নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
পুতুল খেলতে খেলতেই মেয়েরা তার ভবিষৎ সংসার জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে লালিত করে একটি সুন্দর সুখনীড়।দোলন ও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা।পড়াশুনায় ছিলো তুখোড়।বাড়ির এবং স্কুল কলেজের সকলেই তার উজ্জ্বল ভবিষৎ জীবনের স্বপ্ন দেখতো।
দেখতে শুনতেও মন্দ ছিলোনা।আহামরি রূপ তার না থাকলেও কুৎসিত তাকে বলা যায়না।অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে দোলন ছিলো সকলের ছোট।তাই তার আদর ভালাবাসাটাও ছিলো একটু বেশি।
মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক বেশ ভালো নম্বর নিয়ে পাশ পর দোলন কলেজে ম্যাথে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়।স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে এসেই সে হোঁচট খায় বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে।দিদিরা তখন সকলেই সংসারী একমাত্র দাদাও তখন বিবাহিত।বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই দাদার ব্যবহারের পরিবর্তন লক্ষ্য করে দোলন।মায়ের সাথে এমনকি তার সাথেও কারনে অকারনে ঝামেলা করতে থাকে।মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারলেও অধিকাংশ সময়ই দোলন এ নিয়ে মাথা ঘামাতোনা।কারন সবসময়ই সে লক্ষ্য করেছে দাদা এই যে মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতো বৌদি মোটেই তাতে খুশি হতনা বরং প্রতিদিন রাতেই সে দাদা বৌদির ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতো কেন দাদা মায়ের সাথে এরকম ব্যবহার করে তাই নিয়ে।বাড়িটা ছিলো মায়ের নামে।বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর দাদা মাকে তার নামে বাড়িটা লিখে দিতে বলে।মা রাজি হননি।তিনি বলেছিলেন,
---দোলার পড়াশুনা শেষ হোক ও একটা চাকরী জোগাড় করুক তারপর সব সম্পত্তি আমি তোর নামে লিখে দেবো।
কিন্তু দোলন বুঝতে পেরেছিলো দাদার মনে ভয় ছিলো মা যদি সবকিছু দাদাকে না দিয়ে সকল দিদিদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেন।
দোলনের বৌদি ছিলো ভীষন ভাল মানুষ।যখন সে এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসে দোলন ছিলো স্কুল ছাত্রী।স্কুল আর পড়া ছাড়া বাকি সময়টুকু সে তার বৌদির সাথেই সময় কাটাতো।স্বভাবিকভাবেই দুজনের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।একমাত্র ভাইপো ছোটপিসি বলতে অজ্ঞান।সুখ দুঃখের সাথে দোলনের দিনগুলি এগিয়ে যেতে থাকে।দুঃখগুলো মনের মধ্যে কখনোই সে পুষে রাখতোনা কারন সে জানতো সামনে তার কঠিন লড়াই,তাকে অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে হবে।দাদার উপর সংসারের পুরো দায়িত্ব।রুগ্ন মায়ের প্রতিমাসের ওষুধের খরচ প্রচুর।বৌদির অশান্তির ভয়েই মাসের প্রথমেই অনিচ্ছা সত্বেও মায়ের পুরো মাসের ওষুধটা দাদা কিনে আনে।দোলন বুঝতে পারে দাদার উপর একটা বিশাল চাপ পরে যাচ্ছে।অবশ্য তার পড়াশুনার খরচ সে নিজেই টিউশনি করে জোগাড় করে।সন্ধ্যায় বাড়িতে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়েকে সে পড়ায়।মাঝে মাঝে সে বৌদির হাতেও কিছু গুঁজে দেয় যদিও তার বৌদি রিতা কিছুতেই সে টাকা নিতে চায়না কিন্তু দোলন তার কোন আপত্তিই শোনেনা।
দোলনের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ।দাদা একদিন জ্বর নিয়ে অফিস থেকে ঘরে ফেরে।পরদিন বৌদি তার বাচ্চাটিকে দোলন ও তার শ্বাশুড়ীর জিম্মায় রেখে স্বামীকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়।প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা অর্থ ব্যয়ের পর জানা যায় দাদার শরীরে কিডনী ছিলো জম্মগত একটা যা এখন অকেজো।ডায়ালিসিস করে কিছুদিন হয়ত দাদাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিন্তু তারপর?টাকাপয়সাও বা কোথা থেকে আসবে?দোলনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে।মায়ের শরীরও ভালোনা।মা সবকিছু জেনে গেছেন।সর্বক্ষণ দাদার খাটের পাশে বসে চোখের জল ফেলে চলেছেন।বৌদি তার সমস্ত গয়না এনে দোলার হাতে দিয়ে বলে,
---এগুলো বিক্রি করে দেখো কোন সুরাহা হয় কিনা।তোমার দাদার ব্যাংকে কিছু টাকাও আছে।আপাতত ওগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নাও।গয়নাগুলো বিক্রি করলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে বলে মনেহয়।
---কিন্তু বৌদি এগুলো তো সব তোমার বাপের বাড়ির থেকে দেওয়া গয়না।
---কি করবো আমি ওইগুলো দিয়ে আর বলতে পারো?
---দেখি দিদিদের কাল ফোন করে বলি সব কথা ওরা কোন সাহায্য করতে পারে কিনা।
না,বড়দি মেঝদি কোন সাহায্যের হাতই বাড়িয়ে দেয়নি ভায়ের অসুস্থ্যতায়।দু'জনেই পরিবারিক নানান ঝামেলার গল্প শুনিয়ে দিয়েছে।ডায়ালিসিস শুরু হয় দোলনের দাদার।ওষুধপত্র, খাওয়াদাওয়া আর ডায়ালিসিসের খরচ দোলনদের মত পরিবারের পক্ষে জোগাড় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।মা ও বৌদির সাথে ঠিক করে বসত বাড়িটা রেখে বাকি জমিজমা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।এদিকে দোলার দাদার শরীর দিনকে দিন খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে।ডক্টর কোন আশ্বাসই দিতে পারেননা।একদিন ডায়ালিসিস করে বাড়িতে নিয়ে আসার পর শরীর মারাত্মকভাবে খারাপ হওয়ায় পূণরায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।বাড়িতে আর সে ফিরে আসতে পারেনা।দোলনের কাঁধে এসে পরে মস্তবড় দায়িত্ব।
পাগলের মত হন্যে হয়ে দোলন চাকরীর চেষ্টা করতে লাগে।টিউশনি করাও বাড়িয়ে দেয়।মার পাগলের মত অবস্থা।বৌদিও একই রূপ।কোন কুলকিনারা খুঁজে পায়না।হঠাৎ করে দেখা হয় কলেজ প্রিন্সিপ্যালের সাথে।সব শুনে তিনি তার রেফারেন্সে একটি কলেজে পার্টটাইম পড়ানোর সুযোগ করে দেন।কিছুটা হলেও সংসারের হাল ফেরে।কিন্তু দোলনের মায়ের হঠাৎ করেই শরীর মারত্মক খারাপ হতে থাকে।হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।চলে যাওয়ার আগে দোলনের হাত দুটি ধরে বলে যান,"বৌমা আর ছেলেটিকে দেখিস।
দোলনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু বৌদিকে সে সবকিছু থেকে আগলে রাখতে চেষ্টা করে।বৌদি আস্তে আস্তে চুপচাপ হয়ে যেতে থাকে।ছেলেটার দিকেও খুব একটা নজর দেয়না।ভাইপো রিন্টু দোলনকে আঁকড়ে ধরে।বাড়িতে দোলন যখন ছাত্রছাত্রী পড়ায় রিন্টু তখন চুপ করে দোলনের পাশে বসে থাকে।একমাত্র দোলন বাইরে বেরোলেই সে তার মায়ের কাছে যায়।যথাসময়ে রিন্টুকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় দোলন। দোলনের বৌদি রিতা চুপচাপ থাকতে থাকতে এখন আর কারও সাথেই কথা বলেনা।কিন্তু নিজের মনে সবসময় বিড়বিড় করে চলে। নিজের ঘর থেকেও কখনো বেরোয় না।রান্নাবান্না সংসারের যাবতীয় কাজ দোলনকেই করতে হয়।এমনকি বৌদির ঘরে তার সামনে বসে থেকে রাগ দেখিয়ে তার খাবারটুকু খাওয়াতে হয়।মাঝে মধ্যে ভুলভাল কথাবার্তা বলে।কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।শেষমেষ দোলন একজন সাইকিয়াট্রিসটের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।কিন্তু দিনকে দিন অবস্থার অবনতি হতে থাকায় ডাক্তারের পরামর্শ মত তাকে এ্যাসাইলামে ভর্তি করতে দোলন বাধ্য হয় কারন রিতার ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার খরচ দোলনের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভবপর ছিলোনা।
দোলনের জীবনে তার এই সংগ্রামের পাশে সে তার সহকর্মী পলাশকে পায়।পলাশ চক্রবর্তী।দোলন কখনোই তার এই সংগ্রামবহুল জীবনে অন্য কাউকেই জড়াতে চায়নি।কিন্তু সবকিছু তো আর নিজের মর্জিমত চলেনা।দোলন বুঝতে পারে পলাশ তাকে ভালোবাসে।দোলন ধরা দেয়না।কারন পরিবারিক এই বিশাল বিপর্যয়ের পরে দোলনের ধ্যানজ্ঞান ভাইপো রিন্টুকে মানুষ করা।ইতিমধ্যে তার চাকরীটাও পার্মান্যান্ট হয়ে যায়।অবশ্য এর সম্পূর্ণ ক্রেডিটটা পলাশ চক্রবর্তীর প্রাপ্য।দৌড়াদৌড়ি,ছুটোছুটি,উপর মহলকে ধরা-সবই সেই করে। তাই ইচ্ছা থাকলেও দোলন পলাশকে এড়িয়ে যেতে পারেনা।কিন্তু হাবভাবে দোলন তাকে বুঝিয়ে দেয় রিন্টু চাকরী না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ে করে সংসার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।এ ছাড়াও আছে বৌদির চিকিৎসার বিশাল ব্যায়ভার।
( ২৪ঘন্টা বিরতির পর 😂)
No comments:
Post a Comment