Monday, January 3, 2022

ঝরাপাতা (পঞ্চম পর্ব)

ঝরাপাতা (পঞ্চম পর্ব)
  সেদিন স্যারের কাছে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেই স্যারের টেবিলে রাখা বোতল থেকে ওই ঠান্ডার মধ্যেই ঢকঢক করে জল খেতে শুরু করে সুচন্দা।তখন সবাই এসে গেছে।দেবাশীষ স্যার পড়ানোও শুরু করে দিয়েছেন।সুচন্দার দিকে তাকিয়ে স্যার বুঝতে পারেন কিছু একটাতে সুচন্দা খুব ভয় পেয়ে গেছে।তিনি সুচন্দার কাছে জানতে চাইলেন,
--- কি হয়েছে তোমার?এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন?আবার তো দেখছি ঠক ঠক করে কাঁপছ?কিছু একটাতে ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে।কি হয়েছে খুলে বলতো?
 সুচন্দারা একসাথে পাঁচজন পড়তো।স্যার সমেত বাকি চারজন ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।সুচন্দা মুহূর্তে ভেবে নিলো কথাটা এদের মধ্যে বলা মানে পুরো স্কুল জেনে যাবে।কারণ সকলেই একই স্কুলে পড়ে। ততক্ষণে সে নিজেকে কিছুটা সামলেও নিতে পেরেছে।বললো,
--- তেমন কিছু না স্যার।দেরি হয়ে গেছে তাই ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপিয়ে গেছি।
বসে পড়ে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে।দেবাশীষ স্যার ওদের অঙ্ক করাতেন।খাতা,বই খুলে অঙ্কে মন দিলেও বুকের ভিতর তখনো তার ঢিপঢিপ করেই চলেছে।মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্কও হয়ে পড়ছে।সুচন্দা যেহেতু পড়াশুনায় খুব ভালো তাই স্কুল বা টিউশন স্যারেরা তাকে খুবই ভালোবাসতেন।সুচন্দার আজকের এই আচরণ স্যারের নজর এড়ায় না। পড়া শেষে সুচন্দা ছাড়া সবাই উঠে দাঁড়ায়।সে বইখাতা গুছাতে গুছাতে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- তোরা এগোতে লাগ আমি স্যারের সাথে একটা কথা বলেই আসছি।
 বন্ধুরা বেরিয়ে গেলে সে স্যারকে বিধানের কথাগুলো বলে।স্যার সব শুনে বললেন,
--- এত ভয়ানক কান্ড!চলো আমি আজ তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসছি।
 সকাল ন'টা তখনো ভালোভাবে কুয়াশা কাটেনি।স্যার একটা  মোটা সোয়েটার আর টুপি পরে সুচন্দাকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা হেঁটে এসে দেখেন সুমিত চায়ের স্টলে বসে আছে।কোলের উপর একটা বইয়ের ব্যাগ।সুমিতকে স্যারও চিনতেন।কারণ সে ও একসময় স্যারের ছাত্র ছিল।স্যার এগিয়ে এসে তার কাছে জানতে চাইলেন,
--- এত সকালে তুমি এখানে বসে?পড়তে গেছিলে?
-- হ্যাঁ স্যার।একটু আগেই বেরিয়ে আসলাম।
--- ঘটনাটা শুনলাম।বিধান এটা ঠিক করেনি।দেখি ওর বাবার সাথে আমি কথা বলবো।আমি সুচন্দাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য বেরিয়ে ছিলাম।তোমাকে পেয়ে ভালোই হল।আমাকে তো আবার স্কুলে বেরোতে হবে তার আগে একটু বাজারে যেতে হবে।তুমি এক কাজ করো ওকে বাড়িতে একটু কষ্ট করে পৌঁছে দাও।
--- আমি ওই জন্যই বসে আছি স্যার।বিধানের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে।ও আর এরূপ করবে না কথা দিয়েছে।ওর বাবাকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে হবে না।ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে স্যার।
--- ও তাহলে ঠিক আছে।আমি তো খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।যাও ওকে বাড়ি অবধি আজ ছেড়ে দিয়ে আসো।আসলে ও খুব ভয় পেয়ে গেছে।
 সুমিত ব্যাগটা পিঠে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।পাশে সুচন্দা চুপচাপ হাঁটতে থাকে।সুমিত হাঁটতে হাঁটতেই সুচন্দাকে বলে,
--- বিধান আর কখনোই তোমায় বিরক্ত করবে না আমি তোমায় কথা দিচ্ছি।কিন্তু তুমি আজকের কথা কাউকে আর বোলো না।তাহলে ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে।
 সুচন্দা কোন উত্তর না দিয়ে হাঁটতে থাকে।তখন সুমিত পুনরায় তাকে বলে,
--- কিছু বলছো না যে ?
--- কি বলবো?আজকের ঘটনাটা এমন কোন প্রসংশাজনক নয় যে কারো কাছে গল্প করতে হবে।এটা আমার জীবনের একটা লজ্জাজনক ঘটনা! এ কথা তো আমি জীবন থাকতে কাউকে জানাতে পারবো না।তুমি বলছো ও আর এরকম করবে না।কিন্তু তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?
--- ও আমায় কথা দিয়েছে।আর আমি ওকে বুঝিয়ে বলাতে ও নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে।যেটুকু মানুষ চিনি তাতে বুঝতে পেরেছি ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা বিধান আর ঘটাবে না।
--- না ঘটালেই ভালো।তুমি স্যারকে বললে তোমার একটা কাজ আছে বলে তুমি কোচিং থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছ।এরপর তো কলেজ আছে তোমার।তুমি বাড়ি ফিরে যাও এটুকু পথ আমি একাই চলে যেতে পারবো।
--- যে কাজের জন্য আমি একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছি সেটাই তো করছি।
--- মানে?
--- তখনই দেখেছিলাম তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছো। পড়া হয়ে গেলে একা বাড়ি ফিরতে তোমার ভয় লাগতেই পারে।তাই তোমাকে সাথে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছি।
 সুচন্দা অবাক হয়ে সুমিতের দিকে তাকায়।সুমিতও তখন তার দিকে তাকিয়ে।এই চার চোখের মিলনে জীবনের প্রথমেই দুটি মানুষের শরীরের মধ্যে এক বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে যায় যা নিজেরা ছাড়া পরস্পরের অন্য কেউ জানতে পারে না।একই সাথে দুজনেই চোখ নামিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।দুজনেই নীরব! কারো মুখে কোন কথা নেই।কিন্তু দুজনেই যেন মনেমনে দুজনকেই অনেককিছু বলে দিচ্ছে নিঃশব্দে, নীরবে।
 কিন্তু অলক্ষ্যে হয়ত বিধাতা পুরুষও নীরবেই হেসেছিলেন।তিনি ক্ষণিকের জন্য হলেও চার চোখের মিলন ঘটিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ভাগ্য লিখেছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত।সেদিন তিনি দুটি কিশোর কিশোরীর মনে ভালোবাসার বীজটা বপন করলেও মিলনটা তাদের জীবনে লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন।কিন্তু যে বীজ তিনি রোপণ করেছিলেন দুটি নিষ্পাপ সরল কিশোর কিশোরীর মনে জীবনে চলার পথটা তাদের আলাদা হলেও তারা দুজনেই অতি যত্ন সহকারে হৃদয়ের কোন এক কোণে চোখের জল আর বিরহ দিয়ে সকলের চোখের আড়ালে তাকে বড় হতে সাহায্য করেছে।
  জীবন নদীর বাঁকে হাঁটতে হাঁটতে দুজনের জীবনেই এসেছে অন্য পুরুষ,অন্য নারী।কারণ এগিয়ে চলার নামই তো জীবন।কিন্তু সেই প্রথম জীবনে প্রথম ভালোলাগা বা প্রথম ভালোবাসার সেই বীজ চারাগাছ থেকে বাড়তে বাড়তে আজ তা পরিপূর্ণ একটি গাছ।কিন্তু সবই দুটি মানুষের দুটি হৃদয়ের সম্পূর্ণভাবে চোখের আড়ালে।
 তাদের মিলন বিধাতা লিখেছিলেন না ঠিকই ;তারা যে যার মত করে নিজেদের জীবন এগিয়ে নিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কখনো সখনো কিছুটা সময় বা কয়েকটা দিনের জন্য ভুলে গেলেও মন থেকে কখনোই মুছে যায়নি।একাএকা,নিস্তব্ধ ঘরে বা কখনো রাতের আঁধারে পাশে শুয়ে থাকা মানুষটি যখন অকাতরে ঘুমাচ্ছে তখনই হৃদয়ে বপন করা ভালোবাসার সেই গাছটি তার ডালপালা নাড়িয়ে জানান দিয়েছে সে আছে সেই আগের মতই নীরব প্রেমের স্বাক্ষী হয়ে।
 হয়ত সুমিত ও চন্দনার এই ভালোবাসার আর একটি প্রেমাখ্যান তৈরি হতেই পারতো ঠিক যেমন তৈরি হয়েছিল লায়লা-মজনু, হীর-রঞ্জা,শীরি-ফরহাদের ক্ষেত্রে।কিন্তু লায়লা মজনু, হীর রঞ্জা বা শিরী ফরহাদের প্রেম কাহিনী লোকে জানতো।জানতো না তারা সুমিত সুচন্দার ভালোবাসার কথা।ভালোবাসাটা ছিল শুধু হৃদয়ের মিলন কোনোকিছুর প্রত্যাশা কেউ কারো কাছ থেকে কখনোই করেনি।শুধু নিঃশব্দে যখন তারা কাছে ছিল তখন আবার যখন তারা দূরে ছিলো তখনো শুধু ভালোই বেসে গেছে।কিন্তু এ কেমন ভালোবাসা?যে ভালোবাসা শুধু ভালোবাসাতেই খুশি কোন কিছুর প্রত্যাশা কোনদিন করেনি।

ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment