Tuesday, February 21, 2023

একদিন ভালোবাসবে ( সপ্তম পর্ব)

একদিন ভালো বাসবে ( ৭ম পর্ব)


  শ্রাবনীর মা ইলাদেবী খুব টেনশনে রয়েছেন। একটা পরোপকারী ছেলে এতটা সাহায্য করলো আর শ্রাবণীর বাবা কিনা এরমধ্যে অন্য কোন গন্ধ খুঁজছেন। যদি ধরেই নিই শ্রাবণীর সাথে তার কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাতে অসুবিধা কোথায়? নিজের জীবনটা এই লোকটার পাল্লায় পরে শেষ হয়ে গেলো। একটা দিন এমন কী একটা সময়ও এই মানুষটা ভালোভাবে দু'দণ্ড কথা বলেনি। অন্যের করা  দোষেে সারাজীবন আমার উপরেই রাগ দেখিয়়ে গায়ের জ্বালা মেটালো। আর আমার বাবা আমাকেই বলির পাঠা করলেন অন্য পরিবাারের সমস্যা মেটাতে গিয়ে। পাড়ার ছেলে দীপায়ন তখন উচ্চমাধ্যমিক দেবে। দু'জনের মধ্যে একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছিলো। দীপায়ন তাকে জানিয়েছিল চাকরি পাওয়ার পর বাবা,মাকে পাঠিয়ে সম্মন্ধ করে ইলাকে বিয়ে করবে।কিন্তু হঠাৎ করেই সাত দিনের মধ্যেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন।

  আসলে শ্রাবণীর বাবা সাত্যকির বিয়ে ঠিক হয়েছিল অন্যত্র। কার্ড ছাপানো, সবকিছুর এডভ্যান্স করা,লোক নিমন্ত্রণ করা সব রেডি। হঠাৎ করেই বিয়ের কনে উধাও হল তার প্রেমিকের সাথে। অপমান এবং লোকলজ্জার হাত থেকে রক্ষা পেতে তার বাড়ির লোকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন ওই দিনেই ছেলের বিয়ে দেবেন বলে। আর তাদের এই অপমান আর লোকলজ্জার হাত থেকে মুক্তি দিতে ইলার বাবার বন্ধু এই সম্মন্ধটার খোঁজ দেন। কোন চাহিদা ছাড়া চার মেয়ের বড় মেয়েটিকে বিয়ের মাধ্যমে তাদের হাতে তুলে দিতে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন ইলার বাবা।


   দীপায়ন এখন ইঞ্জিনিয়ার। শুনেছে কানাডায় স্থায়ী বাসিন্দা সে এখন। বিয়ে হওয়ার পর একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। চোখাচোখি হওয়াতে দীপায়ন একদৃষ্টে ইলার দিকে তাকিয়ে তার অব্যক্ত অনেক কথাই সেদিন বলে দিয়েছিল। ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে সেদিন ইলা খুব কেঁদেছিলেন। এটা ছিল অষ্টমঙ্গলে আসার পরের ঘটনা। তারপর আর কোনদিন দেখা হয়নি। যেহেতু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ইলার বাপেরবাড়িতে আসা একদম পছন্দ করতেন না বিশেষত সাত্যকি। তাই দীপায়নের সাথে আর কোন দেখার সুযোগও আর হয়ে ওঠেনি। বহু বছর পর ইলা জেনেছিলেন দীপায়ন চাকরি নিয়ে কানাডায় চলে গেছে। 


  কিশোরীবেলার অনেক প্রেমই পূর্ণতা পায় না। ইলার আর দীপায়নের প্রেমটাও ঠিক তাই। কিন্তু মনে থেকে যায় আমৃত্যু। আজও যখন সাত্যকির ব্যবহারে ইলা কষ্ট পান নিজের অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দীপায়নের মুখটা। বিশেষত দেখা হওয়ার শেষ দিনের সেই দৃষ্টি আজও এই বয়সে এসে ইলার বুকে কাঁপন ধরায়।


 ইলা আত্মীয়দের কাছে শুনেছেন সাত্যকি এরূপ ছিলেন না। হাসিখুশি একটা মিশুকে মানুষ ছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে মানুষটার আমূল পরিবর্তন হয়।পৃথিবীর কাউকেই তিনি বিশ্বাস করেন না। তার কথার উপর কেউ কথা বললেই তিনি ক্ষেপে বোম হয়ে যান। শ্বশুর শ্বাশুড়ি যতদিন বেঁচে ছিলেন একান্নবর্তী পরিবারে সাত্যকির এই আচরণের জন্য নিত্য কথা শুনতে হয়েছে ইলার। তাদের মৃত্যুর পর একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে। কোনদিনও কোন কথা স্বামীর মুখের উপর বলতে পারেননি।সব সময় ভয়ে জুজু বুড়ি হয়ে থেকেছেন। মেয়েও ছোটবেলা থেকে বাবাকে জমের মত ভয় পায়। তিনি ভাবতে থাকেন ছেলেটা সম্পর্কে বনির কাছ থেকে সবকিছু জানতে হবে। ছেলেটাকে সতর্ক করতে হবে। যদি সত্যিই বনি ওকে ভালোবাসে তাহলে বনিকে বুঝিয়ে যদি সরানো না যায় কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। কারণ ভালোবাসা হারানোর জ্বালা তিনি ভালোভাবেই জানেন। জীবন যতই সুখের হোক না কেন প্রথম ভালোবাসা বুকের মাঝে সারাজীবন ধরে ধিকিধিকি জ্বলে। আজও এই বয়সে এসে দীপায়নের সাথে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাটানোর মুহূর্তগুলো মনেহয় এই তো সেদিনের কথা।


 সামনেই ফাইনাল সেমিস্টার। খুব একটা কলেজে যাতায়াত নেই। এই কোচিংয়ে নিলয় না পড়লেও ঘড়ির কাঁটা ধরে ছুটির সময় এসে হাজির হয়। পাড়ায় ঢোকার পূর্ব পর্যন্ত যেটুকু কথা হয়। সব সময়ই একটা ভয় কাজ করে।যদি পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যায়? বাবার কানে একবার কথাটা গেলে মেরেই ফেলে দেবেন। 


  সেদিন ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ইলা তাকে ইশারা করে রান্নাঘরে নিয়ে যান। নিজের ঘরে খাটের উপর বসে টিভি চালিয়ে সাত্যকি খবর দেখছিলেন আর মুড়ি,চানাচুর মাখা খাচ্ছিলেন। একটু আগেই ডাক্তারের কথা অনুযায়ী নিয়ম মাফিক নেবুলাইজার নিয়ে বর্তমানে শ্বাসকষ্ট একটু কম।বাড়িতে শ্রাবনীকে ঢুকেই একবার বাবার ঘরে ঢুকতে হয় তার বাড়িতে ফেরার উপস্থিতি জানান দিতে। কিন্তু কথা কিছুই হয় না।শুধু শ্রাবণী দরজার কাছ থেকেই বলে,"বাবা আমি চলে এসছি।"সেটা শেষ করেই মায়ের জরূরী তলবে সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। বাবাকে সে যমের মত ভয় পেলেও মা তার কাছে বন্ধুর মত। মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,

-- মা জামা ছেড়ে আসি।তুমি চা করো।চা খেতে খেতে তোমার কথা শুনবো।

--- ওসব পরে হবে। আগে আমার কথাগুলির ঠিকঠাক জবাব দে --।

--- কী এমন কথা তোমার যে এখুনি বলতে হবে?

--- খুব দরকারী কথা না হলে কী আর এইভাবে তোর বাবার আড়ালে দেখে নিয়ে আসতাম?

-- ঠিক আছে বলো কী কথা?

-- তোর বাবা হাসপাতালে থাকতে যে ছেলেটা আসতো ওর নাম কিরে? কোথায় থাকে? একসাথে পড়িস? ওদের বাড়ি কো ---।

--- আরে দাঁড়াও দাঁড়াও - এত পুলিশের মত জেরা করছো কেন? কী হয়েছে আগে বলো 

--- তোর বাবা জানতে পেরেছেন একটি ছেলে রোজ হাসপাতালে আসতো।

 শ্রাবণী চমকে উঠলো।এই ভয়টাই সে পাচ্ছিলো। কথাটা শুনেই তার ভয়ে চোখ,মুখ শুকিয়ে গেছে।

--- সর্বনাশ! বাবা কী করে এসব জানলেন? ও তো কোনদিন বাবার সামনে যায়নি? তবে বাবার কানে এ কথাটা গেলো কী করে?

-- অত সব আমি জানি না। মনেহয় কোন নার্স বা আয়া বলেছে।তিনি তো আর বাইরে আসেননি। আমাকে সব খুলে বল।

-- কী খুলে বলবো মা।তুমি তো জানো তোমাকে আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না। ও আমার সাথে পড়ে,ওর নাম নিলয়।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান।

 শ্রাবণী চুপ করে যায়।

-- কী রে চুপ করে গেলি কেন? আসল কথাটা বল 

--- আসল কথা আবার কী?

--- তুই কি ছেলেটিকে ভালোবাসিস? সত্যি করে বল আমাকে।ব্যাপারটা আমায় একটু বুঝতে দে। ছেলেটার জীবনে বিপদ ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পারছি। তোর বাবাকে তো তুই চিনিস। ওর কোন বড়সড় বিপদ হওয়ার আগেই ওকে সাবধান করতে হবে।

 মায়ের এসব কথা শুনে শ্রাবণী ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-- অনেক চেষ্টা করেছি ওকে এড়িয়ে যেতে মা।কিন্তু পারিনি। ও আমাকে একদিন একটা বড় রকমের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিল। তারপর থেকেই একটু একটু করে ওর প্রতি আমার আলাদা একটা অনুভুতি তৈরি হয়।তার থেকেই ওকে আমি ভালোবেসে ফেলি।

 শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতেই সেদিনে পিকনিকে ঘটা সমস্ত ঘটনা মাকে খুলে বলে। সব শুনে ইলা মেয়েকে বলেন,

--- তুই আমার কথা শোন আর ছেলেটিকে বুঝিয়ে বলবি সব কথা। আমি তোকে কথা দিচ্ছি পড়াশুনা শেষ করার পর ও যদি খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি জোগাড় করে নিতে পারে তাহলে আমি জীবনে প্রথম তোর বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তোদের মিলিয়ে দেবো।কারণ আমি জানি জীবনে প্রথম ভালোবাসা হারানো কতটা কষ্টের।

  শ্রাবণী এই প্রথম মায়ের মুখে এরূপ একটা কথা শুনে অবাক হয়ে মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।


ক্রমশ 


  


No comments:

Post a Comment