একদিন ভালোবাসবে ( নবম পর্ব)
ইলার তখন জ্ঞান ছিলো না।সুতরাং এম্বুলেন্স এ করে তাকে নিতে হল। তাও এম্বুলেন্স ছোট গলির ভিতর ঢুকবে না তাই পাড়ার লোকের সাহায্যে স্ট্রেচার নিয়ে আসা হল।শ্রাবণী ও সাত্যকি ছাড়াও পাড়ার দু'একজনকে সাথে নিয়ে পাড়ার মধ্যেই সদ্য গজিয়ে ওঠা এক নার্সিংহোমে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। বাইরে বাবা,মেয়ে পাশাপাশি বসে। কিন্তু আচরণ তাদের অপরিচিতের মত। ডাক্তারের সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে যাবতীয় শ্রাবণী। সাত্যকি চুপচাপ বসেই আছেন। একসময় তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। শ্রাবণী বাবার উপরের সমস্ত রাগ বিসর্জন দিয়ে পাড়ার এক দাদার সাথে তাকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। এদিকে এতক্ষন পরে নার্সিংহোমের ভিতর থেকে খবর এলো আমাদের এখানে আজ হার্ট স্পেশালিস্ট আসেননি এখন উনি জানালেন আজ উনি আসতে পারবেন না। শুনেই শ্রাবণী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো,
--- এ কথা আপনারা এখন বলছেন? এতক্ষণ কী করছিলেন? আপনাদের এসব কথায় আমার মা যে চলে যেতে বসেছেন তার দায় কে নেবে? তিনি আসতে পারবেন না আপনারা অন্য ডাক্তারকে ফোন করুন।
নার্সিংহোমের আর.এম. ও. বললেন, "দেখছি আমরা।"
বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে পাড়ার কিছু লোকজনের সাথে যখন হাসপাতালে বসে থেকে মায়ের জন্য ঈশ্বরের কাছে সমানে প্রার্থনা করে চলেছে তখন সেই মুহূর্তে নিলয়ের কথা খুব মনে পরে। ফোনটা নিয়ে নিলয়কে ফোন করতে গিয়ে দেখে সুইচ অফ।
নিলয়কে সেদিন থানা থেকে দেখে পাঠায়। নিলয় আসার সাথে সাথেই তাকে অ্যারেস্ট করা হয়। নিলয়ের সাথে ছিলো ওর বন্ধু দীপ্ত। দীপ্তর বাবা একজন নামকরা উকিল। দীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে ফোন করে। তিনি সেই মুহূর্তেই থানায় হাজির হয়ে যান। এর আগে নিলয় পুলিশকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে নির্দোষ। শ্রাবণীকে তাদেরই ক্লাসমেট সম্রাট ও নিশীথ পরীক্ষার শেষ দিনে যখন শ্রাবণী বাড়ি ফিরবে বলে বাস থেকে নেমে নির্জন রাস্তা দিয়ে আসছিল ঠিক তখনই সম্রাট আর নিশীথ একটা গাড়ি এনে শ্রাবণীর সামনে দাঁড় করিয়ে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ওষুধের সাহায্যে অজ্ঞান করে জোর করে গাড়িতে তোলে। মেইন রাস্তায় যখন গাড়িটা জ্যামে আটকে যায় ঠিক তার পাশেই জ্যামে আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো দীপ্তর বাইক।পিছনে বসা নিলয়। নিলয় দেখতে পায় সম্রাট ও নিশীথকে। দু'জনের মাঝখানে একটি মেয়ে ছিটে হেলান দিয়ে শুয়ে। মেয়েটি যে শ্রাবণী ওরা তা তখনও বুঝতে পারেনি। কিন্তু কিছু যে একটা ঘটেছে সেটা বুঝেই ওরা গাড়িটিকে অনুসরণ করতে থাকে। চলতে চলতেই ওরা ওই গাড়িটির নম্বর প্লেটের একটি ছবি তুলে নেয়। গাড়িটিকে ফলো করতে করতে ওরা একটা নির্জন জায়গায় চলে আসে। বহুবার গাড়িটির দিশা চোখের পলকেই হারিয়েছে। কিন্তু ছবিটি তোলার ফলে ঠিক খুঁজে বেরও করেছে। নিলয় দীপ্তর বাইকে বসেই নিজেদের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুদের ফোন করে লোকেশন দিতে থাকে। এইভাবে যখন সম্রাটরা শ্রাবণীকে নির্মীয়মান একটি বড় ফ্ল্যাটের শুনশান একটি জায়গায় নিয়ে দুই বন্ধু মিলে তাকে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে তখনো শ্রাবণীর জ্ঞান ফেরেনি। নিলয় ও দীপ্ত খুব আস্তে আস্তে ওদের অনুসরণ করতে থাকে। ওরা অপেক্ষা করতে থাকে বাকি বন্ধুদের।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি বন্ধুরাও চলে আসে। তখন সকলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পরে ওরা সম্রাট ও নিশীথের উপরে। কিল,চর,ঘুষি, লাথি - ছ'জনের সাথে পেরে না উঠে ওরা দু'জন পালিয়ে যায়। তখনও শ্রাবণীর জ্ঞান ফেরেনি। ক্ররোফর্মের পরিমাণ বেশি হওয়াতে শ্রাবণীর জ্ঞান ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
নিলয় একটা উবের বুক করে ওকে নিয়ে আসে। বাকি বন্ধুরা যে যার মত বাইকে ফেরে। শ্রাবণীদের বাড়িটা বড় রাস্তা থেকে অনেকটাই দূরে হওয়ায় এবং রাস্তা ছোট হওয়ায় উবের ঢুকতে অস্বীকার করে। তাই সেখানেই সেটিকে ছেড়ে দিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে নিলয় তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কারণ ওই সামান্য রাস্তাটুকুও হাঁটার সামর্থ শ্রাবণীর ছিল না।
দীপ্তর বাবা অনিমেশ মুখার্জী দীপ্তর কথামত বাকি বন্ধুদের থানাতেই ডেকে নিয়ে পুলিশকে তাদের মুখ থেকেই আলাদা আলাদা ভাবে ঘটনার বিবৃতি শোনান অফিসারকে। নিজে বন্ড দিয়ে সেই মুহূর্তেই নিলয়ের জামিন করান। সেই থেকেই চলছে সেই কেসের জন্য মাঝে মাঝেই কোর্টে হাজিরা দেওয়া।
পরদিন অনিমেষ মুখার্জীর তৎপরতায় সম্রাট আর নিশীথকে গ্রেপ্তার করানো হয়। কিন্তু সাক্ষ্য,প্রমাণ থাকা সত্বেও তারা টাকার জোরেই হয়ত জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়।
নিলয় ঘটনার দিন দেরিতে বাড়ি ফিরলে মা বারবার করে তার কাছে জানতে চাওয়ায় সে মাকে সত্য ঘটনা লুকিয়ে যায়। এরপর কেটে গেছে দু'বছর। ওই ঘটনার পর শ্রাবণীর আর কোন খোঁজ নিলয় পায়নি। অনেক চেষ্টা করেছে। ফোনে প্রথম প্রথম সুইচ অফ বললেও এখন নম্বরটির অস্তিত্ব নেই বলেই জানায়। নিজে তো চেষ্টা করেছেই বন্ধুদের সাহায্যেও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বাইরে থেকে সব সময় তালা বন্ধ। আশেপাশের বাড়িতে প্রথম প্রথম ভয়ে জিজ্ঞাসা করতেও পারেনি। মাস তিনেক পরে জানতে পারে সাত্যকি দত্ত এখান থেকে বাড়ি বিক্রি করে কোথায় চলে গেছেন কেউই তা বলতে পারে না।
প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে নিলয় খুবই ভেঙ্গে পরে। মন খারাপ করে থাকে ,একা একা কান্নাকাটি করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব কষ্টের উপরেই একটা প্রলেপ পরে যায়। শোক কিছুটা সামলে উঠে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে একটি চাকরির। ছ'মাসের মাথায় সে বড় একটা বিদেশী কোম্পানিতে জয়েন করে। আর প্রাইভেটে চেষ্টা চালিয়ে যায় এম এ করার। এখানেই পরিচয় হয় তার সাথে অসিতের।
অসিত সুপুরুষ। ছ' ফুটের উপরে উচ্চতা। ভীষণ মিশুকে একটি ছেলে। একদিন নিলয়ের সাথে গল্প করতে করতে তার ফোনটা সে ফেলে যায় নিলয়ের টেবিলে। নিলয় সেটি দেখতে পেয়ে অসিতকে ফেরৎ দিতে যাওয়ার মাঝপথে ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে ছবিটা দেখতে পেয়ে নিলয় হাঁটতে ভুলে গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে অসিতের ফোন ফেলে যাওয়ার কথা মনে পড়ায় সে এগিয়ে আসতে গিয়ে দেখে মাঝ পথে নিলয় ফোনের স্ক্রীনের দিকে হা করে তাকিয়ে মাঝপথেই দাঁড়িয়ে।অসিত হাসতে হাসতে বলে,
--- ওটা আমার বউয়ের ছবি। মাস ছ'য়েক হল বিয়ে করেছি।
নিলয় ফোনটা অসিতের হাতে দিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে ধপ করে বসে পরে।
No comments:
Post a Comment