Monday, April 11, 2022

ঝরাপাতা (একুশ পর্ব)

ঝরাপাতা (একুশ পর্ব)
  সুচন্দা তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির সংসারটিকে খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিয়েছিলো।চাহিদা সংসারে প্রচুর থাকলেও মানুষগুলির ব্যক্তিগত কোন চাহিদা ছিল না।তাই সেইসব চাহিদাগুলোকে সুচারুরূপে প্রত্যেকেই এড়িয়ে চলতে পারতো।
 সুচন্দার শ্বাশুড়ী ছিলেন মাটির মানুষ।তিনি তার এই বড় বৌমাটিকে নিজ মেয়ের মত স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন।কখনো কোনদিনও শ্বাশুড়ী মায়ের সাথে সুচন্দার তর্ক বা ঝগড়া হয়নি।বরং দেখা গেছে সঞ্জয়ের সাথে সামান্য তর্ক বা ঝামেলায় সুচন্দা যখন মুখটি গম্ভীর করে রেখেছে তখনই তিনি বুঝতে পেরেছেন তার সঞ্জুই বৌমাটিকে মুখ কালো করে কোন কথা বলেছে।সুচন্দার অনুপস্থিতিতে তিনি তার ছেলেকে বকাবকি করেছেন,বুঝিয়েছেন।
 শ্বাশুড়ী অন্নপূর্ণাদেবী অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে বিশাল বড় এক সংসারের বউ হয়ে এসেছিলেন।সংসারে অভাব ছিল নিত্য সঙ্গী।রোজগেরে মানুষ একজন - তার স্বামী।সংসারের যাবতীয় সব কাজ করেও উঠতে বসতে তাকে গঞ্জনা সইতে হত।কিন্তু কোনদিনও কোন প্রতিবাদ তিনি করেননি তার একটাই কারণ ছিল ঝগড়াঝাঁটি তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না।ছোট একটা পাউরুটির কারখানায় চাকুরীরত স্বামীর সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের পর যখন তিনি ঘরে ফিরতেন তখন তার সেই শুকনো কালি বর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলার আর ইচ্ছা থাকতো না।স্বল্প শিক্ষিত অন্নপূর্ণাদেবী সংসারে কিছুটা সুরাহা করতে ঘরে বসে কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি করে বিক্রি করতেন।অথর্ব অবিবাহিত খুড়তুতো শ্বশুর,দুই অবিবাহিত ননদ উপরুন্ত দেশভাগের পর অন্নপূর্ণাদেবীর শ্বাশুড়ির বাপের বাড়ির দিক থেকে দুই বিধবা মাসি শ্বাশুড়ী।তারা সবাই কোনরকমে মাথা গোঁজার মত একটা আশ্রয় পেয়েছিলেন ওই সংসারে।কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারে বউ হয়ে এসে অন্নপূর্ণাদেবী পড়েন অথৈ সমুদ্রে।সেই সংসারে কিছুটা সুরাহা করতে স্বামীর কাছ থেকে মত নিয়ে শুরু করেন কাগজ কিনে এনে ঠোঙ্গা তৈরি করতে। আস্তে আস্তে বাড়ির প্রায় সকলেই এই কাজে হাত লাগায়।অনেক বড় বড় দোকানও তাদের তৈরি কাগজের এই ঠোঙ্গা নিতে শুরু করে।সংসারে বিশাল কিছু উপকারে না আসলেও কিছুটা সাশ্রয় হয়।
 সময়ের সাথে সাথে বয়সের ভারে,রোগ-শোকে অনেকেই সংসার ছেড়ে চিরতরে পাড়ি দেন অজানা দেশে। শ্বাশুড়ীও শয্যাশায়ী হন।দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রায় বছর খানেক বিছানায় থেকে তিনিও চলে যান।অবশ্য চলে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে তিনি তার পুত্র বধুটির কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেন।
 অন্নপূর্ণাদেবীর প্রথম সন্তান সঞ্জয়ের জন্মের পর তার স্বামী ছোট একটা পাউরুটির কারখানায় চাকরী পান।নিজ পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সেই ছোট্ট কারখানাটিকে কিছুটা হলেও মালিককে লাভের মুখ দেখাতে সক্ষম হন।মালিক সম্পূর্ণভাবে সঞ্জয়ের বাবা বিশ্বনাথের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।একটু একটু করে যখন কারখানার উন্নতি সাধিত হচ্ছে বিশ্বনাথবাবুর মাস মাইনে তরতর গতিতে বেড়ে চলায় সংসারে একটু সুখের মুখ দেখতে সকলে শুরু করেছে ঠিক তখনই একদিন রাতে সর্টসার্কিট হয়ে পুরো কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
 বিশ্বনাথবাবুর সংসারে নেমে এলো পুনরায় দুর্যোগ।বিশাল সংসারের দায়িত্ব ,বয়স্কদের রোগ-যন্ত্রণা আর সর্বোপরি প্রথম সন্তান সঞ্জয়ের লেখাপড়া।তিনিও দিনরাত ঠোঙ্গা তৈরিতে মন দিলেন।কিন্তু কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি করে আর কটা পয়সা পাওয়া যায়?কমতে শুরু করলো অন্নপূর্ণাদেবীর
 গয়নার বাক্স হতে একটা একটা করে গয়না।
 এইভাবে অভাব,দুঃখ,দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে করতে বয়সের ভারে সাথে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেকেই অকালে চলে গেলেন।সংসারে পড়ে রইলেন স্বামী,স্ত্রী আর তাদের বাচ্চা।খেয়ে না খেয়ে চলতে লাগলো সংসার।এমনই একদিনে দামী গাড়ি হাঁকিয়ে জীর্ণ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো পুড়ে যাওয়া কারখানার মালিক।তিনি বিশ্বনাথবাবুকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন ছাই হয়ে পড়ে থাকা কারখানার কাছে।করজোড়ে অনুরোধ করলেন সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে তার এই শেষ হয়ে যাওয়া কারখানাটিকে পুনর্জীবিত করতে।বিশ্বনাথবাবু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন।তিনি এমনই একটি আশা বুকের ভিতর লালন করে চলেছেন কারখানায় আগুন লাগার পর থেকেই।কিন্তু সাহস করে মালিককে বলে উঠতে পারেননি।মনেমনে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন।ঈশ্বর তার মনের কথা শুনেছেন। সৎ,সত্যবাদী,একনিষ্ঠ, বিশ্বাসী কর্মীর হাতে হাজার হাজার টাকা তুলে দিয়ে শুধু দিনান্তে গাড়ি করে এসে কতটুকু কাজ হয়েছে দেখে যাওয়ায় ছিল কারখানার মালিক অমিযকান্তি সাহার কাজ।দিনরাত এক করে একটু একটু করে পাউরুটির কারখানাটিকে পুনরায় দাঁড় করান বিশ্বনাথবাবু।যখন প্রথম দিকে তিনি কারখানার কাজ শুরু করেন তখন বেশ কিছুদিন তিনি রাস্তার পাশেই জোগাড় করা একটি বেঞ্চের উপর রাত কাটিয়েছেন যাতে বিল্ডার্সের মালামাল চুরি না হয়ে যায়।কয়েক মাসের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায় সেই পাউরুটির কারখানা যার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিশ্বনাথবাবুর। হ্যাঁ মালিক অমিয়কান্তি সাহা তার মর্যাদা রেখেছিলেন।কারখানা চালু হলেই তিনি বিশ্বনাথবাবুকে সেখানকার ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে তার অবর্তমানে এই ছোট্ট কারখানার মালিক অন্নপূর্ণাদেবীর একটা পেনশনের ব্যবস্থাও করে রেখে গেছিলেন ; যা অন্নপূর্ণাদেবী আমৃত্যু পেয়ে গেছেন।
 এরপরেই কিছুটা সুখ ও শান্তি ফিরে আসে সংসারে।কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষের পরিশ্রম করে সুফল পাওয়ার পর সেই সুখ সবার কপালে বেশিদিন স্থায়ী হয় না।বিশ্বনাথবাবুর ক্ষেত্রেও হল তাই।হঠাৎ করেই তিনি ইউরিন ইনফেকশনে মারাত্মকভাবে অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন।অমিয়কান্তিবাবু চেষ্টা করেছিলেন অর্থের বিনিময়ে তাকে সুস্থ্য করে তুলতে।কিন্তু আয়ু তো থাকে বাঁধা।
  চলে গেলেন তিনি তার স্ত্রী,পুত্রদের রেখে।তখন সবেমাত্র সঞ্জয় বারো ক্লাস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে।সংসারের জোয়াল এসে পড়লো সম্পূর্ণভাবে তার উপর।কোন রকমে পরীক্ষাটা দিয়েই মা,ভাইদের জন্য দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে তাদের কিছুই না জানিয়ে যখন যা পেয়েছে সেই কাজ করেছে।সে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে থেকে কুলির কাজ।ততদিনে সঞ্জয়ের মামাও একটি ভালো সরকারি চাকরী পেয়ে গেছেন একটু বেশি বয়সেই।তিনিও নানানভাবে তার দিদির সংসারটিকে আর্থিক সাহায্য করে গেছেন।অন্নপূর্ণাদেবী পুনরায় শুরু করেন কাগজের সেই ঠোঙ্গার ব্যবসা।মাঝে কয়েক বছর একটু সুখের মুখ দেখে এ সবই তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
  সঞ্জয় ভালোভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলেও ওখানেই তার পড়ার ইতি টানতে হয় শুধুমাত্র সংসারটিকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে।সামান্য এই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সে একটার পর একটা চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চলে।ইতিমধ্যে সে একটি সেলসের কাজ জুটিয়ে নেয়।সকাল থেকে সন্ধ্যা সাইকেল করে কলকাতা থেকে দূরদুরান্তের মফরসল শহর খালি পেটে ছুটে গেছে।খুব খিদে পেলে ছাতু আর জল ছাড়া কোনদিন কিছুই তার পেটে পড়েনি।মা,ভাইদের দুবেলা পেট পুড়ে খাবার জোগাড়ের তাগিদে নিজের ক্ষুদা তৃষ্ণা ভুলে গিয়ে দিনের পর দিন অনিচ্ছা সর্ত্বে নিজের শরীরের ক্ষতি করে গেছে যা তাকে পরবর্তীতে ভুগতে হয়েছে নানান রোগের বাসা শরীরে তৈরি করে।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment