ঝরাপাতা (একাদশ ও শেষ পর্ব)
বিশাখার বিয়ের একবছরের মাথায় সুমিতের বিয়ে হয় দীপালীর সাথে।বোনের বিয়েতে সুমিত আসতে পারেনি।বিয়ের সময় এসে সুমিত মাসখানেক ছিল।তারপর দীপালিকে নিয়ে সে সুইডেন চলে যায়।বৃদ্ধ বাবা,মা গ্রামের বাড়িতেই থেকে যান।তবে সুমিত তাদের সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু তারা কেউই রাজি হননি।এমনকি সুমিত বিয়ের পরে প্রথম যেবার টাকা পাঠায় সুমিতের বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ফোন করে জানিয়ে দেন
--- তুমি বোনের বিয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছো।সেখানে আমার কোন খরচই হয়নি।সুতরাং আমার যা ক্যাশ ছিল তাতে হাত পড়েনি।এখন আমি ভালোই পেনশন পাই।তোমার দিদি এবং বোন উভয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।তারা দুজনেই চাকরি করে।ভালোই আছে তারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে।প্রত্যেক বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে তাদের ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার এবং পরবর্তীতে তাদের সংসারী করার।আমরা সে দায়িত্ব পালন করেছি।আমরা সুযোগ দিয়েছি তোমরা তোমাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সে সুযোগকে কাজে লাগিয়েছো।তোমাদের কারো কাছে আমাদের কোন চাহিদা নেই।তোমরা ভালো থেকো এটাই শুধু একমাত্র কামনা আমাদের।বছরে একবার করে দেশে এসো তুমি এটাই শুধু চাই।
বাবা মা যতদিন বেঁচে ছিলেন সুমিত বছরে একবার করে দেশে এসেছে বাবার কথা রাখতে।দুই ছেলেমেয়ের বাবা সে।পুরো দুনিয়াটা আজ মানুষের হাতের মুঠোয়।রোজই সুমিত তার দিদি ও বোনের সাথে কথা বলে।বিশাখা নার্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন একটা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা।স্বামী,স্ত্রী একই স্কুলে আছে।
বিশাখা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর প্রথমেই নার্সিং ট্রেনিংয়ের জন্য ভর্তি হয়।সাথে সে চাকরির জন্য নানান জায়গায় পরীক্ষা দিতে থাকে।স্কুল জীবনে বিশাখা খুব ভালো ছাত্রী না হলেও সে ছিল খুবই অধ্যবসায়ী।ফলে রেজাল্ট তার বেশ ভালই হত।নার্সিং ট্রেনিং শেষে সেখান থেকেই সে সরকারি হাসপাতালে চাকরী পেয়ে যায়।বছর খানেক যখন চাকরির বয়স তখন তার বিয়ে হয়।এর ঠিক ছমাস পরেই তার স্কুলের চাকরির খবর আসে।নার্সের চাকরি মানেই শিপ্টিং ডিউটি।আর অধিকাংশ শ্বশুরবাড়িতে শিপ্তিং ডিউটি করতে যাওয়া মানেই ছোটখাটো ঝামেলার সম্মুখীন হওয়া।সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে আট ঘণ্টা কোন কোনদিন বা তারও বেশি অমানুষিক পরিশ্রমের পর বাড়িতে এসে সর্ব কাজ করেও শ্বাশুড়ির নিত্য গঞ্জনা বিশাখার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে।আর ঠিক এমনই এক মুহূর্তে বিশাখার প্রাইমারী স্কুলে জয়েনিং লেটার আসে।বিশাখার স্বামী তাকে নার্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্কুলে জয়েন হতে বলে।কারণ তাহলে ছেলের সামনে তার মা বিশাখার উপরে এত বেশি অত্যাচার করার সুযোগ পাবেন না।
সুধীরের কথামত বিশাখা নার্সের চাকরি ছেড়ে স্কুল শিক্ষিকার পদই গ্রহণ করলো।তবে সুধীরের স্কুলে বদলী হয়ে আসতে তাকে বেশ কয়েক মাস কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।তবে এক্ষেত্রে শ্বাশুড়ির অত্যাচার বেশ কিছুটা হলেও কম ছিল।সুধীর ঘরে থাকতেই বিশাখা যেটুকু সংসারের কাজকর্ম শেষ করতে পারতো সে টুকুই করে চলে যেত আর যখন স্কুল থেকে ফিরতো সে সময়ও সে ঘরেই থাকতো।কাজ আগেও সব করতো এখনো করে পার্থক্য একটাই আগে সব কাজ করেও শ্বাশুড়ির মুখ ঝামটা খেত কিন্তু এখন সব কাজ করার পরে সেই মুখ ঝামটাটা আর খেতে হয় না।
এরও মাস ছয়েক পরে বিশাখা প্রেগন্যান্ট হয়।এতদিন বদলীর জন্য ছুটাছুটি করে যে কাজ সুধীর করতে পারেনি এবার এই ঘটনার কথা জানার পর বিশাখার বদলীর পথ তরান্বিত হয়।বিশাখা বদলী হয়ে সুধীরের স্কুলে জয়েন করে।
দেখতে দেখতে দশ মাস দশ দিন কেটে যায়।বিশাখা জন্ম দেয় একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্র সন্তানের।বিশাখার শ্বাশুড়ীও নাতির মুখ দেখে ভীষণ খুশি।তিনি যেন একটু বেশীই খুশি নাতিকে দেখে।কারণ খুঁজতে খুঁজতে জানা গেলো বিশাখার শ্বশুরমশাইয়ের নাকের ডানদিকে একটা জরুল ছিল।বিশাখার ছেলেরও ঠিক ঐরূপ একটি জড়ুল রয়েছে নাকের ডানদিকে।তো শ্বাশুড়ী মা একশ পার্সেন্ট সিওর সুধীরের বাবা ই সুধীরের ছেলের রূপ ধরে তার কাছে ফিরে এসেছেন।এতে সুবিধা হয়েছে বিশাখার একটাই ছেলেকে নিয়ে তার কোনোই হ্যাপা পোহাতে হয় না।
কিন্তু সুখ বেশিদিন বিশাখার কপালে ঈশ্বর লেখেননি।ছেলের বয়স তখন পাঁচ বছর।একদিন স্কুল চলাকালীন সময়ে সুধীর খুব অসুস্থ্য বোধ করে।বুকের বা দিকটা চাপ চাপ ব্যথা অনুভব করতে থাকে।ক্লাস করতে করতে অসুস্থ্যতা বোধ করায় একজন ছাত্রকে পাঠায় বিশাখাকে ডেকে আনবার জন্য।কিন্তু বিশাখা আসার আগেই বুকের ব্যথায় অস্থির সুধীর চেয়ারে বসে থাকাকালীন অজ্ঞান হয়ে নিচুতে পরে যায়।ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তাদের স্যারের এই অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।কতটুকু আর কিইবা করতে পারে তারা?বিশাখা ছুটে আসে।বিশাখা তার সহকর্মীদের সাহায্যে সুধীরকে নিয়ে বড় নার্সিংহোম যায়।কিন্তু ইমারজেন্সিতেই ডাক্তার দেখে জানিয়ে দেন বেশ কিছুক্ষন আগেই সুধীর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে চলে গেছে।
শুরু হল বিশাখার জীবনে আর এক লড়াই।ঘটনার আকস্মিকতায় সে পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়।আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু,স্কুল কলিগের সহয়তায় সব কাজ মিটলো ঠিকই কিন্তু শ্বাশুড়ীর মধ্যে দেখা দিল আবার আগের সেই রণচন্ডি মূর্তি।দাদা বাইরে থেকে তাকে জানালো বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি মিলিয়ে তাকে থাকতে তাতে করে অন্তত একটু হলেও মানসিক শান্তি সে পাবে।কিন্তু তার শ্বাশুড়ী তাকে এক বেলার জন্যও ছেলে সমেত কোথাও ছাড়বে না।কোথাও যাওয়ার কথা বললেই তিনি অকথ্য ভাষায় বিশাখাকে গালমন্দ করতে থাকেন।প্রতিটা মুহূর্তেই তিনি তাকে মনে করে দিতে ভোলেন না বিশাখার জন্যই তিনি তার সন্তানকে হারিয়েছেন।
মাঝে মধ্যে বাপের বাড়িতে কিছুক্ষনের জন্য আসলেও ছেলেকে আনার সাহস কোনদিন সে পায়নি।স্কুল,বাড়ি আর সংসারের যাবতীয় কাজ -- এইভাবেই চলে গেলো আরও বেশ কয়েকটা বছর।প্রয়োজন ছাড়া কেউই তার মুখে কোন কথা শুনতে পায়না।ছেলে সুবীর যত বড় হতে থাকলো ততই সে অদ্ভুতভাবে মায়ের নেওটা হয়ে উঠতে লাগলো।ঠাকুমাকে যথেষ্ঠ ভালোবাসলেও ঠাকুমার তার মায়ের প্রতি অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ সে দশ বারো বছর বয়স থেকেই করতে শুরু করে।আর বিশাখা ছেলের তার প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ দেখে একটু একটু করে যেন মানসিক বল ফিরে পেতে শুরু করে।
খুব ছেলেবেলা থেকেই সুবীর অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে ঠিক তার বাবা সুধীরের মতই দুখিনী মায়ের পাশে থেকে সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে তার মাকে রক্ষা করে চলে।স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম বিশাখার মনে হতে থাকে তাকে বাঁচতে হবে শুধু তার ছেলের জন্যই নয় তার নিজের জন্যও।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment