Tuesday, February 28, 2023

একদিন ভালোবাসবে (১৪ তম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (১৪ তম পর্ব)

  গাড়ি এসে রাজ প্রাসাদ সম বাড়ির কাছে থামলো। অরুণাভ গাড়ি থেকে নেমে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- আয় মা। কোন ভয় নেই তোর। আজ থেকে তুই এই বাড়িরই মেয়ে। এখানে তোর কোন অযত্ন,অবহেলা কিছুই হবে না। তবে কখনো যদি তোর কিছুতে খারাপ লাগে সঙ্গে সঙ্গে আমায় জানাবি।
 কথা বলতে বলতে তিনি শ্রাবণীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। এত বড়লোকের বাড়িতে শ্রাবণী আগে কখনোই ঢোকেনি। 
--- মারে, তুই এত গম্ভীর থাকিস না। দাঁড়া আমি তোর মাকে - 
 কথাটা বলেই তিনি কিছুটা শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-- আমাকে আর আমার স্ত্রীকে বাবা,মা বলে ডাকতে তোর কোন অসুবিধা নেই তো?
 শ্রাবণী তার নিজের বাবার কাছ থেকে কোনদিন কোন ভালোবাসা পায়নি। পিতৃসম এই মানুষটি প্রথম থেকেই শ্রাবণীকে বড্ড আপন করে নিয়েছেন। নিজের মেয়ের জায়গায় বসিয়েছেন। পিতার স্নেহ, ভালোবাসা কী জিনিস শ্রাবণী তার জীবনে কোনদিন অনুভব করতে পারেনি। সে ছলছল চোখে অরুণাভকে বললো,
--- মায়ের কাছে যাবার আগে তোমায় একটা প্রণাম করি বাবা।
 অরুণাভর চোখদু'টি জলে ভর্তি হয়ে গেলো। তিনি শ্রাবণীকে বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় একটা স্নেহের পরশ এঁকে দিলেন। আর ঠিক এই মুহূর্তে অঞ্জলী ঘরে ঢুকে বললেন,
--- কে এসেছে গো?
শ্রাবণীর হাত ধরে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন,
--- দেখো তো অঞ্জু তুমি ওকে চিনতে পারো কিনা?
অঞ্জলী অনেকক্ষণ শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বুদ্ধিমতী শ্রাবণী অঞ্জলীকে একটা প্রণাম করে বললো,
--- কেমন আছো মা?
 অনেকদিন পর তার কুহুর সমবয়সী কারো মুখে মা ডাক শুনে তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। দু'হাতে শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বলে উঠলেন,
--- তুই এতদিন কোথায় ছিলি কুহু? আমায় ছেড়ে থাকতে তোর একটুও কষ্ট হয়নি।
 শ্রাবণী গাড়ির মধ্যেই অঞ্জলীর সব কথা শোনার ফলে সে ও এই প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধিমতীর মতই বললো,
--- কেন মা তোমার সাথে তো আমি রোজ কথা বলি। তুমি আজকাল কিছুই মনে রাখতে পারো না।
  অঞ্জলী শ্রাবণীকে বুকের সাথেই চেপে ধরে বললেন,
--- বয়স হয়েছে তো কিছুই মনে থাকে না। হ্যাঁ আমি তো তোর সাথে রোজই কথা বলি। মাথা থেকে কথাটা একদম বেরিয়ে গেছিলো।তুই বলাতে আমার মনে পড়লো। চল তুই তোর ঘরে চল। ফ্রেস হয়ে কিছু খেয়ে নিবি।
 অদূরে দাঁড়িয়ে অরুণাভ চোখের জল ফেলতে ফেলতে সব দেখছিলেন আর মনেমনে বাচ্চা মেয়েটার বুদ্ধির তারিফ করছিলেন। এবার তিনি নিশ্চিত এই মেয়েটিই তার অঞ্জুকে সুস্থ করে তুলবে। কিন্তু এই মেয়েটির জন্য তাকে ভাবতে হবে। মেয়েটিকে দেখে তো মনেহয় পড়াশুনা জানে। কতদূর পড়েছে ওর আরও পড়ার ইচ্ছা আছে কিনা সব জেনে নিয়ে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও একটা চিন্তা,ভাবনা করতে হবে। মেয়েটির মধ্যে একটা সেবিকা সুলভ মনোভাব আছে। বড় বড় ডাক্তাররা যা পারেনি ওই পারবে অঞ্জুকে সুস্থ করে তুলতে ।
 
 সদ্য মা হারা শ্রাবণী নতুন মায়ের সাথে গল্প করতে করতে চোখের জল ফেলছিলো। আর অঞ্জলী তার আঁচল দিয়ে মাঝে মাঝে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলছিলেন,
-- কাঁদছিস কেন? এই তো আমি তোর সাথে আছি।
টেবিলের অন্যদিকে অরুণাভ বসে সব খেয়াল করছিলেন।তিনি বুঝতে পারছিলেন সদ্য মা হারা মেয়েটি তার মায়ের কথা মনে করেই চোখের জল ফেলছে আর এক মায়ের হাতের পরশ পেয়ে। তিনি চুপচাপ শুধু শ্রাবণীর কথাবার্তা,কার্যকলাপ খেয়াল করছেন। অঞ্জলী যখন শ্রাবণীকে বললেন,
-- তোর আলমারির থেকে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে তাড়াতাড়ি। আমি তোর প্রিয় চাউমিন করবো এখন।
 কোন আলমারি,কোথায় বাথরুম শ্রাবণী কিছুই জানে না। কিন্তু সে ব্যাপারটাকে কী সুন্দরভাবে ম্যানেজ করলো। আবদারের সুরে বললো,
--- মা আমি কোন জামাটা পরবো তুমি বের করে বাথরুমে একটু রেখে দাও।
-- পাগলী মেয়ে! তুই সেই একই রকম থেকে গেলি।
 অরুণাভ যতই মেয়েটিকে দেখছেন ততই অবাক হচ্ছেন। ভগবান যেন নিজে না এসে এই মেয়েটিকেই পাঠিয়েছেন তার পরিবারে সেই পূর্বের সুখ,শান্তি ফিরিয়ে দিতে। 
 অঞ্জলী নিজে হাতে মেয়েটিকে খাইয়ে দিচ্ছে আর অনর্গল কথা বলে চলেছেন তার কুহুর সাথে। রাতে ছেলের সাথে ফোনে যখন কথা হয় অরুণাভর তিনি শুধু তাদের এখনকার কুহুর গল্পই করে গেলেন। ছেলে সব শুনে বাবাকে বললো,
-- দিনকাল ভালো না বাবা।একটা অজানা, অচেনা মেয়েকে এনে দিদির জায়গায় বসিয়ে এত খুশি হয়ো না। চোখ, কান খোলা রেখো। জিনিসপত্র খুব সাবধান। মায়ের দিকেও এখন একটু বেশি খেয়াল রেখো। কী করতে মা কী করে বসবেন মেয়েটিকে নিয়ে তার কোন খোঁজ নেই।
 অরুণাভ অনেক করে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু শেষমেষ ছেলের যুক্তির কাছে চুপ করে গিয়ে বললেন,
--- নিজের চোখে মেয়েটিকে দেখলে এত কথা বলতিস না।
--- দু'মাস পরে ফিরছি।অন্তত সেই পর্যন্ত মেয়েটিকে চোখে চোখে রেখো। এই মেয়েটার অন্য কোন মতলব আছে বলেই তোমার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল। আজকাল আকছার এরূপ ঘটনা ঘটে। 
--- নেগেটিভ সাইডটা একটু কম ভাব খোকা। এত বয়স হয়েছে মানুষ চিনতে আমি ভুল করিনি। আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা আসার সাথে সাথেই তোর মা তার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। কতদিন তোর মাকে আমি এভাবে হাসতে দেখিনি।
-- তোমার এই এক দোষ বাবা! অল্পতেই গলে যাও। নাহ্ ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। তবুও বলছি সবাই একটু সাবধানে থেকো।

  ছেলে ফোন রেখে দিলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে তার কুহুর ঘরের দিকে যেতে যেতে একটি মিষ্টি গানের গলা পেলেন। " ও তোতা পাখিরে,শিকল ছেড়ে উড়িয়ে দেবো আমার মাকে যদি এনে দাও -" । ধীর পায়ে মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। এই কয়েক বছরে তিনি হাতে গুনে বলতে পারবেন ক'দিন তিনি এ ঘরে এসেছেন। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে শ্রাবণী গান গাচ্ছে আর চোখ থেকে তার অবিরল ধারায় জল পড়ছে। বালিশে মাথা দিয়ে অঞ্জলী বেশ কয়েক বছর পরে কড়া ডোজের ওষুধ ছাড়াই ঘুমাচ্ছে। অরুণাভ এসব দেখে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে চোখ ভরা জল নিয়ে শ্রাবণীর কাছে এসে যখন দাঁড়ালেন শ্রাবণী ইশারা করে তাকে কথা বলতে নিষেধ করে আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে এলো পিছন পিছন অরুণাভ।

ক্রমশ 

    

Monday, February 27, 2023

একদিন ভালোবাসবে (১৩ তম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (১৩ তম পর্ব)

  অরুণাভর মা ছেলেকে ডেকে বললেন,
--- পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তোদের কোন উপায় নেই। হয়ত পৃথিবীর আমিই প্রথম মা হবো যে কিনা নিজের সন্তানকে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যেতে বলছে। মেয়েটিকে আমিও খুব ভালোবাসি।তোর জন্যই ব্যাপারটা এত জটিল হয়ে গেলো!এত দেরি করে ব্যাপারটা আমায় জানালি। সে যাই হোক অঞ্জলীর বাবা,মায়ের মানসম্মান নষ্ট হবে বুঝেও আমি স্বার্থপরের মত আমার ছেলের সুখের কথাটাই ভাববো। তোরা আজ রাতেই পালাবি।

 অরুণাভর মা কিছু টাকা আর একটা সোনার চেন বের করে গুছিয়ে রাখলেন। তার অনুকে বললেন,
-- সন্ধ্যায় বেরিয়ে তোরা প্রথম কালীঘাট মন্দির গিয়ে সেখান থেকে অঞ্জলীকে সিঁদুর পরিয়ে কোন হোটেলে গা ঢাকা দিয়ে থাকবি। অঞ্জলীর বিয়ের তারিখটা চলে গেলে বাকি সব ভাবা যাবে। আর এই চেনটা ওকে দিবি। বাদবাকি সব তোরা ফিরে এলে হবে।

  অরুণাভ,অঞ্জলী সেই মত সেদিনই বেরিয়ে পড়ে। বেশ কয়েকদিন পরে তারা যখন তাদের বাড়িতে ফিরে আসে প্রথম অবস্থায় অঞ্জলীর বাড়ি থেকে অশান্তি করলেও তাদের প্রথম সন্তান কুহেলির জন্মের পরে আর অঞ্জলীর কাছ থেকে আর্থিক দিক দিয়ে নানান উপকৃত হয়ে তারা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান "যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে।" 
  তারপর সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। পরে তাদের একটি ছেলে হয়েছে। নাম অসিত। সুখের সংসারে হঠাৎ করেই ছন্দপতন! মেয়ে কুহেলীর কিছুদিন ধরেই হঠাৎ করেই পায়ে ব্যথা। হাঁটতে কষ্ট হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া হয়। ওষুধে ব্যথা তো কমেই না বরং ডান হাতেও ব্যথা শুরু হয়। শিরদাঁড়ায় ব্যাথার জন্য সে শুতেই পারে না। চলে যায় স্বামী,স্ত্রী দু'জনে মিলে চেন্নাই। মেয়ের বয়স তখন কুড়ি আর ছেলে চৌদ্দ বছরের। ছেলেকে শ্বশুর,শ্বাশুড়ীর কাছে রেখেই তারা ছোটে। সেখানে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ধরা পরে কুহেলীর বোন ক্যান্সার। দীর্ঘ দু'মাস মারণ ব্যাধির সাথে সংগ্রাম করেও তারা মেয়েকে নিয়ে ফিরতে পারে না। সেই থেকেই অঞ্জলী কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

   কুহেলীর ঘরে আজও তার জিনিসপত্র সেই আগের মত করেই গুছানো। অঞ্জলী সেই ঘরে সময়ে,অসময়ে ঢুকে জোরে জোরেই তার কুহুর সাথে কথা বলে কখনো কাঁদে আবার কখনো বা হাসে। খাবার নিয়ে কুহেলীর ছবির সামনে ধরে তাকে খাওয়ানোর জন্য জোরাজুরিও করে। অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছে ওষুধের উপরেই আছে কিন্ত কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু সংসারের কাজে তার কোন অনীহা নেই। সময়মত স্বামী,ছেলেকে খেতে দেওয়া, যতদিন শ্বশুর,শ্বাশুড়ি বেঁচে ছিলেন তাদের দেখভাল করা সবই করেছেন নিয়ম মেনে ঘড়ির কাঁটা ধরে। কিন্তু যখন কুহেলীর ঘরে ঢোকেন তখন তিনি অন্য মানুষ। তার একটা আলাদা জগৎ তৈরি হয়। সেই জগতে সে আর কুহেলী ছাড়া অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই।
  
 তাকে এই স্মৃতি থেকে বের করতে ঘর তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল কিন্তু তাতে সে আরও অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। তার পাগলামী দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।তখন সে আর সংসারের কাজ করতে পারে না। দিনরাত শুয়ে বসে সে তার কুহুর সাথে গল্প করে। অবস্থা দিনদিন।খারাপ হচ্ছে দেখে পুনরায় তারা কুহেলীর ঘরের তালা খুলে দিয়েছে। আর তারপরেই সে আবার পূর্বের মত।ছেলে এবং স্বামীর সাথে যখন খাবার টেবিলে বসে তখন তার কুহুর গল্প,আজ কুহু কী বলেছে, মায়ের কাছে কী খেতে চেয়েছে সব মনগড়া কল্পনা নিয়ে বলে চলেন। চুপচাপ বাপ,ছেলে অঞ্জলীর কথা শোনে। এইভাবেই অঞ্জলীর জীবন এগোতে থাকে।

  অরুণাভ শ্রাবণীকে নিয়ে যখন ফেরেন তখন গাড়ির মধ্যে তার কাছে জানতে চান,
--- মা, তোর নামটাই তো জানা হয়নি। তবে তোর নাম যায় হোক আজ থেকে তুই আমাদের কুহেলী। তোকে আমরা কুহু বলেই ডাকবো।
 শ্রাবণী মাথা হেলিয়ে তার সম্মতি জানায়। কিন্তু কারণ জানতে চাইলো না। অরুণাভ সংক্ষেপে তার মেয়ের অকালে চলে যাওয়ার গল্প শ্রাবণীকে শোনান। মেয়ে চলে যাওযার পর তার স্ত্রীর বর্তমান পরিস্থিতি কী সেটাও বলতে ভোলেন না। শ্রাবণীর যা বয়স তার কুহুও ঠিক এই বয়সেই চলে গেছিলো। তাই অরুণাভর দৃঢ় বিশ্বাস এই মেয়েটিকে দেখেই তার অঞ্জলী সুস্থ হবেন। শুধু স্ত্রীর সুস্থতার জন্যই যে তিনি তাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন তা কিন্তু মোটেই নয়। একা একটা মেয়ে যার পৃথিবীতে কেউ নেই এটা জানার পর তার ভিতর মানবিকতাও জেগে উঠেছিল। সঙ্গে পিতৃত্বও ছিল।

  ভগবানের কী অসীম লীলা! বিয়ের কনে বিয়ের মাত্র ক'দিন আগেই পালিয়ে গেছিলো বলে সাত্যকি সেই তাকিখেই বিয়ে করলেও এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তার স্ত্রী,কন্যার সাথে ভালো ব্যবহার করেননি একটা অন্য মেয়ের দোষের কারণে।অবহেলায় প্রায় ঢুকতে ঢুকতে ইলা যখন চলে গেলেন তার মেয়ে আশ্রয় পেলো ঠিক সেই পরিবারটির কাছে। যতদিন ইলা বেঁচে ছিলেন নিজের মানসিক অশান্তিতে অচেনা,অজানা এই মহিলার প্রতি তার একটা তীব্র রাগ ছিল। ইলা মনে করতেন তার দুর্বিষহ জীবনের জন্য একমাত্র সেই মেয়েটিই দায়ী যে কিনা বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পরে পালিয়ে গেছিলো। একেই বলে বোধহয় ভবিতব্য! 

ক্রমশ 

  

Sunday, February 26, 2023

একদিন ভালোবাসবে (১২তম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (১২ তম পর্ব)

 ধনীর দুলাল অরুণাভ দাশগুপ্ত ছেলেবেলা থেকেই ভালোবাসে পাড়ার গরীব ঘরের মাধ্যমিক পাশ করা সুন্দরী অঞ্জলীকে। অঞ্জলীর অরুণদাকে ভালো লাগলেও কোনদিন ভয়ে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। অরুণদা ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান। বাবার বিশাল ব্যবসা। এমন একজন মানুষকে সামান্য লেড কারখানার কর্মচারীর মেয়ে ভালোবাসে একথা যদি শুধু অরুণদা কেন পাড়ার যেই শুনবে সেই ছি ছি করবে। লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবে না পরিবারের কেউ। অঞ্জলী তাই তার ভালোবাসার কথা নিজের মনেই রেখে দেয়। বাবা অঞ্জলীর বিয়ে ঠিক করেন। পাত্র নিজে দেখে পছন্দ করে যাওয়ার পর বাড়ির সকলে এসে অঞ্জলীকে দেখে যায়। গরীবের ঘরে জন্ম হলেও অঞ্জলী শুধু রূপই নয় গুনেও ছিল অনন্যা। জন্মগত সুন্দর একটি গানের গলা ছিল। কোনদিনও গান শেখেনি কিন্তু যে গানটাই শুনতো বিশেষত সন্ধ্যা মুখপাধ্যায়ের গান সে অবলীলায় গেয়ে দিত। পাড়ার ছোটখাটো ফ্যানশানেও মাইক্রোফোন হাতে দিব্যি বাদ্য যন্ত্রের সাথে সুর,তাল,লয় ঠিক রেখে হাততালি কুড়িয়েছে। কিন্তু গরীবের ঘরে জন্ম হওয়ার ফলে মাধ্যমিকের পর আর বেশীদুর পড়ার সুযোগ তার হয়নি গান তো দূরহস্ত।

   পড়াশুনায় খুব ভালো না হলেও কোনদিন ফেল সে করেনি। অরুণাভ অঞ্জলীর শুধু রূপেই নয় তার গানের এই অসাধারণ গুনেও ছিল মুগ্ধ।
  অরুণাভ ছিল একটু মুখচোরা স্বভাবের ছেলে। ফর্সা, ছ'ফুটের উপর হাইট, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত দু'টি চোখ। বাবা,মায়ের বাধ্য সন্তান। একই পাড়ায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে অরুণাভর মায়ের সাথে অঞ্জলীর একটা সুসম্পর্ক ছিল। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলেই অরুণাভর মা অঞ্জলীদের বাড়ির সকলকে নিমন্ত্রণ করতেন আর অঞ্জলীকে বলে দিতেন,
--- তুই আগে গিয়ে আমার হাতে হাতে একটু কাজ করে দিবি। 
 এই কাজ করতে গিয়েই অরুণাভর সাথে যা দু'একটা কথা হত। একদিন কোন একটা কাজে অরুণাভর ঘরে ঢুকে অঞ্জলী দেখে টেবিলে ঝুঁকে অরুণদা কিছু একটা করছে। আস্তে আস্তে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় অঞ্জলী। অরুণাভ তখন সুচিত্রা সেনের একটি ছবি আঁকছে সুচিত্রা সেনের ছোট্ট একটা ফটোকপি দেখে। অরুণাভ তার কাজ নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিল যে অঞ্জলী তার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতেই পারেনি।অঞ্জলী ঝুঁকে পরে অরুণাভর আঁকা দেখছিল। ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস পড়ছে তবুও অরুণাভর কোন খেয়াল নেই। ছবিটা একমনে দেখতে দেখতে অঞ্জলী হঠাৎ বলে উঠলো,
--- অরুণদা, তুমি কী সুন্দর ছবি আঁক। আমার একটা ছবি এঁকে দেবে?
 অরুণাভ তার ওই সুন্দর চোখদুটি দিয়ে গভীর ভাবে যখন অঞ্জলীর দিকে তাকালো তখন অঞ্জলীর বুকের ভিতর যেন শুন্য হয়ে গেছে। শরীরের ভিতরে একটা কম্পন শুরু হয়েছে।
 অরুণাভ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারে অঞ্জলীর মনের কথা। সে অঞ্জলীর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-- আমি জানি তোমার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে তোমাকে দেখে আমার মনেহচ্ছে এই বিয়েতে তোমার খুব একটা মত নেই। তুমিও মনেহয় আমারই মত বোকা।মুখ ফুটে কোন কথা বলতে পারো না। ঈশ্বর আজ আমাদের দু'জনকে এইখানে দাঁড় করিয়েছেন যাতে দু'জনে দু'জনার মনের কথাগুলো শেয়ার করতে পারি।
 এরপরই আচমকা অঞ্জলীর একটি হাত ধরে বলে,
-- তোমায় এই আমি ছুঁয়ে আছি।আমি জানি আমায় ছুঁয়ে তুমি মিথ্যে বলবে না।সত্যি করে বলো তো তুমি আমায় ভালোবাসো তাই না?
 অঞ্জলী তখন ঠকঠক করে কাঁপছে। ফর্সা গায়ের রং লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই মায়াভরা চোখ দু'টি থেকে টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো।
-- বোকা মেয়ে! ভালোবাসার কথা বলতে কেউ কাঁদে?
-- আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। আমরা যে খুব গরীব। আর বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন তো।
-- গরীব বলে কী ভালোবাসা আসতে পারে না জীবনে?
--- কিন্তু তোমাদের সাথে আমাদের কোনই মিল নেই। তোমরা কত বড়লোক।
-- এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ওসব আমার চিন্তার বিষয়। এখন যেটা কথা হচ্ছে সেটা হল বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। মাকে আমি রাজি করিয়ে ফেলবো। আর মায়ের কথাতে বাবাও রাজি হবেন। কিন্তু তোমাদের বাড়িতে কেউ রাজি হবেন না কারণ বিয়ের তারিখটাই ফাইনাল হয়ে গেছে। এই কটাদিন শুধু সুযোগ খুঁজেছি কখন তোমায় একা পাবো। কিন্তু কিছুতেই তোমার দেখা পাচ্ছিলাম না। তাছাড়াও ভাবছিলাম তুমি আমায় নিয়ে কিছু ভাবছো কিনা। দেখো আজ ঠিক সুযোগ পেয়ে গেলাম। ঈশ্বরই এ সুযোগটা আমাদের করে দিয়েছেন।তিনিও চান আমরা এক হই।
  অরুণাভ দু'হাতে অঞ্জলীকে বুকের মাঝে চেপে ধরে। অঞ্জলী বিনা বাঁধায় নিজেকে সমর্পণ করে অরুণাভর বুকে। অরুণাভ অঞ্জলীর মুখটা একটু উপরে তুলে নিয়ে তার ঠোঁট দু'টিতে গভীর চুম্বন করে বলে,
--- ওই তারিখের আগেই আমরা বিয়ে করবো। তুমি কিচ্ছু ভেবো না। আগে আমি মায়ের সাথে কথা বলি তারপর তার কথামত আমরা কাজ করবো। ভয় পাবে না একদম। মা তোমায় খুব পছন্দ করেন আমি জানি। আমাদের ডিসিশন নিতে শুধু একটু দেরি হয়ে গেলো এই যা -। তবে ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে।

  সেদিন রাতেই অরুণাভ মাকে তার ভালোবাসার কথা জানায়। বিয়েটা ঠিক হয়ে যাওয়াতেই মায়ের যা একটু আপত্তি। কিন্তু তিনি তার ছেলেকে কথা দেন যেভাবেই হোক তার বাবাকে রাজি করাবেন। 

  অরুণাভর বাবারও সেই একই কথা। বিয়েটা তো ঠিক হয়ে গেছে। এখন কেমনভাবে ওই মেয়ের সাথে তিনি ছেলের বিয়ের জন্য রাজি হবেন?
-- এতদিন তোমার ছেলে কি ঘুমাচ্ছিল। একদম শেষ মুহূর্তে এসে অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে।
-- জানোই তো তোমার ছেলে কী ধরনের। মুখ ফুটে কোন কথা পরিষ্কার করে কখনোই বলে না। 
-- তা আমাকে এখন কী করতে হবে? অঞ্জলীর বাবা,মায়ের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াতে হবে?
-- সে কথা কখন বললাম আমি? তুমি শুধু রাজি আছ কিনা সেটাই বলো। যা করার আমি করবো। মেয়েটিকে আমিও খুব ভালোবাসি। কী লক্ষীমন্ত স্বভাব। আমার ঘরে বউ হয়ে আসলে ঘর আলো করে থাকবে।
-- তা তুমি যেভাবে তোমার ঘর আলো করতে চাও করো। আমার কোন আপত্তি নেই। কারণ আমার অনু কষ্ট পাক সেটা আমার কাছেও কষ্টদায়ক হবে। তবে ভেবেচিন্তে কাজ কোরো পুলিশের হ্যাপা যাতে না হয়।

ক্রমশ 

একদিন ভালোবাসবে (১১ তম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে ( ১১ পর্ব)

  শ্রাবণী সেদিন মাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ভুঁইফোড় এর মত টাকা রোজগারের জন্য গজিয়ে ওঠা পাড়ার নার্সিংহোমগুলিতে ভালো কোন ডাক্তার নেই। আদতেও যারা স্থেথো ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারাও ডক্টর কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে বাবার জেদের কাছে মায়ের জীবনের কোন দাম ছিলো না। 
      কয়েকদিন আগেই বাবার অসুস্থ্যতার কারণে বেশকিছু টাকা খরচ হয়ে যাওয়াতে ভালো কোন জায়গায় নেওয়ারও কোন ক্ষমতা তাদের ছিলও না। আর সেই মুহূর্তে ইলার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না।সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে অগত্যা এটাই ছিল ভরসা। এখন চিকিৎসা মানেই লক্ষ লক্ষ টাকা। গরীবের বাঁচার পৃথিবীতে কোন অধিকার নেই। প্রকৃত চিকিৎসা মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্তরা তাদের পরিবারের সদস্যের দিতে পারে না। চোখের সামনে তিলতিল করে তাদের চলে যেতে দেখেও তখন বাড়ির লোকের কিছুই করার থাকে না। শেষ পর্যন্ত তখন একটাই শান্তনা "ওইটুকুই আয়ু ছিল।" 

  কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয় ইলা আর নেই। অসহায় শ্রাবণী সারাটা রাত হাসপাতালেই বসে থাকে পাড়ার দু'একজনের সাথে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মা'ই তার সব। প্রয়োজন না পড়লে বাবার সাথে তার কোন কথা কোনদিনও হয় না। আর বাবাকে সে ছোটবেলা থেকেই জমের মত ভয় পায়। বাবা সেই ছোট থেকেই কোনদিন মিষ্টি করে দু'টো কথাও বলেননি। মায়ের আদর ,ভালোবাসা এতটাই ছিলো বাবার কাছ থেকে কিছু না পাওয়াটা কোনদিনও সেভাবে বড় করে সে দেখেনি। আজ মাকে হারিয়ে, নিলয়ের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে সে প্রচন্ড অসহায় হয়ে পরে।

  পরদিন সকালে গুলশানে সজ্জিত করে মাকে নিয়েই সে বাড়ি ফেরে অন্যদের সহয়তায়। তখন নিজেকে সে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। সাত্যকি এসে একবার মৃতদেহের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পুনরায় ঘরে চলে যান। সেই রাতেও বহুবার সে নিলয়কে ফোন করেছে।কিন্তু প্রতিবারই সুইচ অফ পেয়েছে। পুরো পৃথিবীতে মা ছাড়া তার আর কেউ ছিলো না। বাবা তো থেকেও নেই। নিলয় তার জীবনে ফ্রেস অক্সিজেন হয়ে এসেছিলো। 

  শ্রাবণীর মায়ের এই খবর পেয়ে তার কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন। তাদের সাথেই সে মায়ের শেষ কাজ করতে শ্মশানে যায়।যন্ত্র চালিতের মত সকলের কথা শুনে কাজ শেষে ঘরে ফেরে। সমস্ত টাকাপয়সা সেই মুহূর্তে জ্যাঠতুতো দাদারাই খরচ করে। তারপর মাঝে মাঝেই তারা শ্রাবণীর খবর নিতে এসেছে। শ্রাবণীর হাতে কিছু টাকাও ধরিয়ে দিয়েছে। শ্রাবণী না করেনি কারণ সেই মুহূর্তে বাবার কাছ থেকে মায়ের জন্য একটা টাকাও তার নিতে ইচ্ছা করেনি।

 স্ত্রী বিয়োগের পরেও সাত্যকির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। শ্মশান থেকে মেয়ে ফিরবার পরেই তিনি তার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে সুইচ অফ করে দেন। কোন বাঁধা দেয়নি শ্রাবণী। বাইরের গেটে সব সময় তালা ঝুলছে। কেউ এলে বাবার ঘরে ঢুকে 'কে এসেছে' জানার পর তিনি চাবি মেয়ের হাতে দেন। দু'টি প্রাণী বাড়িতে কিন্তু কারো মধ্যে কোন কথা নেই। শ্রাবণী হোবিষ্য করতে যে সেদ্ধ ভাত করে তাই বাবার জন্য ঢাকা দিয়ে রেখে দেয়।তিনি তার নিজের সময় মত সেটা খেয়ে নেন।
 
 দাদাদের পরামর্শে তাদের সহায়তায় কালীঘাট গিয়ে মায়ের কাজ করে। দাদারা তাকে বাড়ির কাছে বড় রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে যে যার মত বাড়ি চলে যায়। শ্রাবণী ভাবে বাড়িতে ফিরে সে আর কী করবে? সে বাড়ির রাস্তা না ধরে উল্টোদিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। কত পথ যে সে সেদিন হেঁটেছে তা সে নিজেও জানে না। হঠাৎ একটি গাড়ির ধাক্কায় সে পরে যায়। গাড়ি চালক পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেও সওয়ারি গাড়ি থামিয়ে নেমে আসেন। দুশ্চিন্তা,দুর্ভাবনায় আর সারাদিনের ক্লান্তিতে এমনিতেই সে ছিলো দুর্বল তার উপর গাড়ির সামান্য আঘাতেই সে অজ্ঞান হয়ে পরে। কিন্তু বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয় না।

 যখন তার জ্ঞান ফেরে সে তখন একটি নার্সিংহোমে। চারিপাশে তাকিয়ে তার মনেহয় এত বড় একটি নার্সিংহোমে তাকে কে নিয়ে এলো? একজন সিস্টারকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইলো,
-- আমি এখানে কেমন করে এলাম? 
সিস্টার হেসে পরে বললেন,
--- কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন আপনি নিজেই সব জানতে পারবেন।
 শ্রাবণী চুপ করে আকাশপাতাল ভাবতে লাগলো। হঠাৎ তার মায়ের কথা মনে পড়ায় প্রচণ্ড কষ্ট হতে লাগলো। পাশ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। এমন সময় মাথায় একটি স্নেহের পরশ পেয়ে সে উঠে বসে দেখলো একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক হাসি মুখে তার দিকে চেয়ে আছেন।তিনি জানতে চাইলেন,
--- কেমন আছো মা? বাড়ির ফোন নম্বরটা বলো তো - কাল থেকে তারা তোমার খোঁজ না পেয়ে নিশ্চয় খুব চিন্তা করছেন।
 শ্রাবণী কোন উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে ভাবে, যে বাড়িতে মা নেই অত্যাচারী বাবা থেকেও নেই কিছুতেই আর সে বাড়িতে সে ফিরে যাবে না। শ্রাবণীকে চুপ থাকতে দেখে ভদ্রলোক আবারও বললেন,
--- রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছো? কিন্তু বাড়িতে তো ফিরতে হবে। এখানে তো থাকতে পারবে না।আজই তোমাকে ছুটি দিয়ে দেবে।
 শ্রাবণী চোখ ভরা জল নিয়ে ভদ্রলোকটির পানে তাকিয়ে বললো,
--- বাড়িতে শুধু আমার মা ছিলেন। তিনি আমায় ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন।আমি একা ওই বাড়িতে থাকতে পারবো না। ভাড়াবাড়ি কয়েকমাস ভাড়া বাকি পরে আছে। আপনি চিন্তা করবেন না আমাকে নিয়ে। আমি অন্য কোথাও চলে যাবো।
 সত্য মিথ্যা যায় সে বলুক না কেন তার একটাই প্রতিজ্ঞা ওই বাড়িতে সে কিছুতেই ফিরবে না।
 কপালে ভাঁজ পরে ভদ্রলোকটির। তিনি পুণরায় বলেন,
--- সেই অন্য কোথাও কোথায় সেটা বলো।আমি নিজে গিয়ে তোমায় পৌঁছে দেবো। তুমি একা অল্প বয়সী একটি মেয়ে। যে কোন সময় যে কোন বিপদ হতে পারে তোমার। তোমার যাতে কোন বিপদ না হয় সেই জন্যই তো ঈশ্বর আমায় তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি সবকিছু আগে থাকতেই ঠিক করে রাখেন। 
  শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
--- আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আপনি যদি দয়া করে আমাকে আপনার বাড়িতে ঠাঁই দেন আমি সব কাজ করে দেবো সংসারের।বিনিময়ে থাকা আর খাওয়া হলেই চলবে।
 ভদ্রলোকটির চোখে জল এসে গেল। অতীতের কিছু স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি শ্রাবণীর মাথায় হাত রেখে বললেন,
-- কাজের মেয়ে নয় রে তুই আমার বাড়িতে আমার মেয়ে হয়েই থাকবি। আমিও মনেমনে এটাই ভাবছিলাম একবার যদি তুই বলিস তোর কেউ নেই,থাকবার জায়গা নেই তাহলে তোকে আমার কাছেই নিয়ে যাবো। তুই এখানে চুপটি করে বসে থাক। আমি ফর্মালিটিগুলো সেরে আসছি।
 ভদ্রলোকের কথা শুনে শ্রাবণীর চোখের জল আর বাঁধ মানেনি। সে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। ভদ্রলোক তার মাথায় হাত বুলিয়ে মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় একটা স্নেহের চুমু দিয়ে বললেন,
--- তোর কাঁদার দিন শেষ।আজ থেকে তুই আমাদের মেয়ে হয়েই আমাদের বাড়িতে থাকবি। একটা মা পাবি তুই। দেখবি সে তোকে কত ভালোবাসবে। একটা দাদাও পাবি। তবে এখন সে এখানে নেই। বাইরে পড়তে গেছে। তুইও ভালো থাকবি আর আমরাও ভালো থাকবো।
  কথাগুলো বলে ব্যবসায়ী অরুণাভ দাশগুপ্ত ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণীর দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা যেন আর থামতেই চায় না। ভাবতে থাকে মা তো সারা জীবনের জন্য চলে গেলেন। কিন্তু নিলয়? তাকে সে কিভাবে খুঁজে বের করবে? ফোন নম্বরটা তো কোনদিন সেভাবে খেয়াল করেও দেখেনি যেহেতু নামটা ফোনে সেভ করা ছিল। 

ক্রমশ -
  
( লেখাটির ভালোমন্দ সম্পর্কে মন্তব্যের মাধ্যমে জানালে এবং এই গল্পটিকে আপনারা কিভাবে দেখতে চাইছেন তার গঠনমূলক সমালোচনা যদি করেন লেখার উৎসাহ পাবো🙏,) 

Friday, February 24, 2023

একদিন ভালোবাসবে ( দশম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে ( দশম পর্ব) 

 তিয়াসা নিচুতে নেমে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ নিলয় ছাদের সেই এক কোণেই দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ করেই তার শ্রাবণীর কথা মনে পড়ে যায়। আজ তিয়াসাকে শুধুমাত্র দেখেই তার ভিতরে যে পরিবর্তন এসেছে শ্রাবণীকে দীপ্তদের বাড়িতে এত কাছে পেয়েও তার ভিতরে এ আকুল আবেদন আসেনি। তার নিজেকে কন্ট্রোল করতে এক মুহুর্ত সময় লাগেনি। বহুবার সে শ্রাবণীকে কিস করেছে। চেপে জড়িয়ে ধরেছে বুকের সাথে। কিন্তু আজ এত সময় পরেও তার মন আকুলিবিকুলি করছে তিয়াসাকে কাছে পেতে। এই ছাব্বিশ বছর বয়সে প্রথমবার তার জীবনে এমন ঘটনা ঘটলো।
 এক একবার নিজের পরেই নিজের রাগ হচ্ছে। কেন যে ফুলশয্যার রাত্রে সবকিছু বলে দিলো না! এখন নিজের থেকে ওকে কাছে টানা মানেই নিজেকে ওর কাছে হেয় করা। শ্রাবণী তো দিব্যি বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। তাহলে ও কেন নিজেকে দাম্পত্য সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে? 
 ভাবনায় ছেদ পরে পিয়ার ডাকে 
--- আরে নিলয়দা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছো বলো তো? নিচুতে কত লোক এসেছে নতুন জামাই দেখবে বলে। চলো নিচুতে চলো।
--- হ্যাঁ তুমি যাও আমি চেঞ্জ করেই আসছি।

 বসবার ঘরে প্রচুর লোকের সমাগম। সকলের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে তিয়াসা। ঘরে ঢুকেই সে প্রথমে তিয়াসাকে লক্ষ্য করে। দু'জনের চোখাচোখি হয়ে যায়। এই তিন চারদিনের মধ্যে অনেকবার নিলয়ের সাথে তিয়াসার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। কিন্তু আজকে তিয়াসা নিলয়ের দিকে তাকানোর সাথে সাথেই নিলয়ের বুকের ভিতর কে যেন হাতুড়ি পিটিয়ে দিলো। কেন এমন হচ্ছে আজকে এরূপ নিলয় কিছুতেই বুঝতে পারে না। একঘরে থেকেও তো এ কটাদিন এরূপ কোন ফিলিংস ওর আসেনি। আজ কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না কেনো? 

 নিলয়ের জন্য রাখা নিদ্দিষ্ট চেয়ারটিতে সে গিয়ে বসে পরে। নিজেকে নিজেই সংযত করে কিছুতেই সে আর তিয়াসার দিকে তাকাবে না। কিন্তু একটু পরে পরেই নিজের অজান্তেই সে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে পড়ছে। তিয়াসাও যেন কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। সেও ইচ্ছাকৃত ঘন ঘন নিলয়ের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। নিলয় মূলত পিয়ার সাথেই কথা বলছে বেশি। আর এদিকে যে যা প্রশ্ন করছে তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ নিলয়ের মোবাইলে একটা ফোন আসাতে নিলয় বাইরে বেরিয়ে আসে। পিছন পিছন তিয়াসাও এসে দাঁড়ায়। ফোনে কথা শেষ হলে আবার যেতে গিয়ে দেখে তিয়াসা দাঁড়িয়ে 
--- কিছু বলবে?
-- বলবো বলেই তো এসেছি। তুমি কী ভাবলে কে ফোন করেছে তাই জানতে এসছি?
-- না, আমি তা মিন করিনি 
--- যাক গে যেটা বলতে এসেছিলাম ; মা কিছু জামাকাপড় দিয়ে দিয়েছেন ওগুলো বাবা,মাকে প্রণাম করে দিতে হবে। 
--- পিয়ার জন্য কিছু দেননি মা?
-- হ্যাঁ সেটাও দিয়েছেন। এখন সকলে বেরিয়ে গেলে খেতে বসার আগে এগুলো দিয়ে খেতে বসবে।
-- ওরে বাবা! এখুনি আবার খেতে বসতে হবে?
 নিলয়ের বলার ভঙ্গিমাতে তিয়াসা হেসে দিয়ে ভিতরে চলে গেলো।

  শ্বশুর,শ্বাশুড়ীকে প্রণামী দেওয়ার পর পিয়ার প্যাকেটটা নিয়ে নিলয় তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-- আগে প্রণাম চাই তারপর জিনিস দেবো 
 সঙ্গে সঙ্গে পিয়া ঢিপ হয়ে একটা প্রণাম করেই হাত পাতে তার প্রাপ্য নেওয়ার জন্য। নিলয়ের কান্ড দেখে সবাই হাসতে থাকে। নিলয় তার শ্যালিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,"আশীর্বাদ করি যেন আমার মত একটা হ্যান্ডসাম বর কপালে যোঠে। 
--- ভেবো না যাকে পছন্দ করে রেখেছি সে তোমার থেকেও হ্যান্ডসাম।
 বলেই পিয়া হাসতে শুরু করে দেয়। নিলয় চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে
-- এ তো একদম ঝুনো নারকেল দেখছি
  পিয়া হাসতে হাসতে নিজের প্যাকেটটা খুলতে থাকে। এক একটা জিনিষ বের করে আর কখনো চোখের সামনে আবার কখনো বা গায়ের উপর ধরে "ওয়ও" করে চেঁচিয়ে উঠছে। নিলয় মনেমনে ভাবে দেখতেই মেয়েটা বড় হয়েছে এত শিশুদের মত সরল।

  টেবিলের খাবার দেখে মনেহচ্ছে ফাইবস্টার হোটেলে খেতে হয়েছে। হরেক রকম পদ দিয়ে সাজানো টেবিল। নিলয় চেয়ারে বসেই বলে উঠলো,
--- এত খাবার কী একদিনে খাওয়া যায়। এখন তো যাওয়া আসা লেগেই থাকবে। অল্প পদ হলে তাড়িয়ে তাড়িয়ে তার টেস্ট নেওয়া যায়। এখন এত সব খাবার খেলে এন্টাসিডেও কাজ হবে না ।
 নিলয়ের কথা শুনে শ্বশুরমশাই বললেন,
--- জামাই বাড়িতে আসলে শ্বাশুড়ীরা ভাবেন কিভাবে আর কত রকম রান্না করে তাদের খেতে দেওয়া যায়। পদ যত বাড়বে জামাই আপ্যায়ন তত বেশি হবে। জামাইয়ের যে কী হাল হয় সে ভুক্তভোগীরা ছাড়া বোঝে না।
  তন্দ্রা চোখ বড় বড় করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- উল্টোপাল্টা কথা বলা আবার শুরু হল তোমার? এবার খেতে দাও ওদের।
--- তোমার কী মনেহচ্ছে গিন্নি আমি ওদের হাত চেপে ধরে রেখেছি?
--- তুমি দয়া করে এবার থামো। নতুন জামাইয়ের সামনে যা মুখে আসছে তাই বলছে।
 আসা থেকে নিলয় শ্বশুর, শ্বাশুড়ীর এই কথোপকথন বেশ উপভোগ করছে।সে হাসতে হাসতে বললো,
--- আমার কিন্তু বেশ ভালো লাগছে বাবার এই কথাগুলো।
 সবাই একসাথে হেসে উঠলো। নিলয়ের পাশের চেয়ারেই তিয়াসা বসেছিল। নিলয় খেতে খেতে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকছে। শ্বাশুড়ীর খাওয়ার জন্য জোরাজুরিতে একবার তিয়াসা বলে ওঠে,
-- মা,এত জোর কোরো না। আছি তো আর একদিন। শেষে হজমে গন্ডগোল হলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।
 পিয়া দিদির কথা শুনে তার নিলয়দার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।
 খাওয়া শেষ করে তিয়াসা উঠে যাওয়ার সময় নাইটিতে বেঁধে পরে গিয়ে ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে এঁটো হাতে নিলয় তাকে ধরতে গেলেও সামলাতে পারে না। ধপ করে তিয়াসা মেঝেতে পরে যায়। ছুটে গিয়ে নিলয় বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে তাকে মেঝে থেকে তুলতে গিয়ে দেখে তিয়াসা দাঁড়াতেই পারছে না। দুই হাতে তাকে সকলের সামনেই কোলে তুলে নেয়। তিয়াসা একদৃষ্টে নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিয়া বলে ওঠে,
-- দিদি তুই নিলয়দার গলাটা জড়িয়ে ধর। তাহলে নিতে সুবিধা হবে। নিলয়দা দিদিকে তুমি বাবার খাটে শুইয়ে দাও। নিলয় তিয়াসাকে নিয়ে গিয়ে শ্বাশুড়ীর খাটে শুইয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি পায়ের কাছ থেকে নাইটিটা তুলে দেখতে যায় কোথায় লেগেছে। তিয়াসা বাঁধা দিয়ে বলে,
--- গোড়ালিতে লেগেছে।মনেহচ্ছে মচকে গেছে।
 ততক্ষনে পিয়া ফ্রীজ থেকে বরফ নিয়ে এসে দিদির গোড়ালিতে দিতে গেলে নিলয় বলে ,
--- পিয়া আমাকে দাও আমি দিয়ে দিচ্ছি। 
তিয়াসা একমনে নিলয়ের উৎকণ্ঠা দেখে চলেছে। শ্বশুরমশাই চুপচাপ খাটে বসা আর শ্বাশুড়ী মা কোনরকমে খাবারগুলো ঢেকে রেখে এসে বললেন,
-- কী কাণ্ডটা বাঁধলি বলতো? হ্যাগো ডাক্তারকে ফোন করবে?
 নিলয় বলে উঠলো,
-- আমার মনেহয় ডাক্তার লাগবে না। আপনি একটু চুন,হলুদ গরম করে নিয়ে আসুন।
 শ্বাশুড়ি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন রান্নাঘরে। যাওয়ার আগে পিয়াকে বললেন,
-- রমলামাসি তো পান খায়। তুই ছুটে গিয়ে তার কাছ থেকে একটু চুন নিয়ে আয়।

 গরম চুন,হলুদের বাটিটা শ্বাশুড়ীর হাত থেকে নিয়ে নিলয় অতি যত্ন সহকারে তিয়াসার পায়ে লাগাতে লাগলো। শ্বশুর,শ্বাশুড়ি দু'জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিয়া দিদির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-- দিদি নিলয়দার অবস্থা দেখে মনেহচ্ছে ব্যাথাটা তোর পায়ে লাগেনি ওটা লেগেছে নিলয়দার বুকে।
 তিয়াসা বোনের কথা শুনে বলে উঠলো,
--- সে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
 নিলয় গভীর দৃষ্টি নিয়ে তিয়াসার দিকে তাকালো। সে দৃষ্টিতে এমন কিছু তিয়াসা দেখলো যে সে মুখ ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হল। কারণ তখন তার বুকের ভিতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে।

 ক্রমশ 

Thursday, February 23, 2023

একদিন ভালোবাসবে (নবম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে ( নবম পর্ব)
  ইলার তখন জ্ঞান ছিলো না।সুতরাং এম্বুলেন্স এ করে তাকে নিতে হল। তাও এম্বুলেন্স ছোট গলির ভিতর ঢুকবে না তাই পাড়ার লোকের সাহায্যে স্ট্রেচার নিয়ে আসা হল।শ্রাবণী ও সাত্যকি ছাড়াও পাড়ার দু'একজনকে সাথে নিয়ে পাড়ার মধ্যেই সদ্য গজিয়ে ওঠা এক নার্সিংহোমে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। বাইরে বাবা,মেয়ে পাশাপাশি বসে। কিন্তু আচরণ তাদের অপরিচিতের মত। ডাক্তারের সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে যাবতীয় শ্রাবণী। সাত্যকি চুপচাপ বসেই আছেন। একসময় তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। শ্রাবণী বাবার উপরের সমস্ত রাগ বিসর্জন দিয়ে পাড়ার এক দাদার সাথে তাকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। এদিকে এতক্ষন পরে নার্সিংহোমের ভিতর থেকে খবর এলো আমাদের এখানে আজ হার্ট স্পেশালিস্ট আসেননি এখন উনি জানালেন আজ উনি আসতে পারবেন না। শুনেই শ্রাবণী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো,
--- এ কথা আপনারা এখন বলছেন? এতক্ষণ কী করছিলেন? আপনাদের এসব কথায় আমার মা যে চলে যেতে বসেছেন তার দায় কে নেবে? তিনি আসতে পারবেন না আপনারা অন্য ডাক্তারকে ফোন করুন।
 নার্সিংহোমের আর.এম. ও. বললেন, "দেখছি আমরা।"
 বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে পাড়ার কিছু লোকজনের সাথে যখন হাসপাতালে বসে থেকে মায়ের জন্য ঈশ্বরের কাছে সমানে প্রার্থনা করে চলেছে তখন সেই মুহূর্তে নিলয়ের কথা খুব মনে পরে। ফোনটা নিয়ে নিলয়কে ফোন করতে গিয়ে দেখে সুইচ অফ।

  নিলয়কে সেদিন থানা থেকে দেখে পাঠায়। নিলয় আসার সাথে সাথেই তাকে অ্যারেস্ট করা হয়। নিলয়ের সাথে ছিলো ওর বন্ধু দীপ্ত। দীপ্তর বাবা একজন নামকরা উকিল। দীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে ফোন করে। তিনি সেই মুহূর্তেই থানায় হাজির হয়ে যান। এর আগে নিলয় পুলিশকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে নির্দোষ। শ্রাবণীকে তাদেরই ক্লাসমেট সম্রাট ও নিশীথ পরীক্ষার শেষ দিনে যখন শ্রাবণী বাড়ি ফিরবে বলে বাস থেকে নেমে নির্জন রাস্তা দিয়ে আসছিল ঠিক তখনই সম্রাট আর নিশীথ একটা গাড়ি এনে শ্রাবণীর সামনে দাঁড় করিয়ে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ওষুধের সাহায্যে অজ্ঞান করে জোর করে গাড়িতে তোলে। মেইন রাস্তায় যখন গাড়িটা জ্যামে আটকে যায় ঠিক তার পাশেই জ্যামে আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো দীপ্তর বাইক।পিছনে বসা নিলয়। নিলয় দেখতে পায় সম্রাট ও নিশীথকে। দু'জনের  মাঝখানে একটি মেয়ে ছিটে হেলান দিয়ে শুয়ে। মেয়েটি যে শ্রাবণী ওরা তা তখনও বুঝতে পারেনি। কিন্তু কিছু যে একটা ঘটেছে সেটা বুঝেই ওরা গাড়িটিকে অনুসরণ করতে থাকে। চলতে চলতেই ওরা ওই গাড়িটির নম্বর প্লেটের একটি ছবি তুলে নেয়। গাড়িটিকে ফলো করতে করতে ওরা একটা নির্জন জায়গায় চলে আসে। বহুবার গাড়িটির দিশা চোখের পলকেই হারিয়েছে। কিন্তু ছবিটি তোলার ফলে ঠিক খুঁজে বেরও করেছে। নিলয় দীপ্তর বাইকে বসেই নিজেদের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুদের ফোন করে লোকেশন দিতে থাকে। এইভাবে যখন সম্রাটরা শ্রাবণীকে নির্মীয়মান একটি বড় ফ্ল্যাটের শুনশান একটি জায়গায় নিয়ে দুই বন্ধু মিলে তাকে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে তখনো শ্রাবণীর জ্ঞান ফেরেনি। নিলয় ও দীপ্ত খুব আস্তে আস্তে ওদের অনুসরণ করতে থাকে। ওরা অপেক্ষা করতে থাকে বাকি বন্ধুদের। 
  
   কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি বন্ধুরাও চলে আসে। তখন সকলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পরে ওরা সম্রাট ও নিশীথের উপরে। কিল,চর,ঘুষি, লাথি - ছ'জনের সাথে পেরে না উঠে ওরা দু'জন পালিয়ে যায়। তখনও শ্রাবণীর জ্ঞান ফেরেনি।  ক্ররোফর্মের পরিমাণ বেশি হওয়াতে শ্রাবণীর জ্ঞান ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
  নিলয় একটা উবের বুক করে ওকে নিয়ে আসে। বাকি বন্ধুরা যে যার মত বাইকে ফেরে। শ্রাবণীদের বাড়িটা বড় রাস্তা থেকে অনেকটাই দূরে হওয়ায় এবং রাস্তা ছোট হওয়ায় উবের ঢুকতে অস্বীকার করে। তাই সেখানেই সেটিকে ছেড়ে দিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে নিলয় তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কারণ ওই সামান্য রাস্তাটুকুও হাঁটার সামর্থ শ্রাবণীর ছিল না।

 দীপ্তর বাবা অনিমেশ মুখার্জী দীপ্তর কথামত বাকি বন্ধুদের থানাতেই ডেকে নিয়ে পুলিশকে তাদের মুখ থেকেই আলাদা আলাদা ভাবে ঘটনার বিবৃতি শোনান অফিসারকে। নিজে বন্ড দিয়ে সেই মুহূর্তেই নিলয়ের জামিন করান। সেই থেকেই চলছে সেই কেসের জন্য মাঝে মাঝেই কোর্টে হাজিরা দেওয়া।
 
  পরদিন অনিমেষ মুখার্জীর তৎপরতায় সম্রাট আর নিশীথকে গ্রেপ্তার করানো হয়। কিন্তু সাক্ষ্য,প্রমাণ থাকা সত্বেও তারা টাকার জোরেই হয়ত জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। 
  নিলয় ঘটনার দিন দেরিতে বাড়ি ফিরলে মা বারবার করে তার কাছে জানতে চাওয়ায় সে মাকে সত্য ঘটনা লুকিয়ে যায়। এরপর কেটে গেছে দু'বছর। ওই ঘটনার পর শ্রাবণীর আর কোন খোঁজ নিলয় পায়নি। অনেক চেষ্টা করেছে। ফোনে প্রথম প্রথম সুইচ অফ বললেও এখন নম্বরটির অস্তিত্ব নেই বলেই জানায়। নিজে তো চেষ্টা করেছেই বন্ধুদের সাহায্যেও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বাইরে থেকে সব সময় তালা বন্ধ। আশেপাশের বাড়িতে প্রথম প্রথম ভয়ে জিজ্ঞাসা করতেও পারেনি। মাস তিনেক পরে জানতে পারে সাত্যকি দত্ত এখান থেকে বাড়ি বিক্রি করে কোথায় চলে গেছেন কেউই তা বলতে পারে না।

 প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে নিলয় খুবই ভেঙ্গে পরে। মন খারাপ করে থাকে ,একা একা কান্নাকাটি করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব কষ্টের উপরেই একটা প্রলেপ পরে যায়। শোক কিছুটা সামলে উঠে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে একটি চাকরির। ছ'মাসের মাথায় সে বড় একটা বিদেশী কোম্পানিতে জয়েন করে। আর প্রাইভেটে চেষ্টা চালিয়ে যায় এম এ করার। এখানেই পরিচয় হয় তার সাথে অসিতের।

  অসিত সুপুরুষ। ছ' ফুটের উপরে উচ্চতা। ভীষণ মিশুকে একটি ছেলে। একদিন নিলয়ের সাথে গল্প করতে করতে তার ফোনটা সে ফেলে যায় নিলয়ের টেবিলে। নিলয় সেটি দেখতে পেয়ে অসিতকে ফেরৎ দিতে যাওয়ার মাঝপথে ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে ছবিটা দেখতে পেয়ে নিলয় হাঁটতে ভুলে গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে অসিতের ফোন ফেলে যাওয়ার কথা মনে পড়ায় সে এগিয়ে আসতে গিয়ে দেখে মাঝ পথে নিলয় ফোনের  স্ক্রীনের দিকে হা করে তাকিয়ে মাঝপথেই দাঁড়িয়ে।অসিত হাসতে হাসতে বলে,
--- ওটা আমার বউয়ের ছবি। মাস ছ'য়েক হল বিয়ে করেছি। 
 নিলয় ফোনটা অসিতের হাতে দিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে ধপ করে বসে পরে।
  

Wednesday, February 22, 2023

একদিন ভালোবাসবে ( অষ্টম পর্ব)

একদিন ভালো বাসবে ( ৮ম পর্ব)

  মেয়ের চোখের দৃষ্টি দেখে মায়ের বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না সে কী জানতে চায়।তিনি অত্যন্ত ধীর এবং শান্ত ভাবে মেয়েকে বললেন,
--- আমরাও একসময় তোদের বয়সী ছিলাম। আমাদেরও তোদের মত একটা উচ্ছল একটা জীবন ছিল। আমরাও তোদের মতোই স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু জীবনের শুরুতে দেখা সব স্বপ্ন কী আর পূরণ হয় সবার? আমার বাবা ছিলেন সামান্য চাকুরে।আমরা চার বোন ছিলাম। ওই অভাবের মধ্যেও বাবা চেষ্টা করতেন সকলকে লেখাপড়া শেখাতে।
 এইটুকু বলেই ইলা চুপ করে গেলেন।মেয়েকে বললেন হাসতে হাসতে,
--- থাক আর মায়ের প্রেমের গল্প শুনতে হবে না। যা জামাকাপড় ছেড়ে আয় আমি চা করি এখন।
 শ্রাবণী মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
--- বলো না মা শুনতে খুব ভালো লাগছে। কোনদিন তো বলোনি এসব কথা?
-- দরকার পড়েনি তাই বলিনি। আর এসব কথা কেউ বলে তার সন্তানকে?আজ মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো।
 বলেই হাসতে হাসতে হঠাৎই গম্ভীর হয়ে বললেন,
--- ছেলেটা চাকরি পাক আগে প্রয়োজন পড়লে এই ব্যাপারে তোর বাবার অমতে গিয়ে লুকিয়ে তোর বিয়ে দেবো।
 শ্রাবণী মাকে জড়িয়ে ধরে মুখের সাথে চেপে ধরে বড় শব্দ করেএকটা চুমু দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
 ইলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দেন। চা করতে করতে কিছুটা সময় অতীতে পারি জমান। একবার রথের মেলায় দীপায়নের সাথে ঘুরতে গিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে। রথে বন্ধুদের সাথে গিয়ে পূর্ব কথামত বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে দীপায়নের সাথে ঘুরতে গিয়ে দীপায়ন চা খেতে চায়। দু'জনে যখন মেলার এককোণে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে ঠিক তখনই তারা দেখতে পায় ইলার পাড়ার এক বৌদি আর তার ছোট্ট ছেলেটি সেদিকেই এগিয়ে আসছে। দু'জনেই চায়ের ভার সেখানেই ফেলে দিয়ে যে যার মত সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। এই নিয়ে পরে অনেক হাসাহাসি হয়েছিল ওদের মধ্যে। আজও মনে পড়াতে নিজের মনেই হেসে ওঠেন ইলা। আর ঠিক এই সময়েই মেয়ে এসে মায়ের হাসি দেখে মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে অদূরে গলায় বলে,
--- ওমা, একা একাই হাসছো? পুরনো কথা কিছু নিশ্চয় মনে পড়ছে! বলো না তোমার সেই কিশোরীবেলার কথা।
-- প্রচণ্ড দুষ্টু হয়েছিস বনি। 
 কথাটা বলেই মাথায় একটা মৃদু চর মারেন।
  কয়েকদিনের মধ্যেই নিলয়ের সাথে শ্রাবণীর দেখা হয় বলতে গেলে পরীক্ষার আগে তারা একবার দেখা করে। শ্রাবণী মায়ের কাছে জানিয়েই বেরোয় নিলয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে বলে। বাবাকে বলে স্যারের কাছ থেকে শেষ মুহূর্তের সাজেশন আনতে যাচ্ছে।সেদিন তারা দেখা করে নিলয়েরই বন্ধু দীপ্তর বাড়ি। দীপ্তর বাবা,মা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। এটা দীপ্তর মুখ থেকে শোনার পরেই নিলয় শ্রাবণীকে বন্ধুর বাড়িতে ডেকে নেয়। তিনজনে বসে কিছুক্ষণ গল্প করার পর কাজ আছে বলে দীপ্ত বেরিয়ে যায়।
 বন্ধুর বাড়িতে নিলয় আর শ্রাবণী পাশাপাশি একই খাটে বসে গল্প করতে করতে নিলয় বলে ওঠে,
--- যেটা ডিউ আছে আজ দিয়ে দে নারে -
--- তুই না খুব অ স ভ্য।
--- এটা তুই ভুল বললি। সত্যিই আমি যদি অ স ভ্য হতাম তোর কাছে চাইতাম না তোকে নিজেই দিয়ে দিতাম।
--- তুই খুব বাজে -
--- এত কথার কী আছে।তুই না দিলে কিন্তু আমিই এবার দিয়ে দেবো।
 কথাটা বলেই দুইহাতে শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কিস করে নিলয়। শ্রাবণী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিলয়ের কাছে সমর্পণ করে। শ্রাবণীর গলা,নাক,চোখ,মুখ চুমুতে চুমুতে আদরে ভরিয়ে দেয় নিলয়। ব্যাপারটা অনেক গভীরে চলে যাচ্ছে দেখে নিলয় নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে,
-- কিছু বাকি থাক সেই স্বপ্নের রাতের জন্য।
-- তোর সাথে কবে আর দেখা হবে জানি না। ফোনে কথা বলতে খুব ভয় করে যদি বাবা শুনে ফেলেন।তুই মেসেজ করিস আমাকে। আমি সুযোগ পেলে তোকে ফোন করবো।

  শেষ পরীক্ষার দিনে শ্রাবণীর ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে ইলা চিন্তায় ঘরবার করতে থাকেন। সাত্যকি বেশ কয়েকবার জানতে চান মেয়ে ফিরেছে কিনা। দু'জনের কেউই কিছুতেই বুঝতে পারছেন না শ্রাবণীর ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন? মোবাইল নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে বাইরে বইয়ের ব্যাগে রেখে যেতে হয় বলে শ্রাবণী পরীক্ষার সময় মোবাইল নিয়ে বেরোয় না। এদিকে মেয়ের এই দেরি দেখে "মাছ না পেয়ে ছিপে কামড়" এর মত সম্পূর্ণ দোষ স্ত্রীর উপরে চাপিয়ে চিৎকার,চেঁচামেচি করে চলেছেন সাত্যকি। কিন্তু ইলার এসবে এখন আর কিছুই যায় আসে না। তিনি স্বামীকে গিয়ে বললেন,
--- ও ইচ্ছা করে দেরি করছে না। ওর নিশ্চয় কোন বিপদ হয়েছে। তুমি এখুনি থানায় চলো।এরপর অনেক দেরি হয়ে যাবে।
 স্ত্রীর কথা শুনে প্রথম অবস্থায় একটু দমে গেলেও পরে তিনি চিৎকার করে বলেন,
--- ওই ছেলেটার বাড়ি কোথায় জানো?
--- আরে ওই ছেলেটা ওর কোন ক্ষতি করবে না।
--- তুমি যেন সব জেনে বসে আছো?
--- নাহ্ তোমার সাথে তর্ক করে আমার বৃথা সময় নষ্ট হচ্ছে। আমি চললাম থানায়।
 হন্তদন্ত হয়ে ইলা বেরিয়ে যাচ্ছেন দেখে সাত্যকি বলেন,
--- দাঁড়াও আমিও আসছি।
--- কোন দরকার নেই তুমি থাকো তোমার মত। তুমি আমার সাথে না আসলেও আমি আমার মেয়ের খোঁজ করতে পারবো।
 গেট থেকে বেরিয়েই দেখেন বিদ্ধস্ত শ্রাবণীকে রিক্সা থেকে নামাচ্ছে হাসপাতালে দেখা সেই ছেলেটি অর্থাৎ নিলয়। শ্রাবণী নেমেই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। আর নিলয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠে নিলয়ের গালে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেন সাত্যকি।
--- স্কাউন্দ্রেল! আমি ঠিক বুঝেছিলাম তুইই আমার মেয়ের সাথে আছিস। আমি তোকে পুলিশে দেবো। কিছুতেই ছাড়বো না তোকে আমি। সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় আমি তোকে দেখেছিলাম আমার মেয়ের সাথে তুই ইশারায় কথা বলছিস। সেদিনই বুঝেছিলাম তুই ওর সর্বনাশ করবি। তোকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।
 চিৎকার করছেন আর কিল,চর মেরেই চলেছেন। মা,মেয়ে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক মুহূর্ত।পরমুহুর্তে সম্বিৎ ফিরতেই দু'জনে মিলেই এই উন্মাদ মানুষটির হাত থেকে নিলয়কে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। নিলয় কিন্তু ইচ্ছা করলেই তার নিত্য এক্সারসাইজ করা পেটানো শরীরের সাহায্যে অনায়াসেই ভদ্রলোকের একটি হাত ধরেই কাবু করতে পারতো। কিন্তু শুধুমাত্র শ্রাবণীকে ভালোবাসে বলেই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে।
শ্রাবণী এই প্রথম বাবার সামনে জোরে বলে উঠলো,
--- তুমি ভুল করছো বাবা! আমাকে ওই বাঁচিয়েছে কিছু ছেলের হাত থেকে।
 সাত্যকি মেয়ের মুখে ঠাস করে এক চর মারেন সঙ্গে সঙ্গে। দ্বিতীয় থাপ্পড়টা মারার আগেই নিলয় শ্রাবণীর বাবার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। আশেপাশের কিছু লোকজন জড়ো হয়ে যায় সেখানে। তাদের সকলের অনুরোধে সাত্যকি রণে ভঙ্গ দিয়ে বউ,মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও শুরু হয় তাদের উপর মানসিক অত্যাচার। তিনি পরদিন সকালেই নিলয়ের বিরুদ্ধে এফ আই আর করেন। মেয়ের ফোন থেকে নিলয়ের ফোন নম্বর জোগাড় করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

 তারপরেই থানা থেকে ফোন করে ডেকে নিয়ে নিলয়কে অ্যারেস্ট করান। মেয়ের বাড়ি থেকে বেরোনো পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। এইসব ঝামেলা ঝক্কি সইতে না পেরে পরদিন ইলার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যায়। শ্রাবণী অনেক কান্নাকাটি করেও মাকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে পারে না। বাড়ির কাছের একজন ডাক্তারকে সাত্যকি ডেকে আনেন। ডাক্তার দেখে জানান অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক এই মুহূর্তে উনাকে হাসপাতাল ভর্তি না করলে হাতের বাইরে সবকিছু চলে যাবে। শ্রাবণী প্রচণ্ড কান্নাকাটি শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সে চিৎকার করে বলে ওঠে,
--- মায়ের যদি কিছু হয়ে যায় আমি কিন্তু পুলিশকে জানিয়ে দেবো তুমি ইচ্ছা করে মাকে মেরে ফেলেছো।
 মেয়ের এই উগ্র মূর্তি দেখে সাত্যকি বাধ্য হন ইলাকে নার্সিংহোম ভর্তি করতে।

ক্রমশ 




  

Tuesday, February 21, 2023

একদিন ভালোবাসবে ( সপ্তম পর্ব)

একদিন ভালো বাসবে ( ৭ম পর্ব)


  শ্রাবনীর মা ইলাদেবী খুব টেনশনে রয়েছেন। একটা পরোপকারী ছেলে এতটা সাহায্য করলো আর শ্রাবণীর বাবা কিনা এরমধ্যে অন্য কোন গন্ধ খুঁজছেন। যদি ধরেই নিই শ্রাবণীর সাথে তার কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাতে অসুবিধা কোথায়? নিজের জীবনটা এই লোকটার পাল্লায় পরে শেষ হয়ে গেলো। একটা দিন এমন কী একটা সময়ও এই মানুষটা ভালোভাবে দু'দণ্ড কথা বলেনি। অন্যের করা  দোষেে সারাজীবন আমার উপরেই রাগ দেখিয়়ে গায়ের জ্বালা মেটালো। আর আমার বাবা আমাকেই বলির পাঠা করলেন অন্য পরিবাারের সমস্যা মেটাতে গিয়ে। পাড়ার ছেলে দীপায়ন তখন উচ্চমাধ্যমিক দেবে। দু'জনের মধ্যে একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছিলো। দীপায়ন তাকে জানিয়েছিল চাকরি পাওয়ার পর বাবা,মাকে পাঠিয়ে সম্মন্ধ করে ইলাকে বিয়ে করবে।কিন্তু হঠাৎ করেই সাত দিনের মধ্যেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন।

  আসলে শ্রাবণীর বাবা সাত্যকির বিয়ে ঠিক হয়েছিল অন্যত্র। কার্ড ছাপানো, সবকিছুর এডভ্যান্স করা,লোক নিমন্ত্রণ করা সব রেডি। হঠাৎ করেই বিয়ের কনে উধাও হল তার প্রেমিকের সাথে। অপমান এবং লোকলজ্জার হাত থেকে রক্ষা পেতে তার বাড়ির লোকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন ওই দিনেই ছেলের বিয়ে দেবেন বলে। আর তাদের এই অপমান আর লোকলজ্জার হাত থেকে মুক্তি দিতে ইলার বাবার বন্ধু এই সম্মন্ধটার খোঁজ দেন। কোন চাহিদা ছাড়া চার মেয়ের বড় মেয়েটিকে বিয়ের মাধ্যমে তাদের হাতে তুলে দিতে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন ইলার বাবা।


   দীপায়ন এখন ইঞ্জিনিয়ার। শুনেছে কানাডায় স্থায়ী বাসিন্দা সে এখন। বিয়ে হওয়ার পর একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। চোখাচোখি হওয়াতে দীপায়ন একদৃষ্টে ইলার দিকে তাকিয়ে তার অব্যক্ত অনেক কথাই সেদিন বলে দিয়েছিল। ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে সেদিন ইলা খুব কেঁদেছিলেন। এটা ছিল অষ্টমঙ্গলে আসার পরের ঘটনা। তারপর আর কোনদিন দেখা হয়নি। যেহেতু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ইলার বাপেরবাড়িতে আসা একদম পছন্দ করতেন না বিশেষত সাত্যকি। তাই দীপায়নের সাথে আর কোন দেখার সুযোগও আর হয়ে ওঠেনি। বহু বছর পর ইলা জেনেছিলেন দীপায়ন চাকরি নিয়ে কানাডায় চলে গেছে। 


  কিশোরীবেলার অনেক প্রেমই পূর্ণতা পায় না। ইলার আর দীপায়নের প্রেমটাও ঠিক তাই। কিন্তু মনে থেকে যায় আমৃত্যু। আজও যখন সাত্যকির ব্যবহারে ইলা কষ্ট পান নিজের অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দীপায়নের মুখটা। বিশেষত দেখা হওয়ার শেষ দিনের সেই দৃষ্টি আজও এই বয়সে এসে ইলার বুকে কাঁপন ধরায়।


 ইলা আত্মীয়দের কাছে শুনেছেন সাত্যকি এরূপ ছিলেন না। হাসিখুশি একটা মিশুকে মানুষ ছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে মানুষটার আমূল পরিবর্তন হয়।পৃথিবীর কাউকেই তিনি বিশ্বাস করেন না। তার কথার উপর কেউ কথা বললেই তিনি ক্ষেপে বোম হয়ে যান। শ্বশুর শ্বাশুড়ি যতদিন বেঁচে ছিলেন একান্নবর্তী পরিবারে সাত্যকির এই আচরণের জন্য নিত্য কথা শুনতে হয়েছে ইলার। তাদের মৃত্যুর পর একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে। কোনদিনও কোন কথা স্বামীর মুখের উপর বলতে পারেননি।সব সময় ভয়ে জুজু বুড়ি হয়ে থেকেছেন। মেয়েও ছোটবেলা থেকে বাবাকে জমের মত ভয় পায়। তিনি ভাবতে থাকেন ছেলেটা সম্পর্কে বনির কাছ থেকে সবকিছু জানতে হবে। ছেলেটাকে সতর্ক করতে হবে। যদি সত্যিই বনি ওকে ভালোবাসে তাহলে বনিকে বুঝিয়ে যদি সরানো না যায় কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। কারণ ভালোবাসা হারানোর জ্বালা তিনি ভালোভাবেই জানেন। জীবন যতই সুখের হোক না কেন প্রথম ভালোবাসা বুকের মাঝে সারাজীবন ধরে ধিকিধিকি জ্বলে। আজও এই বয়সে এসে দীপায়নের সাথে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাটানোর মুহূর্তগুলো মনেহয় এই তো সেদিনের কথা।


 সামনেই ফাইনাল সেমিস্টার। খুব একটা কলেজে যাতায়াত নেই। এই কোচিংয়ে নিলয় না পড়লেও ঘড়ির কাঁটা ধরে ছুটির সময় এসে হাজির হয়। পাড়ায় ঢোকার পূর্ব পর্যন্ত যেটুকু কথা হয়। সব সময়ই একটা ভয় কাজ করে।যদি পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যায়? বাবার কানে একবার কথাটা গেলে মেরেই ফেলে দেবেন। 


  সেদিন ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ইলা তাকে ইশারা করে রান্নাঘরে নিয়ে যান। নিজের ঘরে খাটের উপর বসে টিভি চালিয়ে সাত্যকি খবর দেখছিলেন আর মুড়ি,চানাচুর মাখা খাচ্ছিলেন। একটু আগেই ডাক্তারের কথা অনুযায়ী নিয়ম মাফিক নেবুলাইজার নিয়ে বর্তমানে শ্বাসকষ্ট একটু কম।বাড়িতে শ্রাবনীকে ঢুকেই একবার বাবার ঘরে ঢুকতে হয় তার বাড়িতে ফেরার উপস্থিতি জানান দিতে। কিন্তু কথা কিছুই হয় না।শুধু শ্রাবণী দরজার কাছ থেকেই বলে,"বাবা আমি চলে এসছি।"সেটা শেষ করেই মায়ের জরূরী তলবে সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। বাবাকে সে যমের মত ভয় পেলেও মা তার কাছে বন্ধুর মত। মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,

-- মা জামা ছেড়ে আসি।তুমি চা করো।চা খেতে খেতে তোমার কথা শুনবো।

--- ওসব পরে হবে। আগে আমার কথাগুলির ঠিকঠাক জবাব দে --।

--- কী এমন কথা তোমার যে এখুনি বলতে হবে?

--- খুব দরকারী কথা না হলে কী আর এইভাবে তোর বাবার আড়ালে দেখে নিয়ে আসতাম?

-- ঠিক আছে বলো কী কথা?

-- তোর বাবা হাসপাতালে থাকতে যে ছেলেটা আসতো ওর নাম কিরে? কোথায় থাকে? একসাথে পড়িস? ওদের বাড়ি কো ---।

--- আরে দাঁড়াও দাঁড়াও - এত পুলিশের মত জেরা করছো কেন? কী হয়েছে আগে বলো 

--- তোর বাবা জানতে পেরেছেন একটি ছেলে রোজ হাসপাতালে আসতো।

 শ্রাবণী চমকে উঠলো।এই ভয়টাই সে পাচ্ছিলো। কথাটা শুনেই তার ভয়ে চোখ,মুখ শুকিয়ে গেছে।

--- সর্বনাশ! বাবা কী করে এসব জানলেন? ও তো কোনদিন বাবার সামনে যায়নি? তবে বাবার কানে এ কথাটা গেলো কী করে?

-- অত সব আমি জানি না। মনেহয় কোন নার্স বা আয়া বলেছে।তিনি তো আর বাইরে আসেননি। আমাকে সব খুলে বল।

-- কী খুলে বলবো মা।তুমি তো জানো তোমাকে আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না। ও আমার সাথে পড়ে,ওর নাম নিলয়।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান।

 শ্রাবণী চুপ করে যায়।

-- কী রে চুপ করে গেলি কেন? আসল কথাটা বল 

--- আসল কথা আবার কী?

--- তুই কি ছেলেটিকে ভালোবাসিস? সত্যি করে বল আমাকে।ব্যাপারটা আমায় একটু বুঝতে দে। ছেলেটার জীবনে বিপদ ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পারছি। তোর বাবাকে তো তুই চিনিস। ওর কোন বড়সড় বিপদ হওয়ার আগেই ওকে সাবধান করতে হবে।

 মায়ের এসব কথা শুনে শ্রাবণী ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-- অনেক চেষ্টা করেছি ওকে এড়িয়ে যেতে মা।কিন্তু পারিনি। ও আমাকে একদিন একটা বড় রকমের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিল। তারপর থেকেই একটু একটু করে ওর প্রতি আমার আলাদা একটা অনুভুতি তৈরি হয়।তার থেকেই ওকে আমি ভালোবেসে ফেলি।

 শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতেই সেদিনে পিকনিকে ঘটা সমস্ত ঘটনা মাকে খুলে বলে। সব শুনে ইলা মেয়েকে বলেন,

--- তুই আমার কথা শোন আর ছেলেটিকে বুঝিয়ে বলবি সব কথা। আমি তোকে কথা দিচ্ছি পড়াশুনা শেষ করার পর ও যদি খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি জোগাড় করে নিতে পারে তাহলে আমি জীবনে প্রথম তোর বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তোদের মিলিয়ে দেবো।কারণ আমি জানি জীবনে প্রথম ভালোবাসা হারানো কতটা কষ্টের।

  শ্রাবণী এই প্রথম মায়ের মুখে এরূপ একটা কথা শুনে অবাক হয়ে মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।


ক্রমশ 


  


Thursday, February 16, 2023

একদিন ভালোবাসবে ( ষষ্ঠ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (ষষ্ট পর্ব)
  
   গাড়ি ছুটে চলেছে বেহালা থেকে বারুইপুর। সমান তালে পাল্লা দিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল। ফেব্রুয়ারি মাস। সেভাবে এখনো গরম পড়েনি। কিন্তু নতুন শাড়ি তার উপর কাঞ্জিভরম সাধারণত একটু মোটা হয় ।ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে তিয়াসার বেশ গরম লাগতে লাগলো। তার কপাল, ঘাড়ের গোড়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পেয়ে নিলয় ড্রাইভারকে বলে এসিটা চালিয়ে দিতে। 
 গড়িয়া মোড়ে একটা বড় মিষ্টির দোকান দেখে নিলয় ড্রাইভারকে একটু সাইড করতে বলে। চালক তখন বলে ওঠেন,
--- দাদা,বেশি দেরি করবেন না তাহলে কিন্তু ওয়েটিং চার্জ দিতে হবে।
-- দিতে হলে দেবো দাদা। কিন্তু মিষ্টি না নিয়ে তো আর শ্বশুরবাড়ি যেতে পারি না।
 চালক হেসে উঠেন।আর তিয়াসা চোখ বড় বড় করে নিলয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবে,'বোধবুদ্ধি সব আছে।শুধু বউকে আদর করার ক্ষেত্রেই অতীত সামনে চলে আসছে। কত মেয়েকে এর আগে আদর করেছে সেটা একদিন গুনে গুনে হিসাব নেবো। একদিনেই বুঝে ফেলেছি মশাই তুমি যে ধাতুতে গড়া সেটা একটু নরম।"
 কথাগুলো ভেবে নিজের মনেই হাসতে লাগলো। আর এদিকে নিলয় একহাতে দইয়ের এক বিশাল হাড়ি অন্য হাতে এক বিশাল মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে গাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে। তিয়াসা দরজা খুলে সেগুলো নিতে গেলে নিলয় তার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- বাড়িতে কারো সুগার নেই তো?
তিয়াসা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো "না"।

  এসিটা চালিয়ে দেওয়াতে তিয়াসা খুব আরাম বোধ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করতে করতে চলে। এই দু'তিনদিনেই সে বুঝে গেছে পরের বাড়িতে গেলে বাবা,মা বোনের জন্য কী পরিমাণ কষ্ট হয়। একটা অচেনা,অজানা পরিবারের লোকদের আপন করে নিজের বাড়ির লোকগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকা যে কতটা কষ্ট তা একমাত্র মেয়েরাই বুঝতে পারে। 
  গাড়ি এসে বারুইপুর তিয়াসাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।বোনের সাথে গাড়িতে বসে হোয়াটসঅ্যাপেই কথা হচ্ছিল কোথায় ,কতটা এসেছে। সুতরাং নতুন জামাইকে বরণ করার জন্য মা প্রতিবেশী কাকিমার সাথে বরণডালা নিয়ে একদম গেটের কাছে হাজির। তিয়াসা গাড়ি থেকে নেমেই বোনকে জড়িয়ে ধরে। পিয়াসা ওরফে পিয়া দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
--- দিদি,তোকে যা লাগছে না।একদম ফাটাফাটি।
 নিলয়ের কনুইতে একটা ধাক্কা দিয়ে  ফিসফিস করে বলে,
--- নিলয়দা কী দেখতে দেখেছেন আমার দিদিকে?
--- নিলয়ও শালীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়েই বলে,
--- কেন আমাকে কী খারাপ দেখতে নাকি? একদম হিরো হিরো লাগছে না?
 কথাটা বলেই নিলয় হাসতে থাকে। তাতে যোগ দেয় পিয়াসাও। 
 নিলয়ের মধ্যে যে চাপা একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে তা তাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। বিয়ের আগে তার আপত্তি থাকলেও ,ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দিলেও তিয়াসার মোহময়ী রূপের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সত্যিই তার নিজের সাথে নিজেকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এ যুদ্ধ সে না করলেও পারতো। সবকিছু প্রথম রাতেই স্ত্রীকে বলে দিয়ে হালকা হতে পারতো। কিন্তু কেন যে সেদিন তিয়াসাকে সব খুলে বলতে পারলো না তা সে নিজেই জানে না। মিথ্যে এক ঝামেলায় ফেঁসে গিয়ে আজ প্রায় দু'বছর ধরে তাকে মাঝে মাঝেই কোর্টে হাজিরা দিতে হচ্ছে। যা বাড়ি কিংবা অফিসের কেউই জানে না।
 তিয়াসাদের বাড়িটা ছোট হলেও খুব সুন্দর। মেইন গেট থেকে বাড়ির দরজা অবধি আসার প্রায় পনের ফুটের মত রাস্তা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। দু'পাশে প্রচুর ফুলগাছ। এখনো তাতে বড়বড় চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া,নানান জাতের বাইকালার পিটুনিয়া, গোলাপ আরও নাম না জানা কত ফুল ফুটে রয়েছে। দেখতে দেখতে যেতে গিয়ে নিলয় সকলের পিছনে পরে যায়।পিয়া দৌড়ে এসে নিলয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
-- নিলয়দা, তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে আর দিদিকে একসাথেই ভিতরে ঢুকতে হবে তো।
 নিলয় পিয়ার সাথে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায়। এ বাড়ির নিয়ম অনুসারে নিলয় তিয়াসার হাত ধরে ঘরে ঢুকবে।
 ছিমছাম সুন্দর গোছানো ড্রয়িং রুম। যদি এ রুমে এত ফার্নিচার না থাকতো তাহলে নিলয়ের মনেহয় চেয়ার,টেবিল পাতিয়ে জনা চল্লিশেক লোক অনায়াসে যে কোন অনুষ্ঠানে এখানে বসেই খেতে পারবে। নিলয়ের ভাবনায় ছেদ পড়ে পিয়ার কথায়।
-- জানো নিলয়দা ওই যে দেওয়ালে জলছবিটা বাঁধানো দেখছো না - ওটা দিদির আঁকা। দিদি খুব সুন্দর ছবি আঁকে। ওই শোকেসে যত্ত মেমেন্টো সব দিদির পাওয়া। নিলয় উঠে গিয়ে ছবিটার সামনে দাঁড়ায়। ছবিটাকে খুব খুটিয়ে খেয়াল করে একটা বড় জলাশয়ের কাছে অস্তগামী সূর্য্যটা আস্তে আস্তে জলের সাথে যেন মিশে যাচ্ছে। আর ঠিক তার পাশেই একটা বড় গাছের তলায় পিছন দিক দিয়ে একটি তরুণী আর প্রেমিকের কাঁধে মাথা দিয়ে সামনের দিকে দু'জনেই তাকিয়ে রয়েছে। মুগ্ধ হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে নিলয়। পিছন থেকে শ্বাশুড়ী মায়ের ডাকে চমক ভাঙ্গে
--- এসো বাবা একটু কিছু খেয়ে নাও।
 নিলয় তাকিয়ে দেখে এক প্লেট মিষ্টি,আর একটি বড় থালায় খান ছ'য়েক বড় বড় ফুলকো লুচি,বেগুন ভাজা আর আলুর দম।এসব দেখে তো নিলয়ের চক্ষু চড়ক গাছ। মনেমনে ভাবে এখন প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে এখন এসব খেলে দুপুরে কখন খাবো? আর খেলেও তো হজম হবে না। সে এসে সোফায় বসে টি টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আমরা তো আসবার সময় টিফিন করেই এসেছি।এখন এত খেলে দুপুরে খেতে পারবো না। আপনি কষ্ট করে করে এনেছেন আমি একটা লুচি আর একটা মিষ্টি খাচ্ছি।
 "আমি বলেছিলাম তোমার শ্বাশুড়ী মাকে এই বেলায় এত কিছু কোরো না।কিন্তু কে শোনে কার কথা?" বলতে বলতে তিয়াসার বাবা অনিলবাবু সোফায় নিলয়ের পাশে এসে বসেন। বাইরে দাঁড়িয়ে যারা যারা তাদের বরণ করেছেন সকলকেই তিয়াসার দেখাদেখি নিলয় প্রণাম করেছিলো।এতক্ষন পরে শ্বশুরমশাইয়ের দেখা পেয়ে নিলয় তার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে। নিলয়ের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন,
--- কোন জোর জবরদস্তি নয় তুমি যেটুকু পারবে সেটুকুই খাবে।নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি বাবা শ্বশুরবাড়ি জামাই আসলেই বাড়িতে গিয়ে তার পেটের গন্ডগোল হবেই।
তন্দ্রাদেবী স্বামীর কথা শুনে বলে উঠলেন,
--- কী হচ্ছে কী নতুন জামাইয়ের সাথে?
 নতুন আর পুরনো সকলের দশাই এক। নিলয় মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
 পিয়া এসে তাকে নিয়ে গেলো উপরে দিদির ঘরে। তিয়াসা তখন সবে শাড়িটা পাল্টে পুরো হলুদ রঙের একটি নাইটি পরেছে। তার গায়ের রঙের সাথে যেন নাইটিটা রঙ নিয়ে চেপে বসে আছে।
-- নিলয়দা এটা আমার আর দিদির ঘর। তোমরা যে দু'দিন থাকবে এই ঘরেই শোবে।আমি বাবা,মায়ের ঘরে থাকবো। আসলে আমাদের ড্রয়িং রুমটাই যা বড়। নিচুতে বেডরুমটা বাবা,মায়ের। রান্নাঘর,বাথরুম তার উপর মায়ের শখে বাড়ির বাইরে অতটা জমি ছাড়তে হয়েছে ফুলের বাগানের জন্য। যা হোক তোমার জন্য এ কটাদিন আমি সক্রিফাইস করলাম। আফটার অল সাতটা নয় পাঁচটা নয় তুমি আমার একটি মাত্র জিজু। কিন্তু আমি তোমাকে দাদা ই বলবো।পিয়া বেরিয়ে যায়। বেশ ভালো লাগে মেয়েটিকে তার।  তিয়াসার দিকে তাকিয়ে দেখে ও একমনে ওর শাড়িটা ভাঁজ করছে। হঠাৎ নিলয়ের বুকের ভিতরটা এরূপ করছে কেন? ভীষণ ইচ্ছা করছে তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরতে। ওর ঠোঁট দুটো নিজের মুখের মধ্যে নিতে। ওর ভিতরে একটা শারীরিক পরিবর্তনটাও ও টের পাচ্ছে। কিন্তু কই শ্রাবনীকে এত কাছে পেয়েও বহুবার ওর এই শারীরিক পরিবর্তন তো কোনদিন আসেনি। তবে কেন আজ ? নাহ্ এক্ষুনি নিজেকে কন্ট্রোল করতে হবে।বেরিয়ে পরে ঘর থেকে খোলা ছাদে।
 তিয়াসা তার কাপড় গুছিয়ে ব্যাগ থেকে নিলয়ের জন্য একটা পায়জামা আর ফুল হাতা টিশার্ট বের করে দেখে নিলয় খোলা ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে দাঁড়িয়ে তিয়াসা বলে,
-- তোমার জামা,প্যান্ট বের করে রেখে এসেছি।এখানে কোন অসুবিধা হলে আমায় জানিও।
 নিলয় আর ওর মুখের দিকে তাকায় না নিজেকে সংযত রাখতে।

ক্রমশ 
  
    

Wednesday, February 15, 2023

একদিন ভালোবাসবে ( পঞ্চম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে ( পঞ্চম পর্ব)
  
  বাথরুমের দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে তিয়াসা দাঁড়িয়ে গিয়ে পিছন ফিরে নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।নিলয় একটু ইতস্তত করে কিভাবে কথাটা তিয়াসাকে বলবে। তারপর আমতা আমতা করতে করতেই বলে বসে,
--- আজ তো তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা। তা কখন বেরোতে হবে?
 তিয়াসা কিছুটা অবাক হয়ে যায়।যে মানুষটা তাকে এখনো পর্যন্ত স্ত্রীর মর্যাদা দিলো না সে নির্বিবাদে রিচুয়ালগুলো করে চলেছে। মানুষটা তো খারাপ বলে মনে হয় না। কিন্তু এর কী এমন অতীত আছে যে অতীত থেকে সে কিছুতেই বেরোতে পারছে না।
 তিয়াসাকে চুপ থাকতে দেখে নিলয় আবারও তাকে বলে,
--- বললে না কখন বেরোতে হবে?
-- আমি জানি না। ওটা মা বলবেন। তুমি মায়ের কাছ থেকে শুনে নাও।
 কথাটা বলে তিয়াসা বাথরুমে ঢুকে যায়।
 নিলয় তার আলমারি খুলে দু'একটি শার্ট,প্যান্ট বের করে খাটের উপর রেখে দিয়ে নিচুতে নেমে যায়। তিয়াসা বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাটের উপর নিলয়ের শার্ট,প্যান্ট দেখে বুঝতে পারে এগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্যই নিলয় বের করে রেখে গেছে। সে ভীষণ অবাক হয়! ট্রলিটা আলমারির উপর থেকে নামিয়ে খাটের উপরেই রেখে গেছিলো নিলয়। তিয়াসা নিজের সামান্য কিছু কাপড়চোপড় বের করে রেখে সেও নিচে নেমে যায়।
 তিয়াসাকে নিচুতে দেখতে পেয়ে তার শ্বাশুড়ি বলে ওঠেন,
-- দশটার মধ্যে অস্টমঙ্গলে বেরিয়ে যাবে।আজ তুমি রান্নাঘরে ঢুকবে না একদম। আমি সব করে নিতে পারবো। তোমার বাবা পাউরুটি নিয়ে এসেছেন।পাউরুটি, ডিমসিদ্ধ আর কলা টিফিন করে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পরো। রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না এখানে বসেই দু'জনে টিফিন করে নাও। আমি সব গুছিয়ে রেখেছি।তোমার খাওয়া হয়ে গেলে একটু আমার ঘরে এসো।
 নিলয় আগেই একটা চেয়ার দখল করে বসে ছিল। নীলিমা তার সামনে প্লেটটা রেখে বললেন,
-- তোর কী কী নিতে হবে বৌমাকে সব বের করে দিস।ও গুছিয়ে নেবে।
নিলয় মাথা নাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মত হ্যাঁ বললে নীলিমা সেখান থেকে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলেন। দু'জনেই চুপচাপ বসে খেয়ে চলেছে। দু'জনেই দু'জনের দিকে একটু আড়চোখে দেখছে কিন্তু কেউই কথা বলছে না। তিয়াসার আগেই খাওয়া হয়ে গেছিলো কিন্তু তা স্বর্তেও সে বসে আছে দেখে নিলয় তাকে বলে,
-- তুমি উঠে যাও আমার খাওয়া হয়ে গেলে আমি প্লেট সিঙ্কে রেখে আসবো।আমার এগুলো অভ্যাস আছে।
-- হ্যাঁ সেতো আমি দেখতে পাচ্ছি গুনের আধার।শুধু মনের কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করার অভ্যাসটাই নেই।
--- বলবো সব বলবো। একটু সময় চাইছি 
 তারপর বিড়বিড় করে বলে 'কিন্তু কতটা বলতে পারবো সেটা বুঝতে পারছি না। মনটা তো অন্যকিছু চাইছে।'
 নিলয়ের শেষ কথাটা ভালোভাবে শুনতে না পেয়ে তিয়াসা উৎসুক হয়ে জানতে চায়,
--- বুঝতে পারলাম না কী বললে?
নিলয় মাথা নাড়িয়ে বললো "না কিছু না -" আর মনেমনে ভাবলো , "দূর আমি যে কী চাই নিজেও সেটা বুঝতে পারছি না -। তোমার মুখের দিকে তাকালেই তো আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।"
 কথা বলতে বলতে নিলয়ের খাওয়া শেষ হয়ে যায়। তিয়াসা নিলয়ের সামনে থেকে প্লেটটা নিতে গেলে নিলয় তার দিকে তাকিয়ে পড়ে।দু'জনে চোখাচোখি হওয়াতে তিয়াসার বুকের ভিতর ধক করে কেঁপে ওঠে। নিজেকে সামলাতে সে সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়ে।
  শ্বাশুড়ি মায়ের ঘরে ঢুকলে তিনি একটি বড় বিগসপার দেখিয়ে বলেন,
--- এর মধ্যে তোমার বাবা,মা আর বোনের কিছু কাপড়চোপড় আছে। নিলয়কে দিয়ে তোমার বাবা,মাকে প্রণাম করিয়ে এগুলো দিও। 
 বিয়ের আগেই কথা হয়েছিল যার যার প্রণামী নিজেদের।কিন্তু তা স্বর্তেও উভয় পরিবারের বাড়ির প্রণামীগুলো কিনতে হয়। এটা তিয়াসার জানা ছিলো তাদের পরিবার থেকেও নিলয়ের বাবা,মায়ের জন্য পাঠিয়েছে।তাই সে মাথা নাড়িয়ে শ্বাশুড়ীকে হ্যাঁ সূচক বার্তা দেয়।
 বিয়ের পর প্রথম বাপের বাড়ি যাওয়া। নিজের মনে খুব একটা আনন্দ না থাকলেও বাড়ির লোককে তো সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। সে একটা নীল কাঞ্জিভরম পরে। খুব সুন্দর করে খোঁপা বাঁধে। গায়ে হালকা সোনার গয়না। আর নিলয়ের জন্য তাদের বাড়ি থেকে দেওয়া একটা নীল পাঞ্জাবী আর পায়জামা বের করে খাটের উপর রেখে দেয়। নিজেকে তৈরি করার আগেই সে ট্রলিটা গুছিয়ে রেখেছিল। এবার সে তার ঘরের দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখে নিলয় সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
--- অদ্ভুত মানুষ তো! এসে দাঁড়িয়ে আছো অথচ দরজা খুলতে বলছো না?
--- হু জানি তো তুমি সাজছো তাই অপেক্ষা করছি হয়ে গেলেই তো খুলে দেবে।
 কথাগুলো নিলয় সরাসরি তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে চোখ না সরিয়ে তাকিয়েই থাকে। তিয়াসার হঠাৎ রবি ঠাকুরের গানটা মনে পড়ে যায় "আমি রূপে তোমায় ভুলাবো না, ভালোবাসায় ভূলাবো।" আর মনে মনে বলে,'চলো শ্বশুরবাড়ি দেখি আমায় কিভাবে এড়িয়ে যেতে পারো। তোমার সাথে যখন আমার গাঁটছড়া বাঁধা পড়েছে আর মানুষটা তুমি মোটেই মন্দ নও;অতীতে তুমি কী করেছো তা নিয়ে আমার বিন্দু বিসর্গ কোন আগ্রহ নেই। আমাকে বুকে তোমার টানতেই হবে।"
-- এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ভিতরে ঢুকবে।
 এতক্ষণ হ্যাংলার মত তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য নিলয় নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। সে তিয়াসাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে তারজন্য পাঞ্জাবী আর পায়জামা বের করে রাখা হয়েছে। তিয়াসা নিলয়কে রেডি হওয়ার সুযোগ দিতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
 ওদের বেডরুম থেকে বেরিয়েই পূর্বদিকে একটা বেশ বড় চাপা ফুলগাছ রয়েছে। গাছটাতে কুঁড়ি ভর্তি হয়ে  আছে। কিছুদিনের মধ্যেই গাছে ফুল ভর্তি হয়ে যাবে। চাপা ফুলের খুব সুন্দর গন্ধ। তিয়াসা যে স্কুলে পড়তো সেই স্কুল মাঠে একটা চাপা ফুলগাছ ছিল।যখন গাছটাতে ফুল আসতো পুরো স্কুল চত্বর গন্ধে ম ম করতো। কত পাখি গাছটাতে এসে বসতো। অনেক সময় স্কুল চলাকালীন সময়ে গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় পাখি কত বন্ধুদের মাথায় মল ফেলেছে।মনে পড়লে সেই সব ঘটনা আজও হাসি পায়। তিয়াসা আজই ভোরবেলা কোকিলের ডাক শুনতে পারছিলো।তার মানে এই গাছে বসেই কোকিলটা তার সাথীকে ডাকছিল। উল্টোপাল্টা ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন 
 ভিতর থেকে নিলয় সাড়া দেয় 
--- আমি রেডি। সাড়ে ন'টা বাজে। তিয়াসা ঘরে ঢুকে নিলয়কে দেখে একটু থমকে যায়। তার ছ'ফুট দু'ইঞ্চির মনের মানুষটাকে যে এত ভালো লাগবে তারই পছন্দ করে কেনা পাঞ্জাবী ,পায়জামা তে এতটা সে ভাবেনি। কিন্তু একজলক তার দিকে তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিয়ে ট্রলিটা নিতে যায়। নিলয় দেখতে পেয়ে খপ করে ট্রলিটা ধরে বলে,
-- তুমি নেমে যাও আমি এটা নিয়ে নামছি।
 তিয়াসা একটু মনেমনে হাসে। নিজেই মনেই বলে, "ওই যে একটা প্রবাদ আছে না আর একবার সাধিলেই খাই " বাবুর দশা ঠিক এরূপ। ছাব্বিশ বছরের তরতাজা যুবকের সামনে একটা চব্বিশ বছরের যুবতী তার রূপ যৌবন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখি কতক্ষন পরে কিংবা কতদিন পরে ধ্যান ভঙ্গ হয়?
 তিয়াসা নিচুতে নেমে গিয়ে তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ীকে প্রণাম করে। নিলয়ও তিয়াসার দেখাদেখি বাবা,মাকে প্রণাম করে দাঁড়ালে নীলিমা বলে ওঠেন,
--- বেরিয়ে পর এবার। 
নিলয় ট্রলি নিয়ে আগে আগে আর তিয়াসা তার পিছন পিছন এগিয়ে যায়। ক্যাবটা বাড়ির ভিতরে থাকতেই বুক করেছিলো নিলয়। ক্যাব এসে দাঁড়ালে দু'জনে তাতে উঠে পড়ে। পাশাপাশি দু'জনে বসে কিন্তু চুপচাপ। তিয়াসা বুঝতে পারে নিলয় বারবার আড়চোখে তাকে দেখছে। আর মনেমনে ভাবছে বরফ গলার আর বেশি সময় নেই।

ক্রমশ 

Sunday, February 12, 2023

একদিন ভালোবাসবে ( চতুর্থ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (চতুর্থ পর্ব)

 
  কলেজের অনেক ছেলেই নিলয়ের সাথে শ্রাবণীর বন্ধুত্বকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। শ্রাবণী ছিল কলেজের অনেকের চোখে ক্রাশ।তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সম্রাট আর নিশীথ।কিন্তু সে কোনদিনও কাউকে পাত্তা দেয়নি। পিকনিকের দিন থেকেই ওদের এই মেলামেশাকে গুটিকয়েক ছেলের চক্ষুশূল হয়ে উঠলো দু'জনেই। 
  ফাইনাল পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে শ্রাবণীর বাবার হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়াতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ভদ্রলোকের একরোখা মনোভাবের কারণে কোন আত্মীয়ের সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিলো না।ফলে যা হয় তাই হল।কেউ কেউ এক দু'দিন ফোনেই একটুআধটু খবরাখবর নিলেন।বাকি একা শ্রাবণীই দৌড়ঝাঁপ করতে লাগলো। নিলয়ের সাথে ফোনে কথা প্রসঙ্গে সে বাবার অসুস্থ্যতার কথা জানায়। ওই ঘটনার পর থেকে শ্রাবণী নিলয়ের কাছে অনেকটাই ফ্রী হয়ে যায়।কিন্তু বারবার করে সে নিলয়কে হাসপাতাল আসতে নিষেধও করে।নিলয় তার কোন কথাকে গুরুত্ব না দিয়েই হাসপাতালে এসে হাজির হয়।আর আসার পর থেকেই দৌড়াদৌড়ি,ছুটাছুটি সেই করে। 
  
  শ্রাবণীর বাবার শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা ছিলো। উপরন্তু ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে জলও জমে গেছিলো। একসময় তাকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়।ওই সেদিনই শ্রাবণীর মা প্রথম নিলয়কে দেখেন। সেদিন তিনি মেয়ের নিষেধকে অগ্রাহ্য করে এসেছিলেন।নার্সিংহোমে যখন তখন প্রয়োজন অপ্রয়োজনে রোগীর বাড়ির লোকের কাছে এক প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেওয়া হয় যখন তখন। আর ঠিক এই দৌড়ঝাঁপগুলি নিলয় করে। যদিও টাকা সবসময় শ্রাবণী দিয়ে দিয়েছে কিন্তু তবুও নিলয়ের পকেট খরচ থেকে কিছু তো খরচ হয়েছেই।

   শ্রাবণী সব সময় একটা ভয়ে ভয়ে থাকে বাবার কানে কথাটা চলে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। মা সেদিন এসে ছেলেটি 'কে'জানতে চেয়েছিলেন। মাকে বন্ধু বলে মানিয়ে নিলেও বাবা যে এটা জানলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে তুলবেন এটা শ্রাবণী বেশ ভালোভাবেই জানে। বাবা রেগে গেলে বাবার যে কান্ড জ্ঞান লোপ পেয়ে যায় এটা তাদের পরিবারের কারও অজানা নয়।কিন্তু নিলয় তার কোন কথাই শুনলো না। গত পনেরদিন ধরে হাসপাতালে নিলয় ছুটাছুটি করলেও কোনদিন সে শ্রাবণীর বাবাকে দেখতে ভিতরে ঢোকেনি কিংবা বলা ভালো শ্রাবণী তাকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি।
  শ্রাবণী বুঝতে পারে সে আস্তে আস্তে নিলয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু তার বাবা কোনদিনও যে এ সম্পর্ক মেনে নেবেন না তা সে ভালোভাবেই জানে। নিজের ভালোলাগা,ভালোবাসাকে সে নিজের মধ্যেই রেখে দেয়। কিন্তু নিলয় সামনে আসলেই তার বুকের ভিতর তোলপাড় করতে থাকে। নিলয়ের হাত থেকে কোন জিনিষ নিতে গেলেও ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠে।
  এরই মধ্যে একদিন ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার পর দু'জনে মিলে একসাথে অনেকটা পথ হেঁটে এসে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে চুপচাপ ঝালমুড়ি খাচ্ছিল।হঠাৎ নিলয় তাকে বলে ওঠে,
--- আমাদের এই বন্ধুত্বটা আজীবন রাখবি তো?
 নিলয়ের প্রশ্নে শ্রাবণী চমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। নিলয় পুনরায় বলে,
--- তোর সাথে যদি সারাজীবন একই সাথে হাঁটতে চাই তোর কোন আপত্তি নেই তো?
 শ্রাবণীর তখন ইচ্ছে করছে এই ফাঁকা নির্জন জায়গায় নিলয়কে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখটি নিয়ে ফিসফিস করে বলে,'খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোকে।তোর সাথেই আমি সারাজীবন হাতে হাত রেখে হাঁটতে চাই।" 
  কিন্তু কোন কথাই সে বলতে পারে না।বাবার অনুপস্থিতিতেও বাবার ভয়েই সে চুপ করে থাকে। শুধু চোখ'দুটি জলে ভর্তি হয়ে যায়। হঠাৎ করেই নিলয় ওর হাতদুটো ধরে বলে,
--- তোর এই চোখের জল আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। আমি খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি জোগাড় করে নেবো। আমি জানি আমার পছন্দ করা মেয়েকে বাবা মা খুশি মনেই মেনে নেবেন।
 হাত'দুটো নিজের মুখের কাছে নিয়ে আলতো করে একটা চুমু করে শ্রাবণীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
--- এত সুন্দরী,স্মার্ট মেয়ে তুই। মুখ ফুটে কথাটা না বলে কাঁদতে শুরু করে দিলি?
--- তুই জানিস না নিলয় আমার বাবা খুব একগুঁয়ে,জেদী মানুষ।তিনি যা বলবেন তাই করেই ছাড়বেন।তিনি কিছুতেই এ সম্পর্ক মেনে নেবেন না।
--- তিনি মেনে নেবেন কি নেবেন না সেতো পরের কথা তুই আমাকে ভালোবাসিস তো?
 শ্রাবণী এবার দু'হাতে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
--- তুই বুঝিস না? আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি। 
 শ্রাবণী নিলয়ের কাঁধেই একটা কিস করে।নিলয় দু'হাতে তার মুখটা সামনে এনে মিষ্টি হেসে নিজের ঠোঁট আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,
-- উহু ওখানে না, এইখানে --
 শ্রাবণী লজ্জায় এবার লাল হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
--- ডিউ থাক এটা ,অন্যদিন দেবো।
--- তোকে পাওয়ার জন্য দরকার হলে তোর বাবার পায়ে ধরতেও রাজি আছি।কিন্তু এজীবনে আমি কিছুতেই তোকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেই পারি না।

  পনেরদিন পড়ে শ্রাবণীর বাবাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়।শ্রাবণী কাকুতিমিনতি করে নিলয়কে হাসপাতাল আসতে নিষেধ করে দেয়।কিন্তু নিলয় তবুও আসে। তবে দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। একটা ক্যাব বুক করে শ্রাবণী তার বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।ক্যাবের মধ্যে বাবা,মেয়ের কোন কথাই হয় না।শ্রাবণী লক্ষ্য করে বাবার মুখটা বেশ থমথমে।বুঝতে পারে বাবা কোন একটা ব্যাপার নিয়ে খুব রেগে আছেন।কিন্তু কী সেটা বুঝতে না পারলেও নিলয়কে নিয়ে একটা অজানা আশংখ্যা তার মনে থেকে যায়।

  বাবা বাড়িতে ফেরেন ঠিকই কিন্তু সব সময় মুখটা গম্ভীর। চিৎকারটা আগের মত অসুস্থ্যতার কারণে করতে না পারলেও মুখটা দেখলেই বোঝা যায় যে তিনি ভিতরে ভিতরে সর্বদা রেগে আছেন। বিশেষত শ্রাবণী কোন কথা বললেই তার যেন রাগটা আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। একদিন শ্রাবণীর মা তাকে বললেন,
-- হ্যাগো মেয়েটা পনেরটা দিন ধরে যে এত পরিশ্রম করে তোমায় সুস্থ্য করে নিয়ে আসলো বাড়ি তোমার কী মন বলে কিছু নেই। মেয়েটার সাথে একটু ভালোভাবে কথাও বলো না। তোমার কোন পরিবর্তন নেই।
--- তুমি শিওর তোমার মেয়ে একাই হাসপাতালে ছুটাছুটি করেছে?
-- এ আবার কী কথা। আমি তো রোজ যেতেও পারিনি। নিজে অত কিছু বুঝিও না। ও একাই তো সব করলো।
-- একটি ছেলে ছিল তুমি কি সেটা জানো? আগে ওর কাছ থেকে জানো ছেলেটার সাথে ওর সম্পর্কটা কী?
 শ্রাবণীর মা একটু চুপ করে থেকে মনে করলেন তিনিও ছেলেটিকে দেখেছেন। মনে পড়াতে বললেন,
--- হ্যাঁ জানবো না কেন? ওতো ওর বন্ধু। ছেলেটি ছিল বলেই ওর পরিশ্রমটা একটু কম হয়েছে।তোমার তো এত আত্মীয়স্বজন কই কেউ তো একদিনের জন্যও আমাদের এই বিপদে এসে পাশে দাঁড়ায়নি। 
-- তারা আসেনি সেটা তাদের ব্যাপার। ও ব্যাপারে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু একটা মেয়ের সমবয়সী একটা ছেলে যে শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না সে বুদ্ধি কী তোমার আছে?
-- তাহলে এখন তুমি কী করবে? মেয়েটিকে ধরে মারবে নাকি ছেলেটিকে পুলিশে দেবে?
--- দু'দিন অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতাল পরে ছিলাম এসে দেখছি ফটরফটর কথা বলতে শিখেছো। 
--- তোমার মত বেঈমান আমি আর দু'টি দেখিনি। এই জন্যই কোন আত্মীয় স্বজনেরা কোনদিন তোমার সাথে যোগাযোগ রাখেনি।
শ্রাবণীর বাবা চিৎকার করে বলে উঠলেন,
--- আর একটা কথা যদি এ বিষয়ে বলো তাহলে আমাকে কিন্তু অন্য ব্যবস্থায় করতে হবে।
 শ্রাবণীর মা চুপ করে অন্য ঘরে চলে গেলেন। চিৎকার করলে তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে আর তিনি মানুষটিকে ভালোভাবেই চেনেন। সবে মাত্র একটু সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এখন যদি আবার চিৎকার,চেঁচামেচি শুরু করেন তাহলে শরীর আরও খারাপ হবে। কিন্তু তিনি বেশ জানেন এই ঘটনা এখানেই শেষ হবে না ভবিষ্যতে ছেলেটির জীবনে কী অপেক্ষা করে আছে সেটা চিন্তা করলেই অজানা আশঙ্কায় তার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। তার স্বামী রাগ করে যেকোন ক্ষতি ছেলেটার করে দিতে পারেন এটা তিনি ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বামীর রোষানল থেকে তিনি ছেলেটিকে কিভাবে বাঁচাবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। 

ক্রমশ -