মুছে ফেলা যাবেনা |
কিন্তু জীবনে দেখা স্বপ্নগুলো সবকিছু যেন তছনছ হয়ে গেলো | সেই চাকরি হল ঠিকই কিন্তু কয়েকটা মাস আগে হলে হয়তো জীবন থেকে অয়নিকাকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হতনা | সে তো ভেবেছিলো একবার শিলিগুড়ি গিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখবে | কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি সেখানে গিয়ে ফিরে এসে চাকরিতে জয়েন করার সময় পেরিয়ে যাবে | তাকে আগামীকাল থেকেই চেষ্টা করতে হবে দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি |
দুদিন পরেই অতুল চলে গেলো দিল্লিতে চাকরির জন্য | যাওয়ার আগে বারবার করে মাকে বলে গেলো শিলিগুড়িতে পৌঁছেই যেন মা তাকে ফোন করেন সে অফিসে জয়েন করেই অফিসের ফোন নম্বর পাঠিয়ে দেবে পৌছোসংবাদের সাথে | মেসোকে দিয়ে পরিচিত কোন দোকান থেকে সেদিনই যেন খবরটা তাকে দেওয়া হয় | কারণ সে খুব চিন্তায় থাকবে | দিল্লি পৌঁছে পরদিন অফিসে গিয়ে সে যা জানলো তাতে বুঝতে পারলো ছমাসের মধ্যেই তাকে কোম্পানি লন্ডন পাঠাবে |নূতন চাকরি , নূতন পরিবেশ | সময় কেটে যায় বেশ | যখন সারাদিন সে অফিসে থাকে তখন যেমন তেমন কিন্তু রাতে শুতে গেলেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অয়নিকার মুখ | অয়নিকার বিয়ের বিস্তারিত সে মায়ের চিঠিতেই জেনেছে | ভগবানের কাছে তার একটাই প্রার্থনা এখন অয়নিকা যেন খুব সুখী হয় | সে যেন তাকে ভুলে যায় |
এদিকে তাকে ছমাসের মধ্যেই লন্ডন চলে যেতে হবে শুনে মা তাকে বিয়ের কথা বলেন | কিন্তু অতুল চিঠিতে মাকে জানায় এখন নূতন চাকরি কোথায় কখন থাকবে তার ঠিক নেই এই মুহূর্তে সে বিয়ে নিয়ে ভাবছেনা | মা তাকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু অতুল কিছুতেই রাজি হয়না | চাকরির যখন পাঁচ কি সাড়ে পাঁচমাস বয়স তখন তাকে কোম্পানি বিশেষ কাজের জন্য তাকে লন্ডন পাঠিয়ে দেয় | সব ব্যবস্থা পাকা করেই দুদিন আগে কোম্পানি তার হাতে টিকিট ধরিয়ে দেয় | অসহায় হয়ে পরে অতুল | ভেবেছিলো বাইরে যাওয়ার আগে একবার কলকাতা এসে মা বাবার সাথে দেখা করে যাবে | কিন্তু এখন তো কোনোই উপায় নেই আর |
কেটে গেছে এরপর তিনবছর | অতুলকে ব্রিটিশ কোম্পানি তাদের সেখানকার মেইন ব্রাঞ্চ থেকে আর ছাড়েনি | হঠাৎ একদিন টেলিগ্রাফ মারফৎ জানতে পারে বাবার মৃত্যু সংবাদ | অনেক কষ্টে ছুটি ম্যানেজ করে পনেরদিনের জন্য অতুল কলকাতা আসে | মায়ের কাছে জানতে পারে অয়ন তার বাবার মুখাগ্নি করেছে | দুই বন্ধুরই পদবি ও গোত্র এক হওয়ার কারণে ঠাকুরমশাই এই বিধান দিয়েছিলেন | পারলৌকিকক্রিয়া অতুল করলেও অয়নকেও শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী কিছু কাজ করতে হয় | বাবার কাজে মাসি , মেসো আসলেও অয়নিকা আসেনা | অতুল অয়নিকা সম্পর্কে শুধু একটা কথায় জানতে চায় তার মাসির কাছে 'সে কেমন আছে |' আর কোন কথায় অতুল কারও কাছে তার সম্পর্কে জানতে চায়না | মা আর মাসির মধ্যে তাকে নিয়ে কোন কথা উঠলেই অদ্ভুতভাবে সে সেখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় |
তিয়াসা তার শ্বশুরবাড়িতে খুব সুখেই আছে | ছোট্ট ফুটফুটে তিনবছরের একটি ছেলেকে নিয়ে সকলে হিমশিম খাচ্ছে | আর এদিকে অতুল লিজার যে দায়িত্ব নিয়েছিল তা সে আজও পালন করে চলেছে | প্রতিমাসেই সে তার পড়াশুনার খরচ তার বাবার একাউন্টে পাঠিয়ে দেয় | দেখতে দেখতে তার ফিরে যাওয়ার সময় এসে যায় | বারবার মাকে অনুরোধ করে তার সাথে যাওয়ার জন্য | কিন্তু তার মা স্বামী , শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে যেতে কিছুতেই রাজি হননা | তিনিও বারবার তাকে বিয়ের কথা বলেন | অতুল তাকে বলে , " বাবার চলে যাওয়ার একবছরের মধ্যে এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো |"
খুব একা হয়ে পড়েন অতুলের মা | মাঝে মাঝে তিয়াসা তার ছেলেটাকে নিয়ে তার কাছে এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় | একদিকে সংসার , ভীষণ দুষ্টু ছেলে , তার বৃদ্ধা মা আবার অতুলের মা অথাৎ তার মাসিমা | আপ্রাণ চেষ্টা করে সবদিকে তাল রেখে চলবার | কারণ দাদার ( অতুল ) ঋণ সে সারাজীবন ধরেও শোধ করতে পারবেনা | আর এ ব্যাপারে অয়ন তাকে ভীষণ সাহায্যও করে |
বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায় | লিজা এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে | অতুল তার বলা কথা আজও পালন করে চলেছে | মাকেও সে নিয়মিত টাকা পাঠায় কিন্তু অতুলের বাবা যে মোটা অঙ্কের পেনশন পান তাতেই তার বেশ ভালোভাবেই চলে যায় | সুতরাং ছেলের পাঠানো টাকায় তার হাত দিতে হয়না | অতুল দুএক বছর অন্তর মায়ের কাছে এসে কিছুদিন থেকে আবার চলে যায় তার কর্মস্থলে | মায়ের জিদ তিনি অতুলের সাথে যাবেননা আর অতুলের জিদ সে বিয়ে করবেনা | এইনিয়ে একদিন মায়ের সাথে তুমুল তর্কতর্কি হয় তার | আর সেদিনই রাতে মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়ে পরে | সঙ্গে সঙ্গে অতুল তাকে কলকাতার নামি নার্সিংহোমে ভর্তিও করে | কিন্তু তিনি আর ফেরেননা |
পারলৌকিকক্রিয়ার আগেরদিন মাসি আর মেসোর সাথে অয়নিকাও আসে তার মাসির কাজে | অয়নিকার পরনে ছিল একটা হলুদ শাড়ি যা সে দিল্লি যাওয়ার আগে মায়ের কথামত তার আইবুড়োভাত খাওয়ানোর জন্য নিজে পছন্দ করে কিনে এনে দিয়েছিলো | অতুল তাকে দেখতে পেয়ে বললো ,
--- কেমন আছিস ?
মাথা নাড়িয়ে অয়নিকা 'হ্যাঁ' জানায় | ব্যস আর কোন কথা কেউ বলেনা | শ্রাদ্ধ , নিয়মভঙ্গ সব মিটে গেলো | তিয়াসা তার ছেলেটিকে নিয়ে সবসময়ের জন্যই ছিল | শুধু রাতেরবেলাটুকু সে বাড়িতে গেছে | লিজারাও এই কাজে অতুলের পাশে থেকেছে সবসময় | সব কাজ মিটে যাওয়ার পরের পরদিন সবাই মিলে বিকালের দিকে তিয়াসাদের বাড়ি যায় | অয়নিকা তার শরীর খারাপের অজুহাতে বাড়িতেই থেকে যায় | অতুলও সেদিন বাড়িতেই নিজের ঘরে থেকে যায় | সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অয়নিকা আস্তে আস্তে এসে অতুলের খাটের উপর বসে | অতুল ধড়মড় করে উঠে বসে বলে ,
--- তুই ? তুই ওবাড়িতে যাসনি ?
--- না , তোর সাথে কথা আছে |
--- কি কথা বল --- | তবে একটা কথা আমি আগে বলি, তোকে ভালোবাসতাম এখনো বাসি --- আজীবন বাসবো -- কিন্তু তুই এখন বিবাহিত | এমনকিছু কথা আমাদের মধ্যে আর হতে পারেনা যেখানে অনুপস্থিত থেকেও তোর স্বামীকে অপমান করা হয় |
অয়নিকা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় |
--- কি হল কি ? কি বলবি বলছিলি ?
--- তোকে কিছু বললে আমার স্বামীকে অসম্মান করা হবে কিনা আমি জানিনা তবে তুই আমাকে নিজের অজান্তেই খুব নিচুতে নামিয়ে দিলি --- | শুধু তুই একা না আজও আমি তোকে ভালোবাসি -- তাই হয়তো আমার বিবাহিত জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো আমি সেভাবে গ্রহণ করতে পারিনি --- | তোকে ভালোবেসে পাপ করেছি কিনা জানিনা তবে ঠিক করিনি বা আমি মনেকরি অন্যায় করেছি | প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে অন্যের কাছে ছোট মনেহয় | এতগুলো বছর বিয়ে হয়েছে আজও আমি মা হতে পারিনি --- হয়তো একটা সন্তান থাকলে আমি তাকে নিয়েই তোকে ভুলে থাকতে পারতাম | যে মানুষটাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেছি সে অত্যন্ত সরলসাদা , ভালোমানুষ | যেহেতু তোর বাস আমার অন্তরে তাই আমি মনেকরি প্রতিটা মুহূর্তে আমি তাকে ঠকিয়ে চলেছি |
অতুল চুপ করে থাকে | কিন্তু মনের ভিতর তার ঝড় বয়ে চলেছে | মুখে বড় বড় কথা বললেও এই নির্জন বাড়িতে অয়নিকাকে তার ভীষণভাবে নিজের করে পেতে ইচ্ছা করছে | আস্তে আস্তে তার সংযমের বাঁধ ভাঙ্গতে শুরু করে |
--- তুই ভালো থাকিস অতুল | মাসি , মেসো আজ নেই | এবার তুই একটা বিয়ে কর সংসারী হ | আর এই কথাটা বলার জন্যই আমি তোর কাছে এসেছিলাম |
অয়নিকা উঠে দাঁড়ায় | অতুল তার হাত ধরে টান দেয় | অয়নিকা তাল সামলাতে না পেরে অতুলের বুকের উপর পরে যায় | অতুল তাকে দুহাতে বুকের সাথে চেপে ধরে | মিশে যায় দুজনের নিঃশ্বাস একই সাথে যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলোনা হয়তো দুজনের মন ও শরীর নিজেদের অজান্তেই নিজেদেরকে কাছে পেতে চাইছিলো | এতো বছরের পর শরীর ও মনের আহিনখায় দুজনেই হারিয়ে গেলো অজানা এক সমুদ্রে দুজনাই পরস্পরের কাছে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিলো | ' বিধাতার লিখন না যায় খণ্ডন ---' নুতন কিছুর জন্য আজকের দিনটাও যেন তিনিই ঠিক করে রেখেছিলেন |
দুদিন পরেই যে যার গন্তব্যে চলে গেলো | চলে যাওয়ার আগে কোন একফাঁকে একটু সুযোগ পেয়ে অয়নিকা অতুলকে পুণরায় বলে ,
-- একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে সংসারী হোস |
--- সেটা আর কোনদিন সম্ভব হবেনা | যে জায়গাটা তোকে দিয়েছি সেখানে অন্য কাউকেই আমি আর মেনে নিতে পারবোনা | তুই ভালো থাকিস | আমায় চিঠি লিখিস | হয়তো আমি তার উত্তর দিতে পারবোনা কারণ তুই একা নোস ও বাড়িতে | কিন্তু তোর লেখা পেলে আমি খুব ভালো থাকবো |
এটাই ছিল অতুল ও অয়নিকার শেষ দেখা ও শেষ কথা | এর প্রায় বছর দুয়েক পরে অতুল একটি চিঠি পায় অয়নিকার কাছ থেকে | আজও সে চিঠি সে অতি যত্নে রেখে দিয়েছে | মাঝে মাঝে এ বয়সে এসেও সে সেই চিঠি খুলে পরে | চিঠির কাগজ মলিন হয়েছে --- সাদা রংয়ের জায়গায় লাল আভা এসেছে --- অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়েছে --- কিন্তু একই চিঠি বারবার পড়ার ফলে অতুলের আজ তা মুখস্ত | তবুও সে আজও যত্নসহকারে সে চিঠি বের করে মোটা পাওয়ারের চশমার ভিতর দিয়ে পড়ে চলে |
অয়নিকার সেদিনের চিঠিতে অতুলের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল ---
অতুল ,
আমার জীবনে তোকে লেখা এটাই আমার প্রথম আর হয়তো শেষ চিঠি | আমার ছেলের বয়স এখন দুবছর | সেদিনের তোর , আমার ভালোবাসার ফসল | সবাই বলে ওকে দেখতে তোর মত | অবশ্য কথাটা সবাই এভাবে বলেনা | বলে , " ওকে দেখতে ওর মামার মত |" কথাটা খুব কানে বাজে আমার | ওদেরকে বলতে পারিনা আমার ছেলেকে দেখতে ওর বাবার মত | আমি জানিনা কারও জীবনে আমার জীবনের মত এরূপ কোন ঘটনা ঘটে কিনা | তবে তোর জন্য আমি মা ডাক শুনতে পাচ্ছি এটা যেমন সত্যি অন্যদিকে একটা সৎ সরল মানুষকে ঠকিয়ে চলেছি এটাও সত্যি | একটা মানুষ জীবনে দুটো মানুষকে একই সাথে ভালোবাসতে পারে কিনা জানিনা কিন্তু আমি সত্যিই একটা জীবনে দুটো পুরুষকেই ভালোবাসি | যার সাথে আমি আমার সন্তানকে নিয়ে সংসার করছি সেই মানুষটা এতোইটাই ভালো যে তাকে ভালো না বেসে পারা যায়না | হয়তো তাকে আমি ঠকিয়েছি কিন্তু আমি মনেকরি সবই বিধাতার লিখন | তিনি চেয়েছিলেন নারী জনম আমার সার্থক হোক মা ডাক শুনে কিন্তু সে ক্ষমতা আমার স্বামীর ছিলোনা | তাই হয়তো সেদিন তুই আর আমি ---- |
তুই আর কোনদিন দেশে ফিরবিনা বলে গেছিলি | তাই তোর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবেনা | আমি ভালো আছি আমার জীবনে তোর দেওয়া এই শ্রেষ্ঠ উপহার নিয়ে | ছেলেকে আশীর্বাদ করিস ওকে যেন আমি সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারি |
অয়নিকা |
তিয়াসার ছেলে অতীশ ডাক্তারি পাশ করার পর অতুলের কথামত সে লন্ডন পারি দেয় | অতুল তার প্রভাব খাটিয়ে নামী হাসপাতালে তাকে সুযোগ করে দেয় | বছরে একবার করে সে দেশে ফিরলেও অতুল আর কোনদিন দেশে ফিরে আসেনা | এখন প্রায় রোজই হোয়াটসআপ আর ফেসবুকের দৌলতে অয়নের মাধ্যমে তিয়াসার সাথে কথা হয় | এখন বিদেশবিভুঁই আর দূর নয় | লিজা এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার | এক সন্তানের মা | অতুল সকলেরই খবর রাখে তার পরিচিত বন্ধুবান্ধব মহলে কিন্তু রাখতে পারেনা শুধুমাত্র একজনেরই খবর সে অয়নিকা | অথচ প্রতিটা মুহূর্তে আজও তার কথা সে ভাবে |
অতীশের দেওয়া ঠিকানা দেখে একদিন সন্ধ্যায় প্রদ্যুৎ এসে উপস্থিত হয় তাদের বাড়ি | ফোনে আগেই যোগাযোগ করে নিয়েছিল | অতীশ ও তার মামা অতুল বাড়িতে বসেই জন্মভুমির অতিথির জন্য অপেক্ষা করছিলেন | ছবিতে নিজের চেহারা দেখে মানুষ সহজেই হয়তো নিজেকে চিনতে পারে | কিন্তু সামনাসামনি নিজের মত দেখতে অপর একজনকে দেখে চিনতে বা বুঝতে একটু সময় লাগে বৈকি | গল্পগুজব চলতে থাকে | সাথে খাওয়াদাওয়া |
--- ভারতে তোমাদের বাড়ি কোথায় বাবা ? কে কে আছেন সেখানে ?
--- আগে আমাদের বাড়ি ছিল কুচবিহার | কিন্তু চাকরির সুবাদে এখন আমি কলকাতা থাকি |
--- বাড়িতে আর কে আছেন ?
--- কেউনা --- | সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন |
অতীশ মাঝখানে বলে উঠলো ,
--- মামা , তোমার আগের চেহারার সাথে প্রদ্যুৎবাবুর চেহারার পুরো মিল | আর জানতো এই কারণেই উনাকে আমি এখানে আসতে বলেছিলাম |
আশি ছুঁইছুঁই অতীশ তখন চশমাটাকে ভালো করে মুছে নিয়ে ছেলেটির মুখের দিকে ভালোভাবে তাকালেন | 'হ্যাঁ ঠিক তাই | কোথায় যেন বললো বাড়ি ছিল ?'
--- তোমাদের বাড়িটা কোথায় ছিল বললে যেন ? তোমার বাবার নাম কি ? আর মায়ের নাম ?
--- আমার বাবার নাম সুব্রত মুখাৰ্জী আর মা অয়নিকা ---- |
কোন কথা অতুলের আর কানে ঢুকছেনা | অয়নিকার চিঠিতে বলা কথাগুলো তার মনে পড়ছে | ' প্রদ্যুৎ , প্রদ্যুৎ ' আমার আর অয়নিকার ছেলে --- | কি বললো ও ? ওর কেউ নেই ----? তারমানে অয়নিকা বেঁচে নেই ? কিন্তু নিজেকে যতটা সম্ভব সহজ করে জানতে চাইলো ,
--- কি হয়েছিল তোমার বাবা মার ?
--- একসিডেন্ট | ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল | সামনাসামনি একটা বাসের সাথে --- | দুজনেই স্পট ডেথ | চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই আমার পোস্টিং কলকাতা | আমি তখন সেখানে ছিলামনা ---
প্রদ্যুতের কথার মাঝেই অতীশ দেখে তার মামা ভীষণভাবে ঘামছে | শরীরটা কাঁপছে | সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে মামাকে পরীক্ষা করতে লাগলো | প্রদ্যুতের দিকে তাকিয়ে বললো ,
-- এক্ষুণি এডমিট করাতে হবে | আপনি আমাকে একটু হেল্প করুন | এম্বুলেন্স বাড়ির দোরগোড়ায় উপস্থিত | অতুল জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু কথা আর ইশারায় কিছু তার ভাগ্নে অতীশকে জানায় | অতীশ ছুঁটে গিয়ে মামার বেডরুমে ঢোকে | তন্নতন্ন করে খুঁজে আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করে তার ভিতর থেকে বহু পুরনো একটি খাম বের করে মামার হাতে দিতে যায় | কিন্তু অতুল ইশারায় অতীশকে বলেন ,' খামটাকে ছিঁড়ে ফেলে দিতে |' অতীশ মামার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে |
অতুল ওই মুহূর্তে বুঝে গেছিলেন তার শেষ সময় আগত | চিঠি একদিন না একদিন অতীশের হাতে পড়বে | কানে যাবে প্রদ্যুতের | তার জীবনটা হয়ে উঠবে বিষময় | নিজের ভালোবাসার মূল্য তিনি কোনোদিনই দিতে পারেননি | অন্যের পরিচয়ে আজ তার সন্তান একটা সুন্দর জগৎ তৈরী করেছে | এই শেষ মুহূর্তে এসে তিনি তা তছনছ করে দিতে পারেননা | প্রদ্যুতের শেষ পরিচয়টুকুও তিনি চলে যাওয়ার আগে নিশ্চিন্হ করে গেলেন তানাহলে তো ওপারে গিয়ে অয়নিকাকে জবাবদিহি করতে পারবেননা |
অতীশ ও প্রদ্যুৎ দুজনে মিলে তাকে এম্বুলেন্সে তুলে দুজনেই গাড়িতে উঠে বসলো | অতীশ মামার নাড়ি ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো গাড়ির ভিতর | আর প্রদ্যুৎ হঠাৎ পরিচয়ে এতো কাছ থেকে একটা মানুষের চলে যাওয়ায় কিছুটা থম মেরে গেলো | তার চোখের কোল বেয়ে অজান্তেই দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো |
No comments:
Post a Comment