Tuesday, July 31, 2018

       লালী
              নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

    একখানি রুমাল মুখে করে নিয়ে লালী ছুটতেই থাকে একটা গাড়ির পিছনে।ছুটছে তো ছুটছেই।গাড়িটিও তার গতিতে ছুটছে।হঠাৎ একটি প্যান্ডেলয়ালা বড় মাঠের কাছে গাড়িটি থামে।চুপচাপ বসে থাকে লালী।হয়তো কারও প্রতীক্ষায়!
        লালীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মায়ের মৃতদেহটা।খুব কেঁদেছিল সেদিন লালী।সেই থেকে সে সবসময়ই  কাঁদে ওই রাস্তার পাশে ঝুপড়িটার পাশে বসে।ওই ঝুপড়িটাতেই যে তার মা থাকতো।কিন্তু ওই অসভ্য,বর্বর মানুষগুলো তার মায়ের উপর অত্যাচার করে তাকে মেরে ফেলে।না-লালী কোন মানুষ নয়।কিন্তু তার মা একজন মানুষ।মা হওয়ার জন্য তো শুধু পেটে ধরতেই হয়না।সন্তান স্নেহে কাউকে ছোট থেকে সযত্নে লালিত করে তার অসুখ-বিসুখে সেবাযত্ন করে সুবিধা-অসুবিধাগুলি নিজের মনে করে দূর করতে পারলেই মা হওয়া যায়।ঠিক এভাবেই অনিমা মা হয়ে উঠেছিলো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা একটি কুকুরছানার।
        ঝুপড়িতে যদি কোনদিন ভাত রান্না হয় ঝুপড়িবাসীরা সেই ভাতের ফ্যানটুকুও ফেলেনা।ঠিক তেমনই অনিমার মা,বাবা আর অনিমা সেই ফ্যানটুকু খেয়ে নিতো সকালের খাবার হিসাবে।কিন্তু সাত বছরের অনিমা মা,বাবার চোখ এড়িয়ে তার ভাগের অর্ধেক ফ্যান তার আদরের কুকুর ছানার জন্য নিয়ে লুকিয়ে খাওয়াতো।রাতে নিজের কাছে নিয়ে শুতো।ছোট্ট লালী তখনও ভাত খেতে শেখেনি।মা তাকে দুটি বিস্কুট দিলে একটা লালীকে জলে গুলে খাইয়ে নিজে একটা খেতো।এইভাবেই অনিমা আস্তে আস্তে লালীর মা হয়ে উঠেছিলো।
        অনিমা যেখানেই যেত লালী তার সাথে যেত।একদিন রাতে এক বিয়েবাড়িতে অনেক খাবার ফেলে দেওয়ায় অনিমা লালীকে নিয়ে যায় সেই খাবার খাওয়াতে।লালী তখন বেশ বড়।আর সেদিনই ঘটে লালীদের সংসারে এক অঘটন।এক মদ্যপ গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়িটাকে তুলে দেয় কিছু ঝুপড়িবাসীদের ঘাড়ের উপর।অনেকের সাথে সেদিন অনিমার মা,বাপ ও চিরতরে চলে যান।এসব ঘটনার বিচার হয়না-কারন এদের টাকা নেই।অনিমা হয়ে যায় একা।আর তার পাহারাদার হয়ে ওঠে লালী।
    ভিক্ষাবৃত্তিই একমাত্র উপায় অনিমার বেঁচে থাকা আর তার লালীকে বাঁচিয়ে রাখার।একটা রুটিও যদি কোনদিন জোগাড় করতে পারে অনিমা তার অর্ধেক লালীর আর অর্ধেক নিজে খায়।আর লালীটাও হয়েছে এমন যতক্ষণনা তার মা খাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে খাবারে মুখই লাগাবেনা সামনে নিয়ে অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে।
       এখন অনিমার বয়স দশ।লালী বিন্দুমাত্র সময় অনিমাকে ছাড়েনা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময়টুকু ছাড়া।লালী লক্ষ্য করে এই ছোট্ট মেয়েটার উপর অনেকেরই লোলুপদৃষ্টি।কিন্তু সদা সতর্ক সে।এমন বিশ্বস্ত পাহারাদার মানুষ তো দূরহস্ত অন্য কোন পশুও হতে পারেনা।একদিন অনিমার খুব জ্বর হয়েছিলো।উঠতেই পারছিলোনা। লালী কোন দোকান থেকে একটা পাউরুটি চুরি করে অনিমার সামনে এনে রাখলে অনিমা ওকে দুর্বল শরীর নিয়েও খুব বোকেছিলো।সেদিন লালী অনিমার পায়ের উপর শুয়ে অনেক কেঁদেছিল।কথা হয়তো লালী বলতে পারেনি কিন্তু অনিমাকে সে বুঝিয়ে দিয়েছিলো তার দুর্বল শরীরে এই রুটিটা সে চুরি করতে বাধ্য হয়েছে এবং অনিমা এটা খেলে তার ভালো লাগবে।অনিমা একটা রুটির টুকরো জল দিয়ে খেয়ে আর একটি রুটি লালীর সামনে দেয়।লালী তার মায়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। তার রুটিতে সে মুখই দেয়না। অনিমা বুঝতে পেরে বলে,কি রে আর একটা খেতে হবে?লালী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।মানে একটা রুটির টুকরো খেলে হবেনা।অনিমাকে আরও এক টুকরো রুটি খেতে হবে। এইভাবেই একটা মানুষ ও একটা পশুর মধ্যে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যে বন্ধুত্বে কোন চাহিদা নেই আছে শুধু ভালোবাসা আর বিশ্বাস।   
        এমন অনেক পশু আছে যাদের কায়দা-কানুন সব মানুষের মত।অথচ অনেক মানুষ আছে যারা আজীiবন মানুষের মধ্য থেকেও মানুষের গুনাগুন রপ্ত করতে পারেনা।তাদের আচরণ হয় জঙ্গলে বাস করা পশুর সমতুল্য।
       সেদিন রাতে লালী একটু সময়ের জন্য ঝুপড়ি ছেড়ে খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছিল।আর ঠিক তখনই মানুষ রুপী এক পশু ছোট অনিমার শরীরটাকে ছিড়ে খুবলে খায়। গরীব,অসহায়, দূর্বল অনিমা বাঁধা দিয়েও কিছু করতে পারেনি।সে বহুবার তার আদরের লালীর নাম ধরে ডেকেছে।সেই ডাকের আওয়াজ লালীর কর্ণগোচর হওয়ার সাথে সাথেই লালী তার মুখের খাবার ফেলে তার মায়ের কাছে উদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে চলে আসে।কিন্তু ততক্ষণে অনিমার যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে।লালী হাফাতে হাফাতে এসে যখন তার মায়ের কাছে দাঁড়ায় তখন তার মায়ের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন।অনিমা খুব কষ্টে তার একটি হাত লালীর গায়ে উঠিয়ে বলে,"লালী তুই এর প্রতিশোধ নিস।আমাকে তোর কাছ থেকে যে সরিয়ে দিলো তুইও তাকে এই পৃথিবীতে থাকতে দিবিনা।" আস্তে আস্তে অনিমার হাতটা নীচুতে পড়ে যায়।অনিমা তার আদরের লালীকে ছেড়ে চিরতরে চলে যায়।
       তারপর কতকিছু লালী দেখেছে ওই ঝুপড়ির ঘরে।কত লোক এসেছে তার মাকে দেখতে,কত পুলিস এসেছে,আশেপাশের মানুষজনকে কত কথা জিজ্ঞাসা করছে পুলিস।কিন্তু লালী তো কথা বলতে পারেনা।তাই কেউ তাকে কোন কথায় জিজ্ঞাসা করেনি।সে চুপটি করে ঝুপড়ির বাইরে বসে আছে তার চোখ থেকে অবিরাম জল পরে চলেছে।লালী তার মায়ের মাথার কাছেই বসে ছিলো কিন্তু একজন পুলিস তাকে সেখান থেকে বের করে দিয়েছে।লালীর রাগ হলেও সে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।সে খুব ভালোভাবে ওই পুলিশটাকে লক্ষ্য করেছে।তাকে চিনে রেখেছে।তার মাকে একটা সাদা কাপড়ে বেঁধে নিয়ে যখন ভ্যানরিক্সাটা এগিয়ে চলেছে লালীও সেই ভ্যানরিক্সার পিছুপিছু যেয়ে দেখলো একটা বড় গেট দেওয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকে তার মাকে একটা ঘরের তালা খুলে ঢুকিয়ে আবার তাতে তালা লাগিয়ে দেয়।লালী কি করে জানবে এবার তার মায়ের ছোট্ট শরীরটা কেটে ফালাফালা করবে।সে ভাবলো এটাই বুঝি এখন থেকে তার মায়ের থাকার জায়গা।যেখানে তার কোন প্রবেশাধিকার নেই।
          লালী ফিরে এলো আবার সেই ঝুপড়িতে।ঘরের এদিকে ওদিকে ঘুরে ঘুরে গন্ধ শুকতে শুকতে সে একটি রুমাল দেখতে পেলো।বিছানায় যে গন্ধ রুমালটিতেও সেই একই গন্ধ পেলো।সে রুমালটি মুখে করে বাইরে নিয়ে এসে সারাটা রাত ওটাকে সাথে নিয়েই রাত কাটিয়ে দিলো।না সে খাবারের সন্ধানে গেলো না কেউ তাকে ওই জায়গা থেকে সরাতে পারলো।
       সকাল তখন প্রায় দশটা হবে। একজন গাড়ি করে এলেন।লালী তখন ঘুমাচ্ছে।লোকটি ঝুপড়ির কাছে এক চায়ের দোকানে চা খেতে যেয়ে কাল ঝুপড়ির ভিতরে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা শুনে বেশ দুঃখিত হলেন।দেশের পরিস্থিতি দিনকে দিন কোথায় পৌঁছাচ্ছে তা নিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।এই চিৎকার আর হৈ-হট্টগোলের মধ্যে লালীর গেলো ঘুম ভেঙ্গে।আর ঠিক তখনই লালীর সম্মুখ দিয়েই লোকটি তার গাড়ির উর্দেশ্যে রওনা দিলো।মুহূর্তে লালীর চোখ, কান আর নাক সজাগ হয়ে উঠলো।সে লোকটির পিছনে ডাকতে ডাকতে গাড়ির দরজা পর্যন্ত যেয়ে লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।কিন্তু লোকটির গাড়ির ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পড়ে থাকা একটি লাঠি নিয়ে সজোরে লালীকে আঘাত করে।আর ঠিক এই ফাঁকে লোকটি গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দেয়।লালী দৌড়ে এসে রুমালটা মুখে করে চলন্ত গাড়ির পিছনে ছুটতে শুরু করে।
        লালী তখনও গাড়ির পিছনে লুকিয়ে আছে।আসলো বিশাল পুলিশ ভ্যান।লালী ঠিক যা ভেবেছিল তাই।সেদিনের সেই পুলিশ অফিসারও আছেন সকলের সাথে।লালী সকলের কথা শুনে বুঝলো আজ এখানে একটি বড় রাজনৈতিক সভা হবে যেখানে বক্তৃতা করবেন বড় বড় রাজনীতিবিদরা।ভিতরে লালী কিছুতেই ঢুকতে পারছেনা।সকলে ভিতরে ঢুকে গেছে।লালী একবার প্যান্ডেলের চারিপাশটা ভালোভাবে দেখে আসলো।কোথাও কোন সুবিধা করতে পারলোনা। আবার চলে এলো গেটের সামনে।হঠাৎ দেখে সেই পুলিশ অফিসারটি বেরিয়ে আসছেন একজনের সাথে কথা বলতে বলতে।লালী ছুটে যেয়ে অফিসারের পরা প্যান্টটি ধরে টানতে লাগলো।দুদে অফিসারের বুঝতে বাকি থাকলোনা যে এই সারমেয়টি তাকে কিছু বলতে চায়।তিনি সারমেয়টির কাছে নিচু হয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে জানতে চান,"কি রে আমায় কিছু বলবি তুই?"লালী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।লালী রুমালটি অফিসারের হাতে দেয়।তিনি গ্লাভস পরে ওটিকে একটি প্লাস্টিকে ভরে বলেন,"চল, কোথায় যেতে হবে?"
      লালী ছুটছে আগে, পিছনে পুলিশ ভ্যান।অনেক্ষণ ছুটে এসে লালী ঝুপড়ির কাছে থামলো।পুলিশ অফিসার গাড়ি থেকে নেমে আসলেন।লালী ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে পাগলের মত ছটফট করতে থাকে।অফিসার কি বুঝলেন তিনিই জানেন।লালীকে বললেন,"চল-আমার সাথে।"তিনি এসে গাড়ির দরজা খুলে লালীকে গাড়িতে তুললেন।ছুটলো গাড়ি আবার মিটিংএ।
       পুলিশ অফিসারটি গাড়ির ভিতর লালীকে বললেন, "তোকে নিয়ে আমি ভিতরে ঢুকবো, তুই কিন্তু কোন আওয়াজ করবিনা।শুধু যে মানুষটি দোষী তার কাছে একটু ঘুরঘুর করবি।তখন তো সবাই তোকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।তুই বাইরে বেরিয়ে এসে আমার গাড়ির কাছে অপেক্ষা করবি"।লালী মন দিয়ে অফিসারের কথাগুলো শুনলো এবং সেইমতো কাজও করলো।কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসে সে পুলিশ অফিসারের নয় তার মায়ের খুনির গাড়ির কাছে ঘাপটি মেরে বসে থাকলো।নেতা বেরিয়ে গাড়িতে উঠলেন লালীও তাকে অনুসরণ করলো।আপনজনের মৃত্যুতে কিছু কিছু মানুষ যেমন আইনের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেনা, এক একটা ক্ষণকে মনে করে এক একটা বছর;লালীর মানষিক পরিস্থিতিও এখন সেইরূপ।
         গাড়ির পিছনে ধাওয়া করে লালী পৌঁছে যায় নেতা অমলেন্দু সাহার বাড়িতে।প্রাচীর টপকে বাড়ির ভিতরে ঢোকে।দরজা খোলা দেখে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর ঢুকে একটা খাটের তলায় লুকিয়ে থাকে।অধিক রাতে সেখান থেকে বেরিয়ে নীচুর ঘরগুলোতে খুনিকে দেখতে না পেয়ে চুপিচুপি উঠে যায় দোতলার ঘরে।নেতা তখন ঘুমে অচেতন। ঘুমের মধ্যেই লালী নেতাকে আক্রমন করে।প্রথমেই লালী কামড়ে দেয় নেতার গলা।চিৎকার করার বিন্দুমাত্র সময় সে নেতাকে দেয়না।অমলেন্দু সাহা যখন নেতিয়ে পড়ে চুপিসারে লালী পূর্বের জায়গায় এসে লুকিয়ে থাকে আর সকালে সদর দরজা খোলা হলে সকলের অলক্ষে বেরিয়ে প্রাচীর টপকে বাইরে এসে অপেক্ষায় থাকে।বারবার তার চোখের সামনে মায়ের বলা শেষ কথাগুলো ভেসে উঠতে থাকে।
        পুলিশভ্যান ভর্তি পুলিশ।নেতার মৃত্যুতে জনারণ্য।কারও চোখে জল,কেউবা আড়ালে হাসছে। হঠাৎ পুলিশ অফিসারের নজরে পড়ে লালীকে।সকলের চোখ এড়িয়ে লালীর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,"এরজন্য আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত।শেষ পর্যন্ত পারতাম কিনা তাও জানিনা।যা করেছিস ঠিক করেছিস।আইনের ফাঁক গলে খুনি তার অর্থ আর প্রভাব খাটিয়ে ঠিক বেরিয়ে যেত।তুই চলে যা এখান থেকে।কেউ বুঝাতে পারলে তোকে মেরে ফেলবে।" অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে থেকে লালী সেই স্থান ত্যাগ করলো।হয়তোবা আবার কোন অসহায় নারীর প্রতি হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে।কারন মাতৃহীন পৃথিবীতে এটাই তার এখন একমাত্র লক্ষ্য।

                       শেষ 

Thursday, July 26, 2018

Tuesday, July 24, 2018

আমার লেখা গল্প পড়ুন

"অপেক্ষার শেষ", প্রতিলিপিতে পড়ুন : https://bengali.pratilipi.com/story/WMC8m5AYfw9B?utm_source=android&utm_campaign=content_share ভারতীয় ভাষায় অগুনতি রচনা পড়ুন,লিখুন এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন,সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক
অপেক্ষার শেষ
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

         অবসর জীবনে সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী বই।কিন্তু পাশের ফ্লাটের আধুনিকা সোমাশ্রীর অনুরোধে জয়িতা এক দামী স্মার্ট ফোন কিনে শ্রীর বাধ্য ছাত্রী হয়ে বসে। সোমাশ্রী শিক্ষিতা,সুন্দরী, আধুনিকা।বাবা মায়ের সাথে জয়িতার সদর দরজা বরাবর ফ্লাটটিতেই থাকে।জয়িতা বছর খানেক হোল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন।সোমাশ্রীর সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব।সোমাশ্রীর বয়স চব্বিশ আর জয়িতার একষট্টি।দু'জন অসমবয়সের দু'টি মানুষ।কিন্তু বন্ধুত্বের অদ্ভুত এক মিষ্টি সম্পর্ক দু'টি মানুষের মধ্যে।একটি নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে সোমাশ্রী চাকরী করে।অফিস,বাড়ি আর জয়িতা আন্টির ঘর।আর এখন তো সে জয়িতা আন্টির মোবাইল শেখানোর মাষ্টারনি।হাতে ধরে ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ,টুইটার সব শেখানো চলছে।এমনকি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কিভাবে পাঠাতে হয় কেউ পাঠালে তাকে এ্যাকসেপ্ট করতে হয় -সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো শ্রী তার জয়িতা আন্টিকে শিখিয়ে দেয়।জয়িতাও মাত্র কয়েকদিনেই সময় কাটানোর সুন্দর একটি সমাধান খুঁজে পান।সব থেকে সুবিধা তার যেটা হয় কোন গল্প বা কবিতা পড়তে ইচ্ছা করলেই গুগল সার্চ।কত দূর-দূরান্তের মানুষের সাথে পরিচয়;পরিচিত বা অপরিচিত কত কত মানুষ।বেশ ভালোই লাগে তার নিঃসঙ্গ জীবনে নূতন এই খেলনাটিকে।কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন people you may know -তে একটি ছবিতে এসে তার চোখ আটকে যায়।খুঁটিয়ে সে ছবিটি দেখতে থাকে।
        চল্লিশ বছর হ্যাঁ চল্লিশ বছরই হবে।
জয়িতার বয়স তখন উনিশ কি কুড়ি হবে।তখন তাদের বাড়িতেই ভাড়া আসে এক পরিবার।মা,বাবা,বোন আর দাদা।জয়িতারা থাকতো দোতলায় আর ভাড়াটিয়ারা থাকতো একতলায়।বাইরের দিক থেকে বাড়ির সিঁড়ি।শেখর তখন সদ্য সদ্য ব্যাংকে চাকরী পেয়েছে।সুদর্শন ও স্মার্ট।খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ তাদের হতনা।কথা তো নয়ই।শেখরের বোন শিখা,জয়িতার সমবয়সী।অচিরেই দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।শিখাদের ঘরে জয়িতা যখন যেত যদি শেখরকে দেখতে পেতো সে সঙ্গে সঙ্গেই পালিয়ে আসতো।কিছুতেই শেখরের সামনে সে সহজ হতে পারতোনা।বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা কাঁপুনি শুরু হত।সেটা কেন হত তা ওই বয়সে জয়িতা প্রথম দিকে বুঝতেই পারেনি।কোনদিন মুখোমুখি হয়ে গেলে শেখর কিন্তু সরাসরি জয়িতার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো।কিন্তু জয়িতার সে চাউনি সহ্য করার ক্ষমতা ছিলোনা।তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ শুরু হত।মুহূর্তেই সে জায়গা সে ত্যাগ করতো।শেখর কিন্তু সবই বুঝতে পারতো।কিন্তু কোনদিনও মুখ ফুটে জয়িতাকে কিছুই বলেনি।
        জয়িতাদের বাড়িতে খুব বড় করে প্রতিবছর লক্ষ্মীপুজো হত।পুজোতে ভাড়াটিয়াদের নিমন্ত্রণ থাকায় শেখরও রাত্রে খেতে যায়।সেদিন প্রথম শেখর ও জয়িতা সামনাসামনি নানান ধরনের কথাবার্তা বলে।শেখর খুব ভালো গান করে সেটা শিখার কাছ থেকে জয়িতা জেনেছিল।সকলের মধ্যে জয়িতা শেখরকে অনুরোধ করে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার জন্য।অন্য সকলেও তখন চাপ দিতে থাকে।অগত্যা শেখর গাইতে বাধ্য হয়।খালি গলায় সে গান ধরে,"তুমি রবে নীরবে---"।শেখরের গান সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত চুপ করে শোনে।চলে যাবার সময় শিখাকে একটু একা পেয়ে শেখর বলে যায়,"তোমাকে কিছু বলার ছিলো,কিন্তু বলতে সাহস পারছিলামনা।তবে গান গাইতে বলে আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছো।তোমাকে যা বলবো ভেবেছিলাম তা গানের কথাগুলোর মধ্যেই বলে দিয়েছি।সময় করে তোমার উত্তরটা আমায় জানিও।"
        জয়িতা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।কিভাবে কথা বলতে হয়,কিভাবে ছুটে পালিয়ে যেতে হয় জয়িতা এক নিমেষেই সব ভুলে গেছে।সব ভুলে যাওয়ার মাঝখানে বুকের স্পন্দন গতি কয়েক শ গুন বেড়ে গেছে এটা সে ভালোই বুঝতে পারছে।
           জয়িতাকে শেখরদের বাড়ির সকলেই খুব ভালোবাসতো।জয়িতারা ছিলো ব্রাহ্মন আর শেখররা ছিলো সাহা।জয়িতার মায়ের চোখে লাগে ওদের মেলামেশা গল্পগুজব।তিনি সরাসরি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন।মেয়েও কিছু না লুকিয়ে মায়ের কাছে সব খুলে বলে।জয়িতার মা সব শুনে মেয়েকে জানান,"কোন অবস্থাতেই তোর বাবা এই সম্পর্ক মেনে নেবেননা।নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মন বংশের সন্তান তিনি।আজও দু'বেলা আহ্নিক করেন একবেলা অন্ন গ্রহন করেন।আমি জাতপাতের বিচার করিনা।কিন্তু তোর বাবা?এ কথা শুনলে তার তো স্ট্রোক করবে।নাহয় তিনি আত্মহত্যা করবেন।যত ভালো চাকরীই সে করুক না কেন কিছুতেই তিনি ওই নিচু জাতের ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেবেননা।শেষ পর্যন্ত মেয়ে হয়ে পিতৃঘাতী হবি?"
      জয়িতার দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা নামতে থাকে।মুখ নিচু করে শুধু একটি কথায় বলে,"মা শেখর খুব ভালো ছেলে।এই বয়সেই সে কত বড় পোষ্টে চাকরী----"কথাটা সে শেষ করতেও পারেনা।কথার মাঝখানেই তার মা বলে ওঠেন,"মা আমি সব জানি।কিন্তু তোর বাবা কিছুতেই মেনে নেবেননা।তুই আমাদের একমাত্র সন্তান।আমি জানি মা শেখরের মত ছেলের হাতে পড়লে তুই খুব সুখি হবি।কিন্তু তোর বাবা?প্রচন্ড একগুঁয়ে মানুষ তিনি।তার বংশে কালি লাগুক এমন কোন কাজ তিনি কিছুতেই করবেন না।ওই একরোখা মানুষটার সাথে এত বছর ধরে সংসার করে আমি যা বুঝেছি তিনি তার বংশমর্যাদা রক্ষার্থে যে কোন ধরনের সিধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র ভাববেন না।আমি কালই ওদের বলবো এখান থেকে ভাড়া উঠে যেতে।
           অসহায় জয়িতা মায়ের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই চলে।কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারেনা।শেখরকে কথাগুলো জানানোর একান্ত দরকার।বাবা বাড়িতে চলে এসেছেন।মাও সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।পরদিন সকালে বাবা অফিস বেরোনোর পরে মা যেয়ে আবারও দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি নিজ আঁচলে বেঁধে রাখেন।কলেজ ছুটি,প্রাইভেট টিউশনও ছুটিসব ভাই ফোঁটার পর খুলবে।সারাদিন শিখাও আসেনা।কিছুই বুঝতে পারছেনা সে কি করবে।ঘরের ভিতর ছটফট করতে লাগে। এমনিতেই বাবা খুব কম কথা বলেন,  মায়ের সাথেই শিখার যত কথা।সেই মা ও এখন প্রয়োজন না হলে খুব একটা কথা বলেননা।এই ভাবেই সাত সাতটা দিন কেটে যায়।
     সাতদিনের মাথায় হঠাৎ একদিন শিখা এসে হাজির সাথে তার মা।জয়িতার মা গেটের তালা খুলে তাদের ভিতরে নিয়ে এসে বসান। শিখার মা কিছুটা অবাক হয়ে জয়িতার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,"কি অপরাধে আমাদের এত তাড়াতাড়ি উঠে যেতে বললেন জানিনা।তবে আপনারা বাড়ির মালিক।চলে যেতে বললে আমরা যেতে বাধ্য।কিন্তু অপরাধটা জানতে পারলামনা।মেয়েটিকেও কেন আটকে দিলেন আমার ঘরে যেতে তাও বুঝলামনা।কপাল ভালো আমাদের পনেরদিন সময় দিয়েছিলেন আমরা সাতদিনেই ঘর পেয়ে গেছি।মালপত্র সব চলে গেছে,এবার আমি আর মেয়ে যাবো-"কথাগুলো বলে তিনি কিছু টাকা আর একটি হিসাব করা কাগজ রাখেন সামনের টেবিলের উপর।জয়িতার মা কোন কথার উত্তর দেননা।জয়িতা এসে শিখার মাকে প্রনাম করে।তিনি তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেন,"ভালো থাকিস মা।যে ঘরে বৌ হয়ে যাবি সে ঘর আলো করে থাকিস।বড্ড লক্ষ্মী মেয়ে তুই।তোর বিয়েতে খুব আনন্দ করবো ভেবেছিলাম।কিন্তু কি যে হোল কিছুই বুঝলামন।"জয়িতা কোন উত্তর দেয়না।চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়েই পড়ে।শিখাও এসে জয়িতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।কিন্তু কোন কথা কেউই বলতে পারছেনা।শিখার মা যাওয়ার আগে বললেন,"আসি দিদি।ভালো থাকবেন।"এ কথারও তিনি কোন উত্তর করেননা।
            কেটে গেছে সময় তিন যুগেরও বেশি।শত চেষ্টা করেও স্কুলে শিক্ষকতা করা মেয়ে জয়িতার বিয়ে পারেননি তার মা,বাবা।বাবা, মায়ের মৃত্যুর পর কলকাতার উপরে বিশাল দোতলা বাড়ি বিক্রি করে জয়িতা স্কুলের সুবিধার্থে বাগুইহাটিতে এক নিরিবিলি জায়গায় ফ্লাট কিনে চলে আসে।অবসর নেওয়ার আগে বা পরেও একমাত্র বইই ছিলো তার সর্বক্ষনের সঙ্গী।আর অসমবয়সী সোমাশ্রীর সাথে বন্ধুত্ব,আড্ডা আরও পড়ে শ্রীর পাল্লায় পড়ে ফেসবুকের নেশা।
            ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে জয়িতা বুঝতে পারে এটা শেখর।একটু মোটা হয়েছে।রিকোয়েষ্ট পাঠাবে কি পাঠাবেনা এই দোলাচলে ভুগতে ভুগতে রিকোয়েষ্ট সেন্ড করে।ইনবক্সে কথাও হয় মাঝে মাঝে।শেখর সাহা দেখে জয়িতা যেমন বন্ধুত্বের জন্য আগ্রহী  হয়েছিল ঠিক তেমনই শেখরও জয়িতা চ্যাটার্জি দেখে আগ্রহী হয়ে ইনবক্সে কথা আদানপ্রদান চালাতেই থাকে।শেখরের বাড়ি এখন কলকাতার বেহালা চত্বরে।এক সময় দুজনের মধ্যের অচেনা প্রাচীরটা সরে যায়।শেখর অনেক কথায় বলতে চায়,জানতে চায়।কিন্তু জয়িতা এক কঠিন আবরণে ঢেকে রাখে নিজেকে।কারন জয়িতা নিশ্চিত শেখরের এখন ভরা সুখের সংসার।কিছুতেই সে এই বয়সে এসে শেখরের জীবনে কাঁটা হয়ে উঠতে পারবেনা।কিন্তু শেখরও নাছোড়বান্দা।সে জয়িতার সাথে দেখা করবেই।অবশেষে বাধ্য হয়ে জয়িতা তার ফ্লাটের ঠিকানা শেখরকে জানায়।
            বেশ কয়েকবছর আগে শেখর রিটায়ার করেছে।কি কারনে জয়িতা তার সাথে এরূপ করলো,কি কারনে জয়িতাদের বাড়ি থেকে তাদের সাতদিনের মধ্যে উঠে যেতে হোল সে প্রশ্ন আজও শেখরকে কুরেকুরে খায়।বাবা,মা মারা গেছেন অনেক আগেই।শেখরকেও বাড়ির লোক বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি।মা,বাবা বেঁচে থাকতেই সে বেহালা চৌরাস্তায় একটি ফ্লাট কেনে।শিখার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সে এখন সম্পূর্ণ একা ওই ফ্লাটে।
              জয়িতার সাথে কথা অনুযায়ী নিদৃষ্ট দিনেই সে সকাল সকাল জয়িতার ফ্লাটে এসে হাজির হয়।দুরুদুরু বুক নিয়ে শেখরকে দরজা খুলে দিয়ে বসতে বলে জয়িতা চায়ের কথা বলে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চায়।শেখরকে দেখে বোঝায় যায়না তার বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই।একটু মেদ জমে শরীরটা সামান্য ভারিক্কি হলেও দেখতে যেন আরও সুন্দর হয়েছে।শেখর কোন ভনিতা না করেই সরাসরি প্রশ্ন করে,"কি এমন হয়েছিলো যে হঠাৎ করে নিজেকে ঘর বন্ধি করে আমাদের পনেরদিনের মধ্যে ঘর ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হোল?
            জয়িতা অনেক্ষণ চুপ করে মুখ নিচু করে বসে থেকে শেষে কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত ঘটনা শেখরকে জানায়।কান্না সামলে চোখ মুছে শেখরের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে এবার বলে,"কি হবে এই বয়সে এখন এসব জেনে?বরং তোমার সুখের সংসারে তুমি যেমন আনন্দে আছো ঠিক সেই ভাবেই থাকো।কেন এলে এতোগুলি বছর বাদে নিজেদের জীবনে আবার ঝড় তুলতে?"
---তুমিও তো খুব সুখি দেখছি!টা বিয়ে করোনি কেন?
---কপালে নেই তাই।
---ওটা আমার কপালেও নেই।
         জলভরা চোখে জয়িতা শেখরের মুখের দিকে তাকায়।শেখর এই প্রথম জয়িতার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে বলে,"জীবন থেকে অনেকগুলো বছর শুধু চলে গেছে।আমাদের ভালোবাসাটা কিন্তু সেই এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।ভালোবাসাটাই যখন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে;যে বা যাদের আপত্তিতে আমাদের জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলি হারিয়ে গেছে তারা আজ যখন আর কেউই বেঁচে নেই,আর এই বৃদ্ধ বয়সে এসে জীবন থেকে নূতন করে কিছু পাওয়ারও আশা নেই।কিন্তু দু'টি প্রাণী একই ছাদের তলায় থেকে নিজেদের জীবনের সুখ,দুঃখগুলো তো ভাগ করে নিতে পারি।আর সমাজ?এখান থেকে যখন যাবো কোন নির্জন মন্দিরে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তোমার ওই ফাঁকা সিঁথিটা আমি সিঁদুরে রাঙ্গিয়ে দেবো।কোন আপত্তি নেই তো তোমার?
          জয়িতা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শেখরের বুকে মাথা রেখে।

                  শেষ                ২৮-১০-১৭ 

Friday, July 20, 2018

মিথ্যার মিথ
   নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গীতা ছুঁয়ে শপথ-
"সত্য বই মিথ্যা বলিবো না-"
তবুও সত্য কি সবাই বলে?
না,অনেকেই বলেনা।
শপথ বাক্য পাঠ করে সবাই!
উকিলের শিখিয়ে দেওয়া বুলি,
আর কথার মারপ্যাঁচে-
সত্য অধিকাংশ সময়ই ঢাকা পড়ে যায়।
তবুও আমরা বিচারের আশায় আদালতে যাই।
"সত্য কখনো চাপা থাকেনা-"
যে সত্য কাল কে অতিক্রম করে যায়,
"বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদে-"
যে সত্য বছরের পর বছর চাপা থাকে,
মিথ্যাটাকেই তখন মানুষ সত্য মনেকরে।
কানের কাছে মিথ্যাটাকে বারবার সত্য বলায়,
ওই সত্যই একদিন মিথ্যার মিথ হয়ে যায়।

# নন্দা 

Thursday, July 19, 2018

    অসহায় 
        নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

         গ্রামের অতি সাধারন ঘরের মেয়ে বর্ণালী।কিন্তু স্বপ্ন তার আকাশ ছোঁয়া।কঠিন দারিদ্রের মধ্য থেকে বড় হতে থাকা বর্ণালী পড়াশুনাটাকে জীবনে তার স্বপ্ন পূরন হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হিসাবেই মনে করে।সুন্দর মুখশ্রীর অধিকারী সে নয় কিন্তু চোখ দু'টি তার কথা বলে।গায়ের রং চাপা।তেলের অভাবে মাথার চুল উস্কোখূস্কো।বাবা,মা আর ছোট ভায়ের সংসারে সে বড় সন্তান।বাবা তার গ্রামের সামান্য ভ্যানচালক।দিন এনে দিন খেয়ে কোন রকমে দিন কাটিয়ে দেওয়া।যেদিন বাবা অসুস্থ্যতার কারনে ভ্যান নিয়ে বেরোতে পারেননা সেদিন বর্ণালী নিজে গ্রামের পথে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে সকলের খাবার জোগাড় করার ব্যবস্থা করে।তাতে অবশ্য তার কোন খেদ নেই।স্বপ্নকে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করাতে,নিজের প্রানের থেকেও প্রিয় বাবা,মা আর ভায়ের জন্য সে তার জীবনে কোন কাজকেই ছোট করে দেখতে নারাজ।
           সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্ধ্যার সময় হারিকেনের আলোতে পড়তে বসা।এই সন্ধ্যা থেকে সকাল অবধি তার নিজের।মা বা অন্য কেউ তাকে এইসময় বিরক্ত করেননা।তারা ও ভাবেন মেয়েটা লেখাপড়া শিখে একটা কিছু করতে পারলে সংসারের হাল একটু ফিরবে। অন্তত পেট পুরে দুবেলা খাবার সংস্থান তো হবে।স্কুলটাও নিয়মিত যেতে পারেনা যেদিন ভ্যান নিয়ে তাকে বেরোতে হয়।শত কষ্টের মাঝে এইভাবেই সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে।মাধ্যমিক পাশ করার পরেই সে গ্রামের কিছু ছোট ছেলেমেয়েকে পড়াতে শুরু করে।পরীক্ষায় ভালো ফল করার ফলে স্কুল থেকে মাষ্টারমশাইরা সকলে মিলে তাকে একটি সাইকেল কিনে দেন।গ্রাম থেকে দু'ঘন্টা যেতে আবার দু'ঘন্টা আসতে মোট চার ঘন্টা সাইকেল চালিয়ে সে একটা কম্পিউটার সেন্টারে ভর্তি হয়।
            স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছেও স্বপ্নকে সে ছুঁতে আর পারলোনা।হারিয়ে গেলো, শিকার হোল বর্তমান অসহায় সমাজ ব্যবস্থার কিছু অমানুষের লোলুপ দৃষ্টির।সারারাত উৎকন্ঠা আর দুশ্চিন্তায়  কাটিয়ে সকালে খুঁজে পেলেন বাবা,মা তাদের আদরের বহ্নিকে একটা ঝোপ জঙ্গলের মাঝে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় মৃত। 
       
       বহ্নি আকাশ ছোঁয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলো তার চোখের দিকে তাকিয়ে পরিবারের আর যে তিনজন ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলো কোন এক অদৃশ্য ঝড় হঠাৎ করেই গোটা পরিবারটাকে মাটিতে আছড়ে ফেললো।
       এখন এভাবেই হারিয়ে যায় বহ্নিরা।কোন বিচার হয়না।দেশের প্রশাসন কর্মকর্তারা থাকে নিশ্চুপ!আর অমানুষেরা আবারও ওৎ পেতে থাকে আবার কোন বহ্নির স্বপ্নকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলার নেশায়।আমরা শুধু অসহায়! 

# নন্দা
       

Wednesday, July 18, 2018

আলোর শিখা
        নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

      ছ'মাস হতে আসলো এখনও শিখা স্বাভাবিক হতে পারেনি।ফেলে আসা দিনগুলি তার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়।কি এমন অপরাধ ছিলো তার কোন কিছু না জানিয়ে প্রলয় তাকে ছেড়ে চলে গেলো!চলে যাওয়ার দু'দিন আগেও তো প্রলয়ের সাথে দেখা হয়েছে।হঠাৎ কি এমন ঘটলো যে কিচ্ছুটি না বলে তাকে উধাও হয়ে যেতে হোল?বাড়ির সকলে জানতো তার ও প্রলয়ের সম্পর্কটা।মেনেও নিয়েছিলো বাড়ির লোক তাদের এই মেলামেশাটা।প্রলয় মাঝে মাঝে শিখাদের বাড়িতেও আসতো।প্রলয়ের বাবা দেশের বাড়িতে থাকতেন।মাধ্যমিক দেওয়ার আগেই প্রলয়ের মা মারা যান।উচ্চশিক্ষার জন্য প্রলয় কলকাতা এসে একটি মেসে থাকতো।ইন্জিনিয়ারিং পড়ার সময় প্রলয়ের সাথে শিখার বন্ধুত্ব।সে সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে বেশি সময় লাগেনি।শিখার বাবা মেয়েকে সর্বরকম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।মায়ের থেকে বাবা ছিলেন শিখার খুব কাছের।বন্ধুর মত সম্পর্ক পিতা ও কন্যার।ইন্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথম যাওয়ার দিন সকালে শিখা বাবাকে প্রনাম করতে গেলে অবিনাশবাবু তাকে আশীর্বাদ করে বেশ কয়েকটি কথা বলেছিলেন।তারমধ্যে তিনি বন্ধুর মত তার মেয়েকে যেটা বলেছিলেন তা অনেক বাবা-ই হয়তো বলতে দ্বিধাবোধ করবেন।তিনি বলেছিলেন,"দেখো মা,তুমি বড় হয়েছো।আমাদের সমাজে মেয়েদের পদে পদে বিপদ।নিজেকে সামলে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করবে।রাস্তায় চলতে গেলে অনেক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে কিন্তু তাই বলে তো আমরা বেরোনো বন্ধ করে দিতে পারিনা।আমরা কোকিলের সাথে গলা মেলাতে পারি কিন্তু কখোনো
ই কুকুরের সাথে নয়।কুকুরকে আমরা লাঠির সাহায্যে ঘায়েল করতে পারি।তাই এইসব কুকুররুপী মানুষগুলিকে সবসময় এড়িয়ে যেতে হবে,নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে।প্রকৃতির নিয়মে মানুষের জীবনে প্রেম আসা স্বাভাবিক।কিন্তু এখন তোমার শিক্ষার সময়।তুমি মনে রাখবে এই সময় যদি কোন ছেলেকে তোমার ভালো লাগে আর সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, লাগতেই পারে;তুমি যদি তাকে গুরুত্ব দাও আখের ক্ষতি হবে তোমার এবং ওই ছেলেটিরই।এতে পড়াশুনার ক্ষতি হবে তোমাদের দু'জনের।আগে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও তারপর নাহয় ওসব ভেবো।তোমার মতামতকে আমি সবসময় গুরুত্ব দিয়েছি এখনও দেবো। তোমার প্রতি আমার  বিশ্বাস আছে যে তুমি ভুল কিছু করবেনা।"
          কিন্তু মানুষের মন তো তার নিজ মর্জিতে চলেনা।দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময়েই শিখা প্রেমে পড়ে প্রলয়ের।শিখার প্রলয়কে ভালো লাগতো কিন্তু সে কখনোই মুখ ফুটে কিছু বলেনি।তখন প্রলয় থাকতো কলেজ হোস্টেলে।একদিন ক্লাস শেষে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হোল।শিখা সেদিন ছাতাটা আনতেও ভুলে গেছে।একএক করে কলেজ থেকে সকলেই বেরিয়ে পড়েছে।হঠাৎ প্রলয় একটা ছাতা হাতে শিখার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
---চলো তোমায় বাসস্টান্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসি।যা বৃষ্টি হচ্ছে এই মুহূর্তে থামবে বলে মনে হচ্ছেনা।
---কিন্তু ছাতাটা তো খুব ছোট।দুজনেই ভিজে যাবো।এতো ছোট ছাতার তলে দু'জনে যাওয়া যাবেনা।আমি বরং ভিজতে ভিজতেই চলে যাই।
      এ কথা বলেই শিখা বৃষ্টির ভিতর হাঁটতে শুরু করে।প্রলয় দ্রুত ছাতাটা খুলে দৌড়ে এসে শিখার মাথায় ধরে নিজে ভিজে এগিয়ে যেতে থাকে।শিখা সেটা লক্ষ্য করে প্রলয়ের ছাতা ধরা হাতটা টেনে প্রলয়কে নিজের কাছে আনে।পরস্পরের একটা ধাক্কা লাগে।হঠাৎ প্রলয় বলে ওঠে,"তুমি চাইলে এই ছাতাটা আমি আজীবন তোমার মাথায় ধরে থাকতে পারি।যদি তোমার মত থাকে আমায় জানিও।"ঠিক সেইসময় একটা ট্যাক্সি জমে থাকা জলের উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যায় ওদের ভিজিয়ে দিয়ে।দু'জনেই কাদাজলে ভিজে যায়।শিখার মুখেও লেগে যায়।অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে,শুনশান রাস্তা প্রলয় পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করে পরে স্মার্টলি শিখার চিবুকটা ধরে মুখের জলকাদাটা মুছিয়ে দেয়।শিখা ঠকঠক করে তখন কাঁপছে।প্রলয় বলে,
---ভয় পেয়োনা শিখা।আমি তোমায় ভালোবাসি।আর আমি খুব ভুল না করলে আমি এটাও জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো।যদি আমার এই জানাটা ভুল হয় কথা দিচ্ছি পরীক্ষা শেষে তোমার সাথে আমার আর দেখা হবেনা।আজীবন তুমি আমার মনেই থাকবে।
নিজের অজান্তেই শিখার মুখ থেকে 'না' কথাটি বেরিয়ে আসে।
---কি না শিখা?
---না -না মানে কেন দেখা হবেনা?নিশ্চয় আমাদের দেখা হবে।
---তারমানে বলো আমি যা ভেবেছি সেটা ঠিক তো?
  শিখা সলজ্জ হেসে মাথা নাড়ে।
     মাত্র তো চারটে বছর।দেখতে দেখতে কেটে যায় সময়।শিখা তার বাবাকে প্রলয়ের কথা সব জানায়।শিখার বাবা প্রলয়কে একদিন দেখতে চান।প্রলয় আসে।ছেলেটিকে বেশ ভালোই লাগে শিখার মা ও বাবার।শিখা খুব খুশি হয় মা, বাবা প্রলয়কে মেনে নিয়েছেন দেখে।শিখা প্রলয়কে জানায় এবার তার বাবার মতটা নেওয়ার জন্য।প্রলয় তাকে জানায় ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে সে বাবাকে সব জানাবে।কলেজে যেটুকু তাদের দেখা ও কথা হয় এর বাইরে তাদের কোন কথা হয়না ।এমনকি তারা পরষ্পরের সাথে কখনোই ফোন করেও কথা বলেনা।পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই কলেজ ক্যাম্পাস থেকে প্রলয় মোটা মাইনের এক চাকরীও পেয়ে যায়।কোম্পানীর কথামতো ফাইনাল পরীক্ষার পরেই চাকরীতে জয়েন করতে পারবে।ভবিষৎ জীবনের স্বপ্নে বিভোর তখন দুটি তরুন তরুণী।কিন্তু স্বপ্নের জাল যত সহজে বোনা যায় তত সহজে স্বপ্নকে তো সত্যি করা যায়না।ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন পরেই প্রলয় চলে গেলো গ্রামের বাড়িতে তার বাবাকে সব কিছু জানাতে।কিন্তু সেই যে গেলো আর সে ফিরে এলোনা।প্রথমে অভিমান পরে রাগ আর শেষ পর্যন্ত উৎকন্ঠায় শিখা ছটফট করতে থাকে।বাবা,মা সবই জানেন সুতরাং তাদের সাথে আলোচনা করেও কোন কূলকিনারা শিখা খুঁজে পায়না।শেষে শিখার বাবা ঠিক করেন প্রলয়ের গ্রামের বাড়িতেই যাবেন ব্যাপারটা কি বুঝতে।প্রলয়ের মুখে শুধু গ্রামের নামটা শুনেছিলেন।তার দৃঢ় বিশ্বাস যেহেতু গ্রামের বাড়ি তিনি ঠিক প্রলয়ের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারবেন।প্রলয় জানিয়েছিল তার গ্রামের নাম পিলজঙ্গ।এই নামটিকেই সম্বল করে তিনি তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই প্রলয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন।
           বসিরহাটের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি একটি ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করেন।ক্লাবের ছেলেরা তাকে এ ব্যপারে যথেষ্ট সাহায্য করে।তারা স্থানীয় এক পার্টি অফিস থেকে পিলজঙ্গ গ্রামের ভোটার লিষ্ট দেখে সরাসরি প্রলয়দের বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দেয়।ঠিক সন্ধ্যার মুহূর্তে শিখা ও অবিনাশবাবু প্রলয়ের বাড়িতে উপস্থিত হন।বাইরে দাঁড়িয়ে অবিনাশবাবু প্রলয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকেন।ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
---এটা কি প্রলয়ের বাড়ি?
---হ্যাঁ, কিন্তু আপনারা কে?
---বলছি কিন্তু আগে ওকে ডাকুন।
---ও তো এখানে থাকেনা।
---কোথায় থাকে ?
---আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবো তখনই যখনই জানতে পারবো আপনারা কারা, কি উর্দেশ্যে তাকে খুঁজতে এসছেন।
    অবিনাশবাবু শিখার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন,
---আমার মেয়ে শিখা।প্রলয় ও শিখা উভয়ে পরষ্পরকে ভালোবাসে।সে বাড়িতে এসছিল এই বিয়েতে আপনার মত নিতে কিন্তু তারপর থেকে আজ প্রায় মাস খানেক হতে চললো তার কোন খবর আমরা পাইনি।তাই তাকে খুঁজতে আমরা কলকাতা থেকে এখানে এসছি।
---আচ্ছা এই সে শিখা।হ্যাঁ আমাকে সে বলেছিলো সে কথা।আমার কোন আপত্তি ছিলোনা।কথা হয়েছিলো খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে সে করবে।যেদিন তার সাথে আমার কথা হয় পরদিন কোন এক অজ্ঞাত কারনে সে আমাকে কিচ্ছু না বলে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এখন সে কোথায় আছে আমি ঠিক বলতে পারবোনা
 ঘরের ভিতরে চলে গেলেন।পিতা-পুত্রি হতভম্ব হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের গাড়ির উর্দেশ্যে রওনা দিলেন।

          শিখা গুমরে গুমরে তখন কাঁদছে পাছে বাবা দেখে ফেলে এই ভয় ও লজ্জায় যেটুকু নিজেকে বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টা করে যেতে থাকে।তবে বাবা এবং মেয়ে এটা বুঝেছেন প্রলয়ের বাবা তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আসল ঘটনাটা তাদের কাছে লুকিয়ে গেছেন।কিন্তু কি সেই ঘটনা !যারজন্য শিখার ভালোবাসাকে তাকে অগ্রাহ্য করতে হোল!
        কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর।প্রলয় এখন মুম্বাই বাসিন্দা।অতীতের কথা মনে পড়লেই নিজেকে যেমন তার অসহায় লাগে ঠিক তেমনই বাবার কথা মনে পড়লে লজ্জায়,ঘেন্নায় গা ঘিনঘিন করতে থাকে।যে বাবাকে সে এত ভালোবাসতো সম্মান করতো তিনি কিনা শেষ পর্যন্ত ---।ভাবলেই মাথায় আগুন চড়ে যায় প্রলয়ের।সেদিন খুব খুশি মনে বাড়িতে ফিরে বাবার কাছে শিখার কথা বলায় বাবা এক বাক্যে মেনে নেন।তিনি বলেন,"সংসার তুমি করবে,চাকরী পেয়ে গেছো আমার তো কোন অসুবিধা বা অমতের প্রশ্নই উঠেনা।"শুনে খুব খুশি হয়েছিলো প্রলয়।
         মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকেই এক দূর সম্পর্কের মাসি প্রলয়দের বাড়িতে আশ্রিতা ছিলেন।নাম ছিলো বিনতা।প্রলয় তাকে বিনু মাসি বলেই ডাকতো।খুব ভালোওবাসতো ।মায়ের ছিলো নার্ভের সমস্যা।খুব যন্ত্রনায় কষ্ট পেতেন।তখন এই বীনুমাসি মায়ের কত সেবাযত্ন করতেন।মায়ের অবর্তমানে এই বিনুমাসিই সংসারের সর্বময় কর্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন।সংসারের যাবতীয় কাজ,বাবার সেবাযত্ন কোনটাতেই বিনুমাসির কোন খুদ খুঁজে পাওয়া যেতনা।মাসির বাবা-মা কেউ ছিলেননা।অল্প বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে যখন জায়গা হলোনা তখন একদিন বিনুমাসি একটি টিনের বাক্সে নিজের কিছু জামাকাপড় নিয়ে এসে উঠেছিলেন আমাদের বাড়ি।মা তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেছিলেন,"আজ থেকে আমার বাড়িটা তোর নিজের বাড়ি মনে করিস।"তখন ক্লাস সেভেন বা এইটের ছাত্র ছিলো প্রলয়।মায়ের থেকে বেশ কয়েক বছর ছোট হবে মাসি।তার প্রতিদান যে এভাবে মাসির কাছ থেকে আসবে প্রলয় সেটা কোনদিনও ভাবেনি।অবশ্য মাসিকে দোষ দিয়ে কি লাভ!দোষ সব বাবার।
           সেদিন বাবার সাথে কথা হওয়ার পর খেয়েদেয়ে প্রলয় তার ঘরে শুতে চলে যায়।অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম আসেনা।সে দরজা খুলে বাইরে পায়চারি করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্রলয়ের ঘরের পরেই বাবার ঘর তারপর বিনুমাসির ঘর।বাবার ঘরটা পার হতে যেয়ে কিছু ফিসফিস কথা তার কানে আসে।সে থমকে দাঁড়ায়।বিনুমাসি বাবাকে বলছে, "আজ ছেড়ে দাও জামাইবাবু, ছেলেটা বাড়িতে এসছে ও যদি জানতে পারে লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবোনা।ক'টাদিনই বা ছেলেটা থাকবে।এ কটাদিন তুমি আমায় একটু রেহাই দাও।"
  বাবা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বলেন, "বিনু,তোর দিদি একটা সন্তান জম্ম দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনদিন আমায় শারীরিক সুখ দিতে পারেনি।ভাগ্যিস তুই এসেছিলি এ বাড়িতে তানাহলে তো জীবনের মানেটাই খুঁজে পেতামনা।নে আর কথা বারাসনা;তোকে একটু আদর করতে না পারলে আমার ঘুম আসবেনা।"
    একমুহূর্ত প্রলয় আর সেখানে দাঁড়ায়নি।নিজের ঘরে ঢুকে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে শুধু কেঁদে গেছে।নিজেকে পরে সামলে নিয়ে বাবার উর্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে জামাকাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পরে।
      পোষ্টিং এর ব্যপারে তারকাছে দু'টি অপশন ছিলো।প্রথমটা কলকাতা পরেরটা মুম্বাই।সে দ্বিতীয়টাকেই বেছে নেয়।বাবার কথা কোন মুখে সে শিখার কাছে জানাবে?কি করে বলবে তার বাবা চরিত্রহীন।চরিত্রহীন বাপের ছেলের সাথে শিখার মা,বাবা কিছুতেই বিয়ে দিতে চাইবেননা।কি করে এ মুখ শিখা ও তার পরিবারের কাছে সে দেখাবে।তার চেয়ে বরং ভালো শিখার জীবন থেকে সরে যাওয়া।কিন্তু সত্যিই কি সে শিখার জীবন থেকে সরতে পেরেছিলো? অন্তরে যার বাস তাকে কি সরানো যায় জীবন থেকে? প্রতিমুহূর্তে সে তুষের আগুনে পুড়ে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে।মন ছুটে যেতে চাইছে তার কাছে;কিছুতেই বিবেক সায় দিচ্ছেনা।ফোন করারও উপায় নেই।সেদিন ওই দম বন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাড়ির থেকে বেরোনোর সময় ভুলে ফোনটাই তার আনা হয়নি।তিনটে বছর কোথা থেকে কিভাবে যে কেটে গেলো এখন চিন্তা করতে গেলে প্রলয় কিছুতেই তার হিসাব মিলাতে পারেনা।অনেক ভেবেছে সে।বাবার অপরাধের শাস্তি সে ভোগ করবে কেন?কেন সে নিজের জীবনটাকে এইভাবে নষ্ট করছে?তার মন বলে আজও শিখা তার অপেক্ষাতেই আছে।সবকিছু সে গিয়ে খুলে বলবে।যে শাস্তি শিখা তাকে দেবে সে তা মাথা পেতে নেবে।শিখাকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না।এবার নিজের মনকে সে শক্ত করে সে শিখার কাছে যেয়ে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে তার পরিবারের সমস্ত কথা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
                   কিন্তু যাবো বললেই তো আর যাওয়া যায়না।এখন সে অফিসের এক্জিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার।ছুটি পাওয়া এখন বিশাল ব্যপার।ছুটির জন্য সে দরখাস্ত করে।পনেরদিন ছুটি চেয়ে সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর হয় তার।মুম্বাই থেকে প্রলয় বাই প্লেন কলকাতা এসে পৌঁছায়।ওঠে একটা হোটেলে।সেদিনই সন্ধ্যার দিকে সে আসে শিখাদের বাড়ি।একি এত বড় বাড়ি অন্ধকার কেন?গেটেও একটা বড় তালা ঝুলছে।এগিয়ে গেলো পাশের বাড়ির গেটের কাছে।এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইলো শিখাদের খবর।তিনি প্রলয়কে বললেন,"মাস ছ'য়েক আগে শিখার মা মারা যান।সে একটা বড় প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে।কিন্তু তার অফিসটা একটু দূরে হওয়াতে এখান থেকে যাতায়াত করতে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো।দাদারও বয়স হয়েছে।মেয়েটি সকালে বেরোতো আর রাতে ফিরতো।সারাটাদিন বয়স্ক লোকটাকে একটা কাজের লোকের কাছে থাকতে হত।শিখার খুব দুঃশ্চিন্তা হত।শেষমেষ তারা একটা ঘর ভাড়া করে শিখার অফিসে যাতায়াতের সুবিধার জন্য চলে যান।পুজোর ছুটিতে এখানে আবার আসাবেন বলে গেছেন।কিন্তু আপনার পরিচয়টা তো জানতে পারলামনা।"
     এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে প্রলয় আবারও জানতে চায়, "আচ্ছা শিখা কোন অফিসে চাকরী করে?ওর ফোন নম্বরটা যদি ----" কথা শেষ হওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা দু'টি প্রশ্নের উত্তরেই 'না' সূচক মাথা নাড়েন।
      মনের মাঝে একটি সুপ্ত আশা নিয়ে নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সে এসেছিলো শিখার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে।শিখা যে আজও বিয়ে করেনি এ ব্যপারে সে নিশ্চিত হোল ওই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে।কিন্তু কোথায় খুঁজবে সে এখন শিখাকে?কেউ তো কিছুই বলতে পারছেনা।না,ছুটিটা নষ্ট করা যাবেনা।কালই তাকে মুম্বাই এর উর্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।পুজোর সময় আবার সে আসবে।শিখার কাছে যেভাবেই হোক তাকে ক্ষমা পেতেই হবে।

         অবিনাশবাবুরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে।মাঝে মধ্যেই তারও শরীর ঠিক থাকেনা।তিনি বারবার বলেও মেয়েকে বিয়ে বসতে রাজি করাতে পারেননি।তার এক গো-"আমি চলে গেলে তোমায় কে দেখবে?"বাড়ি ছেড়ে মেয়ের অফিসের যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি ঘর ভাড়া করে থাকছেন কিন্তু তাতেও তার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি নেই কারন তার অবর্তমানে তার শিখার কি হবে? সে কি আদতেও তার জীবনের আলোর শিখাটি দেখতে পাবে?প্রলয়কে দেখে তার কখনোই খারাপ বলে মনে হয়নি।বেশ খোলামেলা বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে বলেই মনে হয়েছে।তবে কিসের জন্য সে তার একমাত্র মেয়ের জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললো এর উত্তর তিনি কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারলেননা।অনেক চেষ্টা করেছেন, নানান অফিসেও খোঁজখবর করেছেন কিন্তু কোন হদিস করতে পারেননি।এই বয়সে এসে মেয়ের কষ্টটা তিনি শত চেষ্টা করেও তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি আর এই না পারাটাই তাকে কুরে কুরে খায়।এখন তিনি পুরো অসহায়।হঠাৎ করেই শিখার মায়ের মৃত্যুটাও তাকে আরও অসহায় করে তুলেছে।এখন তিনি খুব একটা হাঁটাচলা করতেও পারেননা।সর্বক্ষণ একটি কাজের মেয়ে তার সঙ্গী যে শিখারই সমবয়সী।মেয়ে অফিস থেকে আসলে তিনি যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন।সব সময় তার আদরের শিখার জন্য তার একটা দুশ্চিন্তাও কাজ করে।
             দুর্গা পুজোর ঠিক পঞ্চমীর দিনে   শিখা অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে সামনের গেট থেকে উঠতে যেয়ে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায় আর ওই বাসেরই পিছনের চাকা এসে শিখার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়।রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ,শিখা তার জ্ঞান হারিয়েছে;তাকে ঘিরে লোকের জটলা।কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেনা।সকলেই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।হঠাৎ ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসলো এক যুবক।যে কিনা ট্যাক্সি করে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার এক পাশে ভিড় দেখে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে ভিড়ের ভিতর ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে অন্য লোকের সাহায্যে শিখাকে তুলে ওই ট্যাক্সিতেই হাসপাতাল পৌঁছায়।রাস্তার অল্প আলোতে আর লোকের ভিড়ে ছেলেটি তখন মেয়েটির মুখটি ভালোভাবে দেখতেও পারেনি।মুখটি যখন সে দেখলো তখন মেয়েটি স্ট্রেচারে শোয়ানো।জ্ঞানহীন।প্রলয়ের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে একটি কথায় বেরিয়ে আসলো,"শিখা?হায় ঈশ্বর!এ তুমি কি শাস্তি দিলে আমায়?" শিখাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো।কিন্তু পরমুহূর্তেই সেখান  থেকে বের করে প্রলয়ের অনুমতি সাপেক্ষে সোজা অপারেশান থিয়েটারে।সরকারি কাজগুলো প্রলয় দ্রুত সেরে ফেললো।রিলেশনের জায়গায় প্রলয় ওয়াইফ লিখে দিলো।শিখার ব্যাগটা থেকে মোবাইল বের করে কন্টাক্টসে বাবা লেখা দেখে শিখার বাবাকে ফোন করে জানালো তার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে হাসপাতাল থেকে ফোন করছি।তার অফিস কলিগরা আছে আপনি কোন চিন্তা করবেননা।
        দীর্ঘ চার ঘন্টা অপারেশান শেষ ডাক্তার বেরিয়ে এসে যে কথা প্রলয়কে শুনালেন তারজন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা।প্রলয় মাথায় হাত দিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের উপরেই বসে পড়লো।বিরবির করে বলতে লাগলো,"সবকিছুর জন্য আমি দায়ী শিখা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।"
         পরদিন দুপুরবেলার দিকে শিখার জ্ঞান ফিরলো।প্রলয় এক মুহূর্তের জন্যও হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যায়নি।মাঝে মাঝে অবিনাশবাবুকে ফোন করে শিখার খবরাখবর দিয়েছে অফিস কলিগ সেজে।শিখার জ্ঞান ফিরলে নার্স এসে প্রলয়কে ডেকে নিয়ে যায়।শিখা চোখ খুলেই দেখে প্রলয় দাঁড়িয়ে।মুখে মাস্ক কথা বলার ক্ষমতা নেই কিন্তু চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।পায়ের পাতা থেকে কোমর অবধি সাদা কাপড়ে ঢাকা।শিখা এখনও জানেনা তার বা পায়ের উপরের অংশ থেকে সম্পূর্ণ বাদ গেছে।প্রলয় নিজেকে সামলাতে সেখান থেকে দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে আসে।
       বিকালে আবার সে শিখার সাথে দেখা করতে যায়।তখন তার মাস্ক খুলে দেওয়া হয়েছে।প্রলয়কে দেখে শিখা চোখ বন্ধ করে নেয়।প্রলয় এগিয়ে যেয়ে শিখার একটি হাত ধরে বলে,"ক্ষমা করে দাও শিখা। কি পরিস্থিতিতে কেন করেছি সব বলবো তোমায় তুমি শুধু আমায় একটিবার বল আমায় ক্ষমা করবে?"শিখা চুপ করে থাকে।কোন উত্তর সে করেনা এ বিষয়ে।শুধু বলে,
---বাবা খুব চিন্তা করছেন।একটা ফোন করতে হবে।
---মেসোমশাইকে আমি তোমার খবর জানিয়েছি।তোমার ফোনটা আমার কাছে আছে,কথা বলবে?
---শিখা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
   ফোনটা শিখার হাতে প্রলয় তুলে দিতে গেলে একজন নার্স এসে বাঁধা দেন।তিনি বলেন যে শিখার এখন বেশি কথা বলা ঠিকনা।নার্সকে দেখে শিখা জানতে চায়,
---আমার পা টা এত যন্ত্রনা করছে কেন?
---এখন তো একটু যন্ত্রনা করবে।পেইন কিলার দেওয়া হয়েছে ঠিক হয়ে যাবে কিছু পরে।কথাগুলো বলে সিস্টার চলে যান।
   প্রলয় এগিয়ে যায় শিখার কাছে।মাথায় হাত রাখে।শিখা চোখ বন্ধ করে থাকে।কোন কথা আর তাদের মধ্যে হয়না।ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়।"কাল সকালে আবার আসবো"-বলে প্রলয় বেরিয়ে আসে।
     রাস্তায় বেরিয়ে একটা উবের বুক করে সোজা চলে আসে শিখাদের বেহালার বাড়িতে।কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দেয়।প্রলয় কাজের মেয়েটিকে বলে সে শিখার বাবার সাথে দেখা করতে চায়।তাকে নিয়ে কাজের মেয়েটি অবিনাশবাবুর কাছে যায়।প্রলয়কে দেখেই উনি চিনতে পারেন।
---প্রলয় তুমি?খুব দরকার ছিলো এই সময়ে তোমাকে।জানো বাবা, শিখা অ্যাক্সিডেন্ট করে হাসপাতাল রয়েছে।আমি তো এখন অথর্ব।মেয়েটি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে শুনেও কিছুই করতে পারছিনা।আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই যাকে ওখানে পাঠাতে পারি।ওর এক অফিস কলিগই ওকে দেখাশুনা করছে।তুমি কিছু একটা কর বাবা।
     প্রলয় আমতা আমতা করে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে বলা শুরু করে।কিন্তু কথার মাঝপথে চুপ করে যাওয়াতে অবিনাশবাবু অধর্য্য হয়ে উঠে বলেন,"আহ!চুপ করে গেলে কেন?আমাকে সব খুলে বলো।"
---আস---লে
---বলো প্রলয় খুলে বলো ।
---ওর মানে ওর তো বা পায়ের উপর থেকে বাসের পিছনের চাকা চলে গেছিলো ---তাই ওই পায়ের হাঁটুর কাছ থেকে সম্পূর্ণ অংশ বাদ ---
   প্রলয়ের কথা শেষ হয়না।অবিনাশবাবু ছোট শিশুর মত ডুকরে কেঁদে ওঠেন।প্রলয়ের চোখেও জল।সে উঠে যেয়ে অবিনাশবাবুর কাঁধে হাত দেয়।অবিনাশবাবুর কান্না যেন দ্বিগুন বেগে ঝরতে থাকে।কিছুক্ষণ পর প্রলয় নিজেই বলে,
---মেসোমশাই নিজেকে শান্ত করুন।আপনি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়েন আমি একা শিখাকে সামলাতে পারবোনা।আমি শিখার পাশে সারাজীবন আছি আপনাকে কথা দিচ্ছি।আমি একটা ভুল করেছিলাম তার প্রাশ্চিত্ত আমাকে করতেই হবে।ও সুস্থ্য হয়ে বাড়ি আসুক আমি ওকে অন্যভাবে হাঁটার ব্যবস্থা করে দেবোই।কিন্তু আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দেন।নিজের পরিবারের প্রতি ঘেন্না বশত আমি নিজেকে শিখার অনুপযুক্ত মনে করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।আমি সব বলবো আপনাদের।কিন্তু আগে আমাদের দরকার শিখার কাছে যেয়ে তার মনোবল বাড়ানো।সে এখনও জানেনা বিধাতা তার সাথে কি নিষ্ঠুর খেলা খেলেছেন।চলুন আমরা বেরিয়ে পড়ি শিখার কাছে।
     এ কথা শুনে অবিনাশবাবু বাধ্যশিশুর মত জামাপ্যান্ট পড়ে প্রলয়ের একটা হাত ধরে বলেন,"এবার শিখার হাতটা তুমি শক্ত করে ধরো বাবা,আমি আর ক'দিন?মেয়েটা যে বড্ড অসহায় হয়ে পড়লো।"
---আমি আছি,আপনি একদম ভাববেন না।
  দু'জনে হাসপাতালের উর্দেশ্যে রওনা হলেন।
                     ....শেষ....

Saturday, July 14, 2018

চঞ্চল মন
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

মনে আসা শব্দগুলো,
কিছু হয় প্রতিবাদী,
লিখতে গেলে তোলে সুনামী,
সবকিছু ওলটপালট করে দেয়।
জাগতিক সবকিছু ভুলে যাই,
জেগে ওঠে এক প্রতিবাদী সত্ত্বা।
মুহূর্তেই নিজের মনকে প্রশ্ন করি,
কি চাই আমি?
গা বাঁচিয়ে বেঁচে থাকা?
নাকি প্রতিবাদে সামিল হয়ে-
অকালে প্রান দেওয়া!
ভেসে ওঠে আপনজনের মুখ,
পিছিয়ে পড়ি তখন,
হয়ে উঠি স্বার্থপর।

# নন্দা 

Friday, July 13, 2018

ইচ্ছা পূরন
  নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

        ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনায় মেধাবী ছন্দা গ্রাজুয়েশনের পরেই একটা বড় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী পেলেও তার ইচ্ছা ছিলো একটি সরকারি চাকরির।অনেক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে।কিন্তু মনের ইচ্ছা মনেই থেকে গেছে।
         অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে সুছন্দা ছিলো সকলের ছোট।বাবাকে হারিয়েছে দ্বাদশশ্রেনীতে পড়ার সময়েই।বড়দা কেন্ত্রীয় সরকারের অধীনে ভালো চাকরী করতেন।বিয়ে করার সুযোগ তার জীবনে আসেনি।তিনিই পরিবারের বড় সন্তান,বাবার মৃতু্র পর স্বভাবতই সংসারের জোয়াল তার কাঁধে এসে পরে।আর পাঁচজনের মতই সংসারের এই দায়িত্বকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি।এক বোনের বিয়ে বাবা দিয়েই গেছিলেন বাকি তিন বোনের ও ছোট ভায়ের যথাযথ শিক্ষা গ্রহনের তাদেরও বিয়ে দিয়ে সংসারী করেন।এসবের মধ্যে মা-ও চিরতরে বিদায় নেন।সব দায়িত্ব পালন যখন শেষ হোল তখন ছন্দার বড়দার বিয়ের বয়সও পার হয়ে গেছে।সুছন্দা তার বড়দাকে পিতৃসম শ্রদ্ধা, ভক্তি করতো।তিনি তার আদরের স্বাধীনচেতা ছোট বোনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেমন ছেলে তার পছন্দ।সুছন্দা তার বড়দাকে বলেছিলেন,"রূপ মানুষের পরিচয় নয়।রূপবান চাইনা, তুমি চেষ্টা করো একজন প্রকৃত ভালো মনের মানুষ খুঁজে আনতে।আর কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরী করা ছেলে নয়;চেষ্টা কোর যে কোন পোষ্টেই হোকনা কেন একজন সরকারী চাকুরিজীবি ছেলে খুঁজতে।যার বর্তমান আর আমার কপালে যদি থাকে তাকে হারানোর তার অবর্তমানেও আমি তারটাই খাবো।ভবিষ্যতে সন্তানের মুখাপেক্ষী হতে আমি রাজি নই।কারন মেয়েদের জীবনে স্বামী এমন একজন মানুষ যার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবো, যার সাথে ঝগড়া করবো,মন-অভিমান, ভালোবাসা, তার সেবাযত্ন সব-সব করবো;তারপরেই সব জোর খাটাবো।আমার চেহারা, গাড়ি, বাড়ি কিছুরই কোন দরকার নেই।আমার কপালে থাকলে ওই সামান্য চাকরী থেকে আমি নিজেই সব করে নিতে পারবো কারন চাকরিটা থাকবে পার্মানেন্ট।সামান্য মাইনে হলেও সেটা থাকবে নির্দিষ্ট।বড়দা দেবাঞ্জন ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় ঠিক এমনই একটি ছেলের সন্ধান পেয়েছিলেন দূর সম্পর্কের এক বোনপোর মাধ্যমে।রূপে বা অর্থে নয় সে ছিলো গুনের আধার এবং সরকারী একজন সাধারন কর্মচারী।
       ঊনত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সুছন্দা ও তার স্বামী বিজিত খুব সুন্দর বাড়ি করে।মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বেশ বড় ঘরেই ব্যবসায়ী ছেলের সাথে বিয়ে দেয়।ছেলে যখন ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে ঠিক তখনই সুছন্দার জীবনের ছন্দপতন!হঠাৎ করেই মাত্র কা'দিনের জ্বরে বিজিত তার ছন্দকে ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করে।বড্ড একা হয়ে পড়ে ছন্দা।মেয়ে তার সংসার ফেলে কতদিন মাকে আগলে রাখবে?একসময় সেও তার স্বামীর কাছে চলে যায়।সম্পূর্ণ একাকী সুছন্দা তখন মোবাইলকেই সময় কাটানোর বন্ধু বানিয়ে ফেলে।
          সুছন্দা মেধাবী ছেলে রাহুল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে ক্যাম্পাস থেকেই চাকরী পেয়ে যায়।পোষ্টিংও কলকাতাতেই হয়।বিশাল তিনতলা বাড়ির নিচুটা ভাড়া দিয়ে তিনি স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে দোতলা ও তিনতলা নিয়ে থাকতেন।স্বামী বেঁচে থাকাকালীন সময়েই বিচক্ষণ সুছন্দা তিনতলাতে সম্পূর্ণভাবে একটি আলাদা ফ্লাট তৈরি করে রাখেন।তার মনের ইচ্ছা ছিলো ছেলেকে যদি তিনি বিয়ের পরেই আলাদা করে দেন তাহলে আজকের দিনে ঝামেলা এড়িয়ে ছেলে, বৌকে নিয়ে একই ছাদের তলায় থাকতে পারবেন।কারন দুটি বাসন একজায়গায় থাকলে শব্দ হবেই।তিনি মোটা টাকায় পেনশন পান।ছেলে আর বৌকে দেবেন ছাড়া তাদের কাছ থেকে একটি টাকাও তিনি নেবেন না।আর ঠোকঠুকির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একটাই উপায় তোমরা আলাদা থাকো, আমরাও আলাদা থাকি কিন্তু একই ছাদের তলায় ঝগড়াঝাটি ছাড়া থাকি।কিন্তু স্বামী চলে যাওয়ার পর তিনি তার সিদ্ধান্তের কিছুটা পরিবর্তন করেন।বিজিতবাবু না থাকাতে আত্মীয়-পরিজনের আসাও অনেকাংশেই কমে গেছে।তাছাড়া দোতলার এত বড় বড় ঘরে যার প্রতি কোণায় কোণায় স্বামীর স্মৃতি যা তাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছিলো।তাই রাহুলের বিয়ের পর তিনি দোতলা তাদের ছেড়ে দিয়ে তিনতলায় উঠে যান । স্বামী চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বড়দাও চলে যান।বাবাকে হারিয়ে
সুছন্দা বড়দাকেই বাবার আসন দিয়েছিলেন। শ্রদ্ধা,ভালোবাসায় বড়দাকেই জীবনের আদর্শ পুরুষ হিসাবে দেখতেন।মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে পিতৃসম বড়দা আর জীবনের সব থেকে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ছন্দা একেবারেই চুপসে গেছিলেন।মেয়ে, জামাই তাকে জামাইষষ্ঠীতে একটি স্মার্ট ফোন কিনে এনে দিয়ে কিছুটা হলেও শান্তির আভাস এনে দিয়েছে।ছেলে, বৌ ও এক নাতির সান্নিধ্যে তার মাঝে মাঝে সময় খুব ভালোই কাটে।বাকি সময় তিনি তার ফেসবুক নিয়েই থাকেন।বৌমার সংসারে তিনি বিন্দুমাত্র নাক গলান না।নিজের রান্না নিজেই করে খান।ঘরভাড়া ও স্বামীর পেনশনে তার খুব ভালোভাবেই চলে যায়।উপরন্তু তিনি পুরো বাড়ির ইলেকট্রিক বিল, বৌমার গ্যাসের দাম এবং তার টুকটাক হাত খরচ তিনিই দেন। ছেলের প্রিয় খাবারগুলো তিনি মাঝে মাঝেই রান্না করেন আর বাটি ভর্তি করে ছেলেবউয়ের ঘরে চালান করেন।কিন্তু বৌমা তার কোন কাজ করতে গেলে স্বাধীনচেতা সুছন্দার মিষ্টি সুরে একটাই কথা,"এখন আমি সবকিছু করে নিতে পারি মা,আমার শরীর যখন দেবেনা যখন আমি পারবোনা তখন যদি তোমার মনেহয় আমার কোন কাজ করে দেবে তখন কোর।এখন আমার জন্য তোমাদের কিচ্ছু করতে হবেনা।" তবে তার ছেলের বৌ মাঝে মধ্যে এটাসেটা রান্না করে বা কখনো বা এক কাপ চা করে তার শ্বাশুড়ীমাকে দিয়ে আসে।সুছন্দা সেগুলি হাসি মুখেই গ্রহন করেন।ঝগড়া, অশান্তির কোন সুযোগই তিনি দেননা।

   সংক্ষিপ্ত 

Thursday, July 12, 2018

বুঝবে একদিন
   নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

হাতে ছিলো ভিক্ষা পাত্র,
পেটে ছিলো  ক্ষিদে,
সুযোগ বুঝে করলে তুমি,
চুরি অবশেষে?

মনুষ্যত্ব,মানবিকতা দিলে বিসর্জন,
মিথ্যে ভালোবাসার জাল বিছিয়ে,
সকলের হৃদয় করলে জয়!
সুযোগ বুঝে কোপটি মারলে,
ছিড়ে গেলো মুখোশ তোমার,
সমকক্ষ অনেক পেলে সাথে,
অর্থ লোভে ভুললে পরকাল।
সব আদালতের বিচার শেষে,
বিচার হয় মনের আদালতে,
সেখানে তুমি সব হারিয়ে,
মুছবে শুধুই চোখের জল।

  • #  নন্দা       ১২-৭-১৮   রাত ১-২৫  

Tuesday, July 10, 2018

হয়না লেখা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

কালো রাতের গভীরতায়,
শব্দগুলো বলে চুপিসারে,
রাত যে অনেক হোল,
এবার শব্দমালা গাঁথো।

শব্দগুলো এলোমেলো,
মনটা থাকে উদাস!
ইচ্ছা হলেও হয়না লেখা,
একটু পরেই ফোটে ভোরের আলো।

ভোরের সূর্য্যই নিই যে শপথ,
হারবোনা আর এই জীবনে,
চলতি পথেই হয় যে দেখা,
বন্ধুবেশি কিছু শয়তানের।

মুখটা তাদের অবাধ শিশুর,
ভিতরটা ঠিক মীরজাফরের,
ভাবনা আমার হয়না সারা,
কবিতারাও দেয়না ধরা।

   #নন্দা  ১০-৭-১৮ রাত ২-২৭

Wednesday, July 4, 2018


উত্তর খুঁজি
      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

মানুষের এই ক্ষুদ্র জীবনে স্মৃতির খাতায় কত কথা জমা থাকে।তার কিছু আনন্দের আর কিছুটা বা বেদনার।আনন্দ বা বেদনা যায় হোকনা কেন কিছু কিছু ঘটনা মানুষ সহজেই ভুলে যায়।আর কিছু স্মৃতি আছে যা কখনোই ভুলা যায়না।সেইসব স্মৃতির খাতায় ময়লা জমলেও অক্ষরগুলি স্পষ্ট হয়ে থাকে সারাজীবন।
             এখন আমার বয়স প্রায় বাষট্টি বছর।আজও সেসব কথা ভাবলে আমি শিউরে উঠি।বাবা ছিলেন কলেজের প্রফেসার।আমাকে ও মাকে নিয়ে শহরে একটি ঘরভাড়া নিয়ে থাকতেন।আমার স্কুল ও বাবার কলেজ ছুটি  পড়লেই তিনজনে মিলে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতাম।মনেপড়ে যেদিন গ্রামের বাড়িতে যাবো বলে ঠিক থাকতো তার আগের রাতে সারাটা রাত ঘুমই আসতোনা।কখন সকাল হবে আর বাড়ি যাবো এই ভাবনায় সারাটা রাত প্রায় জেগেই কাটাতাম।শহরে যে বাড়িটিতে আমরা ভাড়া থাকতাম সেটিকে বলতাম বাসা আর বাড়ি বলতে আমরা গ্রামের বরীতীকেই বুঝতাম।বাড়িতে যাওয়ার সময় আমি ট্রেনের কামরার ভিতরে বরাবর জানলার কাছেই বসতাম।আম,কাঁঠালের গাছ,ঝোপঝাড়-বাঁশঝাড় পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে আর আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে কটা স্টেশন বাকি তার হিসাব কষে চলেছি।
              ট্রেন নিদিষ্ট স্টেশনে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই দশ মিনিটের রাস্তা আমি দৌড়ে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যেতাম।লালুর বিল,চৌধুরীদের বাগান,পালবাড়ির পুকুর সব ছড়িয়ে দৌড়াচ্ছি আর মনেহচ্ছে ওদের ভালোবাসার ছোঁয়া পাচ্ছি।ওরা যেন আমার আসার অপেক্ষাতেই ছিলো। আমাদের বাড়িতে ঢোকার মুখেই রাস্তার পাশেই 'মনসাতলা'।শ্রাবনমাসের শেষ দিনে এখানে খুব বড় করে পূজা হয়।পুরোপাড়া এই পূজায় অংশগ্রহন করে।ছোটখাটো দোকানপাটও বসে।বেতের বড় বড় ঝুড়ি যাকে গ্রাম্যভাষায় ধামা বলে এই সব বড় বেশ কয়েকটা ধামায় ন্যাড়া মাখা হত।প্রচুর নাড়ুও ভাজা হত পূজার দিনে।বলাবাহুল্য সমস্ত খরচ ছিলো আমাদের বাড়ির অথাৎ আমার ঠাকুরদা।এই সব কাজে গ্রামের সকল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়তেন কিন্তু কোন পারিশ্রমিক তারা নিতেননা। ওই মনসাতলায় দেখেছি সারাদিনের পূজার পর ঠিক সন্ধার দিকে মনসা গাছটার দুপাশ থেকে দুটি কেউটে সাপকে।যারা কলাপাতার উপরে দেওয়া দুধ, কলার উপরে বারকয়েক মুখ রাখতো।ছেলেবেলা এবং বড় হয়েও এ ঘটনার স্বাক্ষী বহুবার থেকেছি।বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করার ফলে পরবর্তীতে জেনেছি সাপ চুষে কিছু খেতে পারেনা।কিন্তু এই অলৌকিক ঘটনার উত্তর আমি বা আমার বাবা এমনকি গ্রামের শিক্ষিত মানুষজন কোনদিন পায়নি।
       রাস্তা থেকে আমাদের বাড়ির মেইন দরজা বেশ খানিকটা দূরে।বাড়ির সীমানায় ঢুকতে গেলে ছোট ছোট বাঁশের তৈরি (যা কঞ্চির ! থেকে একটু মোটা)একটা গেট থাকতো।যাকে গ্রামের ভাষায় বলা হত 'আরকাঠা'।অনেক মোটা পাটের দড়ি দিয়ে এটা তৈরি করা হত।বাঁশগুলিকে পরপর বাঁধা হত ।একটা বাঁশের থেকে আর একটা বাঁশের দূরত্ব থাকতো প্রায় একফুট।এটা চওড়ায় হত প্রায় দশ থেকে বারোফুট।এত বড় করার কারন ছিলো গরুর গাড়িতে করে যখন দূর-দূরান্তের ধান আসতো এটাকে খুলে রাখা হত আর সারিসারি ধান বোঝায় গরুর গাড়ি বাড়ির ভিতরে ঢুকে বড় উঠানে ধান ফেলে বাড়ির পিছনের ছোট উঠান দিয়ে আমাদের জমির অন্য রাস্তা দিয়ে মূল রাস্তায় গাড়িগুলো উঠতো।ছেলেবেলায় সিঁড়ি ভাঙ্গার মত কতবার যে ওই 'আরকাঠা'-বেয়েবেয়ে উপরে উঠতাম তার কোন হিসাব নেই।অবশ্য বড়দের চোখে পড়লে চোখ রাঙ্গানিও খেতে হত।রাস্তার অপরদিকে ছিলো আমাদের বাড়ির বড় পুকুর।এই পুকুরে গ্রামের প্রচুর মানুষ স্নান করতো।মাছ চাষও হত।শীতকালে এই পুকুরের জল থাকতো গরম।তার কারন হিসাবে সকলে বলতো আশেপাশে কোন বড় গাছ না থাকাতে যেহেতু পুরো রোদটা পেত তাই জল গরম থাকে।আমাদের বাড়িতে মূলত তিনটি পুকুর ছিলো।

রাস্তার উপরের পুকুরটাকে বলা হত বড় পুকুর।বাড়ির ভিতরের পুকুরের নাম ছিল ছোট পুকুর।মুলত এই পুকুরে বাড়ির মা,জ্যেঠিমারাই ব্যবহার করতেন।
বাসনমাজা,কাপরকাচা,স্নান করা আর রান্নার জলের জন্য।কিছু মাছ চাষ এখানেও করা হত।আর একটা পুকুর যা বাড়ির শেষ প্রান্তে ছিল তার নাম ছিল
"ভিটের পুকুর"।এই পুকুরে কোন মাছ চাষ করা হতো না।কিন্তু এখানেই পাওয়া যেতো নানান ধরনের মাছ।বিশেষত শিং,মাগুর,কৈ,বড় বড় সরপুঁটি।
বর্ষাকালে যখন নদীনালা ,খাল-বিল সব জল ভর্তি হয়ে যেত তখন সেই সব জায়গায় মাছ সব এই ভিটের পুকুরে এসে জমা হত।লোক দিয়ে সেই সব মাছ মেরে গ্রামের মানুষদের বিলিয়েই তারপর খাওয়া হত।
                  "আড়কাঠা" পার হয়েই কিছুটা এগিয়ে গেলে পড়তো আমার ঠাকুরদার বৈঠকখানা।তারপরেই একটা ডিপ টিউবয়েল।কয়েক মাইল হেঁটে যেয়ে গ্রামের মানুষের খাবার জল আনতে হতো বলে  ঠাকুরদার পরামর্শে আমার বাবা এই  টিউবয়েলটির  ব্যবস্থা করেছিলেন।বিকেল হলেই গ্রাম্য বধূরা আলতাপায়ে,বেশ বড় করে সিঁদুরের টিপ পড়ে তেল চপচপে মাথায় খোঁপা করে কল থেকে যে জল নিতে আসতেন দেখলে মনে হতো এ বাড়ি আমাদের স্বর্গপুরী। বাড়ির ঘরগুলির চারপাশেই ছিল উঠান।আর এই উঠানগুলিতে শীতকালে আঁটি বাঁধা বাঁধা ধানের বোঝা থাকতো।দূর থেকে দৌড়ে এসে এই আঁটি বাঁধা ধানের বোঝা গুলির উপরে উঠার বৃথায় চেষ্টা করতাম।কারন তার আগেই ধানের আঁটির কোনো একটি খাপে পা বেঁধে ধপাস।সারা শরীর খুব চুলকাতো ঐ ধানগুলি গায়ে লেগে।কিন্তুু কোন ভ্রূক্ষেপ ছিলনা।ঘরের পাশেই ছিল বিরাট বড় একটা লিচু গাছ ও ফুলের বাগান।বাদুর ও নানান ধরণের পাখিতে পাকা লিচু খেয়ে যেতো বলে একটা বড় তেলের টিনের ভিতর মোটা এক কাঠি কি অদ্ভুতভাবে বেঁধে বিশাল বড় এক পাঁটের দড়ি ঐ টিনের ভিতর থেকে টেনে বাড়ির বারান্দায় কিছু একটার সাথে বেঁধে রাখা হত।আর বাড়ির লোকেরা ঘুরতে ফিরতে ঐ দড়িটা ধরে টান দিতে টিনটা খুব জোরে  জোড়ে বেজে উঠতো।তাতেই বাদুর এবং পাখিরা উড়ে চলে যেতো।
            ঘটনাগুলি মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। তারপর আস্তে আস্তে বড় হলাম।চাকরি পেলাম।পদোন্নতি হতে হতে একসময়ে আমার এই "ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়গুলি" ছেড়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে বাধ্য হলাম।ততদিনে ঠাকুরদা,ঠাকুমা,,জ্যেঠিমা মারা গেছেন।বাবার একটাই কথা আমাদের কথা ভেবে নিজের ভবিষ্যৎ কে জলাঞ্জলি দিয়োনা।বাবাও রিটায়ার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে এসেছেন।ততদিনে গ্রামের হাল-হকিকত অনেক পালটেছে।গ্রামে ইলেকট্রিক এসেছে, যে কাঁচা রাস্তা ধরে আমি ট্রেন থেকে ছুটে বাড়িতে ঢুকতাম তা এখন পাকা হয়েছে।ঐ রাস্তা দিয়ে এখন বাস অটো চলাচল করে।গত তিন বছরে দুবার আমি গ্রামের বাড়িতে এসছি।সুইডেনে থাকাকালীন সময়ে আমি প্রবাসী এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করি।মা,বাবাকে আসার কথা বললে বাবা জানান,
  ..."সংসার তুমি করবে,আজীবন তাকে নিয়ে তুমি থাকবে।তোমার যদি মনে হয়ে মেয়েটি ভালো তা হলে আমাদের মত রইলো তুমি বিয়ে করো।আমাদের আশীর্বাদ সব সময় তোমার সাথে থাকবে"।
                 দুবছর হয়েছে বিয়ে করেছি।অনেক কষ্টে একমাসের ছুটি বন্দোবস্ত করেছি।অনেকদিন বাবা মা কে দেখিনা ।আগের মতো রোজ আর ফোন ও
করা হয়ে ওঠে না।এবার ইচ্ছে অঞ্জলিকে নিয়ে বাড়িতে যাব।দিন সাতেক আগেই বাবা মায়ের সাথে কথা হয়েছে।চমকে দেবো বলেই বাড়ি যাওয়ার কথাটা
গোপন করেই গেছি।
             অনেকদিন পর দেশে ফিরে মনটা বেশ ফুরফুরে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হাওড়া  স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমে আগে যেপথটুকু দৌড়ে যেতাম এখন সেই পথ পেড়িয়ে আরও দূরে যাওয়ার জন্য সরাসরি অটো দাঁড়িয়ে।ব্যাগ-পত্র প্রচুর ছিল।একটা অটো ভাড়া করে নিলাম।অটো এসে মনসা গাছ তলায় দাঁড়ালো।দুই হাত জোড় করে প্রণাম করলাম।আমার দেখা দেখি অঞ্জলি ও প্রণাম করে কারণ এই দুই বছরে আমাদের বাড়ির খুঁটিনাটি সকল কথা অঞ্জলির  সাথে শেয়ার করেছি।অটো মালিক কে অনুরোধ করলাম আমাদের যাতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায় ।আরকাঠা বহুদিন আগেই ভেঙ্গে চূড়ে গেছে তা গতবার এসেই দেখেছি।ধানী জমি-জামা বাবা একটু একটু করে বিক্রি করে ব্যাঙ্কে আমার নামেই টাকা গচ্ছিত রেখেছেন।এসব বাবা ফোনেই আমায় জানিয়েছেন।
                 উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকলাম মা, ও বাবা আ আ ...
হন্ত দন্ত হয়ে দুজনে বেরিয়ে এলেন।এসেই মা হাসতে হাসতে বললেন,
 ...ওমা তোরা এসে গেছিস?
 ...এমনভাবে বলছো যেন আগে থাকতেই জানতে আমরা আসব!।
 ...ওমা  জানব না কেন?আমরা যে তোর মা,বাবা। সন্তানের সব খবর যে মা বাবার কাছে আগেই আসে।
     অঞ্জলি এগিয়ে গিয়ে বাবা,মাকে প্রণাম করে।তা দেখে বাবা খুব খুশি হয়ে বলে ওঠেন,
 ...তোমার তো বিদেশেই জন্ম শুনেছি মা।তা এখনো এসব তোমাদের বাড়িতে চল আছে? রবিনের পরে আমার বিশ্বাস ছিলো।ও যে মেয়েকে পছন্দ করেছে সে আমাদের পরিবারের উপযুক্ত বউ হবেই। ওগো শুনছো?।যে জন্য অপেক্ষায় আছো সেটা করো।তোমার গৃহলক্ষ্মী কে বরন করে ঘরে তোলো।মা,বাবা বাইরে দাঁড়িয়েই অঞ্জলিকে ধান,দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে ঘরে নিয়ে যান।আমিও ব্যাগ গুলি নিয়ে পিছন পিছন ঘরে ঢুকি।
     মা তার হাতের মোটা নোয়া বাঁধানোটা খুলে অঞ্জলি কে পড়াতে গেলে আমি বাঁধা দিই-
     ...মা এটা কি করছো? এটা তোমার হাতেই থাক।বাবা এখনো বেঁচে রয়েছেন,বাবার অমঙ্গল হবে।
বাবা বলে উঠলেন,
 ... আর মঙ্গল অমঙ্গল।যা হবার তাতো হয়েই গেছে।তুই আর বাঁধা দিস না রবি।তোর মার যা ইচ্ছা করতে দে।বউমা আমাদের কতো আদরের সবই তো
তোদের।হাতের বাঁধানো নোয়াটি অঞ্জলি কে পড়িয়ে কথা বলতে বলতেই আলমারি খুলে মা গয়নার বাক্স টা বের করে অঞ্জলির হাতে দেন।
আমি বলে উঠি।সব এখুনি কেনো করতে হবে মা?একমাস থাকবো।এসব পরে করলেও চলবে।আমার কথার কোনো উত্তর মা বাবা দেন না।মা শুধু বলেন,
 ... অনেক রাত হলো।তোরা হাত মুখ ধুয়ে নে।খেয়ে দেয়ে গল্প করা যাবে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলো।কিছুক্ষণ বসে আড্ডা মারলাম সকলে।বাবা একটা টিনের বাক্সো দেখিয়ে বললেন,
  ...রবি সময় মতো এটা খুলে দেখিস।নে এবার ঘুমিয়ে পর তোরা।আমরাও যাই।কয়েকটা দিন তোর একটু পরিশ্রম যাবে বাবা।এমনিতে সব ঠিকই আছে।যেটুকু না করলে নয় সেটুকুই করিস।
 ... কি কাজ করতে হবে বাবা?তুমি বলো আমি ঠিক-ঠাক সব করে নেবো বাবা।
  ...সে আমি জানি বাবা।নে এবার তোরা শুয়ে পড়।বড় শান্তি পেলাম আজ।
পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি অঞ্জলি অকাতরে ঘুমাচ্ছে।মা,বাবার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ বন্ধ বলে মনেহল ।তারমানে তারাও ঘুমাচ্ছেন।আমি দাঁত ব্রাশ করে বেরিয়ে পড়লাম।এতদিন পরে বাড়িতে ফিরে কি যে এক আনন্দ অনুভব করছি বোঝাতে পারবনা।রাস্তটা দিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি। হটাৎ দেখা নারায়ণ খুঁড়োর সাথে।
 ... কেমন আছো খুঁড়ো?
 ...কে?গলাটা খুব চেনা চেনা লাগছে।
চশমাটা ভালো করে হাতে ধরে নিয়ে মুখের কাছে মুখটা নিয়ে নারায়ণ চক্রবর্তী বললেন,
...রবি না?তা খবর পেয়েই এলে বুঝি?কখন এলে?
 ... কি খবর খুঁড়ো?
     কথাটা খুঁড়ো শুনতে পাননি বুঝতে পারলাম,তার পরবর্তী কথা শুনে।
 ... আজকালকার ছেলে তোমরা।তা এসেই যখন পড়েছো নিয়মকানুন গুলো তো মানতে হবে বাপু।
 ...আমি কিছুই না বুঝে খুঁড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খুঁড়ো আবার শুরু করলেন,
 ...তুমি বাড়িতে যাও।আমি সব ব্যবস্থা  করছি।কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না আমরা। তোমার বাবা,মা বড়পুকুর থেকে স্নান করে রাস্তা পার হচ্ছিলেন।তোমার বাবা রাস্তা পার হয়ে মনসা গাছতলায় দাঁড়িয়ে প্রণাম করছিলেন।তোমার মা হঠাৎ ভিজে কাপড়ে মা বেঁধে রাস্তার উপরে পরে যান।শব্দ হওয়াতে তোমার বাবা সেটা দেখতে পেয়ে দ্রুত এগিয়ে যান তুলতে।আমাদের খগেন তোমারই বয়সই মনে আছে নিশ্চয়ই সে তখন মাঠ থেকে
ফিরছিলো।হঠাৎ করে একটা বাস দ্রুত গতিতেই আসছিলো। চেষ্টা করেছিলো ব্রেক কষতে কিন্তু পারেনি।দুজনকেই জায়গায় পিষে দিয়ে চলে যায়।কিন্তু রবি এত তাড়াতাড়ি তুমি আসলে কি করে বাবা?
আমি তখন বাকরুদ্ধ।কি ভাবে কথা বলতে হয় সেটাই ভুলে গেছি।কিন্তু গতকাল রাতে...
কথা শেষ হওয়ার আগেই খুঁড়ো বললেন,
  ...ও গতকাল রাতে এসেছ? ঘটনাটা তো পরশু দিন ঘটেছে।সে যাই হোক।এসে তো পড়েছো।এবার কাজটা ভালো ভাবে করে নাও।
আর একমুহূর্ত সেখানে সময় নষ্ট না করে ছেলেবেলার মতো দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি ঢুকেই দেখি অঞ্জলি উঠে দাঁত ব্রাশ করছে।আমি তার দিকে একবার তাকিয়েই চলে গেলাম মা বাবার ঘরের কাছে।বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিলাম।দরজা ভেজানো ছিলো। উদভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকে মা,বাবা বলে চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম।অনেক পুরনো বাড়ি।কিছু কিছু জাগায়ট ইট বেরিয়ে গেছে। তখন আমার মনে হচ্ছে নিয়তি যেনো দাঁত বার করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।খাটের উপর মা ও বাবার আটপৌড়ে জামাকাপড় রয়েছে।স্নান করে এসে পড়বেন বলে হয়তো রেখে গেছিলেন।আমার চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ শুনে অঞ্জলি তড়িঘড়ি ঘরে ঢুকে বললো,"কি হলো  এতো চেচাচ্ছো কেনো?বাবা,মা কোথায়?আরে তুমি এত কাঁদছো কেনো?
আমি সব কিছু অঞ্জলি কে খুলে বললাম যা আমায় তিনি বলেছেন।অঞ্জলি শুনে পাথর!বার বার সে তার হাতের নোয়া টাকে নিয়ে নড়াচাড়া করতে লাগলো।
একটু পড়ে খুঁড়ো এলেন সব জিনিস পত্র নিয়ে।বড়পুকুরে যেয়ে স্নান করে ধড়া পড়ে বাড়ি ফিরলাম।খুঁড়ো যে ভাবে যা বললেন সেই ভাবে সব করলাম।
সুইডেনে ফেরার আগে গ্রামের স্কুল ট্রাষ্ট বোর্ডকে বাবার সমস্ত সম্পত্তি দান করে আসি।
    ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে।দাদু,ঠাকুমা ও হয়ে গেছি।কিন্তু অঞ্জলি আর আমি যখন ই একজাগায় নিরিবিলি বসি সেই রাতের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।যার উত্তর আজ ও আমরা খুঁজে পাইনি।যতদিন বাঁচবো এই খোঁজা আমাদের চলতেই থাকবে।
                       শেষ


 


 


   

   
   








Tuesday, July 3, 2018

একটি সাদা পাথর,
সুনিপুন দক্ষতায় রূপ পেয়েছে-
আমার আরাধ্য দেবতায়।
পাথরেও প্রাণসঞ্চার হয়।
সকল কথা উজাড় করে বলি।
অন্ধকারে আমার আলোর দিশা।
সব অন্যায়ের বিচার তার হাতে!
হাতে মারেননা, মারেন পেটে!
শুধু সময়ের অপেক্ষা!

#নন্দা