সন্ধ্যার অনেক আগেই দোদুল অস্মিতাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হল। অস্মিতা তখনো অফিস থেকে বাড়িতে ফেরেনি। অস্মিতার মা কিংবা ভাইবোনেদের ব্যবহার সেই পূর্বের মতই।দোদুল বুঝতে পারে অস্মিতা তারমানে এদের কোনকিছুই জানায়নি।
সন্ধ্যা হয় হয় তখন। অস্মিতা বাড়ি ফেরে।দরজা খুলে দেয় ওর মেঝবোন।সেখানেই দাঁড়িয়ে সে দিদিকে জানায়,
-- দিদি, দোদুলদা এসেছে
--- কখন?কোথায় সে?এতবার করে বলার পরেও ---
শেষের কথাটা খুবই আস্তে বলে সে।বোন লিপি ঠিক শুনতে পায়না।সেও খুবই আস্তে আস্তে দিদির কাছে জানতে চায়,
--- তুই কি বললি এত আস্তে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না
--- না,কিছু না দোদুলকে চা দিয়েছিস?
--- একটা কথা বলতো দিদি,তুই কি দোদুলদার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছিস?তোর ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য অন্যের জীবনের কোন ক্ষতি তুই করতে পারিস না কিন্তু।
--- চুপ কর লিপি।বেশি বকিস না।দোদুল শুনতে পাবে
কথাগুলো বলতে বলতে অস্মিতা দোদুল যে ঘরে বসা অর্থাৎ ড্রয়িং রুমের দিকে এগোতে থাকে।লিপিও তার নিজের ঘরে চলে যায়।
সেদিন অস্মিতা দোদুলকে ফিরিয়েই দেয়।দোদুল তার পাশে থেকে অস্মিতার ভাইবোনদের বড় দাদা হয়ে তাদের মানুষ করতে চেয়েছিলো।কিন্তু অস্মিতা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিল এ লড়াই তার একার।এখন তার জীবন আর দোদুলের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে সে কিছুতেই দোদুলের জীবনটা নষ্ট করতে পারবে না।একথা শুনে দোদুল আহত পাখির মত যন্ত্রণায় ছটফট করেছে অস্মিতার সামনে কিন্তু অস্মিতা তার মনকে আগেই শক্ত করে নিয়েছিল।সে চায়নি তার জীবনের সাথে জড়িয়ে দোদুলের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক।
আসলে মানুষ তার জীবনে অর্থাৎ জীবন রঙ্গমঞ্চে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সে স্ক্রিপ্ট লেখা বিধাতার হাতে।যে কোন সময় তিনি স্ক্রিপ্টের রদবদল করে চরিত্রের পরিবর্তন করে থাকেন।মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।এই জীবনের রঙ্গমঞ্চে তাই মানুষের স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার মধ্যে থেকে যায় বিস্তর প্রভেদ।স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে মিল খুঁজে না পেয়ে অনেকেই ভেঙ্গে পরে আবার অনেকেই সময়ের সাথে সাথে নিজেকে নূতন কোন ভূমিকায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয় সেও সেই অদৃশ্য কারো ইঙ্গিতে।
অস্মিতা একে একে তার ছোট ভাইবোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে।তারা তাদের বড়দিদির এই পরিশ্রমের দামও দেয়।প্রত্যেকেই তাদের নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভও করে একমাত্র মেঝবোন লিপি ছাড়া।বাবা যখন মারা যান তখন লিপি অনেকটাই বড়।সংসারের প্রতি দিদির এই অমানুষিক পরিশ্রম,দিদির নিজের ভালোবাসাকে তাদের জন্য নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলতে ও দেখেছে।তাই দিদির সহচরী হয়ে দিদির পাশে থেকে তার এই লড়াইয়ে সমানভাবে পাশে থেকে গেছে।লিপি নিজেও একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।এখন দুই বোনের সংসার।মা ও বিদায় নিয়েছেন অনেকদিন আগেই।ভাই এখন বিদেশে।বছরে শুধুমাত্র পুজোর সময় সকল ভাইবোনগুলো দশ, বারো দিনের জন্য একজায়গায় হয়।
অস্মিতার সাথে দোদুল তারপর আর কোন যোগাযোগ না করলেও তার প্রতিটা খবর সে রাখে।কারণ সুচন্দার সাথে আজও তার সম্পর্কটা রয়ে গেছে।সুচন্দার ছেলের মুখেভাতে দোদুল আসছে শুনে অস্মিতা সেদিন না গিয়ে পরেরদিন গিয়েছিল।কিন্তু অস্মিতা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি তাকে দোদুল না পেয়ে নিজেও সারাটা জীবন একাকী কাটিয়ে দেবে।
জীবন থেকে অনেকগুলি বছর এইভাবেই হারিয়ে গেলো একই স্বপ্ন দেখা দুটি তরুণ তরুণীর জীবন থেকে।কে কোথায় আছে কেউই জানে না,কেউই কারও খবর জানার বা শোনার আগ্রহ কারো কাছেই প্রকাশ না করলেও দুটি মনের অলিন্দে দুজনেই রয়ে গেছে। কতশত মানুষের জীবন থেকে কত স্বপ্ন হারিয়ে যায় কর্তব্যের বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে।স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা,ইচ্ছা সবকিছু বুকের ভিতর একটা ভারী পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেয় অনেকেই।
দোদুলকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর কেটে গেছে ত্রিশটি বছর।সুচন্দার ছেলের মুখেভাতের পড়ে অস্মিতার সাথে সুচন্দার যোগাযোগটাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।কিন্তু ত্রিশ বছর পর আবার ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে দুই বন্ধুর নূতন করে পরিচয় হয়;এখন নিত্য কথাও হয় তাদের মধ্যে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার দোদুলের সাথে সুচন্দার যোগাযোগটা কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়নি কোনদিন।প্রথম দিকে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান তারপর মুঠোফোনের দৌলতে রোজ একবার করে কানাডাবাসী দোদুলদাদার সাথে সুচন্দার নিত্য যোগাযোগ।
সুচন্দার সাথে এখন অস্মিতার নিত্য যোগাযোগের ফলে দোদুলের কথা অস্মিতা জানতে পারে।কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা এখন অবিবাহিত দোদুল।বাবা,মা অনেক আগেই গত হয়েছেন।আজ প্রায় দশ বছর সে দেশে ফেরে না।'স্মিতা ফাউন্ডেশন' নামে সংস্থার চেয়ার পার্সন যা শিলিগুড়িতে কিছু বিশ্বস্ত কাছের মানুষ দেখভাল করলেও যার দায়ভার সম্পুর্নভাবে দোদুলের।এখানে গরীব,অসহায় মানুষদের নানানভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় স্মিতা ফাউন্ডেশন।
দোদুল সম্পর্কে বর্তমানে সবকিছু জানার পর কয়েকটা রাত শুধু কেঁদেই ভাসিয়েছে সে।পাশে শুয়ে থাকা বোন লিপি সব বুঝতে পারলেও সে দিদির কাছে ধরা দেয়নি।সুচন্দা তার সখীর ইনবক্সে দোদুলের প্রোফাইলের লিঙ্ক পাঠিয়েছে।দুদিন শুধু প্রোফাইলটা ঘেঁটেই গেছে অস্মিতা।দুরুদুরু বুকে সে তার একসময়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে সেকেন্ড,মিনিট,ঘণ্টা গুনে চলেছে।কিন্তু ব্যস্ত দোদুল সেসব দেখবার সময়ও পায়নি।সুচন্দা তাকে বলেই দিয়েছিল দাদা খুব কম অন হয় ভার্চুয়াল জগতের সাথে তার যোগাযোগটা খুবই কম।ওই একটা প্রোফাইল খুলে রেখেছে গোছের।
দোদুলের প্রোফাইল লিংক পাওয়ার পর থেকে অস্মিতা আর নেট ওফ করেনি সেই থেকে।প্রতিটা মুহূর্তে সে সেই আগের থেকেও বেশি যেন দোদুলের অপেক্ষায় আছে।বয়স বেড়েছে অনেকটাই।কিন্তু বুকের ভিতরের সেই ধুকপুকানি আজও সেই একইভাবে রয়ে গেছে।নিজেই বারবার নিজের দোদুলকে লেখা মেসেজগুলো পড়ছে।দিদির ভিতর যে এক অস্থিরতা কাজ করছে লিপির চোখ এড়ায় না।তারউপর কয়েকদিন অন্ধকার ঘরে অনেক রাতে দিদিকে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখেছে।
চাকরি আছে অস্মিতার আরও কয়েক বছর।লিপি দিদির এই অস্থিরতা দেখে একসময় বলেই বসলো,
-- তোর কি হয়েছে বলতো?শরীর খারাপ তো মনে হচ্ছে না।কয়েকটা দিন রাতেও বেশ ছটফট করলি -- সে রকম হলে কটাদিন অফিস থেকে ছুটি নে;আমরা কোথাও ঘুরে আসি।
অস্মিতা ধরা পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোনকে বললো,
-- স্বার্থপর হয়ে বাঁচতে পারবো না বলে দোদুলকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম যাতে ও অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হয়।কিন্তু সে যে এইভাবে নিজেকে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র আমায় হারিয়ে দেবে বুঝতে পারিনি রে !
--- কিভাবে খবর পেলি তার?
--- কয়েকদিন আগেই তো জানিস সুচন্দাকে খুঁজে পেয়েছি।ওর সাথে দোদুলের যোগাযোগ রয়েছে।ওই সব খবর দিলো আমায়।খুব একটা ফেসবুক না করলেও প্রোফাইল একটা আছে।কানাডায় থাকে এখন।ওখানেই বাড়ি করেছে।একাই থাকে বিয়ে থা করেনি।আমার জন্যই ওর জীবনটা তছনচ হয়ে গেলো।কথাগুলো বলতে বলতে সে লিপির সামনেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment