Sunday, January 9, 2022

ঝরাপাতা (ষষ্ঠ পর্ব)

ঝরাপাতা(ষষ্ঠ পর্ব)
  এরপর রাস্তাঘাটে নানান জায়গায় সুমিত ও সুচন্দার দেখা হয়েছে।কিন্তু অদ্ভুত এক ব্যাপার হল দুজনের দেখা হলেই দুজনের মধ্যে এক আড়ষ্টতা কাজ করতো।দুজনের কেউই সেই আড়ষ্টতা বা লজ্জা কাটিয়ে উঠে কথা বলা তো দূরের কথা মুখের দিকেও তাকাতে পারত না।মাঝে মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেলে তাদের জমে থাকা না বলা সব কথা এক মুহূর্তেই যেন বলা হয়ে যেত।
 একদিন বিকেলে সুচন্দা যখন তাদের উঠোনটাতে তার নিজের হাতে লাগানো কিছু ফুলগাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত ঠিক তখনই সেখানে হাজির হয় বিশাখা। বিশাখাকে দেখে সুচন্দার মনের ভিতর একটা ভয় কাজ করতে শুরু করে।সে মনেমনে ভাবে সুমিতকে ভালোলাগার কথা সে তো কাউকে কোনদিন বলেনি।বিশাখা আগে কোনদিন তাদের বাড়িতে আসেনি।তবে হঠাৎ করে আজ এলো কেন?তাছাড়া স্কুলমেস থেকে ওরা তো অনেকটা দূরেই ঘরভাড়া নিয়ে উঠে গেছিল।এইসব ভাবতে ভাবতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।বিশাখা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- কি রে আমি আসতে তুই খুশি হোসনি?এমনভাবে আমার দিকে তুই তাকিয়ে আছিস মনেহচ্ছে জীবনে কোনদিন আমায় দেখিসনি।
 তারপর খুব আস্তে আস্তে বললো," তাও যদি যার মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা তোর থাকতো"!
 বিশাখার পুরো কথাটা সুচন্দা ভালোভাবে শুনতে না পেলেও কিছুটা তার কানে যায়।সে থতমত খেয়ে বলে,
--- কি বললি আমি ঠিক পরিস্কার বুঝতে পারিনি।
--- আমার মুখে শুনে পরিস্কার করে বুঝে আর কি হবে?নিজে যদি কোনদিন বুঝতে পারিস সেদিন বুঝিস।
 সুচন্দার বুঝতে একটুও বাকি থাকলো না ও সুমিতকে নিয়ে যা ভাবছে সুমিতও ঠিক তাইই ভাবছে।আর সে তার ভাবনার কথাটা বোনের সাথে শেয়ার করেছে।সুচন্দা তার বাড়ির এদিকওদিক তাকিয়ে বিশাখার হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়।
--- কি উল্টোপাল্টা বলছিস বলতো ?
--- উল্টোপাল্টা বলছি?ন্যাকা!যেন কিছুই বোঝে না।ওদিকে একজনে দিনরাত তোর কথা ভেবে চলেছে আর এদিকে তুই তার কথা ভেবে চলেছিস।কিন্তু কারোরই সাহসে কুলাচ্ছে না পরস্পরকে কথাটা বলার।অগত্যা আমিই নামলাম পথে।
 কথাগুলো বলেই বিশাখা হাসতে থাকে।কিন্তু সে এসব কথার মধ্যে না ঢুকে তার কাছে জানতে চায়,
--- এই তোরা তো এখন অনেক দূরে বাসা ভাড়া করে চলে গেছিস।কি করে ফিরবি রাত হয়ে গেলে?
--- ঘুরিয়ে দিলি তো কথাটা?ঠিক আছে -- তোর কথারই উত্তর দিই তবে।আমরা ওখান থেকে চলে এসেছি। ও বাড়িতে জলের খুব কষ্ট।এখন আমরা তোদের এই বাড়ি থেকে একটা বাড়ি পরেই ভাড়া এসেছি।তাই ভাবলাম তোর সাথে একটু দেখা করে যাই।ঠিক আমি ভেবেছি কথাটা তা নয় দাদা ই বললো তোর সাথে দেখা করবার কথা।তোকে একটা কথা বলবো চন্দা সত্যি করে উত্তর দিবি?
--- বল কি জানতে চাস 
--- দাদা তোকে ভালোবাসে এটা আমি বুঝতে পারি।কারণ দাদা তোর কথা বলতে,তোর গল্প শুনতে  খুব ভালোবাসে।কিন্তু তুই ও কি সত্যিই দাদাকে ভালবাসিস?
 সুচন্দা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনের মধ্যে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে খুব ধীরে ধীরে তার বন্ধুকে বললো,
--- দেখ শিখু সত্যি কথা বলতে মাত্র কয়েকটা মাস দেরি আছে আমাদের মাধ্যমিকের।এখন এসব নিয়ে ভাবতে গেলে পড়াশুনার কিছুটা হলেও ক্ষতি হবে।তাই এইসব আলোচনা এখন থাক।
--- আচ্ছা আমার কাছে বলতে তোর লজ্জাটা কোথায়? দাদার কথাবার্তা শুনে আমি পরিস্কার বুঝেছি সে তোকে ভালোবাসে।তাহলে তোর দিকটা তাকে তুই জানা।
--- এসব কথা জানানোর জন্য জীবনে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে।এখন আমরা দুজনেই স্টুডেন্ট।পড়াশুনাটা শেষ করি আগে।নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াই তারপর নাহয় এসব আলোচনা করবো।
--- সব ব্যাপারে তুই এত জ্ঞান দিস যে তোকে কিছু বলায় যায় না।যাক গে -- তোরা যা ভালো বুঝিস তাই কর।তবে একটা কথা বলি ছাত্রী হিসাবে তুই যেমন খুব ভালো আমার দাদাও কিন্তু খারাপ নয়। ভবিষ্যৎ এ দাদা কিন্তু ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনেই যাবে।আমি বন্ধু হিসাবে তোকে যেটুকু চিনি আর দাদার বোন হিসাবে তাকে যেটুকু জানি জীবনে কোনকিছুর জন্যই তোরা তোদের লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াবি না।সবকিছুরই একটা সময় আছে।তাই বলছি কি সত্যিই যদি দাদাকে নিয়ে তোর মনের মধ্যে কোন ভাবনা তৈরি হয়ে থাকে সেটা জানিয়ে দিস।
 সেদিন বিশাখার কথাগুলি যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও নিজের লজ্জা সরিয়ে সুচন্দা পারেনি সুমিতকে তার মনের কথাগুলো জানাতে অপরদিকে সহজ সরল সুমিতও পারেনি সুচন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভালোবাসার কথা জানাতে।সুচন্দা  এরপর নিজেকে নানানভাবে তৈরি করে সুমিতকে তার মনের কথাটা জানানোর জন্য বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতে গেছে।কোনদিন সুমিত একা ঘরে রয়েছে জানতে পেরে দরজা দিয়েই বাড়ি চলে এসেছে,আবার কোনদিন বা ঘরে ঢুকে বন্ধুর সাথে গল্পগুজব করেই ঘরে ফিরেছে।আর লাজুক সুমিত সুচন্দাকে দেখেই নিজেই জড়োসড়ো হয়ে যেত।তাই  সাহস করে কোনদিনও তাকে মনের কথাটা বলতে পারেনি।
 মাধ্যমিকের শেষে একদিন বিকেলবেলা সুচন্দা সুমিতদের বাড়িতে যায়।তখন শিখা পরীক্ষা শেষে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।সুচন্দা আজ ঠিক করেই যায় সুমিতকে সে তার মনের কথাটা জানাবে।
 সুচন্দা জানতো বিশাখা তাদের দেশের বাড়িতে গেছে।সে যখন সুমিতদের বাড়িতে আসে তখন দেখে দরজা ভেজানো।সে আস্তে করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে।সামনের ঘরটাতেই সুমিত থাকতো।আর তার পরের ঘরে থাকতো বিশাখা।মাঝে মধ্যে অবশ্য বিশাখার দিদিও এসে এখানে থাকতো।সে এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তাই সেখানকার মেসেই থাকে।সুমিতের বাবা গ্রামের সাধারণ একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক।ন্যায়,নীতি আর আদর্শে তিনি কিন্তু অসাধারণ।প্রতিটা ছাত্রছাত্রী তার কাছে নিজ সন্তান।গ্রামে পড়াশুনার তেমন সুবিধা না থাকায় কারণেই সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশুনার পরেই তিনি অতি কষ্টে হলেও শহরে ঘরভাড়া নিয়ে তার ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার কোনোই কার্পণ্য করেননি।সাধারণ একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হওয়ার ফলে এবং একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ হওয়ার ফলে হয়ত দুবেলা মাছ,ভাত তিনি জোগাড় করতে পারেননি কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি তার বিশাল পরিবারের কোন সদস্যকেই কোনদিন অভুক্তও রাখেননি।
  সুচন্দা ঘরে ঢুকে দেখে সুমিত একমনে তার পড়ার টেবিলে বসে একটা ছবি দেখে কোন আর্ট পেপার নয় নিজের অঙ্কের খাতার উপর কি যেন  একে চলেছে।সুচন্দা যে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছে কিংবা তার টেবিলের অনেকটা কাছেই এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনকিছুই সুমিত টের পায়নি।সামান্য কয়েক হাতের মাত্র ব্যবধান।সুচন্দা একটু কাত হয়ে দেখে সুমিত সুচিত্রা সেনের একটি ছবি দেখে হুবহু তারই মত তার খাতায় পাতায় একটি ছবি আঁকছে।এতদিন ধরে সুচন্দা সুমিত সম্পর্কে যেটুকু শুনেছিল আজ আরও একটি নূতন পালক তাতে সংযোজিত হল।সুমিত একজন ভালো অঙ্কনশিল্পীও বটে!

ক্রমশঃ
 

No comments:

Post a Comment