তুমি রবে নীরবে
ফুটবল খেলতে গিয়ে তনয়ের পা ভেঙ্গে যায় | সেই বছরই তার মাধ্যমিক দেওয়ার কথা | পাহাড়িয়া চত্বরে বাস তাদের | বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষক | কোনরকমে দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চলে | বহুবছর আগে তিনি যখন চাকরি পান তখন প্রথমেই তার পোস্টিং হয় ত্রিপুরা শহর থেকে অনেক দূরে খেদাছড়া গ্রামে | সেখানে বাস বলতে গেলে সবই পাহাড়ী আদিবাসীদের | বাঙালী একদম নেই যে তা কিন্তু নয় | আছে তা বেশ কয়েক মিটার অন্তর অন্তর | সেখানে অখিলবাবু এসে প্রথমে যে সমস্যায় পড়েছিলেন সেটা হল ভাষা | তার বড়ছেলের তন্ময়ের বয়স তখন তিনমাস | তবে আদিবাসী হলে হবে কি মাষ্টারমশাইকে তারা খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতো | আস্তে আস্তে সেখানকার মানুষজন , জল হাওয়ার সাথে তিনি এবং তার স্ত্রী বেশ মানিয়ে নিলেন | প্রথম অবস্থায় ভাঙাচোরা মাটির ঘরে থাকতে শুরু করলেও পরে তিনি স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে আর নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে যা তিনি এখানে আসবার সময় তার বাবা তাকে দিয়েছিলেন --- বেশ কয়েক কাঠা জমি কিনেছিলেন | তার স্ত্রী সেই জমিতে সব রকম সব্জি চাষ করতেন | আর তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতো মাস্টারমশাইয়ের ছাত্ররা | তন্ময়ের যখন ছবছর বয়স তখন তনয়ের জন্ম | দুইভাই স্বভাবচরিত্রে দুই মেরুর বাসিন্দা | তন্ময় ধীর , স্থির আর তনয় রাগী , বদমেজাজি | কিন্তু একদম যে মিল নেই তা কিন্তু নয় | মিল তাদের আছে - দুজনেই পরোপকারী | কারও বিপদের কথা শুনলেই সবার আগে তারা দুজনেই ছুঁটে যায় |
ফুটবল খেলার মাঠে তনয়ের পা ভেঙ্গে গেছে শুনে বাড়ির লোক পৌঁছানোর আগেই মাষ্টারমশাইয়ের ছেলেকে নিয়ে গ্রাম থেকে ততক্ষণে আদিবাসীরা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে | তন্ময় তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে | সে তখন রাজধানী শহরের একটি মেসে থাকে | ফোনের চল ছিলোনা সুতরাং তার কাছে খবরও পৌঁছায় অনেক দেরিতে | খবর পেয়ে সে বাড়িতে ফেরে | ততদিনে ভায়ের পা অপারেশন হয়ে গেছে | সে নিত্য হাসপাতালে যাতায়াত শুরু করে কয়েক ঘন্টা জার্নি করে | এই যাতায়াতের সুবাদেই তার ভালো লেগে যায় ওই হাসপাতালের নার্স গোপা বর্মনকে | ভালোলাগাটা উভয় পক্ষেই ছিল | গোপার দাদা সঞ্জয় আস্তে আস্তে হয়ে গেলো তন্ময়ের বন্ধু | কিন্তু গোপা আর তন্ময়ের সম্পর্কটা গোপার বাড়ির লোকে জানলেও তন্ময়কে বাড়ির কেউই জানতোনা | ভাই তনয় কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলো | সে খুব খুশিই ছিল | কারণ হাসপাতালে ভর্তির সময় গোপাদি তার খুব কেয়ার নিয়েছিল |
কিন্তু গোপা ও তন্ময়ের কথা যখন তন্ময়য়ের বাড়িতে জানলো তখন প্রচন্ড ঝামেলা তৈরী হল | সরলসাধা নরম স্বভাবের ছেলেটির উপর বাবা মা যেন হামলে পড়লেন | তারা কিছুতেই গোপার সাথে এই সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারলেননা | গোড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান অখিলবাবু | এতে তার বংশ মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে বলে তিনি মনে করেন | সাতদিনের মধ্যে তিনি তার তন্ময়ের বিয়ে ঠিক করেন | ততদিনে তন্ময় চাকরি পেয়ে গেছে | বাবা মায়ের সন্মান ক্ষুণ্ন হবে , সন্তান হিসাবে তাদের প্রতি তার দায়িত্ব আছে কারণ অনেক কষ্ট করে তিনি দুই ছেলেকে মানুষ করছেন | এইসব সাতপাঁচ ভেবে সে তার ভালোবাসাকেই বিসর্জন দেয় | কারণ তখনকার দিনের ছেলেমেয়েরা এখনকার দিনের ছেলেমেয়ের মত এতো অবাধ্য যেমন ছিলোনা ঠিক তেমনই বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে কোন কাজও করতোনা |
ফুলশয্যার রাতে তন্ময়ের পায়ের কাছে বসে নিজের সম্পর্কে যে কথা সে জানায় তাতে তন্ময় পুরো পাথর হয়ে যায় | তার বাবা মা তার ভালোবাসাকে মূল্য না দেওয়ার জন্য সাত তাড়না করে যার সাথে তার বিয়ে দিলো সে মেয়ের দুপাটিতে মোট চারটে দাঁত বাঁধানো | রোজ রাতে শোবার আগে তাকে দাঁত খুলে রাখতে হয় | তন্ময় তার জীবনে দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলো নূতন জীবন শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই | তবুও তার সরলতার সুযোগ সকলে সকল সময়ই নিতে লাগলো | বাবা মা তাকে চাপ দেন টাকার জন্য , বৌ মধুরিমা তাকে চাপ দেয় যাতে সে পুরো সংসার খরচের টাকা তার মায়ের হাতে না দেয় | সবদিক সামলাতে গিয়ে শরীরে এবং মনে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে শুরু করে | পারেনা যেমন বাবা মায়ের সাথে মন খুলে কথা বলতে ঠিক তেমনই পারেনা বৌ রিমার সাথে সব কথা শেয়ার করতে | কিন্তু মাঝে মধ্যে সে তার ভাই তনয়ের সাথে কিছু কিছু কথা অতি দুঃখে বলে ফেলে |
তন্ময়ের একটি মেয়েও হয় | পড়াশুনায় সে ভালো হলেও মনের দিক থেকে সে পুরোপুরি মায়ের মতই | তন্ময় সব দেখে বুঝেও কোন প্রতিবাদ করেনা বা করতে পারেনা | যা কিছু যুদ্ধ তার নিজের মনের পক্ষে বিপক্ষে |
বিয়ের পর গোপার সাথে আর কোন যোগাযোগ সে কোনদিনও করেনি | গোপার বিয়ে হয় তার বাড়ির পছন্দের ছেলে অনিমেষের সঙ্গে | চাকরির সুবাদে সে থাকে আমেরিকায় | বিয়ের পর গোপা চলে যায় আমেরিকায় | দাদা সঞ্জয় নিজের থেকে যেটুকু তন্ময়ের কথা তাকে কথাচ্ছলে জানাতো সেটুকুই সে চুপ করে শুনতো কিন্তু আগ বাড়িয়ে কোনদিনও সে কোন কথা জানতে চায়নি | বিয়ের প্রায় কুড়ি বছর পর গোপা বাড়িতে আসে | তন্ময়ের সাথে দেখা করতে মন চাইলেও বিবেক তাকে বাঁধা দিতো | খুব অপমান করেছিলেন একদিন তন্ময়ের মা তাকে | দেখা করার কথা মনে এলেই সিনেমার ফ্লাসব্যাকের মত সেই অপমানের ঘটনাটাও চোখের উপর ভাসতে থাকে |
একদিন সকালে গোপা যখন দাঁত ব্রাশ করছে তার বৃদ্ধ বাবা তাকে ডেকে পেপারটা হাতে দিয়ে বললেন , " ফাষ্টপেজে একটা খবরে আন্ডারলাইন করা আছে দেখ |" দাঁত মাজতে মাজতেই পেপারটায় চোখ বুলালো | একটা বিজ্ঞাপন | অর্থ সাহায্যের | মাথাটা ঘুরে গেলো | এতো বড় একজন মানুষ এতো অর্থ যার তার ট্রিটমেন্টের জন্য অর্থ সাহায্যের জন্য তার বৌ পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়েছে ?
কি করে পারলো এটা ? এতগুলো বছর ধরে যে মানুষটি চাকরি করে গেলো যে এতো বড় একজন ইঞ্জিনিয়ার তার ট্রিটমেন্টের জন্য লোকের কাছে হাত পাততে হচ্ছে ? ঐরূপ উদার প্রকৃতির একটা মানুষের স্ত্রীর এতো লোভ? কিন্তু যা সে ভাবলো সবই মনেমনে বাড়ির কেউই সেকথা জানলোনা | দুদিনের মধ্যে অনিমেষের কাছ থেকে টাকা এনে সে পেপারে উল্লিখিত একাউন্ট নম্বরে একটা মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে দিলো নামটা গোপন রেখেই | দাদা সঞ্জয়ের মাধ্যমে সে তন্ময়ের খবর নিতে লাগলো | রোজই সঞ্জয় তাকে জানায় কোন ইম্প্রুভ করছেনা | একদিন লজ্জা ভয় বিসর্জন দিয়ে সে সঞ্জয়কে বলেই বসলো তন্ময়কে দেখতে যাবে | সঞ্জয়ের প্রথমে খুব আপত্তি ছিল | কিন্তু বোনের এই বাহান্ন বছর বয়সে এসে একটা অসুস্থ্য মানুষকে যাকে কিনা একদিন সে তার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলো তাকে দেখতে গেলে এমন কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা বলেই সে মনে করলো | হঠাৎ করেই তো যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গেছিলো | মানুষটা এতো কষ্ট পাচ্ছে কে জানে হয়তো জীবনের এই শেষ মুহূর্তে গোপার জন্যই এখনো তার শ্বাস পড়ছে | নিয়ে গেলো সঞ্জয় গোপাকে | মেয়ে , স্ত্রী আর তনয় তিনজনেই রয়েছে | অনেকগুলো বছরের ব্যবধান হলেও তনয় ঠিক তার গোপাদিকে চিনতে পারে | কিন্তু ধরা দেয়না | বৌদি ও ভাইঝিকে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দেয় | মা মেয়েও তাড়াতাড়ি ফিরতে পেরে খুশিই হয় | মায়ের মত মেয়েও যে অর্থের কাঙ্গাল তা সকলেই বুঝতে পারে | তারা মানুষটিকে নয় তার প্রচুর অর্থকেই ভালোবাসে |
তনয় এগিয়ে এসে গোপাকে জিজ্ঞাসা করে ,
--- কেমন আছো দিদি ?
চোখ ভর্তি জল নিয়ে গোপা তনয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ,
--- আমি ভিতরে যাবো ?
--- হ্যাঁ নিশ্চয় |
গোপা আইসিউতে ঢোকে | পরিচিত একজন ডাক্তারের সাথে দেখা হয়ে যায় | নানান কথা প্রসঙ্গে গোপা জানতে পারে তন্ময়ের বাঁচার কোন আশা নেই | হার্টের অবস্থা খুবই খারাপ | আজ পনেরদিন ধরেই সে ভেন্টিলেশনে আছে | কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার উনি সবসময় চোখ বন্ধ করেই থাকেন অথচ উনার কিন্তু পুরো জ্ঞান আছে | আমাদের ডাকে চোখ খুলে তাকান ইশারায় কথার উত্তর দেন | কি হন তোমার ?
--- চিনতাম উনাকে |
--- যাও দেখে এসো
গোপা এগিয়ে যায় তন্ময়ের বেডের কাছে | কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তন্ময়ের মাথায় আলতো করে হাত রাখে | সঙ্গে সঙ্গেই তন্ময় চোখ মেলে | গোপার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে | চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নামতে থাকে | অতি কষ্টে গোপা নিজেকে সামলে রাখে কারণ গোপা জানে ও যদি কাঁদে তন্ময় আরও দুর্বল হয়ে পড়বে |
--- তুমি ঠিক সুস্থ্য হয়ে যাবে , একদম ভেবোনা | ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন |
তন্ময়ের হাতে অজস্র চ্যানেল করা , চেষ্টা করলো সে দুটো হাত জড়ো করে তার কাছে ক্ষমা চাইতে কিন্তু হাত সে উঁচু করতেই পারলোনা | গোপা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আর সঙ্গে সঙ্গেই তন্ময় তার চোখদুটি বন্ধ করলো যে চোখ আর সে খুললোনা , চলে গেলো সেদিন রাতেই চিরতরে | সঞ্জয় খবর পেয়ে ছুঁটে বেরিয়ে গেলো | সব কাজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরলো গোপাকে ঘরের ভিতর কোথাও দেখতে না পেয়ে ছাদে উঠে গেলো | গোপা অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে কেঁদে চলেছে |
--- নিচুতে চল | তোর বৌদি এখনো জেগে আছে | যেকোন সময় ছাদে চলে আসবে |
আকাশের দিকে তাকিয়েই গোপা নির্লিপ্তভাবে সঞ্জয়কে বললো ,
--- আমরা তো কোন অপরাধ করেছিলাম না তবে কেন আমাদের সাথে এরূপ হল ?
--- এসব কথা আর কোনদিন মাথায় আনিসনা | এতো ভালো মানুষটা জীবনে কোনদিন শান্তি পেলোনা এটাই কষ্টের | তন্ময় তার পরিবারের কাছে ছিল অর্থ উপার্জনের একটা যন্ত্র মাত্র | বৌ , মেয়ে দুজনেই অর্থের কাঙ্গাল আর মাসিমাও তাকে এই টাকাপয়সা নিয়ে কম কথা শোনাননি | মেসোমশাই যদিও কিছুটা বুঝতেন কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর তন্ময় একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল | কাউকে না বলতে পারা সারাজীবনের জমাট কষ্ট --- | তিলেতিলে ওকে শেষ করে দিয়েছে | সংসারের কোন কথা তো বলতো না কিন্তু একদিন আক্ষেপ করে আমায় বলেছিলো ," না পারলাম ভালো স্বামী হতে না পারলাম ভালো সন্তান হতে |" জীবনের প্রতি কতটা আক্ষেপ থাকলে মানুষ এই খেদোক্তি করতে পারে সেটা বুঝতে পারিস? তবে মানুষ তার ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে | সেখানে কারও কোন হাত নেই | এটাই ভবিতব্য |
হঠাৎ সঞ্জয় বলে ওঠে , " তোর বৌদি আসছে | চোখের জল মোছ নিচুতে চল | যেমন ভুলে ছিলি সেই রকমই ভুলে থাকার চেষ্টা করিস " সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে গোপা আস্তে আস্তে বললো ," সত্যিই কি ভুলে ছিলাম দাদা ?"
শেষ
No comments:
Post a Comment