ঝরাপাতা (অষ্টম পর্ব)
বাড়িতে ফিরে স্বভাবতই সুচন্দার মনটা খুবই খারাপ হয়ে থাকে।সে চুপচাপ হয়ে যায়।কিন্তু পাঁচ বছরের দিদির মেয়ে রিনিটার দুষ্টুমিতে মাঝে মধ্যে কিছু সময়ের জন্য তার মন খারাপ উধাও হয়ে যাচ্ছিল।দিদি,জামাইবাবু খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে কোন কারনেই হোক সুচন্দার মনটা খুবই খারাপ।বারবার তারা দুজনেই জানতে চেয়েছেন কিসের জন্য তার মন খারাপ।কিন্তু চাপা স্বভাবের সুচন্দা সেকথা কাউকেই জানাতে পারেনি।
দিদি,জামাইবাবু দুজনে আলোচনা করে ঠিক করে তারা বাড়িতে ফেরার সময় সুচন্দাকে নিয়েই ফিরবে।কারণ তার এখন পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর অফুরন্ত সময়।বাবা,মা মেয়ে জামাইয়ের এই সিদ্ধান্তে খুবই খুশি হন এবং তারা সানন্দে মত দেন।কারণ তারা নিজেরাও কটাদিন ধরে লক্ষ্য করছেন সুচন্দা একটু মনমরা হয়ে থাকছে।প্রায় প্রতিদিনই সকলের অলক্ষ্যে সুচন্দা একবার করে সুমিতদের বাড়িতে গেছে কোন খবর পায় কিনা তার।কিন্তু প্রতিবারই গিয়ে সে বিফল হয়েই ফিরেছে।
দিদি,জামাইবাবু সুচন্দাকে জানায় তাদের সাথে শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য।সুচন্দা শুনেই না বলে দেয়।কিন্তু তাদের জোরাজুরিতে আর বাবা,মায়ের কথার উপর তার আপত্তি কর্পূরের মত উড়ে যায়।সে যেতে বাধ্য হয়।
কথা ছিলো খুব বেশি হলে দিন পনের মত থেকে চলে আসবে।কিন্তু পরিস্থিতি বইলো স্রোতের বিপরীতে।দিদির বাড়িতে পৌঁছানোর দিন দশেক পরে হঠাৎ করেই দিদি একদিন মারত্মক অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।সারারাত পেট যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।ভোরের দিকে রিনিকে সুচন্দার কাছে রেখে সুচন্দার জামাইবাবু তার দিদিকে নিয়ে হাসপাতাল ছোটে।ডাক্তার বলেন অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
এদিকে সুমিত বাড়িতে পৌঁছে দেখে বাবা ভীষণ অসুস্থ্য।গ্রামের ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভই হচ্ছে না দেখে বাড়ির সকলের সাথে আলোচনা করে বাবাকে নিয়ে কলকাতা আসে।গ্রামের বাড়িতে তালা দিয়ে সব কলকাতা ভাড়া বাসায় এসে ছোট্ট পরিসরে জায়গায় সংকুলান হচ্ছে না দেখে বাবা হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়েই তারা অন্য একটি বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখান থেকে উঠে যায়।এরমধ্যে সুমিত তার বোনকে পাঠিয়ে সুচন্দাদের বাড়ি থেকে জেনে যায় যে সে বেশ কিছুদিন দিদির বাড়ি শিলিগুড়ি আছে।সুমিতের কলেজ,বাবা হাসপাতাল ভর্তি সেখানে ছুটাছুটি তার উপর সুচন্দার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছে না সব মিলিয়ে সুমিতের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।এইভাবে প্রায় দুমাস কেটে গেলো।সামনেই মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে।সুমিত ধৈর্য ধরে বসে আছে রেজাল্ট বেরোনোর আগেই সুচন্দা কলকাতা ফিরে আসবে।সে বিনা কারণে সুযোগ পেলেই সুচন্দাদের বাড়ির সামনে থেকে যাতায়াত করে।বোনকে দিয়ে মাঝে মাঝেই খবর নেয় তাদের বাড়ি পাঠিয়ে।সারা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যেও এক মুহূর্ত সময়ও সুমিতের মন থেকে সুচন্দার চিন্তা যায় না।সব দায়িত্বই সে পালন করছে ঠিকই কিন্তু নিজের মনটাকে কিছুতেই সে কন্ট্রোল করতে পারছে না।সংসারে বড়ছেলে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে প্রতি মুহূর্তে নিজের কষ্ট বুকে চেপে রেখে দায় দায়িত্বগুলি পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা তার।কিছুটা হলেও পড়াশুনার ক্ষতি তো তার হচ্ছেই।বাবাও আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে উঠছেন।ছুটি পেয়ে কটাদিন এখানে কাটিয়ে তারপর গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন।কাজগুলো আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিয়ে আসতে পারলেও সুচন্দার কোন খোঁজ না পেয়ে সেদিনের সেই ঘটনার পরে আর তার সাথে দেখা না হওয়ার যন্ত্রণা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে।
ওখান থেকে চলে আসার পর হঠাৎ একদিন সেই কাজের মেয়ে ঝর্ণার সাথে তার দেখা।তাকে দেখতে পেয়ে সুমিত এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়
--- আচ্ছা তুমি সেদিন সেই চিঠিটা দিয়েছিলে সুচন্দাকে?
প্রথম অবস্থায় ঝর্ণা একটু থতমত খেয়ে যায়।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ডাহা মিথ্যা বলে দিলো।
--- হ্যাঁ দিয়েছিলাম তো।
--- কিছু বলেনি?
--- না দাদা আমি সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। চিঠিটা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে এসেছিলাম।
সুমিত আর কথা বাড়ায় না।কারণ এদের পেটে কোন কথা থাকে না।কোথায় কোন বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে এটাই প্রধান গল্পের বিষয় হয়ে উঠবে।
বিশাখা সুচন্দাদের বাড়ি মাঝে মাঝে যায়।আর যেটুকু খবর জোগাড় করতে পারে দাদাকে এসে জানায়।এদিকে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর সময় এসে গেলো।কিন্তু সুচন্দার দেখা নেই।বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে সুচন্দা প্রথম বিভাগে পাশ করেছে।সুচন্দা এবার ফিরে আসবে এই আশা নিয়ে সে প্রায় প্রতিদিনই তাদের বাড়ির সামনে থেকে যাতায়াত করে বোনকে পাঠায় সুচন্দাদের বাড়িতে।কিন্তু না সে ফিরে আসে না।বরং একদিন বিশাখা সুচন্দার বাড়ি থেকে ফিরে এসে তার দাদাকে জানায়
--- তুই কি জানিস দাদা একদিন সকালে সুচন্দা যখন স্যারের বাড়ি পড়তে যাচ্ছিল একটি ছেলে তাকে অত ভোরে একা পেয়ে রাস্তায় হেনস্থা করেছিলো।
সুমিত যেন কিছুই জানে না এমনভাবে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- না,আমি সেরকম কিছু শুনিনি তো।কেন কি হয়েছে কি তাতে?
--- এই কয়েকদিন আগে মেসোমশাই এর কানে সে কথা যাওয়াতে তিনি সুচন্দার দিদিকে জানিয়ে দিয়েছেন সুচন্দাকে তারা যেন তাদের কাছে রেখেই পড়াশুনা করায়।তাকে যেন কলকাতায় আর না পাঠায়। এখান থেকেই তিনি সমস্ত রকম খরচপাতি বহন করবেন।
এ কথা শুনে সুমিতের মনে হতে থাকে তার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে।সে ধপ করে নিজের সিঙ্গেল খাটটায় বসে পড়ে।মাথাটা নীচু করে থাকে।চোখ থেকে তখন টপটপ করে জল পড়ছে।বিশাখা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে দাদার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরে সুমিত উঠে ঘরের লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে আবার গিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসে পড়ে।
ভালোবাসার শুরুতেই কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পাপড়িগুলো একটা একটা করে ঝরে গেলো।বিধাতা এত নিষ্ঠুর কেন?কেন তিনি দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটিয়ে এইভাবে সারাজীবনের জন্য তাদের আলাদা করে দিলেন?কতক্ষন সে কেঁদেছে আর কতক্ষন সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে একাকী সে শুয়ে ছিল কিছুই তার মনে নেই।বিশাখা যখন ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দাদাকে খেতে ডাকতে এসেছে তখন রাত গভীর।প্রায় বারোটা বাজে।সেতো সবকিছুই জানতো তাই দাদাকে কিছুটা সময় নিরিবিলি নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। একটুও বিরক্ত করতে চায়নি।কিন্তু তার এখন এতটাই খিদে পেয়ে গেছে যে দাদাকে না ডেকে কোন উপায়ই নেই।কারণ ভাইবোন একসাথেই রাতে খায়।বাবা সুস্থ্য হয়ে আবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন।সাথে মা ও।আবার সেই দুই ভাইবোনের সংসার।আর ছেলেবেলার থেকেই বিশাখার সাথে সুমিতের বন্ধুর মত সম্পর্ক।দাদা যে সুচন্দাকে ভালোবাসে সেটা প্রথম থেকেই জানার ফলে আজকে দাদার কষ্টটা সে ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে।l
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment