Sunday, July 6, 2025

ভালোবাসার বন্ধন (২ য় পর্ব)

 ভালোবাসার বন্ধন (২য় পর্ব)

নলিনী কলেজে ভর্তি হল। তাপসবাবু তার জমির কিছুটা বিক্রি করে নলিনীর জন্য এক গাড়ি কিনে বসলেন। গ্রামের লোকেরা মুখ টিপে হাসাহাসি, টোন-টিটকারি যে তার কানে আসেনি তা কিন্তু নয়। কারণ সেই যে ছেলে ঠাকুমার কাজ শেষে বেরিয়েছে তারপর আর আসেনি। কিন্তু মাসের শেষে ছেলের বরাদ্দ টাকা তাপসবাবু ঠিক পাঠিয়ে দেন। বাবার খবরাখবরও তপেশ রাখে ফোনের মাধ্যমেই। কিন্তু নলিনী সম্পর্কে কোন কথা বাবার কাছে  জিজ্ঞাসা করতে সে সাহস পায় না। 
 গ্রামে থেকেও যে লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হওয়া যায় সেটাই যেন তাপসবাবু নলিনীকে দিয়ে তার ছেলেকে দেখিয়ে দিতে চান। 
 নলিনী দু' একবার বাপেরবাড়িতে গেলেও সে দিনই ফিরে এসেছে তার বাবা একা থাকবেন বলে। তাপসবাবুও এখন যেন নলিনী ছাড়া অসহায়! পড়াশুনার মধ্যেই নলিনী জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি এমনকি সংসারের সবকিছুতেই সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছে। শুধু শ্বশুর,বৌমা নয় এখন তারা বাপমেয়ের থেকেও দু'জন দু'জনের কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছেন। দু'জনের মনের কষ্টের দিকটা পরস্পর গোপন রেখেই চলেন।
 কোন কাজেই নলিনীর কোন না নেই। সবকিছুতেই সে যেন সিদ্ধহস্ত। সে সংসার,পড়াশুনা, বিষয় সম্পত্তি এমন কী পাঁচ সাতটা কাজের লোক থাকার পরেও শ্বশুরের সেবাযত্ন সব কিছুই তার নজর এড়ায় না। বয়স জনিত কারণে অনেক সময় জমিজমা সংক্রান্ত কোন ঝামেলায় নলিনী তাপসবাবুকে আর জড়ায় না নিজেই সমস্যার সমাধান করে থাকে। সবকিছু সত্ত্বেও বৃদ্ধের কোথাও যেন একটা কষ্ট কাজ করে তা নলিনী তাঁর মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে। একমাত্র সন্তান ছেড়ে থাকার যে যন্ত্রণা তা  মাঝে মাঝে তাঁর মুখে ফুটে ওঠে। 
 কলেজে নিয়মিত যাতায়াত করতে না পারলেও বছর বছর পরীক্ষার রেজাল্ট তার মন্দ নয়। আসলে ছেলেবেলা থেকেই নলিনী ছিল খুব মেধাবী। কোন প্রাইভেট শিক্ষক কোনদিন তার পরিবার তার জন্য রাখতে পারেননি। সে যেটুকু পড়াশুনা করেছে নিজের চেষ্টায় আর মেধার গুনে। 
  খুব সুন্দরী সে না হলেও চেহারা তার মন্দ নয়। অভাবের মধ্যে মানুষ হওয়ার ফলে চেহারার লালিত্য সেভাবে ছিল না। ভালো থাকা,খাওয়া আর পরার দৌলতে এখন সে রীতিমত রূপসী। নিজের ব্যক্তিত্ব আর পুরুষের কুনজর থেকে নিজেকে রক্ষা করার সমস্ত গুন তার মধ্যে আছে। 
  সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জীবন ঠিক এগিয়ে যায়। আগে তপেশ মাঝে মধ্যে বাড়ি আসলেও বিয়ের পর থেকে মোটামুটি আসা বন্ধ করেছে বলাই ভালো।
   কেটে গেছে তিন তিনটে বছর। একদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে জানতে পারে তপেস এসেছে। নিজের অজান্তেই বুকের ভিতর একটা ধাক্কা খায়। কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরেই বাবার সাথে আগে দেখা করা তার নিত্য দিনের অভ্যাস। ঘরে ঢুকতে গিয়ে ঘরের বাইরে জুতো দেখে নলিনী বুঝতে পারে তপেশ এই ঘরেই আছে। সে ঘরে না ঢুকে বাইরে থেকেই তার শ্বশুরকে জানায় সে বাড়ি ফিরেছে। তপেশ বুঝতে পারে না নলিনী কোথায় গেছিলো কিন্তু তার মনের ভিতর প্রশ্নটা থেকেই যায়। 
  রান্নার মাসিকে দিয়ে তপেশের টিফিন জলখাবার সে বাবার ঘরেই পৌঁছে দেয়। তপেশ বাবার ঘরে টিফিন সেরে অনেকক্ষণ বসে থাকে। মামুলী দু'একটি কথা ছাড়া আর কোন কথা বাবার সাথে তার হয় না। নলিনী সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞাসা করার সাহস তার হয় না। আর তাপসবাবুও এ বিষয়ে কোন কথা তোলেন না। একসময় তপেশ উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। উঠে চলে যাওয়ার আগে বাবাকে বলে,
-- তোমাকে একটা খবর দিতে এসেছি। আমি একটা চাকরি পেয়েছি কলেজে লাইব্রেরিয়ান পদে। এখন থেকে তোমার আমাকে টাকা না পাঠালেও চলবে।
 তাপসবাবু কোন উত্তর করেন না তপেশ তার ঘরে চলে যায়। তাপসবাবুর বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনেমনে বলতে থাকেন " যার কোটি টাকার উপরে সম্পত্তি সে সামান্য কয়েক হাজার টাকার জন্য এমন লক্ষ্মী প্রতিমার মত মেয়েটিকে বুঝতেই চাইলো না।
ঘরে এসে তপেশ স্নান করে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে একটু বাইরে ঘোরার উদ্দেশ্য নিয়ে। রাস্তার মোড়ে এসে চায়ের দোকানে জটলা দেখে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
 অনেকদিন পর তপেশকে দেখে পরিচিতরা নানান কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকে। সে হাসি মুখেই সকলের কথার উত্তর দিতে থাকে। হঠাৎ তার ছেলেবেলার বন্ধু বলে বসলো,
-- বউকে নিয়ে যখন সংসার করবি না তখন বিয়ে করলি কেন?
 প্রথমটাই তপেশ কিছুটা ধাক্কা খায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বাবার টাকায় বউ নিয়ে সংসার করার মনোবৃত্তি হয়নি তাই। সকলের মানসিকতা তো সমান নয়। আর তোদের কে বললো? আমি সংসার করতে চাই না? আমাদের তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আমরা তো দিব্বি আছি।
 বন্ধুটি আর কোন কথা বলার সুযোগ পেলো না। কারণ তপেশের কথা শেষ হতে না হতেই একজন বয়স্ক ব্যক্তি বলে উঠলেন,
-- সবাইকে কি তোমার মত ভাবো? নিজে তো কিছুই করো না। বিয়ে করে বসে আছো। শুনছি তোমার বউ নাকি পোয়াতি। সবটাই তো বাপের ঘাড়ে। বয়স তো কম হল না। এবার নিজে কিছু চেষ্টা করো। বসে বসে খেলে রাজকোষও শূন্য হয়ে যায়। আর শোনো হে আমাদের তপেশের বউ রূপেগুনে মা সরস্বতী। একহাতে কেমন সবদিক সামলে শ্বশুরের সেবাযত্ন করে লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছে। 
 তপেশ এখানেই শোনে তার বউ কলকাতা শহরে পড়াশুনা করতে রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা জার্নি করে। তার বাবা একটা গাড়িও কিনে দিয়েছেন তার যাতায়াতের সুবিধার্থে। অবাক হয়ে শোনে সকলের মুখে নলিনীর প্রশংসা। ঘন্টা দু'য়েক সময় কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতেই পারলো না। কিন্তু মনের মধ্যে তার এখন অনেক প্রশ্ন। নলিনী কলকাতা কোন কলেজে পড়ে, কী পড়ে, কেমন করে এত পরিশ্রমের পরেও বাড়িতে এসে সংসারের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে নজর রাখে? জমিজমা ,হিসাবনিকাশ কিভাবে সামলায়? 
কিন্তু কে দেবে তার এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর? 
 বাড়িতে ফিরতে তার প্রায় দশটা বেজে যায়। গেট থেকেই সে লক্ষ্য করে ব্যালকনিতে অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি। তার একটুও বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা নলিনীই। বুকটার ভিতর হঠাৎ করেই তার কেঁপে ওঠে। কাছে বসিয়ে নলিনীর মুখ থেকে তার সমস্ত ঘটনাগুলি জানতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কোথায় যেন একটা বাধা এসে দাঁড়ায় তার সামনে। এক একবার ভাবে সে কী নিজের ভালো চাইতে নলিনীর সাথে ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছে? নলিনীকে মেনে নিয়ে তার জীবন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো? নিজেকে নিজেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কিন্তু সঠিকবেঠিক বুঝতে পারে না। 
 তপেশকে গেট খুলতে দেখেই নলিনী সেখান থেকে সরে আসে। রান্নাঘরে গিয়ে তপেশের খাবার রেডি করতে থাকে। তপেশ উপরে উঠে দেখে বাবার ঘর অন্ধকার। তারমানে বাবা খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। নলিনীর ঘরে উঁকি দেয়। কোথাও তাকে দেখতে পায় না। এবার নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে ঢোকে ডিনার করতে। গিয়ে দেখে রান্নার মাসি খাবার গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তপেশ কোন কথা না বলে  খেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর সে জানতে চায় মাসির কাছে,
- বাড়ির সকলের খাওয়া হয়ে গেছে?
-- হ্যাঁ সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। শুধু বৌদিমনি আর আমি বাকি 
-- এত রাত হয়ে গেছে তোমরা এখনো খাওনি কেন?
-- ওমা সে কী কথা! তুমি না ফিরতেই বৌদিমনি খেয়ে নেবে? বাড়ির একটা প্রাণীর খাওয়া না হলে বৌদিমনি খায় না। তাই আমিও বসে থাকি। দু'জনে একসাথেই রাতের খাবারটা খাই। আর যেদিন কলেজ থাকে না সেদিন দুপুরেও একসাথে খাই। কলেজ থাকলে তো তাকে আগেই খেতে হয়।
 তপেশ চুপ করে আরও কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলো। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে নলিনী মাসিকে বললো,
-- মাসি এত কথা কেন বলছো? অনেক রাত হল ওনাকে খেতে দাও।
 মাসি চুপ করে গেলো। নলিনী রান্নাঘরের দরজার আড়াল থেকে লক্ষ্য করলো তপেশের দু'টো  চোখ রান্নাঘরের দরজার দিকেই। সে নিজেকে আরও কিছুটা আড়াল করে নিলো।

ক্রমশ :

Monday, May 19, 2025

ভালোবাসার বন্ধন (১ম পর্ব)

ভালোবাসার বন্ধন (১ম পর্ব)
  মেয়ের বয়স সবে আঠারো পেরিয়েছে। গরীবের ঘরের সন্তান তাই মা,বাবা অনেক চেষ্টা করে গ্রামের এক অবস্থাপন্ন ঘরের কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে পাত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন। মেয়ে নলিনীর কান্নাকাটি, হাতেপায়ে ধরা কোন আপত্তিই ধোপে টেকেনি। সামান্য কয়েকজন বরযাত্রী নিয়ে বাইশ বছরের ছেলেটি মাথা নত করে বিয়ে করতে আসে। কারণ এই বিয়েতে তারও কোন মত নেই। সবে দ্বিতীয়বর্ষ তার। স্বপ্ন তার আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু অবস্থার পরিপেক্ষিতে তারও বিয়েতে রাজি হওয়া। 
  বিয়ের আসরে বর কনে দু'জনেই গম্ভীর। দু'জনেরই মুখ নীচের দিকে। শুভ দৃষ্টিতেও কেউ কারো মুখ দেখলো বলে মনে হল না। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলো। মেয়েও পরদিন শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো।
  ফুলশয্যার রাতে তপেশ ঘরে ঢুকে প্রথমেই টিউবলাইট বন্ধ করে দিয়ে বেড সুইচটা জ্বালিয়ে দিয়ে নলিনীর দিকে পিছন ফিরে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসে বলতে শুরু করলো,
-- শুভ দৃষ্টিতে আমি তোমার মুখ দেখিনি। সেই কারণে হয়ত তুমি ভাবতে পারো আমি অন্য মেয়ের প্রতি আসক্ত। কিন্তু তা নয়। আমি এ বিয়ে করতে চাইনি। আমার ঠাকুমা নাতবৌ দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার শরীর ভালো নয়। সেটা তুমি নিজেই দেখেছো। বাবার একান্ত অনুরোধে আমার এই বিয়ে করা। আমি এখানে থাকিও না সেটা তুমি নিশ্চয় শুনেছ। তুমি এখানে অনায়াসেই থাকতে পারো সেক্ষেত্রে আমি তোমায় কিছু বলবো না। কিন্তু স্বামী হিসাবে আমি নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত কোন দায়িত্ব যেমন পালন করতে পারবো না ঠিক তেমনই তোমার উপর কোন অধিকার প্রয়োগও করবো না। দু একদিনের মধ্যেই আমি চলে যাবো কলকাতায় যেখানে থাকি। তোমার বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে আমি সব জানি। আমার ঠাকুমা তোমায় যে গয়নার বাক্স দিয়েছেন তাতে বেশ কয়েক ভরি গয়না আছে। ইচ্ছা করলে ওই গয়না বিক্রি করে তুমি তোমার জীবনটাকেও নিজের মত করে গড়ে নিতে পারো। ইচ্ছে হলে এখানে থাকতে পারো আবার বাপের বাড়িতেও চলে যেতে পারো। 
 -- তাহলে বিয়েতে রাজি হলেন কেন?
-- ওই যে বললাম বাবার কথাতে। হ্যাঁ বলতেই পারো তোমার জীবনটা নষ্ট করলাম কেন? কিন্তু আমার মনেহয় তোমার জীবনটা এবার তুমি গুছিয়ে নিতে পারবে। পড়াশুনাটা আবার শুরু করো নিজের পায়ে দাঁড়াও। আমিও নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। বাপ, ঠাকুর্দার টাকায় সারাজীবন বসে খেতে আমি চাই না। ইচ্ছে হলে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারো নতুবা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দ মত কাউকে জীবন সঙ্গী করতেই পারো। ততদিনে এই পরিবারে অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবে। তোমাকে কেউ কোন বাধা দেবেন না। বাবা পুরো বিষয়টাই জানেন।
যাক গে আমার যা বলার ছিল বলা হয়ে গেছে। অনেক রাত হল এবার শুয়ে পড়ো। আজ না হলেও একদিন ঠিক বুঝবে আমি উভয়ের ভালোর জন্যই এ পথ বেছে নিয়েছি।
 নলিনী কোন কথা আর না বলে খাট থেকে নেমে এদিকওদিক কী যেন খুঁজতে থাকে। দেখতে পেয়ে তপেশ বললো,
-- তুমি খাটেই শোও। পাশেই আর একটি ঘর আছে আমি ওখানেই শুয়ে পড়বো। কোন অসুবিধা হবে না।
 নলিনী পুণরায় খাটে উঠে যায়। সেও যেন তপেশের সিদ্ধান্ত জেনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ পড়াশুনাটা ছাড়তে সেও কখনো চায়নি এমন কী বিয়েও বসতে চায়নি। কিন্তু বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় উচ্চমাধ্যমিক দিয়েই পড়াশুনায় ইতি টেনেছিল।
 পরদিন তপেশ বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার বাবা তন্ময়বাবু তাকে বললেন,
-- অষ্টমঙ্গলা সেরে গেলে হত না? 
-- তোমার সাথে কথা ছিল আমি বিয়ে করবো ঠাকুমাকে নাতবৌ দেখাতে। আমি সে কথা রেখেছি। বৌভাত মিটে গেছে। বাকি আর কোন আমার দায়িত্ব নেই। তবে নিরপরাধ অসহায় মেয়েটির কথা ভেবে একটা অনুরোধ তোমায় করবো। সংসার যাঁতাকলে মেয়েটিকে না বেঁধে রেখে ওকে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিও।
-- ওকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ওর দায়িত্ব আজ থেকে আমার। দেখো পরে যেন তোমাকে আফসোস করতে না হয়। 
 আড়াল থেকে নলিনী সব শুনলো। বলা ভালো শ্বশুরের কথা শুনে কিছুটা নিশ্চিতও হল। তপেশ বেরিয়ে গেলো।
 ছেলেবেলাতেই তপেশ তার মাকে হারিয়েছে। ঠাকুমার কাছেই সে মানুষ। মা ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র সন্তান। দাদু,ঠাকুমা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। আত্মীয়স্বজন বলতে সেরূপ কেউই নেই। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই ঠাকুমাও চলে গেলেন। মৃত্যুর সময় কিংবা মৃত্যুর পর তাকে খবর দেওয়া হলেও তপেশ আসেনি বরং বলা ভালো তার পরীক্ষা চলছিল তাই ইচ্ছা থাকলেও সে আসতে পারেনি। কিন্তু শ্রাদ্ধের দিন সে উপস্থিত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হল পুরো বাড়ির কোথাও সে নলিনীকে দেখতে পায় না। নলিনীকে দেখার জন্য সে যে খুব একটা ব্যাকুল হয়েছিল তা মোটেই নয় কিন্তু কোথাও যেন একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে কাজ করছিল। তার বাবা কিংবা বাড়ির কাজের লোকদের কাছে জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি। 
 তপেশের বাবা এমনিতেই একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ।
এবার বাড়িতে এসে তপেশ দেখে বাবা যেন শোকে, কষ্টে আরও গম্ভীর হয়ে গেছেন। সব কথার উত্তর মাথা নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করেন। শ্রাদ্ধের কাজের জন্য যারা বাড়িতে আজ এসেছেন তারা তাদের নিজেদের মনেই কাজ করছেন কেউ যে বাবার কাছে এসে কিছু জিজ্ঞাসা করছে তা মোটেই নয়। কিন্তু কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবেই চলছে। মনেহচ্ছে অলক্ষ্যে কেউ যেন কাজ করিয়ে নিচ্ছে। তপেশ নিজেকে এ বাড়িতে আজ অবাঞ্ছিত মনে করছে। কেউই সেভাবে তার সাথে কথাও বলছে না। বাবার কাজ শেষ হওয়ার পর ডাক পড়লো তপেশের। তখন তাপসবাবু ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। এতটাই ধীরপায়ে হেঁটে গেলেন খড়ম পরে সিমেন্টে বিন্দুমাত্র আওয়াজ হল না। অনাহুতের মত তপেশ তার ঠাকুমার কাজ সেরে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখে বাবা পুনরায় এসে দাঁড়িয়েছেন। পাশে দাঁড়ানো তার বিয়ে করা বউ নলিনী। মাথায় অনেকটাই ঘোমটা টানা মুখটা দেখা যাচ্ছে না। বাবা ইশারায় তপেশকে সরে যেতে বললেন। তপেশ সরে দাঁড়ালে নলিনী গিয়ে সেই আসনে বসে ঠাকুরমশাইয়ের কথামত কাজ করতে লাগলো। তপেশ সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। বুঝতে পারে এ বাড়িতে এখন নলিনীই সব। তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। 
 গ্রামে দরিদ্র শ্রেণীর বাস বেশি। তাপসবাবু পুরো গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন এবং বস্ত্র বিতরণ করেছেন নলিনীর হাত দিয়েই। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তপেশ শুধু এগুলো দেখেছে। সে ঘরেই ছিল খেতেও যায়নি। দুপুর গড়িয়ে গেলেও সে যখন খেতে নামেনি নিজের ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত সেই সময় একজন পরিচালিকা এসে তার ঘরে খাবার রেখে খেয়ে যেতে বলে বেরিয়ে যায়। সে না খেয়েই ব্যাগ নিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখে দরজার কাছে তার বাবা দাঁড়িয়ে। তিনি বলেন,
-- তুমি বংশের একমাত্র ছেলে। আমার মায়ের কাজে খালি মুখে বেরিয়ে গেলে মায়ের আত্মা শান্তি পাবে না। খেয়ে তবে যাও।
 কোন উত্তর না দিয়ে তপেশ ঘরে ঢুকে দুটি মুখে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে দেখে নলিনী বাবাকে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। বয়সের কারণে এখন অনেক ওষুধই তাপসবাবুকে খেতে হয়। সেই একইভাবে নলিনীর ঘোমটা টানা। মুখ দেখার উপায় নেই। বাবাকে প্রণাম করতে গেলে তিনি বলেন,
-- আমার আশীর্বাদ তোমার মাথার উপর সব সময় আছে। আজকে মায়ের কাজের দিনে আর পা ছুঁয়ে প্রণাম কোরো না।
 -- আমি আসছি।
 তপেশ বেরিয়ে যায়। কেউ আর কোন কথা বলে না।গেটের বাইরে গিয়ে সামনে ফিরে গেট লাগাতে গিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে ব্যালকনিতে নলিনী দাঁড়িয়ে। কিছুটা সময় সেও তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পরিষ্কার করে কেউ কিছুই দেখতে পায় না। 
  বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। আগেকার দিনে বিয়ের পরেই অপরিচিত দু'টি মানুষ একে অপরকে  ভালবাসতে শুরু করতো। এ বন্ধন কি এত সহজে এড়ানো যায়? কোথাও কি দু'জনের মনে ভালোবাসার কোন রেখা পড়েনি?

ক্রমশ - 
 

Monday, February 17, 2025

সন্দেহ বড় রোগ (৭ ম ও শেষ পর্ব)

  বিদিশার এই অস্থিরতার অবসান হয় একটি ফোন কলে। একটা টিস্যু পেপার নিয়ে এসিতে বসে থাকা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফোনটা ধরে ' হ্যালো ' বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে আওয়াজ শুনেই বুঝে যায় কে?
-- আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই 
-- কে বলছেন আপনি?
-- তুমি আমার গলা শুনে চিনতে পারছো না?
-- না চিনতে পারছি না
-- এই ক'টা বছরে গলাটাও ভুলে গেছো?
-- আপনি আপনার পরিচয় দিন আর কী দরকারে ফোন করেছেন সেটা বলুন। এটা আমার অফিস টাইম। ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না।
-- আমি জানি তুমি আমায় চিনতে পেরেছো। তবুও বলছি আমি সুনীল বলছি।
-- আপনার সাহস হয় কীকরে একজন অফিসারকে তুমি বলে কথা বলার? প্রয়োজনীয় কথা থাকলে বলতে পারেন তানাহলে আমি রাখছি।
অপর প্রান্তে সুনীল নিজেকে সামলে নেয়। বুঝতে পারে এত বছর পরেও বিদিশা তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। সুতরাং পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে কোন কিছুই আশা করা যাবে না তার কাছে। এবার সে গলার স্বরের পরিবর্তন এনে বলে,
-- আপনাদের অফিস থেকে আমি একটি লোন নিয়েছিলাম। আপনাদের দেয় সময়মত তা পরিশোধ করতে পারিনি। আগামী পরশু লাস্ট ডেট। বাড়ির দলিল বন্ধক দেওয়া অফিসে। যদি আমাকে আর ক'টা 
মাস সময় দেওয়া যেত তাহলে --
-- দেখুন এভাবে তো এসব কাজ হয় না তবুও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে দেখবো যদি কিছু করতে পারি। তবে আপনাকে একটা এপ্লিকেশন করতে হবে অফিসের জিএম এর কাছে। আগামীকাল এপ্লিকেশন করে নিয়ে অফিসে আসবেন।
 কথাগুলো বলেই বিদিশা ফোন কেটে দেয়। সেই মুহূর্ত থেকে সে নানান জায়গায় ফোন করে আপ্রাণ চেষ্টা করে যদি কিছুটা সময় লোন শোধ করার জন্য বাড়তি দেওয়া যায় সুনীলকে। 
 পরদিন সুনীল অফিসে আসে। বিদিশার রুমে ঢোকার জন্য তাকে আলাদা করে অ্যাপয়েনমেন্ট নিতে হয়। ত্রিশ মিনিট পর তার ডাক আসে। সুনীল গেটের বাইরের থেকে জানতে চায়
-- ভিতরে আসতে পারি ?
বিদিশা এই কয়েক ঘন্টায় নিজের মনকে অনেকটা শক্ত করে নিয়েছে।
-- হু আসুন। 
 সেই সুনীল যাকে ভালোবেসে সে ঘর ছেড়েছিল। সুনীল যেন যুবক হয়ে আরও সুন্দর দেখতে হয়েছে। বিদিশা সুনীলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য? 
সুনীল এপ্লিকেশনটি সামনে এগিয়ে দেয়।
-- ও আচ্ছা আচ্ছা কালকে আপনি ফোন করেছিলেন। 
 অ্যাপ্লিকেশনটি সুনীলের হাত থেকে নিয়ে ওটা পড়ে ইচ্ছাকৃত সুনীলের সামনেই সই আর সিলটা দিয়ে পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে বলে,
-- এবার আপনি আসুন। দেখি আপনার জন্য কী করতে পারি
আচমকা সুনীল ডেকে বসে
-- বিদিশা
-- সাট আপ! একজন অফিসারকে নাম ধরে ডাকার সাহস কোথা থেকে পান? বেরিয়ে যান এখান থেকে। চিৎকার করে ওঠে বিদিশা।
 সুনীল এতটা আশা করেনি। সে মুখ নিচু করে বিদিশার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে।
 সুনীল বেরিয়ে যাওয়ার পর পিওনকে ডেকে বলে,
-- মিনিট দশেক পরে পুণরায় লোক পাঠাবেন। 
 ওয়াশরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে কেটে চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে আসে সে। অনেক চেষ্টা করে একমাস সময় দিতে পারে সুনীলের বাড়ি বাঁচানোর।
 সুনীল কী কারণে লোন নিয়েছিলো? এখন সে কী করে? বিয়ে করেছে কিনা অনেককিছুই জানার ইচ্ছা থাকলেও নিজের ইছাগুলিকে বহু কষ্টে সে দমন করেছে। এরপর সুনীল যতবার অফিসে এসেছে কোনদিনও বিদিশার চেম্বারে ঢুকতে পারেনি কারণ অফিসে বলাই ছিল "ওই লোকটি যেন আমার চেম্বারে আর না ঢোকে।"

শেষ ২৬- ১২-২৪

সন্দেহ বড় রোগ ( ষষ্ঠ পর্ব)

 কেটে গেছে জীবন থেকে অনেকটা সময়। বিদিশা
সেদিন বাড়িতে এসে বাবার পায়ের উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। উভয়ের চোখে জল। বিপিনবাবু তাকে জোর করে পায়ের উপর থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বলতে থাকেন,
-- ভুলে যা মা সবকিছু। নতুন করে আবার পড়াশুনা শুরু কর। আমি জানতাম তুই ফিরে আসবি। ছেলেমেয়েরা তো ভুল করবেই। তাদের সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব তো মা বাবার। কিন্তু আমায় তো কোন সুযোগই তুই দিসনি। সাঁতার না জেনে জলে নামলে তো এরূপ হবেই। যাক গে - ওসব নিয়ে একদম ভাবিস না। আমি বাড়িতে বলে দেবো কেউ যেন তোকে এসব নিয়ে কোন কথা কখনোই কিছু না বলে।
    বাপ মেয়ের কথার মাঝখানে বোনেরা আর মা চলে আসেন। শেষ কথাটা সকলেরই কানে যায়। বিদিশা গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বিদিশার ধাতস্ত হতে দিন সাতেক সময় লাগে। বাবার সাথে কলেজে গিয়ে টিসি নিয়ে অন্য কলেজে ভর্তি হয়। 
  বিপিনবাবু বিদিশাকে না জানিয়ে সুনীলের বিরুদ্ধে থানায় মেয়ের নিরাপত্তার কারণে দেখিয়ে একটি ডাইরি করেন। সেই ডায়রির একটি জেরক্স নিয়ে সুনীলের কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করেন এবং প্রিন্সিপ্যালকে অনুরোধ করেন সুনীলকে ডেকে তাকে একটু ধমকে দিতে যাতে সে আর কোনদিন বিদিশাকে বিরক্ত না করে। তাহলে পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে এফ আই আর করতে বাধ্য হবেন। হাত জোড় করে বৃদ্ধর মেয়েকে বাঁচাতে এই করুন আকুতি প্রিন্সিপ্যাল ফেলতে পারেননি। তিনিও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেন।
   বিদিশা মাত্র ছ'মাসেই বুঝে গেছে জীবনে স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। তার জীবনে এখন একটাই লক্ষ্য একটা ভালো চাকরি পাওয়া। পড়াশুনার সাথে সাথে সে নানান জব এক্সাম দিতে শুরু করে। কলেজ,বাড়ি আর পড়াশুনা এটাই বিদিশার নিত্য রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। সবকিছু সত্ত্বেও আগের সেই উচ্ছলতা, বোনদের সাথে বসে আগের মত গল্পগুজব করতে সে আর পারে না। কোথায় যেন একটা কাঁটা খসখস করতে থাকে। সব সময় বিদিশা একটা অপরাধ বোধে ভোগে। 

চলবে -

সন্দেহ বড় রোগ (৫ ম পর্ব)

  বিদিশার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কোথায় যাবে কী করবে ভাবতে ভাবতে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। পাড়ার শম্ভুকাকু ওকে দেখে জানতে চাইলো,
-- মা আমি জানি তুই তোর বাবার কাছে এসেছিলি। কিন্তু তাঁরা তো এখান থেকে বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তুই কি সেখানে যেতে চাস?
-- তুমি জানো কাকু ওই বাড়ির ঠিকানা?
-- হ্যাঁ একমাত্র আমিই জানি। কারণ তোর বাবা আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তুই চলে যাওয়ার পর বুঝতেই পারছিস তাদের মনের অবস্থা। থানা পুলিশ করেননি। কেউ একজন তোদের দেখেছিল মন্দিরে একটি ছেলে তোকে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে। তোর বাবা তারপর খবর নিয়ে জেনেছিলেন ছেলেটি বেকার এমন কী তার পড়াশুনাও শেষ হয়নি। তিনি আমায় বলেছিলেন,
-- শম্ভু, মেয়েটা খুব ভুল করলো। ও ওখানে টিকতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। ফিরে ও আসবেই। থানা পুলিশ করে জোর করে ওকে ফিরিয়ে আনার থেকে নিজের ভুলটা ধরে ফিরে আসুক। তারপর না'হয় অন্যকিছু ভাবা যাবে কী বলো? আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ও এখানেই আসবে। আর এটাও জানি ও তোমার কাছেই আমাদের খবর জানতে যাবে। ওতো জানে তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা। তাই ঠিকানাটা তোমায় দিয়ে গেলাম। আমার বোকা মেয়েটা ফিরে আসলে ওকে ঠিকানাটা দিও।
 উনি বিদিশার কাছে কোন কথা জানতেও চাইলেন না। মানিব্যাগ বের করে ঠিকানাটা ওর দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখেন বিদিশা তখন হাউকাউ করে কাদঁছে। কিন্তু সে কান্নায় নেই কোন শব্দ। উনি বুঝতে পারলেন বিদিশার বুক বিদীর্ণ করে চোখের থেকে অবিরল ধারায় জল পড়ছে।
-- তোর কাছে কি কোন টাকাপয়সা আছে?
 বিদিশা মাথা নাড়িয়ে না বলে।
শম্ভুকাকু পুণরায় মানিব্যাগ খুলে কয়েকটি টাকা ওর হাতে দিয়ে বললেন,
-- এইটা রাখ। ভালো থাকিস মা। নিজের ভুল যখন বুঝতে পেরেছিস এবার জীবনটাকে নিজের মত করে গড়ে না। একটা কথা মনে রাখিস মা কোন মা কিংবা বাবা তার সন্তানের খারাপ চান না। তাঁরা অন্তত চেষ্টা করেন সন্তানের কিসে ভালো হবে সেটা বুঝতে। কিন্তু ভাগ্য বলেও একটা কথা আছে। তাকেও মানতেই হয়। এবার তুই এগো মা। রাত হয়ে যাচ্ছে।

চলবে -

সন্দেহ বড় রোগ (৪ র্থ পর্ব)

 স্বপ্ন দেখা আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার মধ্যে আকাশপাতাল প্রভেদ। জীবনের শুরুতেই হঠাৎ করেই কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যা জীবনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সিদ্ধান্ত কখনো মানুষের সঠিক হয় আবার কখনো বা সেই সিদ্ধান্তের ফলে জীবনের সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়।
 বিদিশার জীবনে চরম ভুল ছিল সুনীলের কথাই সায় দিয়ে একটা বেকার মধ্যবিত্ত ছেলেকে পালিয়ে এসে বিয়ে করা। অল্প বয়সের ভালোবাসায় দু'জনেই ছিল অন্ধ। একটা বালখিল্য সিদ্ধান্তে দু'জনের জীবনই যে তছনছ হয়ে যেতে পারে তারা তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
ভালোবাসা একটা মোহ ঠিকই অনেক সময় শারীরিক সম্পর্কে অনেকেরই সেই মোহ কেটে যায়। বিদিশার জীবনেও ঠিক তাই হল। বিদিশার কলেজ তো সুনীল বন্ধ করলোই উপরন্তু কারণে অকারণে তাকে খারাপ কথা বলতেও ছাড়ে না।
 বিদিশার কলেজ বন্ধ হল, বাইরে বেরোনো বন্ধ হল এমনকী রাস্তার পাশে বাড়ি হওয়ার ফলে বারান্দায় আসাও বন্ধ হল। খাঁচায় বন্দী পাখির মত সারাটা সময় দু'চোখের জলে দিনাতিপাত। আর রাত হলেই সুনীলের ঘনঘন শারীরিক খিদে মেটাতে নাজেহাল। বিদিশা খুঁজে পায় না সেখানে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা। অতিষ্ট হয়ে ছ'মাসের মধ্যেই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কোথায় যাবে সে? বাবা মায়ের মুখে তো চুনকালি দিয়ে এসেছে। ভাবতে থাকে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তাঁরা কি তাকে ফিরিয়ে দেবেন? একবার শেষ চেষ্টা করে সে দেখবে। যদি জীবনটাকে আবার গুছিয়ে নিতে পারে।
 বেরিয়ে পড়ে একদিন সন্ধ্যায় সুনীলের বাড়ি থেকে। অবশ্য বেরোবার আগে সে শ্বাশুড়িকে জানিয়েই আসে সে বাপের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। যে সুনীলকে সে ভালবেসেছিল আর যার সাথে এই ছ'মাস সে কাটালো দু'টো  সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। এভাবে বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। শাশুড়ি যেদিন বিদিশা এ বাড়িতে এসেছিল সেদিনও যেমন চুপ ছিলেন আজও তিনি চুপই থাকলেন। শুধু বললেন,
-- আমি আমার ছেলেকে খুব ভালোভাবে চিনি মা। তুমি যে এখানে থাকতে পারবে না এটা আমি জানতাম। ও একদম ওর বাপের ধারা পেয়েছে। ওর বাবাও ঠিক একইভাবে আমায় সন্দেহ করতো। আমার জীবনটাও ঝাড়াঝাড়া হয়ে গেছে ওর বাবার কারণে। তবুও তিনি একটা ভালো চাকরি করতেন। আর আমার যাওয়ারও কোন জায়গা ছিল না। তাই মুখ বুঝে সব সহ্য করেছি। তোমার যখন যাওয়ার জায়গা আছে তখন চলে যাও। বাবা মাকে সন্তান আঘাত দিলেও বাবা মা কখনোই সন্তানের খারাপ চান না। তারা তোমায় ঠিক আশ্রয় দেবেন। পড়াশুনাটা চালিয়ে যাও, নিজের পায়ে দাঁড়াও জীবনের এই অধ্যায়টা ভুলে যেও।
 বিদিশা এসে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। একজন মহিলা এসে দরজা খুলে বলেন,
-- কাকে চাই?
-- আমি বিদিশা। মা বাবা কেউ বাড়িতে নেই? 
-- তুমি কাকে চাইছো বলো তো?
-- বিপিন পাল। উনি বাড়িতে নেই?
-- এই নামে এখানে কেউ থাকে না। তবে শুনেছি উনি এখানে থাকতেন। মাসখানেক হল উনি এখান থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। উনার বড় মেয়ে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে যাওয়াতে পাড়ার লোকে কারণে অকারণে উনাকে কুকথা শোনাতে ছাড়েনি। তাই উনি পরিবার নিয়ে এখান থেকে চলে গেছেন।
 কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
-- আচ্ছা তুমি কি উনার সেই বড় মেয়ে?
 বিদিশা কোন উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে আসলো।

চলবে -

সন্দেহ বড় রোগ (৩ য় পর্ব)

 ক্লাসে সেদিন দু'জন ঢুকেছিল ঠিকই কিন্তু স্যারের পড়ানো কারো কানে ঢোকেনি। দু'জনেই ছিল ভাবের জগতে। এভাবেই কেটে গেছে দু'বছর। তখন দু'জনেরই সেকেন্ড ইয়ার। বিদিশার বাবা মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে শুরু করেন। বিদিশা বেঁকে বসে। বলে,
-- পড়াশুনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। তারপর বিয়ে বসবো।
 কিন্তু কে শোনে কার কথা। তিনবোনের মধ্যে বিদিশাই বড়। সুতরাং বিয়েতে মত দিতেই হবে। একদিকে সুনীলের ভালোবাসা,নিজের জীবনের স্বপ্ন অন্যদিকে বাবার জেদ। সুনীলকে সব জানায়। সুনীলও তখন পাগলের মত ভালবাসে তাকে।
-- তুমি বাড়ি থেকে চলে এসো। আমরা মন্দিরে বিয়ে করে নেবো। তারপর দু'জনে পড়াশুনা শেষ করে চাকরি খুঁজে নেবো। কোন অসুবিধা হবে না। আর কোন অসুবিধা হলেও দু'জনে ঠিক একটা উপায় বের করে নেবো।
 পালিয়ে যায় বিদিশা তার ভালোবাসার টানে। অল্প বয়সের কারণে তখন সে বুঝতে পারেনি টাকা না থাকলে গভীর ভালোবাসাও এক সময়ে অসহ্য হয়ে ওঠে। অভাব এমনই সে ভালোবাসা,খিদে,শারীরিক সম্পর্কের উপর এমনভাবে অক্টোপাসের মত জাকিয়ে বসে তাকে উপেক্ষা করা কিছুতেই যায় না।
 মন্দিরে বিয়ে করে সুনীল সোজা তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওঠে। একমাত্র ছেলে। বিধবা বয়স্কা মা। স্বামীর সামান্য পেনশনে সংসার চলে। ছেলের এই অবিবেচকের মত কাজকে সমর্থন করতে না পারলেও মন থেকে মানতে না পারলেও অন্ধের যষ্টিকে হারানোর ভয়ে বিদিশাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।

চলবে -

সন্দেহ বড় রোগ (২ য় পর্ব)

সন্দেহ বড় রোগ (২ য় পর্ব )

  নিজের অফিস রুমে ঢুকে দ্রুত হাতে ড্রয়ার খুলে নিজের কার্ডটি বের করে পিছনে ঘুরতেই দেখে রমেশ এসে দাঁড়িয়েছে। কার্ডটা রমেশের হাতে দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসেই ঢকঢক করে গ্লাসের পুরো জলটা শেষ করে দেয়। এসির পাওয়ারটাকে ১০ ডিগ্রীতে দিয়ে দেয়। অস্থির লাগছে বিদিশার তখন। মাঝে মাঝেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে, এদিকওদিক তাকিয়ে আবার বসে পড়ছে। কিছুতেই কাজে আর মন বসাতে পারছে না।
 বিদিশা নিজের শরীরটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে থাকে। ফিরে যায় পাঁচ বছর আগের দিনগুলিতে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে সুদর্শন যুবক ক্লাসমেট সুনীলকে মন দিয়ে ফেলে। অফ পিরিয়ডে ক্যাম্পাসের ভিতর সবাই মিলে বড় ছাতিম গাছটার নিচে বসে সব গল্প করছিল। সেখানে সুনীলও ছিল। হাসি, ঠাট্টা, হৈ হট্টগোলের মধ্যেও মাঝে মাঝেই সুনীলের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল তার। এটা সুনীলেরও নজর এড়ায় না। আড্ডা শেষে সবাই যখন উঠে ক্লাস রুমের দিকে এগোচ্ছে ঠিক তখনই সুনীল বিদিশার গা ঘেষে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-- একটু কথা আছে দাঁড়িয়ে যা
 বুকের ভিতর বিদ্যুৎ খেলে যায় বিদিশার। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। দু'জনে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। বিদিশা খুব আস্তে করে বলে,
-- আমার ক্লাস আছে। কী বলবে একটু তাড়াতাড়ি বলো।
-- এ ক্লাসটা আজ আর করা হবে না তোমার। কারণ কথা আমার একটা কিন্তু পরিকল্পনা বিশাল।
-- বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বলো।
-- আমি যদি খুব ভুল করে না থাকি আমার মনেহচ্ছে তুমি বোধহয় আমাকে --
 বিদিশা চোখ নামিয়ে নেয়
-- আরে চোখ তুলে মুখের দিকে তাকিয়ে বলো, বারবার আড়চোখে এভাবে মুখের দিকে তাকালে অন্যরা কী বলবে?
 সুনীল হাসতে থাকে। বিদিশা উঠে চলে যেতে রেডি হয় কারণ সে বুঝতে পারে সুনীলের কাছে সে ধরা পড়ে গেছে।
-- তুমি যে কথাটা আমায় বলতে পারছো না আমি সেটা বলে দিচ্ছি। আরে এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে? ভালোবাসার কথা বলতে এত লজ্জা পেলে আজীবন দু'জনকেই পস্তাতে হবে।
 হাসতে থাকে সুনীল।
ছাতিম গাছতলায় সুনীল এবার আরও কাছে এগিয়ে আসে বিদিশার। তার ডানহাতটা ধরে বলে,
-- আমিও অনেকদিন ধরে তোমায় কথাটা বলবো ভাবছি। কিন্তু কী জানো? ভয় পাচ্ছিলাম যদি তুমি রাজি না হও? কিন্তু আজ আমি নিশ্চিত হয়েছি তুমিও আমায় ভালোবাসো।
 বিদিশা ফিক করে হেসে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে যেতে বলে,
-- বাকি কথা কাল হবে। তুমিও চলে এসো ক্লাসে --

চলবে ,-

সন্দেহ বড় রোগ (১ ম পর্ব)

সন্দেহ বড় রোগ (১ম পর্ব)

  পাঁচ বছর পর অফিসের ভিতর একটা পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে কিছুটা চমকে যায় বিদিশা। ব্যাংকের রিজিওনাল ম্যানেজার পোষ্টে লোন ডিপার্টমেন্টের চাকুরীরতা বিদিশা পাবলিক লোনের ফাইলটা চেক করছিল। ঠিক তখনই বাইরের চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে নিজেই বেরিয়ে আসে। সিকিউরিটি তখন চিৎকার রত ভদ্রলোকের বাহু ধরে বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য টানাটানি করছেন। বিদিশা সেখানে পৌঁছেই জানতে চায়,
-- কী হয়েছে রমেশদা? এত চিৎকার কিসের জন্য?
 রমেশ উত্তর দেওয়ার আগেই রমেশের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত জোর করে ভদ্রলোকটি বলতে শুরু করে,
-- দেখুন না ম্যাম -- আ--মি ব -ল-ছি 
ভদ্রলোক চুপ করে যান। জোর হাত দু'টো নিচুতে নেমে আছে। এক দৃষ্টে বিদিশার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
  বিদিশা নিজেও থতমত খেয়ে যায়। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি এভাবে আবার তার সাথে সুনীলের দেখা হবে। তাও এমন পরিস্থিতিতে। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- হ্যাঁ বলুন আপনি কী বলতে চাইছেন?
সুনীল কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে। মাথাটা তার নিচুর দিকে। বিদিশা আগেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। এবার সে সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
-- দেখুন এটা একটা অফিস। আপনিও নিশ্চয়ই কোথাও  চাকরি করেন। সেই হিসাবে আপনি অবশ্যই জানেন অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যে আপনি এসে চিৎকার,চেঁচামেচি করলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারি। কোন বিষয়ে সমস্যা আপনার হতেই পারে। আমার সহকর্মীরা আপনার সেই সমস্যা সমাধানের নিশ্চয় উপায় বলেছেন। তার পরেও আপনার এই আচরণ তারা মানতে পারেননি বলেই আপনাকে বের করে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। আমি আশা করবো আপনি আপনার ব্যবহারে ভদ্রতা বজায় রাখবেন।
 সুনীল সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে,
-- যদি ফোন নম্বরটা?
 বিদিশা রমেশের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- রমেশদা তুমি আমার সাথে এসো। একটা কার্ড এনে উনাকে দিয়ে দাও।
 বিদিশা নিজের রুমের দিকে একটু দ্রুতপায়েই এগিয়ে যায়।

চলবে -
-- 

Friday, May 31, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১০ম পর্ব)

সুবর্ণা হুইল চেয়ার নিয়ে কিছুটা এগোনোর সাথে সাথে দেবেশ দ্রুত হেঁটে গিয়ে সুবর্ণার কাছ থেকে চেয়ারটা নিতে যায়। সুবর্ণা সঙ্গে সঙ্গেই হাতল দু'টি ছেড়ে দেয় কারণ বিদিশা পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে পড়েন।এই ঘটনা বিদিশার মনে একটু খটকা লাগে। কারণ আজ পর্যন্ত যত আয়া তার জন্য এবাড়ি এসেছে যতদূর তার মনে পড়ছে কারো সাথে দেবেশ কোনদিনও কথা বলেনি। কিন্তু আজ দেবেশ সুবর্ণার কাছে এসে যে বললো "আমাকে দাও" - কথাটা বিদিশার মনে কিছুটা হলেও কৌতূহলের সৃষ্টি করে। তবে এটাও তিনি ভাবেন কোনদিনও কোন মেয়ে রান্নাঘরে খাওয়ার সময় ছাড়া যেমন ঢোকেনি ঠিক তেমনই তাকে কেউ কোনদিনও জোর করে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে আসেনি। দেবেশের হয়ত এটা ভালো লেগেছে। তাই সে আজ সুবর্ণার কাছ থেকে হুইল চেয়ারটা নিয়ে নিজে তার ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘরে ঢুকে মাকে তুলতে গিয়ে একবারে সম্ভব না হলে সুবর্ণা এগিয়ে এসে বলে,
-- আমি পায়ের দিকটা ধরছি তু --
বলেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- আপনি মায়ের বগলের তলা দিয়ে ধরুন।
 দেবেশ সুবর্ণার কথামত মাকে সেইভাবে তুলে ধরে। সুবর্ণা পা দু'টো ধরে দেবেশের সাথে খাটে বসিয়ে দেয় বিদিশাকে। দেবেশ সুবর্ণার মুখের দিকে তাকালে বিদিশা সেটাও খেয়াল করেন। দেবেশ বেরিয়ে গেলে সুবর্ণা বিদিশাকে বলে,
-- মা, আমি একটু রান্নাঘরে গিয়ে পিসিকে সাহায্য করি?
-- হ্যাঁ যা। বাপ,ছেলে বেরিয়ে গেলে আমায় এসে স্নান করিয়ে দিস। এতদিন ধরে শুয়ে থেকে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটাই চলে গেছিলো। ওরা আমাকে বারবার বলতো হুইল চেয়ারে করে ঘরের ভিতরেই ঘুরতে। কিন্তু স্নান করতে গিয়েই কোমরে ব্যথা শুরু হয় তাই সাহসই পায়নি এতদিন।কিন্তু তুই এসে যেন আমার সাহস বারিয়ে দিয়েছিস মা। ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন। আজ মনটাও খুব ফুরফুরে লাগছে। যা তুই বিলাসীর কাছে। আমাকে পেপারটা দিয়ে যাস।
 "হ্যাঁ" বলে সুবর্ণা রান্নাঘরে যেতে গিয়ে পথের মাঝখানে দেবেশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে না দেখার ভান করে এগিয়ে যেতে গেলে দেবেশ তাকে বলে,
-- থ্যাংকস।মা আজ অনেকদিন পর নিজের ঘর থেকে বেরোলেন। বাবা,আমি দু'জনেই খুব খুশি। বাবা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
 সুবর্ণা দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এসব কথা আমার না শুনলেও চলবে। আমার কাজ আছে। 
 সুবর্ণা চলে গেলে দেবেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মনেমনে বললো ,'একসময় আমি এটাই চেয়েছিলাম। তোমায় নিজের করে বাড়িতে নিয়ে আসবো আর এভাবেই তুমি সকলের মন জয় করবে। সবকিছু যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেলো।"
   এইভাবে পাঁচ পাঁচটা দিন কেটে গেলো সুবর্ণার এ বাড়িতে। রবিবার তার বাড়িতে যাওয়ার কথা। রাতেই স্বরূপ তাকে এই সাতদিনের জন্য একটা মোটা অংকের টাকা খামে করে হাতে দিয়ে দিয়ে বললেন,
-- প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার সময় তুমি এই টাকাটা পাবে। আমি প্রতি সপ্তাহেই তোমায় তোমার টাকা দিয়ে দেবো। আজ পর্যন্ত যত মেয়ে এসেছে তোমার মাকে দেখাশুনার জন্য তাদের সাথে তোমার কোন তুলনায় হয় না। মাত্র কটাদিনেই তুমি তোমার মায়ের মনের বল অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছো। ডাক্তারী শাস্ত্র অনুযায়ী এই রোগের সবচেয়ে ভালো ওষুধ হচ্ছে মনের বল যা তোমার মা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কোথাও তেমন কোন সমস্যা ওর শরীরে নেই। আমি নিজে একজন ডাক্তার হয়ে বলছি তুমিই পারবে আমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে। 
-- আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
 কথা শেষ করে সুবর্ণা আবার বিদিশার ঘরে ফিরে আসে। 
-- কিরে খামটা খুলে দেখেছিস?
-- না, বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে দেবো মা তখন দেখবেন
-- দূর বোকা মেয়ে! দেখে আমায় বলতো কত আছে ওর ভিতর? তোর চলবে কিনা ওই টাকাই?
-- তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। যা আছে থাক।
-- আসলে কী জানিস মা ? তোর চালচলন, ব্যবহার আমাকে পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছে তুই ভালোঘরের লেখাপড়া জানা একটি মেয়ে। নিজের সংসারকে বাঁচাতে চাকরি না পেয়ে তুই এই কাজে এসেছিস। এটা সত্যি তুই চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু তবুও তোকে বলছি কাগজপত্রগুলো নিয়ে আছিস দেখি বাপ,ছেলেকে বলে তোর ভালো কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি কিনা। 
-- আমার তো একাজ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তোমার যদি আমাকে পছন্দ নাহয় তাহলে অন্য কথা।
-- ও তুই বুঝে গেছিস তোকে আমি কতটা ভালোবেসে ফেলেছি। তাই আমার সাথে ইয়ার্কি হচ্ছে?
সুবর্ণা হাসতে হাসতে বলে,
-- চলো, অনেক রাত হল এবার খেতে যাই
-- আজও আমায় টেবিলে খেতে যেতে হবে?
-- তাতো যেতেই হবে। কারণ তুমি পারো। আজ আমি একাই তোমায় চেয়ারে বসাবো
-- আরে না, তুই ওদের কাউকে ডাক
 ওদের কথার মাঝখানে বিলাসী খাবার নিয়ে আসে। দেখতে পেয়ে সুবর্ণা বলে,
-- পিসি, মা টেবিলেই খাবেন সকলের সাথে কথা বলতে বলতে। তুমি খাবারটা টেবিলে রেখে এসে আমায় একটু হেল্প করো মাকে চেয়ারে বসাতে।
 বিলাসী খাবার নিয়ে চলে যেতেই সেখানে এসে হাজির হল দেবেশ।
 সুবর্ণা আর দেবেশ দু'জনে মিলে বিদিশাকে চেয়ারে বসিয়ে দেবেশ নিজেই চেয়ার নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার দু'জনের চোখাচোখি হয়। কিন্তু কেউই কোন কথা বলে না। দু'জনের বুকেই কাঁপুনি কিন্তু কারো কাছেই কারো প্রকাশ তার নেই। 
আজ যেন বিদিশা আরও বেশি সতর্ক এই দু'টি তরুণ,তরুণীর আচারাচরণের দিকে। সুবর্ণা আসার পর থেকেই দেবেশকে যেন মায়ের ঘরে একটু বেশিবার এবং একটু বেশি সময় বিদিশা পাচ্ছেন। তাই তিনি সব সময় নিজের চোখ, কানকে বেশি সতর্ক রেখেছেন। কিন্তু এরা পরস্পরের সম্পর্কে নিজেরা যেন নিজেদের মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। সুবর্ণাকে বিদিশার বেশ ভালো লেগেছে। আর ছেলের সুবর্ণার সামনে বেশি আনাগোনার ফলে বিদিশার মনেও একটা আশার আলো জ্বলতে শুরু করেছে। এবার হয়ত তার দেবু বিয়ের ব্যাপারে নিজের মত পাল্টাবে। 
খাবার টেবিলে সুবর্ণা খাবার সার্ভ করছিল। স্বরূপ এবং বিদিশার পাতে বেগুন ভাজা দিলেও দেবেশের থালায় সেটা ছিল না। কারণ দেবেশের বেগুন ভাজায় এলার্জি আছে। বিদিশা সেটাও খেয়াল করেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই এই কয়দিনে সুবর্ণার সেটা জানার কথা নয়  কারণ সে আসার পর আজই প্রথম বেগুন ভাজা হয়েছে। এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি বিদিশাকে ভাবাচ্ছে এরা দু'জন আগে থাকতেই দু'জনকে চেনে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সিওর হচ্ছেন ততক্ষন পর্যন্ত কিছু বলতেও পারছেন না। তবে এই ঘটনাগুলো তিনি খুবই উপভোগ করছেন।
 রুটি,তরকারি খেতে গিয়ে দেবেশের ভিসুম লাগে। সুবর্ণা তড়িঘড়ি জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় তার দিকে। জল খেয়ে ধাতস্ত হয়ে দেবেশ সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে, "থ্যাংকস"। সেটাও বিদিশার নজর এড়ায় না। তিনি সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-- তুইও বসে পড় আমাদের সাথে।
 বিদিশার কথা শুনে বাপ,ছেলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকান। কারণ আজ পর্যন্ত যারা তার দেখভালের জন্য এ বাড়িতে এসেছে তাদের কেউই কোনদিনও টেবিলে তাদের সাথে বসে খাওয়ার অনুমতি পায়নি। এমনকি বিলাসীর জন্যও রান্নাঘরে টেবিল বরাদ্দ। বিদিশার কথা শুনে সুবর্ণা বলে,
-- তোমরা খেয়ে নাও আমি পিসির সাথে রান্নাঘরে বসে খাবো।
-- কেন আমাদের সাথে খেতে তোর আপত্তি কোথায়?
 আপত্তিটা যে কোনখানে তা সুবর্ণা কী করে বলবে বিদিশাকে? এরই মধ্যে কতবার যে দেবেশ তার দিকে তাকিয়েছে আর তার এই তাকানোর ফলে সুবর্ণার বুকের ভিতর যে বিদ্যুত খেলে গেছে তার আচ সে ছাড়া আর কেউই জানে না।
 খাওয়া শেষে দেবেশ মাকে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু কোন এক ফাঁকে সে সুবর্ণার হাতের মধ্যে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দেয়।

ক্রমশ

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (২০তম পর্ব)

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ২০ তম পর্ব)

  সকাল দশটা নাগাদ রজতের ঘুম ভাঙে। সে ঘুমাতে লাগলে এর আগে তার মা,বাবা বহুবার এঘরে এসেছেন। ছেলে অঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখে কোন সাড়াশব্দ নেই তাতেও মা,বাবার আতঙ্ক কমে না। চশমার ডাটি ধরে বুকের কাছে ঝুঁকে পড়ে দেখেন ঠিকমত নিশ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা। মা, বাবার সব সময়ই তার সন্তানকে নিয়ে এক দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।
সেই জন্মের থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
  রজত ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। সে ভাবতে চেষ্টা করে গত দু'দিন তার সাথে কী কী ঘটেছে আর সে যদি একটু সাহসী না হত তাহলে কী ঘটতে পারতো। ট্রেনে করে নিত্য যাতায়াতের সূত্র ধরে অনেক মুখের সাথেই একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। মুখোমুখি হয়ে গেলে জাস্ট একটু হেসে পড়া। কিন্তু সেদিন কী যে হল। ওই মেয়েটাকে তো সে বহুবার দেখেছে, মামুলি কথাও কখনো সখনো হয়েছে। কিন্তু তার ভিতর কী এমন হল যে গত পরশু মেয়েটির কথামত তার পিছন পিছন গাড়ি থেকে এক অচেনা স্টেশনে নেমে পুণরায় অন্য একটা ট্রেনে উঠে পড়লো। মেয়েটি এক সময় তাকে বলেছিল,
-- আমার ফোনটাই চার্জ নেই যদি আপনি ফোনটা দিতেন আমি একটা কল করতাম।
 পকেট থেকে ফোন বের করে রজত মেয়েটির হাতে দেয়। খুব ঘুম পাচ্ছিল রজতের। যখন ওর ঘুম ভাঙে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে। মশা ছেঁকে ধরেছে। উঠার ক্ষমতা নেই। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। একসময় ঘরের ভিতরে কিছু লোকজন ঢোকে তাদের সকলের মুখেই কাপড় বাঁধা। শুধু চোখদু'টি তাদের দেখা যাচ্ছে। সামনে তিনটে রুটি আর আলুর তরকারি দিয়ে কেউ একজন তাকে বলেছিল,
-- খাবারটা খেয়ে নিন। আর একদম পালানোর চেষ্টা করবেন না। আমাদের লোকজন বাইরে সবসময় পাহারায় আছে।
 কাউকেই সে চিনতে পারছিল না কিন্তু প্রচণ্ড খিদে পাওয়াতে সে রুটি আর তরকারি পুরোটা খেয়ে নেয়। তারপর আবার কোন সময় যেন ঘুমিয়ে পড়ে।
 তার চিন্তায় ছেদ পড়ে মা যখন এসে তার ঘরে ঢোকেন।
-- ঘুম ভাঙলো তোর রাজু? 
-- হ্যাঁ মা কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। তাতো পাবেই রে। তুই দাঁত ব্রাশ করে নে আমি তোর জন্য চা করে নিয়ে আসি।
 রজতের গলার আওয়াজ পেয়ে রজতের বাবা এই ঘরের দিকেই আসছিলেন। রজতের মা বেরিয়ে যেতে গেলে রজত মাকে ডেকে বলে,
-- মা সুলতা আসেনি কাল?
 রজতের মা কথাটা শুনতে পান না। তিনি বেরিয়ে যান ঘর থেকে। কিন্তু উত্তরটা দেন রজতের বাবা,
-- আসেনি মানে? মেয়েটা নাওয়া-খাওয়া ভুলে এ দু'টোদিন পাগলের মত ছুটাছুটি করেছে। একদিকে অফিস আর অন্যদিকে তোর জন্য দৌড়াদৌড়ি। গতকাল অফিস করে থানা হয়ে যখন বাড়িতে ফিরেছে তখন রাস্তায় তোর ফেরার খবর শুনেই মাকে নিয়ে অত রাতে ছুটে এসেছে। অনেক রাতে এখান থেকে ফিরেছে। তোর মা তো বললেন তোকে নাকি ঘুমের মধ্যে দুধ,রুটি মাখা খাইয়েও দিয়েছে। সকালে তো সময় পায় না ও ঠিক আফিস থেকে ফিরেই চলে আসবে। কিন্তু তুই আমাকে এখন বল তো কী করে কী হল?
-- বলবো বাবা সব বলবো। আগে আমি নিজে একটু ধাতস্ত হয়ে নিই। প্রচণ্ড খিদে পেটে। স্নানটা করে আসি। খেয়েদেয়ে তারপর সব বলছি তোমাদের। 
রজতের বাবা আর জোর করলেন না। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে তার কথার সমর্থন জানালেন।
 রজত পেষ্ট ব্রাশ নিয়ে ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুনরায় ভাবতে থাকে ওই মেয়েটার নামও সে জানে না। মুখ চেনা একই বগিতে সেদিন পাশাপাশি সিটে বসা। সে পকেট থেকে ফোনটা বের করে মেয়েটাকে দেয়। মেয়েটা কথা বলে তাকে ফোনটা ফেরত দেয়। পকেটেও রাখে সে। কিন্তু তারপর কী যে হল প্রচণ্ড ঘুম পেতে লাগলো। পকেটে সেদিন মাইনের সব টাকা। একবার হাত দিয়ে প্যান্টের ভিতরের পকেটে একটু চাপ দিয়ে দেখে নিলো। তারপর যা কিছু ঘটেছে তার আবছা আবছা মনে আছে। মেয়েটা তাকে হাত ধরে ট্রেন থেকে নামালো। তারপর ওভার ব্রিজ করে অন্য একটা ট্রেনে উঠলো। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ট্রেনে বসে পড়েই পূনরায় ঘুমিয়ে পড়ে সে। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখে একটা অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে সে। এর আগে ওই মেয়েটা তাকে বোতলে জলও খেতে দেয়। জলটাই কোন টেস্ট ছিল না। কেমন যেন লাগছিল খেতে। কিন্তু ওই মেয়েটি তাকে জোর করে বোতলের পুরো জলটা খাওয়ায়।

ক্রমশ 
 

Thursday, May 2, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৯তম)

 ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৯ তম পর্ব)

  সেদিন বাড়ি ফিরতে সুলতা আর তার মায়ের অনেকটাই দেরি হয়ে গেলো। পরদিন অফিস যেতেই হবে। অফিস থেকে ফিরে আবার রজতকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে যে রজতের সাথে দেখা করে যাবে সেটাও সম্ভব নয়। হয়ত সে অত সকালে উঠবেই না। অফিস তো তাকে যেতেই হবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন সুলতার চোখদু'টো ঘুমে জড়িয়ে এলো। ঘুম ভাঙলো সকালে মায়ের ডাকে। মা যে ইচ্ছাকৃতই একটু দেরি করে তাকে ঘুম থেকে ডেকেছেন যাতে তার ঘুমটা পুষিয়ে যায় এটা সুলতা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে বেরিয়ে পড়ে। ৮-২০ লোকালটা না পেলে অফিসে দেরি হয়ে যায়। তাই যেভাবেই হোক সময় মত স্টেশনে পৌঁছাতেই হবে।
  অনেকদিন পর আজ হঠাৎ করেই তার সুবর্ণার সাথে দেখা হয়ে যায়। সুলতা তার সাময়িক সমস্যার কথা মন খুলে সুবর্ণাকে বললেও সুবর্ণা কিন্তু তার সম্পর্কে কোন কথাই জানায় না। চুপচাপ সুলতার কথা শুনে যায়। পাশের সহযাত্রীর চার,পাঁচ বছরের বাচ্চার দুষ্টুমির দিকেই তার নজর বেশি। সুবর্ণা নিজের সমস্যায় এতই জর্জরিত অন্য কারো সমস্যা শুনলে কিংবা দেখলেও কিছুটা আনমনা হয়েই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কারণ তার মাথায় কোনকিছুই ঢুকছে না। একদিকে দেবেশের ভালোবাসার পাগলামি অন্যদিকে তার নিজের পরিবারের দু'মুঠো অন্নের সংস্থান তাকে উদ্ভ্রান্ত করে দিচ্ছে। দেবেশকে কিছুতেই সে পাশ কাটাতে পারছে না। অথচ ওই কাজটা ছেড়েও চলে আসতে পারছে না। ইচ্ছাকৃত যে তাকে মাইনেটা বেশি দেওয়া হচ্ছে তা সে বেশ ভালই বুঝতে পারছে। আজ সে তার সমস্ত সার্টিফিকেটগুলো নিয়েই যাচ্ছে কারণ দেবেশ তাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে। বিদিশা অনেকটাই মনের জোর পেয়েছেন সুবর্ণার কারণেই। যদি কোন চাকরির জোগাড় দেবেশ করতেও পারে তখন ওখান থেকে চলে আসলেও তার অসুবিধা হবে। এইসব হিজিবিজি চিন্তায় মনটা সব সময়ই অন্যমনস্ক থাকে। তাই সুলতার সবকথা তার কান অবধি পৌঁছায়ও না।
 আসলে নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় সন্তান হয়ে জন্মানোটাই অনেক সময় কারো কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে যায়। একমাত্র স্বার্থপর হলেই তারা জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারে। আর যারা সেটা পারে না তাদের সারাজীবন বাপেরবাড়ির জোয়াল টানতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। সুলতা আর সুবর্ণার পারিবারিক সমস্যা এক। দু'জনেই নানান জটিলতার মধ্য দিয়ে একইভাবে এগিয়ে চলেছে। 
 শিয়ালদহ এসে যে যার গন্তব্যে এগিয়ে যায়। দু'জনকেই বাস রাস্তায় এসে বাস ধরতে হয় কিন্তু নম্বর আলাদা।
 সুলতা অফিসে পৌঁছে ম্যানেজারের ঘরে ঢোকে সই করতে। সেখানে গিয়ে দেখে পুরনো এক বয়স্ক কর্মচারী বসে আছেন। সুলতা তাকে আগে থাকতেই চিনতো। সুলতাকে দেখে তিনি জানতে চাইলেন,
-- কেমন আছো মা? চিনতে পারছো তো আমাকে?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ মেসোমশাই চিনতে পারছি। ওই চলে যাচ্ছে আর কী? তা কী মনে করে এতদিন পরে?
-- মা,আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ম্যানেজারের সঙ্গে চাকরি জীবনের আগে থেকেই পরিচিতি। তাই আসলাম উনাকে গরীবের বাড়িতে পদধূলি দেওয়ার নিমন্ত্রণ জানাতে। তা তোমার সাথে যখন দেখা হয়ে গেলো মা তুমিও যেও। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা কার্ড দিই।
-- না না মেসোমশাই। কার্ড দিতে হবে না। আমি যদি যেতে পারি ম্যানেজারবাবুর সাথেই যাবো। আসলে কি জানেন? নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
 কথাটা কানে যেতেই ম্যানেজারবাবু বললেন,
-- ভুলে যাই বয়সের ভারে সব। তা কোন খবর পেলে তোমার সেই পরিচিতের?
-- হ্যাঁ গতকাল নিজেই বাড়ি ফিরেছেন। তবে কথা বলার মত অবস্থায় নেই। থরথর করে কাঁপছে। মনেহচ্ছে এ দু'টোদিন ঘুম খাওয়া কোনটাই হয়নি। অনেক রাত পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। কিন্তু কোন কথা এখনো জানতে পারিনি। তবে মনেহচ্ছে এমন কিছু ওর সাথে ঘটেছে যার জেরে ও খুব ভয়ে আছে। বাড়িতে পৌঁছে ভাবছি নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাবো।
-- সেই ভালো হবে। 
 দু'জনকে বলে সুলতা ম্যানেজারের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সারাদিন অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি করতে করতে এক মুহূর্তের জন্যও সে রজতের কথা মাথা থেকে নামাতে পারেনি। কারা এবং কেন ওকে কিডন্যাপ করেছিলো এটা কিছুতেই মাথায় আসছে না তার। মুক্তিপণের জন্য কোন ফোন আসেনি। তারমানে তারা এটাও জানতো টাকা চাইলে দেওয়ার মত ক্ষমতা তাদের নেই। যেহেতু পে-ডেট ছিল তাই মাইনের টাকা এবং মোবাইল নিয়ে তো ওকে ছেড়ে দিতেই পারত। তা না করে ওকে তুলে নিয়ে গেলো কেন? কী এমন রহস্য এর ভিতর লুকিয়ে আছে?

ক্রমশ
    

Sunday, April 28, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৮তম পর্ব)

সুলতা পাড়ার জেঠিমার কথা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যায়। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে জানতে চায়,
-- কোথায় ছিল এই দু'টোদিন?
-- সে সব তো কিছু বলতেই পারছে না। খুব দূর্বল। রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে বাড়িতে গেছে। আমরা অনেকেই ওর পিছন পিছন যেতে যেতে জানতে চেয়েছি। কিন্তু ও কারো কথার উত্তর করেনি। 
-- জেঠি, তাহলে আমি এখুনি যাই। পরে তোমার সাথে কথা বলবো। 
 রজতের বাড়ির দিকে রওনা হয়েও সে আগে বাড়ি গিয়ে ঢোকে। কারণ রাত অনেক। বাবা,মা দু'জনেই চিন্তা করছেন তার ফিরতে দেরি দেখে। বাড়িতে ঢুকে সব জানিয়ে মাকে সাথে নিয়ে সে রজতের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে  দু'দিন পরে তার মনেহচ্ছে যেন তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস সেই আগের মত চলছে। এই দু'দিন যেন সে দম বন্ধ করেই ছিল। খুব দ্রুত হেঁটে তারা রজতদের বাড়ি পৌঁছালো। দরজা খোলা ছিল কারণ কিছু পাড়াপ্রতিবেশী রজতদের বাড়িতে তখনো ছিলেন। সকলেই সামনে ঘরে বসে। সুলতা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই রজতের বাবার কাছে জানতে চাইলো,
-- কখন ফিরেছে ও?
-- তোমার সাথে ফোনে আমি কথা বলার কিছুক্ষণ পর।
-- কোথায় ছিল এ দু'দিন?
-- সেতো কথা বলার মত অবস্থায় নেই। প্রচণ্ড দুর্বল। তার মা তাকে একগ্লাস গরম দুধ খাইয়ে সাথে নিয়ে গিয়ে তার ঘরে শুইয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড ভাবে কাঁপছে। মনেহয় খুব ভয় পেয়েছে। তুমি যাও ওর ঘরে। ওর মা ওর কাছেই আছে।
 সুলতা মায়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
-- তুমি যাবে মা?
-- না,তুই যা আমি এখানেই বসি।
 সুলতা প্রায় দৌড়ে গিয়ে রজতের ঘরে ঢোকে। গিয়ে দেখে সে পাশ ফিরে শুয়ে আর তার মা রজতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ইশারা করে জানতে চায় রজত ঘুমাচ্ছে কিনা? রজতের মা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলেন। সুলতা চুপচাপ এসে খাটের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকে। রজতের মা উঠে দাঁড়িয়ে ইশারাতেই সুলতাকে ওর পাশে বসতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। রজতের মা বেরিয়ে গেলে সুলতা এসে রজতের মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু রজত গভীর ঘুমে তখন আচ্ছন্ন। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ওর মনেহয় ভাস্কর সেনকে একবার ফোন করে বিষয়টা জানানো দরকার। সুলতা রজতের ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে ভাস্কর সেনকে ফোন করে ,
-- স্যার আমি সুলতা সেন বলছি। রজত বাড়িতে ফিরে এসেছে 
 ভাস্কর সেন কথাটা শুনেই একনাগাড়ে বলে যেতে লাগলেন,
-- কখন ফিরলেন? তিনি কী নিজেই কোথাও গেছিলেন নাকি কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছিলো? তিনি কি কাউকে চিনতে পেরেছেন? কী কারণে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল জানতে পারলেন? তিনি কি --
 ভাস্কর সেনের কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে সুলতা বললো,
-- সে খুব দূর্বল। কথা বলার মত অবস্থায় নেই। এখন ঘুমাচ্ছে। আমরা কেউ কিছুই এখনো জানতে পারিনি। আমি জানতে পারলে কাল আপনাকে ফোন করে সব জানাবো।
-- তাহলে কাল সন্ধ্যায় দিকে আমি একবার আসি? বিষয়টা খুব একটা স্বচ্ছ বলে মনে হচ্ছে না -
-- হ্যাঁ সে আপনি আসতেই পারেন। কিন্তু আসবার আগে একটা ফোন করে আসবেন। ওকে নিয়ে কাল অফিস থেকে ফিরে একবার ডাক্তার দেখাতে যাবো।
-- ওকে, আমি তোমায় ফোন করেই যাবো।
 সুলতা ফোন কেটে দিয়ে রজতের মায়ের কাছে যায়। তিনি তখন দুধ গরম করছেন। সুলতা রান্নাঘরে ঢুকে জানতে চাইলো,
-- তোমাদের খাওয়া হয়নি এখনো?
-- আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু রজত তো একগ্লাস দুধ খেয়েছে। ও যা অঘোরে ঘুমাচ্ছে তাতে ওকে ডেকে তুলে বসিয়ে খাওয়ানো যাবে না। তাই ভাবছি গরম দুধে রুটি দিয়ে চটকে খাইয়ে দেবো। তুই আর একটু বোস। খাবারটা তৈরি করে দিচ্ছি তুই একটু খাইয়ে দে ওকে। আমিও আসছি কিন্তু তুই থাকলে আমার একটু সুবিধা হবে।
 রজতের মা খাবার রেডি করে সুলতার হাতে দিয়ে বলেন,
-- তুই নিয়ে যা। আমি আসছি।
 সুলতা খাবার নিয়ে রজতের ঘরে ঢুকে দেখে সে তখনো অসারে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। সে মাথার চুলে হাত বুলাতে লাগে। কিন্তু রজতের ঘুম ভাঙে না। বেশ কয়েকবার তাকে গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকে কোন সারা পায় না। বুকটার ভিতর ধরাস করে ওঠে তার। সে নাকের কাছে হাত রেখে নিশ্বাসপ্রশ্বাস চালু আছে কিনা দেখে একটু স্বস্তি পায়। ইতিমধ্যে রজতের মা এসে ঘরে ঢোকেন। 
-- ডেকে সারা পাসনি?
-- না, অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
-- দাঁড়া এভাবে হবে না। আমার হাতে বাটিটা দে। তুই ওকে গলার পিছনের দিকে হাত দিয়ে মাথাটা একটু তোল।
-- এভাবে কী করে খাওয়াবে?
-- ও ঘুমের মধ্যে মুখের কাছে ধরলে ঠিক খেয়ে নেবে। ওকে অনেক বড়বেলা পর্যন্ত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে এভাবেই খাওয়াতাম।

ক্রমশ
 
    

Friday, April 26, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৭ তম পর্ব)

বাস থেকে নেমেই হাঁফাতে হাঁফাতে এসে থানায় ঢোকে সুলতা। একজন পুলিশ অফিসার তাকে দেখে জানতে চায়,
-- আপনি সুলতা সেন তো?
-- হ্যাঁ 
-- স্যার একটা বিশেষ দরকারে বেড়িয়েছেন, আপনাকে বসতে বলে গেছেন।
 অফিসার বসার জন্য একটা চেয়ার দেখিয়ে দেন। সুলতা সেখানে গিয়ে বসে। মাথার মধ্যে নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে পৌঁছানোর আগে একটি পরিচিত ছেলেকে দিয়ে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে যে সে থানায় যাচ্ছে বাড়িতে জানিয়ে দিতে। কিছুতেই সুলতা বুঝতে পারছে না কেন এবং কিসের জন্য তাকে থানায় ডাকা হল? যদি রজতের কোন খবর থাকতো তাহলে তো তিনি ফোনেই জানাতে পারতেন। তবে কী জানাতে তিনি থানায় ডেকে আনলেন? 
  হঠাৎ ব্যাগের মধ্যে ফোনটা বেজে ওঠায় তার সম্বিৎ ফিরে। ফোনটা বের করে দেখে রজতের বাবা ফোন করেছেন। কী খবরই বা সুলতা তাকে দেবে? তবুও ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে বৃদ্ধ কাঁপা কন্ঠ স্বরে জানতে চাইলেন,
-- কোন খবর আছে? তোমায় থানায় ডেকে পাঠালো কেন?
 সুলতার বুঝতে অসুবিধা হল না পাড়ার ওই ছেলেটির মাধ্যমেই বোধহয় রজতের বাড়ি পর্যন্ত খবর গেছে সুলতাকে থানায় ডেকেছে। রাত প্রায় ন'টা তখন। ওসি তখনও আসেননি। বাস থেকে নেমে সারাদিনের পরিশ্রমের পর থানায় এসে বসে থেকে থেকে সুলতার ঝিমুনি এসে গেছে। যেহেতু ওসির পরিচিত তাই একসময় একটু কাগজের ছোট্ট কাপে এককাপ লাল চা পেলো সাথে দুটো বিস্কুট। খিদে পেয়েছে খুব। ইতস্তত করতে করতে বিস্কুট দু'টো নিয়েই নিলো। ওখানে বসে বসে কত মানুষের কত রকম সমস্যা শুনতে লাগলো। রাত প্রায় দশটা। ভাস্কর সেন আসলেন থানায়। ভিতরে ঢুকে সুলতাকে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন,
-- সরি, অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।একটা ঝামেলায় ভীষণভাবে ফেঁসে গেছিলাম। তুমি আর একটু বসো। চিন্তা করো না আমি নিজেই তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেবো। আমি এখুনি আসছি।
 তিনি ভিতরে ঢুকে ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে এলেন। এসেই বললেন, 
-- চলো 
-- কোথায়?
-- যেখানে নিয়ে যাবো বলে তোমায় আসতে বলেছিলাম সেখানে এত রাতে তোমায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
-- না,না আমার কোন অসুবিধা নেই। আপনি চলুন। 
 কথাটা বলে ভাস্কর সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- কিন্তু কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন আমায়?
 ভাস্কর একটু ইতস্তত করতে করতে বললেন,
-- রাত হয়ে গেছে কালই যাবো
-- কিন্তু জায়গাটা কোথায় বললেন না তো?
-- মর্গে 
-- মানে? সেখানে কেন? 
-- এখান থেকে কিছুটা দূরের এক স্টেশনে ক্ষতবিক্ষত একটা লাশ পাওয়া গেছে। পরিচয় জানা যায়নি। তাই আর কী --
-- এটা অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। 
 সুলতা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। ভাস্কর সেন তার মাথায় হাত রেখে বলেন,
-- আমিও চাই এটা যাতে সত্যি না হয়। কিন্তু যেহেতু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এটা একটা নিয়মই মনে করো।
-- না, এ নিয়ম আমি মানতে পারবো না। প্রয়োজনে আপনি আরও সোর্স লাগান। কিন্তু আমি মর্গে কিছুতেই যাবো না। রজতের এরূপ কোন ঘটনা ঘটতেই পারে না। তাহলে আমি টের পেতাম।
ভাস্কর সেন কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। এদিকে ড্রাইভার গাড়িতে উঠে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললো,
-- স্যার উঠুন।
 ভাস্কর সেন গাড়িতে উঠে সুলতার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-- গাড়িতে উঠে এসো। অনেক রাত হয়েছে। তোমায় বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি। যা ভাবার বা করার সকালে করবো।
 সুলতা গাড়িতে উঠে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ভাস্কর বললেন,
-- এত ভেবো না। রজতবাবুর কোন খারাপ খবর আছে সেইজন্য কিন্তু তোমায় বডি সনাক্ত করতে মর্গে যেতে বলা হয়নি। যেহেতু এই মুহুর্তেই তিনি নিখোঁজ আর এখনই ওই অজ্ঞাত পরিচয় বডিটা পাওয়া গেছে সেই হিসাবেই নিয়মমাফিক তোমায় মর্গে যেতে হবে। খোঁজ তো আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। 
 সুলতা কোন উত্তর দেয় না ভাস্কর সেনের কথার। গাড়ি এসে সুলতাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বড় রাস্তার মোড়ে থামে। দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভাস্কর সেনের দিকে তাকিয়ে শুধু "আসছি" - বলে এগিয়ে যায়।
 পুলিশের গাড়ি থেকে সুলতাকে নামতে দেখে অনেকেই কৌতূহল দৃষ্টিতে অত রাতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সুলতা কোন দিকে না তাকিয়ে আনমনাভাবে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। সুলতাকে দেখতে পেয়ে একজন বয়স্ক মহিলা বেশ কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকেন। কিন্তু অন্যমনস্ক থাকার ফলে সে ডাক সুলতার কানে পৌঁছায় না। কিন্তু তিনি ডাকতে ডাকতে তার পিছন পিছন আসতে থাকেন। সুলতা এবার শুনতে পায়। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভদ্রমহিলা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলতে শুরু করেন
-- এত রাত পর্যন্ত তুমি হন্যে হয়ে রজতের খবরের জন্য ছুটাছুটি করছো অথচ তোমার ফোন বন্ধ। তুমি কি জানো রজত ফিরে এসেছে কিছুক্ষণ আগে।
-- এ্যা 

ক্রমশ 

Wednesday, April 24, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৬ তম পর্ব)

বাস্তবিক ভাস্কর তার বিবাহিত জীবনে সুখী বলা চলে। কিন্তু ভাস্কর যে ধরণের মানুষ তার জীবনে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না। একাকী থাকলেই সেইসব দিনের কথা ভাস্করকে কুরেকুরে খায়। যে মেয়েটিকে সে ভালবেসেছিল তাকেই সে বিয়ে করতে চেয়েছিল বলেই বারংবার সে অনসূয়াকে কাছে টেনেছে একান্তে দু'টো শরীর এক হয়েছে। অথচ কোন কারণ না দেখিয়েই মেয়েটি এভাবে তাকে অন্ধকারে রেখে কেন অন্যত্র বিয়ে করে নিলো ? কেন বারংবার তারই সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হল? সে তো এটা চায়নি। সেতো মন থেকেই অনসূয়াকে ভালবেসেছিল। তাই তার সাথে মিলিত হতে কখনো তার মনে একটুও দ্বিধাবোধ জন্মায়নি। এটা অনসূয়া কেন করলো? 
  কিন্তু এ প্রশ্ন ভাস্করকে তাড়া করে বেড়ালেও মাঝে মধ্যে অনসূয়ার সাথে দেখা হলেও উত্তর কোনদিন জানা হয়ে ওঠেনি। তাই বাবার মৃত্যুর পর চাকরি পাওয়ার পর অফিসে যাতায়াতের অসুবিধা হয় জানিয়ে স্বল্প দামে বাড়ি বিক্রি করে এখান থেকে অন্যত্র চলে যায় যাতে অনসূয়ার সাথে তার দেখা না হয়। 
 এখান থেকে ভাস্কর চলে গেলেও অনসূয়ার খবরাখবর সে রাখে পাড়ার নানান লোকের মাধ্যমে। ভাস্কর এটাও জানে অনসূয়ার শ্বাশুড়ির মৃত্যুর পর অনসূয়া তার স্বামী,সন্তানকে নিয়ে এখন বাবা,মায়ের সাথেই থাকে। 
যেহেতু সুলতার সূত্র ধরে অনসূয়ার সাথে তার পরিচয় তাই সুলতার কথা ভাস্করের আজও মনে আছে। আর এই কারণেই বহুবছর বাদে সুলতাকে দেখে একটুও চিনতে কষ্ট হয়নি ভাস্করের।
 ভাস্কর যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে রজতকে খুঁজে বের করার। নানান জায়গায় সোর্স লাগিয়ে সে অনবরত খবর নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। 
 রজত যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন ছিল তার পে ডেট। সুতরাং চুরি, ছিনতাইয়ের বিষয়টাও উড়িয়ে দিতে পারছে না। কিন্তু সেতো নয় টাকাপয়সার ব্যাপার। আস্ত মানুষটা সে কারণে উড়ে যেতে তো পারে না।
 ভাস্কর কোনোই কূলকিনারা করতে পারছে না। রোজই অফিস থেকে ফিরে সুলতা তাকে ফোন করে। কিন্তু কোন সদুত্তরই ভাস্কর দিতে পারেন না। এদিকে রজতের বাবা,মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ছেলের চিন্তায় দিনদিন খারাপ হতে থাকে। রজতের মা নাওয়া খাওয়া ভুলে ছেলের জন্য সব সময় ঠাকুরের সামনে চোখ বুঝে বসে। সুলতা একা দুটি পরিবারের মধ্যিখানে পড়ে নাজেহাল অবস্থা। রজতকে না পেয়ে মানসিক দিক থেকে সে ভেঙে পড়লেও দায়িত্ব কর্তব্য থেকে বিন্দুমাত্র সরার কোন উপায় তার নেই। কারণ দুটি পরিবারের মধ্যে সেই একমাত্র কর্মক্ষম। 
 এদিকে ভাস্কর সেন দু'দিন পর বিকেলের দিকে ফোন করে সুলতাকে তার সাথে দেখা করতে বলেন। সুলতা তখনও তার অফিস থেকে বের হয়নি। সে ভাস্করের কাছে জানতে চায়
-- কোন খোঁজ পেলেন?
-- তুমি এসো আসলে সব কথা হবে।
-- আমি এখনো অফিস থেকে বের হইনি। অফিসে একটা ঝামেলা চলছে। আজ কোন অবস্থাতেই আগে বেরোতে পারবো না। আপনি যদি আমাকে ফোনেই বলেন সব আমি চিন্তামুক্ত হতে পারি।
-- তুমি তোমার অফিসের কাজ মিটিয়েই এসো। কোন অসুবিধা নেই।
-- তারমানে এখনো সেরূপ কোন খবর নেই।
 ভাস্কর সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।
 সেদিন সুলতার অফিসে হিসাবের গণ্ডগোল হওয়ায় ক্যাশিয়ারের সাথে ম্যানেজারের এক চরম ঝামেলা হওয়ার পরে মালিক ও তার ছেলে এসে উপস্থিত হন। তারা এসেই ঘটনার বর্ণনা শুনেই পুলিশে ফোন করেন। অনেক কাকুতিমিনতি করেও ক্যাশিয়ার রেহাই পায় না। তাকে পুলিশ আরেস্ট করে থানায় নিয়ে যায়। ক্যাশিয়ারের দোষগুণ বিচার করবে কোর্ট। কিন্তু সেই মুহূর্তে অফিসের সামনে যে চিৎকার,চেঁচামেচি আর  আরাজগতার সৃষ্টি হয়েছে তার রেশ অফিস ছুটির পরেও ঘণ্টা দেড়েক রয়ে যায়। স্বভাবতই সুলতার বেরোতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। বারবার ম্যানেজারকে সে বেরোনোর কথা জানালেও মালিক থাকায় নিজের চাকরি বাঁচানোর দায়ে তিনি নাকচ করেছেন সুলতার অনুরোধ। কারণ এই বয়সে চাকরি হারালে আর চাকরি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা তার নেই। সংসার অচল হয়ে পড়বে। সুলতাকে তিনি সন্তান স্নেহে দেখলেও আজকে তিনি তার জন্য কিছুই করতে পারেননি।
 সুলতা অফিস থেকে বেরিয়ে স্টেশনে পৌঁছানোর জন্য যে রাস্তাটা সেটা সে হেঁটেই পার হয়। কিন্তু আজ সে অটো ধরে স্টেশনে আসে। কিন্তু এলেই তো আর হল না। ট্রেনের তো একটা নিদ্দিষ্ট সময় আছে। আধাঘন্টা বসে,দাঁড়িয়ে,পায়চারি করে ভিড়ে ঠাসা একটি বগিতে উঠে পড়ে। মাথার মধ্যে সর্বদা একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেটা হল যদি ওসি রজতের কোন খবর পান তাহলে তো সরাসরি তাকে ফোনেই জানাতেন। তাহলে কী এমন হল যে তিনি থানাতেই দেখা করতে বললেন? কোন খারাপ খবর কি? তবে কি রজত --।

ক্রমশ