একটি খোলা চিঠি
অপু ,
কয়েক যুগ পরে তোকে চিঠি লিখছি | আমি জানিনা এ চিঠি তোর কাছে পৌঁছাবে কিনা | কারণ আমি এটাও জানিনা তুই সেই পুরনো ঠিকানায় আছিস কিনা | একটু চেষ্টা করলে হয়তো আমি তোর ফোন নম্বর জোগাড় করতে পারতাম | তোর মাসতুত বোনের বিয়ে হয়েছে আমাদের পাড়াতেই | একদিন হঠাৎ ওর সাথে রাস্তায় দেখা | ওর কাছ থেকেই তোর সম্পর্কে সব জানতে পারি | মাঝে মধ্যেই রাস্তায় যাতায়াতের পথে দেখা হয় | সেই প্রথমদিন যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন ও নিজের থেকেই তোর সব কথা জানিয়েছিল | আমারও শোনার আগ্রহ ছিল | পাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাই সেদিনের পরে আর কখনোই তোকে নিয়ে আলোচনা করিনি ওর সাথে | ও কথা তুললেও আমি প্রসঙ্গ পাল্টে দিই | ভয় পাই ; কারণ ভরা সংসার আমার | নিজেকে যদি হারিয়ে ফেলি ?
বাড়ির থেকে যখন আমার বিয়ে ঠিক করেছিল তুই আমায় বলেছিলি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবি | কারণ তুই বেকার বলে মায়ের আপত্তি ছিল | তাই বাবার কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছাতেই পারেনি | দুজনে সেটা ঠিক করেই তোর দেওয়া সময় মেনে টিউশনি করা নিজের কিছু জমানো টাকা নিয়ে আমি যখন সকলের অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরোই তখনও বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফেরেননি | আমি খুব দ্রুত হেঁটে বড় রাস্তায় উঠে হাঁটতে হাঁটতেই একটি ট্যাক্সির খোঁজ করতে থাকি | হঠাৎ একটি ট্যাক্সি এসে আমার সামনে দাঁড়ায় | ট্যাক্সির ভিতরে যে ব্যক্তি বসে ছিলেন তিনি আমার বাবা | এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছি জানতে চান | আমি তখন অসার হয়ে যাই | কোন কথাই মুখ থেকে বেরোয়না | বাবা কি বুঝেছিলেন তখন আমি জানিনা --- ট্যাক্সির দরজা খুলে শুধু গম্ভীর মুখে বলেছিলেন ," ভিতরে উঠে এসো|" সারা রাস্তা কোন কথা আর বলেননি |
বাড়িতে ফিরে গেটে দরজায় তালা লাগিয়ে নিজের কাছেই চাবি রাখতেন | তখনও বিয়ের একমাস বাকি | কোন কথা তিনি কখনোই জানতে চাননি | কারণ মা তোর আর আমার ব্যাপারটা জানতেন | তিনিই সবকিছু সে রাত্রে বাবাকে জানিয়েছিলেন | আর সম্ভবত দুজনেই বুঝতে পেরেছিলেন আমি সেদিন রাতে পালিয়ে যাচ্ছিলাম | কিন্তু কোনদিন তারা আমার কাছে কোন কথাই জানতে চাননি | সেদিনের পরে তোর সাথে যোগাযোগ করার কোন রাস্তাই ছিলোনা | কারণ তখন বাড়িটা ছিল আমার কাছে জেলখানা | বাবা মা কেউ আমার সাথে আগের মত আর কথা বলতেননা | সবসময় নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম | আমার বিয়ের পরে আমার সাথে মায়ের ব্যবহারের পরিবর্তন হলেও বাবা আমৃত্যু আর কথা বলেননি | সেদিন যদি আজকের মত মুঠোফোনের চল থাকতো হয়তো তোকে কোন না কোন সময় ঘটনাগুলো জানাতে পারতাম |
যে মানুষটার সাথে বিয়ে হয়েছিল মানুষটা সত্যিই খুব ভালো ছিল | তোকে বুকের মাঝে ঘুম পাড়িয়ে মানুষটার প্রানঢালা ভালোবাসায় সাড়া না দিয়ে পারিনি | ওর তো কোন দোষ ছিলোনা তাই তাকে ঠকাতে পারিনি | জানি হয়তো বলবি , 'আমার কি দোষ ছিল ?' না তোরও কোন দোষ ছিলোনা | সব দোষ আমার কপালের |
সেদিন তোর মাসতুতো বোন নীলিমার কাছে শুনলাম তুই আজও একা | কাউকে আপন করতে পারিসনি | বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠেছিল --- আজও একইভাবে তা রয়ে গেছে | সত্যি বলতে কি জানিস ? সেই সময়ে আমাদের মেয়েদের জীবনের কোন সিদ্ধান্তই মেয়েরা নিতে পারতোনা | মেয়েদের কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আগেপিছে অনেককিছু ভাবতে হয় | সব মেয়ে ডেসপারেট হতে পারেনা | আমিও পারিনি সেদিন বাবা মায়ের সম্মানের কথা ভেবে | তুই আমাকে স্বার্থপর ভাবতেই পারিস | কিন্তু আমি নিজের স্বার্থ যদি দেখতাম তাহলে বিদ্রোহ করতাম --- দেখেছিলাম জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর স্বার্থ | আর নারী জীবন তো তরল পদার্থের ন্যায় | যেখানেই যাকনা কেন ঠিক মানিয়ে নিতে পারে |
আজ কথাগুলো তোকে লিখতে পেরে নিজেকে খুব হালকা লাগছে | যদি পারিস আমার এই অপারগতা ক্ষমা করে দিস |
ইতি তোর মানবী
No comments:
Post a Comment