---অহংকারী , দাম্ভিক লোকটাকে একদম সহ্য হয়না , নেহাৎ আমার বস লোকটা তাই মেনে নেওয়া |
--- কিন্তু উনি তো আমার সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার করেননা | সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলেন |
--- কি জানি বাবা আমি ওর কি ক্ষতি করেছি | আমার সাথে তো কখনোই ভালো ব্যবহার করেননা |
দিশা আর জয়ীর কথোপকথনের মধ্যে রূপসা এসে হাজির হয় | তিনজনেই একটা ম্যাটিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে |
--- কি রে তোরা নির্ঘাত রিতেশ ব্যানার্জীকে নিয়ে কথা বলছিস ?
দিশা বলে ওঠে, "ঠিক ধরেছিস | চাকরি করতে এসেও শান্তি নেই |"
রূপসা ওর সাথে একমত হয়ে বলে ওঠে ,
--- এই লোকটার মাথার ঠিক আছে বলে আমার মনেহয়না | এ সাইকো পেসেন্ট |
তিনজনেই একসাথে হেসে ওঠে |
রিতেশ ব্যানার্জী খুব অল্প বয়সেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে বসে আছে | সুন্দর , সুপুরুষ | যে কোন মেয়ে দেখলেই তার প্রেমে পড়তে বাধ্য | কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিনি সুন্দরী মেয়েদের মোটেই পছন্দ করেননা | দিশা এবং রূপসা এই অফিসের ডাকসাইটে সুন্দরী | একমাত্র এই দুজন ছাড়া অফিসের অন্য কেউই তাদের বসের ক্ষেত্রে দাম্ভিক , অহংকারী শব্দদুটি প্রয়োগ করেনা | কারণ তিনি প্রত্যেকের সাথেই সুন্দর ব্যবহার করেন | রিতেশ ব্যানার্জীকে সকলেই পরোপকারী ও সুন্দর মনের মানুষ বলেই ব্যাখ্যা করেন | কিন্তু কি কারণে দিশা ও রূপসার সাথে তিনি এরূপ ব্যবহার করেন তা কারও বোধগম্য হয়না |
রিতেশ ব্যানার্জীর বয়স এখন আঠাশ ঊনত্রিশ বছর | কলেজ জীবনে ভালোবেসেছিল তারই সহপাঠী অপরূপাকে | নামেই শুধু সে অপরূপা ছিলোনা | চেহেরাতেও সে অপরূপা | কলেজের অন্যান্য সহপাঠীদের তার দিকে নজর থাকলেও সে রিতেশকেই মন দিয়েছিলো | কারণ রিতেশও ছিল সুন্দর চেহারার পুরুষ | পড়াশুনায় রিতেশ খুবই ভালো ছিল | পড়াশুনা শেষ করে তাই চাকরি পেতে তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি | অবস্থা তাদের খুব একটা ভালো ছিলোনা | একটু বেশি বয়সে রিতেশ তার মায়ের কোলে আসায় তার কলেজ জীবন চলাকালীন সময়েই রিতেশের বাবা রিটায়ার করেন | একমাত্র সন্তান সে | মা ছিলেন গৃহবধূ | রিতেশ চাকরি পাওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে | অপরূপা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে | যখনই অপরূপা তাকে বিয়ের কথা বলে তখনই রিতেশ বলে ," একটু গুছিয়ে নিই তারপর বিয়ে |"
চাকরি পাওয়ার বছর তিনেক পরে অপরূপাকে রিতেশ বিয়ে করে | হানিমুন করতে তারা সিমলা যায় | মাসতিনেক বেশ আনন্দের ভিতর দিয়ে কেটে যায় | কিন্তু তারপরেই বাধে গোল | বিয়ের খরচ ,গয়নাগাটি ,হানিমুন --- ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কারণে এই তিনবছরে যে টাকা রিতেশ গুছিয়েছিলো তা সবই খরচের খাতায় | বড়লোকের একমাত্র সুন্দরী কন্যার হাত খরচ সেভাবে দিতে না পাড়ায় টুকটাক ঝামেলা হতে হতে যখন তা চরমে পৌঁছায় তখন একদিন ব্যাগপত্তর গুছিয়ে অপরূপা তার বাবা মায়ের কাছে চলে যায় রিতেশ অফিসে থাকাকালীন সময়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা অমান্য করে | দিন তিনেক রিতেশ চুপ করে থাকে | কিন্তু বাবা মায়ের কথা অগ্রাহ্য করতে না পারায় সে অপরূপাকে আনতে তার বাড়িতে যায় | কিন্তু আপ্যায়নের বদলে তাকে অপমানিত হতে হয় শ্বশুরের কাছে | তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন যদি সে ঘরজামাই থাকতে পারে তবেই তার মেয়ে তার সাথে সংসার করবে নচেৎ না | তিনি মেয়ের জোরাজুরিতে তার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তারা যে এতো গরীব তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি | অপরূপা তার সাথে দেখা করেনি বা করতে দেয়নি তার বাবা | এর কয়েক মাসের মধ্যেই ডিভোর্সের নোটিশ চলে আসে রিতেশের কাছে | সেই শুরু রিতেশের টাকার পিছনে দৌড়ানো | নিজের সততা ,পরিশ্রম, আর মেধা দিয়ে এই বয়সেই সে এই কোম্পানির টপপোষ্টে বসে আছে | শুধু সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তার মাথা গরম হয়ে যায় |
বছর তিনেক পরে বাবার মৃত্যুর পর মাকে নিয়ে রিতেশ শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো | সারাটা দিন মাকে নিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে হোটেলে ফিরে একটু ফ্রেস হয়ে রুম লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে মায়ের সাথে গল্প করার সময় লক্ষ্য করে মা একটু অন্যমনস্কভাবে অন্য রুমের ব্যালকনিতে একটা বছর দুই কি আড়াইয়ের বাচ্চার দিকে একমনে তাকিয়ে আছেন |
--- এতো মন দিয়ে বাচ্চাটাকে কি দেখছো মা ?
--- একটা অদ্ভুত ব্যাপার --- এই বাচ্চাটার মুখের সাথে তোর ছোটবেলার মুখের একটা অদ্ভুত মিল আছে |
রিতেশ হেসে পরে বললো ,
--- সে আর এমন কি মা ? এটা হতেই পারে | কত লোকের মুখের সাথে কত লোকের মিল খুঁজে পাওয়া যায় |
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে গেলেন |
পরদিন ভোরবেলায় তিনি ঘুম থেকে উঠেই ওই রুমের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করতে লাগলেন | দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো অপরূপা | কিন্তু তাকে দেখেই তিনি চমকে উঠলেন ---|
অপরূপা তার শ্বাশুড়ীকে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো ,
--- আপনি এখানে ?
সেকথার উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন ,
--- আমার কালই সন্দেহ হয়েছিল তোমার ছেলেকে দেখে | তাইতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই এখানে চলে এসেছি | আমি যেটা ভাবছি তাহলে কি সেটাই ঠিক ? আর তোমার মুখে ওগুলো কিসের দাগ ?
--- ওখান থেকে চলে আসার পর পক্স হয়েছিল | সেই দাগ আর মুখ থেকে মিলায়নি |খুব কষ্ট পেয়েছি সে সময় এই পক্সের কারণে | সে সময় রক্তিম আমার পেটে | বাবা চেয়েছিলেন আমি যাতে আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো না দেখাই | কিন্তু আমি তা পারিনি | অভিমান করে সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম | ভেবেছিলাম রিতেশ সঙ্গে সঙ্গেই আমায় নিতে চলে আসবে | রিতেশকে বাবার কোনদিনও পছন্দ ছিলোনা | আমার জোরাজুরিতে বাবা বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন | রিতেশ যে আমায় আনতে গেছিলো আমি জেনেছি অনেক পরে | বাবা তার আগেই ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন | ঠিক তার কদিন পরেই আমি জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি | বাবা যেন নজর বন্দি করে রেখেছিলেন আমায় | মা বাবাকে খুব ভয় পেতেন তাই কোনদিন প্রতিবাদও করতে পারেননি | কিন্তু বাচ্চাটা যাতে নষ্ট না করি তারজন্য ক্রমাগত আমায় বুঝিয়ে গেছেন | রক্তিম হওয়ার পর আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ততদিনে আপনারা অন্যত্র বাড়ি কিনে চলে গেছেন | বাবা মারা গেছেন বছর খানেক আগে | বেশ কয়েকমাস প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় ছিলেন | কথা বলতে পারতেননা | আমাকে দেখলেই তার চোখ থেকে অনর্গল জল পড়তো | হয়ত তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন | আমি ছেলেকে নিয়ে এখানে এসেছি তার কারণ এখানে নাকি একজন আছেন তিনি গাছগাছড়া দিয়ে ওষুধ তৈরী করেন | মুখে লাগালে নাকি এই দাগগুলো মিলিয়ে যাবে |
রুমে বসে যখন অপরূপা এই কথাগুলো বলছিলো তখন রিতেশ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথাগুলো সব শুনছিলো | সে তার মাকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ পরিচিত একটি গলার আওয়াজ পেয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে পরে | তারপর উঁকি মেরে দেখে ভিতরে মা বসা | অপরূপাকে দেখা না গেলেও গলার আওয়াজে তাকে সে ঠিকই চিনতে পারে | রক্তিম ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় দৌড় দেয় | পিছনে অপরূপা | অপরূপা পর্দা সরিয়ে দেখে রিতেশ ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে |
--- তুমি কে ?
--- আমি বাবা |
--- আমার বাবা ? মা যে বলে বাবা হারিয়ে গেছে |
--- তুমি খুঁজে বের করলে তো --
--- তাহলে ভিতরে চলো , মাকে বলি আমি বাবাকে খুঁজে পেয়েছি |
রিতেশ ছেলে কোলে ফিরে দেখে অপরূপা আর মা দাঁড়িয়ে |
অপরূপা হাত জোর করে বলে ,
--- ক্ষমা করে দাও | সামান্য মানাভিমান থেকে জীবনটাই যে নয়ছয় হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি |
রিতেশ সে কথার উত্তর না দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো ,
--- মা , তোমার বৌমার যদি এখানকার কাজ মিটে গিয়ে থাকে তাহলে আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বো | তুমি কথা বলে সব ঠিক করে নাও | আমি আমার বাবাকে নিয়ে আমার রুমে যাচ্ছি | রিতেশ ছেলেকে কোলে নিয়ে এগিয়ে গেলো | আর অনুপমা চোখ ভর্তি জল নিয়ে শ্বাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো |
No comments:
Post a Comment