গাড়ি এসে রাজ প্রাসাদ সম বাড়ির কাছে থামলো। অরুণাভ গাড়ি থেকে নেমে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- আয় মা। কোন ভয় নেই তোর। আজ থেকে তুই এই বাড়িরই মেয়ে। এখানে তোর কোন অযত্ন,অবহেলা কিছুই হবে না। তবে কখনো যদি তোর কিছুতে খারাপ লাগে সঙ্গে সঙ্গে আমায় জানাবি।
কথা বলতে বলতে তিনি শ্রাবণীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। এত বড়লোকের বাড়িতে শ্রাবণী আগে কখনোই ঢোকেনি।
--- মারে, তুই এত গম্ভীর থাকিস না। দাঁড়া আমি তোর মাকে -
কথাটা বলেই তিনি কিছুটা শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-- আমাকে আর আমার স্ত্রীকে বাবা,মা বলে ডাকতে তোর কোন অসুবিধা নেই তো?
শ্রাবণী তার নিজের বাবার কাছ থেকে কোনদিন কোন ভালোবাসা পায়নি। পিতৃসম এই মানুষটি প্রথম থেকেই শ্রাবণীকে বড্ড আপন করে নিয়েছেন। নিজের মেয়ের জায়গায় বসিয়েছেন। পিতার স্নেহ, ভালোবাসা কী জিনিস শ্রাবণী তার জীবনে কোনদিন অনুভব করতে পারেনি। সে ছলছল চোখে অরুণাভকে বললো,
--- মায়ের কাছে যাবার আগে তোমায় একটা প্রণাম করি বাবা।
অরুণাভর চোখদু'টি জলে ভর্তি হয়ে গেলো। তিনি শ্রাবণীকে বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় একটা স্নেহের পরশ এঁকে দিলেন। আর ঠিক এই মুহূর্তে অঞ্জলী ঘরে ঢুকে বললেন,
--- কে এসেছে গো?
শ্রাবণীর হাত ধরে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন,
--- দেখো তো অঞ্জু তুমি ওকে চিনতে পারো কিনা?
অঞ্জলী অনেকক্ষণ শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বুদ্ধিমতী শ্রাবণী অঞ্জলীকে একটা প্রণাম করে বললো,
--- কেমন আছো মা?
অনেকদিন পর তার কুহুর সমবয়সী কারো মুখে মা ডাক শুনে তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। দু'হাতে শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বলে উঠলেন,
--- তুই এতদিন কোথায় ছিলি কুহু? আমায় ছেড়ে থাকতে তোর একটুও কষ্ট হয়নি।
শ্রাবণী গাড়ির মধ্যেই অঞ্জলীর সব কথা শোনার ফলে সে ও এই প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধিমতীর মতই বললো,
--- কেন মা তোমার সাথে তো আমি রোজ কথা বলি। তুমি আজকাল কিছুই মনে রাখতে পারো না।
অঞ্জলী শ্রাবণীকে বুকের সাথেই চেপে ধরে বললেন,
--- বয়স হয়েছে তো কিছুই মনে থাকে না। হ্যাঁ আমি তো তোর সাথে রোজই কথা বলি। মাথা থেকে কথাটা একদম বেরিয়ে গেছিলো।তুই বলাতে আমার মনে পড়লো। চল তুই তোর ঘরে চল। ফ্রেস হয়ে কিছু খেয়ে নিবি।
অদূরে দাঁড়িয়ে অরুণাভ চোখের জল ফেলতে ফেলতে সব দেখছিলেন আর মনেমনে বাচ্চা মেয়েটার বুদ্ধির তারিফ করছিলেন। এবার তিনি নিশ্চিত এই মেয়েটিই তার অঞ্জুকে সুস্থ করে তুলবে। কিন্তু এই মেয়েটির জন্য তাকে ভাবতে হবে। মেয়েটিকে দেখে তো মনেহয় পড়াশুনা জানে। কতদূর পড়েছে ওর আরও পড়ার ইচ্ছা আছে কিনা সব জেনে নিয়ে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও একটা চিন্তা,ভাবনা করতে হবে। মেয়েটির মধ্যে একটা সেবিকা সুলভ মনোভাব আছে। বড় বড় ডাক্তাররা যা পারেনি ওই পারবে অঞ্জুকে সুস্থ করে তুলতে ।
সদ্য মা হারা শ্রাবণী নতুন মায়ের সাথে গল্প করতে করতে চোখের জল ফেলছিলো। আর অঞ্জলী তার আঁচল দিয়ে মাঝে মাঝে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলছিলেন,
-- কাঁদছিস কেন? এই তো আমি তোর সাথে আছি।
টেবিলের অন্যদিকে অরুণাভ বসে সব খেয়াল করছিলেন।তিনি বুঝতে পারছিলেন সদ্য মা হারা মেয়েটি তার মায়ের কথা মনে করেই চোখের জল ফেলছে আর এক মায়ের হাতের পরশ পেয়ে। তিনি চুপচাপ শুধু শ্রাবণীর কথাবার্তা,কার্যকলাপ খেয়াল করছেন। অঞ্জলী যখন শ্রাবণীকে বললেন,
-- তোর আলমারির থেকে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে তাড়াতাড়ি। আমি তোর প্রিয় চাউমিন করবো এখন।
কোন আলমারি,কোথায় বাথরুম শ্রাবণী কিছুই জানে না। কিন্তু সে ব্যাপারটাকে কী সুন্দরভাবে ম্যানেজ করলো। আবদারের সুরে বললো,
--- মা আমি কোন জামাটা পরবো তুমি বের করে বাথরুমে একটু রেখে দাও।
-- পাগলী মেয়ে! তুই সেই একই রকম থেকে গেলি।
অরুণাভ যতই মেয়েটিকে দেখছেন ততই অবাক হচ্ছেন। ভগবান যেন নিজে না এসে এই মেয়েটিকেই পাঠিয়েছেন তার পরিবারে সেই পূর্বের সুখ,শান্তি ফিরিয়ে দিতে।
অঞ্জলী নিজে হাতে মেয়েটিকে খাইয়ে দিচ্ছে আর অনর্গল কথা বলে চলেছেন তার কুহুর সাথে। রাতে ছেলের সাথে ফোনে যখন কথা হয় অরুণাভর তিনি শুধু তাদের এখনকার কুহুর গল্পই করে গেলেন। ছেলে সব শুনে বাবাকে বললো,
-- দিনকাল ভালো না বাবা।একটা অজানা, অচেনা মেয়েকে এনে দিদির জায়গায় বসিয়ে এত খুশি হয়ো না। চোখ, কান খোলা রেখো। জিনিসপত্র খুব সাবধান। মায়ের দিকেও এখন একটু বেশি খেয়াল রেখো। কী করতে মা কী করে বসবেন মেয়েটিকে নিয়ে তার কোন খোঁজ নেই।
অরুণাভ অনেক করে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু শেষমেষ ছেলের যুক্তির কাছে চুপ করে গিয়ে বললেন,
--- নিজের চোখে মেয়েটিকে দেখলে এত কথা বলতিস না।
--- দু'মাস পরে ফিরছি।অন্তত সেই পর্যন্ত মেয়েটিকে চোখে চোখে রেখো। এই মেয়েটার অন্য কোন মতলব আছে বলেই তোমার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল। আজকাল আকছার এরূপ ঘটনা ঘটে।
--- নেগেটিভ সাইডটা একটু কম ভাব খোকা। এত বয়স হয়েছে মানুষ চিনতে আমি ভুল করিনি। আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা আসার সাথে সাথেই তোর মা তার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। কতদিন তোর মাকে আমি এভাবে হাসতে দেখিনি।
-- তোমার এই এক দোষ বাবা! অল্পতেই গলে যাও। নাহ্ ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। তবুও বলছি সবাই একটু সাবধানে থেকো।
ছেলে ফোন রেখে দিলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে তার কুহুর ঘরের দিকে যেতে যেতে একটি মিষ্টি গানের গলা পেলেন। " ও তোতা পাখিরে,শিকল ছেড়ে উড়িয়ে দেবো আমার মাকে যদি এনে দাও -" । ধীর পায়ে মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। এই কয়েক বছরে তিনি হাতে গুনে বলতে পারবেন ক'দিন তিনি এ ঘরে এসেছেন। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে শ্রাবণী গান গাচ্ছে আর চোখ থেকে তার অবিরল ধারায় জল পড়ছে। বালিশে মাথা দিয়ে অঞ্জলী বেশ কয়েক বছর পরে কড়া ডোজের ওষুধ ছাড়াই ঘুমাচ্ছে। অরুণাভ এসব দেখে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে চোখ ভরা জল নিয়ে শ্রাবণীর কাছে এসে যখন দাঁড়ালেন শ্রাবণী ইশারা করে তাকে কথা বলতে নিষেধ করে আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে এলো পিছন পিছন অরুণাভ।
ক্রমশ