আলোর শিখা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ছ'মাস হতে আসলো এখনও শিখা স্বাভাবিক হতে পারেনি।ফেলে আসা দিনগুলি তার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়।কি এমন অপরাধ ছিলো তার কোন কিছু না জানিয়ে প্রলয় তাকে ছেড়ে চলে গেলো!চলে যাওয়ার দু'দিন আগেও তো প্রলয়ের সাথে দেখা হয়েছে।হঠাৎ কি এমন ঘটলো যে কিচ্ছুটি না বলে তাকে উধাও হয়ে যেতে হোল?বাড়ির সকলে জানতো তার ও প্রলয়ের সম্পর্কটা।মেনেও নিয়েছিলো বাড়ির লোক তাদের এই মেলামেশাটা।প্রলয় মাঝে মাঝে শিখাদের বাড়িতেও আসতো।প্রলয়ের বাবা দেশের বাড়িতে থাকতেন।মাধ্যমিক দেওয়ার আগেই প্রলয়ের মা মারা যান।উচ্চশিক্ষার জন্য প্রলয় কলকাতা এসে একটি মেসে থাকতো।ইন্জিনিয়ারিং পড়ার সময় প্রলয়ের সাথে শিখার বন্ধুত্ব।সে সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে বেশি সময় লাগেনি।শিখার বাবা মেয়েকে সর্বরকম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।মায়ের থেকে বাবা ছিলেন শিখার খুব কাছের।বন্ধুর মত সম্পর্ক পিতা ও কন্যার।ইন্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথম যাওয়ার দিন সকালে শিখা বাবাকে প্রনাম করতে গেলে অবিনাশবাবু তাকে আশীর্বাদ করে বেশ কয়েকটি কথা বলেছিলেন।তারমধ্যে তিনি বন্ধুর মত তার মেয়েকে যেটা বলেছিলেন তা অনেক বাবা-ই হয়তো বলতে দ্বিধাবোধ করবেন।তিনি বলেছিলেন,"দেখো মা,তুমি বড় হয়েছো।আমাদের সমাজে মেয়েদের পদে পদে বিপদ।নিজেকে সামলে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করবে।রাস্তায় চলতে গেলে অনেক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে কিন্তু তাই বলে তো আমরা বেরোনো বন্ধ করে দিতে পারিনা।আমরা কোকিলের সাথে গলা মেলাতে পারি কিন্তু কখোনো
ই কুকুরের সাথে নয়।কুকুরকে আমরা লাঠির সাহায্যে ঘায়েল করতে পারি।তাই এইসব কুকুররুপী মানুষগুলিকে সবসময় এড়িয়ে যেতে হবে,নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে।প্রকৃতির নিয়মে মানুষের জীবনে প্রেম আসা স্বাভাবিক।কিন্তু এখন তোমার শিক্ষার সময়।তুমি মনে রাখবে এই সময় যদি কোন ছেলেকে তোমার ভালো লাগে আর সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, লাগতেই পারে;তুমি যদি তাকে গুরুত্ব দাও আখের ক্ষতি হবে তোমার এবং ওই ছেলেটিরই।এতে পড়াশুনার ক্ষতি হবে তোমাদের দু'জনের।আগে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও তারপর নাহয় ওসব ভেবো।তোমার মতামতকে আমি সবসময় গুরুত্ব দিয়েছি এখনও দেবো। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে যে তুমি ভুল কিছু করবেনা।"
কিন্তু মানুষের মন তো তার নিজ মর্জিতে চলেনা।দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময়েই শিখা প্রেমে পড়ে প্রলয়ের।শিখার প্রলয়কে ভালো লাগতো কিন্তু সে কখনোই মুখ ফুটে কিছু বলেনি।তখন প্রলয় থাকতো কলেজ হোস্টেলে।একদিন ক্লাস শেষে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হোল।শিখা সেদিন ছাতাটা আনতেও ভুলে গেছে।একএক করে কলেজ থেকে সকলেই বেরিয়ে পড়েছে।হঠাৎ প্রলয় একটা ছাতা হাতে শিখার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
---চলো তোমায় বাসস্টান্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসি।যা বৃষ্টি হচ্ছে এই মুহূর্তে থামবে বলে মনে হচ্ছেনা।
---কিন্তু ছাতাটা তো খুব ছোট।দুজনেই ভিজে যাবো।এতো ছোট ছাতার তলে দু'জনে যাওয়া যাবেনা।আমি বরং ভিজতে ভিজতেই চলে যাই।
এ কথা বলেই শিখা বৃষ্টির ভিতর হাঁটতে শুরু করে।প্রলয় দ্রুত ছাতাটা খুলে দৌড়ে এসে শিখার মাথায় ধরে নিজে ভিজে এগিয়ে যেতে থাকে।শিখা সেটা লক্ষ্য করে প্রলয়ের ছাতা ধরা হাতটা টেনে প্রলয়কে নিজের কাছে আনে।পরস্পরের একটা ধাক্কা লাগে।হঠাৎ প্রলয় বলে ওঠে,"তুমি চাইলে এই ছাতাটা আমি আজীবন তোমার মাথায় ধরে থাকতে পারি।যদি তোমার মত থাকে আমায় জানিও।"ঠিক সেইসময় একটা ট্যাক্সি জমে থাকা জলের উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যায় ওদের ভিজিয়ে দিয়ে।দু'জনেই কাদাজলে ভিজে যায়।শিখার মুখেও লেগে যায়।অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে,শুনশান রাস্তা প্রলয় পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করে পরে স্মার্টলি শিখার চিবুকটা ধরে মুখের জলকাদাটা মুছিয়ে দেয়।শিখা ঠকঠক করে তখন কাঁপছে।প্রলয় বলে,
---ভয় পেয়োনা শিখা।আমি তোমায় ভালোবাসি।আর আমি খুব ভুল না করলে আমি এটাও জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো।যদি আমার এই জানাটা ভুল হয় কথা দিচ্ছি পরীক্ষা শেষে তোমার সাথে আমার আর দেখা হবেনা।আজীবন তুমি আমার মনেই থাকবে।
নিজের অজান্তেই শিখার মুখ থেকে 'না' কথাটি বেরিয়ে আসে।
---কি না শিখা?
---না -না মানে কেন দেখা হবেনা?নিশ্চয় আমাদের দেখা হবে।
---তারমানে বলো আমি যা ভেবেছি সেটা ঠিক তো?
শিখা সলজ্জ হেসে মাথা নাড়ে।
মাত্র তো চারটে বছর।দেখতে দেখতে কেটে যায় সময়।শিখা তার বাবাকে প্রলয়ের কথা সব জানায়।শিখার বাবা প্রলয়কে একদিন দেখতে চান।প্রলয় আসে।ছেলেটিকে বেশ ভালোই লাগে শিখার মা ও বাবার।শিখা খুব খুশি হয় মা, বাবা প্রলয়কে মেনে নিয়েছেন দেখে।শিখা প্রলয়কে জানায় এবার তার বাবার মতটা নেওয়ার জন্য।প্রলয় তাকে জানায় ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে সে বাবাকে সব জানাবে।কলেজে যেটুকু তাদের দেখা ও কথা হয় এর বাইরে তাদের কোন কথা হয়না ।এমনকি তারা পরষ্পরের সাথে কখনোই ফোন করেও কথা বলেনা।পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই কলেজ ক্যাম্পাস থেকে প্রলয় মোটা মাইনের এক চাকরীও পেয়ে যায়।কোম্পানীর কথামতো ফাইনাল পরীক্ষার পরেই চাকরীতে জয়েন করতে পারবে।ভবিষৎ জীবনের স্বপ্নে বিভোর তখন দুটি তরুন তরুণী।কিন্তু স্বপ্নের জাল যত সহজে বোনা যায় তত সহজে স্বপ্নকে তো সত্যি করা যায়না।ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন পরেই প্রলয় চলে গেলো গ্রামের বাড়িতে তার বাবাকে সব কিছু জানাতে।কিন্তু সেই যে গেলো আর সে ফিরে এলোনা।প্রথমে অভিমান পরে রাগ আর শেষ পর্যন্ত উৎকন্ঠায় শিখা ছটফট করতে থাকে।বাবা,মা সবই জানেন সুতরাং তাদের সাথে আলোচনা করেও কোন কূলকিনারা শিখা খুঁজে পায়না।শেষে শিখার বাবা ঠিক করেন প্রলয়ের গ্রামের বাড়িতেই যাবেন ব্যাপারটা কি বুঝতে।প্রলয়ের মুখে শুধু গ্রামের নামটা শুনেছিলেন।তার দৃঢ় বিশ্বাস যেহেতু গ্রামের বাড়ি তিনি ঠিক প্রলয়ের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারবেন।প্রলয় জানিয়েছিল তার গ্রামের নাম পিলজঙ্গ।এই নামটিকেই সম্বল করে তিনি তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই প্রলয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন।
বসিরহাটের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি একটি ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করেন।ক্লাবের ছেলেরা তাকে এ ব্যপারে যথেষ্ট সাহায্য করে।তারা স্থানীয় এক পার্টি অফিস থেকে পিলজঙ্গ গ্রামের ভোটার লিষ্ট দেখে সরাসরি প্রলয়দের বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দেয়।ঠিক সন্ধ্যার মুহূর্তে শিখা ও অবিনাশবাবু প্রলয়ের বাড়িতে উপস্থিত হন।বাইরে দাঁড়িয়ে অবিনাশবাবু প্রলয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকেন।ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
---এটা কি প্রলয়ের বাড়ি?
---হ্যাঁ, কিন্তু আপনারা কে?
---বলছি কিন্তু আগে ওকে ডাকুন।
---ও তো এখানে থাকেনা।
---কোথায় থাকে ?
---আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবো তখনই যখনই জানতে পারবো আপনারা কারা, কি উর্দেশ্যে তাকে খুঁজতে এসছেন।
অবিনাশবাবু শিখার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন,
---আমার মেয়ে শিখা।প্রলয় ও শিখা উভয়ে পরষ্পরকে ভালোবাসে।সে বাড়িতে এসছিল এই বিয়েতে আপনার মত নিতে কিন্তু তারপর থেকে আজ প্রায় মাস খানেক হতে চললো তার কোন খবর আমরা পাইনি।তাই তাকে খুঁজতে আমরা কলকাতা থেকে এখানে এসছি।
---আচ্ছা এই সে শিখা।হ্যাঁ আমাকে সে বলেছিলো সে কথা।আমার কোন আপত্তি ছিলোনা।কথা হয়েছিলো খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে সে করবে।যেদিন তার সাথে আমার কথা হয় পরদিন কোন এক অজ্ঞাত কারনে সে আমাকে কিচ্ছু না বলে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এখন সে কোথায় আছে আমি ঠিক বলতে পারবোনা
ঘরের ভিতরে চলে গেলেন।পিতা-পুত্রি হতভম্ব হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের গাড়ির উর্দেশ্যে রওনা দিলেন।
শিখা গুমরে গুমরে তখন কাঁদছে পাছে বাবা দেখে ফেলে এই ভয় ও লজ্জায় যেটুকু নিজেকে বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টা করে যেতে থাকে।তবে বাবা এবং মেয়ে এটা বুঝেছেন প্রলয়ের বাবা তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আসল ঘটনাটা তাদের কাছে লুকিয়ে গেছেন।কিন্তু কি সেই ঘটনা !যারজন্য শিখার ভালোবাসাকে তাকে অগ্রাহ্য করতে হোল!
কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর।প্রলয় এখন মুম্বাই বাসিন্দা।অতীতের কথা মনে পড়লেই নিজেকে যেমন তার অসহায় লাগে ঠিক তেমনই বাবার কথা মনে পড়লে লজ্জায়,ঘেন্নায় গা ঘিনঘিন করতে থাকে।যে বাবাকে সে এত ভালোবাসতো সম্মান করতো তিনি কিনা শেষ পর্যন্ত ---।ভাবলেই মাথায় আগুন চড়ে যায় প্রলয়ের।সেদিন খুব খুশি মনে বাড়িতে ফিরে বাবার কাছে শিখার কথা বলায় বাবা এক বাক্যে মেনে নেন।তিনি বলেন,"সংসার তুমি করবে,চাকরী পেয়ে গেছো আমার তো কোন অসুবিধা বা অমতের প্রশ্নই উঠেনা।"শুনে খুব খুশি হয়েছিলো প্রলয়।
মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকেই এক দূর সম্পর্কের মাসি প্রলয়দের বাড়িতে আশ্রিতা ছিলেন।নাম ছিলো বিনতা।প্রলয় তাকে বিনু মাসি বলেই ডাকতো।খুব ভালোওবাসতো ।মায়ের ছিলো নার্ভের সমস্যা।খুব যন্ত্রনায় কষ্ট পেতেন।তখন এই বীনুমাসি মায়ের কত সেবাযত্ন করতেন।মায়ের অবর্তমানে এই বিনুমাসিই সংসারের সর্বময় কর্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন।সংসারের যাবতীয় কাজ,বাবার সেবাযত্ন কোনটাতেই বিনুমাসির কোন খুদ খুঁজে পাওয়া যেতনা।মাসির বাবা-মা কেউ ছিলেননা।অল্প বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে যখন জায়গা হলোনা তখন একদিন বিনুমাসি একটি টিনের বাক্সে নিজের কিছু জামাকাপড় নিয়ে এসে উঠেছিলেন আমাদের বাড়ি।মা তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেছিলেন,"আজ থেকে আমার বাড়িটা তোর নিজের বাড়ি মনে করিস।"তখন ক্লাস সেভেন বা এইটের ছাত্র ছিলো প্রলয়।মায়ের থেকে বেশ কয়েক বছর ছোট হবে মাসি।তার প্রতিদান যে এভাবে মাসির কাছ থেকে আসবে প্রলয় সেটা কোনদিনও ভাবেনি।অবশ্য মাসিকে দোষ দিয়ে কি লাভ!দোষ সব বাবার।
সেদিন বাবার সাথে কথা হওয়ার পর খেয়েদেয়ে প্রলয় তার ঘরে শুতে চলে যায়।অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম আসেনা।সে দরজা খুলে বাইরে পায়চারি করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্রলয়ের ঘরের পরেই বাবার ঘর তারপর বিনুমাসির ঘর।বাবার ঘরটা পার হতে যেয়ে কিছু ফিসফিস কথা তার কানে আসে।সে থমকে দাঁড়ায়।বিনুমাসি বাবাকে বলছে, "আজ ছেড়ে দাও জামাইবাবু, ছেলেটা বাড়িতে এসছে ও যদি জানতে পারে লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবোনা।ক'টাদিনই বা ছেলেটা থাকবে।এ কটাদিন তুমি আমায় একটু রেহাই দাও।"
বাবা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বলেন, "বিনু,তোর দিদি একটা সন্তান জম্ম দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনদিন আমায় শারীরিক সুখ দিতে পারেনি।ভাগ্যিস তুই এসেছিলি এ বাড়িতে তানাহলে তো জীবনের মানেটাই খুঁজে পেতামনা।নে আর কথা বারাসনা;তোকে একটু আদর করতে না পারলে আমার ঘুম আসবেনা।"
একমুহূর্ত প্রলয় আর সেখানে দাঁড়ায়নি।নিজের ঘরে ঢুকে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে শুধু কেঁদে গেছে।নিজেকে পরে সামলে নিয়ে বাবার উর্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে জামাকাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পরে।
পোষ্টিং এর ব্যপারে তারকাছে দু'টি অপশন ছিলো।প্রথমটা কলকাতা পরেরটা মুম্বাই।সে দ্বিতীয়টাকেই বেছে নেয়।বাবার কথা কোন মুখে সে শিখার কাছে জানাবে?কি করে বলবে তার বাবা চরিত্রহীন।চরিত্রহীন বাপের ছেলের সাথে শিখার মা,বাবা কিছুতেই বিয়ে দিতে চাইবেননা।কি করে এ মুখ শিখা ও তার পরিবারের কাছে সে দেখাবে।তার চেয়ে বরং ভালো শিখার জীবন থেকে সরে যাওয়া।কিন্তু সত্যিই কি সে শিখার জীবন থেকে সরতে পেরেছিলো? অন্তরে যার বাস তাকে কি সরানো যায় জীবন থেকে? প্রতিমুহূর্তে সে তুষের আগুনে পুড়ে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে।মন ছুটে যেতে চাইছে তার কাছে;কিছুতেই বিবেক সায় দিচ্ছেনা।ফোন করারও উপায় নেই।সেদিন ওই দম বন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাড়ির থেকে বেরোনোর সময় ভুলে ফোনটাই তার আনা হয়নি।তিনটে বছর কোথা থেকে কিভাবে যে কেটে গেলো এখন চিন্তা করতে গেলে প্রলয় কিছুতেই তার হিসাব মিলাতে পারেনা।অনেক ভেবেছে সে।বাবার অপরাধের শাস্তি সে ভোগ করবে কেন?কেন সে নিজের জীবনটাকে এইভাবে নষ্ট করছে?তার মন বলে আজও শিখা তার অপেক্ষাতেই আছে।সবকিছু সে গিয়ে খুলে বলবে।যে শাস্তি শিখা তাকে দেবে সে তা মাথা পেতে নেবে।শিখাকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না।এবার নিজের মনকে সে শক্ত করে সে শিখার কাছে যেয়ে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে তার পরিবারের সমস্ত কথা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
কিন্তু যাবো বললেই তো আর যাওয়া যায়না।এখন সে অফিসের এক্জিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার।ছুটি পাওয়া এখন বিশাল ব্যপার।ছুটির জন্য সে দরখাস্ত করে।পনেরদিন ছুটি চেয়ে সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর হয় তার।মুম্বাই থেকে প্রলয় বাই প্লেন কলকাতা এসে পৌঁছায়।ওঠে একটা হোটেলে।সেদিনই সন্ধ্যার দিকে সে আসে শিখাদের বাড়ি।একি এত বড় বাড়ি অন্ধকার কেন?গেটেও একটা বড় তালা ঝুলছে।এগিয়ে গেলো পাশের বাড়ির গেটের কাছে।এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইলো শিখাদের খবর।তিনি প্রলয়কে বললেন,"মাস ছ'য়েক আগে শিখার মা মারা যান।সে একটা বড় প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে।কিন্তু তার অফিসটা একটু দূরে হওয়াতে এখান থেকে যাতায়াত করতে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো।দাদারও বয়স হয়েছে।মেয়েটি সকালে বেরোতো আর রাতে ফিরতো।সারাটাদিন বয়স্ক লোকটাকে একটা কাজের লোকের কাছে থাকতে হত।শিখার খুব দুঃশ্চিন্তা হত।শেষমেষ তারা একটা ঘর ভাড়া করে শিখার অফিসে যাতায়াতের সুবিধার জন্য চলে যান।পুজোর ছুটিতে এখানে আবার আসাবেন বলে গেছেন।কিন্তু আপনার পরিচয়টা তো জানতে পারলামনা।"
এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে প্রলয় আবারও জানতে চায়, "আচ্ছা শিখা কোন অফিসে চাকরী করে?ওর ফোন নম্বরটা যদি ----" কথা শেষ হওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা দু'টি প্রশ্নের উত্তরেই 'না' সূচক মাথা নাড়েন।
মনের মাঝে একটি সুপ্ত আশা নিয়ে নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সে এসেছিলো শিখার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে।শিখা যে আজও বিয়ে করেনি এ ব্যপারে সে নিশ্চিত হোল ওই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে।কিন্তু কোথায় খুঁজবে সে এখন শিখাকে?কেউ তো কিছুই বলতে পারছেনা।না,ছুটিটা নষ্ট করা যাবেনা।কালই তাকে মুম্বাই এর উর্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।পুজোর সময় আবার সে আসবে।শিখার কাছে যেভাবেই হোক তাকে ক্ষমা পেতেই হবে।
অবিনাশবাবুরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে।মাঝে মধ্যেই তারও শরীর ঠিক থাকেনা।তিনি বারবার বলেও মেয়েকে বিয়ে বসতে রাজি করাতে পারেননি।তার এক গো-"আমি চলে গেলে তোমায় কে দেখবে?"বাড়ি ছেড়ে মেয়ের অফিসের যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি ঘর ভাড়া করে থাকছেন কিন্তু তাতেও তার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি নেই কারন তার অবর্তমানে তার শিখার কি হবে? সে কি আদতেও তার জীবনের আলোর শিখাটি দেখতে পাবে?প্রলয়কে দেখে তার কখনোই খারাপ বলে মনে হয়নি।বেশ খোলামেলা বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে বলেই মনে হয়েছে।তবে কিসের জন্য সে তার একমাত্র মেয়ের জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললো এর উত্তর তিনি কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারলেননা।অনেক চেষ্টা করেছেন, নানান অফিসেও খোঁজখবর করেছেন কিন্তু কোন হদিস করতে পারেননি।এই বয়সে এসে মেয়ের কষ্টটা তিনি শত চেষ্টা করেও তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি আর এই না পারাটাই তাকে কুরে কুরে খায়।এখন তিনি পুরো অসহায়।হঠাৎ করেই শিখার মায়ের মৃত্যুটাও তাকে আরও অসহায় করে তুলেছে।এখন তিনি খুব একটা হাঁটাচলা করতেও পারেননা।সর্বক্ষণ একটি কাজের মেয়ে তার সঙ্গী যে শিখারই সমবয়সী।মেয়ে অফিস থেকে আসলে তিনি যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন।সব সময় তার আদরের শিখার জন্য তার একটা দুশ্চিন্তাও কাজ করে।
দুর্গা পুজোর ঠিক পঞ্চমীর দিনে শিখা অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে সামনের গেট থেকে উঠতে যেয়ে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায় আর ওই বাসেরই পিছনের চাকা এসে শিখার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়।রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ,শিখা তার জ্ঞান হারিয়েছে;তাকে ঘিরে লোকের জটলা।কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেনা।সকলেই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।হঠাৎ ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসলো এক যুবক।যে কিনা ট্যাক্সি করে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার এক পাশে ভিড় দেখে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে ভিড়ের ভিতর ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে অন্য লোকের সাহায্যে শিখাকে তুলে ওই ট্যাক্সিতেই হাসপাতাল পৌঁছায়।রাস্তার অল্প আলোতে আর লোকের ভিড়ে ছেলেটি তখন মেয়েটির মুখটি ভালোভাবে দেখতেও পারেনি।মুখটি যখন সে দেখলো তখন মেয়েটি স্ট্রেচারে শোয়ানো।জ্ঞানহীন।প্রলয়ের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে একটি কথায় বেরিয়ে আসলো,"শিখা?হায় ঈশ্বর!এ তুমি কি শাস্তি দিলে আমায়?" শিখাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো।কিন্তু পরমুহূর্তেই সেখান থেকে বের করে প্রলয়ের অনুমতি সাপেক্ষে সোজা অপারেশান থিয়েটারে।সরকারি কাজগুলো প্রলয় দ্রুত সেরে ফেললো।রিলেশনের জায়গায় প্রলয় ওয়াইফ লিখে দিলো।শিখার ব্যাগটা থেকে মোবাইল বের করে কন্টাক্টসে বাবা লেখা দেখে শিখার বাবাকে ফোন করে জানালো তার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে হাসপাতাল থেকে ফোন করছি।তার অফিস কলিগরা আছে আপনি কোন চিন্তা করবেননা।
দীর্ঘ চার ঘন্টা অপারেশান শেষ ডাক্তার বেরিয়ে এসে যে কথা প্রলয়কে শুনালেন তারজন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা।প্রলয় মাথায় হাত দিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের উপরেই বসে পড়লো।বিরবির করে বলতে লাগলো,"সবকিছুর জন্য আমি দায়ী শিখা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।"
পরদিন দুপুরবেলার দিকে শিখার জ্ঞান ফিরলো।প্রলয় এক মুহূর্তের জন্যও হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যায়নি।মাঝে মাঝে অবিনাশবাবুকে ফোন করে শিখার খবরাখবর দিয়েছে অফিস কলিগ সেজে।শিখার জ্ঞান ফিরলে নার্স এসে প্রলয়কে ডেকে নিয়ে যায়।শিখা চোখ খুলেই দেখে প্রলয় দাঁড়িয়ে।মুখে মাস্ক কথা বলার ক্ষমতা নেই কিন্তু চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।পায়ের পাতা থেকে কোমর অবধি সাদা কাপড়ে ঢাকা।শিখা এখনও জানেনা তার বা পায়ের উপরের অংশ থেকে সম্পূর্ণ বাদ গেছে।প্রলয় নিজেকে সামলাতে সেখান থেকে দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে আসে।
বিকালে আবার সে শিখার সাথে দেখা করতে যায়।তখন তার মাস্ক খুলে দেওয়া হয়েছে।প্রলয়কে দেখে শিখা চোখ বন্ধ করে নেয়।প্রলয় এগিয়ে যেয়ে শিখার একটি হাত ধরে বলে,"ক্ষমা করে দাও শিখা। কি পরিস্থিতিতে কেন করেছি সব বলবো তোমায় তুমি শুধু আমায় একটিবার বল আমায় ক্ষমা করবে?"শিখা চুপ করে থাকে।কোন উত্তর সে করেনা এ বিষয়ে।শুধু বলে,
---বাবা খুব চিন্তা করছেন।একটা ফোন করতে হবে।
---মেসোমশাইকে আমি তোমার খবর জানিয়েছি।তোমার ফোনটা আমার কাছে আছে,কথা বলবে?
---শিখা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
ফোনটা শিখার হাতে প্রলয় তুলে দিতে গেলে একজন নার্স এসে বাঁধা দেন।তিনি বলেন যে শিখার এখন বেশি কথা বলা ঠিকনা।নার্সকে দেখে শিখা জানতে চায়,
---আমার পা টা এত যন্ত্রনা করছে কেন?
---এখন তো একটু যন্ত্রনা করবে।পেইন কিলার দেওয়া হয়েছে ঠিক হয়ে যাবে কিছু পরে।কথাগুলো বলে সিস্টার চলে যান।
প্রলয় এগিয়ে যায় শিখার কাছে।মাথায় হাত রাখে।শিখা চোখ বন্ধ করে থাকে।কোন কথা আর তাদের মধ্যে হয়না।ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়।"কাল সকালে আবার আসবো"-বলে প্রলয় বেরিয়ে আসে।
রাস্তায় বেরিয়ে একটা উবের বুক করে সোজা চলে আসে শিখাদের বেহালার বাড়িতে।কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দেয়।প্রলয় কাজের মেয়েটিকে বলে সে শিখার বাবার সাথে দেখা করতে চায়।তাকে নিয়ে কাজের মেয়েটি অবিনাশবাবুর কাছে যায়।প্রলয়কে দেখেই উনি চিনতে পারেন।
---প্রলয় তুমি?খুব দরকার ছিলো এই সময়ে তোমাকে।জানো বাবা, শিখা অ্যাক্সিডেন্ট করে হাসপাতাল রয়েছে।আমি তো এখন অথর্ব।মেয়েটি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে শুনেও কিছুই করতে পারছিনা।আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই যাকে ওখানে পাঠাতে পারি।ওর এক অফিস কলিগই ওকে দেখাশুনা করছে।তুমি কিছু একটা কর বাবা।
প্রলয় আমতা আমতা করে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে বলা শুরু করে।কিন্তু কথার মাঝপথে চুপ করে যাওয়াতে অবিনাশবাবু অধর্য্য হয়ে উঠে বলেন,"আহ!চুপ করে গেলে কেন?আমাকে সব খুলে বলো।"
---আস---লে
---বলো প্রলয় খুলে বলো ।
---ওর মানে ওর তো বা পায়ের উপর থেকে বাসের পিছনের চাকা চলে গেছিলো ---তাই ওই পায়ের হাঁটুর কাছ থেকে সম্পূর্ণ অংশ বাদ ---
প্রলয়ের কথা শেষ হয়না।অবিনাশবাবু ছোট শিশুর মত ডুকরে কেঁদে ওঠেন।প্রলয়ের চোখেও জল।সে উঠে যেয়ে অবিনাশবাবুর কাঁধে হাত দেয়।অবিনাশবাবুর কান্না যেন দ্বিগুন বেগে ঝরতে থাকে।কিছুক্ষণ পর প্রলয় নিজেই বলে,
---মেসোমশাই নিজেকে শান্ত করুন।আপনি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়েন আমি একা শিখাকে সামলাতে পারবোনা।আমি শিখার পাশে সারাজীবন আছি আপনাকে কথা দিচ্ছি।আমি একটা ভুল করেছিলাম তার প্রাশ্চিত্ত আমাকে করতেই হবে।ও সুস্থ্য হয়ে বাড়ি আসুক আমি ওকে অন্যভাবে হাঁটার ব্যবস্থা করে দেবোই।কিন্তু আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দেন।নিজের পরিবারের প্রতি ঘেন্না বশত আমি নিজেকে শিখার অনুপযুক্ত মনে করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।আমি সব বলবো আপনাদের।কিন্তু আগে আমাদের দরকার শিখার কাছে যেয়ে তার মনোবল বাড়ানো।সে এখনও জানেনা বিধাতা তার সাথে কি নিষ্ঠুর খেলা খেলেছেন।চলুন আমরা বেরিয়ে পড়ি শিখার কাছে।
এ কথা শুনে অবিনাশবাবু বাধ্যশিশুর মত জামাপ্যান্ট পড়ে প্রলয়ের একটা হাত ধরে বলেন,"এবার শিখার হাতটা তুমি শক্ত করে ধরো বাবা,আমি আর ক'দিন?মেয়েটা যে বড্ড অসহায় হয়ে পড়লো।"
---আমি আছি,আপনি একদম ভাববেন না।
দু'জনে হাসপাতালের উর্দেশ্যে রওনা হলেন।
....শেষ....
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ছ'মাস হতে আসলো এখনও শিখা স্বাভাবিক হতে পারেনি।ফেলে আসা দিনগুলি তার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়।কি এমন অপরাধ ছিলো তার কোন কিছু না জানিয়ে প্রলয় তাকে ছেড়ে চলে গেলো!চলে যাওয়ার দু'দিন আগেও তো প্রলয়ের সাথে দেখা হয়েছে।হঠাৎ কি এমন ঘটলো যে কিচ্ছুটি না বলে তাকে উধাও হয়ে যেতে হোল?বাড়ির সকলে জানতো তার ও প্রলয়ের সম্পর্কটা।মেনেও নিয়েছিলো বাড়ির লোক তাদের এই মেলামেশাটা।প্রলয় মাঝে মাঝে শিখাদের বাড়িতেও আসতো।প্রলয়ের বাবা দেশের বাড়িতে থাকতেন।মাধ্যমিক দেওয়ার আগেই প্রলয়ের মা মারা যান।উচ্চশিক্ষার জন্য প্রলয় কলকাতা এসে একটি মেসে থাকতো।ইন্জিনিয়ারিং পড়ার সময় প্রলয়ের সাথে শিখার বন্ধুত্ব।সে সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে বেশি সময় লাগেনি।শিখার বাবা মেয়েকে সর্বরকম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।মায়ের থেকে বাবা ছিলেন শিখার খুব কাছের।বন্ধুর মত সম্পর্ক পিতা ও কন্যার।ইন্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথম যাওয়ার দিন সকালে শিখা বাবাকে প্রনাম করতে গেলে অবিনাশবাবু তাকে আশীর্বাদ করে বেশ কয়েকটি কথা বলেছিলেন।তারমধ্যে তিনি বন্ধুর মত তার মেয়েকে যেটা বলেছিলেন তা অনেক বাবা-ই হয়তো বলতে দ্বিধাবোধ করবেন।তিনি বলেছিলেন,"দেখো মা,তুমি বড় হয়েছো।আমাদের সমাজে মেয়েদের পদে পদে বিপদ।নিজেকে সামলে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করবে।রাস্তায় চলতে গেলে অনেক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে কিন্তু তাই বলে তো আমরা বেরোনো বন্ধ করে দিতে পারিনা।আমরা কোকিলের সাথে গলা মেলাতে পারি কিন্তু কখোনো
ই কুকুরের সাথে নয়।কুকুরকে আমরা লাঠির সাহায্যে ঘায়েল করতে পারি।তাই এইসব কুকুররুপী মানুষগুলিকে সবসময় এড়িয়ে যেতে হবে,নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে।প্রকৃতির নিয়মে মানুষের জীবনে প্রেম আসা স্বাভাবিক।কিন্তু এখন তোমার শিক্ষার সময়।তুমি মনে রাখবে এই সময় যদি কোন ছেলেকে তোমার ভালো লাগে আর সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, লাগতেই পারে;তুমি যদি তাকে গুরুত্ব দাও আখের ক্ষতি হবে তোমার এবং ওই ছেলেটিরই।এতে পড়াশুনার ক্ষতি হবে তোমাদের দু'জনের।আগে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও তারপর নাহয় ওসব ভেবো।তোমার মতামতকে আমি সবসময় গুরুত্ব দিয়েছি এখনও দেবো। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে যে তুমি ভুল কিছু করবেনা।"
কিন্তু মানুষের মন তো তার নিজ মর্জিতে চলেনা।দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময়েই শিখা প্রেমে পড়ে প্রলয়ের।শিখার প্রলয়কে ভালো লাগতো কিন্তু সে কখনোই মুখ ফুটে কিছু বলেনি।তখন প্রলয় থাকতো কলেজ হোস্টেলে।একদিন ক্লাস শেষে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হোল।শিখা সেদিন ছাতাটা আনতেও ভুলে গেছে।একএক করে কলেজ থেকে সকলেই বেরিয়ে পড়েছে।হঠাৎ প্রলয় একটা ছাতা হাতে শিখার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
---চলো তোমায় বাসস্টান্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসি।যা বৃষ্টি হচ্ছে এই মুহূর্তে থামবে বলে মনে হচ্ছেনা।
---কিন্তু ছাতাটা তো খুব ছোট।দুজনেই ভিজে যাবো।এতো ছোট ছাতার তলে দু'জনে যাওয়া যাবেনা।আমি বরং ভিজতে ভিজতেই চলে যাই।
এ কথা বলেই শিখা বৃষ্টির ভিতর হাঁটতে শুরু করে।প্রলয় দ্রুত ছাতাটা খুলে দৌড়ে এসে শিখার মাথায় ধরে নিজে ভিজে এগিয়ে যেতে থাকে।শিখা সেটা লক্ষ্য করে প্রলয়ের ছাতা ধরা হাতটা টেনে প্রলয়কে নিজের কাছে আনে।পরস্পরের একটা ধাক্কা লাগে।হঠাৎ প্রলয় বলে ওঠে,"তুমি চাইলে এই ছাতাটা আমি আজীবন তোমার মাথায় ধরে থাকতে পারি।যদি তোমার মত থাকে আমায় জানিও।"ঠিক সেইসময় একটা ট্যাক্সি জমে থাকা জলের উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যায় ওদের ভিজিয়ে দিয়ে।দু'জনেই কাদাজলে ভিজে যায়।শিখার মুখেও লেগে যায়।অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে,শুনশান রাস্তা প্রলয় পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করে পরে স্মার্টলি শিখার চিবুকটা ধরে মুখের জলকাদাটা মুছিয়ে দেয়।শিখা ঠকঠক করে তখন কাঁপছে।প্রলয় বলে,
---ভয় পেয়োনা শিখা।আমি তোমায় ভালোবাসি।আর আমি খুব ভুল না করলে আমি এটাও জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো।যদি আমার এই জানাটা ভুল হয় কথা দিচ্ছি পরীক্ষা শেষে তোমার সাথে আমার আর দেখা হবেনা।আজীবন তুমি আমার মনেই থাকবে।
নিজের অজান্তেই শিখার মুখ থেকে 'না' কথাটি বেরিয়ে আসে।
---কি না শিখা?
---না -না মানে কেন দেখা হবেনা?নিশ্চয় আমাদের দেখা হবে।
---তারমানে বলো আমি যা ভেবেছি সেটা ঠিক তো?
শিখা সলজ্জ হেসে মাথা নাড়ে।
মাত্র তো চারটে বছর।দেখতে দেখতে কেটে যায় সময়।শিখা তার বাবাকে প্রলয়ের কথা সব জানায়।শিখার বাবা প্রলয়কে একদিন দেখতে চান।প্রলয় আসে।ছেলেটিকে বেশ ভালোই লাগে শিখার মা ও বাবার।শিখা খুব খুশি হয় মা, বাবা প্রলয়কে মেনে নিয়েছেন দেখে।শিখা প্রলয়কে জানায় এবার তার বাবার মতটা নেওয়ার জন্য।প্রলয় তাকে জানায় ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে সে বাবাকে সব জানাবে।কলেজে যেটুকু তাদের দেখা ও কথা হয় এর বাইরে তাদের কোন কথা হয়না ।এমনকি তারা পরষ্পরের সাথে কখনোই ফোন করেও কথা বলেনা।পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই কলেজ ক্যাম্পাস থেকে প্রলয় মোটা মাইনের এক চাকরীও পেয়ে যায়।কোম্পানীর কথামতো ফাইনাল পরীক্ষার পরেই চাকরীতে জয়েন করতে পারবে।ভবিষৎ জীবনের স্বপ্নে বিভোর তখন দুটি তরুন তরুণী।কিন্তু স্বপ্নের জাল যত সহজে বোনা যায় তত সহজে স্বপ্নকে তো সত্যি করা যায়না।ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন পরেই প্রলয় চলে গেলো গ্রামের বাড়িতে তার বাবাকে সব কিছু জানাতে।কিন্তু সেই যে গেলো আর সে ফিরে এলোনা।প্রথমে অভিমান পরে রাগ আর শেষ পর্যন্ত উৎকন্ঠায় শিখা ছটফট করতে থাকে।বাবা,মা সবই জানেন সুতরাং তাদের সাথে আলোচনা করেও কোন কূলকিনারা শিখা খুঁজে পায়না।শেষে শিখার বাবা ঠিক করেন প্রলয়ের গ্রামের বাড়িতেই যাবেন ব্যাপারটা কি বুঝতে।প্রলয়ের মুখে শুধু গ্রামের নামটা শুনেছিলেন।তার দৃঢ় বিশ্বাস যেহেতু গ্রামের বাড়ি তিনি ঠিক প্রলয়ের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারবেন।প্রলয় জানিয়েছিল তার গ্রামের নাম পিলজঙ্গ।এই নামটিকেই সম্বল করে তিনি তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই প্রলয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন।
বসিরহাটের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি একটি ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করেন।ক্লাবের ছেলেরা তাকে এ ব্যপারে যথেষ্ট সাহায্য করে।তারা স্থানীয় এক পার্টি অফিস থেকে পিলজঙ্গ গ্রামের ভোটার লিষ্ট দেখে সরাসরি প্রলয়দের বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দেয়।ঠিক সন্ধ্যার মুহূর্তে শিখা ও অবিনাশবাবু প্রলয়ের বাড়িতে উপস্থিত হন।বাইরে দাঁড়িয়ে অবিনাশবাবু প্রলয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকেন।ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
---এটা কি প্রলয়ের বাড়ি?
---হ্যাঁ, কিন্তু আপনারা কে?
---বলছি কিন্তু আগে ওকে ডাকুন।
---ও তো এখানে থাকেনা।
---কোথায় থাকে ?
---আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবো তখনই যখনই জানতে পারবো আপনারা কারা, কি উর্দেশ্যে তাকে খুঁজতে এসছেন।
অবিনাশবাবু শিখার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন,
---আমার মেয়ে শিখা।প্রলয় ও শিখা উভয়ে পরষ্পরকে ভালোবাসে।সে বাড়িতে এসছিল এই বিয়েতে আপনার মত নিতে কিন্তু তারপর থেকে আজ প্রায় মাস খানেক হতে চললো তার কোন খবর আমরা পাইনি।তাই তাকে খুঁজতে আমরা কলকাতা থেকে এখানে এসছি।
---আচ্ছা এই সে শিখা।হ্যাঁ আমাকে সে বলেছিলো সে কথা।আমার কোন আপত্তি ছিলোনা।কথা হয়েছিলো খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে সে করবে।যেদিন তার সাথে আমার কথা হয় পরদিন কোন এক অজ্ঞাত কারনে সে আমাকে কিচ্ছু না বলে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এখন সে কোথায় আছে আমি ঠিক বলতে পারবোনা
ঘরের ভিতরে চলে গেলেন।পিতা-পুত্রি হতভম্ব হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের গাড়ির উর্দেশ্যে রওনা দিলেন।
শিখা গুমরে গুমরে তখন কাঁদছে পাছে বাবা দেখে ফেলে এই ভয় ও লজ্জায় যেটুকু নিজেকে বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টা করে যেতে থাকে।তবে বাবা এবং মেয়ে এটা বুঝেছেন প্রলয়ের বাবা তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আসল ঘটনাটা তাদের কাছে লুকিয়ে গেছেন।কিন্তু কি সেই ঘটনা !যারজন্য শিখার ভালোবাসাকে তাকে অগ্রাহ্য করতে হোল!
কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর।প্রলয় এখন মুম্বাই বাসিন্দা।অতীতের কথা মনে পড়লেই নিজেকে যেমন তার অসহায় লাগে ঠিক তেমনই বাবার কথা মনে পড়লে লজ্জায়,ঘেন্নায় গা ঘিনঘিন করতে থাকে।যে বাবাকে সে এত ভালোবাসতো সম্মান করতো তিনি কিনা শেষ পর্যন্ত ---।ভাবলেই মাথায় আগুন চড়ে যায় প্রলয়ের।সেদিন খুব খুশি মনে বাড়িতে ফিরে বাবার কাছে শিখার কথা বলায় বাবা এক বাক্যে মেনে নেন।তিনি বলেন,"সংসার তুমি করবে,চাকরী পেয়ে গেছো আমার তো কোন অসুবিধা বা অমতের প্রশ্নই উঠেনা।"শুনে খুব খুশি হয়েছিলো প্রলয়।
মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকেই এক দূর সম্পর্কের মাসি প্রলয়দের বাড়িতে আশ্রিতা ছিলেন।নাম ছিলো বিনতা।প্রলয় তাকে বিনু মাসি বলেই ডাকতো।খুব ভালোওবাসতো ।মায়ের ছিলো নার্ভের সমস্যা।খুব যন্ত্রনায় কষ্ট পেতেন।তখন এই বীনুমাসি মায়ের কত সেবাযত্ন করতেন।মায়ের অবর্তমানে এই বিনুমাসিই সংসারের সর্বময় কর্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন।সংসারের যাবতীয় কাজ,বাবার সেবাযত্ন কোনটাতেই বিনুমাসির কোন খুদ খুঁজে পাওয়া যেতনা।মাসির বাবা-মা কেউ ছিলেননা।অল্প বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে যখন জায়গা হলোনা তখন একদিন বিনুমাসি একটি টিনের বাক্সে নিজের কিছু জামাকাপড় নিয়ে এসে উঠেছিলেন আমাদের বাড়ি।মা তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেছিলেন,"আজ থেকে আমার বাড়িটা তোর নিজের বাড়ি মনে করিস।"তখন ক্লাস সেভেন বা এইটের ছাত্র ছিলো প্রলয়।মায়ের থেকে বেশ কয়েক বছর ছোট হবে মাসি।তার প্রতিদান যে এভাবে মাসির কাছ থেকে আসবে প্রলয় সেটা কোনদিনও ভাবেনি।অবশ্য মাসিকে দোষ দিয়ে কি লাভ!দোষ সব বাবার।
সেদিন বাবার সাথে কথা হওয়ার পর খেয়েদেয়ে প্রলয় তার ঘরে শুতে চলে যায়।অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম আসেনা।সে দরজা খুলে বাইরে পায়চারি করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্রলয়ের ঘরের পরেই বাবার ঘর তারপর বিনুমাসির ঘর।বাবার ঘরটা পার হতে যেয়ে কিছু ফিসফিস কথা তার কানে আসে।সে থমকে দাঁড়ায়।বিনুমাসি বাবাকে বলছে, "আজ ছেড়ে দাও জামাইবাবু, ছেলেটা বাড়িতে এসছে ও যদি জানতে পারে লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবোনা।ক'টাদিনই বা ছেলেটা থাকবে।এ কটাদিন তুমি আমায় একটু রেহাই দাও।"
বাবা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বলেন, "বিনু,তোর দিদি একটা সন্তান জম্ম দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনদিন আমায় শারীরিক সুখ দিতে পারেনি।ভাগ্যিস তুই এসেছিলি এ বাড়িতে তানাহলে তো জীবনের মানেটাই খুঁজে পেতামনা।নে আর কথা বারাসনা;তোকে একটু আদর করতে না পারলে আমার ঘুম আসবেনা।"
একমুহূর্ত প্রলয় আর সেখানে দাঁড়ায়নি।নিজের ঘরে ঢুকে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে শুধু কেঁদে গেছে।নিজেকে পরে সামলে নিয়ে বাবার উর্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে জামাকাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পরে।
পোষ্টিং এর ব্যপারে তারকাছে দু'টি অপশন ছিলো।প্রথমটা কলকাতা পরেরটা মুম্বাই।সে দ্বিতীয়টাকেই বেছে নেয়।বাবার কথা কোন মুখে সে শিখার কাছে জানাবে?কি করে বলবে তার বাবা চরিত্রহীন।চরিত্রহীন বাপের ছেলের সাথে শিখার মা,বাবা কিছুতেই বিয়ে দিতে চাইবেননা।কি করে এ মুখ শিখা ও তার পরিবারের কাছে সে দেখাবে।তার চেয়ে বরং ভালো শিখার জীবন থেকে সরে যাওয়া।কিন্তু সত্যিই কি সে শিখার জীবন থেকে সরতে পেরেছিলো? অন্তরে যার বাস তাকে কি সরানো যায় জীবন থেকে? প্রতিমুহূর্তে সে তুষের আগুনে পুড়ে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে।মন ছুটে যেতে চাইছে তার কাছে;কিছুতেই বিবেক সায় দিচ্ছেনা।ফোন করারও উপায় নেই।সেদিন ওই দম বন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাড়ির থেকে বেরোনোর সময় ভুলে ফোনটাই তার আনা হয়নি।তিনটে বছর কোথা থেকে কিভাবে যে কেটে গেলো এখন চিন্তা করতে গেলে প্রলয় কিছুতেই তার হিসাব মিলাতে পারেনা।অনেক ভেবেছে সে।বাবার অপরাধের শাস্তি সে ভোগ করবে কেন?কেন সে নিজের জীবনটাকে এইভাবে নষ্ট করছে?তার মন বলে আজও শিখা তার অপেক্ষাতেই আছে।সবকিছু সে গিয়ে খুলে বলবে।যে শাস্তি শিখা তাকে দেবে সে তা মাথা পেতে নেবে।শিখাকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না।এবার নিজের মনকে সে শক্ত করে সে শিখার কাছে যেয়ে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে তার পরিবারের সমস্ত কথা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
কিন্তু যাবো বললেই তো আর যাওয়া যায়না।এখন সে অফিসের এক্জিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার।ছুটি পাওয়া এখন বিশাল ব্যপার।ছুটির জন্য সে দরখাস্ত করে।পনেরদিন ছুটি চেয়ে সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর হয় তার।মুম্বাই থেকে প্রলয় বাই প্লেন কলকাতা এসে পৌঁছায়।ওঠে একটা হোটেলে।সেদিনই সন্ধ্যার দিকে সে আসে শিখাদের বাড়ি।একি এত বড় বাড়ি অন্ধকার কেন?গেটেও একটা বড় তালা ঝুলছে।এগিয়ে গেলো পাশের বাড়ির গেটের কাছে।এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইলো শিখাদের খবর।তিনি প্রলয়কে বললেন,"মাস ছ'য়েক আগে শিখার মা মারা যান।সে একটা বড় প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে।কিন্তু তার অফিসটা একটু দূরে হওয়াতে এখান থেকে যাতায়াত করতে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো।দাদারও বয়স হয়েছে।মেয়েটি সকালে বেরোতো আর রাতে ফিরতো।সারাটাদিন বয়স্ক লোকটাকে একটা কাজের লোকের কাছে থাকতে হত।শিখার খুব দুঃশ্চিন্তা হত।শেষমেষ তারা একটা ঘর ভাড়া করে শিখার অফিসে যাতায়াতের সুবিধার জন্য চলে যান।পুজোর ছুটিতে এখানে আবার আসাবেন বলে গেছেন।কিন্তু আপনার পরিচয়টা তো জানতে পারলামনা।"
এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে প্রলয় আবারও জানতে চায়, "আচ্ছা শিখা কোন অফিসে চাকরী করে?ওর ফোন নম্বরটা যদি ----" কথা শেষ হওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা দু'টি প্রশ্নের উত্তরেই 'না' সূচক মাথা নাড়েন।
মনের মাঝে একটি সুপ্ত আশা নিয়ে নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সে এসেছিলো শিখার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে।শিখা যে আজও বিয়ে করেনি এ ব্যপারে সে নিশ্চিত হোল ওই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে।কিন্তু কোথায় খুঁজবে সে এখন শিখাকে?কেউ তো কিছুই বলতে পারছেনা।না,ছুটিটা নষ্ট করা যাবেনা।কালই তাকে মুম্বাই এর উর্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।পুজোর সময় আবার সে আসবে।শিখার কাছে যেভাবেই হোক তাকে ক্ষমা পেতেই হবে।
অবিনাশবাবুরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে।মাঝে মধ্যেই তারও শরীর ঠিক থাকেনা।তিনি বারবার বলেও মেয়েকে বিয়ে বসতে রাজি করাতে পারেননি।তার এক গো-"আমি চলে গেলে তোমায় কে দেখবে?"বাড়ি ছেড়ে মেয়ের অফিসের যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি ঘর ভাড়া করে থাকছেন কিন্তু তাতেও তার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি নেই কারন তার অবর্তমানে তার শিখার কি হবে? সে কি আদতেও তার জীবনের আলোর শিখাটি দেখতে পাবে?প্রলয়কে দেখে তার কখনোই খারাপ বলে মনে হয়নি।বেশ খোলামেলা বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে বলেই মনে হয়েছে।তবে কিসের জন্য সে তার একমাত্র মেয়ের জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললো এর উত্তর তিনি কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারলেননা।অনেক চেষ্টা করেছেন, নানান অফিসেও খোঁজখবর করেছেন কিন্তু কোন হদিস করতে পারেননি।এই বয়সে এসে মেয়ের কষ্টটা তিনি শত চেষ্টা করেও তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি আর এই না পারাটাই তাকে কুরে কুরে খায়।এখন তিনি পুরো অসহায়।হঠাৎ করেই শিখার মায়ের মৃত্যুটাও তাকে আরও অসহায় করে তুলেছে।এখন তিনি খুব একটা হাঁটাচলা করতেও পারেননা।সর্বক্ষণ একটি কাজের মেয়ে তার সঙ্গী যে শিখারই সমবয়সী।মেয়ে অফিস থেকে আসলে তিনি যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন।সব সময় তার আদরের শিখার জন্য তার একটা দুশ্চিন্তাও কাজ করে।
দুর্গা পুজোর ঠিক পঞ্চমীর দিনে শিখা অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে সামনের গেট থেকে উঠতে যেয়ে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায় আর ওই বাসেরই পিছনের চাকা এসে শিখার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়।রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ,শিখা তার জ্ঞান হারিয়েছে;তাকে ঘিরে লোকের জটলা।কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেনা।সকলেই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।হঠাৎ ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসলো এক যুবক।যে কিনা ট্যাক্সি করে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার এক পাশে ভিড় দেখে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে ভিড়ের ভিতর ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে অন্য লোকের সাহায্যে শিখাকে তুলে ওই ট্যাক্সিতেই হাসপাতাল পৌঁছায়।রাস্তার অল্প আলোতে আর লোকের ভিড়ে ছেলেটি তখন মেয়েটির মুখটি ভালোভাবে দেখতেও পারেনি।মুখটি যখন সে দেখলো তখন মেয়েটি স্ট্রেচারে শোয়ানো।জ্ঞানহীন।প্রলয়ের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে একটি কথায় বেরিয়ে আসলো,"শিখা?হায় ঈশ্বর!এ তুমি কি শাস্তি দিলে আমায়?" শিখাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো।কিন্তু পরমুহূর্তেই সেখান থেকে বের করে প্রলয়ের অনুমতি সাপেক্ষে সোজা অপারেশান থিয়েটারে।সরকারি কাজগুলো প্রলয় দ্রুত সেরে ফেললো।রিলেশনের জায়গায় প্রলয় ওয়াইফ লিখে দিলো।শিখার ব্যাগটা থেকে মোবাইল বের করে কন্টাক্টসে বাবা লেখা দেখে শিখার বাবাকে ফোন করে জানালো তার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে হাসপাতাল থেকে ফোন করছি।তার অফিস কলিগরা আছে আপনি কোন চিন্তা করবেননা।
দীর্ঘ চার ঘন্টা অপারেশান শেষ ডাক্তার বেরিয়ে এসে যে কথা প্রলয়কে শুনালেন তারজন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা।প্রলয় মাথায় হাত দিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের উপরেই বসে পড়লো।বিরবির করে বলতে লাগলো,"সবকিছুর জন্য আমি দায়ী শিখা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।"
পরদিন দুপুরবেলার দিকে শিখার জ্ঞান ফিরলো।প্রলয় এক মুহূর্তের জন্যও হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যায়নি।মাঝে মাঝে অবিনাশবাবুকে ফোন করে শিখার খবরাখবর দিয়েছে অফিস কলিগ সেজে।শিখার জ্ঞান ফিরলে নার্স এসে প্রলয়কে ডেকে নিয়ে যায়।শিখা চোখ খুলেই দেখে প্রলয় দাঁড়িয়ে।মুখে মাস্ক কথা বলার ক্ষমতা নেই কিন্তু চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।পায়ের পাতা থেকে কোমর অবধি সাদা কাপড়ে ঢাকা।শিখা এখনও জানেনা তার বা পায়ের উপরের অংশ থেকে সম্পূর্ণ বাদ গেছে।প্রলয় নিজেকে সামলাতে সেখান থেকে দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে আসে।
বিকালে আবার সে শিখার সাথে দেখা করতে যায়।তখন তার মাস্ক খুলে দেওয়া হয়েছে।প্রলয়কে দেখে শিখা চোখ বন্ধ করে নেয়।প্রলয় এগিয়ে যেয়ে শিখার একটি হাত ধরে বলে,"ক্ষমা করে দাও শিখা। কি পরিস্থিতিতে কেন করেছি সব বলবো তোমায় তুমি শুধু আমায় একটিবার বল আমায় ক্ষমা করবে?"শিখা চুপ করে থাকে।কোন উত্তর সে করেনা এ বিষয়ে।শুধু বলে,
---বাবা খুব চিন্তা করছেন।একটা ফোন করতে হবে।
---মেসোমশাইকে আমি তোমার খবর জানিয়েছি।তোমার ফোনটা আমার কাছে আছে,কথা বলবে?
---শিখা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
ফোনটা শিখার হাতে প্রলয় তুলে দিতে গেলে একজন নার্স এসে বাঁধা দেন।তিনি বলেন যে শিখার এখন বেশি কথা বলা ঠিকনা।নার্সকে দেখে শিখা জানতে চায়,
---আমার পা টা এত যন্ত্রনা করছে কেন?
---এখন তো একটু যন্ত্রনা করবে।পেইন কিলার দেওয়া হয়েছে ঠিক হয়ে যাবে কিছু পরে।কথাগুলো বলে সিস্টার চলে যান।
প্রলয় এগিয়ে যায় শিখার কাছে।মাথায় হাত রাখে।শিখা চোখ বন্ধ করে থাকে।কোন কথা আর তাদের মধ্যে হয়না।ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়।"কাল সকালে আবার আসবো"-বলে প্রলয় বেরিয়ে আসে।
রাস্তায় বেরিয়ে একটা উবের বুক করে সোজা চলে আসে শিখাদের বেহালার বাড়িতে।কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দেয়।প্রলয় কাজের মেয়েটিকে বলে সে শিখার বাবার সাথে দেখা করতে চায়।তাকে নিয়ে কাজের মেয়েটি অবিনাশবাবুর কাছে যায়।প্রলয়কে দেখেই উনি চিনতে পারেন।
---প্রলয় তুমি?খুব দরকার ছিলো এই সময়ে তোমাকে।জানো বাবা, শিখা অ্যাক্সিডেন্ট করে হাসপাতাল রয়েছে।আমি তো এখন অথর্ব।মেয়েটি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে শুনেও কিছুই করতে পারছিনা।আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই যাকে ওখানে পাঠাতে পারি।ওর এক অফিস কলিগই ওকে দেখাশুনা করছে।তুমি কিছু একটা কর বাবা।
প্রলয় আমতা আমতা করে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে বলা শুরু করে।কিন্তু কথার মাঝপথে চুপ করে যাওয়াতে অবিনাশবাবু অধর্য্য হয়ে উঠে বলেন,"আহ!চুপ করে গেলে কেন?আমাকে সব খুলে বলো।"
---আস---লে
---বলো প্রলয় খুলে বলো ।
---ওর মানে ওর তো বা পায়ের উপর থেকে বাসের পিছনের চাকা চলে গেছিলো ---তাই ওই পায়ের হাঁটুর কাছ থেকে সম্পূর্ণ অংশ বাদ ---
প্রলয়ের কথা শেষ হয়না।অবিনাশবাবু ছোট শিশুর মত ডুকরে কেঁদে ওঠেন।প্রলয়ের চোখেও জল।সে উঠে যেয়ে অবিনাশবাবুর কাঁধে হাত দেয়।অবিনাশবাবুর কান্না যেন দ্বিগুন বেগে ঝরতে থাকে।কিছুক্ষণ পর প্রলয় নিজেই বলে,
---মেসোমশাই নিজেকে শান্ত করুন।আপনি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়েন আমি একা শিখাকে সামলাতে পারবোনা।আমি শিখার পাশে সারাজীবন আছি আপনাকে কথা দিচ্ছি।আমি একটা ভুল করেছিলাম তার প্রাশ্চিত্ত আমাকে করতেই হবে।ও সুস্থ্য হয়ে বাড়ি আসুক আমি ওকে অন্যভাবে হাঁটার ব্যবস্থা করে দেবোই।কিন্তু আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দেন।নিজের পরিবারের প্রতি ঘেন্না বশত আমি নিজেকে শিখার অনুপযুক্ত মনে করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।আমি সব বলবো আপনাদের।কিন্তু আগে আমাদের দরকার শিখার কাছে যেয়ে তার মনোবল বাড়ানো।সে এখনও জানেনা বিধাতা তার সাথে কি নিষ্ঠুর খেলা খেলেছেন।চলুন আমরা বেরিয়ে পড়ি শিখার কাছে।
এ কথা শুনে অবিনাশবাবু বাধ্যশিশুর মত জামাপ্যান্ট পড়ে প্রলয়ের একটা হাত ধরে বলেন,"এবার শিখার হাতটা তুমি শক্ত করে ধরো বাবা,আমি আর ক'দিন?মেয়েটা যে বড্ড অসহায় হয়ে পড়লো।"
---আমি আছি,আপনি একদম ভাববেন না।
দু'জনে হাসপাতালের উর্দেশ্যে রওনা হলেন।
....শেষ....
No comments:
Post a Comment