অরুণাভর মা ছেলেকে ডেকে বললেন,
--- পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তোদের কোন উপায় নেই। হয়ত পৃথিবীর আমিই প্রথম মা হবো যে কিনা নিজের সন্তানকে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যেতে বলছে। মেয়েটিকে আমিও খুব ভালোবাসি।তোর জন্যই ব্যাপারটা এত জটিল হয়ে গেলো!এত দেরি করে ব্যাপারটা আমায় জানালি। সে যাই হোক অঞ্জলীর বাবা,মায়ের মানসম্মান নষ্ট হবে বুঝেও আমি স্বার্থপরের মত আমার ছেলের সুখের কথাটাই ভাববো। তোরা আজ রাতেই পালাবি।
অরুণাভর মা কিছু টাকা আর একটা সোনার চেন বের করে গুছিয়ে রাখলেন। তার অনুকে বললেন,
-- সন্ধ্যায় বেরিয়ে তোরা প্রথম কালীঘাট মন্দির গিয়ে সেখান থেকে অঞ্জলীকে সিঁদুর পরিয়ে কোন হোটেলে গা ঢাকা দিয়ে থাকবি। অঞ্জলীর বিয়ের তারিখটা চলে গেলে বাকি সব ভাবা যাবে। আর এই চেনটা ওকে দিবি। বাদবাকি সব তোরা ফিরে এলে হবে।
অরুণাভ,অঞ্জলী সেই মত সেদিনই বেরিয়ে পড়ে। বেশ কয়েকদিন পরে তারা যখন তাদের বাড়িতে ফিরে আসে প্রথম অবস্থায় অঞ্জলীর বাড়ি থেকে অশান্তি করলেও তাদের প্রথম সন্তান কুহেলির জন্মের পরে আর অঞ্জলীর কাছ থেকে আর্থিক দিক দিয়ে নানান উপকৃত হয়ে তারা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান "যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে।"
তারপর সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। পরে তাদের একটি ছেলে হয়েছে। নাম অসিত। সুখের সংসারে হঠাৎ করেই ছন্দপতন! মেয়ে কুহেলীর কিছুদিন ধরেই হঠাৎ করেই পায়ে ব্যথা। হাঁটতে কষ্ট হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া হয়। ওষুধে ব্যথা তো কমেই না বরং ডান হাতেও ব্যথা শুরু হয়। শিরদাঁড়ায় ব্যাথার জন্য সে শুতেই পারে না। চলে যায় স্বামী,স্ত্রী দু'জনে মিলে চেন্নাই। মেয়ের বয়স তখন কুড়ি আর ছেলে চৌদ্দ বছরের। ছেলেকে শ্বশুর,শ্বাশুড়ীর কাছে রেখেই তারা ছোটে। সেখানে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ধরা পরে কুহেলীর বোন ক্যান্সার। দীর্ঘ দু'মাস মারণ ব্যাধির সাথে সংগ্রাম করেও তারা মেয়েকে নিয়ে ফিরতে পারে না। সেই থেকেই অঞ্জলী কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
কুহেলীর ঘরে আজও তার জিনিসপত্র সেই আগের মত করেই গুছানো। অঞ্জলী সেই ঘরে সময়ে,অসময়ে ঢুকে জোরে জোরেই তার কুহুর সাথে কথা বলে কখনো কাঁদে আবার কখনো বা হাসে। খাবার নিয়ে কুহেলীর ছবির সামনে ধরে তাকে খাওয়ানোর জন্য জোরাজুরিও করে। অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছে ওষুধের উপরেই আছে কিন্ত কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু সংসারের কাজে তার কোন অনীহা নেই। সময়মত স্বামী,ছেলেকে খেতে দেওয়া, যতদিন শ্বশুর,শ্বাশুড়ি বেঁচে ছিলেন তাদের দেখভাল করা সবই করেছেন নিয়ম মেনে ঘড়ির কাঁটা ধরে। কিন্তু যখন কুহেলীর ঘরে ঢোকেন তখন তিনি অন্য মানুষ। তার একটা আলাদা জগৎ তৈরি হয়। সেই জগতে সে আর কুহেলী ছাড়া অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই।
তাকে এই স্মৃতি থেকে বের করতে ঘর তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল কিন্তু তাতে সে আরও অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। তার পাগলামী দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।তখন সে আর সংসারের কাজ করতে পারে না। দিনরাত শুয়ে বসে সে তার কুহুর সাথে গল্প করে। অবস্থা দিনদিন।খারাপ হচ্ছে দেখে পুনরায় তারা কুহেলীর ঘরের তালা খুলে দিয়েছে। আর তারপরেই সে আবার পূর্বের মত।ছেলে এবং স্বামীর সাথে যখন খাবার টেবিলে বসে তখন তার কুহুর গল্প,আজ কুহু কী বলেছে, মায়ের কাছে কী খেতে চেয়েছে সব মনগড়া কল্পনা নিয়ে বলে চলেন। চুপচাপ বাপ,ছেলে অঞ্জলীর কথা শোনে। এইভাবেই অঞ্জলীর জীবন এগোতে থাকে।
অরুণাভ শ্রাবণীকে নিয়ে যখন ফেরেন তখন গাড়ির মধ্যে তার কাছে জানতে চান,
--- মা, তোর নামটাই তো জানা হয়নি। তবে তোর নাম যায় হোক আজ থেকে তুই আমাদের কুহেলী। তোকে আমরা কুহু বলেই ডাকবো।
শ্রাবণী মাথা হেলিয়ে তার সম্মতি জানায়। কিন্তু কারণ জানতে চাইলো না। অরুণাভ সংক্ষেপে তার মেয়ের অকালে চলে যাওয়ার গল্প শ্রাবণীকে শোনান। মেয়ে চলে যাওযার পর তার স্ত্রীর বর্তমান পরিস্থিতি কী সেটাও বলতে ভোলেন না। শ্রাবণীর যা বয়স তার কুহুও ঠিক এই বয়সেই চলে গেছিলো। তাই অরুণাভর দৃঢ় বিশ্বাস এই মেয়েটিকে দেখেই তার অঞ্জলী সুস্থ হবেন। শুধু স্ত্রীর সুস্থতার জন্যই যে তিনি তাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন তা কিন্তু মোটেই নয়। একা একটা মেয়ে যার পৃথিবীতে কেউ নেই এটা জানার পর তার ভিতর মানবিকতাও জেগে উঠেছিল। সঙ্গে পিতৃত্বও ছিল।
ভগবানের কী অসীম লীলা! বিয়ের কনে বিয়ের মাত্র ক'দিন আগেই পালিয়ে গেছিলো বলে সাত্যকি সেই তাকিখেই বিয়ে করলেও এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তার স্ত্রী,কন্যার সাথে ভালো ব্যবহার করেননি একটা অন্য মেয়ের দোষের কারণে।অবহেলায় প্রায় ঢুকতে ঢুকতে ইলা যখন চলে গেলেন তার মেয়ে আশ্রয় পেলো ঠিক সেই পরিবারটির কাছে। যতদিন ইলা বেঁচে ছিলেন নিজের মানসিক অশান্তিতে অচেনা,অজানা এই মহিলার প্রতি তার একটা তীব্র রাগ ছিল। ইলা মনে করতেন তার দুর্বিষহ জীবনের জন্য একমাত্র সেই মেয়েটিই দায়ী যে কিনা বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পরে পালিয়ে গেছিলো। একেই বলে বোধহয় ভবিতব্য!
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment