অতীত পিছু ডাকে
কিছু অতীত আছে যা বারবার পিছনে ফিরতে বাধ্য করে | ভুলতে চাইলেও তাকে ভোলা যায়না | এই অতীত কখনো মানুষকে কাঁদায় আবার কখনো বা হাসায় | লোক সমাগমে তারা কখনোই ফিরে আসেনা | সে আসে নির্জনে মানুষের একাকিত্বকে সঙ্গ দিতে | অন্যের পদশব্দে চুপ করে তারা হৃদয়ের গহীনে ঘুমিয়ে পরে |
তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি | প্রফেসর সুধীন ব্যানার্জীর ছেলে সুতনু আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় | দুজনেই তখন বাংলায় অনার্স করছি | একসাথে কলেজ ক্যান্টিনে খাওয়া , অফ পিরিয়ডে বসে গল্প করা সব চলছে | সুতনুর মনে কি ছিল আমি জানিনা তবে আমি কিন্তু ওর সাথে বন্ধুর মতই মিশতাম | সুধীন স্যার ছিলেন বাংলার প্রফেসর | সুতনু খুব একটা মেধাবী ছিলোনা | কোনরকমে বাংলায় অনার্সটা পেয়ে গেছিলো | বন্ধুত্বের সুবাদে অনেকবারই স্যারের বাড়িতে গেছি | সেই সূত্রে মাসিমা আর স্যারের পনের বছরের ছোট ছেলের সাথেও খুব ভাব হয়ে গেছিলো | কলেজ থেকে স্যারের বাড়িতে গেলেই মাসিমা খাবার না খাইয়ে ছাড়তেননা |
একদিন ছুটির দিনে স্যারের বাড়ি গেছি - বেশ গল্পগুজব চলছে আমাদের চারজনের মানে আমি, মাসিমা , সুতনু আর ওর ছোটভাই সুমনের | হঠাৎ করেই স্যারের বুকে ব্যথা করতে শুরু করে | তড়িঘড়ি তাকে নিয়ে আমরা চারজনেই হসপিটালে ছুটলাম | কিন্তু এম্বুলেন্সের ভিতর স্যার একটা এমন কাজ করে ফেললেন আমরা কেউই তারজন্য প্রস্তুত ছিলামনা | বিশেষত আমি তো নয়ই | আমি , সুতনু আর মাসিমা স্যারকে নিয়ে পিছনে আর সুমন সামনে ড্রাইভারের পাশে | স্যার একহাতে বুকের বাদিকটা চেপে ধরে আর একহাতে আমার হাতটা ধরে বললেন ,
--- তোমায় আজ আমার মনের কথাটা জানিয়ে যেতে চাই নন্দিনী --- যদি আর সময় না হয় |
সবাই অবাক হয়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি | স্যার বললেন ,
--- আমার খুব ইচ্ছা তুমি আমার সুতনুর বৌ হয়ে আমার বাড়ি আসো | তুমি আমায় কথা দাও আমার যদি কিছু হয়ে যায় সুতনু চাকরি পাওয়া অবধি তুমি ওর জন্য অপেক্ষা করবে ---|
আমরা প্রত্যেকেই হতভম্ব | আমি তো এ কথা স্বপ্নেও মনে আনিনি কখনো | সুতনুর মুখের দিকে একবার তাকালাম | চোখভর্তি জল নিয়ে সে তখন বাবার দিকেই তাকিয়ে আছে | কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিনা | তবুও মনে বল এনে একজন মৃত্যু পথযাত্রীর কথা ফেলতে না পেরে ঘোরের মধ্যেই বলে দিলাম ,
--- সুতনু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড | ওর পাশে আমি সারাজীবন থাকবো |
না , স্যার আর বাড়িতে ফিরে আসেননি | তারপর শ্রাদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই আমি সুতনুদের বাড়িতে গেছি | কিন্তু আলাদাভাবে সুতনুর সাথে যেমন কোন কথা হয়নি বা আমি হয়তো নিজের থেকেই সে সুযোগটা ওকে দিইনি | সবকিছু মিটে যাওয়ার পর আবার কলেজে দুজনের সাথে দেখা হতে লাগলো | আমি লক্ষ্য করলাম শুধু আমিই নই সুতনুও একটু জড়োসড়ো সেই ঘটনার পর থেকে | আগের সেই গল্প উচ্ছলতা দুজনের মধ্যেই যেন হারিয়ে গেছে |
গতানুগতিক জীবনপ্রবাহে আমি তখন মাস্টার্স করছি | সুতনু গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটা অনামী কোম্পানিতে তখন চাকরি করছে | যোগাযোগ খুব একটা নেই বললেই চলে কারণ তখনকার দিনে ফোনের এতো রমরমা ছিলোনা | মাস্টার্স শেষ করে দুবছরের মধ্যে আমি তখন আমার কলেজেরই বাংলার প্রফেসর | চাকরি জীবনের প্রথমদিনে কলেজে পা রেখে সে এক অদ্ভুত অনুভূতি | যে কলেজের আমি ছাত্রী ছিলাম সেই কলেজেই প্রফেসর হিসাবে যোগদান করা সকলের ভাগ্যে সে সুযোগ আসেনা | কিন্তু সে এক অন্য গল্প | আজ আমি বলবো শুধু সুতনু আর নন্দিনী মানে আমার কথা |
চাকরি পাওয়ার দুবছরের মধ্যে ডাক্তার ছেলের সাথে বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করলেন | সুতনুকে সে চোখে না দেখলেও স্যারের বলা শেষ কথাগুলো মনে রেখে একদিন কলেজ ছুটির পর ওদের বাড়িতে গেলাম | সুমন তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে | আমাকে দেখে মাসিমা , সুমন খুব খুশি হলো | কিন্তু সুতনুর মুখে কোন ভাবান্তর দেখতে পেলামনা | সুযোগ পেয়ে সুতনুর ঘরে ঢুকে বললাম ,
--- কেমন আছিস ?
--- চলে যাচ্ছে |
--- ওই কোম্পানিতেই আছিস ?
--- না , চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি | ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করেছি |
--- আমাকে কিছু বলার আছে তোর ?
--- কি বলবো ?
--- কিছুই বলার নেই ?
--- না ---
--- আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে --
--- জানি -- ভালো থাকিস
--- জানি মানে তুই কি করে জানলি ?
প্রতুত্তরে সুতনু তার গজ দাঁতটা বের করে হেসে দিলো |
সবে ওকে বলতে যাচ্ছিলাম স্যারের বলা কথাগুলো কিন্তু হঠাৎ মাসিমা একপ্লেট মিষ্টি নিয়ে এসে আমার সামনে রাখলেন | আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন ,
-- ছেলের বাড়ি কোথায় রে ?
আমি অবাক হয়ে উনার মুখের দিকে তাকালাম | তারমানে মাসিমাও সব জানেন ? তাহলে স্যারের ইচ্ছার সাথে সুতনু বা মাসিমার ইচ্ছার মিল নেই আর তাই তারা এ ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন | খুব অপমানিত বোধ করেছিলাম সেদিন | সুতনুকে বন্ধু হিসাবে দেখলেও শুধুমাত্র স্যারের কথা রাখতেই সেদিন ওদের বাড়িতে গেছিলাম | বন্ধু ছাড়া অন্য কোন ফিলিংস সুতনুর প্রতি আমার কোনদিনও জন্মায়নি |
বিয়ে হয়ে গেলো আমার | সুতনুদের নিমন্ত্রণ করেছিলাম | কেউ আসেনি | আমাকে উপেক্ষা করার অপমানটা কিছুতেই ভুলতে পারতামনা | এক ছেলের মা আমি | ছেলের বয়স যখন দশবছর তখন মাসতুতো বোনের মেয়ের বিয়েতে ছেলে , স্বামী নিয়ে গেছি | রাতের দিকে বেশ দামি গাড়ি থেকে দুজন নামলেন | দেখে তাদের খুব চেনাচেনা মনে হতে লাগলো | অনেকক্ষণ পরে বুঝতে পারলাম একজন সুতনু আর একজন সুমন | সুতনুকে এড়িয়ে সুমনের সাথেই গল্পে মজে গেলাম | জানতে পারলাম ছেলের বাড়ির নিকট আত্মীয় এরা | মাসিমা বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন | সুমন বিয়ে করেছে বৌ প্রেগন্যান্ট এবং বাপের বাড়িতে আছে বলে বিয়েতে আসতে পারেনি | ইচ্ছা করেই সুতনুর কথা কিছু জানতে চাইলামনা | কিন্তু সুমন বলতে লাগলো ,
--- দাদা বিয়ে করেনি | বিয়ে করবেনা বলে ধনুকভাঙ্গা পণ করে বসে আছে | দাদার ব্যবসাটা ভালো দাঁড়িয়ে গেছে | 200 জন কর্মচারী এখন দাদার নিজস্ব কোম্পানিতে | ব্যবসার কাজে মাঝে মাঝেই দাদাকে দেশের বাইরে যেতে হয় | আমার কি মনেহয় জানো নন্দীদি দাদা কোন মেয়েকে ভালোবাসতো হয় সে দাদার সাথে বিট্রে করেছে নাহয় তার অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে গেছে | আর এই কারণেই দাদা বিয়ে করতে চায়না |
নন্দিনী বসে বসে অনেকক্ষণ সুমনের সাথে গল্প করলো | একে একে বিয়েবাড়ি ফাঁকা হতে শুরু করেছে | সুতনুকে একজায়গায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নন্দিনী এসে তার পাশের চেয়ারটাই বসে বললো ,
--- কিরে তুই কি আমায় চিনতে পারিসনি ? কেমন আছিস বল ?
--- চিনতে পারার প্রশ্নটাতো আমারই করা উচিত ছিল | আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লি | আমি বিন্দাস আছি |
--- বিয়ে করিসনি কেন ?
সুতনু তার সেই গজ দাঁতটা বের করে হেসে দিয়ে বললো ,
--- বিয়েটাই কি জীবনের সব ? দূর থেকে আজীবন ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবেসে যাওয়াটাই আমার মতে বুদ্ধিমানের কাজ | বিয়ে করলেই তো ঝগড়াঝাটি , অশান্তি |
--- ও তাই বল | তা তোর সেই ভালোবাসার মানুষটাকে কি আমি চিনি ?
--- বিলক্ষণ -- তবে মানুষটাকে চিনলেও তার মনটাকে তুই চিনতে পারিসনি |
--- কি হেঁয়ালি করছিস ? কে সে ?
সুতনু হোহো করে হাসতে লাগলো |
--- হাসছিস কেন ? বলনা কে সে ?
--- এটাই আমার জীবনের চরম ট্রাজেডি | যাকে কলেজ লাইফ থেকে ভালোবেসেছি সে কোনদিনও বুঝতেই পারেনি | হ্যাঁ সে আমাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলো কিন্তু কি জানিস বাবার মৃত্যুর পর সামান্য ওই পেনশনের টাকাটাই ছিল সম্বল | দুই ভায়ের পড়াশুনা , মায়ের ওষুধ , সংসার চালানো - তাই ইচ্ছা থাকলেও আমি এমএ টা করতে পারিনি | সামান্য মাইনের একটা চাকরি খুঁজে নিতে হয়েছিল | অবশ্য এই চাকরিটা আমার কাছে ছিল লাকি | এখান থেকে শিখেই আমি ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পেরেছি | ও যা বলছিলাম - যাকে আমি ভালোবাসতাম সেই মেয়েটিকে আমার অভাবের সংসারে ঢুকিয়ে তাকে কষ্ট দিতে পারিনি | তাই বুকে পাথর বেঁধে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলাম | আর সবথেকে বড় কথা ভালোবাসাটা ছিল একতরফা | মেয়েটি তো কোনদিন বুঝতেই পারেনি শুধু আমি নয় আমার বাবা , মা এমন কি আমার ভাইও চাইতো সে আমার বাবার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করুক | কিন্তু তখন ছিলাম আমি অসহায় ---
এতক্ষণ পর নন্দিনী অস্ফুট স্বরে বলে ,
--- সুতনু !
--- ছেড়ে দে পুরনো সব কথা | কবে সব চুকেবুকে গেছে |
--- আজও ভালোবাসিস আমায় ?
--- যতদিন বাঁচবো আমার চেতন অবচেতনে ভালোবাসা দিয়ে লেখা একটিই নাম -'নন্দিনী' |
উভয়ের বুক চিরে শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাসই বেরিয়ে আসলো | মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নন্দিনী ছুঁটে বাথরুমের দিকে চলে গেলো |
ছেলে এখন আমার কানাডাবাসী | স্বামী বছর পাঁচেক আগেই গত হয়েছেন | বিশাল বাড়ি, স্বামীর স্মৃতি , আর সর্বপরি সুতনুর নীরব ভালোবাসা নিয়েই আমার দিন গুজরান |
No comments:
Post a Comment