মাষ্টারমশাই
রোদের ভিতর হাঁটতে হাঁটতে চঞ্চলা মাথায় কাপড়টা পুণরায় টেনে দেয় | দুদিন গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা হয়নি | আজ তাকে যেভাবে হোক দেখা করতেই হবে | হাঁটতে হাঁটতেই ভাবে উফফ রোদের কি তেজ রে বাবা ! একটা ভালো ছাতাও নেই ঘরে যে সেটাকে নিয়ে বেরোবে | পুরনো দিনের কথাগুলো ভীষণভাবে মনে পড়ছে | আবেগের বশে বোকার মত সেদিন যদি নরেশের কথা সে না শুনতো তবে আজ এই দিনটা তার জীবনে আসতোনা | মাষ্টারমশাই সেদিন পইপই করে নিষেধ করেছিলেন 'পড়াশুনাটা শেষ কর মা | এই বয়সে সংসারী হতে যাসনা | একটু নিজেকে তৈরী কর , আমি তো তোর পাশে আছি | মানুষের ভাগ্যের কথা তো বলা যায়না ; কোন সময় কি বিপদ এসে উপস্থিত হয় --' কেন যে সেদিন সেকথা না শুনে নরেশের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো --- আজ ভাবলে খুব খারাপ লাগে | তবে উপায়ও সেরকম ছিলোনা | নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসার , মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করেন আর বাবা রিকশা চালান | চার চারটে ভাইবোন তারা | সে মেঝো | দিদির বিয়েটা দিদি নিজেই পালিয়ে গিয়ে করেছে | অন্তত দুবেলা পেট পুরে খেতে পারছে | চঞ্চলা আর তার পরের বোন চপলা দুজনেই সরকারি স্কুলে পড়তো | হঠাৎ করেই দুজনেই পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকে | চঞ্চলার মাথাটা পড়াশুনায় খুবই ভালো ছিল | মাষ্টার অবিনাশ মজুমদার চঞ্চলাকে খুবই ভালোবাসতেন | শুধু চঞ্চলায় নয় তিনি মেধাবী গরীব ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে নানানভাবে সাহায্য করতেন তাদের টিউশনি পড়াতেন বিনা পয়সায় |
অবিনাশবাবুর কানে যেদিন কথাটা আসে সেদিনই তিনি ছুঁটে গেছিলেন চঞ্চলাদের বস্তিতে | তিনি অনেক করে তাকে বুঝিয়েছিলেন কিন্তু চঞ্চলা মাথা নিচু করেই ছিল মাষ্টার মশাইয়ের কোন কথার উত্তর সে দিয়েছিলোনা | তাতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই বিয়ের ভূত চঞ্চলার মাথা থেকে নামাতে তিনি পারেননি | তার বাবা মাকেও অনেক করে বুঝিয়েছিলেন কোন লাভ হয়নি | তাদের দুজনের সেই এককথা " এতগুলো পেট চালাতে হিমশিম খেয়ে যাই , মেয়ের বিয়ে কোনদিন নিজেরা দিতেও পারবোনা | তার থেকে এই ভালো মাস্টারবাবু ও নিজে থেকে মন্দিরে বিয়ে করে নিক '| অবিনাশবাবু বিফল হয়ে ফিরে এসেছিলেন | তারপর কেটে গেছে চার বছর ---
হনহন করে রোদের ভিতর চঞ্চলা হাঁটতে থাকে | যখন সে এসে তার মাষ্টারমশিয়ের বাড়ি পৌঁছায় তিনি তখন সবে খেয়ে উঠেছেন | চঞ্চলা এসে নিচু হয়ে প্রণাম করে |
--- ওরে তুই কে রে মা ?
--- আমায় চিনতে পারছেননা মাষ্টারমশাই ? আমি চঞ্চলা |
চোখে অবিনাশবাবু খবুই কম দেখেন | তিনি অঙ্গুলি নির্দেশে চঞ্চলাকে টেবিলের উপর থেকে চশমাটা আনতে বললেন | তারপর সেটি চোখে দিয়ে বললেন ,
--- হ্যাঁ এবার বুঝতে পেরেছি | তা কেমন আছিস মা ? আচ্ছা পরে সব কথা হবে | তুই একটু তোর গিন্নিমাকে ডেকে আনতো |
চঞ্চলা ভিতরে গিয়ে অবিনাশবাবুর স্ত্রীকে ডেকে আনে | তিনি তার স্ত্রীকে বলেন ,
--- আগে মেয়েটিকে কিছু খেতে দাও | ওর মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে | এই কাঠফাটা রোদে অনেক দূর থেকে এসেছে |
অবিনাশবাবুর স্ত্রী তার স্বামীর এসব ব্যাপারে অভ্যস্ত | বিয়ের পর থেকেই তিনি এগুলো দেখে আসছেন |
--- গত দুদিন ধরেই তো ও আসছে | কতবার বলি এতদূর থেকে এসেছিস দুটো খেয়ে যা --- তা কে শোনে কার কথা ---
পড়াশুনার সূত্র ধরে চঞ্চলার মত এ বাড়িতে অনেকেরই যাতায়াত আছে | নিঃসন্তান দম্পতি | বাপ্ ঠাকুর্দার আমলের একটি ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ি আছে | সংস্কার করার কোন ইচ্ছা তাদের নেই | এই বাড়িটাতে অনেকগুলি ঘরই থাকে তালাবন্ধ | রাতবিরেতে থাকার জন্য কোন বাড়ির কোন অতিথির অসুবিধা হলে অবিনাশবাবুর বাড়িতেই তাদের আশ্রয় হয় |
চঞ্চলা খেয়ে এসে তার মাস্টারমশাইয়ের পায়ের কাছে বসলো | সত্যিই বড্ড খিদে পেয়েছিলো | সকাল থেকে কিছু খাওয়াই হয়নি | হবে কি করে ? আজ তিনমাস নরেশের কোন খবর নেই | সবাই বলে নরেশ অন্য কোন মেয়ের সাথে ঘর বেঁধেছে | প্রথম প্রথম চঞ্চলার বিশ্বাস হয়নি | কিন্তু আস্তে আস্তে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে লোকের কথাটা মিথ্যে নয় | ঘরের মধ্যেই কদিন বন্দি হয়ে একবছরের কন্যাটিকে বুকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছে | তারপর মনেমনে ভেবেছে যে ভাবেই হোক তাকে বাঁচতে হবে মেয়েটাকেও মানুষ করতে হবে | আর তখনই মনে পরে মাষ্টারমশাইয়ের কথা | বাপের বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাদের গলগ্রহ আর সে হবেনা |
অবিনাশবাবু চেয়ারে বসে আছেন আর তার পায়ের কাছে বসে চঞ্চলা নিজের জীবনকাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছে | অনেকবার তিনি বলেছেন উপরে উঠে বসতে কিন্তু সে ওঠেনি | কথা বলতে বলতে বেশ কয়েকবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিয়েছে |
--- আমাকে কি করতে হবে বল ?
--- আমাকে কিছু লোনের ব্যবস্থা করে দাও | আমি একটা সেলাই মেশিন কিনবো | আপাতত দোকান থেকে কিছু এনে সেলাই করে নিজের পেটটা তো চলাই তারপর কাটিং শিখে আস্তে আস্তে এগোতে থাকবো |
--- লোন নিলে সুদের সাথে যে আসলও কিছু কিছু দিয়ে শোধ করতে হয়রে ---
--- হ্যাঁ জানি তো | তিনটে বাড়ি রান্না ঠিক করেছি | এভাবে তো সারাজীবন চলবেনা | নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই | মেয়েটাকেও তো মানুষ করতে হবে | বস্তিতে থাকলে কি হবে ? ঘরভাড়া টা তো লাগে |
অবিনাশবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললেন ,
--- ঠিক আছে তুই দুদিন পরে আয় দেখি কি করতে পারি |
মেয়েকে নিয়ে চঞ্চলা এখন অবিনাশবাবুর বাড়িতেই থাকে | খাওয়াদাওয়া ঘরভাড়া সব ফ্রী | শুধু গিন্নিমার হাতে হাতে একটু কাজ করে দেয় | অবিনাশবাবু তাকে একটি সেলাইমেশিন কিনে দিয়েছেন হাজার পনের দিয়ে | তবে তিনি চঞ্চলাকে জানিয়েছেন এটা তিনি লোন নিয়েই কিনেছেন | চঞ্চলা যেমন পারবে এই টাকা শোধ করার জন্য কিছু কিছু করে ব্যাংকে টাকা জমা রাখবে | পনের হাজারের সাথে তাকে দুহাজার সুদ দিতে হবে | সতের হাজার হয়ে গেলেই যেন একবারে সে টাকাটা দিয়ে দেয় |
খাওয়া থাকা পরাই কোন খরচ নেই | তার মাস্টারমশাইয়ের সুপারিশে সে বহু দোকান থেকে জামা কাপড় নিয়ে এসে সেলাই করে টাকা উপার্জন করতে থাকে | সপ্তাহ শেষে ব্যাংকে জমা করে আসে | ছমাসের টেলারিংয়ে ভর্তি হয়ে বেশ ভালোভাবেই কাটিংটা শিখে নেয় | মাঝে মধ্যে দু একটা অর্ডারও পাচ্ছে | বছর খানেকের মধ্যেই সে গুছিয়ে ফেলে তার লোনের সতের হাজার টাকা | টাকাটা তুলে এনে মাস্টারমশাইয়ের হাতে দিলে তিনি বলেন ,
--- কাল দশটার সময় রেডি থাকবি | আমার সাথে বেরোবি |মেয়েকে গিন্নিমার কাছে রেখে যাবি |
কোন প্রশ্ন না করেই চঞ্চলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় |
পরদিন অবিনাশবাবু চঞ্চলাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে নূতন বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট একটা দোকানের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বললেন ,
--- দেখতো এই দোকানটা তোর পছন্দ হয় কিনা |
--- আমার দোকান ?
--- আমি ভাবছি তুই এখানে একটা টেলারিংয়ের দোকান দিলে বেশ ভালো চলবে |
--- কিন্তু মাষ্টারমশাই এক্ষুণি কি করে দোকান নেবো | সবে তো লোনটা শোধ করলাম |
--- দূর পাগলী আমি কি লোন নিয়েছি নাকি ? ওটা আমিই তোকে দিয়েছিলাম | যে টাকাটা তুই ফেরৎ দিয়েছিস তারমধ্যে আর কিছু দিয়ে এই দোকানটা তোকে করে দিলাম | আগেই কথা বলে রেখেছিলাম |পুরো টাকাটাই সেলামি দিতে হল | মাসে মাসে তোকে কিন্তু ভাড়া দিতে হবে | আমার তো সে রকম জমানো কোন টাকা নেই | থাকলে কি আর তোর সাথে এই ছলচাতুরিটা করতাম | তোর মত যে আমার এখানে ওখানে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে | তাদের সবাইকেই তো একটু আধটু দেখতে হয় |
আচমকা অচলা রাস্তার মধ্যেই তার মাস্টারমশাইয়ের পাদুটি জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে | রাস্তাঘাটে মাস্টারমশাইয়ের হাত পা জড়িয়ে ধরে কারও কারও কান্না পথচলতি মানুষজন দেখেই থাকে | কারণ এই পরোপকারী মানুষটির কথা কারও অজানা নয় | একজন কাছে এগিয়ে এসে বললো ,
--- আবার একজনকে বাঁচার পথ দেখালেন মাষ্টারমশাই ?
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর | দোকানটা এখন দোতলা হয়েছে | মাষ্টারমশাই আর গিন্নিমাও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন | মৃত্যুর আগে অবিনাশবাবু তার চারকাঠা জমির উপরের বাড়িটা চঞ্চলার নামে করে গেছেন | মাষ্টারমশাই রাতে ঘুমের মধ্যে মারা গেলেও গিন্নিমা বছরখানেক শয্যাসায়ী ছিলেন | তার সবকিছু চঞ্চলা নিজহাতে করেছে | কিছুটা জমি বিক্রি করে বাড়িটার সংস্কার করেছে | মেয়েটাকে ভালো স্কুলেই পড়াশুনা করিয়েছে | সেও মাঝে মধ্যে গিয়ে মায়ের সাথে দোকানে কাজ করে | বসবার ঘরে তার মাষ্টারমশাই আর গিন্নিমার বড় করে ছবি বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছে | রোজ দোকান থেকে ফেরার পথে দুটো ফুলের মালা কিনে এনে স্নান করে ছবিতে ধূপকাঠি , দুটি সন্দেশ আর মালা দিতে তার ভুল হয়না | নরেশ একবার তার কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে সংসার করতে চেয়েছিলো সে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে | বাড়িতে তার কোন ঠাকুরের আসন নেই | কেউ কিছু বললেই সে বলে , "তার জীবনে ঠাকুর, দেবতা সবকিছু তার গিন্নীমা আর মাষ্টারমশাই | তাই সে তাদেরই পুজো করে |"
No comments:
Post a Comment