Saturday, February 27, 2021

ভাগ্যের চাকা

ভাগ্যের চাকা

  ----বৌমা এবার ওঠো।সেই সকাল থেকে ঠাকুর ঘরে পড়ে আছো।মুখে একটু জল পর্যন্ত দাওনি।যা ঘটেছে তাকে তো মেনে নিতেই হবে।আমি তো তার মা।দেখো আমি কত শক্ত হয়ে গেছি।না খেয়ে কান্নাকাটি করে নিজের শরীর খারাপ করলে আমার অনন্ত তো আর ফিরে আসবেনা।তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে তোমার পেটেরটার কথা মনে করে।তুমি না খেয়ে থাকলে ও তো কিছু খেতে পারবে না ওর তো কষ্ট হবে।ভাগ্যকে যে খন্ডন করা যায় না!নিয়তির কাছে আমরা যে বড় অসহায়!আমিও এই বয়সেই অনন্তর বাবাকে হারিয়ে ছিলাম।তখন অনন্তর বয়স মাত্র ছ'মাস।ওর মুখে ভাত দেবো বলে সব আয়োজন সারা।বাড়িতে আত্মীয় কুটুম ভর্তি।মানুষটা কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে বেরিয়ে ছিল। ফিরলো নিষ্প্রাণ দেহ হয়ে।সবই তো তুমি জানো।মুহূর্তের মাঝে শুধু বাড়ির টুনি লাইটের আলো নয় আমার আর অনন্তর জীবনের সমস্ত আলো নিভে গেলো।আমি তো তোমার পাশে আছি কিন্তু সেদিন আমার পাশে কেউ ছিলনা।এটা মনেহয় এই পরিবারের অভিশাপ। আমার কথা শোনো লক্ষী মা আমার।এবার মুখে কিছু দাও।
 পিতৃহারা অনন্তকে অনেক কষ্টে সরমাদেবী মানুষ করেছিলেন। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় চাকরি পেয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশে। সরমাদেবীর ইচ্ছা ছিল না ছেলে পুলিশে চাকরি করুক।তখন অনন্ত মাকে বুঝিয়ে ছিলো,
--- মা বাইশ বছর বয়স আমার। আমার হায়ার এডুকেশন আছে।আমি ঠিক ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে এখানে উন্নতি করবো।তুমি কিছু চিন্তা করোনা।
 সরমা দেবী সেদিন ছেলের কথা ফেলতে পারেননি।তিনি ভেবেছিলেন এত অল্প বয়সে একটা সরকারি চাকরি পাচ্ছে। আস্তে আস্তে যদি ভবিষ্যতে উন্নতি হয় তাহলে তো চিন্তার কিছু থাকবেনা।এরপর বয়স বাড়লে সে সরকারি চাকরি নাও পেতে পারে।তাই তিনিও আর পরে আপত্তি করেননি। চাকরি পাওয়ার দু'বছরের মধ্যে তিনি অনন্তর বিয়ে দিয়ে নিজে পছন্দ করে বউ ঘরে আনেন। এক বছরের মাথায় তার বৌমা তাকে সুখবরটি জানান। বেশ চলছিল দিনগুলি।কিন্তু হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত সংসারের উপর নেমে এলো এক কালো মেঘ।
  অনন্ত সহ আরো বেশ কিছু কনস্টেবলকে নিয়ে থানার বড়বাবু একটি অপারেশন এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গাড়িটা একটা লরির সাথে ধাক্কা লেগে ব্রিজের উপর থেকে পুলিশের গাড়িটা উল্টে যায়।ঘটনাস্থলে গাড়িতে থাকা বেশ কয়েকজন কনস্টেবল ও বড়বাবু সহ সকলেই নিহত হন। সেদিন সকালে অফিসে বেরোনোর আগে অনন্ত তার স্ত্রী এবং মাকে এই অপারেশনের যেতে হবে কথাটা জানিয়ে গেছিল। টিভিতে খবর দেখে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল।কারণ নিহতদের তালিকা খবরে প্রকাশ করা হয়েছিল।তার ভীতর অনন্ত সাহার নামটিও ছিল।
 সরমাদেবী তার বৌমার পেটেরটির কথা চিন্তা করে নিজেকে শক্ত করে নেন।এবং অনেক কষ্টে তার বৌমাকে একটু দুধ,মুড়ি খাওয়ান। রাত দশটার দিকে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলে সরমাদেবী গেটে তালা লাগিয়ে তার বিধ্বস্ত বৌমার পাশে এসে বসেন।বৌমার যাতে নিজেকে একটু সামলে নিতে পারে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান।ঠিক রাত এগারোটার দিকে খাটের পরে রাখা রিনার ফোনটা বেজে ওঠে।কিন্তু রিনা সে ফোন ধরে না। সরমাদেবী হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে তার বৌমার হাতে দিতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠেন,
--- বৌমা, এই দেখো অনন্তর সেল থেকে ফোন এসেছে। আমার অনন্ত কি তবে বেঁচে আছে?
  তড়িৎগতিতে কাকের মত ছো মেরে রিনা ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত থেকে অনন্তর গলা ভেসে এলো,
--- হ্যালো রিনা আমি আজ ডবল ডিউটিতে আছি,বাড়িতে ফিরতে পারবো না রাতে।তোমরা গেটে তালা বন্ধ করে দাও।
 রিনা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জিজ্ঞাসা করল,
--- তুমি আজকে অপারেশনের যাওনি?
--- না না শেষ মুহূর্তে আমার যাওয়াটা ক্যানসেল হয়েছে। আমার জায়গায় অন্য একজন গেছিলো। আর সেই জন্যই আমাকে ডাবল ডিউটি করতে হচ্ছে।কিন্তু একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে,যে গাড়িটাই আমার যাওয়ার কথা ছিল--- আচ্ছা থাক বাড়িতে গিয়ে কাল সব জানাবো।তোমরা সাবধানে থেকো।
 ফোনটা নামিয়ে রেখে রিনা তার শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু জানালো। সরমাদেবীও  বৌমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।

 

Friday, February 26, 2021

সত্য মিথ্যার দোলাচলে

শাশ্বত রায় একটা দামি কোম্পানর এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।নিজে ড্রাইভ করে সে তার স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে শপিংমলে আসে কিছু কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে নিয়ে। শপিংমলের পার্কিং জোন এসে সে যখন গাড়িটা পার্কিং করতে যাবে কোথা থেকে সেখানে হাজির হয় ময়লা ছেড়া কাপর পরা এক ভিখারিনী। মেয়ে দীপশিখা এবং স্ত্রী মধুরিমা দুজনে গাড়ি থেকে নেমে ততক্ষণে শপিং মলের ভিতর ঢুকে গেছে।কিন্তু শাশ্বত রায় পঞ্চাশোর্ধ এই মহিলাটিকে দেখে দাঁড়িয়ে যান।তার মনেহয় কোথায় যেন এই মহিলাটিকে তিনি দেখেছেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে অনেক চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারেন না।
বছর সতেরো আগের কথা। তখন শাশ্বত রায় বছর পাঁচেক হল বিয়ে করেছেন। কিন্তু কোন সন্তানাদি তাদের হয়নি।তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিবছরই একবার করে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের পুজো দিতে চান  কুলো পুরোহিতের কথামতো। কলকাতা, মাদ্রাস সহ বহু জায়গায় বহু বড় বড় ডাক্তার দেখানোর পরেও কোন সন্তানের মুখ বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেও তারা দেখতে পাননি।বিজ্ঞান যখন মানুষের জীবনে অকৃতকার্য হয় তখন মানুষ দৈবশক্তি লাভের আশায় ঈশ্বরের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান।কুলো পুরোহিতের বিধান অনুসারে প্রতিবছর যদি জগন্নাথ মন্দিরে ভগবান জগন্নাথের পুজো দেয়া হয় তাহলেই তিনি বাবা ডাক শুনতে পারবেন সেই কথা শিরোধার্য করে তারা প্রতিবছরই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিতে যান। প্রথম বছর তারা নির্বিঘ্নে পুজো দিয়ে কলকাতা ফিরে আসেন।কিন্তু দ্বিতীয় বছর পুজো দিয়ে তারা যখন মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হাঁটার পর দেখতে পান রাস্তার উপরে বছরখানেকের একটা শিশু একটা চটের বস্তার উপরে ঘুমিয়ে আছে।তার কাছে তার মা বা অন্য কেউ নেই।আশেপাশেও সেরূপ কোন মানুষজন নেই।প্রথমে ব্যাপারটি তার স্ত্রী মধুরিমার চোখে পড়ে।তিনি তার স্বামীকে দেখান।হঠাৎ সেখানে কয়েকটা সারমেয় চিৎকার চেঁচামেচি করে মারপিট শুরু করে।পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে যেকোন সময় ওই বাচ্চাটির উপর সারমেয়গুলি এসে হামলা করতে পারে।তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েন। তারা সারমেয়গুলিকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বাচ্চাটি মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর এক ভদ্রমহিলা সেখানে এসে হাজির হন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভাবেন এই মহিলাই বাচ্চাটির মা।কিন্তু মহিলা বাচ্চাটির কাছে এসে কিছু মানুষকে ডেকে জানান বাচ্চাকে এখানে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তার মা যখন দোকানে বাচ্চাটির জন্য একটু দুধ আনতে গেছিল তখন একটা গাড়ী এসে তাকে পিষে দিয়ে যায়।ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান।মারা যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে তিনি তার বাচ্চার কথা তাকেই বলে যান।কিন্তু তিনি এ বাচ্চা নিয়ে কি করবেন? তিনি নিজেই তো ভিক্ষে করে খান।এই বাচ্চাকে মানুষ করার তার কোন ক্ষমতা নেই।যদি কেউ থাকে সুপরামর্শ দেয় এই বাচ্চাটিকে নিয়ে কি করা যায় তাহলে তিনি বাচ্চাটির সেই ব্যবস্থা করতে পারেন। সেখানে জড়ো হওয়া প্রত্যেকটা মানুষ দাঁড়িয়ে তার কথা শুনে সকলেই যে যার মত পথ ধরলো। শুধু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো মধুরিমা আর শাশ্বত রায়।
  ওই বাচ্চাটি এবং ভদ্রমহিলাকে সাথে নিয়ে শাশ্বত ও মধুরিমা প্রথমে থানায় যায়।সেখানে তারা বাচ্চাটা জমা দিয়ে নিজেরা দুজনে আলোচনা করে ঠিক করে ওই বাচ্চাটিকে তারা দত্তক নেবেন।কিন্তু প্রথম অবস্থায় বাচ্চাটিকে থানায় জমা দিলেও এত ছোট বাচ্চাকে থানায় রাখতে কেউ রাজি হয় না।তখন তার দেখভাল করার জন্য তারা শাশ্বত, মধুরিমাকে অনুরোধ করে, এবং পরবর্তীতে আইনি কাগজপত্র রেডি হলে তারা বাচ্চাটিকে নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারবেন। যতদিন পর্যন্ত ওই শিশুকন্যাটিকে আইনি মারফত শাশ্বত মধুরিমা কাছে পাইনি ততদিন পর্যন্ত তিনি তার ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে পুরীতে থেকে যান।
 মেয়েটির বয়স এখন প্রায় 15,16 বছর হবে।সে জানেনা যে শাশ্বত এবং মধুরিমা তার আপন বাবা, মা নয়।
  শাশ্বত শপিংমলে ঢুকে তার স্ত্রী এবং কন্যার সাথে শপিং করতে করতে হঠাৎ ওই ভদ্রমহিলাকে কোথায় দেখেছে তার মনে পরল।তিনি তখন স্ত্রী-কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- তোমরা কেনাকাটা করতে লাগো আমি একটু পরেই আসছি।ছুঁটে বাইরে চলে এলেন।খোঁজ করতে লাগলেন মহিলাটিকে এবং একসময় তাকে পেয়েও গেলেন। পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে মহিলার হাতে দিতে গেলে তিনি শাশ্বত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পারেন এবং তার কাছে জানতে চাই,
--- বাবু আমার মেয়েটা কেমন আছে?তাকে আমাকে  একটু দেখাবে?
--- কিন্তু সেদিন যে তুমি বলেছিলে ও আর একজনের মেয়ে, ওর মা অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে।
--না বাবু সেটা ঠিক না।মেয়েটি আমারই।সেদিন আমাদেরই মত একজন ভিখারিনী ওই রাস্তায় মারা গেছিলেন ঠিকই আর সেটাকেই কাজে লাগিয়ে আমি মেয়েটাকে অন্য কারো কাছে রেখে মানুষ করতে চেয়েছিলাম।আমার আরো তিন তিনটে মেয়ে রয়েছে। রাস্তাতেই তারা থাকে তাই আমি চাইনি আমার চতুর্থ মেয়েটাও এইভাবে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে পেট চালাক।আমি সেদিন শুধুমাত্র মেয়েটিকে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য ওই অভিনয়টা করেছিলাম।আমি কলকাতারই মেয়ে।পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাছে ভিক্ষে করতাম কারণ আমার সাথে যার বিয়ে হয়েছিল সে ওখানেই থাকতো। বিয়ে করে এনে খেতে পরতে দিত না।তাই ভিক্ষা করতে শুরু করেছিলাম।কিন্তু আমার সাথে যারা পথে পথে ভিক্ষা করতো তারা আমার অভিনয়টা ধরে ফেলেছিল।তারা আমাকে বলেছিল পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবে।তাই ভয় পেয়ে আমি মেয়ে তিনটেকে নিয়ে কলকাতাতেই চলে আসি।চতুর্থ মেয়েটি হওয়ার পরে আমার স্বামী আমায় ছেড়ে চলে গেছিল। বাবু ,আজ যখন তোমার সাথে দেখা হল আমার মেয়েটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে দেবে?বিশ্বাস কর বাবু ,আমি আমার পরিচয় দেবোনা।আসলে নাড়িছেঁড়া ধন তো!মনটাকে বেঁধে রেখে মেয়েটার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সেদিন তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।আজ তোমাকে দেখে তার সেই ছোটবেলার মুখটা ভীষণ মনে পড়ছে।একটু দেখা করিয়ে দাও না বাবু?দূর থেকে দেখবো একদম কাছে যাবো না।
তারপর শাশ্বতর হাতে ধরা টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
---এই টাকাগুলো আমি নেবো না বাবু। তুমি সারা জীবনের জন্য আমার মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছো।তার বিনিময়ে আমি কি তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারি?আমায় ক্ষমা করো।আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, তুমি শুধু আমাকে মেয়েটার মুখটা দূর থেকে একটু দেখার সুযোগ করে দাও;আর আমাকে ক্ষমা করে দিও সেদিন তোমাদের কাছে মিথ্যে কথা বলার জন্য।


Thursday, February 25, 2021

বাঁধন হোক শক্ত

বাঁধন হোক শক্ত 
   রাহুল আর শ্রীতমা একই কলেজে পড়তো।যদিও তারা ক্লাসমেট নয়;রাহুল দু'বছরের সিনিয়র ছিল।দুজনের মনের মধ্যেই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল।কিন্তু কেউ কোনদিন কাউকে মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারেনি।কখনো অফ পিরিওড অথবা টিফিন পিরিয়ডে দুজনে একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছে।গল্পগুজব,ক্যান্টিনে খাওয়া, কলেজের বিশাল মাঠে বসে গল্প করা সবই চলতো।কিন্তু ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা কোনটাই কেউ কোনদিন মুখে প্রকাশ করতে পারেনি।
  ধনী পরিবারের সন্তান রাহুল পাস করার পর তার বাবা উচ্চশিক্ষার্থে তাকে বাইরে পাঠিয়ে দেন।তখনো শ্রীতমার কলেজ শেষ হয়নি।একদিন কলেজ ছুটি শেষে শ্রীতমা কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখে রাহুল দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে।তাকে দেখে শ্রীতমা ভীষণ খুশি হয়।হাসতে হাসতে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
--- কিরে এতদিন পরে মনে পরলো বুঝি আমার কথা?একটা ফোনও তো করতে পারতিস--।
---সে তো তুইও আমাকে করতে পারতিস।করিস নি তো! তাহলে আমিই বা কেন উপযাচক হয়ে তোকে ফোন করতে যাবো? দায় টা কি আমার একার?
--- না আমার সব দায়--।এখন বল কি বলতে এসেছিস ?
--- অনেক কিছু বলবো বলেই তো এসেছিলাম।কিন্তু তুই তো আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলি।এখন কোথা থেকে শুরু করবো সেটাই ভাবছি।
--- আমারও তো তোকে কিছু বলার ছিল।তবে তুই যখন আগে বলতে চেয়েছিস তখন বলে নে।আমি না হয় ফোন করে তোকে বলবো।
 রাহুল বার করে আশে পাশে তাকালো,কয়েকবার দুপুরের কাঠফাটা রোদে আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল, সর্বশেষে  শ্রীতমা দিকে তাকিয়ে বলল,
--- আগামী পরশু আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি।তিন বছর পরে ফিরে আসবো।তুই কি এই তিনটে বছর আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবি?
রাহুলের স্পষ্ট কথা বলার ধরনে শ্রীতমা ফিক করে হেসে দিলো।কিন্তু রাহুলের কথা শুনে তার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছিল।সে সরাসরি রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
--- তোকে পাওয়ার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
 সেদিন রাতেই রাহুল শ্রীতমাকে ফোন করল।তার কাছে জানতে চাইলো,
---তুই যেন কি আমাকে ফোন করে বলবি বলেছিলি?
-- আমি যা বলবো ভেবেছিলাম তা তুই বলে দিয়েছিস।তাই নতুন করে আর কিছু আমার বলার নেই।শুধু অপেক্ষার পালা।
 রাহুল চলে গেল উচ্চশিক্ষার্থে অস্ট্রেলিয়া।মাঝেমধ্যে রাহুলের সাথে ফোনে কথা হয় শ্রীতমার। দেখতে দেখতে দিনগুলি কেটে যেতে থাকে।দুজনেই মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে।কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার পর শ্রীতমারা সবাই মিলে ঠিক করে তারা কোথাও একটা জায়গায় ঘুরতে যাবে।সেইমতো সবাই বেরিয়ে পড়ে।একটা বাস ভাড়া করে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেও যায়।সেখানে পৌঁছে শ্রীতমা দেখতে পায় সকলেই তাকে লুকিয়ে কিছু একটা আলোচনা করে চলেছে।কিন্তু কী সেই আলোচনা তা সে জানে না।যখন কারো কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করছে সকলেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।কেউ কথা বলতে লাগলে সেখানে শ্রীতমা উপস্থিত হলে তারা কথাবলা বন্ধ করে দিচ্ছে।শেষমেষ  শ্রীতমার প্রিয় বন্ধু স্মৃতির কাছ থেকে জানতে পারি রাহুল নাকি দিন তিনেক আগে কোন এক বিদেশিনীকে ভালবেসে বিয়ে করেছে।রাহুলের প্রিয় বন্ধু মৈনাককে সে একথা জানিয়েছে।সরল বিশ্বাসে শ্রীতমা ওদের কথা বিশ্বাস করে নেয়।কিন্তু ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে সে।রাহুলের সাথে অভিমান করে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।ভার্চুয়াল জগতে তাকে ব্লক করে দেয়।
  এই ঘটনার বছর খানেক বাদে রাহুল দেশে ফিরে আসে তখন শ্রীতমা নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে।শ্রীতমা রাহুল দুজন দুজনকে ভালবাসলেও এবং তারা বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া সত্বেও দুজনের কেউই কিন্তু দুজনের বাড়ির ঠিকানা জানতো না।হঠাৎ করে একদিন মৈনাক শ্রীতমাকে ফোন করে একটা কফিশপে তার সাথে দেখা করতে বলে।কথাটা শুনে শ্রীতমা তাকে মুখের উপরই না বলে দেয়। কিন্তু মৈনাকের শত অনুরোধ এবং কাকুতি মিনতি দেখে শ্রীতমা রাজি হয় তার সাথে দেখা করতে কফিশপে। মৈনাক শ্রীতমার অনেক আগেই কফিশপে পৌঁছে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শ্রীতমা সেখানে পৌঁছালে মৈনাক তাকে বলে,
---আজকে তোমার সাথে একজনের দেখা করিয়ে দেবো। তখন তুমি বুঝতে পারবে আমার মুখে বসিয়ে যে কথাগুলি তোমার বন্ধুরা বলেছিলো কথাগুলো সত্যি নয়।তুমি কোনদিন তা যাচাই করার জন্য আমার কাছে জানতেও চাওনি সত্যিটা আসলে কি এবং আমি কথাগুলো কাউকে বলেছি কিনা।মানুষ সবথেকে যে ভুলটা করে সেটা হচ্ছে অন্যের মুখে কথা শুনে হঠাৎ করে কিছু মানুষ সম্পর্কে ভুল ধারনা করে ফেলে,তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়।কিন্তু এটা যে কতটা বোকামি তা তারা একবারও ভেবে দেখেনা। সবসময় উচিত কোন কথা কারোর কাছ থেকে জানলে তার সত্যতা বিচার করার জন্য অন্তত একবার মানুষটার মুখোমুখি হওয়া। যাহোক আমার কাজ শেষ আমি চললাম আমি যার সাথে তোমাকে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে এখানে আসতে বলেছিলাম সে তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
 মৈনাক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।আর শ্রীতমা পিছন ফিরে দেখে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে রাহুল দাঁড়িয়ে আছে।
--- তুই এখানে ?তোর বউ কোথায়?বিদেশিনী বউ আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি না?
--- তুই মনেহয় মৈনাকের কথাগুলো বুঝতে পারিস নি। কে বা কারা কেন রটিয়ে ছিল যে আমি একজন বিদেশীনিকে বিয়ে করেছি এবং সেটা একমাত্র মৈনাককেই জানিয়েছি আমি জানিনা।তবে এটা আমি ভালোভাবে জানি একজন বউ থাকতে আর একটা মেয়েকে বিয়ে করা যায় না।
-- মানে?
--- পাগলি একটা, যাওয়ার আগে তোকে বলে গেলাম না আমার জন্য অপেক্ষা করিস তিনটে বছর।ফিরে এসে তোকে বউ করে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব এটাই ভেবে বলেছিলাম। কিন্তু তুই অন্যের মুখের কথা শুনে আমাকে অবিশ্বাস করলি! পাগলী তোকে আমি কত ভালবাসি--।আর তুই যে আমাকে ভার্চুয়াল জগতে ব্লক করে দিয়েছিস, আমার সাথে যোগাযোগ রাখিস নি।একবারও ভেবে দেখিসনি যে তোর জন্য চিন্তা করে করে আমার রেজাল্ট খারাপ হতে পারে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি, আমার কিছু হয়ে যেতে পারে। একবারের জন্যও এসব ভাবিস নি।কিন্তু কেন রে? ভালোবাসার মধ্যে বিশ্বাস থাকা দরকার সকলের আগে। বিশ্বাস যদি না থাকে ভালোবাসায় ফাটল আসে।আর কোনদিন আমাকে অবিশ্বাস করিস না।আমি তোকে ছাড়া আমার জীবনটাকে কল্পনাই করতে পারি না।
 শ্রীতমা হঠাৎ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাহুলকে জড়িয়ে ধরে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
--- খুব ভুল করে ফেলেছি।আমিও তোকে ভীষণ ভালোবাসি। ওরকম একটা কথা শুনে আমি সত্যিই খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম।সত্য মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা তখন আমার ছিলনা। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।আর সারা জীবনের মতো শক্ত করে বুকের সাথে বেঁধে রাখিস।

 
 

Tuesday, February 23, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২৭)

সুখের ঘরে আগুন (২৭)

  প্রায় দুটো দিন পরে  নিলয় আজ পেট ভরে ভাত,ডাল,তরকারি খেয়ে অফিস গেলো।খেতেখেতে নিলয় ভাবছিল অচলার হাতের রান্না হাত বেশ চমৎকার। বেশ কয়েকদিন পর অচলার হাতের রান্না খেয়ে তার মনে হলো যেন বাড়ির রান্নাই খাচ্ছে। আজও অফিস বেরোনোর সময় নিলয় অচলাকে বলে গেল সেই একই কথা, কোন অবস্থাতেই সে যেন কেউ ডাকলে দরজা খুলে বাইরে না আসে।সে বাইরে থেকেই তালা দিয়ে যাবে।আজও আসতে নিলয়ের দেরি হবে।সংসারের আরো কিছু জিনিসপত্র  কিনতে হবে।তাছাড়া সবার আগে দরকার অচলার জন্য একটা তক্তপোষ আর বালিশ,বিছানা,চাদর।
  অফিসে গিয়ে নিলয় অনেকবার ভাবে নিখিলেশের সাথে অচলাকে নিয়ে আলোচনা করবে কিনা।নতুন পরিচয় কি ভাবতে কি ভেবে বসবে এইসব চিন্তা মাথায় ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে নিরুপায় হয়েই অন্তত একজনের সাথে কিছুটা পরামর্শ করা দরকার মনে করে সে নিখিলেশকে তার কেনাকাটার ব্যাপারে সাহায্য করতে বলে আজ। নিখিলেশ সানন্দে রাজি হয়ে যায়। অফিস ছুটির পর দুজনে বেরিয়ে প্রথমে একটু টিফিন করে। নিলয় একটা প্যাটিস কিনে তার ব্যাগে রাখতে গেলে নিখিলেশ হাসতে হাসতে বলে,
-- কি ভাই, রাতে কি প্যাটিস খেয়েই শুয়ে পড়বে নাকি?
 নিলয় কিছুটা হলেও একটা সুযোগ পেয়ে যায়।বলে,
--- তোমার সাথে একটা কথা বলার আছে ভাই।আমি জানিনা অবশ্য তুমি কিভাবে আমার এই কথাটা নেবে।কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি ছাড়া এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি অন্য কারো সাথে আলোচনা করতে ঠিক সাহস পাচ্ছিনা।এমনকি আমার আত্মীয়-স্বজন কিংবা আমার বাবা মায়ের সাথেও না।
--- কি এমন কথা বল। তোমাকে সাহায্য করা আমার পক্ষে যতটা সম্ভব হয় নিশ্চয়ই কোরবো।
--- জিনিসপত্রগুলো কেনার পর তোমাকে নিয়ে বাড়িতে যাব মানে আমার কোয়ার্টারে যাব।সেখানে বসেই চা খেতে খেতে কথা গুলো বলা যাবে কি বল?
--- তোমার যা মনের ইচ্ছা তাই হবে।
  একটা তক্তপোষ,বালিশ,বিছানা ছাড়াও বেশকিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে নিলয়, নিখিলেশকে সাথে নিয়ে কোয়ার্টারের দরজা খুলে যখন প্রবেশ করল তার আগেই  তক্তপোষ ও বালিশ বিছানা যে ভ্যানটাই করে এনেছিল তাকে নিলয় ছেড়ে দিয়েছে।সুতরাং দরজা খুলে হাতের জিনিসপত্রগুলি ঘরের ভিতরে রেখে সে পুনরায় বেরিয়ে গেল তক্তপোষ ও বাকি জিনিসগুলি ভিতরে আনবার জন্য। যাওয়ার আগে অচলাকে বলে গেল ভিতরের ঘরটাতে চলে যাওয়ার জন্য। যখন সে ডাকবে তখনই যেন সে বাইরে আসে এর আগে নয়।
  অচলা, নিলয় যে ঘরটাতে থাকে সেই ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজাটা ভিজিয়ে দিলো। নিলয় আর নিখিলেশ দুজনে মিলে ছোট তক্তপোষটা ধরাধরি করে ভিতরে নিয়ে আসলো। ঘরের ভিতরে তক্তপোষটা রেখে তার উপরেই দুজনে বসে হাঁফাতে লাগলো।অচলা দরজাটা সামান্য ফাঁক করে দেখে তার দাদার সাথে আরো একজন ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেছেন। সে কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে গেল।কিন্তু তাকে যেহেতু নিলয় বলেছে, "আমি না ডাকলে তুমি বেরোবে না"- তাই সে সেখানে চুপ করেই বসে থাকল আর অপেক্ষা করতে থাকলো কখন তার দাদা ডাকবে আর সে গিয়ে তার দাদাকে চা করে দেবে।আজকে নিলয় অফিস যাওয়ার সময় অচলা তাকে জানিয়ে দিয়েছিল সে যেন কোন খাবার কিনে নিয়ে না আসে।সে নিজেই রাতের খাবার তৈরি করে নেবে। তাই সন্ধ্যা বেলাতেই অচলা ডিনারটা রেডি করে রেখেছিল।আর যেহেতু নিলয়ের ফিরতে দেরী হবে বলেছিল তাই সে কোনো টিফিনও করেনি।
 কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর নিলয় নিখিলেশকে বলে, 
---যে কথাগুলো তোমায় বলব বলেছিলাম সে কথাগুলো বলার আগে তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।তারপর আমি আমার কথা শুরু করবো।বলেই সে তার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে অচলাকে ডাক দিলো,
-- বোন একটু এদিকে আয় তো।
এভাবে নিলয় ইচ্ছাকৃতই অচলাকে ডাকলো তার কারণ ডাকের মধ্য দিয়ে নিলয় নিখিলেশকে বোঝাতে চেয়েছিল তার ও অচলার সম্পর্কটা কি। অচলা এসে সামনে দাঁড়ায়। তখন নিলয় তাকে বলে,
--- আমাদের জন্য দু'কাপ চা করে নিয়ে আয়।
আর ব্যাগ থেকে প্যাটিসটা বের করে অচলার হাতে দিয়ে বলে,
-- আমরা টিফিন করে এসেছি।এটা তোর জন্য।খেয়ে নিস, সেই দুপুরবেলা খেয়েছিস, এখন তো নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে।ডিনার করতে তো একটু দেরি হবে।
অচলা যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে নিলয় পুনরায় বলে,
--আর শোন, আমার বন্ধু নিখিলেশ দত্ত।আমরা দুজনে একই অফিসে চাকরি করি।
অচলা হাত জোড় করে নিখিলেশকে নমস্কার করে। নিখিলেশ ও প্রত্যুত্তরে তার হাত দুটি জোড় করে অচলাকে প্রতি নমস্কার জানায়।কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিখিলেশ অচলার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেয়েটির মধ্যে একটা সারল্যতা রয়েছে।
 অচলা চা করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে যায়।তখন নিলয় শুরু করে অচলার সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে সমস্ত ঘটনা। কিন্তু কথার মাঝখানেই অচলা  চা আর কিছুটা শুকনো চিড়ে তেল দিয়ে ভেজে নিয়ে ঘরে ঢোকে।ওদের কথা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়।তখন নিলয় তাকে বলে,
--- তুই এক কাজ কর ওই ঘরে গিয়ে বোস।আমি আমার বন্ধুর সাথে একটু গল্প করি।পরে তোকেও ডেকে নেবো গল্প করার জন্য।
অচলা মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অচলার সাথে দেখা হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটনা ঘটেছে সবই নিলয় নিখিলেশকে বলে।তারপর নিখিলেশের কাছে জানতে চায় এখন সে কি করবে?যদিও সে ভেবেছে অচলাকে তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু তার একার পক্ষে এটা কিছুতেই যে সম্ভব নয় তাও সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।তার সাথে অচলা রাস্তায় বেরোলেই যেভাবে গ্যাংয়ের লোকেরা ওৎ পেতে রয়েছে তারা ধরে ফেলতে পারে।তাই এই ব্যাপারে নিখিলেশের কাছে সে সাহায্য চায়।
 নিখিলেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর নিলয়কে বলল,
--- তাহলে ওকে তোমার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল হবে বলে আমারও মনেহয়।এ ব্যাপারে আমি তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।তবে একটা কথা আমার মাথায় আসছে তুমি যেদিন ওকে নিয়ে কলকাতা যাবে সেদিন শেষ ট্রেনটা ধরে যেতে হবে।প্রথমে আমি ওকে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠবো।তারপর তুমি এখান থেকে বেরোবে।আর যেটা করতে হবে তোমার বোনকে বাড়ি থেকে বের করতে হবে ছদ্মবেশে
। ছদ্মবেশে বের করলে আর আমি যেহেতু অপরিচিত একটি মানুষ খুব একটা কেউ বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না।তবে হ্যাঁ আজ এখানে এলাম যদি কেউ আমাকে দেখে ফেলে তাহলে একটু সমস্যা।তবে এখন তো কোয়ার্টারে প্রচুর ফ্যামিলি রয়েছে।লোকজন যাতায়াত করছে।খুব বিশেষ একটা অসুবিধা হবে বলে আমার মনে হয় না।তুমি আমাকে জানিও কবে কলকাতা যেতে চাও তোমার বোনকে নিয়ে। আমার যেটুকু ক্ষমতা আমি তা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। একজন মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা এটা।মানসম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে।সুতরাং তুমি একটুও চিন্তা কোরোনা,আমি তোমার সাথে আছি,কোন অসুবিধা হবে না।এতদিন তুমি একাই উনার সমস্যাটা মোকাবেলা করে চলছিলে আর আজ থেকে আমিও তোমার পাশে থাকলাম দুজন মিলে উনাকে রক্ষা করতে পারবো।
 নিলয় নিখিলেশের হাত দুটি ধরে বলল,
---বন্ধু তো একেই বলে, মাত্র কয়েকটা দিন তোমার সাথে আমার আলাপ।কিন্তু আমি মানুষ চিনতে একটুও ভুল করিনি।আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই ব্যাপারে আমি তোমার কাছ থেকে সর্বতোভাবে সাহায্য পাবো।আমি সারাজীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম।
নিখিলেশ হো হো করে হেসে বলল,
--- এসব কি বলছ তুমি?আমি তো তোমার বন্ধু,আর বন্ধুর বিপদে বন্ধুই পাশে দাঁড়ায়।
  চায়ের সাথে চিড়ে ভাজা গুলো খেতে খেতে নিখিলেশ বলে,
--- চিড়ে ভাজাটা বেশ ভালো হয়েছে কিন্তু খেতে। ছোট ছোট পেঁয়াজ কুচি,লঙ্কা আর সরষের তেল দিয়ে  মাখাতে মনেহচ্ছে যেন দোকানের চিড়ে ভাজা খাচ্ছি।
--- ভদ্রঘরের মেয়ে।সুযোগের অভাবে লেখাপড়া বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।তবে ভীষণ বুদ্ধিমতি,সমস্ত রকম সাংসারিক কাজকর্মেও পারদর্শী।ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাকে সত্যিই এবার ভাবতে হবে।মাত্র এই দু তিন দিনেই ওর প্রতি আমার একটা মায়া পড়ে গেছে।দাদা বলে ডাকে,তাই দাদার মতই আমি ওর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই।তবে এখানে থেকে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।ওকে কলকাতাতেই আমার বাবা-মায়ের কাছে পাঠানোর পর আমি ওকে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাস করাবো।তারপরও যদি পড়তে চায় ওকে আমি পড়াবো। মোটকথা আমি ওকে ওর ভবিষ্যৎ টা গড়ে দেবো।
--- আমিও তোমার সাথে আছি।যেকোনো সময় যেকোনো রকম হেল্প এর দরকার হলে আমাকে জানিও সব সময় আমায় পাশে পাবে।
 সেদিন রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত নিখিলেশ আর নিলয় বসে গল্প করতে থাকে।মাঝখানে একবার অচলাকে ডেকে নিলয় বলে,
--- তুই এক কাজ কর বোন, আর কটা ভাত রান্না করে নে, যা তরকারি রান্না করেছিস আমরা তিনজনে মিলে একসাথেই খেয়ে নেবো।
নিখিলেশ প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,
--- আরে না, না, আমি বাড়িতে গিয়েই খাবো।আমার ফ্রিজে রান্না করা রয়েছে।যাবো একটু গরম করবো ব্যাস্।
--- থাকো তো ভাই একাই।তাই এখানেই আমাদের ভাই বোনের সাথে চারটি খেয়ে নাও না।তোমার খেতেও ভালো লাগবে আর আমাদেরও ভালো লাগবে তুমি খেয়ে গেলে।আর আমার বোনের হাতের রান্না খেলে এ বাড়ির আশেপাশে তোমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে।খুব সুন্দর রান্না করে অচলা। একথা শুনে লজ্জায়  লাল হয়ে অচলা রান্নাঘরের দিকে দৌড় দেয়। আর নিলয় নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে ওঠে।
সেদিন নিখিলেশ অচলার হাতের রান্না খেয়ে ভুয়সী প্রশংসা করে।আর এই প্রশংসা চলাকালীন দুএকবার তার অচলার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। প্রতিবারই অচলা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।কিন্তু প্রতিবারই তার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে লাগে।যা তার এই বাইশ বছর জীবনে কোনদিনও কারো চোখের দিকে তাকিয়েই হয়নি।

ক্রমশঃ 

Wednesday, February 17, 2021

ভালোবাসার দিন

ভালোবাসার দিন
  সারাটা দিন এ বাড়ি ও বাড়ি দুবেলা কাজ করে সন্ধ্যার সময় ঘরে এসে দু চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে দুলুর। কিন্তু বদমেজাজী,মাতাল স্বামী ঘরে ঢুকেই দুলুর কাছে খেতে চাইবে। আর তখনই তাকে খাবার দিতে না পারলে সে দুলুর চুলের মুঠি ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ আর মারধর করতে শুরু করে। সংসারে একটা পয়সা দেওয়ার মুরোদ নেই।সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যে টাকা পায় তা দিয়ে গলা অবদি মদ খেয়ে ঘরে এসে দুলুর উপর অত্যাচার শুরু করে।
   একখানা মাত্র ঘর।এক চিলতে বারান্দা। বারান্দাতেই রান্নাবান্না আর তা নিয়ে এসে ঘরে বসে খাওয়া।দুটো মানুষ একসাথে নিচে বসে খেতে খুবই অসুবিধা হয়। এই ঘরের ভাড়া দেড় হাজার টাকা।তারপর লাইট আলাদা, জল বাইরে থেকে টেনে নিয়ে আসতে হয়।সবকিছুই করতে হয় দুলুকে। নরেশ তাকে একটা টাকা দিয়েও সাহায্য করে না। খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দুলু চলে যায় লোকের বাড়িতে কাজ করতে।এক বাড়িতে রান্নাবান্না করে সেখানে এসে দুপুরে খায় সে। আর নরেশ ভ্যান চালিয়ে বাইরে কোথাও ডাল ভাত ,ডিম ভাত খেয়ে নেয়।দুলুর ঘরে রান্না বলতে সেই রাতে।সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরার সময় একটু আনাজপাতি আর  কম পয়সায় একটু মাছ যদি পায় তাহলে সে কিনে নিয়েই বাড়িতে আসে।তার বরটা ভালোমন্দ খেতে একটু ভালোবাসে। দুলু এত অত্যাচার সহ্য করেও বরের মন রাখতে আর নিজের ভালোবাসার টানে নরেশ এর জন্য সব সময় একটু ভাল মন্দ রান্না করার চেষ্টা করে। দুলু দেখেছে যখন তার বর মদ খায় না ভালো থাকে তখন সে দুলুর সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে,মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, বাইরে বেরোলে একটা টিপের পাতা বা একটা কানের দুল দুলুর জন্য কিনে নিয়ে আসে।তাতেই দুলু বুঝতে পারে নরেশ তাকে এখনো খুব ভালোবাসে। কিন্তু পেটে  মদ পড়লে সে হয়ে যায় সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।তখন তার কোন কিছুই হুশ থাকেনা।অনেকদিন খেতে খেতে সেখানেই ঝিমাতে শুরু করে।দুলু তখন তার মুখ ধুয়ে, মুখ মুছিয়ে দিয়ে ধরে নিয়ে খাটের উপর শুইয়ে দেয়।
   আজ দুবছর ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের মাস ছয়েক পর থেকেই লোকটা মদ ধরেছে।আগে মানুষটা কত ভালো ছিল। সারাটাদিন ভ্যান চালালেও সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে কত গল্প করতো।এদিক ওদিকে ঘুরতেও নিয়ে যেত।সেই কবে মানুষটার সাথে গিয়ে "বাবা কেন চাকর" দেখে এসেছিল তারপর আর কোনদিন হলমুখো হয়নি মানুষটা।সন্ধ্যা হলেই তো মদ গিলে বসে থাকে।এসব ভাবতে ভাবতে মাঝেমধ্যেই দুলু অন্যমনস্ক হয়ে পরে।আজ কাজের থেকে ফেরার পথে দুলু আড়াইশ মুরগির মাংস কিনে নিয়ে এসেছে।মাইনে পেলে সেদিনটা সে একটু মাংস আনে।তার মানুষটা যে খেতে ভালোবাসে।এমাসে প্রথমদিকে যে সব বাড়ির মাস হয়ে যায় সেখান থেকে টাকা পেয়েও আনেনি।একটা বাড়িতে ১৪ই ফেব্রুয়ারি দুলুকে কাজের জন্য মাইনে দেয়।এ দিনটা সবাই বলে দুলু শুনেছে ভালোবাসার দিন।তাই মনেমনে ঠিক করে রেখেছিল এ মাসে ওখান থেকে মাইনেটা দিলে সে মানুষটার জন্য একটু মাংস আনবে।
 দুলু সেদিন বাড়িতে ফিরে দেখে মানুষটা আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে।এসে স্নান করে পরিষ্কার জামা কাপড় পরে দুলুর জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। দুলু এসে দেখে তো অবাক! দুলুকে দেখে বলল,
--- একটু চা করে নিয়ে এসো। আলুর চপ এনেছি। দুজনে বসে মুড়ি মেখে চপ দিয়ে খাই।
 দুলু তো অবাক!আজ কতদিন পর কত মিষ্টি মিষ্টি কথা স্বামীর মুখে শুনে দুলুর বেশ ভালো লাগে।সে  তড়িৎ গতিতে মুড়ি মেখে নিয়ে আসে। মাংসটা রান্না করে তার স্বামীকে খেতে দেয়।নরেশ খেতে খেতে বলে,
--- তুমিও নিয়ে বস আজকে দুজনে একসাথে খাই। খেয়েদেয়ে দুজনে খাটে উঠে যায়।হঠাৎ করে নরেশ খাট থেকে নেমে জামার পকেট হাতরে কিছু একটা হাতে করে নিয়ে খাটে উঠে আসে।তখন দুলু তাকে বলে,
---- আরে লাইটটা অফ করে দাও।সারাদিন পরিশ্রম করার পর খুব ঘুম পাচ্ছে।আচ্ছা মাংসটা কেমন খেলে বললে নাতো?
---  বলবো বলবো তোমায় একটা জিনিস দেবো।আসলে কিভাবে দেবো সেটাই ভাবছি।
দুলু আরো অবাক হয়!ভাবছে মানুষটার হল কি?বলে,
--- কি দেবে দাও না।
----চোখটা বন্ধ করো, আমার লজ্জা করছে।
---আচ্ছা ঠিক আছে বুঝেছি।এই বুজলুম চোখ এবার দাও-- । নরেশ তখন তার হাতে একটা লাল গোলাপ ধরিয়ে দেয়। আর বলে,
--- জানো দুলু  আজ না  ভালোবাসার দিন।যে যাকে ভালোবাসে আজকের দিনে তাকে নাকি লাল গোলাপ দিতে হয়।কত লোক কিনে নিয়ে যাচ্ছে গোলাপ।আমিও আজকে তোমার জন্য তাই একটা লাল গোলাপ কিনে আনলাম।
 দুলু আনন্দে আত্মহারা হয়ে নরেশের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে, "সেই জন্যই তো আমিও ভালোবেসে তোমার জন্য মুরগীর মাংস আনলম।তুমি যে মাংস খেতে খুব ভালোবাসো।"অনেকদিন পর নরেশ দুলুকে সেই আগের মতো কাছে টেনে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল।

  

Monday, February 15, 2021

অভিমান

অভিমান

   আজ অনেকগুলো দিন রুপম এর সাথে  স্বরূপার কোন দেখা নেই। সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝিতে আজ দুজনে দু জায়গায় একইভাবে কষ্ট পেয়ে  চলেছে।কিন্তু ইগো ছেড়ে কেউ বেরিয়ে আসতে পারেনি।অথচ প্রতিবছর এই ভ্যালেন্টাইন দিনে সারাটা দিন নানান জায়গায় দুজনে ঘুরে বেড়াতো।আগামীকাল ১৪ই ফেব্রুয়ারি।খুব মিস করছে স্বরুপা আজ রুপমকে।
   দু'বাড়ির থেকেও তাদের এই সম্পর্ককে মেনে নিয়েছিল। রূপমের আগেই  স্বরূপা একটা হাই স্কুলে ক্লারিক্যাল পোস্টে চাকরি পেয়ে গেছিল।কিন্তু রুপম চাকরি না পেয়ে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। স্বরূপা চাকরি পাওয়ার পর সেই আগের মত দুজনে ঘুরে বেড়াতে না পারলেও স্কুল ছুটি থাকলে তারা দুজনে বেরিয়ে পরতো।কখনো ভিক্টোরিয়া, কখনো গঙ্গার পাড়, কখনো বা কোন মুভি দেখা।যেহেতু বাড়ির সকলেই সম্পর্কটাকে মেনে নিয়েছিল তাই সময় মেনে বাড়ি ফেরার কোন তাড়া স্বরুপার ছিল না।একটু বেশি রাত না হলেই হল। সকাল আটটায় বেরিয়ে স্কুল করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্বরুপার রোজ আটটা সারে আটটা হয়ে যেত। স্কুলটা বাড়ি থেকে বেশ একটু দুরে। তাই স্কুল থাকাকালীন সময়ে সে কখনোই ইচ্ছা থাকলেও রুপম এর সাথে দেখা করতে পারত না। রুপম তখন নানান জায়গায় চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়ে চলেছে।আর এই পরীক্ষাগুলো অধিকাংশ দিন পরে রবিবার করেই।আর যার ফলে দুজনের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎটা প্রায় কমেই গেছে।রোজ রাতে ফোনেই যা একটু কথা হয়। তাও স্বরূপা বেশিক্ষণ ফোনে কথা বলে না।তার কারণ হচ্ছে চাকরির পরীক্ষাগুলো দেওয়ার জন্য রুপম রাত জেগে পড়াশোনা করে।প্রথম থেকেই রূপমের রাত জেগে পড়াশোনা করা একটা অভ্যাস।দিনে ও পড়তে পারে না।ওর নাকি দিনে পড়লে পড়া ওর মাথায় থাকে না।রাতেই স্কুল কলেজ লাইফে পড়াশোনা করতো আর আজকে চাকরির পরীক্ষার জন্য সেই রাতেই পড়াশোনা করে।
    একদিন স্বরুপা স্কুল ছুটির পর বাসে উঠে বসার একটু জায়গা পায়।সেদিন বাসটাও খুব ফাঁকা ছিল। সে রুপমকে ফোন করে।কিন্তু রূপমের ফোন রিসিভ করে একটি মেয়ে। স্বরূপা খুব অবাক হয়ে যায় মেয়েটির গলার আওয়াজ শুনে।
প্রথমে সে ভাবে হয়তো ভুল করে অন্য কোন নাম্বার ডায়াল করে ফেলেছে।ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কন্টাক্টটা দেখে নেয়। না ঠিকই তো আছে।সে জানতে চাই,
--- কে বলছেন আপনি?
--- আগে বলুন আপনি কি কারনে রুপমকে ফোন করেছেন? রুপন এখন খুব ব্যস্ত।সে আপনার সাথে এখন কথা বলতেই পারবেনা। আপনি যে স্বরূপা সেটা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু আপনি রুপমের কি হন সেটা একটু কাইন্ডলি বলবেন?
  চড়াৎ করে  স্বরুপার মাথাটা গরম হয়ে যায়।সে কান থেকে ফোনটা নামিয়েই ফোনটা কেটে দেয়। কিছুক্ষণ পরে রূপমের সেল থেকে ফোন আসে।স্বরূপা ফোনটা ধরে তাকে বলে,
--- এখন কি খুব ব্যস্ত আছো তুমি?তাই নিজের ফোনটা নিজের রিসিভ করতে পারোনি?অন্যকে দিয়ে রিসিভ করিয়েছো?
--- আরে ও একটা পাগলী --- 
  কথা শেষ হয়না রূপমের।স্বরূপা যেহেতু বাসের ভিতরে রয়েছে তাই চাপা স্বরে বলে ওঠে,
---  তাহলে তোমার ওই পাগলিকে নিয়ে সময় কাটাও।
  দুজনের মধ্যে মান-অভিমানের সেই শুরু।রুপম কিছুতেই স্বরুপাকে বুঝাতে পারেনা যে রীনা তার দূরসম্পর্কের বোন। আর ও একটু এরকমই।স্বরুপার কথা রীনা সবকিছুই জানে। জেনেশুনেই জাস্ট একটু ইয়ার্কি মারতে চেয়েছিল। ইয়ার্কিটা যে এতোটা সিরিয়াস হবে কেউ বোঝেনি।
  সেদিন কথার মাঝখানেই স্বরূপা রূপমের ফোন কেটে দিয়েছিল।তারপর রুপম বহুবার ফোন করেছে কিন্তু স্বরুপা ধরেনি। রাগ করে রুপমও বেশ কিছুদিন আর ফোন করেনা। একটা একটা করে দিন এগিয়ে যেতে থাকে আর একটু একটু করে স্বরুপার রাগ কমতে থাকে।আগামীকাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে।সব অভিমান ভুলে রূপমকে একটা মেসেজ করে,
---  কাল একবার দেখা করা যাবে?
 কিছুক্ষনের মধ্যেই উত্তর আসে -- 
--- কেন?
--- কেন মানে?কাল তো ভ্যালেন্টাইনস ডে একবার দেখা করবো না?
--- রাগ কমেছে?
--- আমি মোটেই রাগ করিনি।আমার বড্ড অভিমান হয়েছিল। আমি তোমায় ফোন করলাম আর সে ফোন অন্য একজনের ধরলো। আমার অভিমান হবে না?ভালোবাসি বলেই তো অভিমান হয়।ভাল না বাসলে আমি রাগ করতাম।
--- তার মানে স্বীকার করছো আমায় তুমি ভালোবাসো।
--- বাসি বাসি বাসি। আর কতবার বলবো আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।অবশ্য আমি জানি আমি যতটা তোমাকে ভালোবাসি তুমি ততটা আমায় ভালোবাসো না।
--- অনেক কিছু জেনে-বুঝে আছো। যেটা জানো না সেটা আমি কাল তোমায় জানিয়ে বাকিটা বুঝিয়ে দেবো। তাড়াতাড়ি করে খুব সেজেগুজে চলে আসবে কিন্তু।কতদিন দেখিনা বলতো?
--- সাজতে আমার বয়েই গেছে।আমায় যেমন দেখতে সেই ভাবেই সারা জীবন আমায় নিয়ে তোমার থাকতে হবে।আর হ্যাঁ আমি কিন্তু একটুও অপেক্ষা করে থাকতে পারবো না। কালকে যদি আমাকে অপেক্ষা করাও তাহলে কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই আমার রাগ হবে।
স্বরুপার কথা শুনে রুপম খুব হাসতে থাকে ফোনের অপরপ্রান্তে।
--- পাগলী আমার !খামোখা রাগ করে এই কটা দিন নিজেও কষ্ট পেলো আর আমাকেও কষ্ট দিল।আমিতো এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করে আছি কবে আমার পাগলির রাগ পড়বে।একটা ভালো খবর দেওয়ার আছে।আমার চাকরির একটা ইন্টারভিউ এসেছে।পরীক্ষাটা ভালই দিয়েছিলাম। এবার ভাইভাটা ভালোভাবে হলেই ঈশ্বর যদি মুখ তুলে তাকান।তাহলে বেশি দিন আর তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে না।আজ তাহলে রাখি বাকি কথা কাল হবে।
 অনেকদিন পর স্বরুপা চোখের জল না ফেলে রাত্রিটা ভালোভাবে ঘুমালো।মনেমনে ভাবলো কাল স্কুলে আর যাবে না,তাহলে অনেক দিন পর অনেকটা সময় রূপমের সাথে থাকতে পারবে।
    

সুখের ঘরে আগুন (২৫)

সুখের ঘরে আগুন (২৫)

    অচলা সেই সোফার উপরেই বসে থাকল।নিলয় পাউরুটি আর সেদ্ধ ডিম খেয়ে অফিসে বেরিয়ে গেল।যাওয়ার সময় অচলা কে পুনরায় বলে গেল,
---  অফিস ছুটির পর আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। রান্নাবান্না করে তো খেতে হবে।তাই একটু দেরী হবে আমার আসতে।আবারও বলছি আপনি কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কেউ ডাকলে দরজা খুলবেন না বা জানালা দিয়ে উকি মারবেন না।ওরা কিন্তু সন্দেহ করছে আপনি এই চত্বরেই কোথাও আছেন।
  নিলয় বেরিয়ে গেল।কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে বাস রাস্তা পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল কাল এখানে এসে মাকে একটা ফোন করে জানিয়েছিলাম।তারপরে আর নানান উটকো  ঝামেলায় মাকে ফোন করার কথা মনেই নেই। ভেবেছিলাম রাতে অম্বিকাকে একটা ফোন করবো।তাও মাথা থেকে উবে গেছে। বিছানায় শুয়েই গতকাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।অম্বিকা তো ফোন করতে পারবেনা।তার কাছে তো নিলয়ের ফোন নম্বরটাই নেই।সুতরাং সে ফোন না করা পর্যন্ত অম্বিকার ইচ্ছে হলেও সে নিলয়ের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারবে না।আজ ফিরে অম্বিকাকে একটা ফোন করতেই হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সে বাস রাস্তা চলে এলো।আসবার সময় চায়ের দোকানটায় তাকিয়ে দেখল সকালের সেই লোকটা না থাকলেও কয়েকটা লোক সেখানে বসে তখনও আড্ডা দিয়ে চলেছে।এদের মধ্যেই হয়তো ওদের গ্যাংয়ের কোন লোক বসে আছে। কি সমস্যায় যে পড়া গেল! মেয়েটাকে নিয়ে এখন যে সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।মায়ের সাথে আলোচনা করবে?নাকি বাবাকে সব বলবে?আচ্ছা অম্বিকাকে বললে কেমন হয়? নাহ এর কোনটাই ঠিক হবে না।যা করার নিজেকেই করতে হবে।এ নিয়ে কারও সাথে আলোচনা করতে গেলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।মাকে বললে মা আকাশ-পাতাল চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবে সাথে বাবা কেউ ছাড়বেন না। অম্বিকাকে বললে সে  কিভাবে ব্যাপারটাকে নেবে তাও বলা যাচ্ছে না।সুতরাং কারো সাথে কোন বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। নিজেকেই সমাধান বের করতে হবে।
  নূতন অফিস।সকলেই নূতন।প্রথমদিন সকলে এমনভাবে তার দিকে তাঁকিয়ে দেখছে যেন সে চিড়িয়াখানার কোন জীবজন্তু হবে। যেচে পড়ে অনেকের সাথেই আলাপ করেছে সে। তাদের মধ্যে নিখিলেশ বলে একটি ছেলে যে তার সমবয়সী হবে তার সাথে প্রথম দিনেই খুব ভাব হয়ে যায়। নিলয়, নিখিলেশের কাছ থেকে বাজারঘাট সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে নেয়। নিখিলেশ তার সাথে বাজারে যেতে চাইলেও নিলয় আপত্তি জানায়।তাকে বলে,
---  অনেক দরকারি কাজে হয়তো তোমাকে আমার প্রয়োজন হবে। তাই এই বাজারঘাটটা আমি নিজেই করে নিতে  পারবো।
আসলে নিলয়ের মনে ছিল যে সে অচলার জন্য কিছু জামা কাপড় কিনবে।কিন্তু নিখিলেশ সাথে থাকলে এটা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। তাই কোনোরকমে নিখিলেশকে তার সাথে যাওয়া থেকে বিরত করে।দুই হাত ভর্তি করে নিলয় একবারে রাতের খাবার কিনে নিয়ে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকে দেখে ঘর অন্ধকার । ঘরে ঢুকে সে লাইট জ্বালায়।দেখে অচলা সোফার উপরে অন্ধকারেই শুয়ে আছে।নিলয়কে দেখে সে উঠে বসে।পরনে তার নিলয়ের সকালে কিনে দেওয়া সাধারন একটা নাইটি। অচলা উঠে গিয়ে নিলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
---  আপনাকে ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছি।আমি এখান থেকে চলে যাই।আমার যা কপালে আছে তাই হবে। কিন্তু আমি এখানে থাকলে আমাকে নিয়ে আপনার যেমন একটা চিন্তা থাকবে আবার আপনার বদনাম হবে।
---- আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।আমি এতটা অমানুষ নই যে আপনাকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেবো। আপনার যাওয়ার যদি কোন জায়গা থাকতো আমি সেখানে আপনাকে পৌঁছে দিতাম।কিন্তু সে উপায়ও নেই।আপাতত আপনি কিছুদিন আমার এখানে থাকুন।তারপর দেখছি কি করা যায়।আপনি এক কাজ করুন,এই জিনিসগুলো নিয়ে রান্নাঘরে রাখুন।এর ভিতর থালা, গ্লাস, বাটি, চাল,ডাল সব আছে।রাতের খাবারটাও নিয়ে এসেছি।আচ্ছা আপনি চা করতে পারেন?একটু চা করবেন?সব আছে ব্যাগের মধ্যে।খুব টায়ার্ড লাগছে।
অচলা ব্যাগগুলি নিয়ে একটা একটা করে সব রান্না ঘরে নিয়ে গেল।দুপুরের দিকে সে রান্নাঘরটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রেখেছিল।এখন অভিজ্ঞ হাতে জিনিসগুলোকে রান্নাঘরে গুছিয়ে স্টোভ এ দু'কাপ চা করে দুটো বিস্কুট নিয়ে আসে।তার আগেই নিলয় হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। চা টা মুখে দিয়ে অচলার দিকে তাঁকিয়ে বলে,
--- বাহ চমৎকার!আপনিতো খুব সুন্দর চা করেন। তার মানে আপনি রান্নাও করতে জানেন।ও হ্যাঁ আপনি বলেছিলেন বটে মামাবাড়িতে আপনি রান্না করতেন।এখানে কাল থেকে আপনি চুপচাপ বসে না থেকে এই রান্নাটাই করবেন। আপনার ও সময় কেটে যাবে আর আপনিও নিশ্চিন্ত মনে এখানে থাকতে পারবেন।এই মুহূর্তে আমি তো কোন কাজের লোক রাখতেও পারবোনা।বাইরের লোক আসলেই আপনাকে দেখে ফেলবে।আপনি কিন্তু ভাববেন না যে আপনাকে কাজ করার জন্য এখানে আমি থাকতে বলছি। আপনার বিপদের আঁচ পেয়েই আপনাকে এখানে থাকতে বলছি।আমি আপনাকে জোর করবো না।যদি আপনি মনে করেন এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও থাকতে পারবেন তাহলে আপনি আমায় বলুন কোথায় যাবেন আমি নিজে গিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।কিন্তু আপনাকে একা একা আমি বাইরে কিছুতেই ছাড়বো না। জেনেশুনে আপনাকে আমি বিপদের মধ্যে ফেলে দিতে পারবো না। এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি করবেন?
--- আপনি যে আমার জন্য এতটা ভেবেছেন তাতেই আমি খুশি।আমি বাঁচতে চাই তাই আপনার কথা শুনে এখানেই আমি থাকবো।কিন্তু একটা সম্পর্ক তো গড়তে হবে আপনার আর আমার মধ্যে।তা না হলে কি পরিচয়ে আপনার কাছে থাকবো?আর কি নামেই বা আপনাকে ডাকবো?
নিলয়ের বুকটা তখন দুকদুক করছে।এইরে!কি পরিচয় চাইছে এখন অচলা?
--- সম্পর্কটা আমিই গড়ি তবে-- কি বলো দাদা?
আগের কথাটা শুনে নিলয়ের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।কিভাবে নিঃশ্বাস নিতে হয় আর ছাড়তে হয় সে যেন সেটাই ভুলে গেছিল।কিন্তু অচলার পরের কথাটা শুনে সে  হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।আর মনেমনে ভাবল, না মেয়েটা মোটেই খারাপ নয়।তার সম্পর্কে সে যেটুকু বলেছে এখন মনে হচ্ছে পুরোটাই সত্যি।থাক না এখানেই সে।একটা অসহায় মেয়ে! কেউ নেই কোথাও,কি আর এমন বিপদ হবে? যদি সেরকম কিছু হয় আইন তো আছে আর আইনের কাছে গেলে অন্তত ওই গ্যাংয়ের সন্ধানটা পাওয়া যাবে।
এভাবে দুই সপ্তাহ কেটে গেল।অচলা ঘরের ভিতরেই থাকে। ও নিজেই রান্নাবান্না করে।নিলয় অফিস যাওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে যায় এসে তালা খোলে।ছোট থেকেই অচলা মামাবাড়িতে সংসারের যাবতীয় কাজ করার ফলে নিলয়ের এখানে এসে সে খুব সুন্দর ভাবে নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে।কিন্তু সমস্যা দেখা দিল দু সপ্তাহ পর যখন নিলয়ের নাইট ডিউটি শুরু হলো। নিলয় কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না রাতের বেলা কিভাবে ওকে একা রেখে সে অফিস যাবে।কিন্তু অচলা।বহুবার বলেছে তার কোন অসুবিধা হবে না।সে একাই থাকতে পারবে।সারাদিন যেভাবে থাকে রাতেও সেই একইভাবে থাকবে তার ভয় করবে না।কিন্তু নিলয় রাতের বেলা অচলাকে রেখে কিছুতেই ডিউটিতে যেতে সাহস পাচ্ছে না।অথচ অন্য কোন পথও খুঁজে পাচ্ছে না।সুতরাং তাকে এভাবেই অচলাকে তালাবন্ধ করে ডিউটিতে যেতে হবে।
  নিলয় সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।সে বাইরে থেকে তালা দিয়েই বেরিয়ে যায়।অচলা সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সমস্ত লাইক অফ করে দেয়।রাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রান্নাঘরে বসে চুপিসারে ডিনারটা করে ফেলে।ঘরে আলো জ্বালালে বাইরে থেকে লোকে বুঝতে পারবে ভিতরে লোক রয়েছে তাই সে অন্ধকারের ভিতর এঘর-ওঘর করে আর তার টুকটাক কাজগুলো করে করতে থাকে ওই মোমবাতির আলো়তেই।কিন্তু তা সত্ত্বেও রাত দশটা নাগাদ সে প্রথমে শুনতে পায় দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ,তারপর বেলের আওয়াজ।এর পরেও যখন ভিতর থেকে কোন সাড়া তারা পায়না তখন "ভিতরে কেউ আছেন?"বলে কয়েকবার চিৎকার।অন্ধকার ঘরের ভিতর অচলা জড়োসড়ো হয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে অঝোর ধারায় সারারাত কেঁদে চলেছে। সকাল আটটা নাগাদ নিলয় ফিরে এসে তালা খুলে যখন ঘরে ঢোকে অচলা দৌড়ে এসে নিলয়কে  জড়িয়ে ধরে ভীষণভাবে কাঁদতে থাকে।প্রথম অবস্থায় নিলয় থতমত খেয়ে যায়।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
---  চিন্তা কিসের?দাদা তো রয়েছে।কিচ্ছু হবে না তোর।তুই এখানেই থাকবি।তোর সব দায়িত্ব আমার।কাল রাতে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কি হয়েছে সেটা আমাকে বল।
অচলা কাঁদতে কাঁদতে গতরাতের।সমস্ত ঘটনা জানায় নিলয়কে।

ক্রমশঃ

Saturday, February 13, 2021

বডিগার্ড

বডিগার্ড

   কলেজ ফেস্টে প্রথম দেখা।অয়নের খুব পছন্দ হয়ে যায় রিমাকে।পুরো অনুষ্ঠানে রিমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করে বেড়ায় অয়ন।অয়ন সুন্দর,সুপুরুষ। ছফুটের উপর লম্বা।যে কোন মেয়েই তাকে পছন্দ করবে। রিমারও তাকে ভালো লাগে।কিন্তু রিমার মনেহয় অয়ন যেন একটু বেশি গায়ে পরা ছেলে। রিমার কলেজে ফার্স্ট ইয়ার হলেও অয়নের থার্ড ইয়ার। মাত্র কটা দিনেই অয়ন যেন রিমার বডিগার্ড হয়ে ওঠে।অয়নের সবকিছু রিমার ভালো লাগলেও অয়নের সব সময়ের জন্য রিমাকে আগলে রাখা এটাই সে কিছুতেই মানতে পারেনা।রিমা সুন্দরী। অধিকাংশ ছেলেরাই তার কাছে এসে একটু দাঁড়াতে,একটু কথা বলতে ভালোবাসে।কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই অয়ন সেখানে হলুদের গুঁড়ার মত এসে হাজির হয়ে যায়। রিমার বান্ধবীরা অনেকেই অয়নের এই কার্যকলাপ দেখে রিমার সাথে খুব হাসাহাসি করে যা একেবারেই মেনে নিতে পারেনা রিমা।
  অয়ন কে রিমার ভালো লাগলেও রিমা কিন্তু অয়নকে ঠিক ভালোবাসে না। সে আস্তে আস্তে অয়নকে এড়িয়ে যেতে শুরু করে।রিমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজই অয়নকে বুঝিয়ে দেয় রিমা অয়নের এই গায়ে পড়া মনোভাবটা মোটেই পছন্দ করছে না। আর এটা বুঝতে পেরে অয়নও রিমার কাছ থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। প্রথম প্রথম রিমা জয়ের আনন্দে আনন্দিত হলেও পরে তার মনটা কেন জানিনা খুঁত খুঁত করতে থাকে। অয়নের লাস্ট সেমিস্টার শেষ হয়ে যায়। অয়ন প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে শুধুমাত্র রিমাকে একটা কথা বলার জন্য।রিমাকে দেখতে পেয়ে অয়ন কাছে এগিয়ে যায় এবং বলে,
---  না বুঝে তোকে হয়তো আমি আঘাত করে ফেলেছি।কিন্তু আমার এরকম কোন উদ্দেশ্য ছিল না। তোকে বলা হয়নি বা বলতে পারিস বলার সুযোগও আসেনি।এক কলেজে পড়ার সুবাদে আমরা ক্লাসমেট না হলেও আমরা কিন্তু বন্ধু হতে পারি।কিন্তু তোর দিক থেকে কোন সাড়া আমি পাইনি। যে কথাটা তোকে বলা হয়ে ওঠেনি সেটা হল আমি একটা বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি।এখানকার অফিস আমার  সল্টলেকে। জীবনে আর হয়তো তোর সাথে আমার দেখা হবে না।কিন্তু তোর কথা আমার মনে থাকবে সারা জীবন।
 কথাগুলো বলে রিমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অয়ন দৌড়ে গিয়ে বাস ধরে বেরিয়ে যায়।রিমা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।হঠাৎ করেই তার মনেহয় বুকের ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে।কিন্তু কেন?সে তো অয়ন কে ভালোবাসে না। ওর চলে যাওয়াটা কেন সে মেনে নিতে পারছে না?তবে কি সে অয়নকে - না -- না -- তা কি করে সম্ভব?সে তো সত্যিই কোনদিনও অয়নকে ভালবাসনি।হ্যাঁ এটা ঠিক অয়নের চেহারা দেখে সে আকৃষ্ট হয়েছিল কিন্তু ভালো লাগা আর ভালোবাসা তো এক নয় তবে কেন আজ এই মুহূর্তে তার ভীষণ খারাপ লাগছে।
  বেশ কয়েকটা দিন রিমার মনটা খুবই খারাপ ছিল।কিন্তু সময় মানুষকে আস্তে আস্তে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিতে না পারলেও সবকিছুর উপর একটা মোটা আস্তরন ফেলে দেয়।অয়নের ঘটনাটাও রিমার জীবনে ঠিক তাই হলো একটা মোটা আস্তরণের তলায় চাপা পড়ে গেল।
  বিটেক পাস করে রীমা আমেরিকান কোম্পানিতে  ভালো একটা চাকরি পেয়ে যায়। অফিস,বাড়ি,মা বাবার আদর  বেশ কাটছিল রিমার দিনগুলি।কিন্তু তারই অফিসের সহকর্মী তরুণ পাল নানান অছিলায় তাকে একটু ছোঁয়ার চেষ্টা, রিমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বাসে তুলে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করা - এগুলো রিমা ঠিক ভালোভাবে নিতে পারছিলনা। একচুয়ালি গায়ে পড়া কোন মানুষকেই রিমা পছন্দ করে না।আর এই কারনেই অয়নের মত একটা ভালো ছেলের সাথেও তার কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি।অনেকবার কলিগ তরুণ পালকে নানান ভাবে নিষেধ করেছে  যে তার ব্যাপারে বেশি আগ্রহ প্রকাশ যেন তিনি না করেন।কিন্তু তরুণ পাল নাছোড়বান্দা।একদিন অফিসের করিডোরের ভেতর হঠাৎ পিছন থেকে এসে রিমার হাতটা টেনে নিয়ে তরুণ পাল বলেন,
--- কিছু কথা ছিল।
কিন্তু হঠাৎই পিছন থেকে একটা শক্ত হাতের থাপ্পড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে তরুণবাবু দেওয়ালে গিয়ে পড়েন। আর ঘটনার আকস্মিকতায় রিমা  চোখ বন্ধ করে ফেলে। রিমা যখন চোখ খোলে তখন দেখে করিডোরের শেষ প্রান্ত দিয়ে কোর্ট পরা এক ভদ্রলোক নিমেষের মাঝে মিলিয়ে  গেলেন। ততক্ষণে তরুণবাবু নিজেকে সামলে নিয়েছেন। রিমা তাদের অফিস রুমে ঢুকে তার নির্দিষ্ট চেয়ারটাতে বসে ভাবতে থাকে এটা কি একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল?কে ভদ্রলোক যে তাকে অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করল?এবং নিজের পরিচয় না দিয়ে নিমেষের মাঝে কোথায় চলে গেল? তার মানে বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোকও এই অফিসে চাকরি করেন। নানান ভাবনায় সে ডুবেছিল।হঠাৎ বসের আর্দালি এসে রুমে বলে গেল, টিফিন আওয়ারে মিনিট দশেক সময় যেন সকলে রুমেই থাকে।বস আসবেন কিছু কথা বলার আছে তার। বস তাদের রুমে আসবেন শুনে সকলের বুকটা দুর দুর করতে লাগলো। কারণ সকলেই শুনেছে তাদের উপরের এই বস মানুষটি ভীষণ রাজি এবং কাঠখোট্টা।অফিসের কাজকর্মের বাইরে একটি কথাও তিনি কারো সাথেই বলেননা।একটা নিরস লোক বলেই সকলে তাকে জানে।টিফিন আওয়ার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে বস এসে ঢুকলেন। সকলে দাঁড়িয়ে পড়লে হাতের ইশারায় তিনি সকলকে বসতে বলেন। কিন্তু রিমা তার বসের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েই থাকে। বস অয়ন মুখার্জি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ---- মিস বোস, আপনি কেন দাঁড়িয়ে?বসে পড়ুন।
 রিমা ক্যাবলার মত এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের সিটে বসে পড়লো। অয়ন তখন সমস্ত কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই শুধু বলল,
--- অফিসের ভিতরে কোন মহিলা কর্মচারীর সাথে কোন পুরুষ যদি অশালীন আচরণ করে তবে উপরমহলের নলেজে সেটা দেওয়া হবে।হয়তো ভবিষ্যতে তার চাকরিও যাবে। উপরমহলের এইরকমই নির্দেশ দেওয়া আছে।সুতরাং কারো কোন অসুবিধা হলে আপনারা যে কোন সময় আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।আমার মাধ্যমে সেটা উপর মহলে যাবে। এটাই আপনাদের বলার ছিল।টিফিন আওয়ারে আপনাদের কিছুটা সময় নেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
 কথাগুলো বলে অয়ন তার রুমে ফিরে গেল।একটু পরে আর্দালি একটা কাগজের চিরকুট তার সামনে গিয়ে ধরে। অয়ন চিরকুটটার  দিকে তাকিয়ে বলে, "ভিতরে পাঠিয়ে দাও"।
--- ভেতরে আসবো?
--- ইয়েস ।
 রিমা এসে অয়নের সামনে দাঁড়ায়। অয়ন হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে।তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলে,
--  অফিশিয়াল কোন কাজ থাকলে বলতে পারেন।আর যদি ব্যক্তিগত কোন কথা থাকে তাহলে অফিস শেষে শুনবো। কারণ আমি অফিসে কোন ব্যক্তিগত আলোচনা করিনা।
   রিমা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো।তার অপমানের জবাবে অয়নের দেওয়া অপমানটা হজম করে নিল। কিন্তু তবুও তার চোখ দুটি জলে ভর্তি হয়ে গেল।সে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলো।অফিস ছুটির পর বাসের জন্য যখন সে অপেক্ষা করছে ঠিক তখন তার সামনে এসে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়ায়।গাড়ির কাঁচ নামিয়ে অয়ন রিমাকে ডেকে নেয়।রিমা কিছুটা ইতস্তত করলেও পরে এসে ওর পাশেই বসে।অয়ন নিজেই ড্রাইভ করছিল। অয়নই প্রথমে কথা বলে,
--- আমি অত্যন্ত দুঃখিত রিমা,আবার তোর সামনে আমাকে দাঁড়াতে হলো।আসলে পুরো অফিসে সিসিটিভি বসানো আছে।আমি কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম মিস্টার পাল তোর সাথে অভদ্র আচরণ করছেন।তাই আমিও একটু সজাগ ছিলাম। আজকের ব্যাপারটা পুরো কাকতালীয়।ওই সময়ে আমিও আমার নিজের রুম থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম ওই জায়গাটায় তুই না হয়ে যদি অন্য কোন মেয়ে হতো আমি একে আচরণ করতাম।
--- তুমি এত কৈফিয়ৎ দিচ্ছ কেন?তারমানে তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি।
--- তুই অন্যায় কি করলি যে তোকে ক্ষমা করবো?
--- পাঁচ, ছ বছর আগে হলেও ম্যাচিওরিটিটা কম ছিল।বুঝতে পারিনি।তুমি দূরে চলে না গেলে হয়তো কোনদিনও বুঝতেই পারতামনা।
--- কি বুঝতে পারতিস না?
--- আমাকে আগে বলতে হবে ?
 অয়ন হেসে পড়ে বললো,
--- তাতো হবেই,তবে তুই আমায় বলতে বললে আমি বলতে পারি।কিন্তু তার আগে আমায় একটা কথা বল তো ? কবে থেকে তোর এই বোধোদয় হল?
--- সেই যে কলেজ গেটে যেদিন আমার সাথে --- ।
--- তারপর খুঁজেছিস আমায় ?
--- হু,তবে সেটা মনেমনে কারণ তোমার ঠিকানাটা তো আমার জানা ছিলনা।
--- এবার তাহলে দুজনের একটা ঠিকানা হতে পারে বল ?
--- তা পারে।তবে একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।তুমি তো আগেই জানতে আমি ওই অফিসেই আছি,কোনদিন দেখা করোনি কেন?
--- অভিমানে?
--- মুখ ফুটে তো কোনদিন তোমার ভালোবাসার কথা বলনি,তাহলে এত অভিমান কিসের জন্য?
--- আমার ভালোবাসাটা তোর বুঝতে না পারার কারণটাই আমার অভিমানের কারণ।তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম একদিন না একদিন তুই ঠিক বুঝতে পারবি।ভাগ্যিস বুঝলি তানাহলে তো আমাকে বিবাগী হতে হত।(অয়ন হাসতে থাকে)
 আমি আরও অনেককিছু পারি। ক্রমশ সব জানতে পারবি।
 রিমা অয়নের পিঠে আলতো করে একটা কিল দিয়ে বলে,
--- অসভ্য!তবে যে অফিসের সবাই বলে বস ভীষণ রাগী, বেশি কথা বলে না, মুখে কোনো হাসি নেই, প্যাঁচার মত মুখ করে থাকে।
--- আরে ওটা তো অফিস ।
 অয়ন গাড়ির গতিটা কমিয়ে রিমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
--- বহুদিনের ইচ্ছা আজ না বলিস না।
 আস্তে করে অয়ন রিমার গোলাপী ঠোঁটদুটো স্পর্শ করে।রিমা তার প্রথম প্রেমের ছোঁয়া চোখ বুজে কম্পমান শরীরে গ্রহণ করে।

  শেষ

 
    নন্দা মুখার্জি রায় চৌধুরী
 প্রজনা

Wednesday, February 10, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২৪)

সুখের ঘরে আগুন (২৪)

  ভাগ্য অচলার জীবনে কোনদিনও সাথ দেয়নি। জন্মের সাথে সাথেই সে তার মাকে হারিয়েছে।আর বাবা পুনরায় বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। সেই শিশুকাল থেকে মামা বাড়িতেই মানুষ।মামা ভালবাসলেও মামি কোনদিনও ভালবাসেনি।যতদিন দিদিমা বেঁচে ছিলেন ততদিন তাও একটু দুবেলা পেট ভরে খেতে পেরেছে স্কুলেও যেত। মামা এবং দিদিমার চোখের আড়াল হলেই সহ্য করতে হতো মামির অত্যাচার আর গঞ্জনা।যখন অচলা নবম শ্রেণীর ছাত্রী তখন মারা যান তার দিদিমা।মামির অত্যাচারে পরিমাণটা তখন আরো বেড়ে যায়।কারণ মামা নানান কাজকর্মে অধিকাংশ সময় বাড়ির বাইরেই থাকতেন। ছাড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে স্কুল।পুরো সংসার তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়।রাতে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুমানোর সময় টুকু ছাড়া বাকি সময়টুকু সে চরকাকারে সংসারের কাজকর্ম করে যেত।মামা অনেক চেষ্টা করেছেন অচলাকে স্কুলে পাঠিয়ে অন্তত মাধ্যমিক পাসটা করাতে।কিন্তু স্ত্রীর মুখের কাছে তিনি সবসময় হেরে যেতেন।আগে যখন অচলার দিদিমা বেঁচে ছিলেন তখন অবশ্য শ্বাশুড়ির মুখের সাথে তার মামি অর্থাৎ হেমাঙ্গিনীদেবী পেরে উঠতেন না।কিন্তু এখন তিনি সংসারের সর্বময় কর্ত্রী। তার কথায় এই সংসারে সকলে উঠে আর বসে। হেমাঙ্গিনীদেবীর রয়েছে দুটি কন্যা সন্তান। তার বক্তব্য অচলার পেছনে টাকা খরচ করে তার কন্যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ফেলতে পারবেন না।সুতরাং অচলার স্কুলে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
  সারাটা দিন সে মুখ বন্ধ করে সংসারের যাবতীয় কাজ করে যায়।মামি এবং তার দুই বোনের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে হয়তো কোন দিন দুপুরের খাওয়াটাও তার হতনা।একবারে রাতের খাবার খেয়ে এসে সে শুয়ে পড়তো। এগুলো যে তার মামি ইচ্ছাকৃত করতেন অচলা সেটা বুঝতে পেরেও চুপ করেই থাকতো কারণ মাথার উপরের ছাদটা সে হারাতে চাইতো না। মামি যদি তাকে তাড়িয়ে দেয় তাহলে সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? একমাত্র মামা তার সাথে একটু ভালভাবে কথা বলতেন।গায়ে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন,সে খেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেন।কিন্তু হেমাঙ্গিনীদেবীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে গিয়েও কোন সুরাহা কোনদিনও করতে পারেননি। অচলার দিনগুলি এভাবেই কেটে যাচ্ছিল।মেনে নিয়েছিল সে তার জীবনের এই পরিণতিটাকে! কিন্তু হঠাৎই অচলা লক্ষ্য করে মামী তার সাথে যেন একটু ভালো ব্যবহার করছেন।আর মামার কাছে সুযোগ পেলেই তার বিয়ের জন্য ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করেছেন। ছোট থেকেই অভাব দারিদ্র্যর মধ্য থেকে মানুষ হলেও বুদ্ধিটা তার ছোট থেকেই একটু বেশি। মামীর এই হঠাৎ পরিবর্তনে তার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না যে মামির অন্য কোন মতলব মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।তাই সে চোখ কান খোলা রেখে থাকতে শুরু করে।
 একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, রান্নাঘরের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে যখন সে তার ঘরে ঘুমাতে যাবে ঠিক তখনই মামা-মামীর ঘরে তর্কাতর্কি শুনে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে।সে জানতে পারে পরের দিন তাকে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে।তাদের কোনো দাবিদাওয়া নেই।এক কাপড়েই তারা মেয়েকে নিয়ে যাব। কিন্তু মামা কিছুতেই রাজি হতে চাইছেন না।তার একটাই কথা আগে তিনি খবর নেবেন ছেলের বাড়ির তারপর ছেলের বাড়ি থেকে অচলাকে দেখতে আসবে এই নিয়েই দুজনের মধ্যে বচসা। অচলা সেখানে আর  দাঁড়ায় না। সে বুঝতে পারে তার জীবনে আবার কোন অঘটন ঘটতে চলেছে।কিন্তু বুঝতে পেরেও সেই মুহূর্তে তার কিছু করারও নেই।পরদিন মামা অফিসে যান না।একটা পাইকারি মুদিখানার দোকানে তিনি কাজ করেন।সামান্য কিছু মাইনে পান।নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারে কোনো রকমে নিজের হাতে সংসারটাকে ধরে রেখে চালিয়ে যাচ্ছেন আজও। মায়ের কিছু জমানো অর্থ ছিল।সেই টাকাটা তিনি ফিক্সট করে রেখে তার সুদটাও প্রতিমাসে তুলে সংসারের পিছনে খরচ করেন।কিন্তু হেমাঙ্গিনীদেবী এই টাকাটা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। মামা অফিস না যাওয়াতে অচলার মনে হয় মামার মনেও কিছু একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছে।
   পরদিন দুপুর নাগাদ ছেলের বাড়ি থেকে অচলাকে দেখতে আসলো তিনজন  পুরুষ আর একজন মহিলা।তারা পরিচয় দিল সবথেকে সুন্দর দেখতে যে ছেলেটি সে হচ্ছে পাত্র বাকি দুজন বন্ধু আর ছেলের মা। অচলাকে দেখে তাদের পছন্দ হলো। তারা পাকা কথা দিতে গেলে অচলার মামা তাদের জানালেন আগে তিনি ছেলের বাড়ি দেখবেন, ছেলের চাকরির স্থান দেখবেন তারপর তিনি তার ভাগ্নির বিয়ে দেবেন। পাত্রপক্ষ একথা শুনে সম্মতি জানিয়ে ফিরে গেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল হেমাঙ্গিনীদেবীকে নিয়ে।তিনি সংসারের তুমুল অশান্তি শুরু করলেন তার স্বামীর সাথে।অচলার সাথে তার মামীর ব্যবহার সেই পূর্ব স্থানেই ফিরে এলো।পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো সারাদিন কাজকর্ম করার পরও অচলা পেট ভরে দুবেলা খেতে পারে না।তখন অচলার মামা বুঝতে পারেন কিছু টাকার বিনিময়ে হেমাঙ্গিনীদেবী তার ভাগ্নিকে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন।দিনরাত এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা লেগেই থাকে।এইভাবে কয়েকটা দিন চলার পর একদিন অচলার মামি অচলাকে রেশন আনতে দোকানে পাঠাযন। কিন্তু অচলা রেশন নিয়ে আর বাড়ি ফিরে আসে না সেরাতে।অচলার মামা অচলাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে রাতে তাকে আর খুঁজে পাননা। শেষমেশ তিনি পুলিশের একটা নিখোঁজ ডায়েরি করেন। দুদিন পরে একদিন রাতে অচলা বাড়িতে ফিরে আসলে তাকে কুলোটা বলে মামি আশ্রয় দিতে রাজি হননা। তার মামা তার কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন সে যখন রেশন নিয়ে বাড়ি ফিরছিল তখন রাস্তার উপরেই তাকে অজ্ঞান করে একটি গাড়িতে করে কোনো একটি অন্ধকার ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে রেখেছিল। তার যখন জ্ঞান ফেরে  তখন ঘরটি ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন।ওই অন্ধকার ঘরের ভিতরে বসে চিন্তা করতে থাকে কিভাবে এখান থেকে সে পালিয়ে যাবে।কিছুক্ষণ পরে দুটো লোক ওই ঘরের ভেতর ঢোকে হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে।লোক দুটিকে  ঢুকতে দেখে অচলা অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করে মাটিতে পড়ে থাকে।লোক দুটি অচলার জ্ঞান আসেনি এটা ভেবে দরজা খুলে রেখেই অন্য কাউকে হয়তো ডাকতে যায়।অচলা এই সুযোগে সেখান থেকে উঠে উদভ্রান্তের মত ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসে।সে যে রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসে সেই রাস্তার সম্পূর্ণ জায়গাটায় কোন আলো ছিল না। আর এই আলো না থাকার কারণে অচলা বেরিয়ে আসার সময় তারা তাকে দেখতেও পায় না।কিন্তু তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল যে ওখান থেকে বেরিয়ে অচলা তার বাড়ীর দিকেই যাবে।
  অচলা বাড়িতে আসার পর যখন তার মামী তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করলেন তখন তার মামা তার স্ত্রীর সাথে প্রচন্ড ঝামেলা করে তাকে সাথে নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন কোন আত্মীয়ের বাড়িতে সেই রাতটা আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু ভাগ্নিকে সাথে নিয়ে বেশি দূর তিনি এগোতে পারেন না।তারা অন্ধকারের ভিতর অচলার মামাকে একটা লাঠির আঘাতে অজ্ঞান করে পুনরায় অচলাকে তুলে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। এই দলটির যিনি হেড ছিলেন তার অবশ্য একটা নীতি ছিল।তার আন্ডারে যারা কাজ করতো তাদের উপর একটা নির্দেশ জারি ছিল কোন মহিলার সাথে অশালীন আচরণ করা যাবে না। যুবতী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকায় অন্যের কাছে বিক্রি করে দেওয়াটাই তাদের ছিল ব্যবসা।তারা কিন্তু কোন নারীকে কখনোই কোন অসম্মান করত না। যেহেতু অচলা একবার পালিয়ে গেছিল তাই এবার তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কড়া পাহারায় বেশ কিছুদিন ঘরে বন্দী করে রাখা হল।দিন কয়েক সেখানে থাকার পর একজন বয়স্ক মানুষের সাথে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল ট্রেনে করে অন্যত্র।বয়স্ক মানুষটি তার সাথে থাকলেও আশেপাশের ট্রেনের বগিতে আরো অনেকেই এই দলের মানুষজন ছিল।তাকে স্টেশনে নিয়ে আসার সময় বলা হয়েছিল যদি সে কোন চালাকি করে তাহলে সাথে থাকা মানুষগুলি সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।তাই প্রথম অবস্থায় সে চিৎকার করা বা কাউকে জানাতে কোন সাহস পায়নি।কিন্তু পরবর্তীতে সে ভেবে দেখে আজ যদি সে সুযোগ না পায় পালানোর জন্য তাহলে সারা জীবনই সে আর কোনো সুযোগ পাবে না।তাই শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে প্লাটফর্মে ট্রেন ঢুকলে চলন্ত ট্রেনের কামরা দিয়ে সে লাফিয়ে পড়েছিল।
    সোফার উপরে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেও ভয়ে আতঙ্কে সারারাত অচলা দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।সকাল হলে সে কোথায় যাবে?এখান থেকে আদতেও বেরোতে পারবে কিনা?যদি এখানে থাকার একটু সুযোগ পায় তাহলে  কি পরিচয়েই বা এখানে থাকবে?এইসব নানান চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। নিলয় ঘুম থেকে উঠে দেখে সেই একইভাবে অচলা সোফার উপর বসে আছে। তাকে দেখে নিলয়ের খুব মায়া হতে থাকে।কিন্তু তারও তো এই মুহূর্তে কিছু করার নেই।সে ব্যাগ থেকে টুথ ব্রাশ,পেস্ট বের করে নিজের ব্রাশে পেস্টটা লাগিয়ে বাথরুমে ঢোকার আগে পেস্টটা অচলার সামনে রেখে দিয়ে তারপর সে বাথরুমে ঢুকে যায়।বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে বাইরে যাওয়ার সময় অচলাকে বলে যায় বাইরে যাচ্ছে সে যেন উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়।দোকানে গিয়ে নিজে একটু চা বিস্কুট খায় তারপর আসে পাশের দোকান থেকে টুকটাক কিছু জিনিসপত্র কিনে একটা গ্লাসে করে চা নিয়ে যখন আসতে যাবে তখনই ওই দোকানে বসে থাকা একটা অল্প বয়সের ছেলে তার কাছে জানতে চাইলো
--- কি দাদা, নিজেতো চা খেলেন,আবার চা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন?আপনি কাল বললেন যে এই প্রথম এখানে এসেছেন?একাই তো আছেন শুনলাম; তাহলে চা টা কার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন?
মুহূর্তের মাঝে নিলয়ের মাথাটা গরম হয়ে গেল।এমনিতেই একটা উটকো ঝামেলা এসে কাঁধে পড়েছে তারপর এই মেয়েটাকে নিয়ে তাঁর চিন্তার শেষ নেই তার পিছনের লোক লেগেই আছে।লোকগুলি আবার তার কাজের কৈফিয়ত চাইছে,সে পিছন ঘুরে বলে উঠলো,
--- দাদা,এখানে কি কোন নিয়ম আছে কে ক'কাপ চা খাবে? কখন কোথায় যাবে?সব কৈফিয়ৎ চায়ের দোকানে বসে থাকা মানুষগুলোকে দিতে হবে?
--- আহা দাদা চটছেন কেন?একটু আলাপ করছিলাম আপনার সাথে। তা কিসে চাকরি করেন দাদা?বাড়িতে কে কে আছেন?
--- সব জানতে পারবেন।কটা দিন সময় দিন।আজ তো এখানে আমার দ্বিতীয় দিন,অফিসটা করে আসি, কিছু জিনিসপত্র কেনার আছে,সেগুলো কিনতে হবে ,তারপরে না হয় একদিন জমিয়ে আমার বাড়িতে বসে আড্ডা মারা যাবে। আজ আসি।
  নিলয় বুঝতে পারে মেয়েটাকে নিয়ে তারা তাকেই সন্দেহ করছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারে না এই রকম একটা অসহায় মেয়েকে কিভাবে একা একা রাস্তায় ছেড়ে দেবে? আবার এই দিনের পর দিন এইরকম একটা ইয়ং মেয়ে তার কোয়ার্টারে থাকলে কেউ যদি জানতে পারে তাহলে বদনাম ছড়াতে এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না। তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে অচলা সেই একইভাবে সোফার উপর বসে আছে। তাকে দেখে সে তার কাপড়ের আঁচল দিয়ে ভেজা চোখ দুটো মুছে নেয়।নিলয় ঘরে ঢুকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। টুকটাক জিনিসপত্রগুলি রান্নাঘরে নিয়ে রাখে।আর একটা প্যাকেট অচলার সামনে রেখে বলে,
-- আমিতো একটু পরেই অফিস যাব,ফিরতে একটু রাত হবে। এই মুহূর্তে কোন কিছু ব্যবস্থা করতে তো পারিনি।এই পাউরুটি আর ডিম সিদ্ধ রেখে গেলাম।আজকের দিনটা চালিয়ে নেবেন।আর এই এর ভিতরে সামান্য কিছু জামাকাপড় আছে ।এত সকালে জামা কাপড়ের দোকান খোলে না।আমি রাতে ফেরার সময় বাজার ঘাট করে নিয়ে আসব। হ্যাঁ, আর একটা কথা আপনি বলেছিলেন সকালে চলে যাবেন।কিন্তু কোনো অবস্থাতে এই মুহূর্তে আপনি বাইরে বেরোবেন না।কারণ দরজার বাইরে তারা ওৎ পেতে আছে। আপনাকে দেখতে পেলেই তারা কিন্তু তুলে নিয়ে যাবে। এখনও তারা চায়ের দোকানে বসে রয়েছে।
কথাগুলো বলে তার সাথে অল্প বয়সী ছেলেটির কথোপকথনটা সে অচলাকে জানায়। অচলার চোখ থেকে জল পড়তে থাকে।নিলয় তাকে বলে,
--- কান্নাকাটি করবেন না।দেখছি আমি কি করতে পারি।তবে একটা কথা আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ এসে যদি ডাকাডাকি করে আপনি কোন জানলা বা ঘরের ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ দেবেন না।আমি এসে নিজে তালা খুলে ঘরে ঢুকবো।

ক্রমশঃ
    

Tuesday, February 9, 2021

পেয়ে হারানোর ব্যথা

পেয়ে হারানোর ব্যথা

--- সিস্টার,কাল যে পেশেন্টের অপারেশন হবে সে ফাইল টা একটু আমায় দিন আর তার বাড়ির লোককে আমার সাথে দেখা করতে বলুন।
--- বাড়ির লোক বলতে উনার স্ত্রী।বয়স্কা মানুষ, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার চেম্বারে।
   সিস্টারকে কথাগুলো বলে ডক্টর অস্মিতা মুখার্জি তার নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন।যাওয়ার সময় তিনি ফাইলটা হাতে করে নিয়ে গেলেন।নিজের চেম্বারে বসে পেশেন্টের নামটা দেখে তার চোখ আটকে গেল সেখানে। একজনের সাথে নামটার ভীষণ মিল ---। যদিও মানুষটাকে সে কোনদিনও চোখেই দেখেনি। নামটা দেখেই তার মনটা কেমন উসখুশ করতে লাগলো।এবার সে ঠিকানায় চোখ বোলালো।কিন্তু যে মানুষটাকে সে কোনদিন চোখেই দেখেনি শুধু নিজের নামের পাশে সেই নামটা বহন করে চলেছে সে মানুষটার ঠিকানা তার অজানা। অন্যমনস্ক হয়ে পরলো। ফাইলটা রেখে দিয়ে চেয়ারটায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে অনেক কিছু ভাবতে লাগলো।তার এই ভাবনায় ছেদ পড়ল হঠাৎ "ভিতরে আসতে পারি?" কথাটা শুনে।
        বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রমহিলা ভিতরে এসে দাঁড়ালেন।
 ডক্টর অস্মিতা তাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন।
--- তুমি মানে আপনি আমায় ডেকেছেন?
--- আপনি অনায়াসে আমাকে তুমি করে কথা বলতে পারেন। আমি আপনার মেয়ের বয়সীই হব।
--- আচ্ছা এই বয়সে আপনি যে হাসপাতাল বাড়ি ছোটাছুটি করছেন আপনার ছেলে-মেয়ে বা বাড়ির অন্য কেউ আসছেন না কেন?
--- আমার কেউ নেই মা। আর ছেলে মেয়ের কথা বলছ?না তাও নেই।একটা ছেলে আমার হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে দু'বছর বয়সে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।তারপর আর কোন সন্তান আমাদের হয়নি।
 ডক্টর মুখার্জী ভদ্রমহিলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
--- আচ্ছা আমরা এবার কাজের কথায় আসি।কাল সকাল সাতটায় অপারেশন হবে।আপনার স্বামীর বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে অপারেশন করলে তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ফিফটি পার্সেন্ট। যথেষ্ট বয়স হয়েছে উনার। অপারেশনের ধকল কতটা নিতে পারবেন তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।আমার দিক থেকে আমি সম্পূর্ণ চেষ্টা করব।চিন্তা করবেন না।আপনি আজ বাড়ি চলে যান কাল সকালে আসবেন।
--- চিন্তা করে আর কি করবো মা!তবে একটা কথা উনি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।ঈশ্বর কপালে যা লিখেছেন তাতো হবেই।আমরা তো উপলক্ষ মাত্র।তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে।শুধু তুমি কেন আমরা সাধারন মানুষেরা ডাক্তারের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই প্রিয় মানুষগুলিকে সুস্থ করার জন্য তাদের হাতে তুলে দিই।আর ডাক্তারেরা তাদের সম্পূর্ণ টুকুন দিয়ে চেষ্টা করেন মানুষটাকে সুস্থ করে আমাদের মুখে হাসি ফোঁটাতে।
   ভদ্রমহিলা বেরিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর মুখার্জি আবার তার ফাইলটা নিয়ে বসেন।নামটা পুনরায় দেখেন।সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনেহয় 'মাকে একটা ফোন করলে হয়না?একটু ঠিকানাটা মায়ের কাছে জানতে চাইলে কেমন হতো?তাহলে অন্তত বুঝতে পারতাম এই মানুষটাকে আমি যা ভাবছি তিনি ঠিক সেই কিনা?'
  অনেক ভেবেচিন্তে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে মাকে রিংটা করেই বসে।কিন্তু রিং হয়ে যায় ফোনটা ডক্টর মুখার্জির মা ধরেন না।অস্মিতা মনেমনে ভাবেন হয়তোবা মা এখন অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।যাকগে বাড়িতে গিয়েই সব জানতে চাইবো।
 পঁচিশ বছর আগে স্কুল শিক্ষিকা কমলাদেবীর বিয়ে হয় ইঞ্জিনিয়ার সুকান্ত মুখার্জির সাথে। সুকান্তদের শিক্ষিত পরিবার হলেও পরিবারটি ছিল কুসংস্কারচ্ছন্ন।তারা সংসারে চেয়েছিলেন একটি পুত্র সন্তান।কিন্তু কমলাদেবী তাদের সে আশা পূরণ করতে পেরেছিলেন না।তিনি জন্ম দিয়েছিলেন একটি কন্যা সন্তানের।আর এই অপরাধের কারণে তাকে সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করতে হয়েছিল। সেদিনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার এই কন্যাটিকে মানুষের মত মানুষ করে তিনি শুধু তার স্বামী শ্বাশুড়ী নয় পুরো পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবেন ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে আজকের দিনে কোন পার্থক্য থাকে না যদি তাকে ঠিকভাবে মানুষ করা যায়।
সেদিনের সেই ছোট্ট শিশু কন্যাটি আজ ডক্টর অস্মিতা মুখার্জি বাবা,সুকান্ত মুখার্জি।
  অস্মিতা বাড়িতে ফিরেই মায়ের সাথে প্রতিদিনই তার নানান রোগীর নানান সমস্যার কথা নিয়ে আলোচনা করে। সে সেদিনও ফিরে চা খেতে খেতে মায়ের সাথে নানান কথা বলতে বলতে সুকান্ত মুখার্জির প্রসঙ্গ আসে। মায়ের কাছে জানতে চায় তাদের পুরনো বাড়ি ঠিকানা। মেয়ের মুখে এই প্রথম বাবার সম্পর্কে কোন কথা জানার কৌতুহল দেখে তিনি নিজেও একটু অবাক হয়ে যান। তিনি মেয়েকে বলেন যে কি কারনে তার এই ঠিকানা জানতে চাওয়া। তখন অস্মিতা বলে,
--আগামীকাল সুকান্ত মুখার্জির হার্ট অপারেশন হবে।এবং নিজেই সুকান্ত মুখার্জির ঠিকানাটা গড় গড় করে বলে যায়।
কমলাদেবী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন তারপর বলেন, ---হ্যাঁ এই সুকান্ত মুখার্জিই তোর বাবা।কারণ এটা তোর বাবার বাড়িরই ঠিকানা। কাল অপারেশনের আগে আমার সাথে তার একটু দেখা করিয়ে দিতে পারবি?আমি যে তোকে একটা ছেলের থেকেও অনেক ভালোভাবে মানুষ করতে পেরেছি তাকে সে কথাটা জানাতে চাই।আর সত্যি বলতে কি কাল অপারেশনের আগে যেতে চাইছি একটাই কারণে যদি সেই সুযোগ আমি আর না পাই।
   খুব ভোরে মেয়ের সাথে কমলাদেবী হাসপাতালে আসেন। এবং দেখা করেন তার স্বামী সুকান্ত মুখার্জির সাথে। সুকান্ত মুখার্জির প্রথম অবস্থায় কমলাদেবীকে চিনতে অসুবিধা হলেও কমলাদেবীর কিন্তু বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি ওই মানুষটাকে চিনতে।আর তিনি তো জেনেই এসেছিলেন যে উনি সুকান্ত মুখার্জি, তার স্বামী। অস্মিতা তার বাবার বেডের কাছে দাঁড়িয়ে তাকে ডেকে বলল,
--- মিস্টার মুখার্জি,দেখুন আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে?
--- হ্যাঁ খুব চেনা লাগছে, কে আপনি?
--- একটু ভালো করে দেখো তো চিনতে পারো কিনা?
সুকান্ত বাবু হাতের ইশারায় চশমাটা দিতে বললেন।অস্মিতা চশমাটা তার বাবার হাতে ধরিয়ে দিল এবং বলল,
--- আপনারা কথা বলুন আমি একটু আসছি।
 কমলাদেবী মেয়ের হাতটা চেপে ধরে বললেন,
-- না তোকে  কোথাও  যেতে হবে না, তুই এখানে দাঁড়া; তোর সামনেই আমি কথা বলব।
 এতক্ষণে সুকান্ত বাবু তার প্রাক্তন স্ত্রী কমলাদেবীকে চিনতে পেরেছেন। অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
--- তুমি এখানে?তুমি কি করে খবর পেলে?
 কমলাদেবী মুখটা একটু কঠিন করে বললেন,
--- না এখানে আসার আমার কোন ইচ্ছা ছিল না।কিন্তু একটা কথা তোমার অপারেশনের আগেই জানাতে এলাম। আমি জানি একজন অসুস্থ মানুষকে এ সময়ে বিরক্ত করা ঠিক নয়।কিন্তু তবুও এই মুহূর্তেই তোমার কথাটা জানা দরকার। একদিন মেয়ে হওয়ার অপরাধে তাকে সমেত আমাকে বাড়ি থেকে তুমি আর তোমার মা তাড়িয়ে দিয়েছিলে।আর কোন খবরই নাওনি। পরে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিলে। আমি ইচ্ছে করলে খোরপোষ দাবী করতে পারতাম।কিন্তু তোমাদের টাকা নিয়ে সেই টাকায় আমার মেয়েকে মানুষ করতে আমি চাইনি।যদিও রক্তের সম্পর্কটা অস্বীকার করতে পারি না।আর তুমি যে ওর বাবা সেটাও তো অস্বীকার করতে পারি না।তাই আজও ওর নামের পাশে বাবা হিসাবে সুকান্ত মুখার্জি নামটাই ব্যবহার করা হয়।এটা আমার কাছে লজ্জার হলেও ওর কাছে সেটা লজ্জার নয়। কাল তোমার যে অপারেশন করবে সে তোমার কে হয় জানো? ও!তা তো তুমি জানো না। আর জানবেই বা কি করে? তুমিতো তার কোন খবরই কোনদিন রাখনি।
অস্মিতার হাতটা টেনে নিয়ে সুকান্তবাবু সামনে দাঁড়িয়ে কমলাদেবী বললেন,
-- এই যে তোমার মেয়ে অস্মিতা।একজন বড় হার্ট স্পেশালিস্ট।যার জন্মের পরেই ওকে সমেত আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল।কারণ আমি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলাম।সেদিন আমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মেয়েকে আমি মানুষ করে তোমাকে দেখাবো।ঈশ্বর আমাকে সে সুযোগটা আজ করে দিলেন।
সুকান্ত বাবু অস্মিতার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরার চেষ্টা করলেন।কমলাদেবী মেয়ের হাতটা টেনে নিলেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে অস্মিতা বলল,
-- মা উনি আমার পেশেন্ট, আজ ওনার অপারেশন। আমি  উনার মানসিক বল হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বাবার হাতটা ধরি।
 সুকান্ত বাবু ঠোঁটের কোণে হাসি এনে মেয়ের হাতটা ধরে বললেন,
-- মায়ের কথাতে সায় দিতে গিয়ে  আমি তোকে অস্বীকার করেছিলাম এ কথা সত্যি।কিন্তু আজ আমি ভীষণ খুশি যে তোর মা তোকে এরকম একজন ডাক্তার তৈরি করেছেন। ঈশ্বরের কি লীলা দেখ সেই তোর হাতেই আজ আমার অপারেশন।অর্থাৎ আমার বাঁচা মরা নির্ভর করছে তোর উপরেই।
   অপারেশনের পর এক বছর সুকান্ত বাবু বেঁচে ছিলেন ততদিনে তার বর্তমান স্ত্রী জেনে গেছেন অস্মিতা তার স্বামীর ঔরসজাত সন্তান।তাই তার মৃত্যুর পর তিনি অস্মিতাকে খবর দিয়ে তার বাবার সমস্ত কাজ তার হাত দিয়েই করান। বর্তমানে তার প্রাক্তন এবং বর্তমান স্ত্রী একই বাড়িতে অস্মিতাকে সাথে নিয়েই থাকেন।
  

Monday, February 8, 2021

স্বপ্নের পথে বাঁধা

স্বপ্নের পথে বাঁধা

  মাইকের ঘোষণা শুনে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সহেলি।হলের মধ্যে তখন লোক গিজগিজ করছে।মঞ্চে ওঠার আগে পুরো হলের ভিতর একবার চোখ বুলিয়ে নিল সহেলি।হয়তো তাঁর চোখ দু'টি খুঁজছিল অন্য আর দুটি চোখ। সাহেলি জানে এটা তার আশা করা বৃথা।তবুও কি এক অমোঘ আকর্ষণে বারবার সেই চোখ দুটি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে,কিন্তু কখনোই তা বাস্তব হয়ে আজ প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো তার সামনে দেখা দেয় না। এক পা দু পা করে সহেলী এগিয়ে যেতে থাকে মঞ্চের দিকে।প্রায় ছ'বছর পর আবার সেই মঞ্চে ওঠা। হঠাৎ তার মনে হল তার পা দুটো কি একটু কাঁপছে?বুকটার ভিতরে ধুকপুক করছে?সেকি ভয় পেয়েছে?সে কি ভয় পাচ্ছে শয়ে শয়ে লোকের সামনে আবার নতুন করে গান করতে এসে?
  মাইকের সামনে সহেলী তার প্রিয় হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসে প্রথমেই গান ধরল,
অনেক আশার স্বপ্ন আমার 
আজকে বুঝি ভেঙ্গে গেল।
তোমার মুখে একটি কথাই 
জীবন আমার হারিয়ে গেল। 
অনেক আশার স্বপ্ন আমার -----
আজকে বুঝি তোমার কাছে 
নতুন কোন সাথী এলো
নতুন সাথী তোমার মাঝে 
নতুন কিছুর ছোঁয়া দিলো।
আমি দূরে হারিয়ে গেলাম,
নতুন সাথি সেথায় নীড় রচিল,
জীবনে তোর এটাই পাবি, 
মনে কি  তোর জানা ছিল?
পাওয়ার যা পেয়ে গেলি 
যাবার যে জন চলে গেল
আর কি তোর চাওয়ার আছে?
তোর প্রিয় তো সুখী হলো।
মিছামিছি কাঁদিস কেন?
যা হারাবার হারিয়ে গেল--
অনেক আশার স্বপ্ন আমার ---।
   গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকাসন হতে পরপর গানের জন্য অনুরোধ আসতে থাকে।কয়েকটা গান গেয়ে সহেলী নেমে আসে স্টেজ থেকে। গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় নিজের চোখে দেখেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারে না,
সামনে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে আর কেউ নয় যাকে সে হলের ভিতরে বারবার খুঁজেছে, যে চোখ দুটি সে বারবার দেখতে চেয়েছে আজ প্রায় ছ'বছর ধরে। তার সামনে দাঁড়িয়ে অরুনাংশ রায়চৌধুরী তার স্বামী।
  কলেজ ফেস্টে সহেলীর গান শুনে প্রেমে পড়েছিল অরুনাংশ। সহেলির তখন ফার্স্ট ইয়ার।আর অরুনাংশ ওই কলেজেরই ইতিহাসের প্রফেসার।দু'বাড়ির মতামতের ভিত্তিতে এক বছরের মধ্যেই বিয়ে।গ্রাজুয়েশনটা সহেলীর আর করা হয়ে ওঠে না।
।সহেলীর গানের গুরু ওস্তাদ অমিয় কান্তি ভাদুড়ী। ওস্তাদের সকল ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে সহেলি ছিল তার প্রিয় ছাত্রী। অমিয় কান্তি কলকাতার ভিতর যেখানে অনুষ্ঠান করতে যেতেন সহেলীকে সাথে নিয়ে যেতেন। এছাড়া সপ্তাহে দুদিন সহেলী ওস্তাদের কাছে নিয়ম করে গান শিখতে যেত। বিয়ের পর মাস ছয়েক অরুনাংশ এ ব্যাপারটি মেনে নিলেও পরবর্তীতে সে যেন সহেলীর এই নিত্য বেরোনো ভালো চোখে নিতে পারেনা। শুরু হয় অশান্তি।গান পাগল সহেলি সকল অশান্তি কে উপেক্ষা করে তার গানকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।কিন্তু অরুনাংশ দিনের পর দিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে থাকে।শুরু হয় ওস্তাদ এবং তাকে  নিয়ে নানান ধরনের কুরুচিকর মন্তব্য। অরুনাংশকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে বিফল হয় সহেলী।কিন্তু গানকে ছেড়ে সংসার তার জীবনে হবে না এটা সে ভালভাবেই বুঝে যায়।আর অরুনাংশ তাকে শর্ত দেয় হয় গান না হয় সে -- যেকোনো একটা সহেলীকে বেছে নিতে হবে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে যখন প্রায় পরাজিত তখন সে স্থির সিদ্ধান্তে আসে গানকেই সে জীবনে প্রাধান্য দেবে বেশি।
  বেরিয়ে আসে সে অরুনাংশর জীবন থেকে।অরুনাংশ তাকে কোনো বাধা দেয় না। উভয় পক্ষ  কোন ডিভোর্স এর নোটিশও কারো কাছে পাঠায় না।ফিরে আসে সে তার বাবা-মায়ের কাছে।গান এবং পড়াশোনা পুনরায় চালিয়ে যেতে থাকে। কোনরকমে গ্রাজুয়েশন শেষ করে সে। কিন্তু গানকেই সে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান করে নেয়।আজ সহেলীর নামে যেকোনো একটা স্টেজ শো অনায়াসেই হতে পারে। দর্শক আসনগুলি সহেলীর নাম শুনে ভর্তি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অরুনাংশ কাছ থেকে চলে আসার পর সহেলীর বুকের একটা দিক আজও শূন্য হয়েই পড়ে আছে। এগিয়ে আসে অরুনাংশ তার দিকে জানতে চায়,
--- কেমন আছো?আজ অনেকদিন পর তোমার গান শুনলাম।আগের থেকে আরো অনেক বেশি ভালো গাও এখন।
--- তুমি ভালো আছো?শরীরটা তো দেখছি একদম ভেঙ্গে গেছে।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো না নাকি?
--- ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করি,না খেলে বাঁচবো কি করে? কিন্তু জীবনে ভালোভাবে বাঁচতে গেলে আগে দরকার মানসিক শান্তি;যেটা আমার ভুলে বহুদিন আগেই হারিয়ে ফেলেছি।আর আমার ইগো আমাকে বিপথে চালনা করেছে।
--- ছাড় ওসব পুরনো কথা।শরীরের দিকে যত্ন নিও। একা একা থাকো দেখার কেউ নেই নিজের শরীরের যত্ন নিজেকেই নিতে হবে।
--- সবকিছু ভুলে আর একবার চেষ্টা করা যায় না?আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।যদি পারো আমায় ক্ষমা করে দিও।চলো আবার নতুন করে আমরা সবকিছু শুরু করি।
--- ভাঙ্গা কাঁচ জোড়া দিলে তার ভিতরে একটা দাগ থেকেই যায়।ভাঙ্গা সম্পর্ক গুলোও ঠিক যেন ভাঙ্গা কাঁচের মতন। যতই তাকে জোড়াতালি দিয়ে কম্প্রোমাইজ করো না কেন পূর্বের জায়গাটা আর ফিরে আসে না।প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা স্বপ্ন থাকে।সেই স্বপ্ন পূরণে যদি কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে অপরপক্ষ তাকে পূর্বের জায়গাটা কখনোই আর দিতে পারে না।ক্ষমা করতে পারে কিন্তু আগের মত ভালবাসতে আর পারে না।আমি দ্বিচারিতা করতে পারবো না।আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা গান।সেই গানকে যে অপমান করবে আমি তাকে আর যাই হোক কিছুতেই ভালোবাসতে পারবো না।তাই আমি নতুন করে আর কোন ভুলের মধ্যে পা দিতে চাইনা।সংসার সকলের দ্বারা সম্ভব হয়না।আমি মনেকরি আমার কপালে ওই কটা দিনই সংসার করা লেখা ছিল।নূতন করে সংসার নিয়ে আর ভাবতে চাই না।
 গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসলো সহেলী।ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। অরুনাংশ ভাঙ্গা মন নিয়ে গাড়িটার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মনেমনে বলল, 
--- আমি আমার ভুল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হলেও আজ আমার স্বীকার করতে একটুও দ্বিধা নেই আমার কাছে থাকলে তোমার স্বপ্ন কোনদিনও পূরণ হতো না।তাই যা হয়েছে হয়তো ভালোর জন্যই হয়েছে।এই জন্যই হয়তো মানুষ বলে থাকে "ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন"।
     

Sunday, February 7, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২৩)

সুখের ঘরে আগুন (২৩)

   নিলয় মনে মনে প্রমাদ গুনলো।এখন উপায়?সে বুঝতে পারছে মহিলা বিপদে পরেছে।মন চাইছে তাকে সাহায্য করতে ।কিন্তু একটা ইয়ং মেয়েকে সাহায্য করতে গেলে সম্ভাব্য কি কি বিপদ আসতে পারে তার একটা তালিকা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।পরিস্থিতি এখন নিলয়ের শাঁখের করাতের মতো যেতেও কাটছে আসতেও কাটবে। মহা মুশকিলে পরল এই অযাচিত বিপদ ঘাড়ে এসে পরাতে । কিন্তু সমাধানও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।জীবনে একটার পর একটা অঘটন ঘটে চলাতে নিজের প্রতি নিজের আস্তাই  হারিয়ে যাচ্ছে।আবার জীবনে নতুন কোন ফ্যাসাদ আসতে চলেছে এটা চিন্তা করে সে কিছুটা সময় চুপ করে থাকল। তারপর ভদ্রমহিলাকে আবারো অনুরোধ করলো  একটা হোটেলে তাকে থাকবার জন্য।কারণ সে কোন অবস্থাতেই  তাকে নিয়ে যেতে পারবে না বলে জানাল।কিন্তু ভদ্রমহিলা নাছোড়বান্দা।সেও নিলয়ের সাথে কোয়ার্টারে যেতে রাজি কিন্তু একা একা হোটেলের ঘরে থাকতে রাজি নয়।অবশ্য এর মধ্যে তার কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই।একাকী হোটেলের ঘরে থাকলে আবার যদি তার কোনো বিপদ হয় তাহলে তাকে উদ্ধার করার মতন সেখানে কেউ থাকবে না।কিন্তু এই ভদ্রলোক (নিলয়) যদি তাকে একটু আশ্রয় দেয় তাহলে মনেহয় সে ওই নরপশু গুলির হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে জনবহুল স্টেশন থেকে কোনদিকে সে দৌড়েছিল তা বয়স্ক লোকটি না দেখতে পেলেও তার সাগরেদরা তো এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে।কোন সময় কার নজরে পড়বে তখন আরেক বিপদ!সে নিলয়ের সামনে  হাত জোড় করে একটা রাত থাকার অনুমতি ভিক্ষা করলো।
  নিলয় যে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ।সে তার ব্যাগ দুটো নিয়ে তার কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে আর মেয়েটি তার পিছন পিছন হাঁটতে থাকে। নিলয় ভাবতে থাকে কি পরিচয় দেবে সেই মেয়েটির? কি উটকো একটা ঝামেলায় ফেঁসে গিয়ে নিলয়ের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। মিনিট দুই তিন হাঁটার পরে নিলয় তার কোয়ার্টারের সামনে এসে হাজির হলো।মেয়েটি তখন নিলয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
--- এবার আপনি চাবিটা নিয়ে আসুন,আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি।আপনি চাবিটা নিয়ে আসার পর আমি আপনার সাথে ভিতরে যাব।তাহলে তো কাউকে কোন জবাবদিহি আপনাকে করতে হবে না।আমি কাল ভোরেই এখান থেকে চলে যাব। (তারপর স্বগউক্তির মত বলল, "কিন্তু কোথায় যাব তা ঈশ্বরই জানেন"।)
  ---- আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।আমি চাবি নিয়ে ঘরের দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে আপনাকে ইশারা করলে আপনি ভিতরে ঢুকবেন।
 মেয়েটি মানে অচলা মাথা কাত করে নিলয়কে সম্মতি জানালো।আর ঈশ্বরের কাছে হাতজোড় করে আজ রাতে ভগবানের মতো এরকম একটা মানুষের সাথে দেখা হওয়ার জন্য হাজার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। নিলয় কেয়ারটেকারের কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে আসবার সময় বয়স্ক লোকটি তাকে বারবার বললেন যে সে সাথে গিয়ে ঘরের দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে তাকে সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে আসবে।কিন্তু নিলয় কিছুতেই রাজি হলো না। সে বার বার বললো
-- আপনাকে উঠে যেতে হবেনা।আমার কাছে টর্চ লাইট আছে আমি ঠিক সবকিছু ম্যানেজ করে নিতে পারবো। আপনি ঘরেই থাকুক।
নিলয়ের পাছে ভয় কেয়ারটেকার ভদ্রলোক গিয়ে যদি মেয়েটিকে দেখেন তাহলে কেলেংকারীর আর শেষ থাকবেনা। তাই যেভাবেই হোক তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নিলয় চাবি নিয়ে তার নির্দিষ্ট কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে যায়। মোবাইলের টর্চ এর সাহায্যে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালায়।কোয়ার্টার সম্পর্কে তার যে ধারণা ছিল রুমের মধ্যে ঢুকে তার সেই ধারণা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়।সে ভেবেছিল ঘরগুলি নোংরা থাকবে।কোন খাট বা চেয়ার টেবিল থাকবে না।কিন্তু ভিতরে ঢুকে তার মনে হচ্ছে এখানে যেন কিছুক্ষণ আগেও কেউ ছিল।ছোট্ট একটা তক্তপোশ,দুটো চেয়ার,একটা টি টেবিল আর দু সিটের একটা সোফা।বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।এখানে আসবার আগে বেশ কয়েকবার কেয়ারটেকারের সাথে তার কথা হয়েছিল।তাকে সে বারবার করে বলেছিল কয়েকটা দিনের থাকার মতো ব্যবস্থা করে রাখতে।খাবার সে বাইরের থেকে এনেই খাবে কিন্তু চায়ের জন্য অন্তত একটা স্টোভের ব্যবস্থা করে রাখতে। আস্তে আস্তে সবকিছু কিনে গুছিয়ে নেবে। তারপরে এই জিনিসগুলো ফেরত দিয়ে দেবে। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক তার কথা অনুযায়ী কাজগুলো ঠিকঠাক করে রেখেছেন।
  সমস্ত ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রেখে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে মেয়েটি তার ঘরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন মেয়েটিকে দেখে নিলয়ের খুব মায়া হয়।সে বুঝতে পারে কতটা অসহায় হলে একজন অপরিচিত পুরুষকে বিশ্বাস করে তার ঘরে রাত কাটাতে কোন মেয়ে রাজি হয়। সে মেয়েটিকে হাত দিয়ে ইশারা করে। মেয়েটি নিলয়ের ইশারা বুঝে সে দ্রুত এসে ঘরের ভিতরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ছিটকিনিটা দিয়ে দেয়। নিলয় মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি একবারে খাবার কিনে নিয়ে এসে হাত-পা ধোবো।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি নিজেই বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি।আপনি কি খাবেন বলুন?
 অচলা নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
-- যার একটা রাতে একটু আশ্রয়ের জন্য অন্যের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে হয় সে একটা রাত না খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে।আমার জন্য আপনার কোন খাবার আনতে হবে না।আপনি যে আজ রাতটুকু আমায় আশ্রয় দিয়েছেন তার জন্য আপনার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
  নিলয় মেয়েটির কথাগুলো শুনে বেরিয়ে গেল বাইরে। যাওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা দিয়ে তারপর গেল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে বেশ কয়েকজন লোকের জটলা দেখে একটু এগিয়ে গেল তাদের দিকে।সে দোকানে খাবার কিনছে  ঠিকই কান দুটো তার রয়েছে জটলার দিকে খাড়া।তাদের অস্পষ্ট কথোপকথনে তার মনে হলো তারা কোনো একটি মেয়ের খবর নিচ্ছে এদিকে তাকে দেখা গেছে কিনা।একটা ছবিও কয়েকজনকে দেখিয়েছে।সবই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিলয় দেখছে।তার বুঝতে অসুবিধা হয় না তার সাথে যে মেয়েটি রয়েছে তাকে খোঁজার জন্যই এই মানুষগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে খাবার কিনে একটু দ্রুত কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু জটলার ভেতর থেকে একজন মানুষ তাকে দেখে বলল,
--- দাদা ছবিটা একটু দেখবেন?মেয়েটিকে দেখেছেন কিনা এই রাস্তায়?
 নিলয় দাঁড়িয়ে পরলো।এবং গলা চড়িয়ে বলল,
-- দাদা আজকে আমার এখানে প্রথম আসা।আমি কোন রাস্তাঘাট, কোন মানুষজন কিছুই চিনি না।
--তবুও ছবিটা দেখুন যদি রাস্তাঘাটে দেখে থাকেন ।
 অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিলয় ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ; হ্যাঁ ঠিকই তো যে মেয়েটিকে সে আশ্রয় দিয়েছে তাকেই তারা খুঁজছে। তারমানে মেয়েটা যা বলেছে প্রতিটা কথায় অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
--- মেয়েটাকে আপনারা খুঁজছেন কেন?মেয়েটা কি হারিয়ে গেছে?
এতো যে জটলা হচ্ছিল আর তারা মেয়েটার ছবি দেখিয়ে খুঁজছিল কিন্তু নিলয়ের এই প্রশ্নে তারা নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাওনি করল। কিছুক্ষণ পর তাদের ভেতর থেকে একজন বলল,
-- হ্যাঁ মেয়েটি আজ দুদিন হল হারিয়ে গেছে। আমার ছোট বোন।মায়ের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়েছে। খুঁজে পাচ্ছিনা তাই বন্ধুবান্ধব নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছি।
--- আপনারা বিষয়টি পুলিশকে জানান তাহলে হয়তো তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে খুঁজে পাবেন।
  সেখানকার লোকগুলির নিলয়ের কথাবার্তায় পছন্দ করলো না।তারা নিলয়কে আর ঘাটাল না।আস্তে আস্তে সে স্থান ত্যাগ করল।আর নিলয় রুটি,তড়কা কিনে নিয়ে দ্রুত কোয়ার্টারে  ফিরে এলো। নিলয় কোয়ার্টারে ফিরে দেখল অচলা সিঙ্গেল সোফাটাতে জবুথবু হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার দরজা খোলার আওয়াজেও অচলা ঘুম থেকে জাগে না।খাবারগুলো টেবিলের উপর রেখে সে বাথরুমে গিয়ে স্নান করে ফ্রেস হয়ে এসে একটা খবরের কাগজ বিছিয়ে রুটি তড়কা রেডি করে সে অচলার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে কয়েকবার "এই যে শুনছেন?" বলে ডাকে। কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অচলা ঘুম থেকে উঠতে পারে না। নিলয় বাধ্য হয় তার গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে।তৎক্ষণাৎ অচলা নিজের গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে উঠে বসে।নিলয় তার নাম জানতে চায় --।তারপর তার সামনে খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
--- খাবারটা খেতে খেতে বলুন তো কে আপনি ?আর কেনই বা ওই লোকগুলি আপনার পিছনে পড়ে আছে?কিসের সম্পর্ক ওদের সাথে আপনার?ওরা তো আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এই পর্যন্ত ধাওয়া করেছে।এখন তো আপনার এখান থেকে বেরোনোই বিপদ!নিজে তো ধরা পড়বেনই আমিও রেহাই পাবো না।
---ওরা এই পর্যন্ত ধাওয়া করেছে মানে? আপনি কি করে বুঝলেন?
---আপনার ছবি দেখিয়ে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা।হয়তো লোকগুলো কিছু একটা ধারণা করেছে যে আপনি হয়তো এদিকে এসেছেন। আমাকেও ছবিটা দেখিয়েছে।
--- এখন উপায়?
--- উপায় আর কি?আপনি এখান থেকে বেরোলেই ওরা আপনাকে ধরবে আর আমার বদনাম হবে। তাই কটা দিন এখানেই চুপচাপ ঘরের ভিতরে থেকে যান।তারপর একটু থেমে পূনরায় বললো,
---কিন্তু আপনার তো কোন জামাকাপড় নেই।মহা সমস্যা! থাকতে গেলে কয়েকটা কাপড়চোপড় তো দরকার আছে। আমার মাথায় কিছু আসছে না।এখন খাবারটা খেয়ে শুয়ে পড়ুন।কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে চিন্তাভাবনা কোরবো।ভীষণ টায়ার্ড লাগছে আজ।আপনি এই ঘরে সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়ুন আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি। কাল শুনবো আপনার সব কথা।
 নিলয় খাবার শেষ করে মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে জল খেয়ে বাকি জলের বোতলটা অচলার সামনে রেখে আর কোন কথা না বলে পাশের ঘরে শুতে চলে যায়।আর অচলা খাবারটা সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে তার ভাগ্যের কথা ভাবতে থাকে।

ক্রমশঃ


    

Tuesday, February 2, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২২)

সুখের ঘরে আগুন (২২)

   অম্বিকা নিলয়ের কথা শুনে একটু অবাকই হয়।সাথে কিছুটা শিহরিতও হয়।নিলয় তাকে।এই মুহূর্তে কি এমন বলতে পারে? সে নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
--- আরে  যা বলবেন বলুন না ,এত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন?
 প্রথমে নিলয় কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো।তারপর নিজের মনের মধ্যে কথাগুলির সাজিয়ে নিয়ে বলল,
--- আসলে অনেকদিন ধরে ভাবছি আপনাকে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করবো।কিন্তু সাহসও পাইনা আর ঠিক সেরকম সময়ও আসে না।আজ যখন সুযোগটা পেয়ে গেলাম মনে মনে ভাবলাম চলে যাওয়ার আগে কথাটা জেনেই যাই।
  অম্বিকা তার মুখের দিকে অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে  তার কাছে জানতে চাইলো,
--- তারমানে আপনি কিছু বলবেন না, আপনি আমার কাছে কিছু কথা জানতে চাইবেন কি তাইতো?
 কথাটা বলেই অম্বিকা হেসে দিল।আর নিলয় মুখে একটু হাসির আভাস এনে বললো,
--- ব্যাপারটা ঠিক তা নয় --- কিছু তো বলবোই আর কিছু কথা জানতে চাইবো।
---- কিন্তু আমাদের গন্তব্যের আর বেশি বাকি নেই সুতরাং যা বলার ঝটপট বলে ফেলুন।
--- আচ্ছা আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
--- মানে?
--- না মানে বলছিলাম আমরা তো এক পাড়াতেই থাকি, আমরা কি দুজন দুজনের সম্পর্কে সম্পূর্ণটা জানি?
--- যতটুকু জানলে এই একজন মানুষকে বন্ধু ভাবা যায় ঠিক ততোটুকুই জানি। আপনি শিক্ষিত, মার্জিত,পরোপকারী, সুচাকুরে সর্বোপরি একজন ভালো মনের মানুষ।
--- ব্যাস এটুকুই?
--- বাকিটা আপনার ব্যক্তিগত জীবন।আর আপনার ব্যক্তিগত জীবনে আমার প্রবেশের কোন অধিকার নেই।
--- না মানে বলছিলাম কি আমার যে বিয়ে হয়েছিল আপনি সেটা জানেন?
--- জানি,বিয়েতে আমাদের নেমন্তন্ন ছিল।বাবা মা গেছিলেন। কিন্তু আমি পরীক্ষা সামনে থাকায় যেতে পারিনি।
---  আর তার পরের ঘটনা কিছু?
--- অন্যের জীবনের ঘটনা সবকিছু আরেকজনকে জানতেই হবে তার তো কোনো মানে নেই।
--- আমি মনে করি যে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে হয় দুটো মানুষ না হয় দুটো পরিবারের মধ্যে;সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে গেলে দুই পক্ষের উভয়ের মধ্যে কোন লুকোচুপি থাকা উচিত নয়।
--- আমরা যখন এক পাড়াতেই থাকি তখন অল্প হলেও কিছুটা জানি বৈকি !
 উবের চালক হঠাৎ গাড়িটা থামিয়ে দেওয়ায় নিলয় বলে উঠলো,
---কি হল দাদা?
---- নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গেছি তো।
 কথা বলতে বলতে কখন যে তারা বড় রাস্তার মোড়ে এসে গেছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি।গাড়ির জালনা দিয়ে দেখে নিয়ে দুজনেই নেমে গেল।নিলয় আজও কিছুতেই অম্বিকাকে কোন টাকা দিতে দিল না।সে নিজেই পেমেন্টটা দিয়ে দিল।কিছুটা রাস্তা হেঁটে এসে প্রথমেই অম্বিকাদের  বাড়ি আরও কিছুটা হেঁটে নিলয়দের । কথা মাঝখানে শেষ হয়ে যাওয়াতে নতুন করে নিলয় আর কোন প্রসঙ্গ তুললো না।শুধু অম্বিকাকে বলল,
-- অনেক কিছু বলার ছিল কাইন্ডলি যদি ফোন নাম্বারটা দেন।
 অম্বিকা ব্যাগ থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে তাতে নিজের ফোন নাম্বারটা লিখে নিলয়ের হাতে দিল।
--- thanks, কখন ফোন করা যাবে?
--- রাত দশটার পরে করলে ফ্রী মাইন্ডে কথা বলতে পারবো।আপনি রওনা হচ্ছেন কবে?
--- আগামীকাল সকালেই। যদি কিছু মনে না করেন তবে মাঝে মাঝে যদি আমার বাবা-মায়ের সাথে গিয়ে একটু গল্প করে আসেন;তাহলে কিন্তু উনাদেরও খুব ভালো লাগবে। আসলে আমি চলে যাওয়ার পরে উনারা খুব একা হয়ে পড়বেন।এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে আমি বাইরে যাচ্ছি।তাই ভীষন চিন্তা হচ্ছে উনাদের জন্য।
--- এত ভাববেন না।একটু বিশ্বাস রাখুন না আমার উপর। আমি কথা দিচ্ছি আমি ওনাদের খেয়াল রাখব।এবার তবে আসি,সাবধানে যাবেন,ভালো থাকবেন।
  ট্রেনের কামরার ভেতর নানান কথা ভাবতে ভাবতে কোন এক সময় তার চোখ দুটি লেগে এসেছিল। ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে গেল একজন পুরুষের কর্কশ গলার আওয়াজে। তিনি চিৎকার করে তার সাথে থাকা ভদ্রমহিলাকে বলছেন,
--- ওদিকে উঁকি মেরে তুমি কি দেখছো?এখানে এসে আমার পাশে বসো। চেনা অচেনা পুরুষ মানুষ দেখলেই তার দিকে হা করে কি যে তুমি দেখো তাই ঈশ্বরই জানেন।
  নিজের স্ত্রীর সাথে পাবলিক প্লেসে মানুষ এই ভাবে কথা বলতে পারে তা নিলয় বোধ করি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি। ইচ্ছাকৃত সে চোখ বন্ধ করে থাকলো।সে মনেমনে ভাবল এই সময়ে চোখ খুললে আর ওই ভদ্রমহিলার দিকে চোখাচোখি হয়ে গেলে তখন লোকটি হয়ত আরো কিছু অফেন্সিভ কথা তার স্ত্রীকে শোনাবে।তাই সে চোখ বন্ধ করেই পরে থাকলো। ট্রেন তখন ভুবনেশ্বর স্টেশনের কাছাকাছি।গতি খুবই ধীর লয়ে। নিলয় তার দুটো লাগেজ নিয়ে দরজার কাছে যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন পিছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা মেরে চলন্ত ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে লাফিয়ে পড়লেন।নিলয় তাকিয়ে দেখলো ট্রেনের সেই ভদ্রমহিলা। পিছনের ভদ্রলোক হই হই করে উঠলেন। তিনি তার বিশাল মোটা ভারী শরীরটা নিয়ে নিলয়কে এক ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে নেমে তার স্ত্রীর খোঁজে সামনের দিকে দৌড় দিলেন।সাথে অবশ্য লাগেজটা নিতে ভুললেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় নিলয় কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল।ওই এসি কামরায় নিলয় আর ঐ ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা ছিলেন।আর কেউ ছিলনা।কিন্তু চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে ভদ্রমহিলা যে মুহূর্তের মাঝে কোথায় দৌড়ে পালিয়ে গেলেন এবং কেন গেলেন সেটা নিলয় সেই মুহূর্তে বুঝতে না পারলেও পরে সে সবকিছু জেনে গেছিল।
  নিলয় প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে অটোর দিকে এগিয়ে যায়। অটো করে তাকে তার কোয়াটারে যেতে হবে।সে একটা অটোর ভিতরে গিয়ে বসে।কিন্তু হঠাৎ করেই পাশে নজর  যেতে সে ভুত দেখার মত চমকে ওঠে।ট্রেনের ভিতরের সেই ভদ্রমহিলা! মুখে কাপড় জড়িয়ে মুখ ঢেকে অটোর ভিতরে বসে।নিলয় অটোতে উঠেও নেমে পড়ে। ভদ্রমহিলা তখন অটোতে বসে নিলয়ের দিকে ফিরে হাতজোড় করে বলে,
--- দয়া করে আপনি আমাকে বাঁচান।আপনি যেখানে যাচ্ছেন আপাতত আমাকে সাথে নিয়ে যান।কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আপনার সাথে আমি আপনার বাড়িতে আমি  যাবো না।কিন্তু কিছুক্ষণ সময় আমাকে আপনার সাথে থাকতে দেন।আমি সবকিছু আপনাকে সময় মতো বলবো।এই মুহূর্তে আমার বাঁচার এটাই একমাত্র রাস্তা।ওরা আমাকে ধরতে পারলে শিয়াল কুকুরের মতন ছিঁড়ে খাবে।তাই আপনার কাছে অনুরোধ,আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন;অন্তত কিছুক্ষণ সময়ের জন্য।
 নিলয় চুপচাপ অটোতে উঠে বসলো।ড্রাইভার পাশের একটি গুমটিতে চা খাচ্ছিল।সে আরো দুজন প্যাসেঞ্জারের জন্য ওয়েট করতে লাগলো।কিন্তু নিলয় বুঝেছিল এই ভদ্রমহিলার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।তাই সে ড্রাইভারকে অনুরোধ করলো সে গাড়িটা রিজার্ভ করে যেতে চায় সুতরাং গাড়িটা ছেড়ে দিতে। ভদ্রমহিলা চাপাস্বরে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "থ্যাংকস।"
  প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট পর অটো এসে থামল নিলয়ের কোয়াটারের সামনে।নিলয় অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিলো। অটো টা চলে যেতে সে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
--- এবার আপনি কি করবেন?কোথায় যাবেন?আর আপনার এমন কি সমস্যা হয়েছে যে নিজের স্বামীর সাথে বেরিয়ে আপনি চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন?
--- আপনাকে তো আমি বলিনি উনি আমার স্বামী,তবে আপনি বুঝলেন কী করে যে উনিই আমার স্বামী?
--- তাহলে উনি আপনার কে হন? অবশ্য এই প্রশ্নগুলো করার আমার কোন অধিকার নেই। আমার কাজ শেষ।আপনি এখন নিশ্চিন্ত মনে যেখানে খুশি যেতে পারেন।
 ভদ্রমহিলা তখন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- আর একটা অনুরোধ রাখবেন?আজকের রাতটা আমাকে একটু জায়গা দেবেন?সকাল হলেই আমি চলে যাব।
--- দেখুন এই জায়গায় আমি আজ নতুন।কিছুই চিনি না এখানকার আমি।এই প্রথম আসা আমার,এখানে চাকরির সূত্রেএকটি কোয়াটার পেয়েছি।চাবি এখনো হাতে পাইনি। এখন কেয়ারটেকারের সাথে দেখা করে চাবি নিয়ে আমাকে সেই ঘরে ঢুকতে হবে।এই পরিস্থিতিতে একজন অচেনা অজানা নারীকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।আপনি যদি চান আপনাকে আমি একটা হোটেল বুক করে দিতে পারি। সেখানে আমি পেমেন্ট দিয়ে আসবো আপনার থাকা-খাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না।যদি রাজি হন তো বলুন,আমি কাজটা করে তারপরে যায়।
ভদ্রমহিলা মনে মনে কি ভাবলেন তিনিই জানেন।তিনি নিলয় কে অনুরোধ করলেন; না কোন হোটেল নয় আপনি আমাকে শুধু রাত্রিটুকু মাথা গোঁজার জন্য একটু আশ্রয় দেন।আমি  আপনার কাছে আর কোন কিছু দাবি করবো না। আপনাকে আমি চিনি না জানি না কিন্তু শয়তান নরপশু গুলো থেকে আপনি যে ভাল মানুষ তা আমি বুঝতে পেরেছি ট্রেনের মধ্যেই।
---ট্রেনের মধ্যে তো আপনার সাথে আমার কোন কথা হয়নি।আমি তো চোখ বুঝেই ছিলাম। তাহলে আপনি কি করে বুঝলেন ?
---বুঝতে পেরেছি।আসলে আপনারা পুরুষেরা  অনেক কিছুই বুঝতে পারেন না।আমরা মেয়েরা কিন্তু মানুষ চেনার ব্যাপারে একটু বেশি অ্যাডভান্স।অপরিণত বয়সে মেয়েরা যে ভুলগুলি করে সেগুলোর কিন্তু আর পুনরাবৃত্তি হয়না।বয়সবৃদ্ধির সাথে সাথেই আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি,বুঝতে পারি।আমাদের মেয়েদের ঠিক মা দুর্গার মত একটা তৃতীয় নয়ন আছে আর সেই নয়নই আমাদের সবকিছু বুঝতে সাহায্য করে।বলতে পারেন ওই তৃতীয় নয়নটাই আর একটা মনের কাজ করেন।

ক্রমশঃ