Sunday, January 2, 2022

ঝরাপাতা(চতুর্থ পর্ব)

ঝরাপাতা (চতুর্থ পর্ব)
  এর বেশ কয়েক বছর পর নবীন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে চাকরি পেয়ে চিরপরিচিত গণ্ডি ছেড়ে বহু দূরে চলে গেছে।বাড়ির লোক পছন্দ করে নবীনের বিয়ে দিয়েছে।কিন্তু সবই ঘটেছে সুচন্দাদের বাড়ির কাছ থেকে ভাড়া উঠে যাবার পর।ফোনের এত রমরমা যেহেতু ছিলনা তাই আস্তে আস্তে মঞ্জুর সাথেও তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
  আসলে মানুষ তার চলার পথে প্রতি মুহূর্তে নিত্য-নূতন ঘটনার সম্মুখীন হয়।এইসব ছোটখাটো ঘটনা আস্তে আস্তে তার জীবন থেকে মুছেও যায়।আবার কিছু কিছু ঘটনা তার জীবনে এমনভাবে জাকিয়ে বসে শত চেষ্টা করেও সে সেইসব ঘটনা মুছে ফেলতে পারে না।
  সুচন্দার মাধ্যমিক পরীক্ষার বছর তিনেক আগে ক্লাস এইটে এসে ভর্তি হল গ্রামের সহজ সরল একটি ছেলে নামটি তার সুমিত।কোনদিকে না তাকিয়ে দেখা শুধু বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকা মেয়েটিও এই সুমিত সম্পর্কে যেন একটু বেশিই কৌতূহলী হয়ে উঠলো।কারণ অন্যকিছু নয়।সুমিত স্কুলে ভর্তি হয়েই এলাম,দেখলাম জয় করার মত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট দিয়ে প্রত্যেক শিক্ষক,শিক্ষিকার মন জয় করে নিলো।সকলের মুখে মুখেই তখন সুমিতের নাম।
 সুমিতকে সুচন্দা তার এক বন্ধুর সহয়তায় একদিন স্কুল গ্রাউন্ডের মধ্যেই বড় মাঠে টিফিন আওয়ারে ফুটবল খেলতে দেখে।রোগা ছিপছিপে,গায়ের রংটা খুবই কালো।মাথা ভর্তি ছিল চুল, বেশ লম্বা।পরবর্তীতে যখন তাকে খুব কাছ থেকে সুচন্দা দেখে তখন সুমিতের চোখদুটো তার কাছে বড় বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।চেহারায় সুমিতের তেমন জৌলুস না থাকলেও তার চোখদুটি যেন কথা বলে।সুচন্দার দিকে তাকানো দেখেই সে বুঝতে পারে যেকথা সুমিত মুখে বলতে পারছে না তার চোখদুটি সেকথা বলে দিচ্ছে।কিন্তু সে তো অনেক পরে।
 সুমিত ছিলো সুচন্দার তিন বছরের সিনিয়র।সুচন্দা এবং সুমিত দুজনেই পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল।অনেক পরে সুচন্দা জেনেছিল সুমিত এবং তার একবোন ও এক দিদি স্কুলের মেসেই থাকতো।সুমিতের এই বোনটি ছিল সুচন্দার ক্লাসমেট।খুব ভালো বন্ধুত্ব না থাকলেও ক্লাসমেট হিসাবে বিশাখা ও সুচন্দার মধ্যে একটা সুসম্পর্ক ছিল।সুমিত খুব ভালো গান করতো ,একজন ভালো আবৃত্তিকারও ছিল।কিন্তু একই স্কুলে পড়ার পরেও সুচন্দা কিন্তু সুমিত সম্পর্কে কিছুই জানতো না বরং বলা ভালো কোন ছেলে সম্পর্কে কিছু জানার কোন আগ্রহই কোনদিন সুচন্দার ছিলনা।
  সুচন্দার স্কুলে যাতায়াত ছিলো পায়ে হেঁটে।এই যাতায়াতের পথে বিধান নামে একটি ছেলে সুন্দরী সুচন্দার ভীষণ পিছনে লাগতো।বহুবার সুচন্দা তাকে নিষেধ করেছে।স্কুলে হেডমাস্টারকে বলে দেবে ভয় দেখিয়েছে।কিন্তু বিধান দমেনি।সে তার স্কুল এবং পড়তে যাওয়ার সময় হয় পায়ে হেঁটে নতুবা সাইকেল নিয়ে নানান ধরনের কটূক্তি করতে করতে পিছন পিছন যেত। এইরূপই একদিন খুব ভোরে সুচন্দা স্কুলে যাওয়ার আগে স্যারের বাড়িতে পড়তে যাওয়ার সময় দেখে বিধান আগে থাকতেই রাস্তার মোড়ে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শীতের সকাল।সেদিন জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে।সঙ্গে উত্তুরে বাতাস।সুচন্দার ঠান্ডাটা একটু কমই বোধ হয় সব সময়। গরমকালেই ওর যত কষ্ট।খুব সাধারণ একটা পাতলা গায়ের চাদর তখন তার গায়ে।সে অতি দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে বিধানকে ফেলে এগিয়ে যায়।কারণ শীতের অত সকালে রাস্তাঘাট ছিল বেশ শুনশান।এমনিতে সুচন্দা খুব ডাকাবুকো মেয়ে।কিন্তু সেদিন কেন জানিনা তার একটু ভয় ভয় করতে থাকে।সুচন্দা অনেকটা এগিয়ে গেছে দেখতে পেয়ে বিধান সাইকেল চালিয়ে দ্রুত গতিতে তার সামনে গিয়ে সাইকেল দাঁড় করায়।
--- তোমার সাথে কিছু কথা আছে
--- কিন্তু আমি তো তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাই না
--- আজকে তোমায় কথাগুলি শুনতেই হবে
--- জবরদস্তি নাকি?পথ ছাড়ো আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
--- এমনিতে যদি আমার কথা না শোনো তাহলে কিন্তু জোর করতে বাধ্য হবো
--- জোর করবে মানে?কি করবে তুমি?তোমার যা খুশী তাই করতে পারো আমার কিচ্ছু যায় আসে না
 বিধান সাইকেলটা একটা লাইটপোষ্টে দাঁড় করাতে গেলে সুচন্দা প্রায় দৌড়েই অনেকটা পথ এগিয়ে যায়।কুয়াশার ভিতর হলেও দেখতে পায় কেউ একজন তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।বুকে একটু হলেও সাহস পায়।এদিকে বিধান সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গিয়ে সুচন্দার একটা হাত ধরে নিজের দিকে টান দেয়।মুহূর্তে সুচন্দা খুব জোড়ে বিধানের মুখে এক চর কষিয়ে দেয়।আর ঠিক তৎক্ষণাৎ বিধান ওর গায়ের চাদরটা ধরে একটানে খুলে নিচুতে ফেলে দেয়।আর আচমকা কুয়াশার ভিতর থেকে আসা মানুষটি তাদের সম্মুখে চলে আসে।সেই মানুষটি আর আর কেউ নয় কলেজে প্রথম বর্ষে পড়া সুমিত দাস।বিধান এবং সুমিত একই স্কুলে পড়ার কারণে তারা একে অপরকে চিনতো।সুমিত বিধানের কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়
--- কি করছিস এসব?মেয়েদের সম্মান দিতে জানিস না?আমার খুব খারাপ লাগছে যে তোকে আমি চিনি।অনেক সময় আমরা একসাথে স্কুলমাঠে ফুটবল খেলেছি।
 এদিকে সুচন্দা ততক্ষনে নীচু থেকে চাদরটা তুলে নিয়ে দ্রুত স্যারের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
সুমিতের কথা শুনে বিধান তাকে বলে,
--- তুই জানিস না মেয়েটার খুব দেমাক।কতদিন ধরে ওকে বলছি আমার কথাটা শুনার জন্য কিছুতেই পাত্তা দেয় না।তাই আজ আর সহ্য করতে না পেরে ---
--- তাই বলে ওকে রাস্তার মধ্যে তুই এভাবে অসম্মান করবি?কি কথা বলতে চাস ওকে তুই ?
--- আমি ওকে ভালবাসি
 সুমিত হো হো করে হাসতে হাসতে বললো,
--- কক্ষনো না -- তুই ওকে ভালোবাসতেই পারিস না
--- তার মানে?
--- ওরে গাধা তুই যদি ওকে সত্যিই ভালবাসতিস তাহলে ওকে এভাবে অপমান করতে পারতিস না।ওর চেহারার প্রতি তোর একটা মোহ জন্মেছে।তাকে ভালোবাসা বলে না।ভালোবাসলে কেউ কাউকে এইভাবে রাস্তার মধ্যে অপমান করতে পারে না।
 বিধান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেও পড়ে বলে ওঠে,
--- হতে পারে তুই সঠিক বলছিস।কিন্তু আমিও ওকে ছাড়বো না,ওর দেমাক আমি ভাঙ্গবোই।
--- কিন্তু সেটা তো আমি হতে দেবো না
--- ওর প্রতি তোর এত দরদ কেন?
--- এটা শুধু সুচন্দা বলেই নয়;যেকোন মেয়ে হলেই আমি এটা বলতাম আর তার সম্মান বাঁচানোর জন্য যতদূর যাওয়ার যেতাম।এভাবে মেয়েদের অসম্মান করিস না।ওর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ সামনে।সবকিছু নষ্ট করে দিস না।তোরও তো একটা বোন আছে ছোট।কেউ যদি তোর বোনের সাথে রাস্তাঘাটে এরূপ আচরণ করে তুই কি তাকে ছেড়ে কথা বলবি?আগে নিজের পায়ে ভালোভাবে দাঁড়া।এরকম অনেক সুন্দরী মেয়ে তখন আশেপাশে ঘুরঘুর করবে।আমি তোকে অনুরোধ করছি তুই সুচন্দাকে আর বিরক্ত করিস না।ও খুব ভয় পেয়ে গেছে।তাছাড়া তুই বুঝতে পারছিস আজকের এই ঘটনার কথা জানাজানি হলে তোর বাবা মায়ের কতটা সম্মানহানি হবে।ওর বাবা একজন সমাজ সেবক।সবাই তাকে চেনে-জানে।হয়ত তোর বাবার সাথেও তার পরিচয় আছে।সুচন্দার বাবা এসে যখন তোর বাবাকে কথাগুলো জানাবেন তখন তো তার মুখ লুকানোর কোন জায়গা থাকবে না।সন্তান হয়ে তুই কিছুতেই এটা করতে পারিস না।
 এরপর বিধান আর কোন তর্কে না গিয়ে বললো,
--- চল সামনের দোকান থেকে দুজনে চা খাই।আমি আর ওকে বিরক্ত করবোনা তোকে কথা দিলাম।তোর সাথে যদি ওর কথা থাকে তাহলে তুইও ওকে বলে দিস ও যেন একথা পাঁচকান না করে।চল আজকের চা টা আমিই খাওয়াবো তোকে।সত্যিই একটা বড় অপরাধ করার হাত থেকে তুই আমায় বাঁচিয়ে দিলি।

ক্রমশঃ

 

No comments:

Post a Comment