Wednesday, April 20, 2022

ঝরাপাতা (পঁচিশ পর্ব)

ঝরাপাতা (পঁচিশ পর্ব)
   ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস!যে মেয়েটার জন্ম হয়েছিল সোনার চামচ মুখে নিয়ে, রুপেগুনে পড়াশুনায় যে সকলকেই মুগ্ধ করেছিলো। যার স্বপ্ন ছিল খুব ভালোভাবে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার;সবকিছুর মিশেলে যে হাওয়ায় উড়ছিলো কিন্তু একবারও সে ভেবে দেখেনি তার স্বপ্ন, আশা আকাঙ্খা নিয়ে সে যখন মশগুল বিধাতা সেই সময়ে শুধু তার হাতের সুতোটা একটু আলগা করেছিলেন মাত্র!তার জীবনে সবকিছু হারানোর পরেও সে যখন সঞ্জয়ের বউ হয়ে সে বাড়িতে এসেছিলো ;চরম দুঃখ,দারিদ্রের সাথে লড়াই করেও তার জীবনের না পাওয়াগুলিকে একটু একটু করে প্রায় ভুলেই গেছিল সঞ্জয় এবং সেই বাড়ির সকলের ভালোবাসায়।কিন্তু হঠাৎ করেই সঞ্জয়ের চলে যাওয়ায় সুচন্দার জীবনে সময় যেন আবার কিছুটা স্তব্ধ হয়ে গেলো।
  একসময় সুচন্দা তার সমস্ত গায়ের গয়না বিক্রি করে আর কিছুটা ধারদেনা করে নিজেও একটু বাড়ি করেছিলো। হ্যাঁ সঞ্জয়দের নিজেদের বাড়িই ছিল।কিন্তু সে জমির পরিমাণ এতটাই কম ছিল যে বাড়ির মেম্বার অনুযায়ী সকলের একটা করে ঘর হওয়ারও কোন সম্ভাবনা ছিল না।তাই অন্নপূর্ণাদেবী ছেলেদের সাথে পরামর্শ করে শ্বশুরবাড়িটি বিক্রি করে যার যার টাকার পরিমাণ প্রতিটা ছেলের হাতে দিয়ে দেন। যার যেখানে পছন্দ সে সেখানে জমি কেনে।
 সঞ্জয়ের চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা দিন সুচন্দা কেমন থম মেরে গেছিলো।ওই সময় তার মেয়ে,জামাই সব তার সাথেই ছিল।আত্মীয়স্বজন তখন কিছু কিছু আসা যাওয়া করতো।কিন্তু পরবর্তীতে আত্মীয়স্বজনের সমাগম কমতে থাকে।ভায়েরা তো আসেই না।তবে হ্যাঁ পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান হলে দেখা সাক্ষাৎ হলেই গলাগলিতে কোন পক্ষই হার স্বীকার করে না।এক সময় সঞ্জয়কে ছাড়া সুচন্দা একা যে থাকতে পারবে সেটাই কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি।কিন্তু দিব্যি তাকে ছাড়া ছেলেমেয়ে,জামাই,সংসারের দায়িত্ব সবকিছু একলাই সামলাতে পারছে।আসলে মানুষ পরিস্থিতিতে না পড়লে ঠিক বুঝতে পারে না সে কিভাবে কোন পথে তার অভিস্পা লক্ষ্যে পৌঁছাবে।
 সুচন্দার ছেলে সায়ক এখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র।বাবার মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ বছর।সেই বয়সে সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন পরিণত বয়সের এক যুবক।কি অদ্ভুতভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে হাসপাতাল থেকে বারবার ফোন করে মা,দিদির খবর নিয়েছে।কাকাদের ও ভগ্নিপতির সমস্ত কথা শুনে ধীরে, সুস্থে সমস্ত কাজ করেছে।তাকে দেখে তখন কে বলবে যে সে সদ্য পিতৃহারা হয়েছে।বাবার মৃত্যু যেন রাতারাতি তাকে অনেকটা বড় আর পরিণত করে তুলেছে।
 ছন্দা সারাজীবনই খুব গুছানো আর সংসারী মেয়ে।সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ার পর মেয়ে,জামাই চলে গেলো তাদের বাড়ি।মা আর ছেলের সংসার।ছন্দা শুরু করলো পুরোদমে আবার গল্প ,কবিতা লিখতে।এই ভার্চুয়াল জগতের সূত্র ধরে কলকাতা,শিলিগুড়ির অনেক বন্ধুদের আস্তে আস্তে খোঁজ পেতে থাকে।
  এইভাবেই সে একদিন খোঁজ পায় অস্মিতার। অস্মিতার সাথে তখন প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা হয় ;এই কথা প্রসঙ্গেই দোদুলের কথা সব জানতে পারে অস্মিতা।কিন্তু প্রায় দিনপণের বাদেও দোদুল অস্মিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখতে পায় না।এদিকে সুচন্দার সাথেও তার কোন যোগাযোগ নেই।প্রতিটা মুহূর্ত,প্রতিটা ক্ষণ সেই কিশোরী কিংবা যুবতী বয়সের মত দোদুলের জন্য অপেক্ষা! যা একদিন সম্পূর্ণভাবে তার ছিল আজ সবকিছু তার হাতের নাগালের বাইরে।ইচ্ছা করলেই সে দোদুলকে ছুঁতে পারছে না,দেখতে পারছে না।এদিকে সুচন্দাও খুব চিন্তিত তার দাদার খবর না পেয়ে।
 প্রায় কুড়িদিন বাদে সুচন্দা যখন অনেক রাতে তার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দোদুল সুচন্দাকে কল করে।কল রিসিভ করেই তো নানান  অভিযোগের তীর একসাথে সুচন্দা তার দাদার দিকে ছুঁড়ে দেয়।দোদুল চুপ করে শুধু শুনেই যায়।তারপরেই সে অস্মিতার কথা বলে কিন্তু তাতেও দোদুলের কোন ভাবান্তর আসে না।কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে বুঝতে পেরে সুচন্দা বলে,
--- দাদা,তোমার শরীর ঠিক আছে তো?তোমার মধ্যে সেই স্বতস্ফুর্ততা বুঝতে পারছি না।কি হয়েছে তোমার?তুমি অস্মিতার কথা শুনেও তো কোন কিছু বললে না।
 দোদুলের বুক চিরে যেন এক গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো।কিছুটা উদাস হয়েই বললো,
--- কি আর হবে?জীবন তো শেষের পথে --- যা আমার ছিল না তা কোনদিনও আমার হয়নি আর এখন তো কোন প্রশ্নই নেই।
--- দাদা তোমার হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারছি না।আমাকে পরিষ্কার করে বোলো তোমার কি হয়েছে?
 এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে দোদুল তার বোন চন্দাকে বলে,
--- শোন আমার একটা দরকারি ফোন আসছে।আমি পরে তোকে আবার কল করবো।তুই অস্মিতাকে বলে দিস আমি তো ফেসবুক করিনা তাই ওর রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করিনি।একদিন সময় করে ওর সাথে কথা বলে নেবো।তুই বরং ওর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা আমায় সেন্ড কর।
 দোদুল ফোন কেটে দেয়।সুচন্দা ভীষণ অবাক হয়।কি এমন হল।মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে দাদার এত পরিবর্তন হল কি করে? অস্মিতার কথা শুনেও কোন ভাবান্তর নেই।দেখা করতে চাওয়া,ফোন করতে চাওয়া কোন কিছুই বললো না কেন?সারাটা দিন মনের ভিতরে এক অজানা আশঙ্কায় কেটেছে।তাহলে কি দাদার কোন কঠিন অসুখ করেছে?
  সারাদিনে অস্মিতাকে অন দেখতে পায়নি সুচন্দা।বারবার কল করেও কোন রেসপন্স পায়নি অপর প্রান্ত থেকে।সন্ধ্যা হতেই অস্মিতাকে অন দেখেই ফোন করে।ফোন ধরেই অস্মিতা তাকে জানায় সারাটাদিন বোনের শরীর খারাপ থাকায় তাই নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল সে।বোনের কি হয়েছে,বোনকে নিয়ে কোথায় কোথায় গেছে,ডাক্তার বোনকে কি বলেছে এইসব অনর্গল বলে যায় সে।চুপচাপ শোনে সুচন্দা সেসব।কিছুক্ষণ পর অস্মিতা বলে,
--- কি হল ?তুই কথা বলছিস না কেন?এত থম্ মেরে আছিস কেন?
 সুচন্দা তখন আমতা আমতা করতে করতে বলে,
--- তোকে একটা খবর দেওয়ার জন্য ফোন করেছিলাম।সারাটাদিন তুই তো অন হওয়ার সুযোগ পাসনি।আমার ফোনটাও রিসিভ করিসনি।তাই খবরটা দিতে পারিনি।আজ দোদুলদা সকালে ফোন করেছিলো।দাদার সাথে কথা বলে মনেহল দাদা ভালো নেই।কথা বলতে বলতেই ফোনটা কেটে দিলো।তোর কথা বললাম কিন্তু সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্চও করলো না।কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব।
--- আমার কথা শুনে কোন কথা কেন বলবে বলতো ?আমি স্বার্থপরের মত তার জীবনটা শেষ করে দিয়েছি।সারাজীবন পাশে থাকতে চেয়েছিলো অথচ আমি সে পথও বন্ধ করে দিয়েছি।আমি তো ভেবেছিলাম আমি ওকে দূরে সরিয়ে দিলে ও নিজের জীবনটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নেবে।কিন্তু একবারও ভাবিনি আমাকে কষ্ট দিতে ও এইভাবে নিজেকে সবকিছুর থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
--- আমি ওকে তোর নম্বরটা দিয়েছি।তোকে দাদার নম্বরটা দিচ্ছি।তুই অবশ্যই একটা মেসেজ করে রাখবি হোয়াটসঅ্যাপে।কিছু তো একটা দাদার হয়েছেই ।

ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment