মেয়ের চোখের দৃষ্টি দেখে মায়ের বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না সে কী জানতে চায়।তিনি অত্যন্ত ধীর এবং শান্ত ভাবে মেয়েকে বললেন,
--- আমরাও একসময় তোদের বয়সী ছিলাম। আমাদেরও তোদের মত একটা উচ্ছল একটা জীবন ছিল। আমরাও তোদের মতোই স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু জীবনের শুরুতে দেখা সব স্বপ্ন কী আর পূরণ হয় সবার? আমার বাবা ছিলেন সামান্য চাকুরে।আমরা চার বোন ছিলাম। ওই অভাবের মধ্যেও বাবা চেষ্টা করতেন সকলকে লেখাপড়া শেখাতে।
এইটুকু বলেই ইলা চুপ করে গেলেন।মেয়েকে বললেন হাসতে হাসতে,
--- থাক আর মায়ের প্রেমের গল্প শুনতে হবে না। যা জামাকাপড় ছেড়ে আয় আমি চা করি এখন।
শ্রাবণী মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
--- বলো না মা শুনতে খুব ভালো লাগছে। কোনদিন তো বলোনি এসব কথা?
-- দরকার পড়েনি তাই বলিনি। আর এসব কথা কেউ বলে তার সন্তানকে?আজ মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো।
বলেই হাসতে হাসতে হঠাৎই গম্ভীর হয়ে বললেন,
--- ছেলেটা চাকরি পাক আগে প্রয়োজন পড়লে এই ব্যাপারে তোর বাবার অমতে গিয়ে লুকিয়ে তোর বিয়ে দেবো।
শ্রাবণী মাকে জড়িয়ে ধরে মুখের সাথে চেপে ধরে বড় শব্দ করেএকটা চুমু দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
ইলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দেন। চা করতে করতে কিছুটা সময় অতীতে পারি জমান। একবার রথের মেলায় দীপায়নের সাথে ঘুরতে গিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে। রথে বন্ধুদের সাথে গিয়ে পূর্ব কথামত বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে দীপায়নের সাথে ঘুরতে গিয়ে দীপায়ন চা খেতে চায়। দু'জনে যখন মেলার এককোণে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে ঠিক তখনই তারা দেখতে পায় ইলার পাড়ার এক বৌদি আর তার ছোট্ট ছেলেটি সেদিকেই এগিয়ে আসছে। দু'জনেই চায়ের ভার সেখানেই ফেলে দিয়ে যে যার মত সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। এই নিয়ে পরে অনেক হাসাহাসি হয়েছিল ওদের মধ্যে। আজও মনে পড়াতে নিজের মনেই হেসে ওঠেন ইলা। আর ঠিক এই সময়েই মেয়ে এসে মায়ের হাসি দেখে মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে অদূরে গলায় বলে,
--- ওমা, একা একাই হাসছো? পুরনো কথা কিছু নিশ্চয় মনে পড়ছে! বলো না তোমার সেই কিশোরীবেলার কথা।
-- প্রচণ্ড দুষ্টু হয়েছিস বনি।
কথাটা বলেই মাথায় একটা মৃদু চর মারেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই নিলয়ের সাথে শ্রাবণীর দেখা হয় বলতে গেলে পরীক্ষার আগে তারা একবার দেখা করে। শ্রাবণী মায়ের কাছে জানিয়েই বেরোয় নিলয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে বলে। বাবাকে বলে স্যারের কাছ থেকে শেষ মুহূর্তের সাজেশন আনতে যাচ্ছে।সেদিন তারা দেখা করে নিলয়েরই বন্ধু দীপ্তর বাড়ি। দীপ্তর বাবা,মা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। এটা দীপ্তর মুখ থেকে শোনার পরেই নিলয় শ্রাবণীকে বন্ধুর বাড়িতে ডেকে নেয়। তিনজনে বসে কিছুক্ষণ গল্প করার পর কাজ আছে বলে দীপ্ত বেরিয়ে যায়।
বন্ধুর বাড়িতে নিলয় আর শ্রাবণী পাশাপাশি একই খাটে বসে গল্প করতে করতে নিলয় বলে ওঠে,
--- যেটা ডিউ আছে আজ দিয়ে দে নারে -
--- তুই না খুব অ স ভ্য।
--- এটা তুই ভুল বললি। সত্যিই আমি যদি অ স ভ্য হতাম তোর কাছে চাইতাম না তোকে নিজেই দিয়ে দিতাম।
--- তুই খুব বাজে -
--- এত কথার কী আছে।তুই না দিলে কিন্তু আমিই এবার দিয়ে দেবো।
কথাটা বলেই দুইহাতে শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কিস করে নিলয়। শ্রাবণী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিলয়ের কাছে সমর্পণ করে। শ্রাবণীর গলা,নাক,চোখ,মুখ চুমুতে চুমুতে আদরে ভরিয়ে দেয় নিলয়। ব্যাপারটা অনেক গভীরে চলে যাচ্ছে দেখে নিলয় নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে,
-- কিছু বাকি থাক সেই স্বপ্নের রাতের জন্য।
-- তোর সাথে কবে আর দেখা হবে জানি না। ফোনে কথা বলতে খুব ভয় করে যদি বাবা শুনে ফেলেন।তুই মেসেজ করিস আমাকে। আমি সুযোগ পেলে তোকে ফোন করবো।
শেষ পরীক্ষার দিনে শ্রাবণীর ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে ইলা চিন্তায় ঘরবার করতে থাকেন। সাত্যকি বেশ কয়েকবার জানতে চান মেয়ে ফিরেছে কিনা। দু'জনের কেউই কিছুতেই বুঝতে পারছেন না শ্রাবণীর ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন? মোবাইল নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে বাইরে বইয়ের ব্যাগে রেখে যেতে হয় বলে শ্রাবণী পরীক্ষার সময় মোবাইল নিয়ে বেরোয় না। এদিকে মেয়ের এই দেরি দেখে "মাছ না পেয়ে ছিপে কামড়" এর মত সম্পূর্ণ দোষ স্ত্রীর উপরে চাপিয়ে চিৎকার,চেঁচামেচি করে চলেছেন সাত্যকি। কিন্তু ইলার এসবে এখন আর কিছুই যায় আসে না। তিনি স্বামীকে গিয়ে বললেন,
--- ও ইচ্ছা করে দেরি করছে না। ওর নিশ্চয় কোন বিপদ হয়েছে। তুমি এখুনি থানায় চলো।এরপর অনেক দেরি হয়ে যাবে।
স্ত্রীর কথা শুনে প্রথম অবস্থায় একটু দমে গেলেও পরে তিনি চিৎকার করে বলেন,
--- ওই ছেলেটার বাড়ি কোথায় জানো?
--- আরে ওই ছেলেটা ওর কোন ক্ষতি করবে না।
--- তুমি যেন সব জেনে বসে আছো?
--- নাহ্ তোমার সাথে তর্ক করে আমার বৃথা সময় নষ্ট হচ্ছে। আমি চললাম থানায়।
হন্তদন্ত হয়ে ইলা বেরিয়ে যাচ্ছেন দেখে সাত্যকি বলেন,
--- দাঁড়াও আমিও আসছি।
--- কোন দরকার নেই তুমি থাকো তোমার মত। তুমি আমার সাথে না আসলেও আমি আমার মেয়ের খোঁজ করতে পারবো।
গেট থেকে বেরিয়েই দেখেন বিদ্ধস্ত শ্রাবণীকে রিক্সা থেকে নামাচ্ছে হাসপাতালে দেখা সেই ছেলেটি অর্থাৎ নিলয়। শ্রাবণী নেমেই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। আর নিলয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠে নিলয়ের গালে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেন সাত্যকি।
--- স্কাউন্দ্রেল! আমি ঠিক বুঝেছিলাম তুইই আমার মেয়ের সাথে আছিস। আমি তোকে পুলিশে দেবো। কিছুতেই ছাড়বো না তোকে আমি। সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় আমি তোকে দেখেছিলাম আমার মেয়ের সাথে তুই ইশারায় কথা বলছিস। সেদিনই বুঝেছিলাম তুই ওর সর্বনাশ করবি। তোকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।
চিৎকার করছেন আর কিল,চর মেরেই চলেছেন। মা,মেয়ে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক মুহূর্ত।পরমুহুর্তে সম্বিৎ ফিরতেই দু'জনে মিলেই এই উন্মাদ মানুষটির হাত থেকে নিলয়কে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। নিলয় কিন্তু ইচ্ছা করলেই তার নিত্য এক্সারসাইজ করা পেটানো শরীরের সাহায্যে অনায়াসেই ভদ্রলোকের একটি হাত ধরেই কাবু করতে পারতো। কিন্তু শুধুমাত্র শ্রাবণীকে ভালোবাসে বলেই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে।
শ্রাবণী এই প্রথম বাবার সামনে জোরে বলে উঠলো,
--- তুমি ভুল করছো বাবা! আমাকে ওই বাঁচিয়েছে কিছু ছেলের হাত থেকে।
সাত্যকি মেয়ের মুখে ঠাস করে এক চর মারেন সঙ্গে সঙ্গে। দ্বিতীয় থাপ্পড়টা মারার আগেই নিলয় শ্রাবণীর বাবার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। আশেপাশের কিছু লোকজন জড়ো হয়ে যায় সেখানে। তাদের সকলের অনুরোধে সাত্যকি রণে ভঙ্গ দিয়ে বউ,মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও শুরু হয় তাদের উপর মানসিক অত্যাচার। তিনি পরদিন সকালেই নিলয়ের বিরুদ্ধে এফ আই আর করেন। মেয়ের ফোন থেকে নিলয়ের ফোন নম্বর জোগাড় করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
তারপরেই থানা থেকে ফোন করে ডেকে নিয়ে নিলয়কে অ্যারেস্ট করান। মেয়ের বাড়ি থেকে বেরোনো পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। এইসব ঝামেলা ঝক্কি সইতে না পেরে পরদিন ইলার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যায়। শ্রাবণী অনেক কান্নাকাটি করেও মাকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে পারে না। বাড়ির কাছের একজন ডাক্তারকে সাত্যকি ডেকে আনেন। ডাক্তার দেখে জানান অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক এই মুহূর্তে উনাকে হাসপাতাল ভর্তি না করলে হাতের বাইরে সবকিছু চলে যাবে। শ্রাবণী প্রচণ্ড কান্নাকাটি শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সে চিৎকার করে বলে ওঠে,
--- মায়ের যদি কিছু হয়ে যায় আমি কিন্তু পুলিশকে জানিয়ে দেবো তুমি ইচ্ছা করে মাকে মেরে ফেলেছো।
মেয়ের এই উগ্র মূর্তি দেখে সাত্যকি বাধ্য হন ইলাকে নার্সিংহোম ভর্তি করতে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment