছে সব নিঃস্ব করেও পুরো টাকা যোগাড় হবে না। তবুও পেপারে অ্যাড দেয়। 
  টাকার চিন্তায় যখন সকলে অস্থির তখনই মনে পড়ে সৌম্যর কথা। সৌম্যর কাছে হাত পাততে নিজেকে খুব ছোট মনেহয় নিজের কাছেই। কিন্তু সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে সে হন্যে হয়ে ব্যাগের ভিতর তার কার্ডটা খুঁজতে থাকে। নিলয় দেখতে পেয়ে জানতে চায়
-- কী খুঁজছো সেই থেকে তুমি পাগলের মত?
-- একটা কার্ড। আমার এক বন্ধু যখন আমরা গ্যাংটক যাই তখন দিয়েছিলো। 
-- সে তো কবের কথা। তা কি আর খুঁজে পাবে? কী করবে তুমি তা দিয়ে?
-- যদি খুঁজে পাই তখন বলবো।
 তবুও তন্নতন্ন করে তাদের যতগুলো ব্যাগ আছে সে খুঁজে চলে। একসময় দুমড়ানো মুচড়ানো সৌম্যর কার্ডটা সে খুঁজেও পায়। কিন্তু সে নিলয়ের কাছে ব্যাপারটা গোপন করে যায়। দু'দিন পর ছিলো নিলয়ের ডায়ালিসিস। তিয়াসা প্রতিবারের মত নিলয়কে নিয়ে নার্সিংহোমে যায়। ভিতরে যখন নিলয়ের ডায়ালিসিস চলছে বাইরে তিয়াসা একবুক আশা নিয়ে সৌম্যকে ফোন করে।
    সমস্ত ঘটনা সে সৌম্যকে ফোনে জানায়। সৌম্য সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তিয়াসা যে তাকে ফোন করেছে সেটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু তার কাছে তিয়াসার এই স্বার্থপরতার থেকেও বেশি হয়ে ওঠে তিয়াসার স্বামীকে সুস্থ্য করে তার ভালোবাসার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। জানতে চায় কোন নার্সিংহোমে আছে আর কতক্ষণ আছে।
  চলে আসে কিছুক্ষণের মধ্যে। সৌম্যকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় তিয়াসা। সৌম্য চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একদৃষ্টে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে থেকে মনেমনে ভাবে - 'এখানে তিয়াসার তো কোন দোষ নেই। সে তার ভালোবাসাকে বাঁচানোর জন্য শেষ লড়াইটা লড়ছে। সেও তো তিয়াসাকে ভালোবেসে তার জীবনের সমস্ত সুখ,শান্তি,আনন্দ,ফুর্তি থেকে দূরে আছে। আর তাছাড়া সে তো কোনদিন তিয়াসাকে তার ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে জানায়নি। এখানে তিয়াসা আর সে - দুজনেই ভালোবাসার কাছে অসহায়!'
 সৌম্য কথা দেয় ডোনার পেলে সে তার সাথে কথা বলবে এবং সব দায়িত্ব নেবে। নিজেকে স্বার্থপর মনে হলেও এই ছাড়া তার আর কোন পথও খোলা নেই তিয়াসার। সেদিনই সে নিলয়ের সাথে তাকে ক্লাসমেট বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
-- এই নার্সিংহোমেই হঠাৎ করেই তার সাথে দেখা হয়ে গেছে।
 ওদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হয়। সৌম্য নিজেই ড্রাইভ করে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। নিলয় এবং তিয়াসা তাকে বারবার অনুরোধ করা স্বর্তেও সৌম্য সেদিন জরুরী কাজ আছে কিন্তু পরে আসবে বলে বেরিয়ে যায়। 

ক্রমশ 

Saturday, April 1, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫২ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৫২ পর্ব)

 
   গ্যাংটক থেকে ঘুরে আসার পরের মাসেই তিয়াসা বুঝতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিতে সে চায়নি। নিলয়কে জানালে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। দু'বাড়ির সকলেই খুশি। সুতরাং তিয়াসা তার মনের কথাটা কাউকেই বলতে পারে না। যদিও পরে সে ভেবে দেখে প্রথম সন্তান নষ্ট করলে পরে যদি তার আর সন্তান না হয়। তাই সে পরবর্তীতে খুশি মনেই সবকিছু মেনে নেয়। প্রথম থেকে শেষ অবধি প্রেগনেন্সির ফলে তার কোনোই শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় না।
      এ সময় মেয়েরা টানা কয়েকমাস বাপের বাড়িতে থাকলেও তিয়াসা তার মাকে জানিয়ে দেয় তার শ্বশুরবাড়িতে যত্নআত্তির কোন কমতি নেই। সুতরাং সে এখানেই থাকবে। চাকরি করার চিন্তা তখন মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। নিলয় বাড়িতে থাকলেই হাঁটতে,চলতে বসতে সব সময় তার নজরদারী। খাওয়ানোর ঘটা বাড়ির সকলের এতটাই এখন খাবার দেখলেই তার আতঙ্ক। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ মনেহয়। আবার কখনো নিজের অজান্তেই একটা অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এত সুখ সত্যিই কী তার কপালে সইবে?
  শ্বশুরবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী তার দু'বার সাধ হয়। একবার সাত মাসে আর একবার ন'মাসে। সাত মাসের সাধে সেরূপ আয়োজন না থাকলেও ন'মাসে বেশ কিছু মহিলাদের নিমন্ত্রণ করা হয়। তিয়াসার বাপেরবাড়ির লোকজন বলতে তো তিনজন। তারমধ্যে ওর বাবা কিছুতেই আসেন না। প্রথমত মেয়ের সাধ তার উপর এটা মহিলাদের অনুষ্ঠান। তাকে তিয়াসাও ফোন করে রাজি করাতে পারেনি। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসে তিয়াসার মা তন্দ্রা মেয়ের সুখ দেখে ভীষণ খুশি। এর আগে তিনি এই তিন বছরে তিনবার এসেছেন পুজোর সময় নতুন জামা কাপড় দিতে সামান্য সময়ের জন্য। কিন্তু এবার তিনি সাধের আগেরদিন এসে দু'রাত থেকে তারপর গেছেন অদ্ভুত এক মানসিক তৃপ্তি নিয়ে।
   সাধের পরেই শ্বাশুড়ি নীলিমা বলে দিলেন,
-- শোনো বৌমা এখন থেকে তুমি আর উপর নিচ করবে না। নিলয় বাড়িতে থাকলে সে তোমার খাবার উপরে দিয়ে আসবে আর ও যখন অফিস বা বাইরে থাকবে আমরা তোমার খাবার উপরে দিয়ে আসবো।
-- আমি খুব আস্তে আস্তে নামবো মা। আপনারও তো বয়স হয়েছে। এখন তো সংসারের কোন কাজই করি না । খেতে অন্তত নিচুতে একটু নামি।
-- না না আর তো মাত্র কয়েকদিন। এ কটাদিন লক্ষী মেয়ের মত আমার কথা শোনো মা।
  তিয়াসা আর কোন কথা বলে না। কারণ সে জানে এই কথাটাই তার শ্বশুর এবং নিলয়েরও কথা হবে।
  সাধ খাওয়ার ঠিক পনেরোদিনের মাথায় ডাক্তার দেখাতে গেলে তিয়াসাকে নার্সিংহোম ভর্তি করে নেয়। সারাটা রাত নিলয় হাসপাতাল জেগে কাটিয়ে দেয়। পিয়া এবং তার বাবা,মা অনেক রাতে নিলয়ের পীড়াপীড়িতে বাড়ি ফিরে যান। ভোর রাতে নর্মাল ডেলিভারী হয়। একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে নিলয় গিয়ে দেখেও আসে। ভোরে সে বাড়ি চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ফোন আসে তিয়াসার অবস্থা মোটেই ভালো নয়। 
   ডেলিভারীর ঠিক ঘণ্টা দু'য়েকের মধ্যে তিয়াসার যে চারটে সেলাই পড়েছিল ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়ার ফলে ভিতর থেকে চাপ এসে সেই সেলাই ছিঁড়ে গিয়ে প্রচণ্ড ভাবে ব্লিডিং হতে শুরু করেছে। নানানভাবে ডাক্তার ব্লিডিং বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকেন। তিয়াসার সম্পূর্ণ জ্ঞানে ডাক্তার রোলার ব্যান্ডেজ আঙ্গুলের সাহায্যে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে প্রথম অবস্থায় ব্লিডিং বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোই লাভ হয় না। সেই সময় ওটিতে আরও দু'জন সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকা হয়।এই কষ্ট তিয়াসা আর নিতে পারছিলো না।সে ডাক্তারের হাত চেপে ধরে বলে,
-- ডাক্তারবাবু আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমাকে অজ্ঞান করে যা করার করুন।
 সেই মুহূর্তে তখনো নিলয়ও এসে পৌঁছায়নি। তারা তিয়াসাকে ওটিতে নিয়ে যান। নিলয় এসে পৌঁছালে বন্ডে সই করিয়ে তিয়াসার অপারেশন শুরু হয়। ডাক্তারদের পরিভাষায় তিয়াসার হিমাটোমা অর্থাৎ একটা বড় মাংসপিন্ড এইভাবে ব্লিডিং হওয়ার ফলে ভিতরে সৃষ্টি হয়েছে। অপারেশন করে ওই মাংসপিণ্ডটা বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার নিলয়কে জানিয়ে দেন যেহেতু ব্লাড প্রেসার হাই তাই যে কোন মুহুর্তে বিপদের সম্ভাবনা হয়েছে। নিলয় প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। দীপ্ত ছাড়া তেমন কোন বন্ধু তার নেই। কিন্তু সেই দীপ্তও তো এখন বাইরের দেশে।
 
  অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে বাইশ দিন পরে তিয়াসা তার ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে বাড়িতে আসে। বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। পিয়া দিদিকে আনতে হাসপাতাল গেছিলো। দিন সাতেক ছুটি নিয়েছিলো নিলয়। ছুটি ফুরিয়ে যেতেই সে অফিস জয়েন করে। বেশ আনন্দেই তাদের দিনগুলি কাটছিলো। হয়ত তাদের এই আনন্দ দেখে বিধাতা পুরুষ অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। তিয়াসার জীবনে এই সুখ তিনি বেশি দিন লিখেছিলেন না। তাই মাঝে মাঝে হয়ত তারই ইচ্ছাতে তিয়াসার অজান্তেই তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠতো। সুখ তো ক্ষণস্থায়ী! তাই বলে যে একবার সুখের মুখ দেখেছে তার কাছ থেকে সেই সুখ চলে যাওয়া মানেই তো তাকে অতল গহ্বরে ধাক্কা দেওয়া। তিয়াসা নিলয়কে জীবন সঙ্গী হিসাবে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করতো। কিন্তু সে স্বপ্নেও ভাবেনি ভবিষ্যতে তারজন্য কী অপেক্ষা করছে।

ক্রমশ