Sunday, January 23, 2022

দশম পর্ব (দশম পর্ব)

ঝরাপাতা (দশম পর্ব)
  সদা উচ্ছল সুচন্দা আস্তে আস্তে নিজের ভিতরে গুটিয়ে যেতে থাকে।কলকাতায় তার নিজের বাড়ির পরিবেশ,প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে পড়াশুনা করার ফলে সেই স্কুলের প্রতিটা ইট,চেয়ার,টেবিল প্রতিটা শ্রেণীকক্ষ সুচন্দার মনের গভীরে প্রতি মুহূর্তে ভাস্বর হয়ে আছে।নূতন পরিবেশের সাথে সে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারেনা।অথচ অদ্ভুত এক জেদ ধরে সে আর কখনোই নিজের বাড়িতে ফিরে আসে না।যে কয়েকবার সে কলকাতা এসেছে প্রতিবারই নানান অনুষ্ঠান উপলক্ষে।কিন্তু প্রতিবারই এসে সে সুমিতের খোঁজ করেছে।কিন্তু প্রতিবারই ভগ্ন হৃদয়েই তাকে ফিরতে হয়েছে।
 সুমিত যখন তার উচ্চশিক্ষার এক একটা কঠিন পরীক্ষায় আশাতিরিক্ত ফল করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাচ্ছে আর অন্যদিকে সুচন্দা একটু একটু করে তার জীবনে দেখা সমস্ত স্বপ্নের পাপড়িগুলোকে কিছুটা নিজের জেদ,ভাগ্য বিড়ম্বনা আর বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক সমস্যা - সবকিছুর সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে অতি সাধারণভাবে কোন প্রকারে গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করে।নিজেকে ডুবিয়ে দেয় সবকিছু ভুলে সাহিত্য জগতের মাঝে।লিখতে থাকে একের পর এক গল্প কবিতা।
 দুঃখ,কষ্ট, শোক ভোলার সব থেকে বড় ওষুধ হচ্ছে সময়।এই সময়ই মানুষকে সবকিছু ভুলিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে শেখায়।স্মৃতির উপরে একটা প্রলেপ ফেলে দেয়।তখন আর দগদগে ঘায়ের সেই যন্ত্রণাটা অনুভূত হয় না।এইভাবে জীবনের এমন অনেক বছর চলে যায় হয়তো সেই ঘায়ের কথাটাই মানুষ ভুলতে বসে।
  সুমিত কিংবা সুচন্দা কারো ক্ষেত্রেই তার ব্যতিক্রম হয়নি।শুধু মাত্র কয়েকটা দিনের স্মৃতি বুকে আগলে রেখে বেশ কয়েকটা বছর উভয়ই কষ্ট পেয়েছে ঠিকই কিন্তু পরিবেশ,পরিস্থিতি আর জীবনের চাহিদা মেটাতে ভুলে যাওয়া নয় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে হৃদয়ের কোন এক কোণে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।কিন্তু একাকী অন্ধকার ঘরে কিংবা উদাস মনে সেই বিকেলের স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।পৃথিবীর দুই প্রান্তে সেই দুটি তরুণ তরুণী যারা আজ মধ্য বয়সী ক্ষণিকের জন্য হলেও সেদিনের সেই স্মৃতি মনকে মোচড় দিয়ে তোলে।
 সুমিত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে নিজ মেধার গুনে চলে যায় সুইডেন।সুচন্দা তার জীবনে আর ফিরবে না এটা সে নিশ্চিত হয়ে যায়।সময় তাকে সেই শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্যও করে।মনের কোণে সুচন্দা এবং সেদিনের সেই সন্ধ্যার স্মৃতি ঘুম পাড়িয়ে রেখেই জীবন যুদ্ধে একটা একটা করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে থাকে।মা,বাবা তখনো বেঁচে।বিদেশ, ভূঁইয়ে বাড়ির একমাত্র ছেলেকে একা একা রাখা সমুচিন মনে করলেন না তারা।ছেলেকে না জানিয়েই তারা তার জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করলেন।অপেক্ষা ছেলে পুজোর সময় বাড়ি আসবে।
এদিকে বিশাখা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নার্সিং ট্রেনিং শেষে সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেয়ে যায়।নার্সিং ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে সে আরো বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল।বড় বোনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে সুমিত দেশে থাকাকালীন সময়েই।দাদা বিদেশে।বাবা,মা শুরু করেন তারজন্যও ছেলে দেখতে।
 দেখতে দেখতে পুজো এসে যায়।সুমিত বাড়ি ফেরে।তার বাবা,মা তাকে জানান যে তারা তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখেছেন।সুমিত কোনো আপত্তি করে না।জীবন থেকে তখন চলে গেছে অনেকগুলি বছর।সুচন্দার স্মৃতিটা মনকে উদাস করলেও দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কষ্টটাও বেরিয়ে যায়।সুমিত মেয়ে দেখে কিছুটা গড়িমসি করলেও বাবা,মায়ের পছন্দের বাইরে যেতে পারে না।দীপালি তখনো গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেনি।সুমিত তার বাবাকে জানায় 
 --- এবারে বিয়েটা করতে চাইনা বাবা।আমি কোনোদিন তোমাদের কথার অবাধ্য হইনি এখনো হবো না।আমার যা চাকরি তাতে আমাকে সারাটাজীবন বাইরে বাইরেই থাকতে হবে।তাই আমি চাই অন্তত মেয়েটা গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করুক।ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি নাহয় আর একবার তখন দেশে ফিরবো।তোমরা ইতিমধ্যে শিখুর বিয়েটা দেওয়ার ব্যবস্থা করো।টাকা-পয়সার  ব্যাপারে ভেবো না।সে ব্যবস্থা আমি করবো।
 সুমিতের বাবা তার কথাগুলি যুক্তিযুক্ত মনে করলেন।সত্যিই তো দেশের বাইরে গিয়ে থাকতে হলে সুমিতের বউকে তো অন্তত গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করতেই হবে।তানাহলে সুমিতের উপযুক্ত সে হবে কি করে? আর শিখুর কথাটাও তো সে ঠিকই বলেছে।বোন থাকতে দাদার আগে বিয়ে কিভাবে সম্ভব? লোকে কি বলবে?আর শিখুও বা মনেমনে কি ভাববে?তারা আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন বিশাখার জন্য ছেলে জোগাড় করতে।
 বিশাখা খুব বেশি লম্বা নয়।এই পাঁচ ফুটের মত।গায়ের রং শ্যামলা।মাথা ভর্তি চুল তার কোমর ছাপিয়ে গেছে।বিশাখার চেহারার সব থেকে সুন্দর দিকটি হচ্ছে তার মায়াভরা দুটি চোখ।আসলে সুমিতের মায়ের চোখ দুটি খুব মায়াভরা।তার তিনটি সন্তানই তার মতই চোখ পেয়েছে।সুমিতের বাবার গায়ের রং ছিল খুব চাপা।অদ্ভুতভাবে তিনটি সন্তানই তার গায়ের রংটা পেয়েছে।তবে তাদের প্রতিটা সন্তানই পড়াশুনায় ছিল খুব ভালো।যে যার ক্লাসে প্রথম স্থানটিই দখল করে থাকতো।গৃহ শিক্ষক তাদের ছিল না ঠিকই কিন্তু তাদের বাবা সে স্থান পূরণ করে দিতেন।প্রতিদিন নিয়ম করেই তিনি তার তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসতেন।আর ছেলেমেয়ে তিনটিও কখনো বাবার অবাধ্য হয়নি। যার ফলে সকলেই তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তাদের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করতে পেরেছে।
 বিশাখার জন্য ছেলে পছন্দ হল।গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের একমাত্র ছেলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশাখাকে ছেলে দেখে পছন্দ করলেও তার মায়ের একটু আপত্তি দেখা দিয়েছিল গায়ের রং নিয়ে।কারণ ছেলে তার ভীষণ ফর্সা।যদি নাতি নাতনীদের চেহারা কালো হয় এই ছিল তার ভয়।কিন্তু তিনি তার মতামত ছেলের উপর চাপাতে সক্ষম হননি।কারণ সুধীর ছিল ভীষণ আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন একজন পুরুষ।সে বিশাখাকে দেখে পছন্দ করে বিশাখাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার সময় সুযোগ বুঝে তার কাছে বলেছিলো,
--- তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।আমি কি তোমার মতামতটা জানতে পারি?
 বিশাখা মুখ নীচু করে সলজ্জ হেসে বলেছিলো,
--- বাবা,মায়ের ইচ্ছায় আমার ইচ্ছা।
 কিন্তু সুধীর তার এই উত্তরে খুশি হয়েছিল না।সে সরাসরি বলেছিলো,
--- বাবা,মায়ের মুখের উপর কথা বলা কোন সন্তানেরই উচিত নয় ঠিকই।কিন্তু তাই বলে সন্তানদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার তারা কিন্তু হরণ করেননি।তোমার যদি আমাকে পছন্দ না হয় আর বাবা,মায়ের কথা রাখতে গিয়ে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসো তাহলে সারাটা জীবন অ্যাডজাস্ট করেই চলতে হবে।বুকের ভিতর কষ্ট চাপা রেখে ভালোবাসার অভিনয় করে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।আমি তা চাইনা। বিয়ে মানে একই ছাদের তলায় দুটি নরনারীর আজীবন থাকা নয়।বিশ্বাস,ভালোবাসা দিয়ে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা।তাই সরাসরি তোমার মতামতটা জানতে চাই।
 সুধীরের কথাবার্তায় বিশাখা বুঝে ফেলে মানুষটা কোন ধরনের।সে সরাসরি সুধীরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আপনাকে যদি আমার পছন্দ না হত তাহলে হয়ত আমি এতক্ষন আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে পারতাম না বা বলতামও না।
 উত্তর শুনে সুধীর খুশি হয়।তাই মাকে সে সরাসরি জানিয়ে দেয় বিয়ে সে এখানেই করবে।

#ক্রমশঃ

    

No comments:

Post a Comment