ভালোবাসার ফুলটি ভালোভাবে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই তা শুকিয়ে ঝরে গেল।ছিটকে গেলো দুটো কিশোর কিশোরী আজীবন ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়াটি নিয়ে।হৃদয় নামক দামী ফ্রেমে বন্দী হয়ে গেলো প্রথম ভালোবাসার পরশ।
সুচন্দা যখন ইলেভেনে ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে ঠিক তখনই তার বাবা মারা যান।মুঠোফোনের এত রমরমা না থাকার কারণে বাবার মৃত্যুর পরদিন টেলিগ্রাম মারফৎ এ দুঃসংবাদ পায় তারা।পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিন রাতেই তারা রওনা দেয়।কাজের আগেরদিন এসে পৌঁছায়।মনে একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে এসেছিল সুচন্দা যেভাবেই হোক এবার সে সুমিতকে খুঁজে বের করবেই।কিন্তু ভাবনার সাথে অধিকাংশ সময়ই মানুষ বাস্তবের মিল খুঁজে পায় না।বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া,নিয়ম ভঙ্গ সবকিছু মিটে যাওয়ার পর "বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি "- এই অজুহাতে সুমিতদের ভাড়া বাড়ি,সুমিতের পরিচিত যারা ছিল তাদের বাড়ি পাগলের মত ছুটাছুটি করতে থাকে।এখন তারা কেউই আর এখানে থাকে না।সুমিত উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জয়েন্টে বসেছিল।কিন্তু খুব ভালো ফল করতে পারেনি।কারণ জীবনের প্রথম স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট তার মনেও যথেষ্ঠ প্রভাব ফেলেছিল।সুচন্দার মত তারও ইচ্ছা ছিল ডাক্তারী পড়ার।কিন্তু এক্ষেত্রে তারও ভাগ্য সহায় হয়নি।সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভালো রাঙ্ক করে এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই ভর্তি হয়ে যায়।কিন্তু বর্তমানে কোথায় সে পড়ছে সে খবর কেউই তাকে দিতে পারে না।
একবুক কষ্ট আর অভিমান নিয়ে সে দিদি,জামাইবাবুর সাথে পুনরায় ফিরে আসে। আসবার আগে মা তাকে জানিয়েছিলেন,
--- তুই যদি মনে করিস এখানে থেকে পড়াশুনা করবি তাহলে থেকে যা।সেই সময় তোর বাবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা আমি করেছিলাম।কিন্তু তিনি আমার কথা শোনেননি।আমি কি করবো বল?
--- বিনা কারণে নিজের বাড়ি থেকে আমায় নির্বাসন দিয়েছো।তোমরা কেউ একবারের জন্যও আমার মানসিক পরিস্থিতির কথা ভাবোনি।আমার কি অপরাধ ছিল সেদিনের ঘটনায় বলতে পারো?অথচ শাস্তিটা আমি পেলাম।ওখানে আমি পড়াশুনায় মন বসাতে পারিনা।আমার ভালো লাগে না ওখানে থাকতে।আমি জানি আমার রেজাল্টও ভালো হবে না।কিন্তু যে সিদ্ধান্ত বাবা আমার ক্ষেত্রে নিয়েছিলেন আজ তিনি নেই ঠিকই আমি তার নেওয়া এই সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও সরবো না।তাতে আমার ক্যারিয়ার যদি শেষ হয়ে যায় তো যাবে।
--- আমার কি ভালো লাগে তোকে তোর দিদির বাড়িতে রেখে পড়াশুনা করাতে?কত করে তাকে বুঝিয়েছিলাম কিন্তু তিনি কিছুতেই শুনলেন না।অনেক অশান্তি করেছি।
--- আমার মত অনেক মেয়েই রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে ছেলেদের কাছে হেনস্থা হয়।তারা সবাই কি বাড়ি ছাড়া হয়?নাকি সকলের এই সুযোগ থাকে? ব্যতিক্রম শুধু আমি!তোমরা কেউ একবারের জন্যও আমার মনের অবস্থাটা জানতে বা বুঝতে চাইলে না।তোমরা একবারও ভাবলে না তোমাদের ছাড়া,এই বাড়ি ছাড়া, দশ বছর ধরে যে স্কুলে পড়ছি সেই চিরপরিচিত গণ্ডি ছেড়ে আমি শিলিগুড়ি কতটা ভালো থাকবো?আসলে সবই আমার ভাগ্যের দোষ!তোমাদের কোন দোষ নেই।মেয়েরা বিয়ের পরে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে যায় আর আমি আমার ভবিষ্যৎ ,আমার চিন্তাধারা,আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছু বস্তাবন্দি করে দিদি,ভগ্নিপতির কাছে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। নাহ্ আমি এখানে আর ফিরবো না পড়াশুনা শেষ করার আগে।যা আমার কপালে আছে হবে।আমার জন্য তখন যখন কিছুই করতে পারোনি বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আজ আর কিছু করার দরকার নেই।
তারপর খুব আস্তে আস্তে বললো,
--- আমার জীবনের যা হারানোর তা হারিয়েই গেছে।শত চেষ্টা করে মাথা কুটে মরলেও আমি আর তা ফেরৎ পাবো না।
--- কি হারিয়ে গেছে তোর জীবন থেকে?
সুচন্দা এবার কেঁদে দিয়ে বললো
--- সব,সবকিছু মা সবকিছু।কেন যে আমাকেই বলির পাঠা করা হল আমি জানিনা।
সুচন্দা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে দেখে মা এগিয়ে গিয়ে তার মাথাটি নিজের বুকের উপর নিয়ে বললেন,
--- এত কষ্ট বুকের ভিতর চেপে রেখেছিস?কিসের এত কষ্ট তোর?আমায় বল দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা।
--- কোন লাভ নেই মা কোন লাভ নেই।আমার জীবন থেকে যা যা হারানোর তার সবকিছুই হারিয়ে গেছে।আর নূতন করে কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সুচন্দার মা মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।আর সুচন্দা মায়ের বুকের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
সেদিন রাতে সুচন্দাকে কেউ কিছু মুখে দেওয়াতেই পারেনি।সারাটা রাত না খেয়েদেয়ে শুধু কেঁদেই গেছে।মা অন্য দিদিরা তাকে অনেক বুঝিয়েছে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে অন্যত্র থাকতে যখন তার এত কষ্ট হচ্ছে তাহলে সে তবে শিলিগুড়ি থেকে ফিরেই আসুক।এখানেই সেই আগের মত পড়াশুনা করুক।এত কষ্ট যে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে সুচন্দা পাচ্ছে তাতো বাড়ির কেউই কোনদিন বুঝতে পারেনি।কিন্তু কিছুতেই সুচন্দা দিদির বাড়ি থেকে কলকাতা ফিরবে না পড়াশুনা করার জন্য।বাবার সিদ্ধান্তের কারণে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সুমিত।সেই অভিমান,সেই কষ্ট কিছুতেই ভুলতে পারেনা সুচন্দা।সুমিত যে তার জীবন থেকে সারা জীবনের জন্য হারিয়ে গেছে আর এইজন্য যে তার বাবার সিদ্ধান্তই দায়ী - একথা সুচন্দা কিছুতেই ভুলতে পারে না।তাই সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার সিদ্ধান্তকেই মেনে আগেও নিয়েছে আর এখন তার নড়চড় হতে কিছুতেই সে দেবে না।
ক্লাসে প্রথম হওয়া মেয়েটি পরিবেশ,পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে নিজের মনকে মানিয়ে নিয়ে পড়াশুনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু পারে না।একাকী,নিরিবিলি থাকলেই সুমিতের কথা মনে পড়তে থাকে তার।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করে।পারে না নূতন করে পড়াশুনায় মন বসাতে। আস্তে আস্তে তার রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করে।সকলেই এখন তার মানসিক পরিস্থিতি বুঝতে পারে।তাকে বাড়ির সকলে ছাড়াও দিদি,জামাইবাবুও বারবার বলেছেন সে যদি চায় তাহলে সে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে।তারা কেউই কোন আপত্তি করবে না।আর কবে কি একদিন ঘটেছে সেই ঘটনাকে মনে রেখে ভয় পেয়ে অকারণে নিজের জীবনের ক্ষতি করার কোন মানেই হয়না।
অজিতেশবাবু এমনিতে খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।কিন্তু মাঝে মধ্যে তিনি খুব জেদী আর একগুঁয়ে টাইপের হয়ে যেতেন।তাই তিনি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুচন্দাকে শিলিগুড়ি থেকে লেখাপড়া শিখাবেন তখন কারো মতামতের গুরুত্ব তিনি দেননি।আর তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ কোন মতামত ব্যক্ত করার সেভাবে কেউ সাহস দেখাতে পারেননি।কিন্তু আজ যখন অজিতেশবাবু নেই আর সুচন্দাও ভালো নেই তখন সকলে মিলেই আবার সুচন্দাকে বোঝাতে থাকেন কলকাতা এসে পড়াশুনা শেষ করার জন্য।কিন্তু বাবার স্বভাব যে ছোট মেয়ে সুচন্দার মধ্যে কিছুটা হলেও আছে।সেও যে একগুঁয়ে।যেহেতু বছর খানেক আগে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার সিদ্ধান্তকে সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল তাই আজ কারও কথা সে শুনতে রাজি নয়।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment