একদিন ভালোবাসবে (ষষ্ট পর্ব)
গাড়ি ছুটে চলেছে বেহালা থেকে বারুইপুর। সমান তালে পাল্লা দিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল। ফেব্রুয়ারি মাস। সেভাবে এখনো গরম পড়েনি। কিন্তু নতুন শাড়ি তার উপর কাঞ্জিভরম সাধারণত একটু মোটা হয় ।ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে তিয়াসার বেশ গরম লাগতে লাগলো। তার কপাল, ঘাড়ের গোড়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পেয়ে নিলয় ড্রাইভারকে বলে এসিটা চালিয়ে দিতে।
গড়িয়া মোড়ে একটা বড় মিষ্টির দোকান দেখে নিলয় ড্রাইভারকে একটু সাইড করতে বলে। চালক তখন বলে ওঠেন,
--- দাদা,বেশি দেরি করবেন না তাহলে কিন্তু ওয়েটিং চার্জ দিতে হবে।
-- দিতে হলে দেবো দাদা। কিন্তু মিষ্টি না নিয়ে তো আর শ্বশুরবাড়ি যেতে পারি না।
চালক হেসে উঠেন।আর তিয়াসা চোখ বড় বড় করে নিলয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবে,'বোধবুদ্ধি সব আছে।শুধু বউকে আদর করার ক্ষেত্রেই অতীত সামনে চলে আসছে। কত মেয়েকে এর আগে আদর করেছে সেটা একদিন গুনে গুনে হিসাব নেবো। একদিনেই বুঝে ফেলেছি মশাই তুমি যে ধাতুতে গড়া সেটা একটু নরম।"
কথাগুলো ভেবে নিজের মনেই হাসতে লাগলো। আর এদিকে নিলয় একহাতে দইয়ের এক বিশাল হাড়ি অন্য হাতে এক বিশাল মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে গাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে। তিয়াসা দরজা খুলে সেগুলো নিতে গেলে নিলয় তার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- বাড়িতে কারো সুগার নেই তো?
তিয়াসা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো "না"।
এসিটা চালিয়ে দেওয়াতে তিয়াসা খুব আরাম বোধ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করতে করতে চলে। এই দু'তিনদিনেই সে বুঝে গেছে পরের বাড়িতে গেলে বাবা,মা বোনের জন্য কী পরিমাণ কষ্ট হয়। একটা অচেনা,অজানা পরিবারের লোকদের আপন করে নিজের বাড়ির লোকগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকা যে কতটা কষ্ট তা একমাত্র মেয়েরাই বুঝতে পারে।
গাড়ি এসে বারুইপুর তিয়াসাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।বোনের সাথে গাড়িতে বসে হোয়াটসঅ্যাপেই কথা হচ্ছিল কোথায় ,কতটা এসেছে। সুতরাং নতুন জামাইকে বরণ করার জন্য মা প্রতিবেশী কাকিমার সাথে বরণডালা নিয়ে একদম গেটের কাছে হাজির। তিয়াসা গাড়ি থেকে নেমেই বোনকে জড়িয়ে ধরে। পিয়াসা ওরফে পিয়া দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
--- দিদি,তোকে যা লাগছে না।একদম ফাটাফাটি।
নিলয়ের কনুইতে একটা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
--- নিলয়দা কী দেখতে দেখেছেন আমার দিদিকে?
--- নিলয়ও শালীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়েই বলে,
--- কেন আমাকে কী খারাপ দেখতে নাকি? একদম হিরো হিরো লাগছে না?
কথাটা বলেই নিলয় হাসতে থাকে। তাতে যোগ দেয় পিয়াসাও।
নিলয়ের মধ্যে যে চাপা একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে তা তাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। বিয়ের আগে তার আপত্তি থাকলেও ,ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দিলেও তিয়াসার মোহময়ী রূপের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সত্যিই তার নিজের সাথে নিজেকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এ যুদ্ধ সে না করলেও পারতো। সবকিছু প্রথম রাতেই স্ত্রীকে বলে দিয়ে হালকা হতে পারতো। কিন্তু কেন যে সেদিন তিয়াসাকে সব খুলে বলতে পারলো না তা সে নিজেই জানে না। মিথ্যে এক ঝামেলায় ফেঁসে গিয়ে আজ প্রায় দু'বছর ধরে তাকে মাঝে মাঝেই কোর্টে হাজিরা দিতে হচ্ছে। যা বাড়ি কিংবা অফিসের কেউই জানে না।
তিয়াসাদের বাড়িটা ছোট হলেও খুব সুন্দর। মেইন গেট থেকে বাড়ির দরজা অবধি আসার প্রায় পনের ফুটের মত রাস্তা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। দু'পাশে প্রচুর ফুলগাছ। এখনো তাতে বড়বড় চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া,নানান জাতের বাইকালার পিটুনিয়া, গোলাপ আরও নাম না জানা কত ফুল ফুটে রয়েছে। দেখতে দেখতে যেতে গিয়ে নিলয় সকলের পিছনে পরে যায়।পিয়া দৌড়ে এসে নিলয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
-- নিলয়দা, তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে আর দিদিকে একসাথেই ভিতরে ঢুকতে হবে তো।
নিলয় পিয়ার সাথে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায়। এ বাড়ির নিয়ম অনুসারে নিলয় তিয়াসার হাত ধরে ঘরে ঢুকবে।
ছিমছাম সুন্দর গোছানো ড্রয়িং রুম। যদি এ রুমে এত ফার্নিচার না থাকতো তাহলে নিলয়ের মনেহয় চেয়ার,টেবিল পাতিয়ে জনা চল্লিশেক লোক অনায়াসে যে কোন অনুষ্ঠানে এখানে বসেই খেতে পারবে। নিলয়ের ভাবনায় ছেদ পড়ে পিয়ার কথায়।
-- জানো নিলয়দা ওই যে দেওয়ালে জলছবিটা বাঁধানো দেখছো না - ওটা দিদির আঁকা। দিদি খুব সুন্দর ছবি আঁকে। ওই শোকেসে যত্ত মেমেন্টো সব দিদির পাওয়া। নিলয় উঠে গিয়ে ছবিটার সামনে দাঁড়ায়। ছবিটাকে খুব খুটিয়ে খেয়াল করে একটা বড় জলাশয়ের কাছে অস্তগামী সূর্য্যটা আস্তে আস্তে জলের সাথে যেন মিশে যাচ্ছে। আর ঠিক তার পাশেই একটা বড় গাছের তলায় পিছন দিক দিয়ে একটি তরুণী আর প্রেমিকের কাঁধে মাথা দিয়ে সামনের দিকে দু'জনেই তাকিয়ে রয়েছে। মুগ্ধ হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে নিলয়। পিছন থেকে শ্বাশুড়ী মায়ের ডাকে চমক ভাঙ্গে
--- এসো বাবা একটু কিছু খেয়ে নাও।
নিলয় তাকিয়ে দেখে এক প্লেট মিষ্টি,আর একটি বড় থালায় খান ছ'য়েক বড় বড় ফুলকো লুচি,বেগুন ভাজা আর আলুর দম।এসব দেখে তো নিলয়ের চক্ষু চড়ক গাছ। মনেমনে ভাবে এখন প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে এখন এসব খেলে দুপুরে কখন খাবো? আর খেলেও তো হজম হবে না। সে এসে সোফায় বসে টি টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আমরা তো আসবার সময় টিফিন করেই এসেছি।এখন এত খেলে দুপুরে খেতে পারবো না। আপনি কষ্ট করে করে এনেছেন আমি একটা লুচি আর একটা মিষ্টি খাচ্ছি।
"আমি বলেছিলাম তোমার শ্বাশুড়ী মাকে এই বেলায় এত কিছু কোরো না।কিন্তু কে শোনে কার কথা?" বলতে বলতে তিয়াসার বাবা অনিলবাবু সোফায় নিলয়ের পাশে এসে বসেন। বাইরে দাঁড়িয়ে যারা যারা তাদের বরণ করেছেন সকলকেই তিয়াসার দেখাদেখি নিলয় প্রণাম করেছিলো।এতক্ষন পরে শ্বশুরমশাইয়ের দেখা পেয়ে নিলয় তার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে। নিলয়ের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন,
--- কোন জোর জবরদস্তি নয় তুমি যেটুকু পারবে সেটুকুই খাবে।নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি বাবা শ্বশুরবাড়ি জামাই আসলেই বাড়িতে গিয়ে তার পেটের গন্ডগোল হবেই।
তন্দ্রাদেবী স্বামীর কথা শুনে বলে উঠলেন,
--- কী হচ্ছে কী নতুন জামাইয়ের সাথে?
নতুন আর পুরনো সকলের দশাই এক। নিলয় মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
পিয়া এসে তাকে নিয়ে গেলো উপরে দিদির ঘরে। তিয়াসা তখন সবে শাড়িটা পাল্টে পুরো হলুদ রঙের একটি নাইটি পরেছে। তার গায়ের রঙের সাথে যেন নাইটিটা রঙ নিয়ে চেপে বসে আছে।
-- নিলয়দা এটা আমার আর দিদির ঘর। তোমরা যে দু'দিন থাকবে এই ঘরেই শোবে।আমি বাবা,মায়ের ঘরে থাকবো। আসলে আমাদের ড্রয়িং রুমটাই যা বড়। নিচুতে বেডরুমটা বাবা,মায়ের। রান্নাঘর,বাথরুম তার উপর মায়ের শখে বাড়ির বাইরে অতটা জমি ছাড়তে হয়েছে ফুলের বাগানের জন্য। যা হোক তোমার জন্য এ কটাদিন আমি সক্রিফাইস করলাম। আফটার অল সাতটা নয় পাঁচটা নয় তুমি আমার একটি মাত্র জিজু। কিন্তু আমি তোমাকে দাদা ই বলবো।পিয়া বেরিয়ে যায়। বেশ ভালো লাগে মেয়েটিকে তার। তিয়াসার দিকে তাকিয়ে দেখে ও একমনে ওর শাড়িটা ভাঁজ করছে। হঠাৎ নিলয়ের বুকের ভিতরটা এরূপ করছে কেন? ভীষণ ইচ্ছা করছে তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরতে। ওর ঠোঁট দুটো নিজের মুখের মধ্যে নিতে। ওর ভিতরে একটা শারীরিক পরিবর্তনটাও ও টের পাচ্ছে। কিন্তু কই শ্রাবনীকে এত কাছে পেয়েও বহুবার ওর এই শারীরিক পরিবর্তন তো কোনদিন আসেনি। তবে কেন আজ ? নাহ্ এক্ষুনি নিজেকে কন্ট্রোল করতে হবে।বেরিয়ে পরে ঘর থেকে খোলা ছাদে।
তিয়াসা তার কাপড় গুছিয়ে ব্যাগ থেকে নিলয়ের জন্য একটা পায়জামা আর ফুল হাতা টিশার্ট বের করে দেখে নিলয় খোলা ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে দাঁড়িয়ে তিয়াসা বলে,
-- তোমার জামা,প্যান্ট বের করে রেখে এসেছি।এখানে কোন অসুবিধা হলে আমায় জানিও।
নিলয় আর ওর মুখের দিকে তাকায় না নিজেকে সংযত রাখতে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment