Sunday, January 30, 2022

বামুন পুকুরে চাঁদ কাজীর সমাধি

বামুন পুকুরে চাঁদ কাজীর সমাধি
 কলকাতা থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে নদীয়া জেলার মায়াপুর ইস্কন মন্দির রেখে বামনপুকুর নামক স্থানে চাঁদ কাজীর সমাধি ক্ষেত্র।সেখানে একটি কাঠালী চাপা গাছ আছে যার বয়স পাঁচশ বছর।এই গাছের নিচে চাঁদ কাজীর সমাধি। চাঁদ কাজীর আসল নাম ছিল মৌলনা সিরাজ উদ্দীন।
 গত ডিসেম্বর মাসে মায়াপুর ভ্রমণ কালে আমরা সকলে উপস্থিত হই এই বামুন পুকুরে চাঁদ কাজীর সমাধি দেখতে।সেখানে পৌঁছে যা দেখি এবং যা শুনি তাতে প্রথমে বিস্ময় পরে হতভম্ব হয়ে পড়ি।
  মায়াপুর ভ্রমণকালে একটি জায়গায় শ্রী চৈতন্যদেবের সাথে চাঁদ কাজীর কিছু মূর্তি যা মাটির তৈরী পুতুল দেখি এবং তার সাথে স্বল্প কথায় কিছু ইতিহাস লেখা পড়ি।বিস্মিত হই!কিন্তু তখনো জানতাম না এই বিস্ময়ের মাত্রা আরো সুদূর প্রসারিত।
 টো টো থেকে নেমে আমরা এগিয়ে যাই বামুন পুকুর চাঁদ কাজীর সমাধি ক্ষেত্রের দিকে।খুব বড় একটি লোহার গেট পার হয়ে গেটের থেকে একটু দূরে জুতো খুলে অপার বিস্ময় নিয়ে এগোতে থাকি।জানতে পারি আগে সমাধি ক্ষেত্রটি মাটির সমান উচ্চতায় থাকলেও এখন কিন্তু সমাধি ক্ষেত্রটির চারিপাশে ইটের গাঁথনি করে তাকে উচুঁ করা হয়েছে। কাঠালী চাপা এবং একটি নিমগাছ দুটি গাছের গোড়ায় ইটের গাঁথনিই ওই ভিতের মধ্যে আছে।ওখানে উপস্থিত এক ভদ্রলোকের (যাকে গাইড বলাই শ্রেয়) মাধ্যমে জানতে পারি -- 
 কংসকে হত্যা করার সময় তিনি যখন কৃষ্ণের কাছে কাতর প্রার্থণা জানাচ্ছিলেন তার প্রাণ ভিক্ষার জন্য,তখন কৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন যে তার পাপের ঘরা পূর্ণ হয়ে গেছে।তাকে এই দেহ ত্যাগ করতেই হবে।তবে কলিযুগে তিনি আবার অবতীর্ণ হবেন এই ধরাধামে।তখন তিনিই আবার তাকে পরজন্মে উদ্ধার করবেন।তবে তিনি পরবর্তী জীবনে বিধর্মী হয়ে জন্মাবেন।সেই সময়ে তার মৃত্যুর পর তিনি একটি কাঠালী চাপা গাছ স্বহাতে তার সমাধির উপর লাগাবেন।এবং এই কাঠালী চাপা গাছটি যুগ যুগ ধরে সর্বদা ফুল ফুটবে এবং সেই ফুল ঠিক তার সমাধির উপরেই পড়বে।এটাই তার প্রতি ভগবানের আশীর্বাদ।
 পরবর্তীতে নবদ্বীপে শ্রী চৈতন্যের নাম সংকীর্তনের ঘোর বিরোধী ছিলেন জমিদারএই চাঁদ কাজী।শ্রী চৈতন্য যখন তার বিশাল সংকীর্তন বাহিনী নিয়ে নবদ্বীপ থেকে বামুন পুকুরের দিকে যাত্রা করেন তখন চাঁদ কাজী আদেশ জারি করেন তা বন্ধের জন্য।কিন্তু চৈতন্যদেব সে কথা অগ্রাহ্য করেই এগিয়ে যেতে থাকেন।
 এর ঠিক আগের রাতে দৈব্য শক্তির বলে চাঁদ কাজী তার পূর্বজন্মের সমস্ত ঘটনা স্বপ্নে দর্শন করেন।চৈতন্যদেব যখন তার বাড়ি লাগোয়া রাস্তায় এসে পড়েন তখন চাঁদ কাজী তার প্রাসাদের ভিতর ভাবে বিহ্বল হয়ে অস্থির হয়ে পড়েন।কোন রকমেই তিনি নিজেকে আর ঘরে বন্দি করে রাখতে পারেন না।দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন এবং শ্রী চৈতন্যদেবের পদতলে এসে আছড়ে পড়েন। চৈতন্যদেব তাকে দুহাতে তুলে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন।নাম সংকীর্তন শুনতে শুনতে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান যে জ্ঞান তার আর ফেরে না।তখন তাকে এই বামুনপুকুরেই সমাধিস্থ করা হয়। চৈতন্যদেব নিজ হাতে ওই সমাধির উপরে একটি কাঠালী চাপা গাছ রোপণ করেন।
 পাঁচশ বছর আগে যে কাঠালী চাপা গাছটি রোপণ করা হয়েছে আজও তা জীবিত। বারো মাস এই গাছটিতে একটি হলেও ফুল ফুটবেই।গাছটির শিকড় মাটির উপরে এতটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত দেখলে মনেহয় খুব বড় কোন কচ্ছপ তার শুরটি ভিতরে ঢুকিয়ে আছে। ডালগুলো যাতে ভেঙ্গে না পরে তার জন্য ইটের গাঁথনি করে সেগুলিকে তার উপর রাখা হয়েছে।
 সত্যি মিথ্যা জানিনা।তবে এসব শুনলে গায়ের কাটা শিউরে উঠবেই।আমারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।ভদ্রলোক যখন বলছিলেন পুরোটাই ভিডিও করেছিলাম।শেষে সেই কথাটাই বলবো 
" বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,তর্কে বহুদূর "।
 

Saturday, January 29, 2022

ঝরাপাতা (একাদশ পর্ব)

ঝরাপাতা (একাদশ ও শেষ পর্ব)
  বিশাখার বিয়ের একবছরের মাথায় সুমিতের বিয়ে হয় দীপালীর সাথে।বোনের বিয়েতে সুমিত আসতে পারেনি।বিয়ের সময় এসে সুমিত মাসখানেক ছিল।তারপর দীপালিকে নিয়ে সে সুইডেন চলে যায়।বৃদ্ধ বাবা,মা গ্রামের বাড়িতেই থেকে যান।তবে সুমিত তাদের সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু তারা কেউই রাজি হননি।এমনকি সুমিত বিয়ের পরে প্রথম যেবার টাকা পাঠায় সুমিতের বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ফোন করে জানিয়ে দেন 
--- তুমি বোনের বিয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছো।সেখানে আমার কোন খরচই হয়নি।সুতরাং আমার যা ক্যাশ ছিল তাতে হাত পড়েনি।এখন আমি ভালোই পেনশন পাই।তোমার দিদি এবং বোন উভয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।তারা দুজনেই চাকরি করে।ভালোই আছে তারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে।প্রত্যেক বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে তাদের ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার এবং পরবর্তীতে তাদের সংসারী করার।আমরা সে দায়িত্ব পালন করেছি।আমরা সুযোগ দিয়েছি তোমরা তোমাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সে সুযোগকে কাজে লাগিয়েছো।তোমাদের কারো কাছে আমাদের কোন চাহিদা নেই।তোমরা ভালো থেকো এটাই শুধু একমাত্র কামনা আমাদের।বছরে একবার করে দেশে এসো তুমি এটাই শুধু চাই।
 বাবা মা যতদিন বেঁচে ছিলেন সুমিত বছরে একবার করে দেশে এসেছে বাবার কথা রাখতে।দুই ছেলেমেয়ের বাবা সে।পুরো দুনিয়াটা আজ মানুষের হাতের মুঠোয়।রোজই সুমিত তার দিদি ও বোনের সাথে কথা বলে।বিশাখা নার্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন একটা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা।স্বামী,স্ত্রী একই স্কুলে আছে।
 বিশাখা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর প্রথমেই নার্সিং ট্রেনিংয়ের জন্য ভর্তি হয়।সাথে সে চাকরির জন্য নানান জায়গায় পরীক্ষা দিতে থাকে।স্কুল জীবনে বিশাখা খুব ভালো ছাত্রী না হলেও সে ছিল খুবই অধ্যবসায়ী।ফলে রেজাল্ট তার বেশ ভালই হত।নার্সিং ট্রেনিং শেষে সেখান থেকেই সে সরকারি হাসপাতালে চাকরী পেয়ে যায়।বছর খানেক যখন চাকরির বয়স তখন তার বিয়ে হয়।এর ঠিক ছমাস পরেই তার স্কুলের চাকরির খবর আসে।নার্সের চাকরি মানেই শিপ্টিং ডিউটি।আর অধিকাংশ শ্বশুরবাড়িতে শিপ্তিং ডিউটি করতে যাওয়া মানেই ছোটখাটো ঝামেলার সম্মুখীন হওয়া।সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে আট ঘণ্টা কোন কোনদিন বা তারও বেশি অমানুষিক পরিশ্রমের পর বাড়িতে এসে সর্ব কাজ করেও  শ্বাশুড়ির নিত্য গঞ্জনা বিশাখার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে।আর ঠিক এমনই এক মুহূর্তে বিশাখার প্রাইমারী স্কুলে জয়েনিং লেটার আসে।বিশাখার স্বামী তাকে নার্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্কুলে জয়েন হতে বলে।কারণ তাহলে ছেলের সামনে তার মা বিশাখার উপরে এত বেশি অত্যাচার করার সুযোগ পাবেন না।
 সুধীরের কথামত বিশাখা নার্সের চাকরি ছেড়ে স্কুল শিক্ষিকার পদই গ্রহণ করলো।তবে সুধীরের স্কুলে বদলী হয়ে আসতে তাকে বেশ কয়েক মাস কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।তবে এক্ষেত্রে শ্বাশুড়ির অত্যাচার বেশ কিছুটা হলেও কম ছিল।সুধীর ঘরে থাকতেই বিশাখা যেটুকু সংসারের কাজকর্ম শেষ করতে পারতো সে টুকুই করে চলে যেত আর যখন স্কুল থেকে ফিরতো সে সময়ও সে ঘরেই থাকতো।কাজ আগেও সব করতো এখনো করে পার্থক্য একটাই আগে সব কাজ করেও শ্বাশুড়ির মুখ ঝামটা খেত কিন্তু এখন সব কাজ করার পরে সেই মুখ ঝামটাটা আর খেতে হয় না।
 এরও মাস ছয়েক পরে বিশাখা প্রেগন্যান্ট হয়।এতদিন বদলীর জন্য ছুটাছুটি করে যে কাজ সুধীর করতে পারেনি এবার এই ঘটনার কথা জানার পর বিশাখার বদলীর পথ তরান্বিত হয়।বিশাখা বদলী হয়ে সুধীরের স্কুলে জয়েন করে।
  দেখতে দেখতে দশ মাস দশ দিন কেটে যায়।বিশাখা জন্ম দেয় একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্র সন্তানের।বিশাখার শ্বাশুড়ীও নাতির মুখ দেখে ভীষণ খুশি।তিনি যেন একটু বেশীই খুশি নাতিকে দেখে।কারণ খুঁজতে খুঁজতে জানা গেলো বিশাখার শ্বশুরমশাইয়ের নাকের ডানদিকে একটা জরুল ছিল।বিশাখার ছেলেরও ঠিক ঐরূপ একটি জড়ুল রয়েছে নাকের ডানদিকে।তো শ্বাশুড়ী মা একশ পার্সেন্ট সিওর সুধীরের বাবা ই সুধীরের ছেলের রূপ ধরে তার কাছে ফিরে এসেছেন।এতে সুবিধা হয়েছে বিশাখার একটাই ছেলেকে নিয়ে তার কোনোই হ্যাপা পোহাতে হয় না।
  কিন্তু সুখ বেশিদিন বিশাখার কপালে ঈশ্বর লেখেননি।ছেলের বয়স তখন পাঁচ বছর।একদিন স্কুল চলাকালীন সময়ে সুধীর খুব অসুস্থ্য বোধ করে।বুকের বা দিকটা চাপ চাপ ব্যথা অনুভব করতে থাকে।ক্লাস করতে করতে অসুস্থ্যতা বোধ করায় একজন ছাত্রকে পাঠায় বিশাখাকে ডেকে আনবার জন্য।কিন্তু বিশাখা আসার আগেই বুকের ব্যথায় অস্থির সুধীর চেয়ারে বসে থাকাকালীন অজ্ঞান হয়ে নিচুতে পরে যায়।ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তাদের স্যারের এই অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।কতটুকু আর কিইবা করতে পারে তারা?বিশাখা ছুটে আসে।বিশাখা তার সহকর্মীদের সাহায্যে সুধীরকে নিয়ে বড় নার্সিংহোম যায়।কিন্তু ইমারজেন্সিতেই ডাক্তার দেখে জানিয়ে দেন বেশ কিছুক্ষন আগেই সুধীর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে চলে গেছে।
 শুরু হল বিশাখার জীবনে আর এক লড়াই।ঘটনার আকস্মিকতায় সে পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়।আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু,স্কুল কলিগের সহয়তায় সব কাজ মিটলো ঠিকই কিন্তু শ্বাশুড়ীর মধ্যে দেখা দিল আবার আগের সেই রণচন্ডি মূর্তি।দাদা বাইরে থেকে তাকে জানালো বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি মিলিয়ে তাকে থাকতে তাতে করে অন্তত একটু হলেও মানসিক শান্তি সে পাবে।কিন্তু তার শ্বাশুড়ী তাকে এক বেলার জন্যও ছেলে সমেত কোথাও ছাড়বে না।কোথাও যাওয়ার কথা বললেই তিনি অকথ্য ভাষায় বিশাখাকে গালমন্দ করতে থাকেন।প্রতিটা মুহূর্তেই তিনি তাকে মনে করে দিতে ভোলেন না বিশাখার জন্যই তিনি তার সন্তানকে হারিয়েছেন।
 মাঝে মধ্যে বাপের বাড়িতে কিছুক্ষনের জন্য আসলেও ছেলেকে আনার সাহস কোনদিন সে পায়নি।স্কুল,বাড়ি আর সংসারের যাবতীয় কাজ -- এইভাবেই চলে গেলো আরও বেশ কয়েকটা বছর।প্রয়োজন ছাড়া কেউই তার মুখে কোন কথা শুনতে পায়না।ছেলে সুবীর যত বড় হতে থাকলো ততই সে অদ্ভুতভাবে মায়ের নেওটা হয়ে উঠতে লাগলো।ঠাকুমাকে যথেষ্ঠ ভালোবাসলেও ঠাকুমার তার মায়ের প্রতি অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ সে দশ বারো বছর বয়স থেকেই করতে শুরু করে।আর বিশাখা ছেলের তার প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ দেখে একটু একটু করে যেন মানসিক বল ফিরে পেতে শুরু করে।
 খুব ছেলেবেলা থেকেই সুবীর অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে ঠিক তার বাবা সুধীরের মতই দুখিনী মায়ের পাশে থেকে সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে তার মাকে রক্ষা করে চলে।স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম বিশাখার মনে হতে থাকে তাকে বাঁচতে হবে শুধু তার ছেলের জন্যই নয় তার নিজের জন্যও।

ক্রমশঃ
  
 

Wednesday, January 26, 2022

ঝরাপাতা(একাদশ ও শেষ পর্ব)

ঝরাপাতা (একাদশ ও শেষ পর্ব)
  বিশাখার বিয়ের একবছরের মাথায় সুমিতের বিয়ে হয় দীপালীর সাথে।বোনের বিয়েতে সুমিত আসতে পারেনি।বিয়ের সময় এসে সুমিত মাসখানেক ছিল।তারপর দীপালিকে নিয়ে সে সুইডেন চলে যায়।বৃদ্ধ বাবা,মা গ্রামের বাড়িতেই থেকে যান।তবে সুমিত তাদের সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু তারা কেউই রাজি হননি।এমনকি সুমিত বিয়ের পরে প্রথম যেবার টাকা পাঠায় সুমিতের বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ফোন করে জানিয়ে দেন 
--- তুমি বোনের বিয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছো।সেখানে আমার কোন খরচই হয়নি।সুতরাং আমার যা ক্যাশ ছিল তাতে হাত পড়েনি।এখন আমি ভালোই পেনশন পাই।তোমার দিদি এবং বোন উভয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।তারা দুজনেই চাকরি করে।ভালোই আছে তারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে।প্রত্যেক বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে তাদের ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার এবং পরবর্তীতে তাদের সংসারী করার।আমরা সে দায়িত্ব পালন করেছি।আমরা সুযোগ দিয়েছি তোমরা তোমাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সে সুযোগকে কাজে লাগিয়েছো।তোমাদের কারো কাছে আমাদের কোন চাহিদা নেই।তোমরা ভালো থেকো এটাই শুধু একমাত্র কামনা আমাদের।বছরে একবার করে দেশে এসো তুমি এটাই শুধু চাই।
 বাবা মা যতদিন বেঁচে ছিলেন সুমিত বছরে একবার করে দেশে এসেছে বাবার কথা রাখতে।দুই ছেলেমেয়ের বাবা সে।পুরো দুনিয়াটা আজ মানুষের হাতের মুঠোয়।রোজই সুমিত তার দিদি ও বোনের সাথে কথা বলে।বিশাখা নার্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন একটা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা।স্বামী,স্ত্রী একই স্কুলে আছে।
 বহুদিন পর সুমিত তার এক বন্ধুর শেয়ার কৃত একটি পোষ্ট ফেসবুকে দেখে।কবিতাটা তার খুবই ভালো লাগে।কবির নামটা দেখে বুকের ভিতরে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে।সার্চ করে ঢুকে পড়ে সুচন্দা ঘোষের প্রোফাইলে।স্কোল করতে থাকে।পেয়ে যায় অল্প বয়সী সুচন্দার একটি ছবি।বুকটার ভিতর ধরাস করে ওঠে।সেদিনের সন্ধ্যার স্মৃতি যেন আবার নূতন করে সামনে আসে। শরীরের ভিতর সেই সেদিনের মত অদ্ভুত এক শিহরণ।ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।কিছুক্ষনের মধ্যেই ফোন অপর প্রান্ত হতে।হাজার হাজার মাইল দূরত্ব থেকে ফোনের দুই প্রান্তে দুটি মানুষ 'হ্যালো' বলেই নীরব হয়ে যায় বেশ কিছুক্ষন। কারো মুখেই কোন কথা নেই।
  জীবনে এমন কোন কোন সময় আসে যখন সেই জীবন থেকে নূতন করে আর কিছু চাওয়া বা পাওয়ার থাকে না।সুমিত কিংবা সুচন্দারও সেই সময়টা আগত।তবুও এই বয়সে এসে দুজনেই শুধু একবার দুজনকে চোখে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান।
 সুচন্দারও একছেলে,একমেয়ে।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,ছেলে ভালো চাকরি করছে।সুচন্দার স্বামী বছর চারেক হল তাদের ছেড়ে চলে গেছে ঘুমের মধ্যেই।লেখালেখি,ছাদ বাগান পরিচর্যা,ছোটখাটো নানান এনজিও সংস্থার সাথে জড়িত থেকে সময় কাটিয়ে দেয় সে।কিন্তু এতগুলো বছর ধরে দিনান্তে একবার হলেও তার সুমিতের কথা মনেপড়ে।পৃথিবীর আর এক প্রান্তে বসে সুমিতেরও ঠিক তাই।
  সুমিত ও সুচন্দার রোজ দুবার করে ফোনে কথা বলা যেন একটা নেশার মত দাঁড়িয়ে গেলো।কথা যেন আর শেষই হতে চায়না।সেখানে থাকে অতীতের কথায় বেশি।এই বয়সে এসে দুজনের জীবনে কিছুটা সময় হলেও যে একাকিত্ব নেমে এসেছিলো - তাদের এই কথা সেই একাকিত্বকে সম্পূর্ণভাবে তাদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।কথা শেষ হওয়ার পর কথার রেশটাই থেকে যায় বাকি সময়টা।কিন্তু কেউ কারো কাছেই কোন কিছুর প্রত্যাশা না করেই দুজনেই রোজ একবার করে ডুব দেয় সেই ফেলে আসা অতীতে।
 তারা ঠিক করে নূতন করে তাদের যখন আবার পরিচয় হয়েছে জীবনে শেষবারের মত একবার তারা যেভাবেই হোক দেখা করবে।কারণ বাবার মৃত্যুর পর সুমিত আর দেশে ফেরেনি বেশ কয়েক বছর।সুমিত আসবে।কিন্তু সে কবে?প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শুরু হয় নূতন করে দুজনের।
     
              শেষ

#টপব্লগকনটেস্ট


    

Sunday, January 23, 2022

দশম পর্ব (দশম পর্ব)

ঝরাপাতা (দশম পর্ব)
  সদা উচ্ছল সুচন্দা আস্তে আস্তে নিজের ভিতরে গুটিয়ে যেতে থাকে।কলকাতায় তার নিজের বাড়ির পরিবেশ,প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে পড়াশুনা করার ফলে সেই স্কুলের প্রতিটা ইট,চেয়ার,টেবিল প্রতিটা শ্রেণীকক্ষ সুচন্দার মনের গভীরে প্রতি মুহূর্তে ভাস্বর হয়ে আছে।নূতন পরিবেশের সাথে সে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারেনা।অথচ অদ্ভুত এক জেদ ধরে সে আর কখনোই নিজের বাড়িতে ফিরে আসে না।যে কয়েকবার সে কলকাতা এসেছে প্রতিবারই নানান অনুষ্ঠান উপলক্ষে।কিন্তু প্রতিবারই এসে সে সুমিতের খোঁজ করেছে।কিন্তু প্রতিবারই ভগ্ন হৃদয়েই তাকে ফিরতে হয়েছে।
 সুমিত যখন তার উচ্চশিক্ষার এক একটা কঠিন পরীক্ষায় আশাতিরিক্ত ফল করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাচ্ছে আর অন্যদিকে সুচন্দা একটু একটু করে তার জীবনে দেখা সমস্ত স্বপ্নের পাপড়িগুলোকে কিছুটা নিজের জেদ,ভাগ্য বিড়ম্বনা আর বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক সমস্যা - সবকিছুর সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে অতি সাধারণভাবে কোন প্রকারে গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করে।নিজেকে ডুবিয়ে দেয় সবকিছু ভুলে সাহিত্য জগতের মাঝে।লিখতে থাকে একের পর এক গল্প কবিতা।
 দুঃখ,কষ্ট, শোক ভোলার সব থেকে বড় ওষুধ হচ্ছে সময়।এই সময়ই মানুষকে সবকিছু ভুলিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে শেখায়।স্মৃতির উপরে একটা প্রলেপ ফেলে দেয়।তখন আর দগদগে ঘায়ের সেই যন্ত্রণাটা অনুভূত হয় না।এইভাবে জীবনের এমন অনেক বছর চলে যায় হয়তো সেই ঘায়ের কথাটাই মানুষ ভুলতে বসে।
  সুমিত কিংবা সুচন্দা কারো ক্ষেত্রেই তার ব্যতিক্রম হয়নি।শুধু মাত্র কয়েকটা দিনের স্মৃতি বুকে আগলে রেখে বেশ কয়েকটা বছর উভয়ই কষ্ট পেয়েছে ঠিকই কিন্তু পরিবেশ,পরিস্থিতি আর জীবনের চাহিদা মেটাতে ভুলে যাওয়া নয় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে হৃদয়ের কোন এক কোণে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।কিন্তু একাকী অন্ধকার ঘরে কিংবা উদাস মনে সেই বিকেলের স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।পৃথিবীর দুই প্রান্তে সেই দুটি তরুণ তরুণী যারা আজ মধ্য বয়সী ক্ষণিকের জন্য হলেও সেদিনের সেই স্মৃতি মনকে মোচড় দিয়ে তোলে।
 সুমিত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে নিজ মেধার গুনে চলে যায় সুইডেন।সুচন্দা তার জীবনে আর ফিরবে না এটা সে নিশ্চিত হয়ে যায়।সময় তাকে সেই শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্যও করে।মনের কোণে সুচন্দা এবং সেদিনের সেই সন্ধ্যার স্মৃতি ঘুম পাড়িয়ে রেখেই জীবন যুদ্ধে একটা একটা করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে থাকে।মা,বাবা তখনো বেঁচে।বিদেশ, ভূঁইয়ে বাড়ির একমাত্র ছেলেকে একা একা রাখা সমুচিন মনে করলেন না তারা।ছেলেকে না জানিয়েই তারা তার জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করলেন।অপেক্ষা ছেলে পুজোর সময় বাড়ি আসবে।
এদিকে বিশাখা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নার্সিং ট্রেনিং শেষে সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেয়ে যায়।নার্সিং ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে সে আরো বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল।বড় বোনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে সুমিত দেশে থাকাকালীন সময়েই।দাদা বিদেশে।বাবা,মা শুরু করেন তারজন্যও ছেলে দেখতে।
 দেখতে দেখতে পুজো এসে যায়।সুমিত বাড়ি ফেরে।তার বাবা,মা তাকে জানান যে তারা তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখেছেন।সুমিত কোনো আপত্তি করে না।জীবন থেকে তখন চলে গেছে অনেকগুলি বছর।সুচন্দার স্মৃতিটা মনকে উদাস করলেও দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কষ্টটাও বেরিয়ে যায়।সুমিত মেয়ে দেখে কিছুটা গড়িমসি করলেও বাবা,মায়ের পছন্দের বাইরে যেতে পারে না।দীপালি তখনো গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেনি।সুমিত তার বাবাকে জানায় 
 --- এবারে বিয়েটা করতে চাইনা বাবা।আমি কোনোদিন তোমাদের কথার অবাধ্য হইনি এখনো হবো না।আমার যা চাকরি তাতে আমাকে সারাটাজীবন বাইরে বাইরেই থাকতে হবে।তাই আমি চাই অন্তত মেয়েটা গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করুক।ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি নাহয় আর একবার তখন দেশে ফিরবো।তোমরা ইতিমধ্যে শিখুর বিয়েটা দেওয়ার ব্যবস্থা করো।টাকা-পয়সার  ব্যাপারে ভেবো না।সে ব্যবস্থা আমি করবো।
 সুমিতের বাবা তার কথাগুলি যুক্তিযুক্ত মনে করলেন।সত্যিই তো দেশের বাইরে গিয়ে থাকতে হলে সুমিতের বউকে তো অন্তত গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করতেই হবে।তানাহলে সুমিতের উপযুক্ত সে হবে কি করে? আর শিখুর কথাটাও তো সে ঠিকই বলেছে।বোন থাকতে দাদার আগে বিয়ে কিভাবে সম্ভব? লোকে কি বলবে?আর শিখুও বা মনেমনে কি ভাববে?তারা আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন বিশাখার জন্য ছেলে জোগাড় করতে।
 বিশাখা খুব বেশি লম্বা নয়।এই পাঁচ ফুটের মত।গায়ের রং শ্যামলা।মাথা ভর্তি চুল তার কোমর ছাপিয়ে গেছে।বিশাখার চেহারার সব থেকে সুন্দর দিকটি হচ্ছে তার মায়াভরা দুটি চোখ।আসলে সুমিতের মায়ের চোখ দুটি খুব মায়াভরা।তার তিনটি সন্তানই তার মতই চোখ পেয়েছে।সুমিতের বাবার গায়ের রং ছিল খুব চাপা।অদ্ভুতভাবে তিনটি সন্তানই তার গায়ের রংটা পেয়েছে।তবে তাদের প্রতিটা সন্তানই পড়াশুনায় ছিল খুব ভালো।যে যার ক্লাসে প্রথম স্থানটিই দখল করে থাকতো।গৃহ শিক্ষক তাদের ছিল না ঠিকই কিন্তু তাদের বাবা সে স্থান পূরণ করে দিতেন।প্রতিদিন নিয়ম করেই তিনি তার তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসতেন।আর ছেলেমেয়ে তিনটিও কখনো বাবার অবাধ্য হয়নি। যার ফলে সকলেই তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তাদের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করতে পেরেছে।
 বিশাখার জন্য ছেলে পছন্দ হল।গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের একমাত্র ছেলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশাখাকে ছেলে দেখে পছন্দ করলেও তার মায়ের একটু আপত্তি দেখা দিয়েছিল গায়ের রং নিয়ে।কারণ ছেলে তার ভীষণ ফর্সা।যদি নাতি নাতনীদের চেহারা কালো হয় এই ছিল তার ভয়।কিন্তু তিনি তার মতামত ছেলের উপর চাপাতে সক্ষম হননি।কারণ সুধীর ছিল ভীষণ আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন একজন পুরুষ।সে বিশাখাকে দেখে পছন্দ করে বিশাখাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার সময় সুযোগ বুঝে তার কাছে বলেছিলো,
--- তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।আমি কি তোমার মতামতটা জানতে পারি?
 বিশাখা মুখ নীচু করে সলজ্জ হেসে বলেছিলো,
--- বাবা,মায়ের ইচ্ছায় আমার ইচ্ছা।
 কিন্তু সুধীর তার এই উত্তরে খুশি হয়েছিল না।সে সরাসরি বলেছিলো,
--- বাবা,মায়ের মুখের উপর কথা বলা কোন সন্তানেরই উচিত নয় ঠিকই।কিন্তু তাই বলে সন্তানদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার তারা কিন্তু হরণ করেননি।তোমার যদি আমাকে পছন্দ না হয় আর বাবা,মায়ের কথা রাখতে গিয়ে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসো তাহলে সারাটা জীবন অ্যাডজাস্ট করেই চলতে হবে।বুকের ভিতর কষ্ট চাপা রেখে ভালোবাসার অভিনয় করে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।আমি তা চাইনা। বিয়ে মানে একই ছাদের তলায় দুটি নরনারীর আজীবন থাকা নয়।বিশ্বাস,ভালোবাসা দিয়ে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা।তাই সরাসরি তোমার মতামতটা জানতে চাই।
 সুধীরের কথাবার্তায় বিশাখা বুঝে ফেলে মানুষটা কোন ধরনের।সে সরাসরি সুধীরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আপনাকে যদি আমার পছন্দ না হত তাহলে হয়ত আমি এতক্ষন আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে পারতাম না বা বলতামও না।
 উত্তর শুনে সুধীর খুশি হয়।তাই মাকে সে সরাসরি জানিয়ে দেয় বিয়ে সে এখানেই করবে।

#ক্রমশঃ

    

Tuesday, January 18, 2022

ঝরাপাতা (নবম পর্ব)

   ভালোবাসার ফুলটি ভালোভাবে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই তা শুকিয়ে ঝরে গেল।ছিটকে গেলো দুটো কিশোর কিশোরী আজীবন ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়াটি নিয়ে।হৃদয় নামক দামী ফ্রেমে বন্দী হয়ে গেলো প্রথম ভালোবাসার পরশ।
  সুচন্দা যখন ইলেভেনে ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে ঠিক তখনই তার বাবা মারা যান।মুঠোফোনের এত রমরমা না থাকার কারণে বাবার মৃত্যুর পরদিন টেলিগ্রাম মারফৎ এ দুঃসংবাদ পায় তারা।পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিন রাতেই তারা রওনা দেয়।কাজের আগেরদিন এসে পৌঁছায়।মনে একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে এসেছিল সুচন্দা যেভাবেই হোক এবার সে সুমিতকে খুঁজে বের করবেই।কিন্তু ভাবনার সাথে অধিকাংশ সময়ই মানুষ বাস্তবের মিল খুঁজে পায় না।বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া,নিয়ম ভঙ্গ সবকিছু মিটে যাওয়ার পর "বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি "- এই অজুহাতে সুমিতদের ভাড়া বাড়ি,সুমিতের পরিচিত যারা ছিল তাদের বাড়ি পাগলের মত ছুটাছুটি করতে থাকে।এখন তারা কেউই আর এখানে থাকে না।সুমিত উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জয়েন্টে বসেছিল।কিন্তু খুব ভালো ফল করতে পারেনি।কারণ জীবনের প্রথম স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট তার মনেও যথেষ্ঠ প্রভাব ফেলেছিল।সুচন্দার মত তারও ইচ্ছা ছিল ডাক্তারী পড়ার।কিন্তু এক্ষেত্রে তারও ভাগ্য সহায় হয়নি।সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভালো রাঙ্ক করে এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই ভর্তি হয়ে যায়।কিন্তু বর্তমানে কোথায় সে পড়ছে সে খবর কেউই তাকে দিতে পারে না।
 একবুক কষ্ট আর অভিমান নিয়ে সে দিদি,জামাইবাবুর সাথে পুনরায় ফিরে আসে। আসবার আগে মা তাকে জানিয়েছিলেন,
--- তুই যদি মনে করিস এখানে থেকে পড়াশুনা করবি তাহলে থেকে যা।সেই সময় তোর বাবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা আমি করেছিলাম।কিন্তু তিনি আমার কথা শোনেননি।আমি কি করবো বল?
--- বিনা কারণে নিজের বাড়ি থেকে আমায় নির্বাসন দিয়েছো।তোমরা কেউ একবারের জন্যও আমার মানসিক পরিস্থিতির কথা ভাবোনি।আমার কি অপরাধ ছিল সেদিনের ঘটনায় বলতে পারো?অথচ শাস্তিটা আমি পেলাম।ওখানে আমি পড়াশুনায় মন বসাতে পারিনা।আমার ভালো লাগে না ওখানে থাকতে।আমি জানি আমার রেজাল্টও ভালো হবে না।কিন্তু যে সিদ্ধান্ত বাবা আমার ক্ষেত্রে নিয়েছিলেন আজ তিনি নেই ঠিকই আমি তার নেওয়া এই সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও সরবো না।তাতে আমার ক্যারিয়ার যদি শেষ হয়ে যায় তো যাবে।
--- আমার কি ভালো লাগে তোকে তোর দিদির বাড়িতে রেখে পড়াশুনা করাতে?কত করে তাকে বুঝিয়েছিলাম কিন্তু তিনি কিছুতেই শুনলেন না।অনেক অশান্তি করেছি।
--- আমার মত অনেক মেয়েই রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে ছেলেদের কাছে হেনস্থা হয়।তারা সবাই কি বাড়ি ছাড়া হয়?নাকি সকলের এই সুযোগ থাকে? ব্যতিক্রম শুধু আমি!তোমরা কেউ একবারের জন্যও আমার মনের অবস্থাটা জানতে বা বুঝতে চাইলে না।তোমরা একবারও ভাবলে না তোমাদের ছাড়া,এই বাড়ি ছাড়া, দশ বছর ধরে যে স্কুলে পড়ছি সেই চিরপরিচিত গণ্ডি ছেড়ে আমি শিলিগুড়ি কতটা ভালো থাকবো?আসলে সবই আমার ভাগ্যের দোষ!তোমাদের কোন দোষ নেই।মেয়েরা বিয়ের পরে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে যায় আর আমি আমার ভবিষ্যৎ ,আমার চিন্তাধারা,আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছু বস্তাবন্দি করে দিদি,ভগ্নিপতির কাছে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। নাহ্ আমি এখানে আর ফিরবো না পড়াশুনা শেষ করার আগে।যা আমার কপালে আছে হবে।আমার জন্য তখন যখন কিছুই করতে পারোনি বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আজ আর কিছু করার দরকার নেই।
 তারপর খুব আস্তে আস্তে বললো,
--- আমার জীবনের যা হারানোর তা হারিয়েই গেছে।শত চেষ্টা করে মাথা কুটে মরলেও আমি আর তা ফেরৎ পাবো না।
--- কি হারিয়ে গেছে তোর জীবন থেকে?
সুচন্দা এবার কেঁদে দিয়ে বললো
--- সব,সবকিছু মা সবকিছু।কেন যে আমাকেই বলির পাঠা করা হল আমি জানিনা।
 সুচন্দা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে দেখে মা এগিয়ে গিয়ে তার মাথাটি নিজের বুকের উপর নিয়ে বললেন,
--- এত কষ্ট বুকের ভিতর চেপে রেখেছিস?কিসের এত কষ্ট তোর?আমায় বল দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা।
--- কোন লাভ নেই মা কোন লাভ নেই।আমার জীবন থেকে যা যা হারানোর তার সবকিছুই হারিয়ে গেছে।আর নূতন করে কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
 সুচন্দার মা মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।আর সুচন্দা মায়ের বুকের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

সেদিন রাতে সুচন্দাকে কেউ কিছু মুখে দেওয়াতেই পারেনি।সারাটা রাত না খেয়েদেয়ে শুধু কেঁদেই গেছে।মা অন্য দিদিরা তাকে অনেক বুঝিয়েছে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে অন্যত্র থাকতে যখন তার এত কষ্ট হচ্ছে তাহলে সে তবে শিলিগুড়ি থেকে ফিরেই আসুক।এখানেই সেই আগের মত পড়াশুনা করুক।এত কষ্ট যে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে সুচন্দা পাচ্ছে তাতো বাড়ির কেউই কোনদিন বুঝতে পারেনি।কিন্তু কিছুতেই সুচন্দা দিদির বাড়ি থেকে কলকাতা ফিরবে না পড়াশুনা করার জন্য।বাবার সিদ্ধান্তের কারণে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সুমিত।সেই অভিমান,সেই কষ্ট কিছুতেই ভুলতে পারেনা সুচন্দা।সুমিত যে তার জীবন থেকে সারা জীবনের জন্য হারিয়ে গেছে আর এইজন্য যে তার বাবার সিদ্ধান্তই দায়ী - একথা সুচন্দা কিছুতেই ভুলতে পারে না।তাই সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার সিদ্ধান্তকেই মেনে আগেও নিয়েছে আর এখন তার নড়চড় হতে কিছুতেই সে দেবে না।
 ক্লাসে প্রথম হওয়া মেয়েটি পরিবেশ,পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে নিজের মনকে মানিয়ে নিয়ে পড়াশুনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু পারে না।একাকী,নিরিবিলি থাকলেই সুমিতের কথা মনে পড়তে থাকে তার।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করে।পারে না নূতন করে পড়াশুনায় মন বসাতে। আস্তে আস্তে তার রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করে।সকলেই এখন তার মানসিক পরিস্থিতি বুঝতে পারে।তাকে বাড়ির সকলে ছাড়াও দিদি,জামাইবাবুও বারবার বলেছেন সে যদি চায় তাহলে সে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে।তারা কেউই কোন আপত্তি করবে না।আর কবে কি একদিন ঘটেছে সেই ঘটনাকে মনে রেখে ভয় পেয়ে অকারণে নিজের জীবনের ক্ষতি করার কোন মানেই হয়না।
 অজিতেশবাবু এমনিতে খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।কিন্তু মাঝে মধ্যে তিনি খুব জেদী আর একগুঁয়ে টাইপের হয়ে যেতেন।তাই তিনি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুচন্দাকে শিলিগুড়ি থেকে লেখাপড়া শিখাবেন তখন কারো মতামতের গুরুত্ব তিনি দেননি।আর তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ কোন মতামত ব্যক্ত করার সেভাবে কেউ সাহস দেখাতে পারেননি।কিন্তু আজ যখন অজিতেশবাবু নেই আর সুচন্দাও ভালো নেই তখন সকলে মিলেই আবার সুচন্দাকে বোঝাতে থাকেন কলকাতা এসে পড়াশুনা শেষ করার জন্য।কিন্তু বাবার স্বভাব যে ছোট মেয়ে সুচন্দার মধ্যে কিছুটা হলেও আছে।সেও যে একগুঁয়ে।যেহেতু বছর খানেক আগে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার সিদ্ধান্তকে সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল তাই আজ কারও কথা সে শুনতে রাজি নয়।

ক্রমশঃ 

Monday, January 17, 2022

বিট্রে

বিট্রে
মনের কথা যদি চোখ পড়ে বোঝা যেত তবে জীবনটা অন্য রকম হত - আমার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে আমি ভালোবেসেছিলাম সৌমেনকে।মনেমনে ভেবেছিলাম সৌমেনও বুঝি আমায় ভালোবাসে।কলেজে পড়াকালীন সময়ে সৌমেন ক্লাসে আমার পাশেই বসতো সবসময়।ক্লাসের অন্যান্যরাও জানতো আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমরা কেউ মুখ ফুটে কিন্তু কাউকে ভালোবাসার কথা কোনদিন বলিনি।
  ভালোলাগা বা ভালোবাসার সব কথা সব সময় মুখ ফুটে সবাইকে বলা হয়ে ওঠে না। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন মনের কথায় নাকি চোখে ফুটে ওঠে।আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি সবকিছু সময় থাকতে মুখেই বলে দেওয়া উচিত।সবাই সবকিছু বুঝতে পারে না,সকলের মধ্যে অন্যের অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা থাকে না।তাই জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় এলে অন্যের বোঝার ক্ষমতার উপর নির্ভর না করে মুখেই বলে দেওয়া উচিত।
 কলেজে একসাথে চার বছর পড়ার সুবাদে কারণে-অকারণে দুজনে একসাথে এদিক ওদিক ঘোরার পর শেষ বর্ষে এসে হঠাৎ একদিন সৌমেন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমায় বলল,
--- আমাকে একটু সাহায্য করবি?
--- হ্যাঁ বল কি করতে হবে?
--- সেদিন নবীন বরণ উৎসবে যে মেয়েটি উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিল ওর সম্পর্কে একটু খোঁজ-খবর চাই ।
--- কেন বলতো?
 এরপর সৌমেন যে উত্তরটা দিলো আমি যেন নিজের কোনকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে,চোখে তখন সবকিছু অন্ধকার দেখছি।সৌমেন হাসতে হাসতে আমায় বললো,
--- আসলে ওই মেয়েটাকে দেখে আমার অবস্থা হয়েছে Love at first sight. আমি না মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছি।
আমি হা করে সৌমেনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।আর মাথার মধ্যে নানান প্রশ্ন  উঁকি দিচ্ছে।তাহলে এতদিন আমার সাথে যেটা করলো সেটা ভালোবাসা নয়?আমার সাথে এই সম্পর্কটার নাম তাহলে কি শুধুই বন্ধুত্ব ছিল? কথায় কথায় হাত ধরা,একসাথে অনেকটা সময় কাটানো,দুজনের মধ্যে সব রকম কথা শেয়ার করা - এগুলো কি ছিল?এগুলো তবে ভালোবাসা নয়?নির্মল বন্ধুত্ব নাকি একটা নারী সঙ্গে শুধুই সময় কাটানো?
 আমাকে থ হয়ে বসে থাকতে দেখে সৌমেন আমার হাত দুটি ধরে কাতর স্বরে বললো,
--- দেখ তোকে ছাড়া আর কাকেই বা মনের কথা বলবো।মেয়েটাকে সত্যিই আমার খুব ভালো লেগেছে সেদিন।
 সৌমেনের কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলাম।সৌমেন বুঝতে পেরে বললো,
--- কি হল?হাতটা সরিয়ে নিলি?তারমানে তুই পারবি না?
আমি নিজেকে অদ্ভুতভাবে সামলে নিয়ে বললাম,
--- এই সাধারণ কথাটা বলতে হাত ধরার কি প্রয়োজন ছিল?আসলে তোরা ছেলেরা মেয়েদের কারণে অকারণে একটু টার্চ করতেই ভালবাসিস।
 সৌমেন স্বপ্নেও ভাবেনি আমি এরকম একটা উত্তর দেবো।সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল।আমি তাকে কথাটা বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম,
--- আমি চেষ্টা করবো ওর ঠিকুজি-কুষ্ঠী জেনে তোকে জানাতে।তবে একটা কথা তোকে বলি আগে নিজের মনকে প্রশ্ন করিস সত্যিই তুই ওর প্রেমে পড়েছিস কিনা নাকি সময় কাটানোর জন্য সঙ্গী পরিবর্তন করতে চাইছিস?
--- মানে?
 আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে সৌমেনের কাছ থেকে উঠে চলে আসি।বলা ভালো আর বেশিক্ষন সৌমেনের সামনে বসে থাকলে চোখটা সৌমেনের মতনই বিট্রে করতো।

Sunday, January 16, 2022

ঝরাপাতা (অষ্টম পর্ব)

ঝরাপাতা (অষ্টম পর্ব)
 বাড়িতে ফিরে স্বভাবতই সুচন্দার মনটা খুবই খারাপ হয়ে থাকে।সে চুপচাপ হয়ে যায়।কিন্তু পাঁচ বছরের দিদির মেয়ে রিনিটার দুষ্টুমিতে মাঝে মধ্যে কিছু সময়ের জন্য তার মন খারাপ উধাও হয়ে যাচ্ছিল।দিদি,জামাইবাবু খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে কোন কারনেই হোক সুচন্দার মনটা খুবই খারাপ।বারবার তারা দুজনেই জানতে চেয়েছেন কিসের জন্য তার মন খারাপ।কিন্তু চাপা স্বভাবের সুচন্দা সেকথা কাউকেই জানাতে পারেনি।
 দিদি,জামাইবাবু দুজনে আলোচনা করে ঠিক করে তারা বাড়িতে ফেরার সময় সুচন্দাকে নিয়েই ফিরবে।কারণ তার এখন পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর অফুরন্ত সময়।বাবা,মা মেয়ে জামাইয়ের এই সিদ্ধান্তে খুবই খুশি হন এবং তারা সানন্দে মত দেন।কারণ তারা নিজেরাও কটাদিন ধরে লক্ষ্য করছেন সুচন্দা একটু মনমরা হয়ে থাকছে।প্রায় প্রতিদিনই সকলের অলক্ষ্যে সুচন্দা একবার করে সুমিতদের বাড়িতে গেছে কোন খবর পায় কিনা তার।কিন্তু প্রতিবারই গিয়ে সে বিফল হয়েই ফিরেছে।
 দিদি,জামাইবাবু সুচন্দাকে জানায় তাদের সাথে শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য।সুচন্দা শুনেই না বলে দেয়।কিন্তু তাদের জোরাজুরিতে আর বাবা,মায়ের কথার উপর তার আপত্তি কর্পূরের মত উড়ে যায়।সে যেতে বাধ্য হয়।
 কথা ছিলো খুব বেশি হলে দিন পনের মত থেকে চলে আসবে।কিন্তু পরিস্থিতি বইলো স্রোতের বিপরীতে।দিদির বাড়িতে পৌঁছানোর দিন দশেক পরে হঠাৎ করেই দিদি একদিন মারত্মক অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।সারারাত পেট যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।ভোরের দিকে রিনিকে সুচন্দার কাছে রেখে সুচন্দার জামাইবাবু তার দিদিকে নিয়ে হাসপাতাল ছোটে।ডাক্তার বলেন অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
 এদিকে সুমিত বাড়িতে পৌঁছে দেখে বাবা ভীষণ অসুস্থ্য।গ্রামের ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভই হচ্ছে না দেখে বাড়ির সকলের সাথে আলোচনা করে বাবাকে নিয়ে কলকাতা আসে।গ্রামের বাড়িতে তালা দিয়ে সব কলকাতা ভাড়া বাসায়  এসে ছোট্ট পরিসরে জায়গায় সংকুলান হচ্ছে না দেখে বাবা হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়েই তারা অন্য একটি বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখান থেকে উঠে যায়।এরমধ্যে সুমিত তার বোনকে পাঠিয়ে সুচন্দাদের বাড়ি থেকে জেনে যায় যে সে বেশ কিছুদিন দিদির বাড়ি শিলিগুড়ি আছে।সুমিতের কলেজ,বাবা হাসপাতাল ভর্তি সেখানে ছুটাছুটি তার উপর সুচন্দার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছে না সব মিলিয়ে সুমিতের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।এইভাবে প্রায় দুমাস কেটে গেলো।সামনেই মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে।সুমিত ধৈর্য ধরে বসে আছে রেজাল্ট বেরোনোর আগেই সুচন্দা কলকাতা ফিরে আসবে।সে বিনা কারণে সুযোগ পেলেই সুচন্দাদের বাড়ির সামনে থেকে যাতায়াত করে।বোনকে দিয়ে মাঝে মাঝেই খবর নেয় তাদের বাড়ি পাঠিয়ে।সারা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যেও এক মুহূর্ত সময়ও সুমিতের মন থেকে সুচন্দার চিন্তা যায় না।সব দায়িত্বই সে পালন করছে ঠিকই কিন্তু নিজের মনটাকে কিছুতেই সে কন্ট্রোল করতে পারছে না।সংসারে বড়ছেলে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে প্রতি মুহূর্তে নিজের কষ্ট বুকে চেপে রেখে দায় দায়িত্বগুলি পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা তার।কিছুটা হলেও পড়াশুনার ক্ষতি তো তার হচ্ছেই।বাবাও আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে উঠছেন।ছুটি পেয়ে কটাদিন এখানে কাটিয়ে তারপর গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন।কাজগুলো আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিয়ে আসতে পারলেও সুচন্দার কোন খোঁজ না পেয়ে সেদিনের সেই ঘটনার পরে আর তার সাথে দেখা না হওয়ার যন্ত্রণা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে।
 ওখান থেকে চলে আসার পর হঠাৎ একদিন সেই কাজের মেয়ে ঝর্ণার সাথে তার দেখা।তাকে দেখতে পেয়ে সুমিত এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়
--- আচ্ছা তুমি সেদিন সেই চিঠিটা দিয়েছিলে সুচন্দাকে?
প্রথম অবস্থায় ঝর্ণা একটু থতমত খেয়ে যায়।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ডাহা মিথ্যা বলে দিলো।
--- হ্যাঁ দিয়েছিলাম তো।
--- কিছু বলেনি?
--- না দাদা আমি সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। চিঠিটা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে এসেছিলাম।
 সুমিত আর কথা বাড়ায় না।কারণ এদের পেটে কোন কথা থাকে না।কোথায় কোন বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে এটাই প্রধান গল্পের বিষয় হয়ে উঠবে।
 বিশাখা সুচন্দাদের বাড়ি মাঝে মাঝে যায়।আর যেটুকু খবর জোগাড় করতে পারে দাদাকে এসে জানায়।এদিকে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর সময় এসে গেলো।কিন্তু সুচন্দার দেখা নেই।বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে সুচন্দা প্রথম বিভাগে পাশ করেছে।সুচন্দা এবার ফিরে আসবে এই আশা নিয়ে সে প্রায় প্রতিদিনই তাদের বাড়ির সামনে থেকে যাতায়াত করে বোনকে পাঠায় সুচন্দাদের বাড়িতে।কিন্তু না সে ফিরে আসে না।বরং একদিন বিশাখা সুচন্দার বাড়ি থেকে ফিরে এসে তার দাদাকে জানায়
--- তুই কি জানিস দাদা একদিন সকালে সুচন্দা যখন স্যারের বাড়ি পড়তে যাচ্ছিল একটি ছেলে তাকে অত ভোরে একা পেয়ে রাস্তায় হেনস্থা করেছিলো।
 সুমিত যেন কিছুই জানে না এমনভাবে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- না,আমি সেরকম কিছু শুনিনি তো।কেন কি হয়েছে কি তাতে?
--- এই কয়েকদিন আগে মেসোমশাই এর কানে সে কথা যাওয়াতে তিনি সুচন্দার দিদিকে জানিয়ে দিয়েছেন সুচন্দাকে তারা যেন তাদের কাছে রেখেই পড়াশুনা করায়।তাকে যেন কলকাতায় আর না পাঠায়। এখান থেকেই তিনি সমস্ত রকম খরচপাতি বহন করবেন।
 এ কথা শুনে সুমিতের মনে হতে থাকে তার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে।সে ধপ করে নিজের সিঙ্গেল খাটটায় বসে পড়ে।মাথাটা নীচু করে থাকে।চোখ থেকে তখন টপটপ করে জল পড়ছে।বিশাখা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে দাদার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরে সুমিত উঠে ঘরের লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে আবার গিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসে পড়ে।
 ভালোবাসার শুরুতেই কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পাপড়িগুলো একটা একটা করে ঝরে গেলো।বিধাতা এত নিষ্ঠুর কেন?কেন তিনি দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটিয়ে এইভাবে সারাজীবনের জন্য তাদের আলাদা করে দিলেন?কতক্ষন সে কেঁদেছে আর কতক্ষন সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে একাকী সে শুয়ে ছিল কিছুই তার মনে নেই।বিশাখা যখন ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দাদাকে খেতে ডাকতে এসেছে তখন রাত গভীর।প্রায় বারোটা বাজে।সেতো সবকিছুই জানতো তাই দাদাকে কিছুটা সময় নিরিবিলি নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। একটুও বিরক্ত করতে চায়নি।কিন্তু তার এখন এতটাই খিদে পেয়ে গেছে যে দাদাকে না ডেকে কোন উপায়ই নেই।কারণ ভাইবোন একসাথেই রাতে খায়।বাবা সুস্থ্য হয়ে আবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন।সাথে মা ও।আবার সেই দুই ভাইবোনের সংসার।আর ছেলেবেলার থেকেই বিশাখার সাথে সুমিতের বন্ধুর মত সম্পর্ক।দাদা যে সুচন্দাকে ভালোবাসে সেটা প্রথম থেকেই জানার ফলে আজকে দাদার কষ্টটা সে ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে।l


ক্রমশঃ

Monday, January 10, 2022

স্বার্থক জীবন

সার্থক জীবন 
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 
   
          পুতুল খেলতে খেলতেই মেয়েরা তার ভবিষৎ সংসার জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে লালিত করে একটি সুন্দর সুখনীড়।দোলন ও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা।পড়াশুনায় ছিলো তুখোড়।বাড়ির এবং স্কুল কলেজের সকলেই তার উজ্জ্বল ভবিষৎ জীবনের স্বপ্ন দেখতো।
দেখতে শুনতেও মন্দ ছিলোনা।আহামরি রূপ তার না থাকলেও কুৎসিত তাকে বলা যায়না।অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে দোলন ছিলো সকলের ছোট।তাই তার আদর ভালাবাসাটাও ছিলো একটু বেশি। 
        মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক বেশ ভালো নম্বর নিয়ে পাশ পর দোলন কলেজে ম্যাথে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়।স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে এসেই সে হোঁচট খায় বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে।দিদিরা তখন সকলেই সংসারী একমাত্র দাদাও তখন বিবাহিত।বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই দাদার ব্যবহারের পরিবর্তন লক্ষ্য করে দোলন।মায়ের সাথে এমনকি তার সাথেও কারনে অকারনে ঝামেলা করতে থাকে।মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারলেও অধিকাংশ সময়ই দোলন এ নিয়ে মাথা ঘামাতোনা।কারন সবসময়ই সে লক্ষ্য করেছে দাদা এই যে মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতো বৌদি মোটেই তাতে খুশি হতনা বরং প্রতিদিন রাতেই সে দাদা বৌদির ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতো কেন দাদা মায়ের সাথে এরকম ব্যবহার করে তাই নিয়ে।বাড়িটা ছিলো মায়ের নামে।বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর দাদা মাকে তার নামে বাড়িটা লিখে দিতে বলে।মা রাজি হননি।তিনি বলেছিলেন, 
---দোলার পড়াশুনা শেষ হোক ও একটা চাকরী জোগাড় করুক তারপর সব সম্পত্তি আমি তোর নামে লিখে দেবো। 
কিন্তু দোলন বুঝতে পেরেছিলো দাদার মনে ভয় ছিলো মা যদি সবকিছু দাদাকে না দিয়ে সকল দিদিদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেন।
     দোলনের বৌদি ছিলো ভীষন ভাল মানুষ।যখন সে এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসে দোলন ছিলো স্কুল ছাত্রী।স্কুল আর পড়া ছাড়া বাকি সময়টুকু সে তার বৌদির সাথেই সময় কাটাতো।স্বভাবিকভাবেই দুজনের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।একমাত্র ভাইপো ছোটপিসি বলতে অজ্ঞান।সুখ দুঃখের সাথে দোলনের দিনগুলি এগিয়ে যেতে থাকে।দুঃখগুলো মনের মধ্যে কখনোই সে পুষে রাখতোনা কারন সে জানতো সামনে তার কঠিন লড়াই,তাকে অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে হবে।দাদার উপর সংসারের পুরো দায়িত্ব।রুগ্ন মায়ের প্রতিমাসের ওষুধের খরচ প্রচুর।বৌদির অশান্তির ভয়েই মাসের প্রথমেই অনিচ্ছা সত্বেও মায়ের পুরো মাসের ওষুধটা দাদা কিনে আনে।দোলন বুঝতে পারে দাদার উপর একটা বিশাল চাপ পরে যাচ্ছে।অবশ্য তার পড়াশুনার খরচ সে নিজেই টিউশনি করে জোগাড় করে।সন্ধ্যায় বাড়িতে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়েকে সে পড়ায়।মাঝে মাঝে সে বৌদির হাতেও কিছু গুঁজে দেয় যদিও তার বৌদি রিতা কিছুতেই সে টাকা নিতে চায়না কিন্তু দোলন তার কোন আপত্তিই শোনেনা। 
       দোলনের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ।দাদা একদিন জ্বর নিয়ে অফিস থেকে ঘরে ফেরে।পরদিন বৌদি তার বাচ্চাটিকে দোলন ও তার শ্বাশুড়ীর জিম্মায় রেখে স্বামীকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়।প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা অর্থ ব্যয়ের পর জানা যায় দাদার শরীরে কিডনী ছিলো জম্মগত একটা যা এখন অকেজো।ডায়ালিসিস করে কিছুদিন হয়ত দাদাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিন্তু তারপর?টাকাপয়সাও বা কোথা থেকে আসবে?দোলনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে।মায়ের শরীরও ভালোনা।মা সবকিছু জেনে গেছেন।সর্বক্ষণ দাদার খাটের পাশে বসে চোখের জল ফেলে চলেছেন।বৌদি তার সমস্ত গয়না এনে দোলার হাতে দিয়ে বলে, 
---এগুলো বিক্রি করে দেখো কোন সুরাহা হয় কিনা।তোমার দাদার ব্যাংকে কিছু টাকাও আছে।আপাতত ওগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নাও।গয়নাগুলো বিক্রি করলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে বলে মনেহয়। 
---কিন্তু বৌদি এগুলো তো সব তোমার বাপের বাড়ির থেকে দেওয়া গয়না। 
---কি করবো আমি ওইগুলো দিয়ে আর বলতে পারো?  
---দেখি দিদিদের কাল ফোন করে বলি সব কথা ওরা কোন সাহায্য করতে পারে কিনা।
     না,বড়দি মেঝদি কোন সাহায্যের হাতই বাড়িয়ে দেয়নি ভায়ের অসুস্থ্যতায়।দু'জনেই পরিবারিক নানান ঝামেলার গল্প শুনিয়ে দিয়েছে।ডায়ালিসিস শুরু হয় দোলনের দাদার।ওষুধপত্র, খাওয়াদাওয়া আর ডায়ালিসিসের খরচ দোলনদের মত পরিবারের পক্ষে জোগাড় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।মা ও বৌদির সাথে ঠিক করে বসত বাড়িটা রেখে বাকি জমিজমা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।এদিকে দোলার দাদার শরীর দিনকে দিন খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে।ডক্টর কোন আশ্বাসই দিতে পারেননা।একদিন ডায়ালিসিস করে বাড়িতে নিয়ে আসার পর শরীর মারাত্মকভাবে খারাপ হওয়ায় পূণরায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।বাড়িতে আর সে ফিরে আসতে পারেনা।দোলনের কাঁধে এসে পরে মস্তবড় দায়িত্ব। 
    পাগলের মত হন্যে হয়ে দোলন চাকরীর চেষ্টা করতে লাগে।টিউশনি করাও বাড়িয়ে দেয়।মার পাগলের মত অবস্থা।বৌদিও একই রূপ।কোন কুলকিনারা খুঁজে পায়না।হঠাৎ করে দেখা হয় কলেজ প্রিন্সিপ্যালের সাথে।সব শুনে তিনি তার রেফারেন্সে একটি কলেজে পার্টটাইম পড়ানোর সুযোগ করে দেন।কিছুটা হলেও সংসারের হাল ফেরে।কিন্তু দোলনের মায়ের হঠাৎ করেই শরীর মারত্মক খারাপ হতে থাকে।হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।চলে যাওয়ার আগে দোলনের হাত দুটি ধরে বলে যান,"বৌমা আর ছেলেটিকে দেখিস। 
      দোলনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু বৌদিকে সে সবকিছু থেকে আগলে রাখতে চেষ্টা করে।বৌদি আস্তে আস্তে চুপচাপ হয়ে যেতে থাকে।ছেলেটার দিকেও খুব একটা নজর দেয়না।ভাইপো রিন্টু দোলনকে আঁকড়ে ধরে।বাড়িতে দোলন যখন ছাত্রছাত্রী পড়ায় রিন্টু তখন চুপ করে দোলনের পাশে বসে থাকে।একমাত্র দোলন বাইরে বেরোলেই সে তার মায়ের কাছে যায়।যথাসময়ে রিন্টুকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় দোলন। দোলনের বৌদি রিতা চুপচাপ থাকতে থাকতে এখন আর কারও সাথেই কথা বলেনা।কিন্তু নিজের মনে সবসময় বিড়বিড় করে চলে। নিজের ঘর থেকেও কখনো বেরোয় না।রান্নাবান্না সংসারের যাবতীয় কাজ দোলনকেই করতে হয়।এমনকি বৌদির ঘরে তার সামনে বসে থেকে রাগ দেখিয়ে তার খাবারটুকু খাওয়াতে হয়।মাঝে মধ্যে ভুলভাল কথাবার্তা বলে।কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।শেষমেষ দোলন একজন সাইকিয়াট্রিসটের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।কিন্তু দিনকে দিন অবস্থার অবনতি হতে থাকায় ডাক্তারের পরামর্শ মত তাকে এ্যাসাইলামে ভর্তি করতে দোলন বাধ্য হয় কারন রিতার ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার খরচ দোলনের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভবপর ছিলোনা। 
       দোলনের জীবনে তার এই সংগ্রামের পাশে সে তার সহকর্মী পলাশকে পায়।পলাশ চক্রবর্তী।দোলন কখনোই তার এই সংগ্রামবহুল জীবনে অন্য কাউকেই জড়াতে চায়নি।কিন্তু সবকিছু তো আর নিজের মর্জিমত চলেনা।দোলন বুঝতে পারে পলাশ তাকে ভালোবাসে।দোলন ধরা দেয়না।কারন পরিবারিক এই বিশাল বিপর্যয়ের পরে দোলনের ধ্যানজ্ঞান ভাইপো রিন্টুকে মানুষ করা।ইতিমধ্যে তার চাকরীটাও পার্মান্যান্ট হয়ে যায়।অবশ্য এর সম্পূর্ণ ক্রেডিটটা পলাশ চক্রবর্তীর প্রাপ্য।দৌড়াদৌড়ি,ছুটোছুটি,উপর মহলকে ধরা-সবই সেই করে। তাই ইচ্ছা থাকলেও দোলন পলাশকে এড়িয়ে যেতে পারেনা।কিন্তু হাবভাবে দোলন তাকে বুঝিয়ে দেয় রিন্টু চাকরী না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ে করে সংসার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।এ ছাড়াও আছে বৌদির চিকিৎসার বিশাল ব্যায়ভার। 

( ২৪ঘন্টা বিরতির পর 😂)

Sunday, January 9, 2022

ঝরাপাতা (ষষ্ঠ পর্ব)

ঝরাপাতা(ষষ্ঠ পর্ব)
  এরপর রাস্তাঘাটে নানান জায়গায় সুমিত ও সুচন্দার দেখা হয়েছে।কিন্তু অদ্ভুত এক ব্যাপার হল দুজনের দেখা হলেই দুজনের মধ্যে এক আড়ষ্টতা কাজ করতো।দুজনের কেউই সেই আড়ষ্টতা বা লজ্জা কাটিয়ে উঠে কথা বলা তো দূরের কথা মুখের দিকেও তাকাতে পারত না।মাঝে মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেলে তাদের জমে থাকা না বলা সব কথা এক মুহূর্তেই যেন বলা হয়ে যেত।
 একদিন বিকেলে সুচন্দা যখন তাদের উঠোনটাতে তার নিজের হাতে লাগানো কিছু ফুলগাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত ঠিক তখনই সেখানে হাজির হয় বিশাখা। বিশাখাকে দেখে সুচন্দার মনের ভিতর একটা ভয় কাজ করতে শুরু করে।সে মনেমনে ভাবে সুমিতকে ভালোলাগার কথা সে তো কাউকে কোনদিন বলেনি।বিশাখা আগে কোনদিন তাদের বাড়িতে আসেনি।তবে হঠাৎ করে আজ এলো কেন?তাছাড়া স্কুলমেস থেকে ওরা তো অনেকটা দূরেই ঘরভাড়া নিয়ে উঠে গেছিল।এইসব ভাবতে ভাবতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।বিশাখা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- কি রে আমি আসতে তুই খুশি হোসনি?এমনভাবে আমার দিকে তুই তাকিয়ে আছিস মনেহচ্ছে জীবনে কোনদিন আমায় দেখিসনি।
 তারপর খুব আস্তে আস্তে বললো," তাও যদি যার মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা তোর থাকতো"!
 বিশাখার পুরো কথাটা সুচন্দা ভালোভাবে শুনতে না পেলেও কিছুটা তার কানে যায়।সে থতমত খেয়ে বলে,
--- কি বললি আমি ঠিক পরিস্কার বুঝতে পারিনি।
--- আমার মুখে শুনে পরিস্কার করে বুঝে আর কি হবে?নিজে যদি কোনদিন বুঝতে পারিস সেদিন বুঝিস।
 সুচন্দার বুঝতে একটুও বাকি থাকলো না ও সুমিতকে নিয়ে যা ভাবছে সুমিতও ঠিক তাইই ভাবছে।আর সে তার ভাবনার কথাটা বোনের সাথে শেয়ার করেছে।সুচন্দা তার বাড়ির এদিকওদিক তাকিয়ে বিশাখার হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়।
--- কি উল্টোপাল্টা বলছিস বলতো ?
--- উল্টোপাল্টা বলছি?ন্যাকা!যেন কিছুই বোঝে না।ওদিকে একজনে দিনরাত তোর কথা ভেবে চলেছে আর এদিকে তুই তার কথা ভেবে চলেছিস।কিন্তু কারোরই সাহসে কুলাচ্ছে না পরস্পরকে কথাটা বলার।অগত্যা আমিই নামলাম পথে।
 কথাগুলো বলেই বিশাখা হাসতে থাকে।কিন্তু সে এসব কথার মধ্যে না ঢুকে তার কাছে জানতে চায়,
--- এই তোরা তো এখন অনেক দূরে বাসা ভাড়া করে চলে গেছিস।কি করে ফিরবি রাত হয়ে গেলে?
--- ঘুরিয়ে দিলি তো কথাটা?ঠিক আছে -- তোর কথারই উত্তর দিই তবে।আমরা ওখান থেকে চলে এসেছি। ও বাড়িতে জলের খুব কষ্ট।এখন আমরা তোদের এই বাড়ি থেকে একটা বাড়ি পরেই ভাড়া এসেছি।তাই ভাবলাম তোর সাথে একটু দেখা করে যাই।ঠিক আমি ভেবেছি কথাটা তা নয় দাদা ই বললো তোর সাথে দেখা করবার কথা।তোকে একটা কথা বলবো চন্দা সত্যি করে উত্তর দিবি?
--- বল কি জানতে চাস 
--- দাদা তোকে ভালোবাসে এটা আমি বুঝতে পারি।কারণ দাদা তোর কথা বলতে,তোর গল্প শুনতে  খুব ভালোবাসে।কিন্তু তুই ও কি সত্যিই দাদাকে ভালবাসিস?
 সুচন্দা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনের মধ্যে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে খুব ধীরে ধীরে তার বন্ধুকে বললো,
--- দেখ শিখু সত্যি কথা বলতে মাত্র কয়েকটা মাস দেরি আছে আমাদের মাধ্যমিকের।এখন এসব নিয়ে ভাবতে গেলে পড়াশুনার কিছুটা হলেও ক্ষতি হবে।তাই এইসব আলোচনা এখন থাক।
--- আচ্ছা আমার কাছে বলতে তোর লজ্জাটা কোথায়? দাদার কথাবার্তা শুনে আমি পরিস্কার বুঝেছি সে তোকে ভালোবাসে।তাহলে তোর দিকটা তাকে তুই জানা।
--- এসব কথা জানানোর জন্য জীবনে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে।এখন আমরা দুজনেই স্টুডেন্ট।পড়াশুনাটা শেষ করি আগে।নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াই তারপর নাহয় এসব আলোচনা করবো।
--- সব ব্যাপারে তুই এত জ্ঞান দিস যে তোকে কিছু বলায় যায় না।যাক গে -- তোরা যা ভালো বুঝিস তাই কর।তবে একটা কথা বলি ছাত্রী হিসাবে তুই যেমন খুব ভালো আমার দাদাও কিন্তু খারাপ নয়। ভবিষ্যৎ এ দাদা কিন্তু ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনেই যাবে।আমি বন্ধু হিসাবে তোকে যেটুকু চিনি আর দাদার বোন হিসাবে তাকে যেটুকু জানি জীবনে কোনকিছুর জন্যই তোরা তোদের লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াবি না।সবকিছুরই একটা সময় আছে।তাই বলছি কি সত্যিই যদি দাদাকে নিয়ে তোর মনের মধ্যে কোন ভাবনা তৈরি হয়ে থাকে সেটা জানিয়ে দিস।
 সেদিন বিশাখার কথাগুলি যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও নিজের লজ্জা সরিয়ে সুচন্দা পারেনি সুমিতকে তার মনের কথাগুলো জানাতে অপরদিকে সহজ সরল সুমিতও পারেনি সুচন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভালোবাসার কথা জানাতে।সুচন্দা  এরপর নিজেকে নানানভাবে তৈরি করে সুমিতকে তার মনের কথাটা জানানোর জন্য বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতে গেছে।কোনদিন সুমিত একা ঘরে রয়েছে জানতে পেরে দরজা দিয়েই বাড়ি চলে এসেছে,আবার কোনদিন বা ঘরে ঢুকে বন্ধুর সাথে গল্পগুজব করেই ঘরে ফিরেছে।আর লাজুক সুমিত সুচন্দাকে দেখেই নিজেই জড়োসড়ো হয়ে যেত।তাই  সাহস করে কোনদিনও তাকে মনের কথাটা বলতে পারেনি।
 মাধ্যমিকের শেষে একদিন বিকেলবেলা সুচন্দা সুমিতদের বাড়িতে যায়।তখন শিখা পরীক্ষা শেষে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।সুচন্দা আজ ঠিক করেই যায় সুমিতকে সে তার মনের কথাটা জানাবে।
 সুচন্দা জানতো বিশাখা তাদের দেশের বাড়িতে গেছে।সে যখন সুমিতদের বাড়িতে আসে তখন দেখে দরজা ভেজানো।সে আস্তে করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে।সামনের ঘরটাতেই সুমিত থাকতো।আর তার পরের ঘরে থাকতো বিশাখা।মাঝে মধ্যে অবশ্য বিশাখার দিদিও এসে এখানে থাকতো।সে এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তাই সেখানকার মেসেই থাকে।সুমিতের বাবা গ্রামের সাধারণ একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক।ন্যায়,নীতি আর আদর্শে তিনি কিন্তু অসাধারণ।প্রতিটা ছাত্রছাত্রী তার কাছে নিজ সন্তান।গ্রামে পড়াশুনার তেমন সুবিধা না থাকায় কারণেই সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশুনার পরেই তিনি অতি কষ্টে হলেও শহরে ঘরভাড়া নিয়ে তার ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার কোনোই কার্পণ্য করেননি।সাধারণ একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হওয়ার ফলে এবং একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ হওয়ার ফলে হয়ত দুবেলা মাছ,ভাত তিনি জোগাড় করতে পারেননি কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি তার বিশাল পরিবারের কোন সদস্যকেই কোনদিন অভুক্তও রাখেননি।
  সুচন্দা ঘরে ঢুকে দেখে সুমিত একমনে তার পড়ার টেবিলে বসে একটা ছবি দেখে কোন আর্ট পেপার নয় নিজের অঙ্কের খাতার উপর কি যেন  একে চলেছে।সুচন্দা যে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছে কিংবা তার টেবিলের অনেকটা কাছেই এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনকিছুই সুমিত টের পায়নি।সামান্য কয়েক হাতের মাত্র ব্যবধান।সুচন্দা একটু কাত হয়ে দেখে সুমিত সুচিত্রা সেনের একটি ছবি দেখে হুবহু তারই মত তার খাতায় পাতায় একটি ছবি আঁকছে।এতদিন ধরে সুচন্দা সুমিত সম্পর্কে যেটুকু শুনেছিল আজ আরও একটি নূতন পালক তাতে সংযোজিত হল।সুমিত একজন ভালো অঙ্কনশিল্পীও বটে!

ক্রমশঃ
 

Monday, January 3, 2022

ঝরাপাতা (পঞ্চম পর্ব)

ঝরাপাতা (পঞ্চম পর্ব)
  সেদিন স্যারের কাছে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেই স্যারের টেবিলে রাখা বোতল থেকে ওই ঠান্ডার মধ্যেই ঢকঢক করে জল খেতে শুরু করে সুচন্দা।তখন সবাই এসে গেছে।দেবাশীষ স্যার পড়ানোও শুরু করে দিয়েছেন।সুচন্দার দিকে তাকিয়ে স্যার বুঝতে পারেন কিছু একটাতে সুচন্দা খুব ভয় পেয়ে গেছে।তিনি সুচন্দার কাছে জানতে চাইলেন,
--- কি হয়েছে তোমার?এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন?আবার তো দেখছি ঠক ঠক করে কাঁপছ?কিছু একটাতে ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে।কি হয়েছে খুলে বলতো?
 সুচন্দারা একসাথে পাঁচজন পড়তো।স্যার সমেত বাকি চারজন ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।সুচন্দা মুহূর্তে ভেবে নিলো কথাটা এদের মধ্যে বলা মানে পুরো স্কুল জেনে যাবে।কারণ সকলেই একই স্কুলে পড়ে। ততক্ষণে সে নিজেকে কিছুটা সামলেও নিতে পেরেছে।বললো,
--- তেমন কিছু না স্যার।দেরি হয়ে গেছে তাই ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপিয়ে গেছি।
বসে পড়ে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে।দেবাশীষ স্যার ওদের অঙ্ক করাতেন।খাতা,বই খুলে অঙ্কে মন দিলেও বুকের ভিতর তখনো তার ঢিপঢিপ করেই চলেছে।মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্কও হয়ে পড়ছে।সুচন্দা যেহেতু পড়াশুনায় খুব ভালো তাই স্কুল বা টিউশন স্যারেরা তাকে খুবই ভালোবাসতেন।সুচন্দার আজকের এই আচরণ স্যারের নজর এড়ায় না। পড়া শেষে সুচন্দা ছাড়া সবাই উঠে দাঁড়ায়।সে বইখাতা গুছাতে গুছাতে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- তোরা এগোতে লাগ আমি স্যারের সাথে একটা কথা বলেই আসছি।
 বন্ধুরা বেরিয়ে গেলে সে স্যারকে বিধানের কথাগুলো বলে।স্যার সব শুনে বললেন,
--- এত ভয়ানক কান্ড!চলো আমি আজ তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসছি।
 সকাল ন'টা তখনো ভালোভাবে কুয়াশা কাটেনি।স্যার একটা  মোটা সোয়েটার আর টুপি পরে সুচন্দাকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা হেঁটে এসে দেখেন সুমিত চায়ের স্টলে বসে আছে।কোলের উপর একটা বইয়ের ব্যাগ।সুমিতকে স্যারও চিনতেন।কারণ সে ও একসময় স্যারের ছাত্র ছিল।স্যার এগিয়ে এসে তার কাছে জানতে চাইলেন,
--- এত সকালে তুমি এখানে বসে?পড়তে গেছিলে?
-- হ্যাঁ স্যার।একটু আগেই বেরিয়ে আসলাম।
--- ঘটনাটা শুনলাম।বিধান এটা ঠিক করেনি।দেখি ওর বাবার সাথে আমি কথা বলবো।আমি সুচন্দাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য বেরিয়ে ছিলাম।তোমাকে পেয়ে ভালোই হল।আমাকে তো আবার স্কুলে বেরোতে হবে তার আগে একটু বাজারে যেতে হবে।তুমি এক কাজ করো ওকে বাড়িতে একটু কষ্ট করে পৌঁছে দাও।
--- আমি ওই জন্যই বসে আছি স্যার।বিধানের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে।ও আর এরূপ করবে না কথা দিয়েছে।ওর বাবাকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে হবে না।ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে স্যার।
--- ও তাহলে ঠিক আছে।আমি তো খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।যাও ওকে বাড়ি অবধি আজ ছেড়ে দিয়ে আসো।আসলে ও খুব ভয় পেয়ে গেছে।
 সুমিত ব্যাগটা পিঠে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।পাশে সুচন্দা চুপচাপ হাঁটতে থাকে।সুমিত হাঁটতে হাঁটতেই সুচন্দাকে বলে,
--- বিধান আর কখনোই তোমায় বিরক্ত করবে না আমি তোমায় কথা দিচ্ছি।কিন্তু তুমি আজকের কথা কাউকে আর বোলো না।তাহলে ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে।
 সুচন্দা কোন উত্তর না দিয়ে হাঁটতে থাকে।তখন সুমিত পুনরায় তাকে বলে,
--- কিছু বলছো না যে ?
--- কি বলবো?আজকের ঘটনাটা এমন কোন প্রসংশাজনক নয় যে কারো কাছে গল্প করতে হবে।এটা আমার জীবনের একটা লজ্জাজনক ঘটনা! এ কথা তো আমি জীবন থাকতে কাউকে জানাতে পারবো না।তুমি বলছো ও আর এরকম করবে না।কিন্তু তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?
--- ও আমায় কথা দিয়েছে।আর আমি ওকে বুঝিয়ে বলাতে ও নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে।যেটুকু মানুষ চিনি তাতে বুঝতে পেরেছি ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা বিধান আর ঘটাবে না।
--- না ঘটালেই ভালো।তুমি স্যারকে বললে তোমার একটা কাজ আছে বলে তুমি কোচিং থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছ।এরপর তো কলেজ আছে তোমার।তুমি বাড়ি ফিরে যাও এটুকু পথ আমি একাই চলে যেতে পারবো।
--- যে কাজের জন্য আমি একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছি সেটাই তো করছি।
--- মানে?
--- তখনই দেখেছিলাম তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছো। পড়া হয়ে গেলে একা বাড়ি ফিরতে তোমার ভয় লাগতেই পারে।তাই তোমাকে সাথে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছি।
 সুচন্দা অবাক হয়ে সুমিতের দিকে তাকায়।সুমিতও তখন তার দিকে তাকিয়ে।এই চার চোখের মিলনে জীবনের প্রথমেই দুটি মানুষের শরীরের মধ্যে এক বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে যায় যা নিজেরা ছাড়া পরস্পরের অন্য কেউ জানতে পারে না।একই সাথে দুজনেই চোখ নামিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।দুজনেই নীরব! কারো মুখে কোন কথা নেই।কিন্তু দুজনেই যেন মনেমনে দুজনকেই অনেককিছু বলে দিচ্ছে নিঃশব্দে, নীরবে।
 কিন্তু অলক্ষ্যে হয়ত বিধাতা পুরুষও নীরবেই হেসেছিলেন।তিনি ক্ষণিকের জন্য হলেও চার চোখের মিলন ঘটিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ভাগ্য লিখেছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত।সেদিন তিনি দুটি কিশোর কিশোরীর মনে ভালোবাসার বীজটা বপন করলেও মিলনটা তাদের জীবনে লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন।কিন্তু যে বীজ তিনি রোপণ করেছিলেন দুটি নিষ্পাপ সরল কিশোর কিশোরীর মনে জীবনে চলার পথটা তাদের আলাদা হলেও তারা দুজনেই অতি যত্ন সহকারে হৃদয়ের কোন এক কোণে চোখের জল আর বিরহ দিয়ে সকলের চোখের আড়ালে তাকে বড় হতে সাহায্য করেছে।
  জীবন নদীর বাঁকে হাঁটতে হাঁটতে দুজনের জীবনেই এসেছে অন্য পুরুষ,অন্য নারী।কারণ এগিয়ে চলার নামই তো জীবন।কিন্তু সেই প্রথম জীবনে প্রথম ভালোলাগা বা প্রথম ভালোবাসার সেই বীজ চারাগাছ থেকে বাড়তে বাড়তে আজ তা পরিপূর্ণ একটি গাছ।কিন্তু সবই দুটি মানুষের দুটি হৃদয়ের সম্পূর্ণভাবে চোখের আড়ালে।
 তাদের মিলন বিধাতা লিখেছিলেন না ঠিকই ;তারা যে যার মত করে নিজেদের জীবন এগিয়ে নিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কখনো সখনো কিছুটা সময় বা কয়েকটা দিনের জন্য ভুলে গেলেও মন থেকে কখনোই মুছে যায়নি।একাএকা,নিস্তব্ধ ঘরে বা কখনো রাতের আঁধারে পাশে শুয়ে থাকা মানুষটি যখন অকাতরে ঘুমাচ্ছে তখনই হৃদয়ে বপন করা ভালোবাসার সেই গাছটি তার ডালপালা নাড়িয়ে জানান দিয়েছে সে আছে সেই আগের মতই নীরব প্রেমের স্বাক্ষী হয়ে।
 হয়ত সুমিত ও চন্দনার এই ভালোবাসার আর একটি প্রেমাখ্যান তৈরি হতেই পারতো ঠিক যেমন তৈরি হয়েছিল লায়লা-মজনু, হীর-রঞ্জা,শীরি-ফরহাদের ক্ষেত্রে।কিন্তু লায়লা মজনু, হীর রঞ্জা বা শিরী ফরহাদের প্রেম কাহিনী লোকে জানতো।জানতো না তারা সুমিত সুচন্দার ভালোবাসার কথা।ভালোবাসাটা ছিল শুধু হৃদয়ের মিলন কোনোকিছুর প্রত্যাশা কেউ কারো কাছ থেকে কখনোই করেনি।শুধু নিঃশব্দে যখন তারা কাছে ছিল তখন আবার যখন তারা দূরে ছিলো তখনো শুধু ভালোই বেসে গেছে।কিন্তু এ কেমন ভালোবাসা?যে ভালোবাসা শুধু ভালোবাসাতেই খুশি কোন কিছুর প্রত্যাশা কোনদিন করেনি।

ক্রমশঃ 

Sunday, January 2, 2022

ঝরাপাতা(চতুর্থ পর্ব)

ঝরাপাতা (চতুর্থ পর্ব)
  এর বেশ কয়েক বছর পর নবীন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে চাকরি পেয়ে চিরপরিচিত গণ্ডি ছেড়ে বহু দূরে চলে গেছে।বাড়ির লোক পছন্দ করে নবীনের বিয়ে দিয়েছে।কিন্তু সবই ঘটেছে সুচন্দাদের বাড়ির কাছ থেকে ভাড়া উঠে যাবার পর।ফোনের এত রমরমা যেহেতু ছিলনা তাই আস্তে আস্তে মঞ্জুর সাথেও তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
  আসলে মানুষ তার চলার পথে প্রতি মুহূর্তে নিত্য-নূতন ঘটনার সম্মুখীন হয়।এইসব ছোটখাটো ঘটনা আস্তে আস্তে তার জীবন থেকে মুছেও যায়।আবার কিছু কিছু ঘটনা তার জীবনে এমনভাবে জাকিয়ে বসে শত চেষ্টা করেও সে সেইসব ঘটনা মুছে ফেলতে পারে না।
  সুচন্দার মাধ্যমিক পরীক্ষার বছর তিনেক আগে ক্লাস এইটে এসে ভর্তি হল গ্রামের সহজ সরল একটি ছেলে নামটি তার সুমিত।কোনদিকে না তাকিয়ে দেখা শুধু বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকা মেয়েটিও এই সুমিত সম্পর্কে যেন একটু বেশিই কৌতূহলী হয়ে উঠলো।কারণ অন্যকিছু নয়।সুমিত স্কুলে ভর্তি হয়েই এলাম,দেখলাম জয় করার মত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট দিয়ে প্রত্যেক শিক্ষক,শিক্ষিকার মন জয় করে নিলো।সকলের মুখে মুখেই তখন সুমিতের নাম।
 সুমিতকে সুচন্দা তার এক বন্ধুর সহয়তায় একদিন স্কুল গ্রাউন্ডের মধ্যেই বড় মাঠে টিফিন আওয়ারে ফুটবল খেলতে দেখে।রোগা ছিপছিপে,গায়ের রংটা খুবই কালো।মাথা ভর্তি ছিল চুল, বেশ লম্বা।পরবর্তীতে যখন তাকে খুব কাছ থেকে সুচন্দা দেখে তখন সুমিতের চোখদুটো তার কাছে বড় বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।চেহারায় সুমিতের তেমন জৌলুস না থাকলেও তার চোখদুটি যেন কথা বলে।সুচন্দার দিকে তাকানো দেখেই সে বুঝতে পারে যেকথা সুমিত মুখে বলতে পারছে না তার চোখদুটি সেকথা বলে দিচ্ছে।কিন্তু সে তো অনেক পরে।
 সুমিত ছিলো সুচন্দার তিন বছরের সিনিয়র।সুচন্দা এবং সুমিত দুজনেই পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল।অনেক পরে সুচন্দা জেনেছিল সুমিত এবং তার একবোন ও এক দিদি স্কুলের মেসেই থাকতো।সুমিতের এই বোনটি ছিল সুচন্দার ক্লাসমেট।খুব ভালো বন্ধুত্ব না থাকলেও ক্লাসমেট হিসাবে বিশাখা ও সুচন্দার মধ্যে একটা সুসম্পর্ক ছিল।সুমিত খুব ভালো গান করতো ,একজন ভালো আবৃত্তিকারও ছিল।কিন্তু একই স্কুলে পড়ার পরেও সুচন্দা কিন্তু সুমিত সম্পর্কে কিছুই জানতো না বরং বলা ভালো কোন ছেলে সম্পর্কে কিছু জানার কোন আগ্রহই কোনদিন সুচন্দার ছিলনা।
  সুচন্দার স্কুলে যাতায়াত ছিলো পায়ে হেঁটে।এই যাতায়াতের পথে বিধান নামে একটি ছেলে সুন্দরী সুচন্দার ভীষণ পিছনে লাগতো।বহুবার সুচন্দা তাকে নিষেধ করেছে।স্কুলে হেডমাস্টারকে বলে দেবে ভয় দেখিয়েছে।কিন্তু বিধান দমেনি।সে তার স্কুল এবং পড়তে যাওয়ার সময় হয় পায়ে হেঁটে নতুবা সাইকেল নিয়ে নানান ধরনের কটূক্তি করতে করতে পিছন পিছন যেত। এইরূপই একদিন খুব ভোরে সুচন্দা স্কুলে যাওয়ার আগে স্যারের বাড়িতে পড়তে যাওয়ার সময় দেখে বিধান আগে থাকতেই রাস্তার মোড়ে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শীতের সকাল।সেদিন জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে।সঙ্গে উত্তুরে বাতাস।সুচন্দার ঠান্ডাটা একটু কমই বোধ হয় সব সময়। গরমকালেই ওর যত কষ্ট।খুব সাধারণ একটা পাতলা গায়ের চাদর তখন তার গায়ে।সে অতি দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে বিধানকে ফেলে এগিয়ে যায়।কারণ শীতের অত সকালে রাস্তাঘাট ছিল বেশ শুনশান।এমনিতে সুচন্দা খুব ডাকাবুকো মেয়ে।কিন্তু সেদিন কেন জানিনা তার একটু ভয় ভয় করতে থাকে।সুচন্দা অনেকটা এগিয়ে গেছে দেখতে পেয়ে বিধান সাইকেল চালিয়ে দ্রুত গতিতে তার সামনে গিয়ে সাইকেল দাঁড় করায়।
--- তোমার সাথে কিছু কথা আছে
--- কিন্তু আমি তো তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাই না
--- আজকে তোমায় কথাগুলি শুনতেই হবে
--- জবরদস্তি নাকি?পথ ছাড়ো আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
--- এমনিতে যদি আমার কথা না শোনো তাহলে কিন্তু জোর করতে বাধ্য হবো
--- জোর করবে মানে?কি করবে তুমি?তোমার যা খুশী তাই করতে পারো আমার কিচ্ছু যায় আসে না
 বিধান সাইকেলটা একটা লাইটপোষ্টে দাঁড় করাতে গেলে সুচন্দা প্রায় দৌড়েই অনেকটা পথ এগিয়ে যায়।কুয়াশার ভিতর হলেও দেখতে পায় কেউ একজন তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।বুকে একটু হলেও সাহস পায়।এদিকে বিধান সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গিয়ে সুচন্দার একটা হাত ধরে নিজের দিকে টান দেয়।মুহূর্তে সুচন্দা খুব জোড়ে বিধানের মুখে এক চর কষিয়ে দেয়।আর ঠিক তৎক্ষণাৎ বিধান ওর গায়ের চাদরটা ধরে একটানে খুলে নিচুতে ফেলে দেয়।আর আচমকা কুয়াশার ভিতর থেকে আসা মানুষটি তাদের সম্মুখে চলে আসে।সেই মানুষটি আর আর কেউ নয় কলেজে প্রথম বর্ষে পড়া সুমিত দাস।বিধান এবং সুমিত একই স্কুলে পড়ার কারণে তারা একে অপরকে চিনতো।সুমিত বিধানের কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়
--- কি করছিস এসব?মেয়েদের সম্মান দিতে জানিস না?আমার খুব খারাপ লাগছে যে তোকে আমি চিনি।অনেক সময় আমরা একসাথে স্কুলমাঠে ফুটবল খেলেছি।
 এদিকে সুচন্দা ততক্ষনে নীচু থেকে চাদরটা তুলে নিয়ে দ্রুত স্যারের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
সুমিতের কথা শুনে বিধান তাকে বলে,
--- তুই জানিস না মেয়েটার খুব দেমাক।কতদিন ধরে ওকে বলছি আমার কথাটা শুনার জন্য কিছুতেই পাত্তা দেয় না।তাই আজ আর সহ্য করতে না পেরে ---
--- তাই বলে ওকে রাস্তার মধ্যে তুই এভাবে অসম্মান করবি?কি কথা বলতে চাস ওকে তুই ?
--- আমি ওকে ভালবাসি
 সুমিত হো হো করে হাসতে হাসতে বললো,
--- কক্ষনো না -- তুই ওকে ভালোবাসতেই পারিস না
--- তার মানে?
--- ওরে গাধা তুই যদি ওকে সত্যিই ভালবাসতিস তাহলে ওকে এভাবে অপমান করতে পারতিস না।ওর চেহারার প্রতি তোর একটা মোহ জন্মেছে।তাকে ভালোবাসা বলে না।ভালোবাসলে কেউ কাউকে এইভাবে রাস্তার মধ্যে অপমান করতে পারে না।
 বিধান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেও পড়ে বলে ওঠে,
--- হতে পারে তুই সঠিক বলছিস।কিন্তু আমিও ওকে ছাড়বো না,ওর দেমাক আমি ভাঙ্গবোই।
--- কিন্তু সেটা তো আমি হতে দেবো না
--- ওর প্রতি তোর এত দরদ কেন?
--- এটা শুধু সুচন্দা বলেই নয়;যেকোন মেয়ে হলেই আমি এটা বলতাম আর তার সম্মান বাঁচানোর জন্য যতদূর যাওয়ার যেতাম।এভাবে মেয়েদের অসম্মান করিস না।ওর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ সামনে।সবকিছু নষ্ট করে দিস না।তোরও তো একটা বোন আছে ছোট।কেউ যদি তোর বোনের সাথে রাস্তাঘাটে এরূপ আচরণ করে তুই কি তাকে ছেড়ে কথা বলবি?আগে নিজের পায়ে ভালোভাবে দাঁড়া।এরকম অনেক সুন্দরী মেয়ে তখন আশেপাশে ঘুরঘুর করবে।আমি তোকে অনুরোধ করছি তুই সুচন্দাকে আর বিরক্ত করিস না।ও খুব ভয় পেয়ে গেছে।তাছাড়া তুই বুঝতে পারছিস আজকের এই ঘটনার কথা জানাজানি হলে তোর বাবা মায়ের কতটা সম্মানহানি হবে।ওর বাবা একজন সমাজ সেবক।সবাই তাকে চেনে-জানে।হয়ত তোর বাবার সাথেও তার পরিচয় আছে।সুচন্দার বাবা এসে যখন তোর বাবাকে কথাগুলো জানাবেন তখন তো তার মুখ লুকানোর কোন জায়গা থাকবে না।সন্তান হয়ে তুই কিছুতেই এটা করতে পারিস না।
 এরপর বিধান আর কোন তর্কে না গিয়ে বললো,
--- চল সামনের দোকান থেকে দুজনে চা খাই।আমি আর ওকে বিরক্ত করবোনা তোকে কথা দিলাম।তোর সাথে যদি ওর কথা থাকে তাহলে তুইও ওকে বলে দিস ও যেন একথা পাঁচকান না করে।চল আজকের চা টা আমিই খাওয়াবো তোকে।সত্যিই একটা বড় অপরাধ করার হাত থেকে তুই আমায় বাঁচিয়ে দিলি।

ক্রমশঃ