Saturday, April 23, 2022

ঝরাপাতা (আঠাশ পর্ব)

 ঝরাপাতা (আঠাশ পর্ব)
  এই বয়সে এসে দুজনের নতুন করে আর কিছুই চাওয়ার নেই।ছেলেমেয়ের গল্প,দৈনন্দিন জীবনে কি ঘটলো না ঘটলো ,পুরনো দিনের কোন হাসিমজার গল্প চলে দু'জনের মধ্যে।এই কথার মধ্য দিয়েই যেন দুজনেরই মনেহয় শুধুমাত্র এই গল্পই জীবনের না পাওয়াগুলির একটু একটু করে পূর্ণতা দিচ্ছে।
  কথা বলতে বলতে যেদিন দু'জনেই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে সেদিন নিজেদের অজান্তেই তারা পৌঁছে যায় বারো থেকে পনের হাজার মাইল দূর থেকে পৃথিবীর দুই প্রান্তে দু'জনে থেকেও বিয়াল্লিশ বছর আগে যেদিন সুমিত তার বলিষ্ঠ দুটি বাহুর মধ্যে সুচন্দার লজ্জাবনত মুদিত দুই চক্ষু আর দুটি থরথর কম্পমান সেই ঠোঁট দুটির আলতো ছোঁয়ায় নিজের ভালোবাসার প্রকাশ করেছিল।আজও যেন দুজনেই সেই ঘটনার শরীর ও মনের শিহরণ অনুভব করে। যা উভয়ের কথাতেই প্রকাশ পায়।কিন্তু কেউ কারও আবেগ কাউকেই বুঝতে দেয় না।
 আমার পাঠককুল হয়ত ভাবতে পারেন জীবনের তিনটে অধ্যায় আলাদা আলাদাভাবে তাদের দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে দিয়ে এই বয়সে এসে সুমিত ও সুচন্দা যা করছেন সেটা মোটেই শোভনীয় নয়।কিন্তু সত্যিই কি তাই?মানুষের মন বলে যে জিনিসটি আছে তাকে কি সব সময় নিজ কন্ট্রোলে রাখা যায়?পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী যান হচ্ছে মানুষের মন।সেতো মুহূর্তেই যে কোন জায়গায় যে কোন পরিস্থিতিতে অন্যত্র পৌঁছে যেতে পারে!তারমধ্যে তো কোন অন্যায় বা খারাপ কিছু নেই।ফেলে আসা অতীতকে তারা কোনদিনও ফিরে পাবে না,সমাজ-সংসার,তাদের ছেলেমেয়েদের ফেলে কেউ নতুন করে নিজেদের নিয়ে কোনো স্বপ্নও দেখবে না।শুধুমাত্র ফোনে কথা বলে নিজেদের মনে জমানো সেই কষ্টের পাহাড়কে ডিঙিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দুজনেই একটু শান্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে মাত্র।আর কিছু না পেলেও সেই মুহূর্তে দুজনেই তাদের ফেলে আসা অতীতে বিচরণ করতে পারে।
  এইভাবেই একদিন কথা বলতে বলতে সুমিত বলে,
-- যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম সেই সময় কলেজে আমার একজন সহপাঠীর সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়।আজও সেই বন্ধুত্ব অটুট।সেও একটি মেয়েকে ভালোবাসতো জানো?কিন্তু ওই কপাল! তারও মেয়েটির সাথে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। দু'বাড়ির সকলেই রাজি ছিলেন।কিন্তু মেয়েটির বাবা হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পরে সেই মেয়েটির উপর।
 সুচন্দা চুপচাপ সুমিতের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। কারো জীবনের সাথে মেলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সুমিত যেহেতু ঘটনার বিবরণ দিয়েই চলেছে তাই সে কথার মাঝখানে কোন কথা বলছে না।সুমিতের কথাগুলো আবার মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে।
 "তখন আমার বন্ধু ওর প্রেমিকাকে বলেছিলো এ দায়িত্ব পালনে সেও তার পাশে থাকবে।কিন্তু জানো সুচন্দা মেয়েটি কিছুতেই রাজি হলো না।ফিরিয়ে দিলো আমার বন্ধুটিকে।বাবা,মা মারা যাওয়ার পড়ে বন্ধুটিরও আর কেউ রইলো না।সারাটা জীবন মানুষের সেবা করেই গেলো।সব কিছুই ঠিক ছিল।কিন্তু হঠাৎ করেই বন্ধুটির জীবনে নেমে এসেছে এক দুর্যোগ।এখন সে সম্পূর্ণভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল।"
--- কেন কি হয়েছে তার?বন্ধুটির নাম কি তোমার?আর তোমার বন্ধু যাকে ভালোবাসতো তারই বা নাম কি?
 সুমিত একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- কি হবে আর সেসব জেনে?তবে জানো আমার বন্ধুর বাড়ি কিন্তু শিলিগুড়ি ছিল -- 
--- তোমার বন্ধুর নাম কি দোদুল?
--- তুমি কি করে জানলে?
--- হা ভগবান!এই মানুষটার সাথে আমার পরিচয় সেই কলেজ লাইফ থেকে।কত বছর আমি দোদুলদাকে ভাইফোঁটা দিয়েছি। ফোনে সব সময় কথা হত।তবে এই কিছুদিন হল দাদা যেন একটু অন্যরকমভাবে কথা বলছে।বেশ কিছুদিন যোগাযোগ রাখেনি।শেষ ফোন করেছে দিন দশেক আগে।দাদা তো আমার বন্ধু অস্মিতাকে ভালোবাসতো।
--- কি বলছো এসব?তারমানে আমি যদি দোদুলকে আমার জীবনে তোমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা জানাতাম তবে সেই বিয়াল্লিশ বছর আগেই তোমার খোঁজ পেতাম?এখন আমার নিজের চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।পাগলের মত চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে।
--- কি হয়েছে দাদার?সেদিন কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ফোনটা কেটে দিলো। অস্মিতার খবর জানালাম কেমন উদাসীন মনেহল।কি হয়েছে বলো তো?
--- তুমি জানো এখন সে কোথায়?
--- দাদা তো তার কাজের প্রয়োজনে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়।আমায় শেষবার বলেছিলো আমেরিকা যাচ্ছে।তারপর তো অনেকদিন কোন যোগাযোগ ছিল না।আর সেদিন দাদা বেশিক্ষণ কথাও বলেনি। 
--- আমেরিকার কাজ শেষ করে ও ওর স্থায়ী ঠিকানা আমার বাড়ির কাছেই অর্থাৎ কানাডায় ফিরছিল।এয়ারপোর্টে এক্সক্লারেটরিতে থাকার সময়েই ওর হার্ট অ্যাটাক হয়।গড়িয়ে পড়ে যায় বেশ উপর থেকেই।হার্টের সমস্যা ছাড়াও দুই পায়েরই হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়।তড়িঘড়ি ওখান থেকেই তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়।দুটো ব্লকেজ ধরা পড়ে।হাঁটুর অপারেশন হয়।কিন্তু সাকসেসফুল হয় না।বেশ কিছুদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ও কানাডায় ফিরে আসে নিজ বাড়িতে।এখন হুইলচেয়ার ছাড়া নড়াচড়া করতে পারে না যদিও ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছেন আর একটা অপারেশনের পর ও সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে যাবে।
--- কি অদ্ভুত লাগছে ঘটনাগুলো।দোদুলদা তোমার বন্ধু, অস্মিতা আমার বন্ধু।আমরা সবাই সবাইকে চিনি জানি।অথচ এতগুলো বছর ধরে আমরা কেউ কারো খবর জানতে পারলাম না শুধুমাত্র নিজেদের কষ্টগুলো নিজেদের মনের ভিতরে চেপে রাখার ফলে।তুমি আজ দাদার কাছে গিয়ে সবকিছু জানাবে আমাদের এই বন্ধুত্বের কথা। অস্মিতার সাথে কথা বলতে বলবে। অস্মিতার তখন কোন উপায় ছিল না ওকে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া।ভাইবোনগুলো সব ছোট ছিলো।সেই মুহূর্তে মাসীমাও খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। অস্মিতা ভেবেছিল দাদাকে ফিরিয়ে দিলে দাদা তার জীবনটাকে সুন্দরভাবে গড়ে নেবে।দাদাকে ভালোবেসে তাকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেও সারাটা জীবন একাকী থেকে কষ্ট পেয়ে গেলো।আমার কাছ থেকে দাদার ফোন নম্বর নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।কিন্তু দাদা কিছুতেই ওর সাথে যোগাযোগ করছে না।ও খুব ভেঙ্গে পড়েছে ,খুব কান্নাকাটিও করছে।সত্যি বলতে কি জানো?ওকে কিন্তু কোন দোষ দেওয়া যায় না।ও যদি তখন শক্ত হাতে সংসারের হালটা না ধরতো ওদের সংসারটা ভেসে যেত,ভাইবোনেরা কেউ মানুষ হত না।পরিস্থিতি মানুষকে কঠোর হতে বাধ্য করে।কিন্তু অস্মিতার মনের মধ্যে ভালোবাসার একটি নামই রয়ে গেছে সে আমার দোদুলদা।
 সুমিত তখন একটু দুষ্টুমি করে বলে,
--- আর তোমার মনের মধ্যে কে আছে?
 সুমিতের হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে সুচন্দা একটু ঘাবড়ে গেলো।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
--- আমরা কিন্তু দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হয়েছি।জীবনে অনেক কাঠখর পুড়িয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা করেছি।কে কতটা সুখী হয়েছি সে কথা নিজেরা ছাড়া অন্য কেউই জানে না।কিন্তু ওদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।ওরা পরস্পরকে ভালোবেসেই পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।এখন আমাদের উচিত ওদের দুজনের একবার দেখা করিয়ে দেওয়ার।দাদা সুস্থ্য হয়ে গেলেই তুমি ওকে নিয়ে একবার দেশে আসবে। 
 সুমিত আবারও দুষ্টুমি করে বলল,
--- ওদের দেখা করিয়ে দেবো নিশ্চয় কিন্তু আমাদের দেখা হলে দু'জনে কিন্তু সেই বাড়িতে আবার যাবো।তখন যদি আবার ---
 সুচন্দা হাসতে হাসতে বলল,
--- মুখে যা আসছে তাই বলছো --।এত কথা তো আগে তোমার মুখে শুনিনি।
--- বারে আমি বড় হয়ে গেছি তো। তখন বাচ্চা ছিলাম এত সাহস ছিল না।(হাসতে হাসতে সুমিত বলে)
সুচন্দাও হাসতে হাসতে বলে,
--- বড় আর হলে কোথায়?বলো বুড়ো হয়ে গেছো।
 ফোনের দুইপ্রান্তে দু'জনেই হাসতে থাকে।

ক্রমশঃ
    

No comments:

Post a Comment