সুখের ঘরে আগুন (২৭)
প্রায় দুটো দিন পরে নিলয় আজ পেট ভরে ভাত,ডাল,তরকারি খেয়ে অফিস গেলো।খেতেখেতে নিলয় ভাবছিল অচলার হাতের রান্না হাত বেশ চমৎকার। বেশ কয়েকদিন পর অচলার হাতের রান্না খেয়ে তার মনে হলো যেন বাড়ির রান্নাই খাচ্ছে। আজও অফিস বেরোনোর সময় নিলয় অচলাকে বলে গেল সেই একই কথা, কোন অবস্থাতেই সে যেন কেউ ডাকলে দরজা খুলে বাইরে না আসে।সে বাইরে থেকেই তালা দিয়ে যাবে।আজও আসতে নিলয়ের দেরি হবে।সংসারের আরো কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে।তাছাড়া সবার আগে দরকার অচলার জন্য একটা তক্তপোষ আর বালিশ,বিছানা,চাদর।
অফিসে গিয়ে নিলয় অনেকবার ভাবে নিখিলেশের সাথে অচলাকে নিয়ে আলোচনা করবে কিনা।নতুন পরিচয় কি ভাবতে কি ভেবে বসবে এইসব চিন্তা মাথায় ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে নিরুপায় হয়েই অন্তত একজনের সাথে কিছুটা পরামর্শ করা দরকার মনে করে সে নিখিলেশকে তার কেনাকাটার ব্যাপারে সাহায্য করতে বলে আজ। নিখিলেশ সানন্দে রাজি হয়ে যায়। অফিস ছুটির পর দুজনে বেরিয়ে প্রথমে একটু টিফিন করে। নিলয় একটা প্যাটিস কিনে তার ব্যাগে রাখতে গেলে নিখিলেশ হাসতে হাসতে বলে,
-- কি ভাই, রাতে কি প্যাটিস খেয়েই শুয়ে পড়বে নাকি?
নিলয় কিছুটা হলেও একটা সুযোগ পেয়ে যায়।বলে,
--- তোমার সাথে একটা কথা বলার আছে ভাই।আমি জানিনা অবশ্য তুমি কিভাবে আমার এই কথাটা নেবে।কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি ছাড়া এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি অন্য কারো সাথে আলোচনা করতে ঠিক সাহস পাচ্ছিনা।এমনকি আমার আত্মীয়-স্বজন কিংবা আমার বাবা মায়ের সাথেও না।
--- কি এমন কথা বল। তোমাকে সাহায্য করা আমার পক্ষে যতটা সম্ভব হয় নিশ্চয়ই কোরবো।
--- জিনিসপত্রগুলো কেনার পর তোমাকে নিয়ে বাড়িতে যাব মানে আমার কোয়ার্টারে যাব।সেখানে বসেই চা খেতে খেতে কথা গুলো বলা যাবে কি বল?
--- তোমার যা মনের ইচ্ছা তাই হবে।
একটা তক্তপোষ,বালিশ,বিছানা ছাড়াও বেশকিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে নিলয়, নিখিলেশকে সাথে নিয়ে কোয়ার্টারের দরজা খুলে যখন প্রবেশ করল তার আগেই তক্তপোষ ও বালিশ বিছানা যে ভ্যানটাই করে এনেছিল তাকে নিলয় ছেড়ে দিয়েছে।সুতরাং দরজা খুলে হাতের জিনিসপত্রগুলি ঘরের ভিতরে রেখে সে পুনরায় বেরিয়ে গেল তক্তপোষ ও বাকি জিনিসগুলি ভিতরে আনবার জন্য। যাওয়ার আগে অচলাকে বলে গেল ভিতরের ঘরটাতে চলে যাওয়ার জন্য। যখন সে ডাকবে তখনই যেন সে বাইরে আসে এর আগে নয়।
অচলা, নিলয় যে ঘরটাতে থাকে সেই ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজাটা ভিজিয়ে দিলো। নিলয় আর নিখিলেশ দুজনে মিলে ছোট তক্তপোষটা ধরাধরি করে ভিতরে নিয়ে আসলো। ঘরের ভিতরে তক্তপোষটা রেখে তার উপরেই দুজনে বসে হাঁফাতে লাগলো।অচলা দরজাটা সামান্য ফাঁক করে দেখে তার দাদার সাথে আরো একজন ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেছেন। সে কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে গেল।কিন্তু তাকে যেহেতু নিলয় বলেছে, "আমি না ডাকলে তুমি বেরোবে না"- তাই সে সেখানে চুপ করেই বসে থাকল আর অপেক্ষা করতে থাকলো কখন তার দাদা ডাকবে আর সে গিয়ে তার দাদাকে চা করে দেবে।আজকে নিলয় অফিস যাওয়ার সময় অচলা তাকে জানিয়ে দিয়েছিল সে যেন কোন খাবার কিনে নিয়ে না আসে।সে নিজেই রাতের খাবার তৈরি করে নেবে। তাই সন্ধ্যা বেলাতেই অচলা ডিনারটা রেডি করে রেখেছিল।আর যেহেতু নিলয়ের ফিরতে দেরী হবে বলেছিল তাই সে কোনো টিফিনও করেনি।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর নিলয় নিখিলেশকে বলে,
---যে কথাগুলো তোমায় বলব বলেছিলাম সে কথাগুলো বলার আগে তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।তারপর আমি আমার কথা শুরু করবো।বলেই সে তার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে অচলাকে ডাক দিলো,
-- বোন একটু এদিকে আয় তো।
এভাবে নিলয় ইচ্ছাকৃতই অচলাকে ডাকলো তার কারণ ডাকের মধ্য দিয়ে নিলয় নিখিলেশকে বোঝাতে চেয়েছিল তার ও অচলার সম্পর্কটা কি। অচলা এসে সামনে দাঁড়ায়। তখন নিলয় তাকে বলে,
--- আমাদের জন্য দু'কাপ চা করে নিয়ে আয়।
আর ব্যাগ থেকে প্যাটিসটা বের করে অচলার হাতে দিয়ে বলে,
-- আমরা টিফিন করে এসেছি।এটা তোর জন্য।খেয়ে নিস, সেই দুপুরবেলা খেয়েছিস, এখন তো নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে।ডিনার করতে তো একটু দেরি হবে।
অচলা যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে নিলয় পুনরায় বলে,
--আর শোন, আমার বন্ধু নিখিলেশ দত্ত।আমরা দুজনে একই অফিসে চাকরি করি।
অচলা হাত জোড় করে নিখিলেশকে নমস্কার করে। নিখিলেশ ও প্রত্যুত্তরে তার হাত দুটি জোড় করে অচলাকে প্রতি নমস্কার জানায়।কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিখিলেশ অচলার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেয়েটির মধ্যে একটা সারল্যতা রয়েছে।
অচলা চা করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে যায়।তখন নিলয় শুরু করে অচলার সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে সমস্ত ঘটনা। কিন্তু কথার মাঝখানেই অচলা চা আর কিছুটা শুকনো চিড়ে তেল দিয়ে ভেজে নিয়ে ঘরে ঢোকে।ওদের কথা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়।তখন নিলয় তাকে বলে,
--- তুই এক কাজ কর ওই ঘরে গিয়ে বোস।আমি আমার বন্ধুর সাথে একটু গল্প করি।পরে তোকেও ডেকে নেবো গল্প করার জন্য।
অচলা মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অচলার সাথে দেখা হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটনা ঘটেছে সবই নিলয় নিখিলেশকে বলে।তারপর নিখিলেশের কাছে জানতে চায় এখন সে কি করবে?যদিও সে ভেবেছে অচলাকে তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু তার একার পক্ষে এটা কিছুতেই যে সম্ভব নয় তাও সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।তার সাথে অচলা রাস্তায় বেরোলেই যেভাবে গ্যাংয়ের লোকেরা ওৎ পেতে রয়েছে তারা ধরে ফেলতে পারে।তাই এই ব্যাপারে নিখিলেশের কাছে সে সাহায্য চায়।
নিখিলেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর নিলয়কে বলল,
--- তাহলে ওকে তোমার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল হবে বলে আমারও মনেহয়।এ ব্যাপারে আমি তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।তবে একটা কথা আমার মাথায় আসছে তুমি যেদিন ওকে নিয়ে কলকাতা যাবে সেদিন শেষ ট্রেনটা ধরে যেতে হবে।প্রথমে আমি ওকে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠবো।তারপর তুমি এখান থেকে বেরোবে।আর যেটা করতে হবে তোমার বোনকে বাড়ি থেকে বের করতে হবে ছদ্মবেশে
। ছদ্মবেশে বের করলে আর আমি যেহেতু অপরিচিত একটি মানুষ খুব একটা কেউ বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না।তবে হ্যাঁ আজ এখানে এলাম যদি কেউ আমাকে দেখে ফেলে তাহলে একটু সমস্যা।তবে এখন তো কোয়ার্টারে প্রচুর ফ্যামিলি রয়েছে।লোকজন যাতায়াত করছে।খুব বিশেষ একটা অসুবিধা হবে বলে আমার মনে হয় না।তুমি আমাকে জানিও কবে কলকাতা যেতে চাও তোমার বোনকে নিয়ে। আমার যেটুকু ক্ষমতা আমি তা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। একজন মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা এটা।মানসম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে।সুতরাং তুমি একটুও চিন্তা কোরোনা,আমি তোমার সাথে আছি,কোন অসুবিধা হবে না।এতদিন তুমি একাই উনার সমস্যাটা মোকাবেলা করে চলছিলে আর আজ থেকে আমিও তোমার পাশে থাকলাম দুজন মিলে উনাকে রক্ষা করতে পারবো।
নিলয় নিখিলেশের হাত দুটি ধরে বলল,
---বন্ধু তো একেই বলে, মাত্র কয়েকটা দিন তোমার সাথে আমার আলাপ।কিন্তু আমি মানুষ চিনতে একটুও ভুল করিনি।আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই ব্যাপারে আমি তোমার কাছ থেকে সর্বতোভাবে সাহায্য পাবো।আমি সারাজীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম।
নিখিলেশ হো হো করে হেসে বলল,
--- এসব কি বলছ তুমি?আমি তো তোমার বন্ধু,আর বন্ধুর বিপদে বন্ধুই পাশে দাঁড়ায়।
চায়ের সাথে চিড়ে ভাজা গুলো খেতে খেতে নিখিলেশ বলে,
--- চিড়ে ভাজাটা বেশ ভালো হয়েছে কিন্তু খেতে। ছোট ছোট পেঁয়াজ কুচি,লঙ্কা আর সরষের তেল দিয়ে মাখাতে মনেহচ্ছে যেন দোকানের চিড়ে ভাজা খাচ্ছি।
--- ভদ্রঘরের মেয়ে।সুযোগের অভাবে লেখাপড়া বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।তবে ভীষণ বুদ্ধিমতি,সমস্ত রকম সাংসারিক কাজকর্মেও পারদর্শী।ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাকে সত্যিই এবার ভাবতে হবে।মাত্র এই দু তিন দিনেই ওর প্রতি আমার একটা মায়া পড়ে গেছে।দাদা বলে ডাকে,তাই দাদার মতই আমি ওর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই।তবে এখানে থেকে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।ওকে কলকাতাতেই আমার বাবা-মায়ের কাছে পাঠানোর পর আমি ওকে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাস করাবো।তারপরও যদি পড়তে চায় ওকে আমি পড়াবো। মোটকথা আমি ওকে ওর ভবিষ্যৎ টা গড়ে দেবো।
--- আমিও তোমার সাথে আছি।যেকোনো সময় যেকোনো রকম হেল্প এর দরকার হলে আমাকে জানিও সব সময় আমায় পাশে পাবে।
সেদিন রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত নিখিলেশ আর নিলয় বসে গল্প করতে থাকে।মাঝখানে একবার অচলাকে ডেকে নিলয় বলে,
--- তুই এক কাজ কর বোন, আর কটা ভাত রান্না করে নে, যা তরকারি রান্না করেছিস আমরা তিনজনে মিলে একসাথেই খেয়ে নেবো।
নিখিলেশ প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,
--- আরে না, না, আমি বাড়িতে গিয়েই খাবো।আমার ফ্রিজে রান্না করা রয়েছে।যাবো একটু গরম করবো ব্যাস্।
--- থাকো তো ভাই একাই।তাই এখানেই আমাদের ভাই বোনের সাথে চারটি খেয়ে নাও না।তোমার খেতেও ভালো লাগবে আর আমাদেরও ভালো লাগবে তুমি খেয়ে গেলে।আর আমার বোনের হাতের রান্না খেলে এ বাড়ির আশেপাশে তোমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে।খুব সুন্দর রান্না করে অচলা। একথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে অচলা রান্নাঘরের দিকে দৌড় দেয়। আর নিলয় নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে ওঠে।
সেদিন নিখিলেশ অচলার হাতের রান্না খেয়ে ভুয়সী প্রশংসা করে।আর এই প্রশংসা চলাকালীন দুএকবার তার অচলার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। প্রতিবারই অচলা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।কিন্তু প্রতিবারই তার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে লাগে।যা তার এই বাইশ বছর জীবনে কোনদিনও কারো চোখের দিকে তাকিয়েই হয়নি।
ক্রমশঃ