শ্রাবণী সেদিন মাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ভুঁইফোড় এর মত টাকা রোজগারের জন্য গজিয়ে ওঠা পাড়ার নার্সিংহোমগুলিতে ভালো কোন ডাক্তার নেই। আদতেও যারা স্থেথো ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারাও ডক্টর কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে বাবার জেদের কাছে মায়ের জীবনের কোন দাম ছিলো না।
কয়েকদিন আগেই বাবার অসুস্থ্যতার কারণে বেশকিছু টাকা খরচ হয়ে যাওয়াতে ভালো কোন জায়গায় নেওয়ারও কোন ক্ষমতা তাদের ছিলও না। আর সেই মুহূর্তে ইলার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না।সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে অগত্যা এটাই ছিল ভরসা। এখন চিকিৎসা মানেই লক্ষ লক্ষ টাকা। গরীবের বাঁচার পৃথিবীতে কোন অধিকার নেই। প্রকৃত চিকিৎসা মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্তরা তাদের পরিবারের সদস্যের দিতে পারে না। চোখের সামনে তিলতিল করে তাদের চলে যেতে দেখেও তখন বাড়ির লোকের কিছুই করার থাকে না। শেষ পর্যন্ত তখন একটাই শান্তনা "ওইটুকুই আয়ু ছিল।"
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয় ইলা আর নেই। অসহায় শ্রাবণী সারাটা রাত হাসপাতালেই বসে থাকে পাড়ার দু'একজনের সাথে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মা'ই তার সব। প্রয়োজন না পড়লে বাবার সাথে তার কোন কথা কোনদিনও হয় না। আর বাবাকে সে ছোটবেলা থেকেই জমের মত ভয় পায়। বাবা সেই ছোট থেকেই কোনদিন মিষ্টি করে দু'টো কথাও বলেননি। মায়ের আদর ,ভালোবাসা এতটাই ছিলো বাবার কাছ থেকে কিছু না পাওয়াটা কোনদিনও সেভাবে বড় করে সে দেখেনি। আজ মাকে হারিয়ে, নিলয়ের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে সে প্রচন্ড অসহায় হয়ে পরে।
পরদিন সকালে গুলশানে সজ্জিত করে মাকে নিয়েই সে বাড়ি ফেরে অন্যদের সহয়তায়। তখন নিজেকে সে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। সাত্যকি এসে একবার মৃতদেহের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পুনরায় ঘরে চলে যান। সেই রাতেও বহুবার সে নিলয়কে ফোন করেছে।কিন্তু প্রতিবারই সুইচ অফ পেয়েছে। পুরো পৃথিবীতে মা ছাড়া তার আর কেউ ছিলো না। বাবা তো থেকেও নেই। নিলয় তার জীবনে ফ্রেস অক্সিজেন হয়ে এসেছিলো।
শ্রাবণীর মায়ের এই খবর পেয়ে তার কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন। তাদের সাথেই সে মায়ের শেষ কাজ করতে শ্মশানে যায়।যন্ত্র চালিতের মত সকলের কথা শুনে কাজ শেষে ঘরে ফেরে। সমস্ত টাকাপয়সা সেই মুহূর্তে জ্যাঠতুতো দাদারাই খরচ করে। তারপর মাঝে মাঝেই তারা শ্রাবণীর খবর নিতে এসেছে। শ্রাবণীর হাতে কিছু টাকাও ধরিয়ে দিয়েছে। শ্রাবণী না করেনি কারণ সেই মুহূর্তে বাবার কাছ থেকে মায়ের জন্য একটা টাকাও তার নিতে ইচ্ছা করেনি।
স্ত্রী বিয়োগের পরেও সাত্যকির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। শ্মশান থেকে মেয়ে ফিরবার পরেই তিনি তার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে সুইচ অফ করে দেন। কোন বাঁধা দেয়নি শ্রাবণী। বাইরের গেটে সব সময় তালা ঝুলছে। কেউ এলে বাবার ঘরে ঢুকে 'কে এসেছে' জানার পর তিনি চাবি মেয়ের হাতে দেন। দু'টি প্রাণী বাড়িতে কিন্তু কারো মধ্যে কোন কথা নেই। শ্রাবণী হোবিষ্য করতে যে সেদ্ধ ভাত করে তাই বাবার জন্য ঢাকা দিয়ে রেখে দেয়।তিনি তার নিজের সময় মত সেটা খেয়ে নেন।
দাদাদের পরামর্শে তাদের সহায়তায় কালীঘাট গিয়ে মায়ের কাজ করে। দাদারা তাকে বাড়ির কাছে বড় রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে যে যার মত বাড়ি চলে যায়। শ্রাবণী ভাবে বাড়িতে ফিরে সে আর কী করবে? সে বাড়ির রাস্তা না ধরে উল্টোদিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। কত পথ যে সে সেদিন হেঁটেছে তা সে নিজেও জানে না। হঠাৎ একটি গাড়ির ধাক্কায় সে পরে যায়। গাড়ি চালক পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেও সওয়ারি গাড়ি থামিয়ে নেমে আসেন। দুশ্চিন্তা,দুর্ভাবনায় আর সারাদিনের ক্লান্তিতে এমনিতেই সে ছিলো দুর্বল তার উপর গাড়ির সামান্য আঘাতেই সে অজ্ঞান হয়ে পরে। কিন্তু বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয় না।
যখন তার জ্ঞান ফেরে সে তখন একটি নার্সিংহোমে। চারিপাশে তাকিয়ে তার মনেহয় এত বড় একটি নার্সিংহোমে তাকে কে নিয়ে এলো? একজন সিস্টারকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইলো,
-- আমি এখানে কেমন করে এলাম?
সিস্টার হেসে পরে বললেন,
--- কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন আপনি নিজেই সব জানতে পারবেন।
শ্রাবণী চুপ করে আকাশপাতাল ভাবতে লাগলো। হঠাৎ তার মায়ের কথা মনে পড়ায় প্রচণ্ড কষ্ট হতে লাগলো। পাশ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। এমন সময় মাথায় একটি স্নেহের পরশ পেয়ে সে উঠে বসে দেখলো একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক হাসি মুখে তার দিকে চেয়ে আছেন।তিনি জানতে চাইলেন,
--- কেমন আছো মা? বাড়ির ফোন নম্বরটা বলো তো - কাল থেকে তারা তোমার খোঁজ না পেয়ে নিশ্চয় খুব চিন্তা করছেন।
শ্রাবণী কোন উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে ভাবে, যে বাড়িতে মা নেই অত্যাচারী বাবা থেকেও নেই কিছুতেই আর সে বাড়িতে সে ফিরে যাবে না। শ্রাবণীকে চুপ থাকতে দেখে ভদ্রলোক আবারও বললেন,
--- রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছো? কিন্তু বাড়িতে তো ফিরতে হবে। এখানে তো থাকতে পারবে না।আজই তোমাকে ছুটি দিয়ে দেবে।
শ্রাবণী চোখ ভরা জল নিয়ে ভদ্রলোকটির পানে তাকিয়ে বললো,
--- বাড়িতে শুধু আমার মা ছিলেন। তিনি আমায় ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন।আমি একা ওই বাড়িতে থাকতে পারবো না। ভাড়াবাড়ি কয়েকমাস ভাড়া বাকি পরে আছে। আপনি চিন্তা করবেন না আমাকে নিয়ে। আমি অন্য কোথাও চলে যাবো।
সত্য মিথ্যা যায় সে বলুক না কেন তার একটাই প্রতিজ্ঞা ওই বাড়িতে সে কিছুতেই ফিরবে না।
কপালে ভাঁজ পরে ভদ্রলোকটির। তিনি পুণরায় বলেন,
--- সেই অন্য কোথাও কোথায় সেটা বলো।আমি নিজে গিয়ে তোমায় পৌঁছে দেবো। তুমি একা অল্প বয়সী একটি মেয়ে। যে কোন সময় যে কোন বিপদ হতে পারে তোমার। তোমার যাতে কোন বিপদ না হয় সেই জন্যই তো ঈশ্বর আমায় তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি সবকিছু আগে থাকতেই ঠিক করে রাখেন।
শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
--- আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আপনি যদি দয়া করে আমাকে আপনার বাড়িতে ঠাঁই দেন আমি সব কাজ করে দেবো সংসারের।বিনিময়ে থাকা আর খাওয়া হলেই চলবে।
ভদ্রলোকটির চোখে জল এসে গেল। অতীতের কিছু স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি শ্রাবণীর মাথায় হাত রেখে বললেন,
-- কাজের মেয়ে নয় রে তুই আমার বাড়িতে আমার মেয়ে হয়েই থাকবি। আমিও মনেমনে এটাই ভাবছিলাম একবার যদি তুই বলিস তোর কেউ নেই,থাকবার জায়গা নেই তাহলে তোকে আমার কাছেই নিয়ে যাবো। তুই এখানে চুপটি করে বসে থাক। আমি ফর্মালিটিগুলো সেরে আসছি।
ভদ্রলোকের কথা শুনে শ্রাবণীর চোখের জল আর বাঁধ মানেনি। সে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। ভদ্রলোক তার মাথায় হাত বুলিয়ে মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় একটা স্নেহের চুমু দিয়ে বললেন,
--- তোর কাঁদার দিন শেষ।আজ থেকে তুই আমাদের মেয়ে হয়েই আমাদের বাড়িতে থাকবি। একটা মা পাবি তুই। দেখবি সে তোকে কত ভালোবাসবে। একটা দাদাও পাবি। তবে এখন সে এখানে নেই। বাইরে পড়তে গেছে। তুইও ভালো থাকবি আর আমরাও ভালো থাকবো।
কথাগুলো বলে ব্যবসায়ী অরুণাভ দাশগুপ্ত ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণীর দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা যেন আর থামতেই চায় না। ভাবতে থাকে মা তো সারা জীবনের জন্য চলে গেলেন। কিন্তু নিলয়? তাকে সে কিভাবে খুঁজে বের করবে? ফোন নম্বরটা তো কোনদিন সেভাবে খেয়াল করেও দেখেনি যেহেতু নামটা ফোনে সেভ করা ছিল।
ক্রমশ -
( লেখাটির ভালোমন্দ সম্পর্কে মন্তব্যের মাধ্যমে জানালে এবং এই গল্পটিকে আপনারা কিভাবে দেখতে চাইছেন তার গঠনমূলক সমালোচনা যদি করেন লেখার উৎসাহ পাবো🙏,)
No comments:
Post a Comment