ঝরাপাতা (তেইশ পর্ব)
সঞ্জয়দের পরিবারে বউ হয়ে এসে জীবনে প্রথম যে উপলব্ধিটা সুচন্দার হয় সেটা হল সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার যদি অভাব না থাকে,খুব বেশি একটা চাহিদা না থাকলে তাহলে সুখী হওয়াটা খুব কষ্টের নয়।স্বামী, দেওররা সর্বোপরি শ্বাশুড়ী মায়ের ভালোবাসায় ফিকে হয়ে যাওয়া অতীতকে প্রায় ভুলেই গেছিলো সুচন্দা।দুবছরের মাথায় সুচন্দার মা হওয়ার খবরে সকলেই খুব খুশি হল।কতদিন পরে বাড়িতে একটা শিশুর আগমণ ঘটবে এই নিয়েই সর্বক্ষণ আলোচনা।সুচন্দা হাঁটতে লাগলেও যেন বাড়ির লোক খেয়াল রাখে যাতে তার কোন কষ্ট না হয়। অর্থই যে সবসময় সুখ এনে দেয় না তার প্রমাণ সঞ্জয়দের বাড়ির প্রত্যেকে প্রতি পদেপদে দিয়েছে।
কিন্তু বিধাতা মনেহয় এখানেও সুচন্দার জীবনে অন্যকিছু লিখেছিলেন।হঠাৎ করে তাদের সংসারে এলো সঞ্জয়ের মামাত বোন শমিতা।বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর শমিতা আশ্রয় নিয়েছিল তার বড়বোন অনিতার কাছে।অনিতার ছিল এক দেওর।তার ছিল শমিতার দিকে নজর।কিন্তু শমিতা তাকে মোটেই পাত্তা দিত না।তাতে ইন্দ্রনীল গেলো আরও ক্ষেপে।একদিন তার দাদা,বৌদি বাড়িতে না থাকার ফলে সে সুযোগ পেয়ে শমিতার ঘরে ঢুকে তার উপর চড়াও হয়।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনীলের উদ্দেশ্য সফল হয় না।ধস্তাধস্তির মাঝে সুযোগ বুঝে শমিতা দরজা খুলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।দিদি,ভগ্নিপতি বাড়িতে ফিরে এলে পাশের বাড়ির সেই কাকিমা শমিতাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়।অনিতাকে বুদ্ধি দেয় বোনকে এখানে না রেখে পরিচিত বিশ্বাসী কোন বাড়িতে রাখার জন্য আর সেরূপ কেউ না থাকলে যেন খুব তাড়াতাড়ি তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
ইন্দ্রনীল এরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে দীঘা চলে যায় যা সে আগেই তার দাদা,বৌদিকে জানিয়ে রেখেছিল যে সে কয়েকদিনের জন্য দীঘা বেড়াতে যাবে। অনিতা ও তার স্বামী সেদিন দুপুরে গেছিলো এক উপনয়ন বাড়িতে।নিমন্ত্রণ ছিল না শমিতার।ইন্দ্রনীল জানতো দাদা, বৌদি বেরিয়ে গেলে শমিতা একা বাড়ি থাকবে।তাই সে আগে থাকতেই তার প্ল্যান ঠিক করে রেখেছিল।সেই মত সে জানিয়ে দিয়েছিল সেদিন বিকেলেই সে দীঘা যাবে।ইন্দ্রনীল তার পূর্ব প্ল্যান মোতাবেক সবকিছু ঠিকঠাক করতে পারলেও শমিতাকে বাগে আনতে না পেরে দুপুরেই বাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
অনিতা বাড়ি ফিরে সবকিছু শুনে সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় শমিতাকে পিসির বাড়িই পাঠিয়ে দেবে।তখনকার দিনে মুঠোফোনের এত রমরমা ছিল না।পিসির পারিবারিক পরিস্থিতি অজানা ছিল না।তার উপর বড়দা মানে সঞ্জয়ের সবে বিয়ে হয়েছে।আগের থেকে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসলেও চাহিদার সাথে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা এখনো তাদের হয়নি।কিন্তু তবুও মানসম্মান বজায় রেখে বোনকে বাঁচাতে গেলে এই ছাড়া অনিতার আর কোন উপায়ও ছিল না।
চাকদার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভগ্নিপতির সাথে বেরিয়ে সূর্য্য যখন মাঝ আকাশে ঠিক তখন এসে শমিতা তার ভগ্নিপতির সাথে বড় পিসির বাড়িতে উপস্থিত হল।সুচন্দাকে দ্বিপ্রহরের ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল।শুরু হল নূতন করে রান্নাবান্না।খুব তাড়াতাড়ি দুটি খেয়ে শমিতার ভগ্নিপতি বেরিয়ে যেতে চাইলেন।তিনি বা শমিতা কোন কথায় অন্নপূর্ণাদেবীকে কেউ বলে না।কি কারণে?কিসের জন্য?কেন এসেছে?কোন কিছুই অন্নপূর্ণাদেবী বা তার বাড়ির কেউই তখনো পর্যন্ত জানেন না।বেরিয়ে যাওয়ার আগে শমিতার ভগ্নিপতি পকেট থেকে একটি চিঠি বের করে পিসিশ্বাশুড়ির হাতে দিয়ে বললেন,
--- আপনার ভাইঝি এই চিঠিটা আপনাকে দিয়েছে।এতে সবকিছু লেখা আছে।আর বাকিটা শর্মির কাছ থেকে শুনে নেবেন।আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।কিছুদিন ও আপনার কাছেই থাক পড়ে সব দেখছি।
ভাইঝি জামাই বেরিয়ে চলে গেলো সন্ধ্যার আগেই।অন্নপূর্ণাদেবী অনিতার চিঠি পড়ে তো পুরো থ।এই অভাবের সংসারে সবে ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ এনেছেন।খরচ তো বেরেছেই তার উপর সুচন্দা মা হবে। উপরন্তু শমিতার শুধু তো খাওয়া-পরায় নয়; সমত্ত মেয়ে,টুকটাক চাহিদার সাথে পরবর্তীতে বিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন হবে।মুখে কিছু না বললেও চিন্তার পাহাড় তার মাথার মধ্যে গিজগিজ করতে লাগলো।তিনি ছেলে বৌমাদের ডেকে সকলকেই চিঠির সারমর্ম জানিয়ে দিলেন।সকলেই শুধু তার কথা শুনলো কিন্তু কেউ কোন কথায় বললো না।আর বলবেই বা কি শমিতার মান-সম্মানের ব্যাপারটাই তো এখানে মুখ্য।
শমিতা যে এসে দিদির কাছে উঠেছে সেদিনই সঞ্জয়ের মামা জানতে পারলেন।তার ইচ্ছা থাকলেও মেয়েটিকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারলেন না তার অর্ধাঙ্গিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে।অগত্যা শমিতার ঠাঁই হল ঘরের এককোণে তার পিসির পাশেই।
কয়েকটা মাস বেশ ভালোই কাটলো।বৌদির সাথেও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো ঠিক অন্যখানে।পরিবারে কোন মেয়ে ছিল না।অন্নপূর্ণাদেবী সবকিছুই দেখেন সাদা দৃষ্টিতে। শমিতা আসার পরেই সুচন্দার ছোটখাটো দোষত্রুটিগুলিকে এক বিশাল আকার করে পিসি এবং দাদাদের কাছে তুলে ধরতে লাগলো।পরিণাম যা হওয়ার তাই হল। দেওররা আর আগের মত বৌদির সাথে হাসিঠাট্টা,গল্পগুজব করে না।অন্নপূর্ণাদেবীও সুচন্দার কাজকর্মের ভুল ধরতে লাগলেন।
সুখের সংসারে বলতে গেলে অশান্তির ঝড় উঠলো।সঞ্জয়ের মামা সব দেখে শুনে স্থির করলেন মেয়েটিকে তিনি যেভাবে হোক তার বাড়িতেই আশ্রয় দেবেন।তিনি তার স্ত্রীর কথায় এবার কোন পাত্তা না দিয়েই শমিতাকে তার বাড়িতে এনে তুললেন।কারণ দোষে-গুনে সব মানুষ বলেই তিনি পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছিলেন শমিতার দায়িত্ব তার দিদির নয়।জেঠু হিসাবে এ দায়িত্ব সম্পূর্ণই তার।
সুচন্দার সংসারে কিছুটা হলেও শান্তি আসে ঠিকই কিন্তু পরিবারের প্রত্যেকের প্রতি যে একটা আত্মিক টান ছিল তা কিছুটা হলেও কেমন একটা গা ছাড়া ভাব হয়ে দাঁড়ায়।এদিকে সুচন্দা তো তখন প্রেগন্যান্ট।
শমিতার জেঠু ছিলেন খুব কড়া ধাতের মানুষ।তিনি পরিস্কার তার ভাইজিটিকে বলে দিয়েছিলেন,
--- সকলকে নিয়ে থাকতে গেলে একের কথা অন্যকে জানালে সেই সংসারে শান্তি থাকে না,ভালোবাসা থাকে না।উপায়ান্তর না দেখেই অনিতা তোমায় পাঠিয়েছে। কারো দোষ না দেখে মিলেমিশে থাকতে পারলে আখের তোমারই লাভ হবে দেখো।এই একটা কথায় শমিতার তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আমূল পরিবর্তন এনে দেয়।কিন্তু সুচন্দার সাথে তার দেওরদের সেই আগের সম্পর্ক আর ফিরে আসে না।
যথা সময়ে সুচন্দার একটি কন্যা সন্তান হয়।তিন পুরুষ পর সংসারে আবার কন্যা সন্তানের জন্ম।স্বভাবতই বাড়িতে খুশির আমেজ বইতে থাকে।
ভাইদের পড়া তখনো শেষ হয়নি এদিকে মেয়ের পিছনে খরচ।অভাব যেন পরিবারটির থেকে আর পিছু ছাড়ে না।এরই মাঝে একদিন সঞ্জয়ের অফিস কলিগ কাম বন্ধু দীপক সরকার বাড়িতে আসে।প্রথম দিন থেকেই বয়সে অনেক ছোট সুচন্দাকে দেখে বলে,
--- শোনো তুমি কিন্তু ভেবো না তোমায় আমি বৌদি বলে ডাকবো।তুমি বয়সে আমার অনেক ছোট।তুমি আমায় দাদা বলবে আর আমি তোমায় নাম ধরেই ডাকবো।মন খুলে আমার সাথে কথা বলবে।ভাইফোঁটার দিনে তুমি যেখানেই থাকবে আমায় না ডাকলেও চলে যাবো তোমার কাছে ফোঁটা নিতে।সঞ্জয় আমার কলিগ হলেও আজ থেকে ওর প্রধান পরিচয় আমার কাছে ও আমার একমাত্র ভগ্নিপতি।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment