Tuesday, July 24, 2018

অপেক্ষার শেষ
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

         অবসর জীবনে সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী বই।কিন্তু পাশের ফ্লাটের আধুনিকা সোমাশ্রীর অনুরোধে জয়িতা এক দামী স্মার্ট ফোন কিনে শ্রীর বাধ্য ছাত্রী হয়ে বসে। সোমাশ্রী শিক্ষিতা,সুন্দরী, আধুনিকা।বাবা মায়ের সাথে জয়িতার সদর দরজা বরাবর ফ্লাটটিতেই থাকে।জয়িতা বছর খানেক হোল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন।সোমাশ্রীর সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব।সোমাশ্রীর বয়স চব্বিশ আর জয়িতার একষট্টি।দু'জন অসমবয়সের দু'টি মানুষ।কিন্তু বন্ধুত্বের অদ্ভুত এক মিষ্টি সম্পর্ক দু'টি মানুষের মধ্যে।একটি নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে সোমাশ্রী চাকরী করে।অফিস,বাড়ি আর জয়িতা আন্টির ঘর।আর এখন তো সে জয়িতা আন্টির মোবাইল শেখানোর মাষ্টারনি।হাতে ধরে ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ,টুইটার সব শেখানো চলছে।এমনকি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কিভাবে পাঠাতে হয় কেউ পাঠালে তাকে এ্যাকসেপ্ট করতে হয় -সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো শ্রী তার জয়িতা আন্টিকে শিখিয়ে দেয়।জয়িতাও মাত্র কয়েকদিনেই সময় কাটানোর সুন্দর একটি সমাধান খুঁজে পান।সব থেকে সুবিধা তার যেটা হয় কোন গল্প বা কবিতা পড়তে ইচ্ছা করলেই গুগল সার্চ।কত দূর-দূরান্তের মানুষের সাথে পরিচয়;পরিচিত বা অপরিচিত কত কত মানুষ।বেশ ভালোই লাগে তার নিঃসঙ্গ জীবনে নূতন এই খেলনাটিকে।কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন people you may know -তে একটি ছবিতে এসে তার চোখ আটকে যায়।খুঁটিয়ে সে ছবিটি দেখতে থাকে।
        চল্লিশ বছর হ্যাঁ চল্লিশ বছরই হবে।
জয়িতার বয়স তখন উনিশ কি কুড়ি হবে।তখন তাদের বাড়িতেই ভাড়া আসে এক পরিবার।মা,বাবা,বোন আর দাদা।জয়িতারা থাকতো দোতলায় আর ভাড়াটিয়ারা থাকতো একতলায়।বাইরের দিক থেকে বাড়ির সিঁড়ি।শেখর তখন সদ্য সদ্য ব্যাংকে চাকরী পেয়েছে।সুদর্শন ও স্মার্ট।খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ তাদের হতনা।কথা তো নয়ই।শেখরের বোন শিখা,জয়িতার সমবয়সী।অচিরেই দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।শিখাদের ঘরে জয়িতা যখন যেত যদি শেখরকে দেখতে পেতো সে সঙ্গে সঙ্গেই পালিয়ে আসতো।কিছুতেই শেখরের সামনে সে সহজ হতে পারতোনা।বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা কাঁপুনি শুরু হত।সেটা কেন হত তা ওই বয়সে জয়িতা প্রথম দিকে বুঝতেই পারেনি।কোনদিন মুখোমুখি হয়ে গেলে শেখর কিন্তু সরাসরি জয়িতার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো।কিন্তু জয়িতার সে চাউনি সহ্য করার ক্ষমতা ছিলোনা।তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ শুরু হত।মুহূর্তেই সে জায়গা সে ত্যাগ করতো।শেখর কিন্তু সবই বুঝতে পারতো।কিন্তু কোনদিনও মুখ ফুটে জয়িতাকে কিছুই বলেনি।
        জয়িতাদের বাড়িতে খুব বড় করে প্রতিবছর লক্ষ্মীপুজো হত।পুজোতে ভাড়াটিয়াদের নিমন্ত্রণ থাকায় শেখরও রাত্রে খেতে যায়।সেদিন প্রথম শেখর ও জয়িতা সামনাসামনি নানান ধরনের কথাবার্তা বলে।শেখর খুব ভালো গান করে সেটা শিখার কাছ থেকে জয়িতা জেনেছিল।সকলের মধ্যে জয়িতা শেখরকে অনুরোধ করে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার জন্য।অন্য সকলেও তখন চাপ দিতে থাকে।অগত্যা শেখর গাইতে বাধ্য হয়।খালি গলায় সে গান ধরে,"তুমি রবে নীরবে---"।শেখরের গান সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত চুপ করে শোনে।চলে যাবার সময় শিখাকে একটু একা পেয়ে শেখর বলে যায়,"তোমাকে কিছু বলার ছিলো,কিন্তু বলতে সাহস পারছিলামনা।তবে গান গাইতে বলে আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছো।তোমাকে যা বলবো ভেবেছিলাম তা গানের কথাগুলোর মধ্যেই বলে দিয়েছি।সময় করে তোমার উত্তরটা আমায় জানিও।"
        জয়িতা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।কিভাবে কথা বলতে হয়,কিভাবে ছুটে পালিয়ে যেতে হয় জয়িতা এক নিমেষেই সব ভুলে গেছে।সব ভুলে যাওয়ার মাঝখানে বুকের স্পন্দন গতি কয়েক শ গুন বেড়ে গেছে এটা সে ভালোই বুঝতে পারছে।
           জয়িতাকে শেখরদের বাড়ির সকলেই খুব ভালোবাসতো।জয়িতারা ছিলো ব্রাহ্মন আর শেখররা ছিলো সাহা।জয়িতার মায়ের চোখে লাগে ওদের মেলামেশা গল্পগুজব।তিনি সরাসরি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন।মেয়েও কিছু না লুকিয়ে মায়ের কাছে সব খুলে বলে।জয়িতার মা সব শুনে মেয়েকে জানান,"কোন অবস্থাতেই তোর বাবা এই সম্পর্ক মেনে নেবেননা।নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মন বংশের সন্তান তিনি।আজও দু'বেলা আহ্নিক করেন একবেলা অন্ন গ্রহন করেন।আমি জাতপাতের বিচার করিনা।কিন্তু তোর বাবা?এ কথা শুনলে তার তো স্ট্রোক করবে।নাহয় তিনি আত্মহত্যা করবেন।যত ভালো চাকরীই সে করুক না কেন কিছুতেই তিনি ওই নিচু জাতের ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেবেননা।শেষ পর্যন্ত মেয়ে হয়ে পিতৃঘাতী হবি?"
      জয়িতার দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা নামতে থাকে।মুখ নিচু করে শুধু একটি কথায় বলে,"মা শেখর খুব ভালো ছেলে।এই বয়সেই সে কত বড় পোষ্টে চাকরী----"কথাটা সে শেষ করতেও পারেনা।কথার মাঝখানেই তার মা বলে ওঠেন,"মা আমি সব জানি।কিন্তু তোর বাবা কিছুতেই মেনে নেবেননা।তুই আমাদের একমাত্র সন্তান।আমি জানি মা শেখরের মত ছেলের হাতে পড়লে তুই খুব সুখি হবি।কিন্তু তোর বাবা?প্রচন্ড একগুঁয়ে মানুষ তিনি।তার বংশে কালি লাগুক এমন কোন কাজ তিনি কিছুতেই করবেন না।ওই একরোখা মানুষটার সাথে এত বছর ধরে সংসার করে আমি যা বুঝেছি তিনি তার বংশমর্যাদা রক্ষার্থে যে কোন ধরনের সিধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র ভাববেন না।আমি কালই ওদের বলবো এখান থেকে ভাড়া উঠে যেতে।
           অসহায় জয়িতা মায়ের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই চলে।কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারেনা।শেখরকে কথাগুলো জানানোর একান্ত দরকার।বাবা বাড়িতে চলে এসেছেন।মাও সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।পরদিন সকালে বাবা অফিস বেরোনোর পরে মা যেয়ে আবারও দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি নিজ আঁচলে বেঁধে রাখেন।কলেজ ছুটি,প্রাইভেট টিউশনও ছুটিসব ভাই ফোঁটার পর খুলবে।সারাদিন শিখাও আসেনা।কিছুই বুঝতে পারছেনা সে কি করবে।ঘরের ভিতর ছটফট করতে লাগে। এমনিতেই বাবা খুব কম কথা বলেন,  মায়ের সাথেই শিখার যত কথা।সেই মা ও এখন প্রয়োজন না হলে খুব একটা কথা বলেননা।এই ভাবেই সাত সাতটা দিন কেটে যায়।
     সাতদিনের মাথায় হঠাৎ একদিন শিখা এসে হাজির সাথে তার মা।জয়িতার মা গেটের তালা খুলে তাদের ভিতরে নিয়ে এসে বসান। শিখার মা কিছুটা অবাক হয়ে জয়িতার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,"কি অপরাধে আমাদের এত তাড়াতাড়ি উঠে যেতে বললেন জানিনা।তবে আপনারা বাড়ির মালিক।চলে যেতে বললে আমরা যেতে বাধ্য।কিন্তু অপরাধটা জানতে পারলামনা।মেয়েটিকেও কেন আটকে দিলেন আমার ঘরে যেতে তাও বুঝলামনা।কপাল ভালো আমাদের পনেরদিন সময় দিয়েছিলেন আমরা সাতদিনেই ঘর পেয়ে গেছি।মালপত্র সব চলে গেছে,এবার আমি আর মেয়ে যাবো-"কথাগুলো বলে তিনি কিছু টাকা আর একটি হিসাব করা কাগজ রাখেন সামনের টেবিলের উপর।জয়িতার মা কোন কথার উত্তর দেননা।জয়িতা এসে শিখার মাকে প্রনাম করে।তিনি তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেন,"ভালো থাকিস মা।যে ঘরে বৌ হয়ে যাবি সে ঘর আলো করে থাকিস।বড্ড লক্ষ্মী মেয়ে তুই।তোর বিয়েতে খুব আনন্দ করবো ভেবেছিলাম।কিন্তু কি যে হোল কিছুই বুঝলামন।"জয়িতা কোন উত্তর দেয়না।চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়েই পড়ে।শিখাও এসে জয়িতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।কিন্তু কোন কথা কেউই বলতে পারছেনা।শিখার মা যাওয়ার আগে বললেন,"আসি দিদি।ভালো থাকবেন।"এ কথারও তিনি কোন উত্তর করেননা।
            কেটে গেছে সময় তিন যুগেরও বেশি।শত চেষ্টা করেও স্কুলে শিক্ষকতা করা মেয়ে জয়িতার বিয়ে পারেননি তার মা,বাবা।বাবা, মায়ের মৃত্যুর পর কলকাতার উপরে বিশাল দোতলা বাড়ি বিক্রি করে জয়িতা স্কুলের সুবিধার্থে বাগুইহাটিতে এক নিরিবিলি জায়গায় ফ্লাট কিনে চলে আসে।অবসর নেওয়ার আগে বা পরেও একমাত্র বইই ছিলো তার সর্বক্ষনের সঙ্গী।আর অসমবয়সী সোমাশ্রীর সাথে বন্ধুত্ব,আড্ডা আরও পড়ে শ্রীর পাল্লায় পড়ে ফেসবুকের নেশা।
            ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে জয়িতা বুঝতে পারে এটা শেখর।একটু মোটা হয়েছে।রিকোয়েষ্ট পাঠাবে কি পাঠাবেনা এই দোলাচলে ভুগতে ভুগতে রিকোয়েষ্ট সেন্ড করে।ইনবক্সে কথাও হয় মাঝে মাঝে।শেখর সাহা দেখে জয়িতা যেমন বন্ধুত্বের জন্য আগ্রহী  হয়েছিল ঠিক তেমনই শেখরও জয়িতা চ্যাটার্জি দেখে আগ্রহী হয়ে ইনবক্সে কথা আদানপ্রদান চালাতেই থাকে।শেখরের বাড়ি এখন কলকাতার বেহালা চত্বরে।এক সময় দুজনের মধ্যের অচেনা প্রাচীরটা সরে যায়।শেখর অনেক কথায় বলতে চায়,জানতে চায়।কিন্তু জয়িতা এক কঠিন আবরণে ঢেকে রাখে নিজেকে।কারন জয়িতা নিশ্চিত শেখরের এখন ভরা সুখের সংসার।কিছুতেই সে এই বয়সে এসে শেখরের জীবনে কাঁটা হয়ে উঠতে পারবেনা।কিন্তু শেখরও নাছোড়বান্দা।সে জয়িতার সাথে দেখা করবেই।অবশেষে বাধ্য হয়ে জয়িতা তার ফ্লাটের ঠিকানা শেখরকে জানায়।
            বেশ কয়েকবছর আগে শেখর রিটায়ার করেছে।কি কারনে জয়িতা তার সাথে এরূপ করলো,কি কারনে জয়িতাদের বাড়ি থেকে তাদের সাতদিনের মধ্যে উঠে যেতে হোল সে প্রশ্ন আজও শেখরকে কুরেকুরে খায়।বাবা,মা মারা গেছেন অনেক আগেই।শেখরকেও বাড়ির লোক বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি।মা,বাবা বেঁচে থাকতেই সে বেহালা চৌরাস্তায় একটি ফ্লাট কেনে।শিখার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সে এখন সম্পূর্ণ একা ওই ফ্লাটে।
              জয়িতার সাথে কথা অনুযায়ী নিদৃষ্ট দিনেই সে সকাল সকাল জয়িতার ফ্লাটে এসে হাজির হয়।দুরুদুরু বুক নিয়ে শেখরকে দরজা খুলে দিয়ে বসতে বলে জয়িতা চায়ের কথা বলে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চায়।শেখরকে দেখে বোঝায় যায়না তার বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই।একটু মেদ জমে শরীরটা সামান্য ভারিক্কি হলেও দেখতে যেন আরও সুন্দর হয়েছে।শেখর কোন ভনিতা না করেই সরাসরি প্রশ্ন করে,"কি এমন হয়েছিলো যে হঠাৎ করে নিজেকে ঘর বন্ধি করে আমাদের পনেরদিনের মধ্যে ঘর ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হোল?
            জয়িতা অনেক্ষণ চুপ করে মুখ নিচু করে বসে থেকে শেষে কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত ঘটনা শেখরকে জানায়।কান্না সামলে চোখ মুছে শেখরের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে এবার বলে,"কি হবে এই বয়সে এখন এসব জেনে?বরং তোমার সুখের সংসারে তুমি যেমন আনন্দে আছো ঠিক সেই ভাবেই থাকো।কেন এলে এতোগুলি বছর বাদে নিজেদের জীবনে আবার ঝড় তুলতে?"
---তুমিও তো খুব সুখি দেখছি!টা বিয়ে করোনি কেন?
---কপালে নেই তাই।
---ওটা আমার কপালেও নেই।
         জলভরা চোখে জয়িতা শেখরের মুখের দিকে তাকায়।শেখর এই প্রথম জয়িতার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে বলে,"জীবন থেকে অনেকগুলো বছর শুধু চলে গেছে।আমাদের ভালোবাসাটা কিন্তু সেই এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।ভালোবাসাটাই যখন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে;যে বা যাদের আপত্তিতে আমাদের জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলি হারিয়ে গেছে তারা আজ যখন আর কেউই বেঁচে নেই,আর এই বৃদ্ধ বয়সে এসে জীবন থেকে নূতন করে কিছু পাওয়ারও আশা নেই।কিন্তু দু'টি প্রাণী একই ছাদের তলায় থেকে নিজেদের জীবনের সুখ,দুঃখগুলো তো ভাগ করে নিতে পারি।আর সমাজ?এখান থেকে যখন যাবো কোন নির্জন মন্দিরে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তোমার ওই ফাঁকা সিঁথিটা আমি সিঁদুরে রাঙ্গিয়ে দেবো।কোন আপত্তি নেই তো তোমার?
          জয়িতা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শেখরের বুকে মাথা রেখে।

                  শেষ                ২৮-১০-১৭ 

No comments:

Post a Comment