একদিন ভালোবাসবে ( পঞ্চম পর্ব)
বাথরুমের দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে তিয়াসা দাঁড়িয়ে গিয়ে পিছন ফিরে নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।নিলয় একটু ইতস্তত করে কিভাবে কথাটা তিয়াসাকে বলবে। তারপর আমতা আমতা করতে করতেই বলে বসে,
--- আজ তো তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা। তা কখন বেরোতে হবে?
তিয়াসা কিছুটা অবাক হয়ে যায়।যে মানুষটা তাকে এখনো পর্যন্ত স্ত্রীর মর্যাদা দিলো না সে নির্বিবাদে রিচুয়ালগুলো করে চলেছে। মানুষটা তো খারাপ বলে মনে হয় না। কিন্তু এর কী এমন অতীত আছে যে অতীত থেকে সে কিছুতেই বেরোতে পারছে না।
তিয়াসাকে চুপ থাকতে দেখে নিলয় আবারও তাকে বলে,
--- বললে না কখন বেরোতে হবে?
-- আমি জানি না। ওটা মা বলবেন। তুমি মায়ের কাছ থেকে শুনে নাও।
কথাটা বলে তিয়াসা বাথরুমে ঢুকে যায়।
নিলয় তার আলমারি খুলে দু'একটি শার্ট,প্যান্ট বের করে খাটের উপর রেখে দিয়ে নিচুতে নেমে যায়। তিয়াসা বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাটের উপর নিলয়ের শার্ট,প্যান্ট দেখে বুঝতে পারে এগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্যই নিলয় বের করে রেখে গেছে। সে ভীষণ অবাক হয়! ট্রলিটা আলমারির উপর থেকে নামিয়ে খাটের উপরেই রেখে গেছিলো নিলয়। তিয়াসা নিজের সামান্য কিছু কাপড়চোপড় বের করে রেখে সেও নিচে নেমে যায়।
তিয়াসাকে নিচুতে দেখতে পেয়ে তার শ্বাশুড়ি বলে ওঠেন,
-- দশটার মধ্যে অস্টমঙ্গলে বেরিয়ে যাবে।আজ তুমি রান্নাঘরে ঢুকবে না একদম। আমি সব করে নিতে পারবো। তোমার বাবা পাউরুটি নিয়ে এসেছেন।পাউরুটি, ডিমসিদ্ধ আর কলা টিফিন করে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পরো। রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না এখানে বসেই দু'জনে টিফিন করে নাও। আমি সব গুছিয়ে রেখেছি।তোমার খাওয়া হয়ে গেলে একটু আমার ঘরে এসো।
নিলয় আগেই একটা চেয়ার দখল করে বসে ছিল। নীলিমা তার সামনে প্লেটটা রেখে বললেন,
-- তোর কী কী নিতে হবে বৌমাকে সব বের করে দিস।ও গুছিয়ে নেবে।
নিলয় মাথা নাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মত হ্যাঁ বললে নীলিমা সেখান থেকে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলেন। দু'জনেই চুপচাপ বসে খেয়ে চলেছে। দু'জনেই দু'জনের দিকে একটু আড়চোখে দেখছে কিন্তু কেউই কথা বলছে না। তিয়াসার আগেই খাওয়া হয়ে গেছিলো কিন্তু তা স্বর্তেও সে বসে আছে দেখে নিলয় তাকে বলে,
-- তুমি উঠে যাও আমার খাওয়া হয়ে গেলে আমি প্লেট সিঙ্কে রেখে আসবো।আমার এগুলো অভ্যাস আছে।
-- হ্যাঁ সেতো আমি দেখতে পাচ্ছি গুনের আধার।শুধু মনের কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করার অভ্যাসটাই নেই।
--- বলবো সব বলবো। একটু সময় চাইছি
তারপর বিড়বিড় করে বলে 'কিন্তু কতটা বলতে পারবো সেটা বুঝতে পারছি না। মনটা তো অন্যকিছু চাইছে।'
নিলয়ের শেষ কথাটা ভালোভাবে শুনতে না পেয়ে তিয়াসা উৎসুক হয়ে জানতে চায়,
--- বুঝতে পারলাম না কী বললে?
নিলয় মাথা নাড়িয়ে বললো "না কিছু না -" আর মনেমনে ভাবলো , "দূর আমি যে কী চাই নিজেও সেটা বুঝতে পারছি না -। তোমার মুখের দিকে তাকালেই তো আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।"
কথা বলতে বলতে নিলয়ের খাওয়া শেষ হয়ে যায়। তিয়াসা নিলয়ের সামনে থেকে প্লেটটা নিতে গেলে নিলয় তার দিকে তাকিয়ে পড়ে।দু'জনে চোখাচোখি হওয়াতে তিয়াসার বুকের ভিতর ধক করে কেঁপে ওঠে। নিজেকে সামলাতে সে সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়ে।
শ্বাশুড়ি মায়ের ঘরে ঢুকলে তিনি একটি বড় বিগসপার দেখিয়ে বলেন,
--- এর মধ্যে তোমার বাবা,মা আর বোনের কিছু কাপড়চোপড় আছে। নিলয়কে দিয়ে তোমার বাবা,মাকে প্রণাম করিয়ে এগুলো দিও।
বিয়ের আগেই কথা হয়েছিল যার যার প্রণামী নিজেদের।কিন্তু তা স্বর্তেও উভয় পরিবারের বাড়ির প্রণামীগুলো কিনতে হয়। এটা তিয়াসার জানা ছিলো তাদের পরিবার থেকেও নিলয়ের বাবা,মায়ের জন্য পাঠিয়েছে।তাই সে মাথা নাড়িয়ে শ্বাশুড়ীকে হ্যাঁ সূচক বার্তা দেয়।
বিয়ের পর প্রথম বাপের বাড়ি যাওয়া। নিজের মনে খুব একটা আনন্দ না থাকলেও বাড়ির লোককে তো সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। সে একটা নীল কাঞ্জিভরম পরে। খুব সুন্দর করে খোঁপা বাঁধে। গায়ে হালকা সোনার গয়না। আর নিলয়ের জন্য তাদের বাড়ি থেকে দেওয়া একটা নীল পাঞ্জাবী আর পায়জামা বের করে খাটের উপর রেখে দেয়। নিজেকে তৈরি করার আগেই সে ট্রলিটা গুছিয়ে রেখেছিল। এবার সে তার ঘরের দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখে নিলয় সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
--- অদ্ভুত মানুষ তো! এসে দাঁড়িয়ে আছো অথচ দরজা খুলতে বলছো না?
--- হু জানি তো তুমি সাজছো তাই অপেক্ষা করছি হয়ে গেলেই তো খুলে দেবে।
কথাগুলো নিলয় সরাসরি তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে চোখ না সরিয়ে তাকিয়েই থাকে। তিয়াসার হঠাৎ রবি ঠাকুরের গানটা মনে পড়ে যায় "আমি রূপে তোমায় ভুলাবো না, ভালোবাসায় ভূলাবো।" আর মনে মনে বলে,'চলো শ্বশুরবাড়ি দেখি আমায় কিভাবে এড়িয়ে যেতে পারো। তোমার সাথে যখন আমার গাঁটছড়া বাঁধা পড়েছে আর মানুষটা তুমি মোটেই মন্দ নও;অতীতে তুমি কী করেছো তা নিয়ে আমার বিন্দু বিসর্গ কোন আগ্রহ নেই। আমাকে বুকে তোমার টানতেই হবে।"
-- এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ভিতরে ঢুকবে।
এতক্ষণ হ্যাংলার মত তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য নিলয় নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। সে তিয়াসাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে তারজন্য পাঞ্জাবী আর পায়জামা বের করে রাখা হয়েছে। তিয়াসা নিলয়কে রেডি হওয়ার সুযোগ দিতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
ওদের বেডরুম থেকে বেরিয়েই পূর্বদিকে একটা বেশ বড় চাপা ফুলগাছ রয়েছে। গাছটাতে কুঁড়ি ভর্তি হয়ে আছে। কিছুদিনের মধ্যেই গাছে ফুল ভর্তি হয়ে যাবে। চাপা ফুলের খুব সুন্দর গন্ধ। তিয়াসা যে স্কুলে পড়তো সেই স্কুল মাঠে একটা চাপা ফুলগাছ ছিল।যখন গাছটাতে ফুল আসতো পুরো স্কুল চত্বর গন্ধে ম ম করতো। কত পাখি গাছটাতে এসে বসতো। অনেক সময় স্কুল চলাকালীন সময়ে গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় পাখি কত বন্ধুদের মাথায় মল ফেলেছে।মনে পড়লে সেই সব ঘটনা আজও হাসি পায়। তিয়াসা আজই ভোরবেলা কোকিলের ডাক শুনতে পারছিলো।তার মানে এই গাছে বসেই কোকিলটা তার সাথীকে ডাকছিল। উল্টোপাল্টা ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন
ভিতর থেকে নিলয় সাড়া দেয়
--- আমি রেডি। সাড়ে ন'টা বাজে। তিয়াসা ঘরে ঢুকে নিলয়কে দেখে একটু থমকে যায়। তার ছ'ফুট দু'ইঞ্চির মনের মানুষটাকে যে এত ভালো লাগবে তারই পছন্দ করে কেনা পাঞ্জাবী ,পায়জামা তে এতটা সে ভাবেনি। কিন্তু একজলক তার দিকে তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিয়ে ট্রলিটা নিতে যায়। নিলয় দেখতে পেয়ে খপ করে ট্রলিটা ধরে বলে,
-- তুমি নেমে যাও আমি এটা নিয়ে নামছি।
তিয়াসা একটু মনেমনে হাসে। নিজেই মনেই বলে, "ওই যে একটা প্রবাদ আছে না আর একবার সাধিলেই খাই " বাবুর দশা ঠিক এরূপ। ছাব্বিশ বছরের তরতাজা যুবকের সামনে একটা চব্বিশ বছরের যুবতী তার রূপ যৌবন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখি কতক্ষন পরে কিংবা কতদিন পরে ধ্যান ভঙ্গ হয়?
তিয়াসা নিচুতে নেমে গিয়ে তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ীকে প্রণাম করে। নিলয়ও তিয়াসার দেখাদেখি বাবা,মাকে প্রণাম করে দাঁড়ালে নীলিমা বলে ওঠেন,
--- বেরিয়ে পর এবার।
নিলয় ট্রলি নিয়ে আগে আগে আর তিয়াসা তার পিছন পিছন এগিয়ে যায়। ক্যাবটা বাড়ির ভিতরে থাকতেই বুক করেছিলো নিলয়। ক্যাব এসে দাঁড়ালে দু'জনে তাতে উঠে পড়ে। পাশাপাশি দু'জনে বসে কিন্তু চুপচাপ। তিয়াসা বুঝতে পারে নিলয় বারবার আড়চোখে তাকে দেখছে। আর মনেমনে ভাবছে বরফ গলার আর বেশি সময় নেই।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment