সে আমার ছোটবোন
আজ মিমির বিয়ে | দিশা ভীষণ ব্যস্ত | বলতে গেলে একা হাতেই সে সবকিছু সামলাচ্ছে | বাড়িতে অনেক সদস্য | কিন্তু সকলেই হাত গুটিয়ে সেজেগুজে বসে আছে | দিশা ছাড়া আর আছে তার স্বামী বিতান | সে বাইরের দিকটা পুরো সামলাচ্ছে | কিছু বন্ধুবান্ধব তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করছে | শ্বশুরমশাইয়ের বয়স হয়েছে তার পক্ষে তো কিছু করা সম্ভবই নয় | আছেন তার শ্বাশুড়িও | তিনি এ অনুষ্ঠানে ' ধরি মাছ না ছুঁই পানি ' - গোছের | আছে দুজন জা , দেওর | কিন্তু কেউই সেভাবে এগিয়ে আসেনি | বিয়ের পুরো টাকাটাই বিতান দিচ্ছে | শ্বশুরমশাই অবশ্য কিছু দিয়েছেন তবে সেটা বাড়ির কেউই জানেনা | দিশা তার কিছু গয়নাও দিচ্ছে তার সন্তানসম বন্ধু , বোন - ননদকে |
মিমিকে যখন দেবারুনের দেখতে আসার কথা হচ্ছিলো তখন বাড়ির বাড়ির সকলেই নাক সিঁটকেছিলো | সকলের একই বক্তব্য ছিল ডাক্তার ছেলে পছন্দ করবে মিমির মত মেয়েকে ? সকলের কথা শুনে বিতান এসে দিশাকে আস্তে আস্তে বলেছিলো ,
--- হ্যাগো আমাদের মিমিকে দেবারুনের পছন্দ হবে তো ?
দেবারুনকে খুব ছোটবেলায় দিশা দেখেছে | পাড়াতুত সম্পর্কে দেবারুন দিশাকে দিদি বলে ডাকতো | দেবারুনের মাসতুত বোন অন্তরার সাথে দিশা পড়তো | বিয়ের পর অনেক বছর অন্তরার সাথে দিশার যোগাযোগ ছিলোনা | ফেসবুক দুই বন্ধুকে আবার মিলিয়ে দিয়েছে | প্রথম যেদিন দিশা অন্তরার সাথে দেখা করতে তার অফিসে গেছিলো অন্তরা হাফ ছুটি নিয়ে দুজনে মিলে একটা পার্কে গিয়ে বসে বহুক্ষণ হারিয়ে ফেলা দিনগুলি নিয়ে হাহা হিহি তে মেতে ছিল | সকলের খোঁজখবর নিতে গিয়ে অন্তরা জানিয়েছিল দেবারুন এখন ডাক্তার | ওর বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে মেয়ে দেখছে | তখন কিছু মাথায় না আসলেও পরে মিমির সাথে দেবারুনের সম্বন্ধটা অন্তরার মাধ্যমে দিশাই করে | বিতানের কথা শুনে দিশা গম্ভীর হয়ে বলেছিলো ,
--- মিমির কিসের অভাব আছে বলো তো ?দেখতে সুন্দর , ইতিহাসে অনার্স , সর্বকাজে পারদর্শী | দেবারুনের যদি ওকে পছন্দ না হয় আমি মনে করবো ঈশ্বর নেই | তিনি ভালোমানুষের পাশে থাকেননা |
মিমিকে দেখে দেবারুনের মা ও তার পছন্দ হয়েছিল | কোন দাবিদাওয়া ছাড়াই তারা মিমিকে তাদের ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে যেতে চেয়েছেন |
বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে এ বাড়ির হালচাল ঠিক বুঝতে পারতোনা দিশা | যদিও বিতান বড় ছেলে এ বাড়ির কিন্তু ছোট দুই দেওরই বিতানের বিয়ের আগে বিয়ে করে নিয়েছিল | একমাত্র ননদ মিমি | জায়েরা সংসারে সেরূপ কোন কাজ না করলেও মিমি কিন্তু পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সংসারের টুকিটাকি কাজ করেই চলতো | মিমির সবথেকে ভাব ছিল তার বড় বৌদির সাথে | বৌভাতের আগেরদিন অথাৎ কালরাত্রির দিনে রাতে যখন দিশা একাই শোয়ার তোড়জোড় করছে তখন বারো বছরের মিমি একটা বালিশ নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দিশাকে বলেছিলো ,
--- বৌদি আমি আজকে তোমার কাছে শুই ?
--- হ্যাঁ নিশ্চয় | ভিতরে এসো | আমি তো মনেমনে ভাবছিলাম কেউ আমার কাছে শুতে এলোনা কেন ? আসলে আমি তো মায়ের কাছে শুতাম তাই একা একা শুতে কেমন যেন লাগছিলো |
--- আমারও প্রথম প্রথম একা শুতে খুব ভয় করতো | কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে | মায়ের মুখটা এখন আর ভালোভাবে মনেও পড়েনা |
--- মানে ?
--- তোমাকে বড়দা কিছু বলেনি ? এই বাড়িতে বড়দা আর বাবা ছাড়া আমায় কেউ ভালোবাসেনা |
--- কি বলছো আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা |
--- আসলে আমি যাকে মা বলে ডাকি তিনি আমার আসল মা নন | উনি আমাকে ভালো না বাসলেও আমি কিন্তু উনাকেই এখন মা ভাবি | আমার যখন বছর পাঁচেক বয়স আমার নিজের মা মারা যান | আমাদের দেখাশুনা করার জন্য বাবা আবার বিয়ে করেন | বড়দার তখন সাত কি আট বছর বয়স | মা , বাবার সামনে আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করলেও আমাদের দু ' ভাইবোনকেই মা খুব বিনা কারণেই বকতেন কখনো কখনো মারতেন ও খুব | খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম আমরা বাবা বাড়িতে না থাকলে | কিন্তু বড়দা আমায় সবসময় বলতো ,' বনু যে কোন পরিস্থিতিতেই কিন্তু আমাদের পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে হবে |' আমিও মাথার মধ্যে এটাই ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম | বড়দা হয়তো সময়ই পায়নি তোমাকে এসব কথা বলার | ঠিক বলবে দেখো | নিজের দাদা বলে বলছিনা আসলে মানুষটাই খুব ভালো |
হ্যাঁ বিতান দিশাকে পরেরদিনই সব জানিয়েছিল | আর বলেছিলো , ' আমার বোনটা খুবই ভালো | ওকে একটু ভালোবেসে কাছে টেনে নিও |' দিশা তার কথা রেখেছিলো | এরপর একটা সময় এসেছিলো যে বিতানের থেকে মিমিকে নিয়ে দিশা ভাবতো বেশি | কি পোশাক ও পরবে , ওর পছন্দের খাবার তৈরী করা , ওকে ভালো কলেজে ভর্তি করা --- সব দিশার ভাবনা | নিজের অজান্তেই দিশা যে কখন মিমির মায়ের জায়গাটা নিয়ে নিয়েছিল তা বোধকরি সে নিজেও বুঝতে পারেনি | শ্বাশুড়িমা দিশা এ বাড়িতে আসার পর থেকে তার স্পষ্ট কথার ভয়ে অনেক সময়ই রুদ্রমূর্তি ধারণ করা থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য হয়েছেন | সংসারের কাজ তিনবউয়ের মধ্যে ভাগ করতেও বাধ্য হতে হয়েছে তাকে | এরও অবশ্য একটা কারণ আছে | অন্য দুই ছেলের তুলনায় বিতান ভালো চাকরি করে | তার নিজের এবং তার স্বামীর যাবতীয় ওষুধপত্র এবং ডক্টরের খরচ বিতানই করে | সংসারেও একটা মোটা অঙ্কের টাকা দেয় | তার ভয় ছিল দিশা যে ধরণের স্পষ্টবাদী মেয়ে তাতে তার বিপক্ষে গেলে সে যদি বিতানকে নিয়ে অন্যত্র চলে যায় --|
বিয়ের অনুষ্ঠান ভালোভাবেই মিটে গেলো | মায়ের সমস্ত কাজ দিশাই করলো | বিদায়ের সময় ননদ , ভাইবৌ দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কান্নাকাটি | মিমি কাঁদতে কাঁদতে বললো ,
--- তোমায় না পেলে আমি তো জানতেই পারতামনা মায়ের আদর কি ? বৌদি বলে তোমায় ডাকি ঠিকই কিন্তু মনেমনে আমি তোমায় মায়ের আসন দিয়েছি যে কবে তা বোধকরি নিজেই জানিনা | পরজন্ম বলে সত্যিই যদি কিছু থাকে আমি যেন তোমার মেয়ে হয়েই জন্মাই |
দিশা কাঁদতে কাঁদতে মিমির চোখের জল মুছাতে মুছাতে বললো ,
--- আজকের এই শুভদিনে এসব কথা বলতে নেই |
তারপর দেবারুনের দিকে ফিরে বললো ,
--- আমার ননদিনি যেন কখনো মনে কষ্ট না পায় | সারাজীবন তুমি ওকে ভালো রেখো |
--- তুমি একদম চিন্তা কোরোনা দিশাদি | এ দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম |
অদূরে দুই প্রতিবেশিনী দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে তখন একে অপরকে বলছে ,
" দিশা এ বাড়ির বৌ হয়ে এসে প্রমাণ করে দিয়েছে ভালোবাসা দিয়ে ননদকেও নিজ সন্তানের মত আগলে রাখা যায় |"
শেষ