একদিন ভালোবাসবে (চতুর্থ পর্ব)
কলেজের অনেক ছেলেই নিলয়ের সাথে শ্রাবণীর বন্ধুত্বকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। শ্রাবণী ছিল কলেজের অনেকের চোখে ক্রাশ।তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সম্রাট আর নিশীথ।কিন্তু সে কোনদিনও কাউকে পাত্তা দেয়নি। পিকনিকের দিন থেকেই ওদের এই মেলামেশাকে গুটিকয়েক ছেলের চক্ষুশূল হয়ে উঠলো দু'জনেই।
ফাইনাল পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে শ্রাবণীর বাবার হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়াতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ভদ্রলোকের একরোখা মনোভাবের কারণে কোন আত্মীয়ের সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিলো না।ফলে যা হয় তাই হল।কেউ কেউ এক দু'দিন ফোনেই একটুআধটু খবরাখবর নিলেন।বাকি একা শ্রাবণীই দৌড়ঝাঁপ করতে লাগলো। নিলয়ের সাথে ফোনে কথা প্রসঙ্গে সে বাবার অসুস্থ্যতার কথা জানায়। ওই ঘটনার পর থেকে শ্রাবণী নিলয়ের কাছে অনেকটাই ফ্রী হয়ে যায়।কিন্তু বারবার করে সে নিলয়কে হাসপাতাল আসতে নিষেধও করে।নিলয় তার কোন কথাকে গুরুত্ব না দিয়েই হাসপাতালে এসে হাজির হয়।আর আসার পর থেকেই দৌড়াদৌড়ি,ছুটাছুটি সেই করে।
শ্রাবণীর বাবার শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা ছিলো। উপরন্তু ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে জলও জমে গেছিলো। একসময় তাকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়।ওই সেদিনই শ্রাবণীর মা প্রথম নিলয়কে দেখেন। সেদিন তিনি মেয়ের নিষেধকে অগ্রাহ্য করে এসেছিলেন।নার্সিংহোমে যখন তখন প্রয়োজন অপ্রয়োজনে রোগীর বাড়ির লোকের কাছে এক প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেওয়া হয় যখন তখন। আর ঠিক এই দৌড়ঝাঁপগুলি নিলয় করে। যদিও টাকা সবসময় শ্রাবণী দিয়ে দিয়েছে কিন্তু তবুও নিলয়ের পকেট খরচ থেকে কিছু তো খরচ হয়েছেই।
শ্রাবণী সব সময় একটা ভয়ে ভয়ে থাকে বাবার কানে কথাটা চলে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। মা সেদিন এসে ছেলেটি 'কে'জানতে চেয়েছিলেন। মাকে বন্ধু বলে মানিয়ে নিলেও বাবা যে এটা জানলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে তুলবেন এটা শ্রাবণী বেশ ভালোভাবেই জানে। বাবা রেগে গেলে বাবার যে কান্ড জ্ঞান লোপ পেয়ে যায় এটা তাদের পরিবারের কারও অজানা নয়।কিন্তু নিলয় তার কোন কথাই শুনলো না। গত পনেরদিন ধরে হাসপাতালে নিলয় ছুটাছুটি করলেও কোনদিন সে শ্রাবণীর বাবাকে দেখতে ভিতরে ঢোকেনি কিংবা বলা ভালো শ্রাবণী তাকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি।
শ্রাবণী বুঝতে পারে সে আস্তে আস্তে নিলয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু তার বাবা কোনদিনও যে এ সম্পর্ক মেনে নেবেন না তা সে ভালোভাবেই জানে। নিজের ভালোলাগা,ভালোবাসাকে সে নিজের মধ্যেই রেখে দেয়। কিন্তু নিলয় সামনে আসলেই তার বুকের ভিতর তোলপাড় করতে থাকে। নিলয়ের হাত থেকে কোন জিনিষ নিতে গেলেও ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠে।
এরই মধ্যে একদিন ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার পর দু'জনে মিলে একসাথে অনেকটা পথ হেঁটে এসে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে চুপচাপ ঝালমুড়ি খাচ্ছিল।হঠাৎ নিলয় তাকে বলে ওঠে,
--- আমাদের এই বন্ধুত্বটা আজীবন রাখবি তো?
নিলয়ের প্রশ্নে শ্রাবণী চমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। নিলয় পুনরায় বলে,
--- তোর সাথে যদি সারাজীবন একই সাথে হাঁটতে চাই তোর কোন আপত্তি নেই তো?
শ্রাবণীর তখন ইচ্ছে করছে এই ফাঁকা নির্জন জায়গায় নিলয়কে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখটি নিয়ে ফিসফিস করে বলে,'খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোকে।তোর সাথেই আমি সারাজীবন হাতে হাত রেখে হাঁটতে চাই।"
কিন্তু কোন কথাই সে বলতে পারে না।বাবার অনুপস্থিতিতেও বাবার ভয়েই সে চুপ করে থাকে। শুধু চোখ'দুটি জলে ভর্তি হয়ে যায়। হঠাৎ করেই নিলয় ওর হাতদুটো ধরে বলে,
--- তোর এই চোখের জল আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। আমি খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি জোগাড় করে নেবো। আমি জানি আমার পছন্দ করা মেয়েকে বাবা মা খুশি মনেই মেনে নেবেন।
হাত'দুটো নিজের মুখের কাছে নিয়ে আলতো করে একটা চুমু করে শ্রাবণীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
--- এত সুন্দরী,স্মার্ট মেয়ে তুই। মুখ ফুটে কথাটা না বলে কাঁদতে শুরু করে দিলি?
--- তুই জানিস না নিলয় আমার বাবা খুব একগুঁয়ে,জেদী মানুষ।তিনি যা বলবেন তাই করেই ছাড়বেন।তিনি কিছুতেই এ সম্পর্ক মেনে নেবেন না।
--- তিনি মেনে নেবেন কি নেবেন না সেতো পরের কথা তুই আমাকে ভালোবাসিস তো?
শ্রাবণী এবার দু'হাতে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
--- তুই বুঝিস না? আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি।
শ্রাবণী নিলয়ের কাঁধেই একটা কিস করে।নিলয় দু'হাতে তার মুখটা সামনে এনে মিষ্টি হেসে নিজের ঠোঁট আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,
-- উহু ওখানে না, এইখানে --
শ্রাবণী লজ্জায় এবার লাল হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
--- ডিউ থাক এটা ,অন্যদিন দেবো।
--- তোকে পাওয়ার জন্য দরকার হলে তোর বাবার পায়ে ধরতেও রাজি আছি।কিন্তু এজীবনে আমি কিছুতেই তোকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেই পারি না।
পনেরদিন পড়ে শ্রাবণীর বাবাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়।শ্রাবণী কাকুতিমিনতি করে নিলয়কে হাসপাতাল আসতে নিষেধ করে দেয়।কিন্তু নিলয় তবুও আসে। তবে দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। একটা ক্যাব বুক করে শ্রাবণী তার বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।ক্যাবের মধ্যে বাবা,মেয়ের কোন কথাই হয় না।শ্রাবণী লক্ষ্য করে বাবার মুখটা বেশ থমথমে।বুঝতে পারে বাবা কোন একটা ব্যাপার নিয়ে খুব রেগে আছেন।কিন্তু কী সেটা বুঝতে না পারলেও নিলয়কে নিয়ে একটা অজানা আশংখ্যা তার মনে থেকে যায়।
বাবা বাড়িতে ফেরেন ঠিকই কিন্তু সব সময় মুখটা গম্ভীর। চিৎকারটা আগের মত অসুস্থ্যতার কারণে করতে না পারলেও মুখটা দেখলেই বোঝা যায় যে তিনি ভিতরে ভিতরে সর্বদা রেগে আছেন। বিশেষত শ্রাবণী কোন কথা বললেই তার যেন রাগটা আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। একদিন শ্রাবণীর মা তাকে বললেন,
-- হ্যাগো মেয়েটা পনেরটা দিন ধরে যে এত পরিশ্রম করে তোমায় সুস্থ্য করে নিয়ে আসলো বাড়ি তোমার কী মন বলে কিছু নেই। মেয়েটার সাথে একটু ভালোভাবে কথাও বলো না। তোমার কোন পরিবর্তন নেই।
--- তুমি শিওর তোমার মেয়ে একাই হাসপাতালে ছুটাছুটি করেছে?
-- এ আবার কী কথা। আমি তো রোজ যেতেও পারিনি। নিজে অত কিছু বুঝিও না। ও একাই তো সব করলো।
-- একটি ছেলে ছিল তুমি কি সেটা জানো? আগে ওর কাছ থেকে জানো ছেলেটার সাথে ওর সম্পর্কটা কী?
শ্রাবণীর মা একটু চুপ করে থেকে মনে করলেন তিনিও ছেলেটিকে দেখেছেন। মনে পড়াতে বললেন,
--- হ্যাঁ জানবো না কেন? ওতো ওর বন্ধু। ছেলেটি ছিল বলেই ওর পরিশ্রমটা একটু কম হয়েছে।তোমার তো এত আত্মীয়স্বজন কই কেউ তো একদিনের জন্যও আমাদের এই বিপদে এসে পাশে দাঁড়ায়নি।
-- তারা আসেনি সেটা তাদের ব্যাপার। ও ব্যাপারে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু একটা মেয়ের সমবয়সী একটা ছেলে যে শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না সে বুদ্ধি কী তোমার আছে?
-- তাহলে এখন তুমি কী করবে? মেয়েটিকে ধরে মারবে নাকি ছেলেটিকে পুলিশে দেবে?
--- দু'দিন অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতাল পরে ছিলাম এসে দেখছি ফটরফটর কথা বলতে শিখেছো।
--- তোমার মত বেঈমান আমি আর দু'টি দেখিনি। এই জন্যই কোন আত্মীয় স্বজনেরা কোনদিন তোমার সাথে যোগাযোগ রাখেনি।
শ্রাবণীর বাবা চিৎকার করে বলে উঠলেন,
--- আর একটা কথা যদি এ বিষয়ে বলো তাহলে আমাকে কিন্তু অন্য ব্যবস্থায় করতে হবে।
শ্রাবণীর মা চুপ করে অন্য ঘরে চলে গেলেন। চিৎকার করলে তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে আর তিনি মানুষটিকে ভালোভাবেই চেনেন। সবে মাত্র একটু সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এখন যদি আবার চিৎকার,চেঁচামেচি শুরু করেন তাহলে শরীর আরও খারাপ হবে। কিন্তু তিনি বেশ জানেন এই ঘটনা এখানেই শেষ হবে না ভবিষ্যতে ছেলেটির জীবনে কী অপেক্ষা করে আছে সেটা চিন্তা করলেই অজানা আশঙ্কায় তার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। তার স্বামী রাগ করে যেকোন ক্ষতি ছেলেটার করে দিতে পারেন এটা তিনি ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বামীর রোষানল থেকে তিনি ছেলেটিকে কিভাবে বাঁচাবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না।
ক্রমশ -
No comments:
Post a Comment