# প্রথম_লেখা_উপন্যাস
লন্ডন পাতালরেল এলগেট ইস্ট স্টেশনে নেমে কিছু পা হ্যাটেস্ট লন্ডন বাংলা টু ব্রিটেন | এখানে মূল বাঙালিদের | বিপণি, পুত্র সবই বাঙালির বাঙ্গালীর | আজ অবধি লম্বা জমিতে বছর আগে ছিলেন অবশ্যই চাকরির সুবাদে | সন্ধ্যা দেশোকা শহরে ফিরে এসেছিল মা, বারবার কথা ভাবা | গতকাল তিনি চলে এসেছেন এবং বারবার তার মায়ের সমস্যাগুলি পরে পারলৌকিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে পুনরায় কর্মস্থল ফিরে আসেন | তার সময়কালীন একটি অনুষ্ঠানের সময় মাসুলুল তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আজও পুরাতন | চোখ বুজ়িশে সেদিনের পরিস্থিতি সেন্সর ফ্লাসব্যাকারের মতো তার চোখের সাক্ষাতকারীর দেখা পান |
ব্রিক অসেরাক্টির নামমোহনোত্তর ডিনার সার্ট লন্ডন ব্রিজিলিয়ান ডোন্টর অতীশ রায়চর | তার সমুদ্র টেবিলে প্রায় সমবেত বা অনুষ্ঠানের সাথে সংক্ষিপ্ত বিবরণ হ'ল আর একজন মানুষের মনোযোগযোগ সহকারীর খালি সময় | কি ডক্টর রায় বোর্ডের ডাকওয়ালা ছেলের ছবি | পরমুহূর্তের স্মৃতিতে একজন মানুষ দেখেন আর কারও মতো দেখতে পান হতে তিনি খাওয়া ঘটনা যেতে যান |
--- স্মরণে খাস বাঙ্গাল | কি ঠিক আছে?
তরুনিতো খাওয়া শেষ | সেহাতাটা ডক্টর রায় স্টোরুরীর সময় -
--- আমি প্রুধু মুখদারী | ইন্ডিয়া থেকে আগত | তবে এখানে নেই কোনও দিন | কাজকাল আবারও ফিরে এসেছে |
--- আমি অতীশ রায় চৌধুরী | পেশা ডাক্তারী | জম্ম ইন্ডিয়াতে হলেও কর্ম এখানে | কাছেই বাড়ি | কোন অসুবিধা না থাকলে আমার বাড়িতে যেতে পারেন | মামা খুব খুশি হবেন | মামা আর ভাগ্নের সংসার | আর সত্যি কথা বলতে কি জানেন আপনার চেহারার সাথে আমার মামার চেহারার একটি অদ্ভুত মিল আছে | পৃথিবীতে একজন মানুষের সাথে আর একজন মানুষের যে এতোটা মিল থাকতে পারে তা আপনাকে না দেখলে বিশ্বাসই হতনা | বিশেষ করে এই কারণেই অযাচিতভাবে আপনার সাথে আলাপ করতে আসা |
--- আপনার সাথে যখন পরিচয় হল নিশ্চয়ই যাবো আপনারদের বাড়িতে | কিন্তু আজ নয় | এখনো দিন সাতেক আছি আমি এদেশে | চলে যাওয়ার আগে
নিশ্চয়ই একবার যাবো |
কয়েক যুগ আগের কথা | অতুল রায় চৌধুরী কলেজের প্রতিটা মেয়ের হার্টথ্রব | বড়লোকের একমাত্র ছেলে | সুদর্শন , স্মার্ট | কলেজে এমন মেয়ে সেসময় খুঁজলে হয়তো পাওয়ায় যেতোনা যে অতুলকে স্বামী হিসাবে কল্পনা করেনি | কিন্তু অতুল ছিল একটু অন্য প্রকৃতির | গম্ভীর একটু লাজুক - সহজে কারও সাথে মিশতে পারতোনা কিন্তু একবার মিশে গেলে সে সেই মানুষটির জন্য জীবনও দিয়ে দিতে পারতো |জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল তার পড়াশুনা আর মানুষের উপকার করা | কেউ বিপদে পড়লে সে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করতোনা |হাসি ঠাট্টা , গল্পগুজবে মেতে উঠলেও তার একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকতো | কোথায় কখন থামতে হবে অতুল সেটা ভালোভাবেই জানতো |
অতুলের মায়ের খুড়তুত বোনের মেয়ে অয়নিকা ছিলো অতুলের সমবয়সী | সম্পর্কে তারা ভাই বোন | কালেভদ্রে যদিও দেখা হত কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত বন্ডিং ছিল | একসাথে সময় কাটাতে তারা দুজনেই খুব ভালোবাসতো | লতায় পাতায় ছিল রক্তের সম্পর্ক | দুজনেই মিশতো তারা খোলামনে | একসাথে সময় কাটানোর ভালোলাগা থেকে দুটি তরুণ তরুণী কখন যে একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছিলো তা বোধকরি দুজনের কেউই সেদিন টের পেয়েছিলোনা | কিন্তু তারা পরস্পরের প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসার যে চুম্বকীয় আকর্ষণ অনুভব করতো তা কেউই কোনদিন কাউকেই বলেনি কারণ তাদের রক্তের সম্পর্কের সংস্কার | আর তাদের এই মেলামেশাকে কেউ কোনদিনও কোন খারাপ নজরে দেখেননি তার কারণও ছিল ওই রক্তের সম্পর্ক | সম্পর্কে তারা ভাই , বোন হলেও দুজন দুজনকেই নাম ধরে ডেকেছে সবসময় |
পারিবারিক পূজায় অয়নিকা তার মায়ের সাথে অতুলদের বাড়ি আসে | পুজোর পরদিন অয়নিকা অতুলের কাছে আব্দার করে ভিক্টোরিয়া দেখতে যাওয়ার জন্য | অয়নিকা বাড়ির সকলের সামনেই এ কথা অতুলকে বলে | অতুলের মা একথা শুনে তাকে বলেন ,
--- যা না -- তোর তো কলেজ ছুটি আছে |
দুজনে বেরিয়ে যায় ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে | সারাটাদিন কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় কেউই টের পায়না | আসবার সময় অতুলের মা কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন অতুলের হাতে | তাই দিয়ে তারা ফুসকা, এগরোল , বাদামভাজা খায় | অয়নিকা চীনাবাদাম খুব ভালো খায় | দুজনে একটা গাছের ছায়ায় বসে যখন বাদাম ভাজা খাচ্ছে ঠিক তাদের একটু দূরে আর একটা গাছের তলায় বসে দুজন তরুণ তরুণী একে অপরকে চুমু খাচ্ছে | অয়নিকা দেখতে পেয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে ,
--- দেখ অতুল ওদের কান্ড দেখ --
--- আরে এখানে কেউ কারও কান্ড দেখেনা | তুই যদি অভয় দিস আমিও এ কান্ডটা করতে পারি |
হঠাৎ করে অতুলের মুখে একথা শুনে অয়নিকার মুখে কোন কথা আসেনা | এতদিন অতুলের কোন কথা বা আলতো ছোঁয়ায় অয়নিকার কিছুই মনে হয়নি | কিন্তু আজ অতুলের মুখে একথা শোনার পর তার বুকের ভিতর উথালপাথাল করতে লাগলো আর সে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো | অতুল অয়নিকার আরও কাছে এগিয়ে আসলো | খুব আস্তে তার মুখটা তুলে নিজের মুখের কাছে নিয়ে ঠোঁটটার উপর নিজের ঠোঁটটা রাখলো | না , অয়নিকা কোনই বাধা দিতে পারলোনা | বা বলা ভালো কোন বাধা সে দিলোনা | সে চোখ বন্ধ করে জীবনের প্রথম পরশের অনুভূতিকে দুরুদুরু বুক নিয়ে উপলব্ধি করতে লাগলো | তার সমস্ত শরীরের ভিতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা সে টের পাচ্ছে | আস্তে আস্তে দুইহাত দিয়ে সে অতুলকে আরও কাছে টেনে নেয় | অতুল ততক্ষণে নিজের মুখের মধ্যে অয়নিকার ঠোঁট ----- কিছু পরে অতুল বলে ,
--- আমাকে ফেরৎ দিবিনা ?
সঙ্গে সঙ্গে অয়নিকা অতুলের ঠোঁটদুটি কামড়ে দেয় | অতুল 'আহ' - বলে ছোট একটা ছোট্ট আত্মনাদ করে ওঠে | অয়নিকা হেসে দিয়ে উঠে দৌড়ে পালিয়ে যায় |
বাড়ি ফেরার সময় বাস থেকে নেমে ওরা একটা রিক্সা নিয়ে নেয় | কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই বিকালের ঘটনার পর দুজনেই নিশ্চুপ | যারা সামনাসামনি হলেই কথার ফোয়ারা ছোটায় তারা হঠাৎ করেই যেন চুপসে গেছে | রিক্সা যখন বাড়ির পথে অতুল অয়নিকার দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ থেকে জল পড়ছে |
--- কিরে তুই কাঁদছিস কেন ?
--- এটা ঠিক হলনারে অতুল --
--- জানি কারণ ওই রক্তের সম্পর্ক | কিন্তু এটাও বিশ্বাস করি ভালোবাসায় কোন পাপ নেয় | যেকোন সময় যে কেউ যাকে খুশি ভালোবাসতে পারে | ভালোবাসা কোন সম্পর্ক, ধর্ম ,বয়স , ধনী ,দরিদ্র , মানেনা | আমরা দুজনের কেউই বুঝতে পারিনি কখন একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি | আজ এই ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো বুঝতেই পারতামনা | অয়নিকার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অতুল ওকে আস্বত্ব করে তুই যদি আমায় পেতে চাস আজ আমায় কথা দে আমার চাকরি পাওয়া পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করবি |
-- পাগলের মত কথা বলিসনা অতুল | তোর আমার এ সম্পর্ক পরিবারের কেউ কোনদিন মেনে নেবেনা |
--- আরে মেনে নেবে নাতো আমিও জানি | আমি দূরে কোথাও চাকরি নেবো | তুই আমি সেখানে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো |
--- যত সহজে তুই কথাগুলো বলছিস ব্যাপারটা তত সহজ নয় রে | পাড়াপ্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন সকলেই আজীবন ছিছি করবে | আমাদের জীবনের উপর অভিশাপ নেমে আসবে | তোর আমার সকল আত্মীয়স্বজন এক | আজীবন তাদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে |
--- তাহলে তুই কি চাস ?
--- আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা | তোর সাথে সময় কাটাতে কথা বলতে ভালোবাসতাম কিন্তু বুঝতেই পারিনি তোকে কখন এতটা ভালোবেসে ফেলেছি | তোকে ছাড়া বাঁচাটা আমার জীবনে যেমন অর্থহীন মনেহচ্ছে আবার সকলের কাছ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়াটাও কিছুতেই মন সায় দিচ্ছেনা | দুটো পরিবারের কাছে আমাদের এই মেলামেশাটা কোনদিন কেউ খারাপ ভাবে নেয়নি | অথচ দেখ আমি তুই কেউই তার মর্যাদা রাখতে পারলামনা | নিজেদের কাছে নিজেরাই ছোট হলাম |
--- কেন এতো ব্যাখ্যা করছিস বলতো ? যা হবার ছিল তাই হয়েছে | আমি তুই কেউই তো এর জন্য প্রস্তুত ছিলামনা | কারও মনের মধ্যে এরূপ কোন কল্পনাও ছিলোনা | আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী জানিস | আমি মনেকরি তিনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে | বিধাতার লিখন কিছুতেই খণ্ডন করা যায়না | খামোখা এসব নিয়ে এখন থেকে ভেবে মন খারাপ করিসনা | যা হবার হবে |
পরদিন অয়নিকা আর তার মা নিজেদের বাড়ি চলে গেলো | অতুলই তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসলো | মামুলি যা কথা হল মাসির সামনেই | কিন্তু দুজনেই একটু নির্জনতা চাইছিলো | অনেক কথা দুজনের মনের মধ্যে ভিড় জমাচ্ছিল | কিন্তু সে সুযোগ থেকে দুজনেই বঞ্চিত হয় | গাড়ি ছেড়ে দিলে অয়নিকা জানলা দিয়ে যতক্ষণ অতুলকে দেখা যায় সে তাকিয়েই থাকে | দুজনের চোখগুলিই জলে ভর্তি কিন্তু ট্রেনের দ্রুততায় কেউই কারও চোখের জল দেখতে পেলোনা | পরস্পরের বুকের ভিতর এক অসীম শূন্যতা আলাদা আলাদা ভাবে দুজনেই টের পেলো কিন্তু সেই শূন্যতা পূরণ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ তারা পেলোনা |
সে সময়ে ফোনের রমরমা এতো ছিলোনা | একমাত্র ভরসা ছিল চিঠি | আজকের দিনে একজায়গা থেকে অন্য জায়গা পৌঁছে মুহূর্তেই 'পৌঁছে গেছি ' - বলে এক ফোনেই সকল চিন্তা মানুষের দূর হয়ে যায় | আর তখনকার দিনে দেশের মধ্যেই কম করে পাঁচ থেকে সাতটা দিন পৌছো সংবাদ পাওয়ার জন্য দুশ্চিন্তা নিয়ে ধর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হত | অতুলরা কলকাতা থাকলেও অয়নিকারা থাকতো শিলিগুড়ি | পাঁচদিন পর তাদের পৌছো সংবাদ আসে | অয়নিকা তার মাসিকে লিখে তাদের পৌছো সংবাদ দেয় | ' বাড়ির সবাই কেমন আছে --' কথাটা থাকলেও আলাদা করে অতুলের নাম সে কোথাও লেখেনি | প্রথম দিকে অতুলের একটু অভিমান হলেও পরে সে নিজেই বুঝতে পারে অয়নিকা যেটা করেছে সে ঠিকই করেছে | চিঠিটা তো বাড়ির সকলের হাতেই যাবে | যদি এখনই সবাই সবকিছু জেনে যায় তাহলে দুটো পরিবারের মধ্যে তুমুল এক ঝড় উঠবে | একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে তখন নাহয় সম্পর্কটা নিয়ে সকলকে কিছু বলা যাবে | নিজেরও ইচ্ছা করে অয়নিকাকে চিঠি লিখতে কিন্তু সেই তো একই অসুবিধা | বাড়িতে চিঠি গেলে তো মাসি আগে খুলে পড়বে | নিজের ইচ্ছাকে ভবিৎষতের কথা ভেবে দমন করে |
দিন, মাস , বছর গড়িয়ে যায় | মাঝে মাঝে চিঠির যে আদানপ্রদান হয় সেটা মা আর মাসির মধ্যেই | অয়নিকার গ্রাজুয়েশন পরীক্ষা শেষ হয় | দুবছর আগেই অতুল গ্রাজুয়েট হয় | দিনরাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে আর ক্লাবঘরে কেরাম আর তাস খেলেই সময় কাটিয়ে দেয় | আর যখনই একা থাকে নানান চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় | কি পড়া যায় কি করা যায় বন্ধুদের সাথে এসব বিষয়েও আলোচনাও হয় | আমাদের এই গরিব দেশে বেকার সমস্যা একটা দুরারোগ্য ব্যাধি | আজকের দিনে রোজগারের জন্য যেমন অনেক রাস্তা খোলা রয়েছে তখনকার দিনে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারলেই সকলেই একটা চাকরির চেষ্টা করে যেত | প্রথম দিকে সরকারি চাকরি , হতাশ হয়ে গিয়ে শেষে যেকোন একটি চাকরি | অতুলের বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মী | ছেলের ভবিৎষত নিয়ে সব বাবা মায়ের মত তিনিও ছিলেন ভীষণ চিন্তিত | তিনি তার এক সহকর্মীর পরামর্শ নিয়ে অতুলকে কম্পিউটার ট্রেনিং নিতে বললেন |
অতুল কম্পিউটারের একটি কোর্স করার জন্য চলে যায় পাটনায় | কলকাতা থেকে আরও দুজন বন্ধু তার সাথে যায় | তিনজনে মিলে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে একটা ঘরে থাকা ও খাওয়া | পালাক্রমে তিনবন্ধু রান্না করে | বাড়িওয়ালা তার স্ত্রী , পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে উপরে থাকেন | কিন্তু তিনবন্ধুর গোল বাঁধে ভদ্রলোকের মেয়েটিকে নিয়ে | অয়ন , তুষার আর অতুল | যদি দুজন ঘরে না থাকে বাড়িয়ালার মেয়েটি গল্প করতে উপর থেকে অতুলদের রুমে নেমে আসে | যে ঘরে থাকে সে বাধ্য হয় দরজা খুলে দিতে | কিন্তু মেয়েটির ভাবগতিক কারোই ভালো লাগেনা | একদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার | ঘরের ভিতর একটিমাত্র জানলা আর সেই জানলা দিয়ে অতুল বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার মনপ্রাণ জুড়ে সেই মুহূর্তে ছিল অয়নিকা | তুষার ও অয়ন তখন ঘরে ছিলোনা | অয়নিকার আর তার একসাথে কাটানো সময়গুলো অতুলের এই একাকীত্বটাকে সব সময় সঙ্গ দেয় | অধিকাংশ সময় অতুল চোখ বুজে তার মানসিকে যেন স্পর্শও করতে পারে | অনেক সময় নিজের অজান্তেই চোখ থেকে অবিরাম জল পড়তে থাকে | অনেকক্ষণ জানলায় দাঁড়িয়ে থাকার পর একসময় সেখান থেকে সরে এসে অতুল স্টোভে রান্না চাপায় | আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়িয়ালীর মেয়েটি এসে নক করে | খুলবেনা খুলবেনা করে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে নেয় অতুল | কিন্তু লাগাতার দরজায় কড়া নাড়িয়েই যায় সে | অগত্যা দরজা খুলতে অতুল বাধ্য হয় | দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি অতুলকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে | সদ্য যুবক হয়ে ওঠা অতুল তার বুকের উপর নরম কিছুর স্পর্শ পেয়ে ক্ষণিকের তরে থমকে যায় | কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে তার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলে ,
-- সবকথা তোমার বাবাকে জানিয়ে দেবো |
--- মেয়েটি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ,
--- কলকাতার ছেলে তুমি | এতো আনস্মার্ট আমি জানতামনা | জীবনটা কদিনের মাত্র | যে কটাদিন বাঁচবো ফুর্তি করেই বাঁচবো | আর তা ছাড়া আমি সারামাস আমার প্রটেকশন নিয়েই থাকি | কেউ বাড়ি নেই | তোমার বন্ধুরাও বাইরে | এসো আমরা কিছুটা সময় হারিয়ে যাই |
অতুল তখন দরদর করে ঘামছে | ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে | এ কি ধরণের মেয়ে ? সে মুহূর্তের মাঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই মুহূর্তে তাকে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে | তানাহলে সে কেস খেয়ে যাবে |হঠাৎ করেই সে মেয়েটিকে এক ধাক্কা মেরে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় | মেয়েটি টাল সামলাতে না পেরে খাটের উপর পরে যায় | অতুল এসে রাস্তায় বসে অয়ন ও তুষারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে | কিছুক্ষণ বাদে তারা যখন আসে অতুল তাদের সব খুলে বলে | খুব হাসাহাসি করতে থাকে অয়ন ও তুষার |
--- গাধা একটা | এতো বড় একটা সুযোগ পেয়েও কাজে খাটাতে পারলি না ? এই সুযোগটা যদি আমি পেতাম ---- তুষার বলে উঠলো |
--- আসলে মেয়েটি সুন্দরের পূজারী | অতুলের চেহারা দেখেই ও ভুলে গেছে |
কথাগুলি অয়ন বলে উঠলো |
--- তোরা এসব ছাড় | কালই বাড়ি পাল্টাতে হবে | আমি ওখানে থাকবোনা | ওখানে থাকাটা আমাদের পক্ষে বিপদজনক হয়ে উঠবে --- আরে আমি তো রান্না চাপিয়েছিলাম | এতক্ষণে তা পুড়ে গেছে | চল সবাই মিলে ঘরে যাই |
বলা বাহুল্য সেদিন অতুলের স্টোভে চাপানো পোড়া ভাত কেউই খেতে পারেনি | দিন চারেকের মধ্যে তারা একটি মেসে উঠে যায় | কিন্তু এই চারদিন কেউই ওই ঘরে একা থাকেনি | প্রয়োজনে তিনজনে একসাথে বেরিয়েছে আবার তিনজনে একসাথেই ফিরেছে | দেখতে দেখতে তাদের তিন বছরের কোর্স শেষ হয়ে গেলো | অয়ন ওখানেই একটি চাকরি পেয়ে পাটনাতেই থেকে গেলো | কারণ তিনজনের মধ্যে অয়নের রেজাল্ট ছিল ভালো তাই ওই ইনস্টিটিউশন থেকেই সে একটি চাকরির সুযোগ পেয়ে যায় | তুষার ও অতুল দুজনে কলকাতা ফিরে আসে | কিন্তু চাকরির মন্দা বাজারে দুজনেই ইন্টারভিউ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পরে | শেষে দুজনেই শুরু করে টিউশনি করা | আর এই টিউশনি করতে গিয়েই অতুলের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে যায় |
একদিন সাইকেল করে বাড়ির প্রয়োজনীয় কোন একটি কাজ সেরে সে ফিরছিলো | হঠাৎ তার সাইকেলের সামনে সুন্দর ফুটফুটে বছর পাঁচেকের একটি মেয়ে এসে পরে | মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে হঠাৎ ব্রেক কষে অতুল নিজেই সাইকেল নিয়ে পড়ে যায় | সামনেই ছিল বাচ্চা মেয়েটির বাড়ি | অতুলের পায়ে সামান্য চোট লাগে | মেয়েটির মা বেরিয়ে এসে অতুলকে তার বাড়িতে নিয়ে যায় | মেয়েটি তার মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে অতুলের মন জয় করে নেয় |
-- তোমার নাম কি সোনা ?
--- লিজা | তোমার নাম ?
--- আমি দাদা | দাদাদের নাম বলতে নেই |
পরিবারটার সাথে অতুলের খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় | সে লিজার মায়ের কথানুসারে তাকে পড়াতে শুরু করে | কিন্তু মাস হয়ে যাওয়ার পরেও তারা অতুলকে কোন মাইনে দেয়না | মুখচোরা অতুলও তাদের কাছে টাকার কথা বলেনা | একদিন অতুল যখন পড়াতে লিজাদের বাড়িতে ঢুকছে তখন শোনে লিজার বাবা ও মায়ের মধ্যে তুমুল অশান্তি |
--- পনেরদিন আগে অতুলের পড়ানো একমাস হয়ে গেছে | সে নাহয় টাকার কথা কিছু বলেনা কিন্তু তুমি কেন তার টাকাটা দিচ্ছনা ?
খুব রেগে গিয়ে লিজার বাবা বললেন ,
--- যাদের পেটে দুবেলা খাবার জোটেনা তাদের মাষ্টার দিয়ে পড়ানো বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয় | আমি বহুবার বলেছি লিজার মাষ্টার ছাড়িয়ে দাও | আমার পক্ষে অতুলকে মাইনে দেওয়া সম্ভব নয় | সামান্য একটা মুদিখানার দোকানে কাজ করে কটা টাকাই বা মাইনে পাই | নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারে গৃহশিক্ষকের বেতন দেওয়া সম্ভব নয় | নিজে তো ঘরেই থাকো বাংলা পড়তে লিখতে তো জানো | অতুলকে ছাড়িয়ে দিয়ে নিজে পড়ানো ধরো |
বাইরে দাঁড়িয়ে অতুল সব শোনে | চুপচাপ সে সেদিন না পড়িয়ে চলে যায় | সত্যি বলতে অতুল তার সময় কাটানোর জন্যই কিছু টিউশনি করতো অর্থের জন্য নয় | পরদিন লিজার জন্য একটা হরলিক্স কিনে নিয়ে সে তার পড়ানোর সময় ধরেই আবার পড়াতে আসে | লিজার মায়ের হাতে হরলিক্সটা দিয়ে বলে ,
--- ওকে সকালে ও সন্ধ্যায় একগ্লাস করে হরলিক্স দেবেন |
--- আমরা তো তোমার মাইনেটাই দিতে পারিনা অতুল তারমধ্যে তুমি আবার ওর জন্য হরলিক্স কিনে নিয়ে আসলে |
--- ভাববেননা কাকিমা | লিজাকে আমি নিজের বোনের মত ভালোবাসি | আমাকে কোন মাইনে দিতে হবেনা | ওর সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম |
পরিবারটির প্রতি দায়িত্ব পালন করা সেই শুরু | শুধু লিজার দায়িত্বই নয় আস্তে আস্তে কাকু , কাকিমার দায়িত্বটাও সে যেন কাঁধে তুলে নিলো | কোনদিন কিছু তরকারি কিনে নিয়ে আসে তো কোনদিন মাছ বা মাংস | একটি যুবক ছেলে হঠাৎ করেই উপযাজক হয়ে আর একটি পরিবারের জন্য কিছু করছে পাড়ার লোকেরা এটা কিছুতেই ভালোভাবে নিতে পারলোনা | তারা বিষয়টিকে নিয়ে নানানভাবে কানাঘুসো শুরু করে দিলো | অদ্ভুতভাবে এতকিছু পরিবারটির জন্য করা হলেও লিজার বাবা অতুলকে কিছুতেই পছন্দ করতে পারতেননা | তার প্রধান ভয় ছিল লিজার মা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী মহিলা | দুঃখ , দারিদ্রতা তার সৌন্দর্য্যে কোনদিন কালো ছায়া ফেলতে পারেনি | এই মানুষটা অতুলের কিনে আনা জিনিসপত্র নিয়ে কোনদিন কোন অভিযোগ বা অশান্তি তো করেননি উপরন্তু সেগুলো তিনি প্রফুল্ল চিত্তে ভুরিভোজ করতেন | কিন্তু তার স্ত্রীকে অতুলের সাথে কথা বলতে দেখলেই তার মাথাটা গরম হয়ে যেত |
--- অতুল পড়াতে আসে পড়িয়েই চলে যাবে তার সাথে এতো গল্প কিসের | এগুলো আমার একদম পছন্দ নয় |
--- স্বার্থপর মানুষ পৃথিবীতে অনেক দেখেছি কিন্তু তোমার মত এরূপ স্বার্থপর মানুষ দেখিনি | তার আনা খাবার খাচ্ছ আর তাকেই সহ্য করতে পারোনা ? মেয়েটিকেও নিয়ে আর কোন চিন্তা করতে হয়না | সবই তো অতুল করছে | আমি ভাবতে পারিনা তুমি এতো বেঈমান কেন |
--- অতুলকে তো নিজের রূপ দিয়ে ভুলিয়েছো , কি ভাবো তুমি আমাকে আমি কিছু বুঝিনা ?
--- ছিছি - কি ছোট মন তোমার | সে আমাকে কাকিমা বলে ডাকে | আমার থেকে সে বয়সে কত ছোট |
--- ওসব কাকিমা , জেঠিমা ডাক আমার ঢের দেখা আছে | লিজাকে পড়ানো হয়ে গেলে ওর সাথে বসে হাহা হিহি করবেনা বলে দিলাম |
নিত্য অশান্তি হতে হতে একদিন লিজার বাবা এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তিনি বুকের বাদিকটা হাত দিয়ে চেপে ধরে খাটের পরে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন | লিজার মা মাধবী পাড়ার ছেলেদের ডেকে অতুলকে খবর দিতে বললেন | অতুল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তার কিছু বন্ধুদের সাহায্যে লিজার বাবা সঞ্জয়কে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো | সরকারি হাসপাতাল হলে হবে কি সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে কিছু ওষুধপত্র কেনার দরকার হয়ে পড়লো | বড়লোকের ছেলে হলেই যে তার পকেট ভর্তি থাকবে সবসময় তা কিন্তু নয় | অতুল পড়লো মহা ফ্যাসাদে | বন্ধুদের কাছ থেকে সামান্য কিছু জোগাড় হলেও হার্টের ওষুধের দাম তখনকার দিনেও অনেকেরই ক্ষমতার বাইরে ছিল | কিছু বন্ধু যারা সব চাকরি বাকরি করে তারা অধিকাংশই বাইরে বাইরে | কি করবে ভাবতে ভাবতে নিজের হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে মায়ের করে দেওয়া সোনার আংটিটা চোখে পড়লো | অবশেষে সে সেটিকেই বিক্রি করে দেয় |
একই সাথে পড়তো গীতা নামে একটি মেয়ে ওই হাসপাতালের নার্স ছিল | সে অতুলকে যথেষ্ট সহযোগিতা করে সঞ্জয়ের চিকিৎসার ব্যাপারে | গীতা অতুলের কাছে জানতে চায় ,
--- তুই কেন এই পরিবারটার প্রতি এতো দায়িত্ব পালন করিস ?
--- আর কেউ জানতে চাইলে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর আমি এড়িয়ে যেতাম | কিন্তু তুই আমার স্কুল ও কলেজ জীবনের বন্ধু | তাই তোকে এই উত্তরটা আমি দেবো | বিশ্বাস কর আমি নিজেও জানিনা ওদের প্রতি কেন আমার এতো টান | প্রথম প্রথম নিজেকে নিজেই বহুবার প্রশ্ন করেছি | কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি | তবে এখন যেহেতু সকলে আমাকে এই ব্যাপারে বাধা দেয় আমার ভিতরে একটা জীদ চেপে বসেছে | আর ওই বাচ্চা মেয়েটি লিজা - পড়াশুনায় খুব ভালো | ও যদি একটু সুযোগ পায় জীবনে মাথা তুলে দাঁড়াবেই | আমি লিজাকে খুব ভালোবাসি |
--- কিন্তু পাড়ার লোকে নানান কথা বলে তোকে আর লিজার মাকে নিয়ে সেটা কি তুই জানিস |
--- জানি রে -- সম্পূর্ণটা জানি | আমার কিছু তাতে যায় আসেনা | নিন্দুকেরা তো নিন্দে করবেই | একটা অসহায় পরিবার | ঘটনাক্রমে পরিবারটির প্রতি আমার সহানুভূতি জম্ম নিয়েছে | আমি যদি পরিবারটিকে একটু সাপোর্ট দিই তাহলে সে মুখ থুবড়ে পড়বেনা | তোর কি মনেহয় আমি কোন অন্যায় করছি ?
--- তোর এই কথার আমার কাছে কোন উত্তর নেইরে | তোর এই জেদ ভালো কাজের জন্য | ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন তোকে শক্তি যোগান |
দিনরাত এক করে পনেরদিন পরে অতুল সঞ্জয়কে সুস্থ্য করে বাড়িতে নিয়ে আসলো | কিন্তু সঞ্জয়ের কৃতজ্ঞতা তো দূরহস্ত সে যেন আরো বেশি সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পরে | অতুল একদম যে বুঝতে পারেনা তা নয় | তাই সে চেষ্টা করে লিজাকে পড়ানোর পরেই সেখান থেকে চলে আসতে | যদিবা কোনদিন একটু সময় সেখানে সে বেশি থাকে সে সঞ্জয়ের ঘরে বসেই কথাবার্তা বলে | লোকের কথা , বাড়িতে মায়ের অশান্তি , বন্ধুদের টিপ্পনি কোনকিছুকেই সে পাত্তা দেয়না | মানুষ বলে মানুষের ভালো কর্মের ফল একসময় না একসময় ঠিক ভগবান দেন | সে এ জম্ম হোক বা পরজম্মে | অনেকেই হয়ত জন্মান্তর মানেনা | কিন্তু অতুল মাঝে মাঝে ভাবে পূর্বজন্মে হয়তো এই পরিবারটির প্রতি তার কোন ঋণ ছিল যা সে এ জনমে শোধ করছে | অপরদিকে লিজার মা ভাবেন অতুল তার সংসারে ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছে | হয়ত পূর্বজন্মে তিনি কোন ভালো কাজের ফল এজনমে পাচ্ছেন | ঈশ্বর তো নিজে এসে পাশে দাঁড়াতে পারেননা তিনি মানুষের মধ্যেই বিরাজিত এবং মানুষের রূপ ধরেই মানুষের উপকার করতে আসেন |
সঞ্জয়কে বাড়িতে নিয়ে আসার পর কিছু ওষুধ অতুল সেই সময় কিনেই আনে | কিন্তু এ ওষুধ তো আজীবন তাকে খেয়ে যেতে হবে এবং হার্টের ওষুধগুলি অসম্ভব দাম ও | বেকার অতুলের পক্ষে এটা একটা মারাত্মক চাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে লিজার মা অতুলের সাহায্যেই শাড়ি বেডকভারের উপর ফেব্রিক বা হাতে এমব্রয়ডারি করে বিক্রি করতে শুরু করলেন | অতুলই সব ব্যবস্থা করে দিলো | পরিবারটার প্রতি অতুলের এই সহনাভূতি অনেকেই তির্যক দৃষ্টিতে দেখে ও নানান ধরণের কটূক্তি করে | কিন্তু অতুল অদ্ভুতভাবে সবকিছু হজম করে | নিজেকে প্রশ্ন করেও নিজে কোন উত্তর পায়নি কেন এ পরিবারটার প্রতি তার এতো ভালোবাসা |
এইসবের মাঝেই একদিন রাতে খাওয়ার সময় তার মা ও তাকে নানান কথা শুনান লিজাদের পরিবারটা নিয়ে এভাবে মাতামাতি করাটা ঠিক হচ্ছেনা বলে | প্রথম অবস্থায় অতুল চুপচাপ থাকলেও পরে চিৎকার করে বলে ওঠে ,
--- একটা গরিব পরিবার | একটু সাহায্য করলে যদি ভবিৎষতে পরিবারটা দাঁড়াতে পারে তাহলে সকলের অসুবিধাটা কোথায় ?
--- আমাদের দেশে এরূপ গরিব পরিবার অনেক আছে | এই পরিবারটা নিয়ে তোকে জড়িয়ে যখন নানান কথা উঠছে তখন সেখানে না গেলেই তো হয় |
--- আমার জিদটাই এখন এখানে | সকলে যা ভাবছে আসলে তা নয় সেটা আমি পরিবারটিকে দাঁড় করিয়েই মোক্ষম জবাবটা দেবো |
মা তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেন | কিন্তু অতুল নাছোড়বান্দা | একটা জিদ যেন তার ঘাড়ের উপর চেপে বসেছে | সারাটাদিন এদিক ওদিক লিজাদের বাড়ি যেমন তেমন ভাবে সময় কেটে গেলেও রাতে যখন খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে শুতে যায় তখন অয়নিকার কথা মনে পড়লেই তার চোখদুটি জলে ভরে যায় | কতদিন সে অয়নিকাকে দেখেনা কোন চিঠিও আসেনা | সুযোগ পেলেই নানান চাকরির পরীক্ষার বইপত্তর নিয়েও রাতে একটু পড়াশুনার চেষ্টা করে | মাঝে মায়ের কাছে জেনেছিলো মেসোর খুব শরীর খারাপ | অতুল যেতে চেয়েছিলো শিলিগুড়ি | কিন্তু মাসি মাকে জানিয়েছিলেন যদি প্রয়োজন হয় তিনি নিজেই অতুলকে ডেকে নেবেন | সে ডাকের জন্য অতুল অধীর আগ্রহে বসে ছিল | কিন্তু পরবর্তী চিঠিতে মাসি লিখেছিলেন ," বিপদ আপাতত কেটে গেছে |" কোন কারণ ছাড়া মাসির বাড়িতে বেড়াতে সে যেতেই পারে | কিন্তু নিজের দুর্বলতা যদি কারও সামনে ধরা পরে যায় | তার আর অয়নিকার সম্পর্ক যদি কেউ ধরে ফেলে | এইসব সাতপাঁচ ভেবে সে চাকরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে | একটা চাকরি পেলেই সে অয়নিকাকে নিয়ে অনেকদূরে বদলি হয়ে চলে যাবে | মাঝে মাঝে এটাও ভাবে লিজাদের পরিবারটার সাথে পরিচয় হয়ে ভালোই হয়েছে | তার সময় অন্তত কেটে যাচ্ছে | একা থাকলেই তো অয়নিকা এসে মাথায় চেপে বসে | মনেমনে তার সাথে চোখ বুজে কত সময় কাটায় |
একদিন খুব ভোরে অতুলের মা এসে চিৎকার করে করে অতুলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মারাত্মক দুঃসংবাদটা দেন | খবরটি শুনেই অতুল কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পরে | দরজাটা খুলে দিয়ে ঘটনাটা শুনেই আবার ধপ করে নিজের খাটের উপর বসে পরে | মা এসে মাথায় হাত রেখে বলেন ,
--- ওদের তো সেরূপ কোন আত্মীয়স্বজন নেই | সবই তো ওদের বন্ধু বান্ধব পাড়াপ্রতিবেশী | মা বাবার বয়স হয়েছে | একমাত্র ওর বোনটা | সে একা কতটুকুই বা করবে | তুই বেরিয়ে পর | ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়া |
প্রকৃত যোগ্যতা থাকা সর্তেও কর্মক্ষম মানুষ কাজ করতে চেয়েও কাজ পায়না আধুনিক সভ্য সমাজে এর থেকে কলঙ্কের আর কিছু হতে পারেনা | অধিকাংশ পরিবার খেয়ে না খেয়ে পরিবারের বড় সন্তানটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেন শিক্ষা শেষে কিছু একটা সে রোজগার করবে এই আশায় | কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অনেকেই অর্থ সংস্থানের কোন পথ খুঁজে না পেয়ে চুরি , ডাকাতি --- বা হয়তো নিজেকেই শেষ করে দেয় আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে আবার কেউবা বলি হয় হিংসার শিকার হয়ে |
তুষারের বাবা ছিলেন একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী | ফ্যানভাত , নুনভাত খেয়ে থাকলেও তিনি ছেলেমেয়েদুটির পড়াশুনা বন্ধ করেননি | সামান্যকিছু প্রফিডেন্ট ফান্ডে যা পেয়েছিলেন তাই দিয়ে তিনি জীবনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছিলেন | অতি সামান্যকিছু রেখেছিলেন মেয়েটির বিয়ের জন্য | বুকে আশা বেঁধে এগিয়ে চলেছিলেন হয়তো তার তুষার একদিন চাকরি পাবে আর তখন তিনি চিন্তামুক্ত হবেন | কিন্তু এতো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তার এবং পুরো পরিবারটার উপর অন্ধকার নেমে আসলো |
তুষার সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে | সেই কলেজ লাইফ থেকেই | মাঝে তিনটে বছর বাইরে থাকার কারণে রাজনৈতিক সংগঠনে সেভাবে সময় দিতে পারেনি | পাটনা থেকে ফিরে এসেই আবার শুরু করে পার্টি নিয়ে নাচানাচি | কিন্তু তাই বলে সে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলোনা তা কিন্তু নয় | বাবা , মা আর বোনের কথা চিন্তা করে সে নানান জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চলেছিল | কিন্তু বিধাতা পুরুষ তার কপালে লিখেছেন অন্যকিছু | অথচ মানুষ হিসাবে সে ছিল ভীষণ পরোপকারী | যে কারো বিপদে সবসময় সে নিজের বিপদ মনে করেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে | দিনে রাতে যে যখন কোন কাজে তাকে ডেকেছে সকলের আগে সে ছুটে গেছে | অতুলের সাথে তার পার্থক্য একটি জায়গাতেই সে পার্টি করতো আর অতুল পার্টি করেনা | কিন্তু দুই বন্ধুই তাদের পাড়ার সকল বিপদ আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে | কয়েকদিন আগেই পাড়ার এক বয়স্ক ভদ্রলোকের জন্য রক্ত জোগাড় করতে না পেরে তুষার নিজেই রক্ত দিলো | কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা --- সেখানে চাঁদা তুলে অতুল আর তুষার বিয়ে সম্পন্ন করছে | অসুস্থ্য অবস্থায় কার চিকিৎসা হচ্ছেনা , কে হাসপাতালে ফ্রি বেড পাচ্ছেনা --- ব্যবস্থা করবে কে ? তুষার | আর দোসর অতুল | আসলে পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসে শুধুমাত্র দেওয়ার জন্য | বিনিময়ে হয়তো তারা কিছুই পায়না | কিন্তু দিতে তারা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনা |
ঘটনা ঘটার আগের রাতে তুষার একটু দেরি করেই বাড়ি ফেরে | মুখটা ছিল থমথমে | মা জিজ্ঞাসা করাতে ' কিছুনা' বলে এড়িয়ে গেছিলো | বৃদ্ধা মা সে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত জেগেই থাকেন | তুষার ফেরার পর একসাথে খান | কাল রাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি | কিন্তু কাকডাকা ভোরে কার ডাকে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলো তা বাড়ির সকলের কাছেই ছিল অজানা | আর এক বন্ধু এসে খবর দিলো বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে কে বা কারা তুষারকে খুন করে রাস্তার উপরে ফেলে রেখে গেছে | খুব কাছ থেকে পরপর দুটি গুলি করা হয়েছে তার বুকে | পুলিশ এসে বডি ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে গেছে ওই ভোরেই | ময়না তদন্ত শেষে বডি তুলে দেবে পরিবারের লোকজনের কাছে | বৃদ্ধ বাবা স্থবির হয়ে বসে আছেন | আর তার মা মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন | তুষারের বোন তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে থম মেরে বসে আছে মায়ের কাছে | যে যা বলছে যন্ত্রচালিতের মত মাথা নাড়িয়ে উত্তর করছে | অতুল তাদের বাড়িতে ঢুকে তিয়াসার মাথায় হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিয়াসা অতুলকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে | অতুলের মুখে সবকথায় যেন হারিয়ে গেছে |
এরই মাঝে আর এক বন্ধু এসে অতুলকে ডেকে নিয়ে গেলো | তুষারের বন্ধুরা সকলে মিলে চললো লাশকাটা ঘরের উদ্দেশ্য | সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঠায় বসে থাকে অতুল ও তুষারের কিছু কমন বন্ধু | সেখানে দেখা যায়না কোন রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীকে | রাগে টগবগ করে ফুটতে থাকে তার বন্ধুরা | তুষারের এই বন্ধু মহলের জানা নেই তার কোন শত্রু ছিল কিনা | তাই তুষারকে মেরে ফেলার কারণ তাদের কাছে অন্ধকার | একটা কথা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা কেন এবং কিসের উদ্দেশ্য নিয়ে তুষারের মত একটি ছেলেকে এভাবে অকালে চলে যেতে হল |
সকালে সবাই চা টুকুও খেয়ে বেরোয়নি | অতুল সকলকে নিয়ে সামনে এগিয়ে একটা চায়ের দোকানে চা খেতে দাঁড়ায় | পাশেই ছিল কয়েকটা মানুষের জটলা | তাদের ফিসফিস করে বলা কিছু কথা অতুলের কানে আসায় সে বুঝতে পারে তারা তুষারের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কেই আলোচনা করছে | ভালো করে খেয়াল করে দেখে তুষার যে পার্টির সাথে জড়িত ছিল সেই পার্টিরই অন্য একটি ছেলে | কিন্তু যতদূর অতুল জানে ওই ছেলেটির সাথে তুষারের ভালোই সম্পর্ক ছিল | বেশ কয়েকবার সে তুষারের সাথে ওকেও দেখেছে | এগিয়ে যায় ছেলেটি অথাৎ বিধানের কাছে | তুষারের এই ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা শুরু করে অতুল তার সাথে | অন্য বন্ধুরাও ততক্ষনে অতুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে | কিন্তু বিধানের এই সম্পর্কিত চিবিয়ে চিবিয়ে কথাবার্তা কারোই পছন্দ হলোনা | আর বিধানও যেন খুব ব্যস্ততার সাথে সেই স্থান ত্যাগ করলো | কেন সে এখানে এসেছে জানতে চাওয়াতে বললো ,' তার অন্য একটা কাজ ছিল |'বিধানের উত্তরটা কারো মনঃপুত না হলেও সেই মুহূর্তে অতুলেরা এ নিয়ে কোন তর্কে গেলোনা |
সন্ধ্যা নাগাদ তারা তুষারের মরদেহ হাতে পায় | বাড়িতে এসে পৌঁছালে পুরো পাড়া ভেঙ্গে পরে তাদের ছোট্ট বাড়িটার সামনে | তুষারের মা এসে একমাত্র ছেলের বুকের উপর আছড়ে পড়েন | কিছুক্ষণ পরে সকলে বুঝতে পারে তিনি পুনরায় জ্ঞান হারিয়েছেন | সকলে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দিলো | পাড়ার বৌ মেয়েরা তার জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করতে লাগলেন | আর এদিকে তুষারের বাবাকে ধরে এনে বারান্দায় একটা চেয়ারের উপর বসিয়ে দেওয়া হল | তিনি ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন কিন্তু কারো সাথে কোন কথা বা কেউ কিছু জানতে চাইলে কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছেন | তার চোখের চাহনি কারো কাছেই নর্মাল বলে মনেহচ্ছে না | আর বোন তিয়াসা --- কাঁদতে কাঁদতে একসময় তার চোখের জলও শুকিয়ে গেছে |
সকলে মিলে তুষারকে নিয়ে রওনা হল | তুষারের বাবা একইভাবে চেয়ারে বসে রইলেন | মানুষটির কোনই হেলদোল নেই | তিয়াসা দৌড়ে গেট অবধি আসলো " দা-- দা-- বলে চিৎকার করে উঠে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে গেলে পাড়ার এক ভদ্রমহিলা তাকে বুকের সাথে চেপে ধরেন | পুরো পাড়ার লোক যেন ভেঙ্গে পড়েছে পরোপকারী তুষারের এই খবর শুনে | শোকে , দুঃখে গাছের পাতাগুলিও হাওয়ায় দুলতে ভুলে গেছে | চারিদিকে একটা গুমোট পরিস্থিতি |
আস্তে আস্তে বাড়ির ভিড়টা অনেকটাই কমে গেছে তখন | দুএকজন প্রতিবেশী তখনও বসে | হঠাৎ তুষারের বাবা বলে উঠলেন ,
--- তিয়াসা এতো লোকজন এসেছিলো কেন ? তুষারটাকে তো দেখতে পেলামনা | ও দুপুরে খেয়ে গেছিলো আজ | একটা চাকরি পার্টি থেকে হওয়ার কথা বলছিলো কোন খবর আছে কিনা আসলে জানতে চাস তো --- না থাক আমিই জেনে নেবো |
সকলেই বুঝতে পারলো তুষারের বাবা তুষারের এই ঘটনায় মারাত্মক আঘাত পেয়ে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছেন | কিছুটা সময় তার মাথা থেকে ব্লাক আউট হয়ে গেছে | কেউ তার কথায় কোন উত্তর করলোনা | আর তুষারের মাকে পাড়ার এক ডক্টর এনে দেখিয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে |
শ্মশানে পৌঁছানোর পর সমস্ত কাজগুলি করতে লাগলো অতুল | কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী যখন মুখাগ্নি করার প্রয়োজন পড়লো তখন অতুল চুপ করে হাতে পাটকাঠি নিয়ে একদৃষ্টিতে তুষারের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো | ঠাকুরমশাই বারবার করে তাকে কাজ শেষ করার জন্য বলতে লাগলেন | তখন সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো | অন্য বন্ধুরা এসে তাকে জোর করে নিচ থেকে তুলে কোনরকমে তুষারের মুখে আগুন ছুঁইয়ে দেয় | শ্মশানে সেই সময় যারা উপস্থিত ছিল সকলের চোখেই ছিল জল | একজন মানুষ মারা যাওয়ার পরও তার নিয়মকানুন যেন শেষই হয়না | দাহ কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর এবার অতুলের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল তুষারের অস্তি | মুখাগ্নির পর থেকেই অতুল ছিল একদম নিশ্চুপ | সে মাটির পাত্রটা নিয়ে বন্ধুদের সাথে গঙ্গায় গিয়ে অস্তি ভাসানোর সময় মনেমনে বললো , " তুষার, তুই জানিস আমি পরজম্মে বিশ্বাসী | পরেরবার আমি তোকেই আবার আমার প্রিয় বন্ধু হিসাবে পেতে চাই " |
তুষারের বাড়িতে আবার তার বন্ধুরা ফিরে এলো | ফেরার পথে ওরা কিছুটা খই আর দই কিনে নিয়ে এসেছিলো | তিয়াসার কাছে সেগুলো দিয়ে অতুল তাকে বলে ,
--- কোনরকম কিছু দরকার পড়লেই তুই আমাকে বলবি | আজ থেকে তোদের সব দায়িত্ব আমার | কোন চিন্তা করবিনা , আমরা সবাই আছি | তুষারের কাজ আমি মন্দিরে করে ফেলবো | তুই শুধু নিজে একটু শক্ত থাকিস কারণ মাসিমা , মেসোমশাইকে তোকেই দেখতে হবে |
অতুলের গলার আওয়াজ পেয়ে তুষারের বাবা বেরিয়ে এসে অতুলের কাছে জানতে চাইলেন ,
--- সকাল থেকে তুষারটাকে দেখতে পাচ্ছিনা | তোমরা কেউ ওকে দেখেছো ?
অতুল এবং তার বন্ধুরা এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলো | তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে বললো ,
--- তোমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাবা এই একটা কথাই বলে যাচ্ছেন | আরো বলছিলেন দাদা নাকি বাবাকে বলেছিলো ওর একটা চাকরি হওয়ার কথা হচ্ছে পার্টির সোর্সে |
কথাটা শুনে অতুল একটা ধাক্কা খায় | কিন্তু সেই মুহূর্তে সে কোন কথা কাউকে বলেনা | মেশোমশায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ,
--- আপনারা খেয়ে শুয়ে পড়ুন ওর আসতে রাত হবে |
কথাটা বলে নিজেকে সামলাতে আর এক মুহূর্ত সময় সে সেখানে দাঁড়ায়না | যেতে যেতে বলে , " বোন তুই দরজাটা দিয়ে দে আমরা আবার সকালে আসবো |"
সারাটা রাত অতুল ছটফট করতে থাকে | "কে মারলো তুষারকে ? কেন মারলো ? ওকে মেরে তার বা তাদের কি লাভ হল ?" কোন প্রশ্নের উত্তরই সে মিলাতে পারেনা | মনটা অস্থির হয়ে আছে | পুলিশ একটা কেস করেছে ঠিকই কিন্তু কোন সুরাহা হবে বলে তো মনেহয়না | সন্ধ্যায় ফিরেই মাকে বলেছে সে তুষারের কাজ করবে এই কটাদিন সে নিরামিষ খাবে | আজ রাতে আর কিছু খাবেনা | তার মা তাকে একগ্লাস দুধ এনে জোর করে খাইয়ে দিয়ে যান | বাবা এসে অতুলকে বলেন ,
--- টাকাপয়সা এই মুহূর্তে যা লাগবে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিস | তুষারের পরিবারটা যাতে ভেসে না যায় সেটা দেখিস | মেয়েটা যেন গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করে |
অতুল সংক্ষেপে তুষারের বাবা মায়ের বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানায় | অতুলের বাবা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন ,
--- বাবা , মা বেঁচে থাকতে সন্তানের চলে যাওয়াটা যেন চরম শত্রুকেও দেখতে না হয় |
অতুল ও তার বন্ধুরা মিলে তুষারের সমস্ত কাজ একটা মন্দিরেই সম্পন্ন করে কয়েকজন দুস্ত মানুষকে খাইয়ে দেয় | তুষারের বাবা সব ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে কাউকে দেখলেই তার ছেলের খোঁজ করেন | আর তার মা দিনরাত তুষারের ঘরে শুয়ে কান্নাকাটি করেন | তিয়াসা কোনরকমে ডাল আলুসিদ্ধ করে এই বয়স্ক মানুষদুটিকে খাওয়াতে নাকানি চুবানি খায় | অতুল প্রায় রোজই তুষারের বাড়িতে যায় | মাঝেমধ্যে বাবার বা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সামান্য কিছু বাজারঘাটও করে দিয়ে আসে | বন্ধুরা মিলে বেশ কয়েকবার থানাতেও গেছে | কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি | মাঝে একদিন পার্টির কিছু ছেলে এসে তিয়াসার কাছে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে যায় |
মাস খানেক পরে অতুলেরা জানতে পারে বিধানের চাকরি হয়েছে পঞ্চায়েত অফিসে | এবার অতুল ও তার বন্ধুরা ঘটনাগুলিকে সাজিয়ে দুয়ে দুয়ে চার করে ফেলে | পুলিশ দিয়ে কিছু হবেনা এটা ওরা বুঝেই গেছিলো | অদ্ভুতভাবে পুলিশ কেসটাকে চাপা দিয়ে রাখে | পার্টির কোন এক ব্যক্তির মাধ্যমে অতুলেরা জানতে পারে পঞ্চায়েত অফিসে এই চাকরিটা হওয়ার কথা ছিল তুষারের | পার্টি থেকে জানানো হয়েছিল যতদিন না তুষার চাকরিতে জয়েন করছে এ কথা যেন ঘুনাক্ষরেও বাইরের কেউ না জানে | তারপরেই এই ঘটনা | এখন ওদের কাছে জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেলো কেন তুষারকে খুন হতে হল | কিন্তু পুলিশ ও পার্টি যেখানে নিশ্চুপ সেখানে ওদের এগোনো ঠিক হবেনা আর ওদের কাছে কোন প্রমাণও নেই | যে ভদ্রলোক ওদের জানিয়েছেন তিনি পরে অস্বীকারও করতে পারেন | সেক্ষেত্রে ওদেরও জীবনহানি হতে পারে | কথাগুলো অতুলের বাবা তার ছেলে ও বাকি বন্ধুদের বলেন এবং অনুরোধ করেন বেঁচে থাকতে গেলে এইসব চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিতে হবে | সকলে মিলে তুষারের পরিবারটিকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন |
দিন সুখ বা দুঃখ কোনকিছুর জন্যই বসে থাকেনা | সে ঘড়ির কাঁটা ধরেই তার আপন কক্ষপথ অতিক্রম করে | দেখতে দেখতে ছমাস হয়ে যায় তুষার চলে গেছে | অতুল প্রতিদিনই আসে তুষারের বাড়িতে | আর অন্যদিকে লিজাকে পড়িয়েই সে চলে আসে সেখান থেকে | আগেরমত ওখানে বসে আর গল্পগুজব করেনা | কিন্তু পরিবারটার প্রতি টানটা তার রয়েই গেছে | তাদের বিপদে আপদে , যেকোন প্রয়োজনে আজও সে ছুটে যায় সেখানে | অদ্ভুত মনের একটি ছেলে এই অতুল | যে কেউ বিপদে পড়লেই সে নিজের বিপদ মনেকরে ঝাঁপিয়ে পরে | পাড়াপ্রতিবেশীরা বা বাড়িতে মা এখন অতুলের এই মনোভাবটা সকলেই বুঝে গেছেন | যে গুঞ্জন একসময় তাকে নিয়ে শুরু হয়েছিল এখন আর কেউই সে সব নিয়ে মাথা ঘামায়না | কিন্তু অতুল মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ায় | তুষারের হত্যাকারী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় তা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা | কিন্তু সে এবং তার বন্ধুদের কারও উপর মহলের সাথে সেরূপ জানাশুনাও নেই যে তাদের সাহায্য করতে পারে |
তুষারের বাবার দিনকে দিন অবস্থা খারাপ হতে থাকে | আস্তে আস্তে তিনি বাড়ি এবং পরিচিত মানুষদের একটু একটু করে ভুলে যেতে থাকেন | সবসময়ের জন্য তিনি একজনকেই খোঁজেন সে তার তুষার | তার স্ত্রী , এবং মেয়ে কাউকেই তিনি এখন আর চিনতে পারেননা | তার মুখে শুধু তুষার আর তুষার | অনেক সময় তিনি বেশ জোরে জোরেই তুষারের সাথে কথা বলেন | চাকরির খবরটাই তিনি বেশি জানতে চান তার একমাত্র ছেলে তুষারের কাছে | অতুল তাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছে কিন্তু কোন লাভ কিছুই হয়নি | সামান্য ওষুধপত্র যা দিয়েছেন ডাক্তার তা তাকে খাওয়াতে তিয়াসার কালঘাম ছুটে যায় | তিয়াসার মা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছেন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কষ্টের কথা ভেবে | তিয়াসার এবার ফাইনাল ইয়ার | দুটো টিউশনিও ধরেছে সে | কিন্তু এই পরীক্ষার সময় অনেক বলে অতুল তার টিউশনি যাওয়া বন্ধ করিয়েছে | মাসখানেক অতুল নিজেই তাদের পড়াবে আর পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে পুণরায় তিয়াসা ধরবে এইগুলি আবার | এইভাবেই ছাত্রীদের অভিভাবকের সাথে তার ও অতুলের কথা হয়েছে |
পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরেই একদিন ভোর রাতে তিয়াসার বাবার খুব শরীর খারাপ করে | অতুল ও তার বন্ধুরা মিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে | কিন্তু তিনি আর বাড়ি ফিরে আসেননা | তার পারলৌকিক কাজের আগেই অতুলের একটি ইন্টারভিউ পরে দিল্লিতে | সমস্ত কাজের দায়িত্ব বন্ধুদের কাঁধে দিয়ে অতুল দিল্লি যায় চাকরির পরীক্ষা দিতে | আঘাত পেতে পেতে তিয়াসাও এখন অনেক পরিণত | সে দাদার বন্ধুদের সহায়তায় নির্বিঘ্নেই বাবার পারলৌকিকক্রিয়া সম্পাদন করে |
সাত আটদিনের মাথায় ফিরে আসে অতুল দিল্লি থেকে | তার এখন নিত্য রুটিন হয়ে পড়েছে লিজাকে পড়ানো ছাড়াও কিছুক্ষণের জন্য হলেও একবার তিয়াসাদের বাড়িতে এসে খবর নেওয়া | বাড়িতে ঢুকেই তিয়াসাকে হাক পেরে বলে ,
--- এককাপ চা করে আনতো বোন |
তিয়াসাও তখন খুশি মনে চা করতে চলে যায় | অয়নকে তুষারের সমস্ত ঘটনায় অতুল চিঠি লিখে জানিয়েছিল | অয়ন চিঠির জবাবে অতুলকে বলেছিলো সে এতদিনে অনেক চেষ্টা করে কলকাতা বদলি হতে পারছে | কিছুদিনের মধ্যেই সে কলকাতা ফিরে আসছে | এই চিঠি অতুলের হাতে আসার প্রায় দিনপনের বাদে অয়ন কলকাতা অফিসে বদলি হয়ে বাড়ি ফেরে | অতুল অয়নকে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়ে বসে | প্রথমে অয়ন একটু কিন্তু কিন্তু করলেও অতুলের সাথে সে তিয়াসাদের বাড়িতে এসে তাকে দেখে তার মন থেকে কিন্তুটা চলে যায় | সে অতুলকে জানায় তার মায়ের সাথে কথা বলতে |
অয়নের বাবা ছিলেননা | অয়নের ছোটবেলাতেই তিনি মারা যান | মারা যান বললে কথাটা একটু ভুল বলা হবে | তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন |
সাধারণ একটা কারখানায় নিপাট ভদ্রলোক রমেশ মজুমদার চাকরি করতেন | পোষ্টটা ছিল ক্যাশিয়ারের | সুতরাং ক্যাশের চাবিটা তার কাছেই থাকতো | সারাদিনের কাজের শেষে হিসাব বুঝিয়ে চাবিটা তিনি কারখানার মালিকের কাছে জমা করে আসতেন | পনের বছর ধরে এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি তার জীবনে | সহজ , সরল , সত্যবাদী মানুষটি সেদিনও কাজের শেষে হিসাব সমেত মালিককে চাবি দিয়ে আসেন | কিন্তু একদিন রাতে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন মালিক সুকুমার ঘোষ | রাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ভোর হতে তিনি মারা যান | তিনি ছিলেন নিঃসন্তান | একমাত্র দিদির একটি পুত্রসন্তানকে নিজপুত্র স্নেহে মানুষ করেছিলেন | সে ছিল কোম্পানির সুপারভাইজার | সুকুমার বাবুর বোনপোটি অর্থলোভীই শুধু নয় নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যে কোন ধরনের কাজ করতে সে দুবার ভাবতোনা | রমেশবাবু ছিলেন একজন সৎ ব্যক্তি | রমেশবাবুর জন্য অনেকসময় ক্যাশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ চেয়েও সে পায়নি | আর এইসব কারণেই রমেশবাবুর প্রতি তার ছিল একটা ভীষণ রাগ | রমেশবাবুর বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা অপবাদ সে দিয়েছে | কিন্তু সুকুমারবাবু কোনদিনও সেসব বিশ্বাস করেননি | সুকুমারবাবুর মৃত্যুর পরের দিনই সে কারখানায় ঢুকে ক্যাশের চাবি নিয়ে সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করে আর দোষ পরে সব রমেশবাবুর উপর | সে কারখানার সমস্ত কর্মচারীর সামনে রমেশবাবুকে নানানভাবে হেনস্থা করে আর চোর অপবাদ দেয় | সুকুমারবাবুর অবর্তমানে কারখানার মালিক যেহেতু তার বোনপোটি তাই কেউ কোন প্রতিবাদও করেনা | তাকে পুলিশে দেওয়া হবে বলেও ভয় দেখানো হয় | কারখানার অন্যান্য কর্মচারীরা সব বুঝেও তাদের চাকরি হারাবার ভয়ে কেউই মুখ খোলেনি | লজ্জায় , অপমানে নিরীহ মানুষটি সেদিনই বাড়িতে ফিরে স্ত্রী , ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন | অয়ন তখন সবে দশ বছরের | অনেক কষ্টে অয়নের মা অয়নকে বড় করেছেন | সারাটাদিন তিনি বাড়ি বাড়ি টিউশনি পড়িয়ে একমাত্র ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন | অয়ন চাকরি পাওয়ার পর বারবার বলে সে মায়ের টিউশনি পড়ানো বন্ধ করেছে |
অতুল তিয়াসার মায়ের অনুমতি নিয়ে অয়নের মায়ের কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পারে | তার আগে অবশ্য সে প্রথমেই তিয়াসার কাছে জেনে নিয়েছে অয়নকে তার পছন্দ কিনা |
--- একটা বড় দায়িত্ব এখন আমাকে পালন করতে হবে |
--- কি দায়িত্ব দাদা ? তুমি তো জন্মই নিয়েছো শুধু পাড়ার লোকের দায়িত্ব পালন করার জন্যই |
-- বেশ তো কথা শিখেছিস ? এমন মারবো যে চোখ ট্যারা হয়ে যাবে |
আমি তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি | এবার তোর বিয়ে দেবো |
---আর কত করবে দাদা ?
--- আবার পাকামো ? এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই তুই মার খাবি আমার কাছে | বেশি কথা না বলে আমায় বলতো --- আমি যাকে পছন্দ করবো আমার বোনের জন্য তোর তাকে পছন্দ হবে তো ? অবশ্য তুই ও তাকে চিনিস |
--- আগে তোমাকে আমি অতুলদা বলতাম | দাদা চলে যাওয়ার পর তুমি আমাদের পরিবারে বটগাছের শীতল ছায়া নিয়ে এসেছো | তোমার নিজগুনে তুমি আমার দাদার জায়গা নিয়েছো | তুমি কি কখনো আমার খারাপ চাইতে পারো ?তুমি যাকে পছন্দ করবে আমি চোখ বুঝে তার গলায় মালা পরিয়ে দেবো |
--- জানতে চাইবি না সে কে ?
--- ওই যে বললাম তুমি যাকে পছন্দ করবে আমি তাকেই মেনে নেবো |
--- আমাদের বন্ধু অয়ন |
--- অয়নদা ?সে আমাকে বিয়ে করতে কেন রাজি হবে ?
--- এখন আর অয়নদা বলবি না | আর রাজি হবেনা মানে ? আমার বোনটা কি ফ্যালনা নাকি ? সুন্দরী , শিক্ষিত - সর্ব কাজে পারদর্শী |
--- সেতো দাদার কাছে বোন সবসময় শ্রেষ্ঠ |
অয়নের মা ভালোভাবেই তিয়াসাকে চিনতেন | অতুল যখন অয়নের মায়ের কাছে অয়নের সাথে তিয়াসার বিয়ের কথা বলে তখন তিনি বলেন
--- অয়নের আপত্তি না থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই | আমি জানি তিয়াসা খুব ভালো মেয়ে | পরিবারটার উপর থেকে যেভাবে ঝড় বয়ে গেলো ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে |
অয়ন সামনেই ছিল | অতুল জানালো
--- কিরে অয়ন নিজমুখে মাকে বল তোর কোন আপত্তি নেই | আর শোন আমি তো পাত্রীর দাদা | আমার বেকার জীবনে বোনের বিয়ে খুব একটা আড়ম্বর করতে কিন্তু পারবোনা | তবে কথা দিচ্ছি আমি চাকরি পেয়ে পুষিয়ে দেবো |
--- একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না ?
--- না পাত্রীপক্ষকে একটু বলতে হয়রে --
তিয়াসার মা সামান্য গয়না বের করে অতুল গেলে তার সামনে রেখে বলেন
--- এর বেশি তো আমার ক্ষমতা নেই | আর সামান্য কিছু টাকা তোমার মেসোমশাই টুসির বিয়ের জন্য রেখেছিলেন |
--- আপনাকে কিছু ভাবতে হবেনা মাসিমা | আমরা আছি তো | ওর বিয়ে আটকাবেনা |
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল | সব বন্ধুরাই যার যেমন ক্ষমতা সবাই অতুলের কাছে টাকা জমা করতে লাগলো | বেশ কিছু অতুলের বাবাও দিলেন | কিন্তু অতুলকে অবাক করে দিয়ে একসন্ধ্যায় অয়ন এসে তার কাছে কিছু টাকা দিয়ে গেলো |
--- আজ তুষার নেই | ওর বন্ধু হিসাবে ওর বোনের প্রতি তোদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে ঠিক তেমনই আমারও কিছু দায়িত্ব রয়ে গেছে | সেই দায়িত্বটাকে আমি কিন্তু অস্বীকার করতে পারিনা |
--- আরে তুই তো সবথেকে বড় দায়িত্বটা পালন করছিস |
--- হ্যা করছি কিন্তু সেটাও কিন্তু তুইই বলে দিয়েছিস | যাকগে এসব নিয়ে তর্ক করিসনা | এই কথা যেন তোর আর আমার মধ্যেই থাকে | আর কাউকেই জানানোর কোন দরকার নেই |
বিয়ের কয়েকটা দিন আগে বাথরুমে পরে গিয়ে তিয়াসার মায়ের পায়ে এমন চোট লাগলো তিনি পুরো বিছানা নিলেন | মহা বিপদে পড়লো অতুল | তার মাকে গিয়ে বলাতে তিনি বললেন ,
--- ভাবিসনা আমি ওর মায়ের সব দায়িত্ব পালন করে দেবো | কিন্তু তুই ওর মায়ের সাথে কথা বলেছিস ?
--- কি ব্যাপারে মা ?
--- আরে ওকে সম্প্রদান করবে কে ?
--- ও সেতো মাসিমা বলেই দিয়েছেন | আমিই ওকে সম্প্রদান করবো | ওদের তো নিজেদের বলতে কেউ নেই |
তিয়াসা আর অয়নের বিয়ে হয়ে গেলো | শ্বাশুড়ি আর বৌ যেন মা আর মেয়ে | সংসারের সব দায়িত্ব তিয়াসা তার নিজের কাঁধে নিয়ে নিলো | এক দুদিন অন্তর অন্তর সে তার মায়ের কাছে যায় | তিয়াসার অতুলদা ই সব খবরাখবর রাখে তার মায়ের | রবিবার করে অতুল প্রায়ই তিয়াসার মাকে সাথে নিয়ে তিয়াসার বাড়ি থেকে ঘুরে আসে | লিজাকে কিন্তু অতুল এখনো পড়ায় | তবে আগের মত সে বাড়িতে আর সময় দিতে পারেনা | সে যায় তাকে পড়িয়ে এককাপ চা খেয়ে চলে আসে | লিজার মা ও আস্তে আস্তে তার হাতের কাজের অনেক প্রসার করেছেন | আগের মত পরিবারটিকে আর অতুলের অর্থ সাহায্য করতে হয়না | তবে মাঝে মধ্যে লিজার বাবার ওষুধের ব্যাপারে তাকে কিছু টাকা দিতেই হয় | এরজন্য অতুল কিন্তু কখনোই বিরক্ত হয়না |
এতো ঘটনার মাঝে অনেকদিন অয়নিকার কোন খবর আর মায়ের কাছ থেকে অতুলের নেওয়া হয়নি | দিল্লি থেকে ফিরে এসে অনেকবার সে ভেবেছে একদিন শিলিগুড়ি যাবে | কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানান সমস্যার কারণে তার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি | তিয়াসার বিয়ের বেশ কিছুদিন পর একদিন রাতে খেতে খেতে অতুল তার মায়ের কাছে তার মাসি , মেসোর কথা জানতে চান | মা কথায় কথায় তাকে জানান তার মাসি , মেসো এখন তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চান | অয়নিকার পড়াশুনা শেষ আর মেসোরও শরীর খুব একটা ভালোনা তাই তিনি থাকতে থাকতেই ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে চান | অতুলের বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠলো | কিন্তু চাকরি সে এখনো পায়নি আর এটাও ভালোভাবেই জানে প্রাণ থাকতে অয়নিকা তার বাবা , মাকে কোন কথা বলবেনা | কিন্তু অতুল এখন কি করবে ? সেদিন রাতে সে ভালোভাবে না খেয়েই উঠে চলে যায় | মাকে বলে ," শরীর ভালো লাগছেনা |" সারাটা রাত ছটফট করেছে , অনেক ভেবেছে কিন্তু কোন কুলকিনারা পায়নি | তারপরই ভেবেছে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে সে শিলিগুড়ি যাবে মাসির বাড়ি | বাড়িতে কিছু একটা বলে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করতে হবে |
এর ঠিক দুদিন পরেই একদিন দুপুরে অতুল বাড়ি ফিরে দেখে বাবার টেবিলের উপর একটা বিয়ের কার্ড | কার্ডটা হাতে নিয়ে খুলে দেখে অতুল ধপ করে মেঝেতে বসে পরে | চারিপাশ মনেহচ্ছে তার অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে | গলা শুকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে | অয়নিকার বিয়ের কার্ড | কি করে সম্ভব ? ও বিয়েতে কিভাবে মত দিলো ? একবারও আমার কথা ভাবলোনা ? আমি যে ওকে ছাড়া বাঁচতেই পারবোনা | আমার সব স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খা সবকিছু যে ওকে ঘিরেই | এখনো পনেরদিন বাকি বিয়ের | আমাকে একবার শিলিগুড়ি যেতেই হবে | কার্ডটা সেখানেই রেখে দিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজেকে কোনরকমে টেনে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো |
আর এদিকে অয়নিকা ' এখন বিয়ে করবোনা '- বলে বলে কয়েকমাস বিয়ে পিছিয়ে দিলেও বাবা আর মায়ের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় | অনেক কেঁদেছে , মন খারাপ করে না খেয়ে থেকেছে -- খাঁচায় বদ্ধ পাখির মত যন্ত্রণায় ছটফট করেছে --- কিন্তু মুখ ফুটে মাসতুত দাদাকে ভালোবাসার কথা বাবা মাকে কোন অবস্থায় জানাতে পারেনি | পারেনি অতুলকে চিঠি দিয়ে সব জানাতে | অসহায় , নিরুপায় হয়ে নিজের পায়ে নিজেই বেড়ি পরে নিয়েছে |
লোকে বলে কোন শুভকাজে কালো কিছু পড়তে নেই | সুব্রত ও তার মা প্রথম যখন তাকে দেখতে আসে সে একটি কালো ব্লাউজ পরে তাদের সামনে আসে | অয়নিকার মা বারবার তাকে নিষেধ করলেও সে সেকথার কোন পাত্তা দেয়না | ছেলেমানুষি মনের ছেলেমানুষি মনোভাব |
ভেবেছিলো কালো ব্লাউজ পড়েছে তাহলে ওরা ওকে আর পছন্দ করবেনা |সুব্রতর মুখের দিকে একবারের জন্যও তাকিয়ে দেখেনি | প্রথম দেখাতেই অয়নিকাকে মা , ছেলের খুব পছন্দ হয়ে যায় তাকে | আর পছন্দ করার মতোই মেয়ে অয়নিকা | গায়ের রং ফর্সা , চোখদুটো টানা টানা , পাঁচফুট দুই ইঞ্চি লম্বা | সুব্রতও বেশ লম্বা চওড়া ছেলে | দেখতে মোটামুটি ভালোই | তার আচার আচরণই বলে দেয় সে খুব শান্ত ও নরম স্বভাবের ছেলে |মা আর ছেলের সংসার | আহামরি তাদের পরিবারের অবস্থা নয় | অয়নিকার বাবার একটা কারণেই পরিবারটিকে পছন্দ তা হল ছেলেটি সদ্য রেলে চাকরি পেয়েছে | নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার | বাড়ি ছোট হলেও নিজেদের | অয়নিকা কাউকে কিছুই বলতে পারলোনা | বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলো |
এদিকে অতুলের মা অতুলকে ডেকে বললো ,
--- আমরা কিন্তু সবাই মিলে বিয়ের দুদিন আগেই দিদির বাড়ি পৌছাবো |
অতুল অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলো ,
--- কিন্তু মা আমি ভাবছিলাম পরশু ওখানে একবার যাবো |
--- হ্যাঁ তুই যদি বিয়ের কটাদিন আগে যাস ওদের একটু ভালো হবে | কিন্তু তোকে তো আবার ফিরে আসতে হবে | তোর বাবার বয়স হয়েছে | উনাকে নিয়ে আমি একা এতদূর জার্নি করতে সাহস পাইনা |
--- সে দেখা যাবে |
এর ঠিক পরের দিনই ঠিক দুপুরের দিকে রেজিস্ট্রি ডাকে একটা চিঠি আসে অতুলের নামে | অতুল এবং ওর বাবা দুজনের কেউই বাড়িতে ছিলেননা | ওর মা চিঠিটা নিয়ে রেখে দেন | পরে অতুল যখন ঘরে ফেরে অতুলের মা বেমালুম ভুলেই যান চিঠিটার কথা | রাতে খাওয়ার সময় তার মনে পরে | অতুলকে সে কথা জানালে অতুল খাওয়া শেষ করে চিঠিটা খুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করতে করতে মা , বাবার ঘরে ছুঁটে আসে |
--- সেদিন দিল্লি গিয়ে যে পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম সেই চাকরিটা আমি পেয়ে গেছিইইইই |
অতুলের মা মাথায় হাত ঠেকিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে বলেন ,
--- যাক বাবা ঈশ্বর এতদিনে মুখ তুলে তাকিয়েছেন |
বাবা জানতে চাইলেন ,
--- কোথায় পোস্টিং হবে রে ?
--- বর্তমানে দিল্লি কিন্তু পরে লন্ডনে যেতে হতে পারে |
অতুলের মা আঁতকে ওঠেন
--- সে কি রে ? আমরা তোকে ছেড়ে কি করে থাকবো ?
অতুলের বাবা বলেন ,
-- গিন্নি , ছেলেকে তার জীবনে সুখী দেখতে গেলে --- ছেলে তোমার জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যদি দেখতে চাও আঁচলের তলা থেকে যে ওকে বের করতেই হবে |
অতুলের মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন ,
--- কবে যেতে হবে চাকরিতে ?
--- হাতে সাতদিন সময় আছে | কালকেই টিকিট কাটতে যাবো , দু একদিনের মধ্যেই রওনা দিতে হবে |
মায়ের কান্না থামাতে অতুল গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো |
--- ওমা , তুমি এতো কাঁদছো কেন আমি তো ছুটি পেলেই চলে আসবো | তোমাদেরও আমি দিল্লি নিয়ে যাবো দেখো |
রাতে নিজের ঘরে লাইট নিভিয়ে অয়নিকার সাথে কাটানো নানান স্মৃতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোখের কোলবেয়ে জলের ধারা অবিরাম পড়তে লাগলো | একবার পুজোর সময় এখানে যখন অয়নিকারা এসেছিলো সপ্তমীর দিনে বাড়ির সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখে অষ্টমীতে আর কেউ ঠাকুর দেখতে বেরোয়না | সেদিন অতুল আর অয়নিকা বেরিয়েছিল | সারাটা রাত দুজনে ঠাকুর দেখে বেরিয়েছে | ভোরবেলা দুজনে বাড়ি ফিরেছে কিন্তু দুজনের কেউই বিন্দুমাত্র ক্লান্ত হয়নি | কখনো দুজনে হাত ধরে আবার কখনোবা পাশাপাশি হেঁটে সারাটা রাত ঘুরে বেরিয়েছে | জীবনে ফেলে আসা এই অনুভূতিগুলো সারাজীবনেও মন থেকে
মুছে ফেলা যাবেনা |
কিন্তু জীবনে দেখা স্বপ্নগুলো সবকিছু যেন তছনছ হয়ে গেলো | সেই চাকরি হল ঠিকই কিন্তু কয়েকটা মাস আগে হলে হয়তো জীবন থেকে অয়নিকাকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হতনা | সে তো ভেবেছিলো একবার শিলিগুড়ি গিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখবে | কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি সেখানে গিয়ে ফিরে এসে চাকরিতে জয়েন করার সময় পেরিয়ে যাবে | তাকে আগামীকাল থেকেই চেষ্টা করতে হবে দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি |
দুদিন পরেই অতুল চলে গেলো দিল্লিতে চাকরির জন্য | যাওয়ার আগে বারবার করে মাকে বলে গেলো শিলিগুড়িতে পৌঁছেই যেন মা তাকে ফোন করেন সে অফিসে জয়েন করেই অফিসের ফোন নম্বর পাঠিয়ে দেবে পৌছোসংবাদের সাথে | মেসোকে দিয়ে পরিচিত কোন দোকান থেকে সেদিনই যেন খবরটা তাকে দেওয়া হয় | কারণ সে খুব চিন্তায় থাকবে | দিল্লি পৌঁছে পরদিন অফিসে গিয়ে সে যা জানলো তাতে বুঝতে পারলো ছমাসের মধ্যেই তাকে কোম্পানি লন্ডন পাঠাবে |নূতন চাকরি , নূতন পরিবেশ | সময় কেটে যায় বেশ | যখন সারাদিন সে অফিসে থাকে তখন যেমন তেমন কিন্তু রাতে শুতে গেলেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অয়নিকার মুখ | অয়নিকার বিয়ের বিস্তারিত সে মায়ের চিঠিতেই জেনেছে | ভগবানের কাছে তার একটাই প্রার্থনা এখন অয়নিকা যেন খুব সুখী হয় | সে যেন তাকে ভুলে যায় |
এদিকে তাকে ছমাসের মধ্যেই লন্ডন চলে যেতে হবে শুনে মা তাকে বিয়ের কথা বলেন | কিন্তু অতুল চিঠিতে মাকে জানায় এখন নূতন চাকরি কোথায় কখন থাকবে তার ঠিক নেই এই মুহূর্তে সে বিয়ে নিয়ে ভাবছেনা | মা তাকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু অতুল কিছুতেই রাজি হয়না | চাকরির যখন পাঁচ কি সাড়ে পাঁচমাস বয়স তখন তাকে কোম্পানি বিশেষ কাজের জন্য তাকে লন্ডন পাঠিয়ে দেয় | সব ব্যবস্থা পাকা করেই দুদিন আগে কোম্পানি তার হাতে টিকিট ধরিয়ে দেয় | অসহায় হয়ে পরে অতুল | ভেবেছিলো বাইরে যাওয়ার আগে একবার কলকাতা এসে মা বাবার সাথে দেখা করে যাবে | কিন্তু এখন তো কোনোই উপায় নেই আর |
কেটে গেছে এরপর তিনবছর | অতুলকে ব্রিটিশ কোম্পানি তাদের সেখানকার মেইন ব্রাঞ্চ থেকে আর ছাড়েনি | হঠাৎ একদিন টেলিগ্রাফ মারফৎ জানতে পারে বাবার মৃত্যু সংবাদ | অনেক কষ্টে ছুটি ম্যানেজ করে পনেরদিনের জন্য অতুল কলকাতা আসে | মায়ের কাছে জানতে পারে অয়ন তার বাবার মুখাগ্নি করেছে | দুই বন্ধুরই পদবি ও গোত্র এক হওয়ার কারণে ঠাকুরমশাই এই বিধান দিয়েছিলেন | পারলৌকিকক্রিয়া অতুল করলেও অয়নকেও শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী কিছু কাজ করতে হয় | বাবার কাজে মাসি , মেসো আসলেও অয়নিকা আসেনা | অতুল অয়নিকা সম্পর্কে শুধু একটা কথায় জানতে চায় তার মাসির কাছে 'সে কেমন আছে |' আর কোন কথায় অতুল কারও কাছে তার সম্পর্কে জানতে চায়না | মা আর মাসির মধ্যে তাকে নিয়ে কোন কথা উঠলেই অদ্ভুতভাবে সে সেখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় |
তিয়াসা তার শ্বশুরবাড়িতে খুব সুখেই আছে | ছোট্ট ফুটফুটে তিনবছরের একটি ছেলেকে নিয়ে সকলে হিমশিম খাচ্ছে | আর এদিকে অতুল লিজার যে দায়িত্ব নিয়েছিল তা সে আজও পালন করে চলেছে | প্রতিমাসেই সে তার পড়াশুনার খরচ তার বাবার একাউন্টে পাঠিয়ে দেয় | দেখতে দেখতে তার ফিরে যাওয়ার সময় এসে যায় | বারবার মাকে অনুরোধ করে তার সাথে যাওয়ার জন্য | কিন্তু তার মা স্বামী , শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে যেতে কিছুতেই রাজি হননা | তিনিও বারবার তাকে বিয়ের কথা বলেন | অতুল তাকে বলে , " বাবার চলে যাওয়ার একবছরের মধ্যে এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো |"
খুব একা হয়ে পড়েন অতুলের মা | মাঝে মাঝে তিয়াসা তার ছেলেটাকে নিয়ে তার কাছে এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় | একদিকে সংসার , ভীষণ দুষ্টু ছেলে , তার বৃদ্ধা মা আবার অতুলের মা অথাৎ তার মাসিমা | আপ্রাণ চেষ্টা করে সবদিকে তাল রেখে চলবার | কারণ দাদার ( অতুল ) ঋণ সে সারাজীবন ধরেও শোধ করতে পারবেনা | আর এ ব্যাপারে অয়ন তাকে ভীষণ সাহায্যও করে |
বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায় | লিজা এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে | অতুল তার বলা কথা আজও পালন করে চলেছে | মাকেও সে নিয়মিত টাকা পাঠায় কিন্তু অতুলের বাবা যে মোটা অঙ্কের পেনশন পান তাতেই তার বেশ ভালোভাবেই চলে যায় | সুতরাং ছেলের পাঠানো টাকায় তার হাত দিতে হয়না | অতুল দুএক বছর অন্তর মায়ের কাছে এসে কিছুদিন থেকে আবার চলে যায় তার কর্মস্থলে | মায়ের জিদ তিনি অতুলের সাথে যাবেননা আর অতুলের জিদ সে বিয়ে করবেনা | এইনিয়ে একদিন মায়ের সাথে তুমুল তর্কতর্কি হয় তার | আর সেদিনই রাতে মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়ে পরে | সঙ্গে সঙ্গে অতুল তাকে কলকাতার নামি নার্সিংহোমে ভর্তিও করে | কিন্তু তিনি আর ফেরেননা |
পারলৌকিকক্রিয়ার আগেরদিন মাসি আর মেসোর সাথে অয়নিকাও আসে তার মাসির কাজে | অয়নিকার পরনে ছিল একটা হলুদ শাড়ি যা সে দিল্লি যাওয়ার আগে মায়ের কথামত তার আইবুড়োভাত খাওয়ানোর জন্য নিজে পছন্দ করে কিনে এনে দিয়েছিলো | অতুল তাকে দেখতে পেয়ে বললো ,
--- কেমন আছিস ?
মাথা নাড়িয়ে অয়নিকা 'হ্যাঁ' জানায় | ব্যস আর কোন কথা কেউ বলেনা | শ্রাদ্ধ , নিয়মভঙ্গ সব মিটে গেলো | তিয়াসা তার ছেলেটিকে নিয়ে সবসময়ের জন্যই ছিল | শুধু রাতেরবেলাটুকু সে বাড়িতে গেছে | লিজারাও এই কাজে অতুলের পাশে থেকেছে সবসময় | সব কাজ মিটে যাওয়ার পরের পরদিন সবাই মিলে বিকালের দিকে তিয়াসাদের বাড়ি যায় | অয়নিকা তার শরীর খারাপের অজুহাতে বাড়িতেই থেকে যায় | অতুলও সেদিন বাড়িতেই নিজের ঘরে থেকে যায় | সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অয়নিকা আস্তে আস্তে এসে অতুলের খাটের উপর বসে | অতুল ধড়মড় করে উঠে বসে বলে ,
--- তুই ? তুই ওবাড়িতে যাসনি ?
--- না , তোর সাথে কথা আছে |
--- কি কথা বল --- | তবে একটা কথা আমি আগে বলি, তোকে ভালোবাসতাম এখনো বাসি --- আজীবন বাসবো -- কিন্তু তুই এখন বিবাহিত | এমনকিছু কথা আমাদের মধ্যে আর হতে পারেনা যেখানে অনুপস্থিত থেকেও তোর স্বামীকে অপমান করা হয় |
অয়নিকা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় |
--- কি হল কি ? কি বলবি বলছিলি ?
--- তোকে কিছু বললে আমার স্বামীকে অসম্মান করা হবে কিনা আমি জানিনা তবে তুই আমাকে নিজের অজান্তেই খুব নিচুতে নামিয়ে দিলি --- | শুধু তুই একা না আজও আমি তোকে ভালোবাসি -- তাই হয়তো আমার বিবাহিত জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো আমি সেভাবে গ্রহণ করতে পারিনি --- | তোকে ভালোবেসে পাপ করেছি কিনা জানিনা তবে ঠিক করিনি বা আমি মনেকরি অন্যায় করেছি | প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে অন্যের কাছে ছোট মনেহয় | এতগুলো বছর বিয়ে হয়েছে আজও আমি মা হতে পারিনি --- হয়তো একটা সন্তান থাকলে আমি তাকে নিয়েই তোকে ভুলে থাকতে পারতাম | যে মানুষটাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেছি সে অত্যন্ত সরলসাদা , ভালোমানুষ | যেহেতু তোর বাস আমার অন্তরে তাই আমি মনেকরি প্রতিটা মুহূর্তে আমি তাকে ঠকিয়ে চলেছি |
অতুল চুপ করে থাকে | কিন্তু মনের ভিতর তার ঝড় বয়ে চলেছে | মুখে বড় বড় কথা বললেও এই নির্জন বাড়িতে অয়নিকাকে তার ভীষণভাবে নিজের করে পেতে ইচ্ছা করছে | আস্তে আস্তে তার সংযমের বাঁধ ভাঙ্গতে শুরু করে |
--- তুই ভালো থাকিস অতুল | মাসি , মেসো আজ নেই | এবার তুই একটা বিয়ে কর সংসারী হ | আর এই কথাটা বলার জন্যই আমি তোর কাছে এসেছিলাম |
অয়নিকা উঠে দাঁড়ায় | অতুল তার হাত ধরে টান দেয় | অয়নিকা তাল সামলাতে না পেরে অতুলের বুকের উপর পরে যায় | অতুল তাকে দুহাতে বুকের সাথে চেপে ধরে | মিশে যায় দুজনের নিঃশ্বাস একই সাথে যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলোনা হয়তো দুজনের মন ও শরীর নিজেদের অজান্তেই নিজেদেরকে কাছে পেতে চাইছিলো | এতো বছরের পর শরীর ও মনের আহিনখায় দুজনেই হারিয়ে গেলো অজানা এক সমুদ্রে দুজনাই পরস্পরের কাছে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিলো | ' বিধাতার লিখন না যায় খণ্ডন ---' নুতন কিছুর জন্য আজকের দিনটাও যেন তিনিই ঠিক করে রেখেছিলেন |
দুদিন পরেই যে যার গন্তব্যে চলে গেলো | চলে যাওয়ার আগে কোন একফাঁকে একটু সুযোগ পেয়ে অয়নিকা অতুলকে পুণরায় বলে ,
-- একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে সংসারী হোস |
--- সেটা আর কোনদিন সম্ভব হবেনা | যে জায়গাটা তোকে দিয়েছি সেখানে অন্য কাউকেই আমি আর মেনে নিতে পারবোনা | তুই ভালো থাকিস | আমায় চিঠি লিখিস | হয়তো আমি তার উত্তর দিতে পারবোনা কারণ তুই একা নোস ও বাড়িতে | কিন্তু তোর লেখা পেলে আমি খুব ভালো থাকবো |
এটাই ছিল অতুল ও অয়নিকার শেষ দেখা ও শেষ কথা | এর প্রায় বছর দুয়েক পরে অতুল একটি চিঠি পায় অয়নিকার কাছ থেকে | আজও সে চিঠি সে অতি যত্নে রেখে দিয়েছে | মাঝে মাঝে এ বয়সে এসেও সে সেই চিঠি খুলে পরে | চিঠির কাগজ মলিন হয়েছে --- সাদা রংয়ের জায়গায় লাল আভা এসেছে --- অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়েছে --- কিন্তু একই চিঠি বারবার পড়ার ফলে অতুলের আজ তা মুখস্ত | তবুও সে আজও যত্নসহকারে সে চিঠি বের করে মোটা পাওয়ারের চশমার ভিতর দিয়ে পড়ে চলে |
অয়নিকার সেদিনের চিঠিতে অতুলের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল ---
অতুল ,
আমার জীবনে তোকে লেখা এটাই আমার প্রথম আর হয়তো শেষ চিঠি | আমার ছেলের বয়স এখন দুবছর | সেদিনের তোর , আমার ভালোবাসার ফসল | সবাই বলে ওকে দেখতে তোর মত | অবশ্য কথাটা সবাই এভাবে বলেনা | বলে , " ওকে দেখতে ওর মামার মত |" কথাটা খুব কানে বাজে আমার | ওদেরকে বলতে পারিনা আমার ছেলেকে দেখতে ওর বাবার মত | আমি জানিনা কারও জীবনে আমার জীবনের মত এরূপ কোন ঘটনা ঘটে কিনা | তবে তোর জন্য আমি মা ডাক শুনতে পাচ্ছি এটা যেমন সত্যি অন্যদিকে একটা সৎ সরল মানুষকে ঠকিয়ে চলেছি এটাও সত্যি | একটা মানুষ জীবনে দুটো মানুষকে একই সাথে ভালোবাসতে পারে কিনা জানিনা কিন্তু আমি সত্যিই একটা জীবনে দুটো পুরুষকেই ভালোবাসি | যার সাথে আমি আমার সন্তানকে নিয়ে সংসার করছি সেই মানুষটা এতোইটাই ভালো যে তাকে ভালো না বেসে পারা যায়না | হয়তো তাকে আমি ঠকিয়েছি কিন্তু আমি মনেকরি সবই বিধাতার লিখন | তিনি চেয়েছিলেন নারী জনম আমার সার্থক হোক মা ডাক শুনে কিন্তু সে ক্ষমতা আমার স্বামীর ছিলোনা | তাই হয়তো সেদিন তুই আর আমি ---- |
তুই আর কোনদিন দেশে ফিরবিনা বলে গেছিলি | তাই তোর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবেনা | আমি ভালো আছি আমার জীবনে তোর দেওয়া এই শ্রেষ্ঠ উপহার নিয়ে | ছেলেকে আশীর্বাদ করিস ওকে যেন আমি সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারি |
অয়নিকা |
তিয়াসার ছেলে অতীশ ডাক্তারি পাশ করার পর অতুলের কথামত সে লন্ডন পারি দেয় | অতুল তার প্রভাব খাটিয়ে নামী হাসপাতালে তাকে সুযোগ করে দেয় | বছরে একবার করে সে দেশে ফিরলেও অতুল আর কোনদিন দেশে ফিরে আসেনা | এখন প্রায় রোজই হোয়াটসআপ আর ফেসবুকের দৌলতে অয়নের মাধ্যমে তিয়াসার সাথে কথা হয় | এখন বিদেশবিভুঁই আর দূর নয় | লিজা এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার | এক সন্তানের মা | অতুল সকলেরই খবর রাখে তার পরিচিত বন্ধুবান্ধব মহলে কিন্তু রাখতে পারেনা শুধুমাত্র একজনেরই খবর সে অয়নিকা | অথচ প্রতিটা মুহূর্তে আজও তার কথা সে ভাবে |
অতীশের দেওয়া ঠিকানা দেখে একদিন সন্ধ্যায় প্রদ্যুৎ এসে উপস্থিত হয় তাদের বাড়ি | ফোনে আগেই যোগাযোগ করে নিয়েছিল | অতীশ ও তার মামা অতুল বাড়িতে বসেই জন্মভুমির অতিথির জন্য অপেক্ষা করছিলেন | ছবিতে নিজের চেহারা দেখে মানুষ সহজেই হয়তো নিজেকে চিনতে পারে | কিন্তু সামনাসামনি নিজের মত দেখতে অপর একজনকে দেখে চিনতে বা বুঝতে একটু সময় লাগে বৈকি | গল্পগুজব চলতে থাকে | সাথে খাওয়াদাওয়া |
--- ভারতে তোমাদের বাড়ি কোথায় বাবা ? কে কে আছেন সেখানে ?
--- আগে আমাদের বাড়ি ছিল কুচবিহার | কিন্তু চাকরির সুবাদে এখন আমি কলকাতা থাকি |
--- বাড়িতে আর কে আছেন ?
--- কেউনা --- | সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন |
অতীশ মাঝখানে বলে উঠলো ,
--- মামা , তোমার আগের চেহারার সাথে প্রদ্যুৎবাবুর চেহারার পুরো মিল | আর জানতো এই কারণেই উনাকে আমি এখানে আসতে বলেছিলাম |
আশি ছুঁইছুঁই অতীশ তখন চশমাটাকে ভালো করে মুছে নিয়ে ছেলেটির মুখের দিকে ভালোভাবে তাকালেন | 'হ্যাঁ ঠিক তাই | কোথায় যেন বললো বাড়ি ছিল ?'
--- তোমাদের বাড়িটা কোথায় ছিল বললে যেন ? তোমার বাবার নাম কি ? আর মায়ের নাম ?
--- আমার বাবার নাম সুব্রত মুখাৰ্জী আর মা অয়নিকা ---- |
কোন কথা অতুলের আর কানে ঢুকছেনা | অয়নিকার চিঠিতে বলা কথাগুলো তার মনে পড়ছে | ' প্রদ্যুৎ , প্রদ্যুৎ ' আমার আর অয়নিকার ছেলে --- | কি বললো ও ? ওর কেউ নেই ----? তারমানে অয়নিকা বেঁচে নেই ? কিন্তু নিজেকে যতটা সম্ভব সহজ করে জানতে চাইলো ,
--- কি হয়েছিল তোমার বাবা মার ?
--- একসিডেন্ট | ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল | সামনাসামনি একটা বাসের সাথে --- | দুজনেই স্পট ডেথ | চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই আমার পোস্টিং কলকাতা | আমি তখন সেখানে ছিলামনা ---
প্রদ্যুতের কথার মাঝেই অতীশ দেখে তার মামা ভীষণভাবে ঘামছে | শরীরটা কাঁপছে | সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে মামাকে পরীক্ষা করতে লাগলো | প্রদ্যুতের দিকে তাকিয়ে বললো ,
-- এক্ষুণি এডমিট করাতে হবে | আপনি আমাকে একটু হেল্প করুন | এম্বুলেন্স বাড়ির দোরগোড়ায় উপস্থিত | অতুল জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু কথা আর ইশারায় কিছু তার ভাগ্নে অতীশকে জানায় | অতীশ ছুঁটে গিয়ে মামার বেডরুমে ঢোকে | তন্নতন্ন করে খুঁজে আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করে তার ভিতর থেকে বহু পুরনো একটি খাম বের করে মামার হাতে দিতে যায় | কিন্তু অতুল ইশারায় অতীশকে বলেন ,' খামটাকে ছিঁড়ে ফেলে দিতে |' অতীশ মামার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে |
অতুলুল মুহুর্তের সময়টি তার আগস্ট সময় | চিঠী একদিন না একদিনের মতো পড়ুন | কেনে প্রসূত্রে | এটির জীবনটা কখন আসবে | আপনার পছন্দসই মূল্য তিনি মনে রাখবেন না অন্যদের পরামর্শ আজকের তার সুন্দর জগৎ তৈরি করা | এই শেষ মুহুর্তটি তিনি এসেছিলেন প্রসুতের শেষ সতর্কতুকু তাকে কিছুক্ষণ আগে চীনচিন্তে এসেছিল তেনাহলে তুমি ওপরে কি করে অনায়িকা জবাবদিহি কর্নার |
অবিশ্ব ও প্রুধু দুজন মিলে এম্বুলেন্সে থাকা দুজনে পোষাক বসলো | অমিতিষ মামার নাড়ি তার ডুকরে কেদেদে ওলোতে আওতার | আর প্রসূত হঠাৎ আচরণে কিছুটা হলেও কিছু না কিছু থম মেরে আসে ো এটির চোখের কোল বজ্র দুজনে দুফোটা অশ্রু গিগি পড়ো |
No comments:
Post a Comment