একটা সুটকেসে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নন্দিনী তার তিনবছরের বিবাহিত জীবন থেকে বেরিয়ে পড়লো | কোথায় যাবে , কার কাছে উঠবে কিছুই বুঝতে পারছেনা | অনেক চেষ্টা করেছিল সবকিছু মানিয়ে নিয়ে বহু কষ্টে পাওয়া চাকরিটাকে বাঁচাতে | কিন্তু ও বাড়িতে থাকতে গেলে চাকরি কিংবা সংসার এরমধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নিতে হবে | নন্দিনী অনেক ভেবেচিন্তে চাকরিটাকেই বেছে নিয়েছে | বাপের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই | বিয়ের দুবছর আগেই বাবা চলে গেছেন | আর এই বছরখানেক হল মা ও চিরবিদায় নিয়েছেন | ভাই বিয়ে করেছে মা থাকতেই তার বিয়ের পরপরই | তার নিজের পছন্দ করা মেয়ে | ভায়ের বিয়ের বেশ কয়েকদিন পর বাপের বাড়িতে গিয়ে ভাইবৌকে দেখে নন্দিনী বুঝেছিলো মাকে সে ঠিক মেনে নিতে পারছেনা | মাকে দিয়েই সে সব কাজ করায় তবুও মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার সে করেনা | তারপর ফোনেই মায়ের খবর নিতো | বিয়ের ছমাস পরেই জয়েনিং লেটার বাড়িতে এসেছিলো | ভাই এসে তার শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে গেছিলো | এই ছটামাস তার বেশ ভালোই কেটেছিল |কিন্তু এই চাকরি নিয়ে প্রথম থেকেই ছিল শ্যামল আর তার মায়ের সাথে ঝামেলা | তাই মাকে নিজের কাছে আনার ইচ্ছা থাকলেও তা করে উঠতে পারেনি | আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন তাহলে তার আর কোন চিন্তা ছিলোনা | কলকাতা শহরে একা একটি মেয়েকে ঘরভাড়াও কেউ দিতে চাইবেনা | নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে | কিন্তু প্রতিনিয়ত সংসারের ঝামেলা তার আর ভালো লাগছিলোনা | শ্যামল তো রীতিমত হুমকি দিলো তিনদিনের মধ্যে হয় চাকরি ছাড়তে হবে নুতবা এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে |
নন্দিনী সরকারি প্রাইমারি স্কুলে বজবজ সন্তোষপুরে চাকরি পেয়েছিলো | সন্তোষপুর স্টেশনে নেমে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ | একটু গ্রাম্য এড়িয়া |থাকতো বেহালা ঠাকুরপুকুরে | প্রথমদিন জয়েন করেই সহকর্মী কঙ্কনার সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিলো | সেও ডিভোর্সি | একাই থাকে | স্কুলের খুব কাছেই একটা ঘরভাড়া নিয়ে সে থাকতো | ঠাকুরপুকুর থেকে একটা উবের ধরে মাঝেরহাট স্টেশনে আসে ট্রেন ধরবার জন্য | উবেরে বসেই সে কঙ্কনাকে ফোন করে | কঙ্কনা তার সমস্ত কথাই জানতো | কঙ্কনা তাকে আশ্বাস দেয় "কোন অসুবিধা হবেনা তুই চলে আয় দুজনে একজায়গায়ই থাকবো |"
বিয়ের সময় নন্দিনী শুনেছিলো তার একটি ননদ আছে | যে অস্ট্রেলিয়া থাকে | শ্বশুরমশাইয়ের দুই বিয়ে | প্রথম পক্ষে একটি মেয়ে হয় | নাম তার মধুরিমা | দশ বছর বয়সে তার মা মারা যান | তখন থেকেই সে হোস্টেলে হোস্টেলে মানুষ | নিজের যোগ্যতায় সে অট্রেলিয়ান এম্বাসিতে চাকরি জুঠিয়ে নেয় | সেখানেই পরিচয় তার রবার্ট এডামসনের সঙ্গে | প্রেম থেকে বিয়ে পরে পাকাপাকিভাবে অস্ট্রেলিয়ায় পারি দেওয়া | ভায়ের বিয়ে , বাবার মৃত্যু সে আর দেশে ফেরেনি | মন থেকে সে কোনদিনও বাবার দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেনি | আর এই কারণেই ইচ্ছাকৃত এই সম্পর্কটা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলো | বহুবছর পর সে দেশে ফিরে আসে তাও তার স্বামীর ব্যবসার প্রয়োজনে | বিয়ের পরে সে এম্বাসির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলো কারণ রবার্ট একা তার ব্যবসা সামলাতে পারছিলোনা | ফাইভস্টার হোটেলেই ছিল দুজনে | কিন্তু মধুরিমার খুব ইচ্ছা করছিলো একটু নিজের বাপের বাড়ির পাড়ায় যেতে | পুরনো যদি কারও সাথে দেখা হয়ে যায় --- আর এই আশা নিয়েই সে হাজির হয় তার ঠাকুরপুকুর বাপের বাড়ির পাড়ায় | তার পোশাকআশাক চালচলন দেখে কেউই তাকে চিনতে পারেনা | আপনমনে পরিচিত রাস্তা দিয়ে মনের খুশিতে হেঁটে চলেছিল | এই রাস্তাঘাট দোকানপাট তার ভীষণ পরিচিত | হঠাৎ একজন বৃদ্ধাকে দেখে সে দাঁড়িয়ে পরে | একদম ভদ্রমহিলার সামনে | বৃদ্ধা প্রথমে একটু হকচকিয়ে যান মেমসাহেবের মত দেখতে একজন অপরিচিত তার রাস্তা আগলে দাঁড়াতে | মধুরিমা নিচু হয়ে তাকে প্রণাম করে |
--- আরে কর কি কর কি ?
--- তুমি আমায় চিনতে পারছোনা কাকিমা ?
--- না মানে তুমি কে মা ?
--- একটু ভালো করে মুখটা দেখো তো -- এই ভ্রুর ওপরের কাটা দাগটা দেখো -
মধুরিমা মুখটা নামিয়ে বৃদ্ধার মুখের সামনে নিচু হয়ে ভ্রুতে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় | বৃদ্ধা নিজের ভ্রুদুটি একটু কুঁচকে নিয়ে মধুরিমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন ,
--- রিমা তুই ? কতদিন পরে দেখলাম | কবে এসেছিস ? জামাই আসেনি ?
-- তোমায় দেখতে পেয়ে কি ভালো যে লাগছে কি বলবো | আগে চলো তোমার বাড়িতে যাই তারপর সব কথা |
মধুরিমার মা যখন মারা যান তখন পাড়ার এই কাকিমার কাছেই সে কিছুদিন ছিল | কারণ তার বাবার ছিল অফিস | একা তাকে বাড়িতে রেখে তিনি অফিস করতে সাহস পেতেননা | রমা কাকিমা আর মধুরিমার মা দুজন ছিলেন বন্ধু | সেই সুবাদে রমাকাকিমা মধুরিমাকে খুবই ভালোবাসতেন | আর তখনও পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিঃসন্তান | বিয়ের প্রায় দশবছর পরে তার একটি ছেলে হয় | এখন অবশ্য বিয়ে করে সে ছেলে ঘোর সংসারী | মাকে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করে , যত্ন করে |
কাকিমার ঘরে ঢুকে পুরনো অনেক কথাই মধুরিমার মনে পড়তে লাগলো | কাকিমার ঘরটা সেই আগের মতই রয়েছে | দরজার উপরে কাকুর একটা বেশ বড় ছবি বাঁধানো | কাকিমার কাছে জানতে পারলো ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক হয়ে বছর তিনেক আগে তিনি চিরতরে চলে গেছেন | অনেক কথার মাঝে কাকিমা মধুরিমার বাপের বাড়ির প্রসঙ্গ তুললেন এবং একে একে সে বাড়ির সমস্ত ঘটনা জানালেন | শ্যামল আর তার মা কেন যে নন্দিনীকে চাকরিটা করতে দিতে চাইছিলেন না তারও একটা সম্ভাব্য কারণ বললেন | নন্দিনী ঠিকই করেছে --- চাকরি বাঁচাতে এই ছাড়া তার আর কোন উপায়ও ছিলোনা | নন্দিনীর অনেক গল্প করলেন রমাকাকিমা | গল্প শুনতে শুনতে তাকে দেখার একটা আগ্রহ তৈরী হল মধুরিমার ভিতর | সারাটাদিন সেখানে কাটিয়ে নন্দিনীর স্কুলের ঠিকানাটা নিয়ে সে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এলো কিন্তু সে তার বাবারবাড়ির দিকে আর গেলোনা |
পরেরদিন মধুরিমা নন্দিনীর স্কুলে গিয়ে হাজির হল | আজ সে শাড়ি পরেই গেছিলো | নন্দিনীর সাথে তার পরিচয় হল | একে অপরকে প্রথম দেখেই দু তরফ থেকে দুজনেই আপন করে নিলো | কিন্তু কি এক আকর্ষনে মধুরিমা নন্দিনীর সাথে দেখা করতে গেছিলো তা সে নিজেই জানেনা | অনেকক্ষণ দুজনের গল্প হল | নন্দিনী তার জীবনকাহিনী তাকে পুরোটাই জানালো | শেষে বললো ,
--- কেন কিসের জন্য তারা আমার চাকরি করা পছন্দ করলেননা শুধু সেটা খুব জানতে ইচ্ছা করে |
--- আমি পুরোটাই জানি |
--- তুমি তো এখানে ছিলেই না তুমি কি করে জানবে ?
--- তাহলে শোনো ---| আমার বাবা চাকরি করতেন বেশ বড় একটা কোম্পানিতে | উনি যাকে এখন স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে এনেছেন সেই ভদ্রমহিলা বাবার সহকর্মী ছিলেন | উনার সাথে বাবার একটা সম্পর্ক ছিল | তাই মায়ের মৃত্যুর পর বাবা উনাকেই সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তোলেন | এখন ওই মহিলার ভয় তুমিও যদি সেরূপ কিছু করো | তাই তোমার চাকরি করা উনি পছন্দ করেননা | তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছো | নিজ পায়ে দাঁড়ানো প্রত্যেকটা মেয়ের দরকার |
--- কিন্তু তুমি এতো কথা কি করে জানলে দিদি ?
--- ওই পাড়ার এক কাকিমার কাছে জেনেছি | সবকিছু জানার পর তোমার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছা করছিলো | তাই চলে এলাম |
--- আমারও খুব ভালো লাগছে তুমি আসাতে | আমার তো এই পৃথিবীতে কেউ নেই | এখন একটা দিদি পেলাম |
---এটা সবসময় মনে রাখবে | বাপের বাড়ির দিক থেকে আমিও একা | বহুবছর পর এই দেশে আসা বিশেষ কাজে | কিন্তু দেখো বাপের বাড়িতে গেলামনা ঠিকই কিন্তু পাড়ায় গিয়ে ঘুরে বেড়ালাম | সে এক অদ্ভুত অনুভূতি পরিচিত রাস্তাঘাট দেখে |
অনেকক্ষণ স্কুল মাঠে বসে দুজনে গল্প করলো | ভার্চুয়াল জগতে বন্ধু হল | তারপর সন্ধ্যা গড়াতে মধুরিমা হোটেলে ফিরে গেলো এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও নিয়ে যেকোন বিপদ আপদে দুজন দুজনের পাশে থাকবে |
তারপর কেটে গেছে তিনবছর | যোগাগাযোগটা ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে রোজই হয় | রবার্টের সাথেও ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে | হঠাৎ একদিন মধুরিমা নন্দিনীকে জানায় রবার্টের স্ট্রোক হয়েছিল হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই চিরতরে চলে গেছে | মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে সে এসেছে কিন্তু বেশিদিন তার কাছে থাকতে পারবেনা | তাকে ফিরে যেতে হবে শ্বশুরবাড়িতে তাড়াতাড়ি | ব্যবসা সে একা সামলাতে পারবেনা | যদি নন্দিনী তার কাছে যেতো বাকি জীবনটা দুবোনে একসাথে কাটিয়ে দিত | নন্দিনী আপত্তি করেনা | চাকরি ছাড়তেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধও করেনা | কারণ প্রথম দেখাতেই মধুরিমাকে তার খুব আপন মনে হয়েছিল | যে চাকরির জন্য সে শ্বশুরবাড়ি এমন কি স্বামীকে পর্যন্ত ত্যাগ করেছিল আজ শুধুমাত্র মনের মত একটা সম্পর্কের ভীত মজবুত করতে এককথায় চাকরি ছেড়ে দিলো |মধুরিমা টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেয় | নন্দিনী তার জন্মভূমি ছেড়ে একটু সঙ্গের আশায় পারি দেয় অস্ট্রেলিয়া | সঙ্গ হয়তো অনেকেই তাকে এখানেও দিতো কিন্তু সেই সংগই মানুষের ভালো লাগে যেখানে মনের মিল থাকে | মধুরিমার সাথে একদিনের পরিচয়ে সে সেটা ভালোভাবেই বুঝেছিলো আর তাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলো ওই অল্প সময়ে | তাই মনের মাঝে কোন দ্বিধা না রেখেই নিজের সরকারি চাকরি ছেড়ে মনের জোরে অন্যের প্রতি মনের টানে ছুঁটে গেলো |
অনেকগুলো বছর কেটে গেছে তারপর | মধুরিমার এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে | ব্যবসাপাতি নন্দিনীই দেখাশুনা করে | মধুরিমা তাকে ঠিক সেইভাবে তৈরী করে নিয়েছে | নন্দিনীর মনটা মাঝে মাঝে উদাস হয় ঠিকই কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য | জীবনে এতবড় আঘাত না পেলে সে জানতেই পারতোনা রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও মানুষ কতটা আপন হয়ে উঠতে পারে |
No comments:
Post a Comment